post

আফসোস কি মিটবে?

তানজিলুর রহমান লাবীব

১২ অক্টোবর ২০১৬
২০১০ সালে তৎকালীন চবি সভাপতি জাকির হোসেন ভাই তাঁর একটি লেখায় বাকৃবির শহীদ শওকত হোসেন তালুকদার ও শহীদ হাসান জহির ওয়ালিউল্লাহ ভাইকে নিয়ে খুব চমৎকার স্মৃতিচারণ করেছিলেন। শাহাদাতের সুধাপানের সুযোগ না পেলেও কয়েকজন শহীদ ভাইয়ের সাথে পরিচয় ও কাজ করার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন তিনি। লেখাটি পড়ে কিছুটা ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়েছিলাম। আফসোস হচ্ছিলো, কোনো শহীদ ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয় হলো না। মেশার সুযোগ হলো না। বিভিন্ন সময় শহীদ ভাইদের নিয়ে আরো অসংখ্য স্মৃতিকথা পড়ার সুযোগ পেয়েছি, কিন্তু লেখার মতো সুযোগ বা হিম্মত কোনোটাই কখনো হয়নি। ২০১৫ সালের মে মাস, কাশিমপুর কারাগারে এক বিডিআর ছিলেন, মনির ওস্তাদ। বুক বাইন্ডিং দফায় কাজ করতেন। পিলখানার ঘটনায় যে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষের স্বপ্নসাধ ধূলিসাৎ হয়ে গেছে, তিনি তাদের একজন। এক ভাইয়ের একটা বই ধার করে পড়তে গিয়ে ছিঁড়ে ফেললাম। কী বাজে ব্যাপার! কাচুমাচু ভঙ্গিতে বাইন্ডিংখানায় গিয়ে বললাম ওস্তাদ আমার বইটা বাঁধাই করে দেবেন? এভাবেই তাঁর সাথে পরিচয়। জানলাম পিলখানার ঘটনার দিন কোনো কিছু না জেনেও জেল খাটছেন আরও অনেকের মতোই। চরম এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে পথ চলছেন মনির ওস্তাদ। তবে তাঁর মনের কোণে সব সময় স্বপ্ন দোলা খায় ছেলেকে বুয়েটে পড়ানোর। আমাকে পেয়ে তাই খুশি হলেন খুব। বললেন এই জেলখানায় তো বুয়েটের আরেকজন আছেন। অবাক হলাম! আবার কোন হতভাগা? মনির ওস্তাদ বললেন, উনার নাম মাহমুদুর রহমান, আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। দেখা করিয়ে দেয়ার জন্য জিদ ধরলাম। মাহমুদুর রহমান ভিআইপি ডিভিশন সেলে থাকেন। ফাঁকা পেয়ে একদিন তার কাছে নিয়েও গেলেন। মাহমুদুর রহমান থাকতেন শেরেবাংলা হলেই, আমার ঠিক ওপরের রুমে, কেমিক্যালের ছাত্র হওয়ায় ক্লাসও করতেন আমার বিল্ডিংয়েই। খুব মিশুক মানুষ, বুয়েটিয়ান একজন পেয়ে ব্যক্তিগত আলাপই জমিয়ে দিলেন। তার বুয়েট লাইফের কথা, তখনকার স্যারদের কথা। এখন আর বুয়েটের খোঁজ তেমন রাখা হয় না, তাও বললেন। একটা কথা খুব ভালো মনে আছে। বলেছিলেন, তানজিল, সময় মানুষকে কোথায় নিয়ে যায় কেউ বলতে পারে না। বুয়েটে পড়েছি, কখনোই চিন্তা করিনি রাজনীতিবিদ হবো, মন্ত্রী মর্যাদার প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হয়েছিলাম। লেখক হবো ভাবিনি, আমার বই বেস্ট সেলার হয়ে গিয়েছে। ব্যবসায়ী হবো ভাবিনি, সিরামিক শিল্পের বিশাল উদ্যোক্তা হয়ে গিয়েছি। মানুষের ভালোবাসা পাবো ভাবিনি, অথচ দেশের ক্ষুদ্র একটা অংশ ঘৃণা করলেও অর্ধেকের বেশি তরুণের কাছে আইডল হয়ে গিয়েছি। যা পাওয়ার তারচেয়ে অনেক বেশি পেয়ে গেছি। তাই সাহসও বেশি। আর কিছু পাওয়ার নেই, হারাবারও নেই। সবচেয়ে মজার ব্যাপার জেল খাটবো ভাবিনি, সেই আমি কয়েকটা বছর কাটিয়ে দিলাম এখানে। আরেক দিনের একটি ঘটনা- মনির ওস্তাদের কাছে অনেক গুঁড়োদুধের প্যাকেট দেখতে পেলাম। জিজ্ঞেস করলাম এগুলো কী করবেন? বললেন, এই জেলে ধারণার চেয়েও ভালো একজন মানুষ আছেন। আমাদের মতো যেসব হতভাগার এখন পরিবার চালানোর কথা, অথচ জেলখানায় পড়ে আছি, আমাদের অবলম্বন তিনি। অক্ষমদের প্রায়ই এটা ওটা দেন। সামনে রমজান মাস তো, তাই আমাদের সবার জন্য এক প্যাকেট করে দিয়েছেন। দুই দিন পর এক সকালে দেখি মনির ওস্তাদ খুব খুশি। কী ব্যাপার? বললেন স্ত্রীর চিকিৎসা যেন ফ্রি করে দেয় তার জন্য একটা লিখিত নিবো ভেবেছিলাম স্যারের কাছ থেকে। আজ পেয়েছি, সব সময় যাওয়ার সুযোগ হয় না তো! সেদিনও বুঝতে পারিনি কার কথা বলছেন। কয়েকদিন পর বললেন, আজকে স্যারের কাছ থেকে চাকরির একটা সুপারিশ লিখে রাখলাম। দেখি, যদি কখনো বের হতে পারি, কে আর চাকরি দেবে সেই বয়সে। স্যারের সুপারিশে যদি কিছু হয়। কেন? তখন নেবেন! এবার হু হু করে কেঁদে ফেললেন মনির ওস্তাদ। ভাই রে! ততো দিনে লোকটারে যদি ফাঁসি দিয়ে দেয়? এতো দিন খুব একটা আগ্রহ পাইনি। আজ জিজ্ঞাসা করলাম, কে উনি? - মীর কাসেম আলী স্যার। খুব দয়ালু মানুষ। উনি এই জেলে আসার পর কতো মানুষকে যে কতো কিছু দিয়েছেন? এমন মানুষকে দেখার আগ্রহ না জন্মে পারে? কনডেম সেলে কারো সাথে দেখা করা বেশ কঠিন। তার পরও মনির ওস্তাদ ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। ফাঁসির জন্য অপেক্ষমাণ একজন মানুষের চোখে আমি জীবনের হাতছানি দেখেছি, আট ফুট বাই চার ফুট সাইজের একটা সেলে বসেও তাঁকে দেশকে নিয়ে স্বপ্নের খেলা খেলতে দেখেছি। আফসোস, আমাদের দেশের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে যদি এর দশ ভাগের একভাগ দেশপ্রেমও থাকতো! খুব অল্প পরিসরে, স্বল্প সময়ের কথোপকথন আমার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পাথেয়, প্রিয় মুহূর্ত। সেলে কম্বল বিছানো, দুটো টুল, একটা টেবিল আর অসংখ্য বই। Ñ আসসালামু আলাইকুম, স্যার আমি লাবীব। সিদ্দিক জামাল আমার বড় মামা। ওয়াআলাইকুম সালাম। (আমাকে জড়িয়ে ধরলেন বুকের সাথে) এখানে কিভাবে রে ব্যাটা? (আমি মুচকি হাসি দিলাম) ইসলামী আন্দোলন করলে আর কোনো অপরাধ লাগে স্যার! সিদ্দিক জামাল ভাই আমার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সংগঠনের নাম তো উনিই প্রস্তাব করেছিলেন। আমাদের লোগো ডিজাইনেও উনি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছিলেন। আমি বললাম, স্যার নাম প্রস্তাবনার ব্যাপারটা জানতাম, লোগোর কথাটা জানা ছিলো না। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আরো খোঁজ খবর নিলেন। অন্যান্য মামা আর খালুদের কথা জিজ্ঞাসা করলেন। অল্প কয়েক মিনিটেই এত আপন করে নিলেন যেন কতদিনের চেনা। ইসলামী আন্দোলন যে কিভাবে অপরিচিতের দূরত্ব ম্লান করে দেয় ঐদিন নতুন করে আবার উপলব্ধি করলাম। একটু পরেই জমাদ্দার ডাকতে এলো। বিদায়ের সময় চেষ্টা করেও অশ্রু আটকে রাখতে পারলাম না। সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখালেন, এ জন্য নিজেদেরকে আগে প্রস্তুত করতে বললেন। অন্য সব কাজের চেয়ে এই জালিম সরকারের হাত থেকে জনগণকে মুক্তি দেয়ার কাজকে অগ্রাধিকার দিতে বললেন। আর বললেন, “আমাদের আশা ছেড়ে দাও। আল্লাহ আমাদের শাহাদাতের মৃত্যু দিলে এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কিছু হতে পারে না। হতাশা নয়, স্বপ্ন আর ভালোবাসা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।” ঈদের দুই দিন আগে দেখি মনির ওস্তাদ মনের খুশিতে পাঞ্জাবি বিলি করে বেড়াচ্ছেন তার মতো অন্যান্য অসহায়দের মাঝে। স্যারের দেয়া পাঞ্জাবি। ৩ সেপ্টেম্বর ২০১৬তে মীর কাসেম আলীকে অন্যায়ভাবে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে শহীদ করা হয়েছে। কোনো শহীদের সাথে দেখা না হওয়ার আফসোস মিটেছে, সেই সাথে নতুন কিছু আফসোস আরো তীব্র হয়েছে। নিজে শাহাদাতের অমিয় সুধা পান না করতে পারার আফসোস, শহীদের রেখে যাওয়া দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করতে পারার আফসোস, নিজেকে যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে না পারার আফসোস, সমৃদ্ধ ইসলামী সমাজ বিনির্মাণ না করতে পারার আফসোস। এ আফসোসগুলোও যে মেটা দরকার, খুব দরকার! লেখক : শিক্ষার্থী, বুুয়েট

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির