post

খাদ্যনিরাপত্তা ও ইসলাম

২৫ মার্চ ২০১২
ড. মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম ইসলামী জীবনব্যবস্থার মূল উদ্দেশ্য হলো মানবকল্যাণ। ইসলামী শরিয়তের সকল প্রকার আইন-কানুন ও বিধি-নিষেধের লক্ষ্যই হলো মানুষের জন্য সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করা। কল্যাণের ইসলামী পরিভাষা হচ্ছে ফালাহ। ফালাহ (Falah) বা কল্যাণ শব্দটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ফালাহ শব্দটি এবং এর থেকে উদগত শব্দ পবিত্র কুরআনে ৪০ বার ব্যবহার করা হয়েছে। আর একটি শব্দ পাউজ বা ফালাহ শব্দটির সমার্থক এবং এর থেকে উদগত শব্দ পবিত্র কুরআনে ২৯ বার ব্যবহৃত হয়েছে। ইসলাম ব্যক্তি-মানুষের কল্যাণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এক ব্যাপক, ভিন্নধর্মী ও ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনৈতিক প্রস্তাবনা পেশ করে। ইসলামের উদ্দেশ্যকে ড. এম ওমর চাপরা বর্ণনা করেছেন মাকসিদ আল শরিয়াহ হিসেবে, যা শরিয়াতের সীমার মধ্যে থেকে ‘ফালাহ’ বা কল্যাণ আহরণ এবং ‘হায়াতে তাইয়্যেবা’ বা পবিত্র জীবন বাস্তবায়নের জন্য যা কিছু করা প্রয়োজন তার সবকিছুকে অন্তর্ভুক্ত করে। এটি হচ্ছে সেই লক্ষ্য যার দিকে প্রতিদিন মুুয়াজ্জিন পাঁচবার বিশ্ববাসীকে আহ্বান করে থাকেন। এভাবে ইসলামের বিশ্বজনীন দৃষ্টিতে ফালাহ এর প্রতি গুরুত্ব প্রদর্শন করা হয়। “মানবজাতির জন্য আশীর্বাদ হওয়া ইসলামী জীবনব্যবস্থার চূড়ান্ত লক্ষ্য। এটিই হচ্ছে প্রধান লক্ষ্য যার জন্য মহানবী (সা) কে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে।” (২১ : সূরা আম্বিয়া : ১০৭) বর্ণ, বংশ, বয়স, লিঙ্গ বা জাতীয়তা নির্বিশেষে দুনিয়ার সকল মানুষের ‘ফালাহ’ বা সত্যিকার মঙ্গল নিশ্চিত করা এই লক্ষ্য অর্জনের একটি অন্যতম অপরিহার্য পন্থা। শুধুমাত্র ইসলামী সমাজই নয় বরং সব সমাজের লক্ষ্যই হচ্ছে ফালাহ। কথাটি অবশ্যই সত্যি, কেননা, দুনিয়ার সব সমাজের মধ্যে এ ব্যাপারে কোনো মতপার্থক্য নেই বললেই চলে যে উন্নয়নের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘ফালাহ’ বা মানুষের মঙ্গল বিধান করা। তবে ফালাহ বা কল্যাণের সংজ্ঞা, উপাদান ও সেটা অর্জনের কৌশল সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি এবং বর্তমান দুনিয়ার অর্থনৈতিক মতবাদসমূহের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। সুষ্ঠু ও সুন্দর জীবন পরিচালনার জন্য ইসলাম স্পষ্ট পথনির্দেশ দিয়ে থাকে। এ পথনির্দেশ পাওয়া যায় জাগতিক ও আধ্যাত্মিক জীবনের সকল পর্যায়ে এবং সমস্ত কাজকর্মের ক্ষেত্রে। এমনকি অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ক্ষেত্রেও। আরবি ফালাহ শব্দটি এসেছে আফলাহা, ইউফলিহু থেকে যার অর্থ হচ্ছে সমৃদ্ধি অর্জন করা, উন্নতি করা, সুখী হওয়া, কৃতকার্য হওয়া । আল্লামা রাগিব ইস্পাহানির মতে ‘ফালাহ’ শব্দ পার্থিব জীবনের জন্য তিন অর্থ তুলে ধরে। যথা- ১.    বাকা (Survival)- বেঁচে থাকা। ২.    ঘ্যানা (Freedom of want)- অভাব থেকে মুক্তি। ৩.    ইজ্জ (Power and Honour)- ক্ষমতা ও সম্মান। আর আখিরাতের অনন্ত জীবনের জন্য ‘ফালাহ’র চারটি অর্থ হচ্ছে- ১.    বাকা বিল ফানাহ ফানাহ (Eternal survival)- অনন্ত জীবন সত্তাকে সার্থক করা ২.    ঘ্যানা বিল ফকর (Eternal prosperity)- অনন্ত সমৃদ্ধি ৩.    ইজ্জ বিল দুউল (Everlasting Glory)- চিরস্থায়ী সম্মান ৪.    ইলম বিল জাহেল (Knowledge free from all Ignorance)- অজ্ঞতামুক্ত জ্ঞান। ড. শেখ মকসুদ আল ফালাহর তিনটি অর্থ করেছেন- ক.    অপরের সুখ কামনা করা (Wish happiness) খ.    অন্যের সুখে সুখী হওয়া (Share happiness) গ.    অপরের দুঃখ কষ্ট ভাগ করে নেয়া (Share Sufferings) কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী মানবজীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে পরকালের অনন্ত অসীম জীবনে কল্যাণ অর্থাৎ ফালাহ (Falah) লাভ করা। ইসলামী অর্থনীতির প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে মানবকল্যাণ। ইসলামের জরুরিয়াত তত্ত্ব ও খাদ্যনিরাপত্তা ইসলামে জরুরিয়াত বা মৌলিক প্রয়োজন হচ্ছে ৬টি। যথা- ১.    দ্বীন/আকিদা (protection of faith, Deen, Ideology) : ঈমান, দ্বীন, আদর্শ। ২.    নফস Nafs (Life itself/ Protection of life)  : ত্বয়ামুন- খাদ্য, লেবাসুন- বস্ত্র, মাকানুন- বাসস্থান, মুয়ালিজ- চিকিৎসা, ইয়ানকালুন- পরিবহন , মুহিতুন- পরিবেশ, আল ইসতিরাহাতুন- বিশ্রাম, অবসর, বিশুদ্ধ পানীয়, যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ পাওয়া, শান্তি, স্বস্তি, নিরাপত্তা ইত্যাদি সব মানুষের জীবন ধারনের সাথে সম্পৃক্ত। ৩.    নসল (Nasal/Family Formation/ Protection of Posterity) : পরিবার গঠনের ক্ষমতা, বংশধারণ, সংরক্ষণ করা। ৪.    আকল/Aql (Intellect/Reason) : শিক্ষা, বুদ্ধিমত্তা। ৫.    মাল/Mal (Property, Wealth) : ন্যূনতম পরিমাণ সম্পদ থাকা এবং তা সংরক্ষণ করা। ৬.    হুররিয়াত / Hurriat / Freedom: স্বাধীনতা। নিরাপত্তা নিরাপত্তা শব্দের অর্থ বিপদ আপদ হতে নিরাপদ রাখার ব্যবস্থা। নিরাপত্তা মানবজীবনের জন্য অপরিহার্য। নিরাপত্তা না থাকলে কোনো সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে উঠতে ও বিকাশ লাভ করকে পারে না। ইসলাম তাই জননিরাপত্তা চায়। ইসলামের এক অর্থ শান্তি অর্থাৎ ইসলাম এমন এক জীবনব্যবস্থা যেখানে নিরাপত্তাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ইসলাম নিরাপত্তা চায় বলেই যেসব উপাদান নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করতে পারে তা হারাম করেছে। খাদ্যনিরাপত্তা খাদ্য ইসলামে জরুরিয়াত হিসেবে স্বীকৃত। খাদ্যনিরাপত্তা তাই ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রতিটি মানুষের জন্য তিন বেলা খাবার পাওয়ার নিশ্চয়তা দেয়াই হলো খাদ্যনিরাপত্তা। খাদ্যনিরাপত্তা মানে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া, খাদ্য ঘাটতি না থাকা বা খাদ্য সমস্যা না থাকা বা খাদ্য সঙ্কট সৃষ্টি না হওয়া। খাদ্যনিরাপত্তা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পরিব্যাপ্ত। ব্যক্তির খাদ্যনিরাপত্তা, পরিবারের সকল সদস্যের খাদ্যনিরাপত্তা, জাতীয় খাদ্যনিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে খাদ্যনিরাপত্তা তথা দেশে দেশে বসবাসরত বিশ্বপরিবারে সকল সদস্যের খাদ্যনিরাপত্তা। খাদ্যনিরাপত্তা বহুমাত্রিক বিষয়। খাদ্যের স্থানীয় উৎপাদন, অভ্যন্তরীণ সংগ্রহ, আমদানির মাধ্যমে বৈদেশিক উৎস থেকে সংগ্রহ এবং ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার (purchasing power) ওপর নির্ভর করে। ক্ষুধা মানবেতিহাসের মত পুরনো সমস্যা। ক্ষুধা-খাদ্যহীনতা ও পুষ্টিহীনতা এবং খাদ্যপ্রাপ্তির অনিশ্চয়তা একটি দেশের উন্নয়নকে ব্যাহত করে। মহান আল্লাহ না খাইয়ে রাখার জন্য তাঁর বান্দাহদের এ দুনিয়ায় প্রেরণ করেননি। প্রতিটি মানুষ আল্লাহর পরিবারের সদস্য হিসেবে খাদ্যনিরাপত্তা পাবে, খাদ্যের অভাব থেকে নিরাপদ থাকবেÑ এটাই আল্লাহ তায়ালা চান। আল্লাহর সৃষ্ট প্রতিটি প্রাণীই খাদ্যনিরাপত্তা ভোগ করে। তবে মানুষের ক্ষেত্রেই এর ব্যতিক্রম দেখা যায়। সেটি মানবীয় ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কারণেই। কেউ খাবার আটলান্টিক মহাসাগরে ফেলে দেয় আর বিশ্বের দেশে দেশে লক্ষ কোটি বনি আদম ক্ষুধা আর দুর্ভিক্ষের কবলে পতিত হয়। সেখানে খাদ্যের অভাবে হাহাকার ওঠে। বহুজাতিক কোম্পানিসমূহের বাজার নিয়ন্ত্রণ ও শোষণমূলক মনোভঙ্গির কারণে বিশ্বে খাদ্যচাহিদার চাইতে বেশি খাদ্য উৎপাদন হলেও বর্তমান বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, বিশ্ব বাণিজ্যসংস্থা (WTO) বিভিন্নভাবে বিশ্বে খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য বিপণের ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে রেখেছে। এ জন্য বিভিন্ন চুক্তির ফাঁদ তৈরি করা হয়েছে। চুক্তিগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে GATT, TATT, TRIPS, TRIMS প্রভৃতি। এসব চুক্তির ফলে কৃষিক্ষেত্রে বহু প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর আগ্রাসনের ফলে কৃষকরা বীজের ওপর তাদের অধিকার হারিয়েছেন। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো তাদের বিক্রীত (জিএমও) বীজ ও বাণিজ্যিক বীজ বাংলাদেশে প্রবর্তনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। কৃষকের সর্বনাশ সাধনের জন্যই বাংলাদেশে বহুজাতিক কোম্পানি এবং তাদের পোষ্য এক শ্রেণীর দালাল বাংলাদেশের কৃষিকে ধ্বংস করে দেশকে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার দিকে ঠেলে দেয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। খাদ্যনিরাপত্তা বিঘিœত হচ্ছে কেন মহান আল্লাহ বলেন, “আমি তোমাদেরকে পৃথিবীতে ঠাঁই দিয়েছি এবং তোমাদের জীবিকা নির্দিষ্ট করে দিয়েছি।” (সূরা আল আরাফ : ১০) “তিনিই তোমাদের জন্য জমিনকে বাসযোগ্য করে দিয়েছেন। অতএব তোমরা তার দিকদিগন্তে ছড়িয়ে পড় এবং তার দেয়া আহার্য গ্রহণ কর। পুনরুত্থানতো তাঁরই নিকট।” (৬৭ : সূরা আল মূলক : ১৫) এই পৃথিবীতে বসবাসকারী সকল মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা দান ও স্বয়ংসম্পূর্ণ করার ক্ষমতা পৃথিবীর আছে। এটি আগেই বলা হয়েছে বণ্টন স্বত্বাধিকার সমস্যা, খাদ্য নিয়ে রাজনীতির কারণে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা উদ্বিগ্ন হারে বেড়েই চলেছে। দরিদ্র জনগণ খাদ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। বর্তমানে খাদ্যের নিয়ন্ত্রণ বড় বড় ব্যবসায়ীদের হাতে, বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। দেশে দেশে দরিদ্র জনগণের খাদ্যপ্রাপ্তি এখন সম্পূর্ণ বাজারের ওপর নির্ভরশীল এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ও বিধিবিধানের  মার-প্যাঁচে বাঁধা। দ্রুত বেড়ে যাওয়া খাদ্যমূল্যের কারণে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ আরো গভীরতর দারিদ্র্যে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। আকাশছোঁয়া খাদ্যমূল্যে মিসর, ইয়েমেন, ক্যামেরুন, আইভরি কোস্ট, বুরকিনা ফাশো, মরোক্কা, মৌরিতানিয়া, গিনি, সেনেগাল, হাইতি, মেক্সিকো, উজবেকিস্তান, ইথিওপিয়া, মাদাগাস্কার, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়ার ক্ষুব্ধ জনগণকে প্রতিবাদে ফেটে পড়তে দেখা গেছে। বর্তমানে বাংলাদেশসহ ৩৭টি দেশ খাদ্যসঙ্কট মোকাবেলা করছে। বিশ্বব্যাংকের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিক বলেছেন, পরিস্থিতি খুব ভয়াবহ। বিশ্বের ক্ষুধার্ত মানুষগুলোকে খাদ্যনিরাপত্তা দেয়ার জন্য অর্থের জোগান দেয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। ইউনেস্কো বলেছে, ২০০৭ সালের মার্চের পর থেকে সয়াবিনের দাম ৮৭ শতাংশ ও গমের দাম ১৩০ শতাংশ বেড়েছে। একই সালে এই সময়টিতেই বিশ্বের খাদ্যমজুদ সর্বনিম্ন স্তরে নেমে গেছে। এর কারণ বহুবিধ। কয়েকটি কারণ নিম্নরূপ : বায়োফুয়েল উৎপাদন : বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ খাদ্যসঙ্কটের মুখে তৈরি হচ্ছে বায়োফুয়েল। ২০০৬ সাল থেকে মিলিয়ন হেক্টর জমি আগে যেখানে কর্ন, গম এবং অন্যান্য শস্য উৎপাদন হতো, এখন তা বায়োফুয়েল উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। বহু পর্যবেক্ষক সম্প্রতি সাবধান করে দিয়েছেন যে, বায়োফুয়েল তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় ফসল উৎপাদনের গরজে উর্বর জমি ব্যবহার করার কারণে খাদ্যশস্য উৎপাদনযোগ্য জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। এর ফলে খাদ্যসরবরাহ কমছে এবং দাম বেড়ে যাচ্ছে। রাইট টু ফুড বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ সংযোগকারী জঁাঁ ডিয়েগলান জার্মান রেডিওতে বক্তৃতাকালে বায়োফুয়েল উৎপাদন বৃদ্ধির সাম্প্রতিক তৎপরতাকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক খাদ্যমূল্যের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। বার্তা সংস্থা ইসলাম অনলাইনের খবরে বলা হয়, গত বছর শেষের দিকে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বক্তৃতায় ডিয়েগলান খাদ্যঘাটতি মোকাবেলার জন্য বায়োফুয়েল তৈরির সব ধরনের উদ্যোগের ওপর পাঁচ বছর মেয়াদি নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেদিন বায়োফুয়েল উৎপাদনে উদ্যোগী ব্রাজিল ও কলম্বিয়ার মতো দেশগুলোর কূটনীতিকরা তার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। বায়োফুয়েল উৎপাদনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক বিতর্কের কেন্দ্র্রবিন্দুতে রয়েছে। এর ফলে বিশ্বের খাদ্যসঙ্কট সৃষ্টি হচ্ছে। বায়োডিজেল কিংবা বায়োইথানল বা অন্যান্য কিছু তৈরি করা হোক না কেন জ্বালানি উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবে খাদ্যদ্রব্যের ব্যবহার বর্তমানে বৈশ্বিক প্রপঞ্চ হিসেবে হাজির হচ্ছে। এ বিষয়টি দানাদার খাদ্যসহ পামওয়েল কাসাভা পর্যন্ত সবকিছুর ওপর প্রভাব ফেলছে। পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষ না খেয়ে থাকবে আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, ভারত খাদ্যনিরাপত্তা বিঘিœত করে জৈব জ্বালানি ব্যবহার করে গাড়ি হাঁকাবে, বিমানে চড়ার উচ্চাভিলাষী স্বপ্নে বিভোর থাকবে। আবহাওয়া পরিবর্তন : আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণেও খাদ্যসঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। সম্প্রতি খারাপ আবহাওয়ার কারণে চাষাবাদ খুবই ব্যাহত হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া এবং আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে খরা, পশ্চিম আফ্রিকায় বন্যা, ভারতে বন্যা, বাংলাদেশে বন্যা ও প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়, সিডরের আঘাত, মিয়ানমারে ঘূর্ণিঝড় নার্গিসের তাণ্ডব, চীন এবং ইউরোপে হিম শীতল আবহাওয়া ফসলের অনেক ক্ষতি করেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় শস্য উৎপাদনকারী দেশ অস্ট্রেলিয়ায় খরার ফলশ্রুতিতে গম উৎপাদন ৬০ ভাগ কম হয়েছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে অতিরিক্ত তাপ প্রবাহে খাদ্যশস্য নষ্ট হয়ে যাওয়া, ধ্বংসাত্মক ঝড়-ঝাপটার ফলে নষ্ট হওয়া, বন্যায় আচমকা ফসল ডুবে গিয়ে নষ্ট হওয়া এখন প্রায় প্রতি বছরই নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি : খাদ্যশস্যের দাম রকেটের গতিতে বাড়ার অন্যতম কারণ জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি। অতি সম্প্রতি প্রতি ব্যারেল অশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ১৩২ ডলারে পৌঁছে গেছে। খাদ্য উৎপাদনের মূলে রয়েছে এই জ্বালানি তেল। তেলের দাম বাড়লে সারের দাম বাড়ে, বেড়ে যায় পরিবহন খরচ। সার্বিক বিচারে কৃষির খরচ বেড়ে যায়। তেলের দাম বাড়ার সাথে সাথে শুধু খাদ্যদ্রব্য নয়, সব রকম পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। খাদ্য রফতানি কমিয়ে ফেলা : ভারত এবং থাইল্যান্ড চালের মূল্য বাড়িয়ে দিয়েছে এবং অভ্যন্তরীণ খাদ্যচাহিদা মোকাবেলার জন্য চাল রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে। ভিয়েতনাম, মিয়ানমার এবং কম্বোডিয়াও একই পথ অনুসরণ করেছে। বর্তমান বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ গম উৎপাদনকারী দেশ কাজাকস্তান নিজস্ব খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য গম রফতানি কমিয়ে দিয়েছে। খাদ্য চাহিদা বৃদ্ধি : বিগত পঁচিশ বছরের মধ্যে বিশ্ব খাদ্য মজুদ সর্বনিম্ন স্তরে নেমে আসার অন্যতম কারণ হলো চীন ও ভারতে খাদ্যচাহিদা বৃদ্ধি। খাদ্য নিরাপত্তা ও বাংলাদেশ বিগত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশে ন্যূনতম খাদ্য আমদানি করে ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্যচাহিদা সফলভাবে পূরণ করে আসছে। এমনকি একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশ থেকে খাদ্য রফতানি হতো। ২০০৬-০৭ সালে পরপর তিনটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেশে আঘাত হানার ফলে সৃষ্ট ফসলের ক্ষয়ক্ষতির কারণে এবং বিশ্বব্যাপী খাদ্যঘাটতির ফলে পরস্থিতি খারাপ হয়েছে। এটা খুবই স্পষ্ট যে এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাদ্যঘাটতি মোকাবেলায় আমদানির কৌশল গ্রহণ করা শুধু যে ঝামেলাপূর্ণ নয়, ব্যয়বহুলও বটে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। খাদ্য সারপ্লাস দেশগুলো খাদ্য রফতানি করবে না। তাদের জাতীয় স্বার্থেই তা করবে না। এ জন্য দেশের প্রতি ইঞ্চি ভূমির সর্বাধুনিক ব্যবহার করতে হবে। মহান আল্লাহর অপরিসীম রহমতে এবং বান্দাহদের চেষ্টায় ইরি-বোরোর বাম্পার ফলন সম্ভব হয়েছে। কৃষকের মুখে হাসি ফুটেছে। গ্রামীণ অর্থনীতি আবার শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে বিশ্বের চতুর্থ খাদ্য উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের নিজস্ব প্রয়োজন  মেটানোর সব রকম দক্ষতা এবং সম্ভাবনা রয়েছে। কৃষি খাতের পুনর্জাগরণ এবং খাদ্যনিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ এবং সরকারি বিনিয়োগ পদ্ধতিতে গতিশীলতা আনয়ন। বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তার জন্য একটি মাস্টার প্লান প্রয়োজন। সেখানে কৃষি গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত বিনিয়োগ, কৃষকদের খাদ্যশস্য উৎপাদনে উৎসাহ প্রদান, যথোপযুক্ত ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণ এবং কৃষি খাতের আধুনিকায়নসহ অন্যান্য বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এটি আশা করা যায় যে, সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে বাংলাদেশ ভবিষ্যৎ প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য উৎপাদন করতে সক্ষম হবে যা অনাগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের জনগণের খাদ্যদ্রব্যের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে পারবে। বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রতিটি ফসলের উৎপাদন ফলন বৃদ্ধির বিকল্প কিছু নেই। এ জন্য ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষিদের একত্রিত করে সমন্বিত খামার গড়ে তোলা, হাইব্রিড বীজ উৎপাদনে স্বনির্ভরতা নীতি গ্রহণ, লবণাক্ততা সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবন, বোরো আমন মৌসুমের মাঝামাঝি তেল ও ডাল ফসলের চাষাবাদ এবং পানি বা সেচ কম প্রয়োজন হয় এমন ফসলের জাত উদ্ভাবনে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। লেখক : বিশিষ্ট ব্যাংকার ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির