post

‘ইসলামী আন্দোলনের জন্য যা করা দরকার তুমি তাই করেছ’

০৫ ডিসেম্বর ২০১৪

সানোয়ার জাহান (পিয়ারি) #

Shahid-Abdul-Kader-mollaছোটবেলা থেকে সবাই আমাকে ‘পিয়ারি’ বলে ডাকতো। আমাদের অরিজিনাল বাড়ি ছিল মুর্শিদাবাদে। আমার দাদারা জমিদার ছিলেন। আমার আব্বা উচ্চশিক্ষিত ছিলেন। পাকিস্তান হওয়ার পরে কলকাতার চাকরি ছেড়ে পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। ঢাকায় এসে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন। এই সরকারি চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জেলায় ঘুরেছেন। তিনি শেষ বয়সে দিনাজপুরে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে অবসর নেন ও স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। আমার ভালো নাম সানোয়ার জাহান, আমার পিতার নাম মো: মীর নাতেক আলী ও মাতা নূরজাহান বেগম। আমি ইডেন মহিলা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের জনসভায় আমি প্রথম সারিতে অবস্থান নিয়েছিলাম। আমি তখন ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী। আমি ২৩ মার্চ রাত্রে ঢাকা ত্যাগ করি ও কুষ্টিয়ার কুমারখালী চলে যাই। তখন আব্বা সেখানকার সার্কেল অফিসার ছিলেন। সেখানকার আওয়ামী লীগ নেতা কিবরিয়া সাহেব (পরবর্তীতে গচ) সহ অন্যান্য নেতাদের আমাদের বাসায় আনাগোনা ছিল। যুদ্ধ শুরু হলে আমরা কুমারখালী ছেড়ে খোকশা নামক গ্রামের দিকে চলে যাই। মাসখানেক পরে আমরা আবার কুমারখালীতে ফিরে আসি। ওখানে আমরা নানা উপায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করি ও সাহায্য-সহযোগিতা করি। আমার মা মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার সরবরাহ করতেন। স্বাধীনতার যুদ্ধে বিজয় অর্জিত হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা বাসায় এসে উল্লাস করেন ও মিষ্টি বিতরণ করেন। এর কিছুদিন পর আমরা দিনাজপুরে চলে যাই। এরও কিছু দিন পর আমি ইডেন মহিলা কলেজে চলে যাই ও পড়াশুনা অব্যাহত রাখি। আমি ডিগ্রিতে পড়ার সময় ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের এঝ ছিলাম। পরে আমি ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রীদের সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করি। ১৯৭৬ সালে পারিবারিকভাবে আব্দুল কাদের মোল্লার সাথে আমার বিয়ে হয়। তখন আব্দুল কাদের মোল্লা একজন মেধাবী ছাত্র ও লেখক হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। আব্বা দৈনিক ইত্তেফাকে পবিত্র শবে মেরাজের ওপর একটা লেখা পড়ে উনাকে পছন্দ করেন। তখন আব্দুল কাদের মোল্লার নামে কোন যুদ্ধাপরাধ তো দূরের কথা সাধারণ যে কোন অপরাধের জন্যও কোন মামলা /এউ হয়নি। যদি কোন মামলা বা কোন গুজবও থাকতো, তবে আমাদের মতো নামীদামি/ শিক্ষিত পরিবার উনার সাথে আমার বিয়ে দিত না বা আমিও সম্মত হতাম না। পর্দার ব্যাপারে উনি অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। বিয়ের দিনে সুটকেসের ভেতরে আমার জন্য হাত ও পায়ের মোজা দিয়েছিলেন। আমার এক মামা মোজাগুলো দেখে বলেছিলেন ‘এখনই এত কঠোরতা অবলম্বন করছো বাবা’। উত্তরে উনি বলেছিলেন ‘বিড়াল মারলে প্রথম রাতে মারাই ভালো’। আমি প্রথম যখন শ্বশুর বাড়িতে গেলাম, সারা গ্রামের লোকজন ভেঙে পড়েছিলো আমাকে দেখার জন্য। কিন্তু উনি আমার পর্দা রক্ষার জন্য কঠোর ছিলেন। এতে আত্মীয়-স্বজনরা মনক্ষুণœ হলেও উনি তার পরোয়া করেননি। আমার স্বামী আব্দুল কাদের মোল্লা ১৯৭৯ সালে জামায়াতে যোগ দেন। এরপর তিনি দৈনিক সংগ্রামে সাংবাদিকতা শুরু করেন। তিনি ১৯৮২-৮৩ সালে পরপর দুইবার ঢাকা ফেডারেশন সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচিত সহসভাপতি ছিলেন। ঐ সময় ইকবাল সোবহান চৌধুরীসহ প্রথিতযশা সাংবাদিকদের সাথে তিনি আড্ডা দিতেন প্রেস ক্লাবে। এই সময় সাংবাদিকরা নানা ফান্ডের টাকা তাকে দিত ও পরে তিনি ফেরত দিতেন। তাঁর সততার ব্যাপারে কেউ কোনদিন প্রশ্ন তুলতে পারেননি। সবাই তাকে বিশ্বাস করতেন। ১৯৮৬ সালে এরশাদের শাসনামলে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রাখার কারণে গ্রেফতার হন। পরে গণ-আন্দোলনের মুখে সরকার তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ১৯৯১ সালে তিনি জামায়াতের ঢাকা মহানগরীর আমীর হন। এরপর ১৯৯৬ সালে তিনি কেয়ারটেকার সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদের সাথে গ্রেফতার হন। কিছুদিন পরই তিনি জেল থেকে ছাড়া পান। ঐ সময় তিনি আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিম, ব্যারিস্টার আবদুস সামাদ আজাদ, জাতীয় পার্টির নেতা আনোয়ার হোসেন মঞ্জুসহ অনেকের সাথে লিয়াজোঁ কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। পরে তিনি জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হন। এই সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি কখনোই যুদ্ধাপরাধী অথবা অন্য কোন মামলার অপরাধী এই কথা কেউ বলতে পারেনি। খুন, ধর্ষণ, লুটতরাজ ইত্যাদি জঘন্য সব অভিযোগ বা অভিযোগের গুজব কখনোই উনার নামে ছিল না। আমার স্বামী আব্দুল কাদের মোল্লা সব সময় সৎ ছিলেন। হালাল রুজি-রোজগার ব্যাপারে উনি অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। উনার চাওয়া-পাওয়া অত্যন্ত সীমিত ছিল, অল্পেই তুষ্ট থাকতেন। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে উনার কোন চাহিদা ছিল না। সারাদিন উনি নানা কাজে ব্যস্ত থাকলেও রাত্রে এসে ছেলেমেয়েদের খোঁজ-খবর নিতেন। আমার প্রথম সন্তান হওয়ার পর উনি প্রোগ্রাম করে বাসায় এসে বাচ্চাকে ধরে রাখতেন। এমনকি পেসাব-পায়খানাও করিয়ে দিতেন। বাচ্চাদেরকে ঘাড়ে করে উনি ঘুরে বেড়াতেন। উনি নিজের কাজ নিজে করতে পছন্দ করতেন। সেলাই করা থেকে শুরু করে কাপড় ধোয়া, উনি নিজে করতে চাইতেন বা করতেন। উনার যত কাজই থাক, কুরআন তেলাওয়াত ও হাদিস না পড়ে সাধারণত ঘুমাতেন না। স্ত্রী হিসেবে তিনি কখনো আমার অমর্যাদা করেননি। ছেলেমেয়েসহ আমাদের প্রায়ই কুরআন-হাদিসের আলোকে শিক্ষাদান করতেন। সব সময় সত্যের ওপর থাকার জন্য তিনি জোর করতেন। আমার স্বামী যন্ত্রের মতো কাজ করেছেন। বিয়ের পর থেকে আমি দেখেছি উনি নিরলসভাবে সংগঠনের জন্য কাজ করেছেন। যখনই কেউ কোন মিটিং বা প্রোগ্রামের জন্য ডেকেছে, উনি ছুটে গেছেন। ইসলামী আন্দোলনের প্রয়োজনে যখন যেখানে প্রয়োজন তিনি গিয়েছেন। আমার ছোট ছেলে মওদুদ হওয়ার দিন উনার কিশোরগঞ্জে প্রোগ্রাম ছিলো। উনি আমাকে বললেন যে, আমার তো জরুরি প্রোগ্রাম আছে। আমি চলে গেলে তুমি ম্যানেজ করে নিতে পারবে কি না, আমি বললাম পারবো। উনি চলে গেলেন কিশোরগঞ্জ। পরের দিন এসে তিনি মওদুদের মুখ দেখলেন। ব্যবসায়ী, কূটনীতিক, শিক্ষক, সাংবাদিক, সরকারি কর্মকর্তাসহ সব মহলে উনার গ্রহণযোগ্যতা ও অবাধ যাতায়াত ছিলো। উনার বুক ভরা সাহস ছিলো। সত্য কথা বলতে তিনি দ্বিধা করতেন না। তিনি অত্যন্ত রসিক লোক ছিলেন। নানা গল্প-কৌতুকে রসময় কথায় আসর মাত করে রাখতেন। এই জন্য বিভিন্ন মহলে উনার ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিলো। সম্ভব হলে উনি আমাকে ও বাচ্চাদেরকে বেড়াতে নিয়ে যেতেন। উনার বিভিন্ন জেলায় নানা কর্মসূচি থাকতো। উনি সম্ভব হলে আমাকে নিয়ে যেতেন। বাসার কাজের মানুষের ব্যাপারে তিনি সহৃদয় ছিলেন। তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করার জন্য বলতেন। আত্মীয়-স্বজন আসলে তাদের আদর-যতœ করার জন্য বলতেন। তিনি নানা সামাজিক সংস্থার সাথে যুক্ত ছিলেন। মাদরাসা, এতিমখানা, স্কুল, কলেজ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন। জেলখানায় শেষ দু’টি দেখায় উনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আমি ইসলামী আন্দোলন করার কারণে তোমাকে যতটুকু সময় প্রয়োজন ছিল দিতে পারিনি। ছেলেমেয়েদের সব ইচ্ছে পূরণ করতে পারিনি। আমাকে ক্ষমা করো।’ আমি উত্তরে বলেছি, প্রশ্নই আসে না ক্ষমা করার। ইসলামী আন্দোলনের জন্য যা করা দরকার তুমি তাই করেছ। আমি বরং সাংসারিক প্রয়োজনে তোমাকে বিরক্ত করেছি। কারণে-অকারণে নানা প্রয়োজনের কথা বলেছি। উত্তরে তিনি বলেন, তোমরা সর্বাবস্থায় আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রাখবে ও ধৈর্য ধরবে। যেদিন উনার ফাঁসি হয় সেদিন সাক্ষাতে উনি আমাকে বলেনÑ ‘বাকি ছেলেমেয়ের বিয়ে দিয়ে দিবে। পারিবারিক সকল দায়িত্ব পালন শেষে আল্লাহ যেন তোমাকে দ্রুত আমার কাছে নিয়ে আসেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা ব্যক্তিগতভাবে কোন প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করবে না। ইসলামী আন্দোলন এ দেশে প্রতিষ্ঠা ও বিজয়ী হওয়ার মাধ্যমে আমার প্রতি যে অন্যায় করা হয়েছে, তার বদলা হবে। একমাত্র ইসলামকে এ দেশে জয়ী করেই ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা আমার প্রতি ফোঁটা রক্তের প্রতিশোধ নেবে। এটা সবাইকে বলে দিও।’ তিনি আরও বলেন, ‘হালাল রোজগারের মাধ্যমে জীবন ধারণ করবা। হালাল রোজগারে কেউ কখনও না খেয়ে মরে না। আর কারও হারাম রোজগারের গাড়ি-বাড়ি দেখে আফসোস করবা না। এটা আল্লাহ তায়ালার খুবই অপছন্দ।’ ‘ইনশাআল্লাহ তোমাদের সাথে আমার জান্নাতের সিঁড়িতে দেখা হবে।’ লেখক : শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার সহধর্মিণী

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির