post

ফারছী

বাঙালায় লেখা পুথি সাহিত্যের অকথিত ইতিহাস

০৯ মার্চ ২০১৫

[পুথি সাহিত্যই বাঙালির জাতীয় সাহিত্য]

ডক্টর এস এম লুৎফর রহমান

[দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব] csআমি লোকের খাহেস দেখে ঐ কেতাবের এক কপি তালাস করে পাই। সে কেতাবের তেছরা জেলেদের বেশির ভাগ পোকা-মাকড় কেটে ফেলায় তা আমি মুনসী মহম্মদ মুছা ছাহেবেকে দিয়ে আবার সংশোধন করিয়ে বহু অর্থ ব্যয়ে এ কেতাব ছাপালাম। এ বিষয়ে মুনসী মহম্মদ মুছার কোন বক্তব্য মেলে নি। কেতাব খানির চৌঠা জেলেদে শুরুতে কবি জোনাবালি লিখেছেনÑ ‘শামের তামাম দেশ রুমের সহর।। ফতে করিলেন যত মমিন লস্কর। ফতুহো স্বামের বিচে লেখা যাহা ছিল।। মুনসী আজিমদ্দি তাহা তরজমা করিল। মুনসী তাজদ্দিন মহাম্মদ নেককার।। তরজমা দোরস্ত চাহি করিয়া তাহার। পহেলা দপ্তর কেচ্ছা দিল ছাপাইয়া।। মমিন খোসাল হৈল পড়িয়া শুনিয়া। আর বাকি কেচ্ছা যাহা ফুতুহ শ্বামের।। তরজমা করিয়া দেই আল্লাহর মেহের। ফুতহোল মেছের বিচে যেসব লড়াই।। যেরূপে করি ফতে মমিন ছেপাই। লড়িল যতেক গাজি পিয়ারা রছুল।। হয়েছে না হবে কেচ্ছা যার সমতুল। সে কেতাব আমি এই অনেরে দিয়া।। কহিলেন দেহ তুমি তরজাম করিয়া। এ থকে জানা যায় মুনসী মোহাম্মদ তাজদ্দিন তাঁর জামাই ও তাঁর ভাই তিন জন প্রকাশক-ই মশহুর (বিশ্ব বিখ্যাত) আরবীয় ঐতিহাসিক ওয়াকেদী রহমাতুল্লাহ আলায়হেরÑ আরবীতে লেখাÑ ‘ফতুহ- শ্বাম ও ফতুহল মেছেরের উরদু থেকে বাঙালীয় তরজমা করিয়েছেন। এভাবে, কাজী সাফিউদ্দনি গং কেতাব লেখাবার জন্য যোগ্য কবিদের খুঁজেছেন। তাদের টাকা কড়ি দিয়েছেন। আবার ছাপার প্রচুর খরচও তাঁরা বহন করেছেন। আবার এসব কবি ও প্রকাশকদের উদ্দেশ্য ছিলো জনকল্যাণ। কবি মোহাম্মাদ খাতেরেরও প্রেস ছিল। তিনি নিজেও ছিলেন অতি উঁচু মানের কবি। প্রকাশক হিসেবে খ্যাতি ছিলÑ তারও । তিনি ছিলেন অন্য কবিদেরর পৃষ্ঠপোষক। এতো গেল বটতলার প্রকাশকদের কথা। এবার প্রকাশক না হয়েও সাধারণ মানুষ কিভাবে পুথির কবিদের উৎসাহ দিয়েছেন তা দেখা যেতে পারে। ১০. পুথি-কেতাবের প্রতি জনগণের জাতীয় আগ্রহ মহাম্মদ তাজিম নামের জনৈক অখ্যাত কবির কেতাবের নাম ‘মাহতাব ও গোলে লাল’ কাব্য রচনার উৎস জানাতে ঐ কবি লিখেছেনÑ ‘জদি কিছু মন্দ মোরে না বলে শুনিয়া।। পদবন্দে বলি কিছু জোটনা করিয়া। নিজ বাড়ী ছেড়ে আমি ভ্রমি নানা দেশ।। দিয়ড় গ্রামেতে আমি হইনু প্রবশে। কাদির মন্ডল নামে মহত তথায়।। নিযুক্ত হইয়া থাকি তাহার আলয়। ধার্মিক সংজ্ঞান তিনি অতি সুভাহল।। ফকির বৈঞ্চচ বিনে অন্য নাহি মন। সেই খানে থাকি আমি করিয়া নিবাস।। মানিক সরকার নাম চক্র পুরে বাস। মঙ্গলের বাসে সেহ থাকে নিরন্তন।। একদিন কেচ্ছা এক কহিল সুন্দর। শুনিতে সুধার সখ প্রস্তাব অনেক।। সমস্ত সুনিনু আমি করি এক এক। মন্ডলের পুত্র নাম কবির তাহার।। কহিল পুস্তক এক করনা তৈয়ার। বাঙলা সাএরে ভাই কর এক পুথি।। পড়িয়া শুনিয়া লোকে জাতে হবে প্রিতি। তাহার খাহেস আমি এড়াইতে নারি।। পদবন্দ করিলাম বাঙালায় সাএরি।’ ঘরছাড়া, অন্যের সেবক কবি মানিক সরকার নামে একজন গেঁয় লোকের কাছে ‘কেচ্ছা’ শুনে তারি ছেলে কবিদের তাকিদে ‘মাহতাব ও গোলে লাল’ কেতাব খানি রচনা করেন। কবিদের খাহেস এড়াতে না পেরেই কবি এ কাব্য লেখেন। অতঃপর বলা জরুরী যেÑ মুনসী তাজদ্দিনের তাকিদে কবি আবুদল আলী লেখেন ‘হালাতুন্নবি ’ বা ‘মৌলুদ সরিফ’। একাব্য রচনার পটভূমি জানাতে কবি সায়েরের পরিচয়। অংশে লিখেছেনÑ ‘এক্ষনে লিখিব আমি আর বিবরণ।। কেতাব রচিবার কথা শুন দিয়া মন। মুনসী তাজদ্দিন সাহেব বড় নেক নাম।। ঢাকা জেলার তাব গড়পাড়া মোকাম।। ছাপাখানা আছে আর কেতাবের দোকান। যায়গায় যায়গায় কত আছয়ে তাহান।। কলিকাতায় (গিয়া) ছিদ্দিকিয়া লাইব্রেরিতে। দেখা হৈল এক রোজ তাহার সহিতে।। আর এক পুথি মেরা সায়ের কালাম।। ‘উলফত নেসান’ বলে রাখিয়াছি নাম। ছাপা করিবার জন্যে এরাদা করিয়া।। মুনসী মৌছুফের কাছে পৌঁছিনু যাইয়া। দেখা সোনা মোলাকাত হইবার পরে।। মেহের করিয়া তবে পোছেন আমারে। কিসের কারণ আসা হৈল আপনার।। কহিনু তখন মেরা যত সমাচার। ‘উলফত নেসান’ তবে দিলাম নজদিকে।। বড় খুসি হয়ে তিনি লাগেন দেখিতে। পছন্দ করিয়া পাছে কহেন আমারে।। ছাপাইয়া দিব আমি দুই মাস পরে। সেসতে হইল ছাপা ‘উলফত নেসান’।। তারপরে খাহেস বুঝি হইয়া তাহান। চিৎপুর ৩৩৭/২ নং দোকানে উপরে।। এক রোজ কহিলেন অধমের তরে ।। নবীর আহওাল আছে যে কেতাবে।। মাতব্বর আছে ছহি দলিলের সাথে। তহকি করিয়া খুব তরজমা করিলে।। ফায়দা উঠাইবে যত মোমিন সকলে। ছলিছ এবারতে হাল মহাম্মদ রছুল।। লিখিলে চলিত ভাসায় হইবে মাকুল। যেই মতে সব লোক বুঝিতে পারিবে।। মেহনত করিয়া তাহা তরজমা করিলে। মৌলবি মজহর আর মহাম্মাদ কাজেম।। ঢাকা নিবাসি চৌধুরি আবদুল হাকেম। মাহবুব খাঁ আর মিয়া মহাম্মদ খাঁ সাহেব।। বড় নামদার মর্দ্দ দিনের তালেব। এহি সব ভাই বন্ধু ছিল সহরেতে।। সকলে মিলিয়া বলে তরজমা করিতে। অবোধ নাদান আমি হুস বিদ্যা কম।। তাহাতে ফোরছত নাই মনে কতগাম। দুনিয়ার কাছে কামে আছি মসগুল।। তথাপি লাচার হয়ে করিনু কবুল। আরবি হিন্দি এবারত বাঙালী জবানে।। তরজমা করিতে বড় ভয় লাগে মনে। তবে মস্কিল কোসা ভরসা করিয়া।। লিখিতেছি নবিজির হালাত রচিয়া।’ ------------------------------ ‘তরজমা করিনু শুরু বান্ধিয়া হেম্মত।। যদি আল্লাহ ফজল করি দেয় বরকত। নবির আহওাল যত সুনিতে পিয়ার।। লিখিব কেতাব বাত অতি মজাদার। ত্রিপদী পয়রা সাথে মিলন করিয়া।। বিনে সুতে গাথি হার কলমে লিখিয়া। ‘মৌলুদ সফির’ এই কেতাবের নাম।। রাখিনু জানিবে ভাই জতেক এছলাম।’ এ বয়ান থেকে জানা যায়, কবি নিজেই আপন গরজে লেখেনÑ ‘উলফত নেসান’। তারপর প্রকাশক কবি তাজদ্দিন ও অন্যান্য দোস্তদারদের তাকিদে রচনা করতে বাধ্য হনÑ ‘মৌলুদ সরিফ’ বা ‘হালাতুন্নবি’। মনে হয়, ‘হালতুন্নবি’ নামকটি প্রকাশকের দেয়া। মুনসী তাজদ্দিনের ইন্তেকালের পর, তাঁর ভাতিজা মুনসী মনিরুদ্দিন এর খাহেসে কবি মুনসী আয়াজদ্দিন আহমদ লেখেনÑ ‘কেচ্ছা গোলান্দাম’। সেকথা জানাতে ঐ কেতাবের আখেরেÑ কবি নিজেই লিখেছেনÑ ‘মুনসী তাজদ্দিন মহম্মদ মরহুমের।। সব দেসে নাম তার আছেত জাহের। তেনার ভাতিজা মুনসী মনিরুদ্দিন নাম।। খায়েসে তাহার লিখি কেচ্ছা গোলান্দাম।’ এছাড়া কবি গোলাম রহমান খন্দকার, কেবলা গা (বাবা) ও ভাইয়ের অনুরোধে লেখেনÑ ‘মৌলুদ সরিফ ছাইদি’। এ বিষেয়ে তিনি লিখেছেনÑ ‘সোনহে সওাকমন্দ আগামি কালাম।। আমানল ওয়েজিন এক কেতাবের নাম। সেই জে কেতাব আমি রচনা করিয়া।। ছাপাইতে কলিকাতায় রাখিলাম গিয়া। তারপরে মাকানেতে পেঁছিনু জখন।। আমার কেবলাগা তিনি কহে এবচন। আর মেরা বেরাদব আমার লাগিয়া।। কহে লেখে ছৈএদি মিলাদ দিয়া। দুয়েহের ফরমানে আসি লাচার হইয়া।। কাগজেতে কালি দিনু এলাহি ভবিয়া।’ কবি মুনসী আয়জদ্দিন ‘মালঞ্চ মালার কেচ্ছা’ নামে পুথি লেখেন প্রকাশক মুনসী মনিরুদ্দিন আহমদ নেককার Ñএর ফরমায়েসে। সেকথা জানাতে কবি লিখেছেনÑ ‘মুনসি মনিরুদ্দিন আহমদ নেক্কার।। তেনার সাঙ্গেতে বড় আলাপ আমার। তাঁর ফরমায়েসে করি একেচ্ছা রচনা।। আছেত ইহার কিছু আসল নমুনা।’ সে নমুনা পাওয়া যায় নি। হয়তো ছহি করতে গিয়ে প্রকাশক তাÑ বাদ দিয়েছেন, ছাপেননি। অপর এক কবি মুনসী আবদুল গফ্যার তাঁর ‘নরবক্ত নওবাহার’-কাব্যের মাগন ঠাকুরের পরিচয় দিতে লিখেছেনÑ ‘আর জে ওস্তাদ আমার কহি শোন নাম তার মুনসী ছাদতুল্লাহ জান।। ফুরফুরা নামে গ্রাম তাহার মাঝেতে ধাম কদিমি মোকাম সেই স্থান। একদিন তিনি মোরে কহিলেন এ প্রকারে শোন ওহে আবদুল গফ্যার।। পুরাতন ইতিহাস শোন এক মোর পাস কথা সেহ অতি চমৎকার।। শুনে তাহা জ্ঞাত হইয়া বঙ্গ ভাসায় বিরচিয়া প্রকাশ করনা বাপু তুমি।।’ ------------------------------- শুনি এই অভাগিয়া কি করি মনে ভাবিয়া ওস্তাদের আজ্ঞা অনুসারে।। স্মরণ করি নিরাকার নুরবক্ত নওবাহার আরম্ভ করিনু রচিবারে।। এরপর কবি দোস্ত মোহাম্মদ ১৮৭৭ সালে লেখেন Ñ ‘কবিতা করিতে সাধ্য নাহিক আমার।। কবিতা করিতে হরেক এলম দরকার। তথাপি ইহার আগে নাদানি করিয়া।। ‘তুহফাতুন্নেছা পুথি’ রচি বিচারিয়া। রচনা তাহার যবে হইল আখের।। কোন গুণবানে দোষ করিল জাহের। ভাসা শব্দ লাগানু মছলার কেতাবে ।। তে কারণে কেহ কেহ সেই দোস ভাবে। জানিলাম নিজ মনে বিদ্যাশুন্য হই।। এ কর্মের উপযুক্ত কাদাচিত নই। লজ্জিত হইয়া তাতে আপনার মনে।। অদ্যাবধি ক্ষান্ত আছিলাম তেকারণে। কবিতা বসন্তে আসে লজ্জার হেমন্ত।। সেই খেদে কোকিলের মত দিনু ক্ষান্ত। এখনেতে মোর কোনÑ কোন শাগরেদান।। খায়েস করিয়া কহে মোর বিদ্যমান। খয়েবরের জঙনামা বাঙালা করিয়া।। আমাদের হছরত কিছু দেন মিটাইয়া। সবে বলে দুরে গেল সময় হেমন্ত।। তোমার বাগান ফের আইল বসন্ত।’ ----------------------- ‘বাগানের সাজেনেতে হাজার দাস্তান।। গাইতে লাগিল সুখে নানা রঙ্গ গান। রঙ্গ ২ গান করে যাকে বুল ২ ।। তাহাগুণে কোকিল জে চিন্তায় ব্যাকুল।’ ------------------------- ‘শুনিয়া মোহিত হইল কোকিলের মন।’ --------------------- ‘ক্ষনেক বিলম্বে পুনঃস্থির হৈয়া চায়।। উপরোক্ত রঙ্গঢঙ্গ দেখিতে না পায়।’ তারপর, কবির প্রেরণা লাভের খোয়াবের ঘোর কেটে গেলে দেখেনÑ ‘কোথা সে বাগান গেল কোথা সে বাহার।। কোথা গেল পুষ্প আর সুসাজ তাহার। নিরীক্ষণ করে দেখে অন্ধকারময়।। খয়বরের জঙ্গ দোস্ত মোহাম্মদ কয়।’ এছাড়া, পুরোপুরি আলাদা বিষয় নিয়ে ১৮৬০ সালে কবি মুনসী মোমিনদ্দিন লেখেন ‘তৃষ্ণা বতী বিরাগুরু’ কেতাব খানি। পেশায় ছিলেন মাছ-ব্যবসায়ী। তিনি কোলকাতার বেলে ঘাটায় মাছের আড়তদারি করার কালে তার ওস্তাদের ভাই (নাম লেখেননি) লেখেন- ‘মিঞা মোর তরে কহে বারে বারে এই কেচ্ছা ভাল হবে।। তার হুকুমেতে নানা বিধিমতে রচিলাম শুদ্ধভাবে।। তাহার মদতে বহুত মেহনতে পুস্তক তৈয়ার করি।। কেচ্ছা তৃষ্ণাবতি মিষ্টাভাষা অতি কহিনু সবার হুজুরী।।’ ১৯ শতকের পহেলা ভাগের কবি, (সমাজ ও জাতি সচেতন) মুনসী মালে মোহাম্মদ আপন খাহেসে ‘ছেরাতল মমিনিন’ কেতাবে লিখেছেনÑ ‘বড়ই নাদান আমি কি জানি সাইরি।। ধরাট করিলে খাতা লিখিতে না পারি। দেলেতে মতলব মেলা লিখিতে সছলা।। আপনা দেশের হাল লেখি জে বাঙালা।’ সমাজের শোাচনীয় হাল দেখে তিন নিজের গরজে কেতাব লেখেন। ১১. একজন ব্যতিক্রমী মাগন কেশবচন্দ্র ঘোষ মরহুম কবিÑ মুনসী ইছহাক উদ্দিন রচিত একখানি বিশাল কেতাবের নাম ‘দাস্তান শহীদে কারবালা’। মোট ৪৬২ পৃষ্ঠায় ৭ কালাম এ লিখিত এ মহাকাব্য খানি কবি ১৩৩৪ সালে (খৃ ১৯২৭) রচনা শুরু করেন এবং খতম করেন ১৩৩৬ সালে বারই ভাদ্দর । ইছাহাক উদ্দিন আপন ইচ্ছায় দস্তান রচনা শুরু করলে ও হজরত রাসূল করীম (দ:) এর দুনিয়া ছাড়বার বয়ানতক লিখে থেমে যান (পৃ-৪০-৪১)। তারপর যার বিশেষ খাহেসে ও তাগিদে কাব্যখানি পুনরায় লেখা শুরু করেনÑ তিনি একজন অমুছলিম (হিন্দু)। কবি লিখেছেনÑ ‘এই এক লিখিয়া যে কেতবা দস্তান।। বন্ধ করিছিনু যে জানিবে ভাইজান। গরবিতে ফোরছত এক ঘড়ি নাই।। কখন সায়েরি করি ফোরছত না পাই। এক রোজ গেনু আমি জলঢাকা ভাই।। ছাড় করিবারে খাল ডাক ঘরে যাই। সেখানেতে আছে এক বাবু নেকনাম।। কেসবচন্দ্র ঘোষ না জানিবে ইছলাম। তেজারতি কারবার জোরে তার চলে।। বড় নামজাদা তিনি জানিবে সকলে। মেজাজ নরম তার বড় খোসহাল।। গরীবের দয়াবান চোরাগ খেছাল এই দাস্তানের বাত সেই বাবু শুনি।। লিখিবার উপদেশ দিলেন তখনি। ভরসা ছিলেন বাবু আমার কারণ।। লিখিতে দাস্তান দেরি না কর কখন। আল্লাহ তাআলা দয়া করি দিবে ছাপাইয়া।। নাওম্মেদ না হইবে রহমত থাকিয়া। শুনিয়া তাহার বাত ভাবিয়া খোদায়।। দাস্তান লিখিতে শুরু করি ফের তায়।’ ----------------------------- ‘তেরশ পঁয়ত্রিশ সাল সাতই আশ্বিন।। রবিবার দিন আজি জানিবে মোমিন। আবার সায়েরী শুরু করিনু দাস্তান।। কেবল ভরসা খোদা পাক ছোবহান।’ জল ঢাকা তখন নীফফামারি জেলার একটা থানা ছিল। এ থানার কোন এক পোস্ট অফিসের পোস্ট মাস্টার কেশবচন্দ্র ঘোষ ‘দাস্তান শহীদে কারবালা’ রচনায় কবিকে উৎসাহ উপদেশ দিয়েছিলেন। এমন অবাক ঘটনা বিরল। এজন্য তিনিÑঅমর হয়ে থাকবেন, তা বেশক বলা যায়। ১২. বিষাদ-সিন্ধু সম্পর্কে একটা অজানা তথ্য এবার মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ-সিন্ধু’ সম্পর্কে একটি অজানা তথ্যের ওপর আলোকেপাত করা হবে। তা হল কবি ইছহাক উদ্দিন পাঁচ কালামে দাস্তান রচনার পর, তা প্রকাশক মৌলবি আজহার আলীর কাছে নিয়ে যান। তাঁর পরিচয় ও নতুন তাকিদ-এর কথা জানাতে কবি লিখেছেনÑ ‘মৌলভী আজহার আলী নদীয়াতে ঘর।। দহকুলা গ্রামে বাড়ী ভাদালিয়া থানার। কেতাবের কারবার আছিল তাহার।। বড় মান্যমান সেই রফিক আল্লাহর। এ দস্তান লিয়া আমি দেখাইনু তারে।। বহুত পছন্দ কৈল দস্তান খাতেরে। আগাগোড়া কেতাবের পড়িয়ে তামাম।। তার পরে কহে ফের সেই নেক নাম। যেরকম ভাবে দস্তান হইল সায়ের।। বড়ই উত্তম চিজ হইবে জাহের। মোহাম্মাদ হানিফার জঙ্গ লেখহ দাস্তানে।। তা হলে একেতাব লাইবে মোমিনে। হানিফার জঙ্গ যদি নাহি লেখ ভাই।। না লইবে খরিদারে বেচা যাবে নাই। বাজারের যে কেতাবে জঙ্গ হানিফার।। নাহি আছে নাহি লয় আম খরিদার।’ তখন কবি আপত্তি জানিয়ে বলেনÑ ‘আরজ করিনু আমি জনাবে তাহার।। কোন কেতাবেতে নাহি জঙ্গ হানিফার। কেমনে সায়ের করি দাস্তান মাঝার।। উরদু কেতাবে নাহি জঙ্গ হানিফার। তখন কেতাব প্রকাশক মৌলীব মরহুম বললেন- কবির কথাÑ ‘শুনিয়া জবাব দিল সেই নামদার।। কেতাব লিখিতে যদি হয় দরকার। মোসাররফ হোছাইন ছিল কুতুব আল্লাহর।। ‘বিষাদ-সিন্ধু’ তে লেখে জঙ্গ হানিফার। আপন আক্কেলে নাহি লেখে সে কেতাব।। মোক্তাল হোছাইন দেখে লেখে বাত সব। আপনি বিষাদ সিন্ধুর মোতাবেক করি।। লেখহ দাস্তানে জঙ্গ হানিফার জারি।’ একথা শুনে কবি ফিরে এলেন। কিছুদিনের জন্য দস্তান ছাপা থেমে গেল। কবিকে এবার প্রকাশকের চাহিদা মাফিক লিখতে হল। কবির জবানীতেÑ ‘তাহার কথায় আমি হেলা না করিুনু।। জঙ্গ হানিফার ভাই দাস্তানে লিখিনু। বিষাদ-সিন্দুর আমি পিছেতে হাঁটিয়।। দাস্তানে হানিফার জঙ্গ লিখি বিরচিয়া।’ কবি ইছহাক উদ্দিন এ কাব্যের সসম (৬ষ্ঠ) বালামের পুরোটাই মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ-সিন্ধু’ লিখেছেন (পৃ. ৩৬৩-৪৪০)। সপ্তম বালাম লিখেছেন ‘রাক্তায়েত’ (হাদিছ মাফিক)। (সমাপ্ত) বি.দ্র. বানানরীতি লেখকের একান্ত নিজস্ব। লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির