post

ফয়সল ছিল নিবেদিতপ্রাণ কর্মী

৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৩

সাইয়্যেদা হাসনা বানু

সেই দিন ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর। আওয়ামী সন্ত্রাসীরা কতগুলো তাজা প্রাণকে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিলো। হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে করল আহত, আবার তারাই এখন ক্ষমতায়। ঘৃণায় মনটা খুব খারাপ লাগে। আবার চিন্তা করি আল্লাহ রাব্বুল আলামিন হয়তো বা ঈমানদারদের ঈমানকে আরও মজবুত করার জন্যই জালিমদের বিজয় দিয়েছেন। আল্লাহপাক আমাদের সবাইকে ঈমানের মজবুতি দান করুন। সেই ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর আওয়ামী হায়েনাদের জঘন্য হত্যাকাণ্ডের শিকার আমার প্রাণপ্রিয় আব্দুল্লাহ আল ফয়সল। নামটি রেখেছিলাম শহীদ সৌদি বাদশাহ ফয়সলের নামানুসারে। ভাবতেই পারিনি আমার ফয়সলের নামের সাথেও শহীদ শব্দটি যুক্ত হয়ে যাবে। শহীদ আবদুল মালেক থেকে শুরু করে যতগুলো সোনার ছেলে শহীদ হয়েছে ওদের কাহিনীগুলো পড়ে পড়ে চোখের পানি ফেলতাম এবং ছেলেমেয়েদের নিয়ে ওদের জন্য দোয়া করতাম, ওদের মহত্ত্বের প্রশংসা করতাম। ওরা আল্লাহর জমিনে দ্বীন কায়েমের জন্য বাতিলকে প্রতিহত করে ন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করার জন্য জীবন বিলিয়ে দিয়ে গেছেন, ওরা আল্লাহর নিকট বিরাট মর্যাদার অধিকারী। কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরাই সর্বোত্তম জাতি, তোমাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্য। তোমরা মানুষকে সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজ থেকে বিরত রাখবে।’ (সূরা আলে ইমরান : ১০৯) এই অসৎ কাজকে বাধা দানের কঠিন দায়িত্বটা যারা পালন করবে তারাই বিপদ-মুসিবতে পড়বে। এমনি একটি দলের নিবেদিতপ্রাণকর্মী ছিল আব্দুল্লাহ আল ফয়সল। ফয়সল যেন একটি সদ্য প্রস্ফুটিত গোলাপ, সদা হাস্যোজ্জ্বল চেহারার মায়াবী মুখ, সুন্দর, লম্বা ও অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী। চেহারা যেমন সুন্দর তার স্বভাব চরিত্র, লেনদেন, কথাবার্তা সবকিছুই ছিল সুন্দর। ছোটবেলা থেকেই মানুষের সাথে খুব বেশি মিশতে পারত। বড়-ছোট সবার সাথে তার সম্পর্ক ভালো ছিল। মুরব্বিদের সাথে ফয়সল খুব ড়নবফরবহঃ ছিল। ছোটদের সাথে খুবই কোমল ব্যবহার করত। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তার খুবই ভক্ত ছিল। ২০০৩ সালের ১৯ জুন ফয়সলের বাবা ব্রেনস্ট্রোকে মারা যান। তার আব্বা একজন পরহেজগার লোক ছিলেন। তিনি সৎভাবে জীবন-যাপন করার জন্য অনেক কষ্ট করতেন। ইসলামের প্রতি তার প্রবল অনুরাগ ছিল। তিনি নিজে জামায়াতে নামাজ, কুরআন অধ্যয়ন ও তাজাজ্জুদ পড়তেন। চাকরির কারণে বিভিন্ন জায়গায় পোস্টিং হয়ে যেখানে যেতেন সেখানেই সংগঠনের সাথে জড়িত হয়ে পড়তেন। সন্তানদেরকে ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করাই তার উদ্দেশ্য ছিল। ফয়সলেরও তার আব্বার মতো ইসলামের প্রতি বেশি আকর্ষণ ছিল। মানুষের বিপদ দেখলে ফয়সল ঝাঁপিয়ে পড়ত। একবার আমাদের এলাকার একটা ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগেছিল। ফয়সল ও আমাদের বাড়ির অন্য ছেলেরা সেখানে আগুন নেভানোর জন্য গিয়েছে। কিন্তু ফয়সল সবার আগে আগুনের একেবারে কাছে গিয়ে পানি ঢালা শুরু করেছে। জানের মায়াটা ফয়সল কম করত। একবার আমাদের এলাকায় কিছু সন্ত্রাসী এসে থানা আমীরের ওপর হামলা করেছিল। ফয়সল খেতে বসবে দুপুরে খাবার, না খেয়েই সে সেখানে চলে যায়। ফুয়াদ, ফাহাদ ও আমি খাওয়া-দাওয়া করে সেখানে যাই। মানবদরদি ফয়সল মানুষের দুঃখ দেখলে খুব কষ্ট পেত। ২০০৬ সালের প্রথম দিকে আমাদের কাজের বুয়ার স্বামী মারা যায়। ফয়সল বুয়াকে নিজেও সাহায্য করেছে এবং ঈদের সময় ওর জন্য ঈদের সেমাই-চিনি সংগঠন থেকে নিয়ে ওদের গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। ওর কথা মনে উঠলেই প্রাণটা যেন ফেটে যায়। ও ছিল পুরো পরিবারের সৌন্দর্যের প্রতীক। দেখাশোনায়, আচার-আচরণ সবটাই ছিল অন্যরকম। মানুষের চোখ পড়ার মতো বিশেষ আকষর্ণীয় স্বভাবের একটা ছেলে ছিল ফয়সল। দলমত নির্বিশেষে সবাই তাকে ভাল ছেলে হিসেবে জানত। সংগঠনের প্রতি তার আন্তরিকতা ছিল যথেষ্ট। ছোটবেলা থেকেই সংগঠনের মিছিল, মিটিং ও বিভিন্ন প্রোগ্রামে যেত। পারিবারিক বিভিন্ন সমস্যার কারণে সংগঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারেনি। সে জন্য সাংগঠনিক মান খুব ওপরে ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আবার সংগঠনে এগিয়ে যাওয়ার প্রতি চেষ্টা করতে লাগল। বিভিন্ন প্রতিকূলতার মধ্যেও ফয়সল সংগঠনের জন্য সময় ব্যয় করতে শুরু করল। সংগঠনে মানোন্নয়নের জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠল। সংগঠনের দেয়া দায়িত্বকে খুব আন্তরিকতার সাথে সম্পন্ন করত। যেকোন সম্মেলনে সুধীদের কাছ থেকে কালেকশনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতো। বই পড়ার প্রতি তার ঝোঁক ছিল। ইসলামী সাহিত্য, গল্প, কবিতা ও ইসলামী সঙ্গীত খুবই পছন্দ করত। বই পড়ার প্রতি এত নেশা ছিল যে কোন একটা বই ধরলে সেটা শেষ করে উঠতে চাইত। মাওলানা মওদূদী সাহেবের বই, আব্বাস আলী খান, অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেব এবং আরও সব উঁচু মানের লেখকদের বই পড়ে শেষ করে ফেলত। আমি মাঝে মাঝে বলতাম, ত্ইু কি নজরুল ইসলামের মতো হতে পারবি? ক্লাসের বইয়ের চেয়ে অন্যান্য বই পড়ার প্রতি এত নেশা। ১১ জ্যৈষ্ঠ জন্মÑ এই জন্যই এই কথাটা বেশি বলতাম। যাক আল্লাহর কাছে লাখো শুকরিয়া আল্লাহ ফয়সলকে আল্লাহর দ্বীনের পথে জীবন বিলিয়ে দেয়ার তাওফিক দিয়েছেন। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর আমার জন্য খুবই বেদনাদায়ক। স্বামীকে হারিয়ে সন্তানদের নিয়ে সুশৃঙ্খল জীবন যাপন করছিলাম। বাবার কথাও সন্তানরা এভাবে শুনে না যেভাবে আমার ছেলেরা আমার কথামতো চলতে লাগল। মানুষ দেখে অবাক হতো। এমনি অবস্থায় পরিবারের দুইজন বড় দায়িত্বশীল ছেলে দুটোই আহত এবং একজন মারা যাওয়ার ঘটনাটা আমাকে অনেক পীড়া দিয়েছে। আমি এখনও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবন যাপন করতে পারছি না। আমি মানসিকভাবে সুস্থ থাকার অনেক চেষ্টা করি। আল্লাহর কাছেও সাহায্য চাই। কুরআনে বর্ণিত শহীদের মর্যাদা এবং সবরের প্রতিফলের কথা স্মরণ করে একটু সান্ত্বনা পাই। সূরা বাকারার ১৫৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা তাদেরকে মৃত বলো না বরং তারা জীবিত, কিন্তু তোমরা উপলব্ধি করতে পারছ না।’ আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি আল্লাহ যেন ওদের সবাইকে শাহাদাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা দিয়ে, তার নিয়ামত দিয়ে ওদের সন্তুষ্ট করেন। শহীদ মুজাহিদ, শিপন, মাসুম ও রফিকের মা ওরাও তো আমারই মতো দুঃখিনী মা। তাদের কথা স্মরণ করি এবং কামনা করি আল্লাহ সবাইকে সবর করার তাওফিক দান করুক। আমার ফয়সল ছিল অত্যন্ত ধীরস্থির, বু্িদ্ধমান ছেলে। বেশ কয়েক বছর আগে যখন আমাদের বাসায় গ্যাস ছিলো না, হিটারে রান্না করতাম। তখনকার একদিনের ঘটনাÑ সুইচ লাগানো অবস্থায়ই আমি হিটারের তার ঠিক করতে হাত দিতেই কারেন্টে শট খেয়ে আমি দূরে পড়ে যাই। তখনও আমার হাতে তার লাগানো। ফাহাদ চিৎকার দিয়ে আমাকে ধরতে আসে কিন্তু ফয়সল কোনো কথা না বলেই তাড়াতাড়ি করে হিটারের সুইচটা খুলে দেয়। ফয়সল অনেক কঠিন কাজকেও সতর্কতার সাথে আঞ্জাম দিতে পারত। ২৮ অক্টোবর সকালবেলা আমাদের এলাকার কয়েকজন বোন বলাবলি করছিল, ফুয়াদের আম্মার ছেলেগুলো এ যুগের ছেলেদের থেকে আলাদা, তারা হীরা ও রতেœর চেয়ে মূল্যবান। এই দুর্ঘটনার পর সেই বোনেরা যখন আমাকে দেখতে আসে, তখন তারা বলল, সেই দিন সকালবেলাই ওদের নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। এখনও সকালবেলা যদি হাঁটতে বের হই, অনেকেই বলাবলি করে ওনার ছেলেদের মতো ছেলে সমাজে খুব কমই আছে। এটা বাহাদুরি নয়। এটা মহান রাব্বুল আলামিনের অশেষ মেহেরবানি। ফয়সলের আব্বা সন্তানদের সুশিক্ষা দিয়ে সুসন্তান হিসেবে গড়ে তোলার ইচ্ছা পোষণ করতেন। আল্লাহ যেন ফয়সলকে শহীদ হিসেবে কবুল করে নিয়ে তার বাবাকে শহীদের পিতা হিসেবে কবুল করেন এবং আমাদের জন্যও ফয়সল নাজাতের উছিলা হয় এই কামনা করি। প্রিয় সন্তানটার অনেক গুণাবলি আছে যা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। সর্বশেষ আমি এই কথাই বলতে চাই, আমাদের সন্তানেরা যে দ্বীন কায়েমের জন্য জীবন দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেল, আমরাও যেন সেই দ্বীনের পথে অবিচল থেকে অন্যায় ও অসত্যের মূলোৎপাটন করে অসত্যের বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রাম করে যেতে পারি। সে সত্যপথে আমরাও এগিয়ে যাব এবং আমাদের পাড়া-প্রতিবেশী পরিবার-পরিজন, সমাজ ও রাষ্ট্রকে এই পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করব। আমি ফয়সলের মা অর্থাৎ সমস্ত ছাত্রশিবিরের মা। আমি জ্ঞানে তোমাদের চেয়ে কম হতে পারি কিন্তু আমার অনুরোধ তোমাদের প্রতি- তোমরা সত্য ও ন্যায়ের পথে অটল থেকে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাও, পিছিয়ে যেও না, আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করবেন। এই পথে যারা চলবেন, আল্লাহর ঘোষণা তারা বিরাট সফলতার অধিকারী হবে। আল্লাহ তোমাদেরকে এবং আমাদেরকে এই পথের জন্য কবুল করুন। আমিন। লেখিকা : শহীদ ফয়সলের আম্মা

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির