post

রক্তাক্ত জনপদে প্রাণহীন মানুুুষের আর্তনাদ

হাসান ইলিয়াছ তানিম

২৮ এপ্রিল ২০১৬
প্রতিদিন বেড়েই চলেছে সারি সারি লাশের মিছিল, কোনভাবেই থামানো যাচ্ছেনা প্রাণহীন মরদেহের এ আর্তচিৎকার। বোবা কান্নার নীরব আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠেছে রক্তাক্ত লাল-সবুজ জনপদের আকাশ-বাতাস। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের মেধাবী ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর নির্মম ও পাশবিক হত্যাকান্ডে কাঁদছে গোটা বাংলাদেশ। বিচারের দাবিতে চলছে রাজনীতির মিছিল, হচ্ছে সমাবেশ। তবুও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না মুখোশধারী কুলাঙ্গার সন্ত্রাসীদের অশরীরী আত্মা। এক কন্যাসন্তানের শোকের রেশ কাটতে না কাটতেই শশ্মানঘাটের পাশে পাওয়া গেল দুই মেধাবী কলেজছাত্রের রক্তাক্ত নিথর দেহ। এবার বাকরুদ্ধ স্বজনদের অভিযোগের তীর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দিকে। কেননা পঁচিশ দিন আগে সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর পরিচয়েই নিহত দু’জনকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বলে জানা গেছে। অবশ্য পর্যবেক্ষক মহল ও মানবাধিকার সংস্থাসমূহ ধারণা করছে, বাংলাদেশের প্রথম সারির একটি বিরোধী ছাত্রসংগঠনের রাজনীতি করার অপরাধেই তাদেরকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজাতেই পরিকল্পিতভাবেই হত্যা করা হয়েছে। এরপর গত ৬ এপ্রিল পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের হৃষিকেশ দাস রোডে রাত সাড়ে ৮টার দিকে দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থী নাজিমুদ্দিন সামাদ। ব্যস্ত এলাকায় খোলা দোকানপাটের সামনেই পাঁচজন মিলে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে তাকে। কিন্তু ব্লগার সামাদের মৃত্যুর পর যেভাবে বিশ্বমিডিয়া ও সুশীলসমাজ প্রতিবাদে সরব হয়ে উঠেছিল এবার তার ভিন্ন রূপ। দেখা গেল সম্প্রতি নিহত হওয়া দুই কলেজছাত্রের ক্ষেত্রে। এবার একেবারেই নিশ্চুপ কথিত মিডিয়া ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো। কারণ খুবই পরিষ্কারÑ নিহত দুই কলেজছাত্র বাংলাদেশের প্রধান ইসলামী ছাত্রসংগঠনের রাজনীতির সাথে জড়িত। এ ছাড়া গত ৪ এপ্রিল যখন পুরান ঢাকার ইসলামপুরে অবস্থিত এক মসজিদের ভেতর থেকে মুয়াজ্জিনের রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয় সে সময়েও আমাদের স্বদেশীয় সংশ্লিষ্ট চিন্তাশীল বৃদ্ধিজীবী ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের কতিপয় বিবেকের নীরবতা লক্ষণীয় ছিল চোখের পড়ার মতো। তাই হত্যা-রাজনীতির এমন বৈষম্য সহ্য করতে না পেরে গত ৮ এপ্রিল রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘ব্লগার হত্যায় সারা পৃথিবীর মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করছে। অথচ আমাদের মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, মাদরাসার ছাত্র প্রতিনিয়ত খুন-গুম হলেও এ নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। কারণ তারা মুসলমান, তারা মানুষ না, এ পৃথিবীতে তাদের বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই’। সোনার বাংলায় এভাবেই চলছে একের পর এক অকাল মৃত্যুর মিছিল। গুম ও খুন আজ ঐতিহ্যগতভাবেই আওয়ামী রজিনীতির একটি বিশেষ অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের বাঁশখালীর মর্মান্তিক ট্র্যাজেডিকে দেখতে পাই; যেখানে কয়লাখনি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকে কেন্দ্র করে স্থানীয় সাধারণ মানুষের ওপর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা গুলি চালিয়ে চারজন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা ও অসংখ্য মানুষকে গুলিবিদ্ধ করে, যারা এখন মৃত্যুর সাথে  লড়ছে। অন্য দিকে রাজনীতির বলি নামক মানুষ হত্যার হোলি খেলায় চলছে নির্বাচনী সহিংসতায় প্রাণহানি। সর্বশেষ তথ্যমতে দুই দফার ইউপি নির্বাচনের সহিংসতায় নিহত হয়েছে ৪২ জন এবং আহত হাজারেরও বেশি। এ ছাড়া বিল্ডিং কোড না মেনে ভবন তৈরি যার ফলশ্রুতিতে রানা প্লাজার ভবনধসে এক হাজার ১৭৫ জন শ্রমিক নিহত এবং দুই হাজারেরও বেশি মানুষ আহত, যা বিশ্বের ইতিহাসে তৃতীয় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচিত। ধারাবাহিকভাবে গার্মেন্টস শিল্পে আগুন, প্রতি বছর বর্ষার মৌসুমে পাহাড়ধসে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি, সড়ক দুর্ঘটনার নামে যান্ত্রিক হত্যা, পাশ্চাত্য ও ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাবে দীর্ঘ হচ্ছে আত্মহত্যার দীর্ঘ লাইন, জনসচেতনতার অভাবে প্রতিনিয়ত ঘটেই চলছে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট ও ট্রেনে কাটা পড়ে অকাল প্রয়াণ, সামাজিক অবক্ষয়ের জেরে হচ্ছে পিতা-মাতার হাতে সন্তান খুন, সন্তানের হাতে বাবা-মা খুনসহ নামে ও বেনামে চলছে এরকম অসংখ্য দুর্ঘটনা। সোজাসাপটা ভাষায় বলতে গেলে প্রতিদিন আমাদেরই কেউ না কেউ যুক্ত হচ্ছে মৃত্যুর এ লম্বা সারিতে। গুম, খুন আর ধর্ষণে রক্তাক্ত হচ্ছে স্বাধীন লাল-সবুজের পবিত্র মাটি। কাঁদছে প্রাণহীন নিথর দেহের মানুষগুলো। আর চিৎকার করে ধিক্কার দিচ্ছে রক্তের ওপর দাঁড়ানো শরীরে প্রাণ থাকা মানুষদেরকে। মৃত্যুপুরীতে ঘুমন্ত মানুষগুলো বলছে তোমাদের বেআইনি শাসনব্যবস্থা আমাদের পৃথিবীর মুক্ত আলো বাতাসে থাকতে দিলো না। অবশ্য গভীর রাতের টেলিভিশন টকশোর সোফায় বসে চিন্তাশীল বুদ্ধিজীবীরা এ সমস্ত মৃত্যু নামক হত্যা রোধে প্রতিনিয়ত খুঁজেই চলেছেন সমাধান কিন্তু পাচ্ছেন না। মাঝে মাঝে অতি বিরক্ত হয়ে দুষছেন গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকা বেআইনি সরকারের আইনি শাসনব্যবস্থা ও জবাবদিহিতাকে। তবে সুশীল ও আমলা শ্রেণীর বিচার বিশ্লেষণ যাই হোক রক্তাক্ত লাশের স্তূপে বাংলাদেশ যে এখন মুত্যু উপত্যকা সে কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এ দেশে সংঘটিত হত্যার প্রকারভেদে সবচেয়ে নিষ্ঠুর ও নির্দয়কপূর্ণ পরিচিত নাম হচ্ছে ‘ক্রসফায়ার’। বিরোধী পক্ষ নির্মূলে সরকারের বিশেষ বাহিনী দ্বারা পরিচালিত বিচারবহির্ভূত এ হত্যাকান্ড একটি স্বাভাবিক দৃশ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও তার ঘনিষ্ঠ মিত্র বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের ছাত্রসংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরাই এ নির্মম হত্যার শিকার হয়েছেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির কথিত নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীনরা সারাদেশে যৌথবাহিনী নামিয়ে সাতক্ষীরা, যশোর, বগুড়া, লালমনিরহাট, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম, রাজশাহী, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া, বাঁশখালী, মহেশখালীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ক্রসফায়ারের নামে শুরু করে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ। গুলিবিদ্ধ হয়ে পঙ্গু হয়ে যায় অনেকে। যার প্রতিটি ঘটনাকে সরকার বন্দুকযুদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। তবে মিডিয়ার পরিসংখ্যান অনুযায়ী যাদেরকে বিচারবহির্ভূত গুলি ও হত্যা করা হয়েছে তাদের অধিকাংশই ছিল বয়সে তরুণ ও মধ্যবয়সী। এখনও প্রতিদিন পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যায় অমুক সন্ত্রাসী ক্রসফায়ারে নিহত। প্রশ্ন জাগে তাহলে কি এদেশে স্বাধীন বিচারব্যবস্থা পরাধীন? সন্ত্রাসী হলেই যদি তাকে হত্যা করতে হয় তাহলে আইন-আদালতের কোনো প্রয়োজন ছিল না। এভাবে রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড চালিয়ে দেশটাকে ক্রসফায়ারের রাষ্ট্রে পরিণত করা হচ্ছে কি না এ প্রশ্ন এখন দেখা দিয়েছে সচেতন সব মহলের মনে। ক্রসফায়ারের পাশাপাশি রয়েছে জীবিত মানুষ উধাও করার সংস্কৃতি যা মিডিয়ার পরিভাষায় গুম হিসেবে আখ্যা পেয়েছে। গুম ও ক্রসফায়ারের সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া কঠিন হলেও বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত তথ্য ও মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে নিচে পাঠকের জ্ঞাতার্থে কয়েকটি (২০০৯-২০১৫) পরিসংখ্যান উল্লেখ করা হলো : ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে বিচারবহির্ভূত কোনো হত্যাকান্ড হবে না বলা হলেও ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে শুরু হয় বিচারবহির্ভূত হত্যাযজ্ঞের ন্যক্কারজনক মিশন। বন্ধুত্বের নমুনাস্বরূপ বৃদ্ধি পায় প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের সীমান্ত বাহিনী বিএসএফ কর্তৃক বর্বরোচিত কিলিং মিশন। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, ২০০৯ সালে জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে প্রাণহানি ঘটেছে মোট ২০০ জনের। একই সময় র‌্যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য বাহিনীর গুলিতে আহত হন আরো ৩ শতাধিক মানুষ। এ বছরের সবচেয়ে নৃশংস ঘটনা ছিল পিলখানার মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার মাত্র দুই মাসের মাথায় ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি দেশের শ্রেষ্ঠসন্তান মেধাবী সেনাকর্মকর্তাদের হত্যা, নির্যাতন ও লাশগুমের লোমহর্ষক উৎসবে মেতে উঠেছিল কিছু নরঘাতক। ২০১০ সালে সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিচারবহির্ভূতভাবে ১৩৩ জন নিহত হয়। বিএসএফ গুলি করে হত্যা করে ১০০ বাংলাদেশীকে। ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন সাতজন। বখাটেদের উৎপাতে ৩১ নারী আত্মহত্যা করেন এবং অপমান সইতে না পেরে একজন বাবাও আত্মহত্যা করেন। যৌতুকের কারণে ২২৩ জনকে হত্যা করা হয় এবং ১৮ জন নির্যাতিত নারী আত্মহত্যা করেন। কারা হেফাজতে মারা গেছেন ৭৪ জন। ৪৩৬টি রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনায় ৭ হাজার ১০৩ জন আহত ও ৭৫ জন নিহত হন। ২ হাজার ২৭৯ প্রবাসী শ্রমিক লাশ হয়ে দেশে ফেরত এসেছেন। ২০১১ সালে অপরাধের নতুন প্রবণতা হিসেবে ‘নিখোঁজ’ বা ‘গুপ্তহত্যার’ ঘটনা ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ। এ বছরে অন্তত ৫১ জন নিখোঁজ বা অপহরণের শিকার হয়। তাদের মধ্যে ১৫ জনের লাশ পাওয়া গেছে। আর প্রায় প্রতিটি ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, তাদের স্বজনকে র‌্যাব বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তুলে নিয়ে গেছে। ২০১১ সালে সারা দেশে কথিত ‘ক্রসফায়ারে’ ১০০ জন নিহত হয়। এদের মধ্যে শুধু ‘ক্রসফায়ারে’ র‌্যাবের হাতে ৩৫ জন, পুলিশের হাতে ১৯ জন, র‌্যাব ও পুলিশের হাতে যৌথভাবে চারজন নিহত হয়। গণপিটুনিতে মারা যায় ১৩৪ জন। কারা হেফাজতে ১১৬ জন কয়েদি ও হাজতির মৃত্যু হয়েছে। সীমান্তে ভারতীয় বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে ৪০ জন। বখাটেদের উৎপাতে ৩৩ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন আর বখাটেদের হাতে খুন হয়েছেন ২৩ জন। গ্রাম্য সালিসির শিকার হয়েছে ৫৯ জন নারী। এদের মধ্যে একজনকে হত্যা করা হয়েছে এবং ১৩ জন আত্মহত্যা করেছে। একই সময়ে দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯৩৬ জন নারী, যার মধ্যে ১০৫ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ১২ জন। এসিড-সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন ৬২ জন নারী। এ ছাড়া ১১৭ জন গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, যাদের ৭৪ জনই শিশু। আর এদের মধ্যে নির্যাতনে ৫১ জনের মৃত্যু হয়েছে, আটজন আত্মহত্যা করেছেন, ছয়জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের দ্বারা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৫১৪ জন শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে একজন শারীরিক নির্যাতনের পর মারা গেছে, একজন আত্মহত্যা করেছে। ২০১২ সালে বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী, শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিবিরের দুই নেতাসহ মোট ৫৬টি গুম-গুপ্তহত্যার ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে আটজন মুক্তি পেয়েছেন, চারজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, ছয়জনকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়েছে এবং অবশিষ্ট ৩৮ জনের খোঁজ মেলেনি। একই সময়ে বিভিন্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন ৯১ জন। এসবের প্রতিটি ঘটনায় সরকারের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অন্যরা নিজেদের পক্ষে সাফাই গেয়ে প্রকারান্তরে অপরাধীদের আড়াল করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়। আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও পুলিশ লিমনের মায়ের মামলায় নির্বিকার ছিল। উল্টো তাদের হয়রানি করা হয়েছে। ২০১২ সালে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘাতের মোট ৫৯৫টি ঘটনা ঘটেছে। এতে কমপক্ষে ৮৪ জন নিহত হয়েছেন। ২০১১ সালে রাজনৈতিক সংঘাতের ঘটনা ছিল ৩৭৫টি। বিশ্বজিৎ দাসকে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করলেও পুলিশ ছিল নিষ্ক্রিয়। ২০১২ সালে সীমান্ত হত্যা ও নির্যাতনের ৩১৯টি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৪৮ জনকে হত্যা করা হয়, শারীরিক নির্যাতনে আহত হয়েছেন ১০৬ জন এবং সীমান্ত থেকে অপহরণের শিকার হয়েছেন ১৪০ জন। অন্য দিকে একই সময়ে কমপক্ষে ৪৪২ জন সংবাদকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৭৪ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা, ৮৭ জন সন্ত্রাসী দ্বারা, ৭২ জন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেন। খুন হয়েছেন সাংবাদিক দম্পতি সাগর ও রুনিসহ পাঁচ সাংবাদিক। যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে ২০১২ সালে কমপক্ষে ২৫০ নারী বখাটেদের দ্বারা লাঞ্ছিত হয়েছেন, এর মধ্যে ১৬ জন আত্মহত্যা করেন। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করায় হামলার শিকার হয়েছেন ২১৫ নারী, তাদের মধ্যে ১৫ জন মারা গেছেন। যৌতুককে কেন্দ্র করে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৫৩৮ নারী। এর মধ্যে আত্মহত্যা করেছেন ১৯ জন। অন্য দিকে এক হাজার ১৪৯ নারী ও শিশু ২০১২ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এসিড নিক্ষেপের শিকার হয়েছেন ৬৮ নারী। ২০১৩ সালে দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি ছিল চরম উদ্বেগজনক। বছরব্যাপী চলতে থাকা রাজনৈতিক সংঘাতে ৫০৭ জন মানুষ নিহত হয়। গুম বা গুপ্তহত্যার শিকার হন ৫৩ জন। বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড হয় ৭২টি। দায়িত্ব পালনকালে মারা যান তিনজন সাংবাদিকও। ২০১৪ সালেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড অব্যাহত ছিল। ২০১৩ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন ৭২ জন। ২০১৪ সালে এই সংখ্যা বেড়ে ১২৮ জনে দাঁড়িয়েছে। গুম ও গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন ৮৮ জন। ২৩ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতনে মারা গেছেন ১৩ জন। গ্রেফতারের আগে মারা গেছেন দু’জন। আত্মহত্যা করেছেন একজন। ৫ জানুয়ারির কথিত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ৬৬৪টি রাজনৈতিক সহিংসতা হয়েছে। এতে নিহত হয়েছে ১৪৭ জন। আহত আট হাজার ৩৭৩ জন। খুন হয়েছেন দু’জন সাংবাদিক। এ বছর সীমান্তহত্যা ও নির্যাতনসহ ২৭৩টি ঘটনা ঘটে। এই সময়ে গুলিতে ১৬ এবং নির্যাতনে ১৬ জন নিহত হন। ২০১৫ সালে রাজনৈতিক সহিংসতায় ১৫৩ জন মারা গেছেন আর আহত হয়েছেন ৬৩১৮ জন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে বা ক্রসফায়ারে ১৯২ জন মারা গেছেন এবং গণপিটুনিতে মারা যান ১৩৫ জন। সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে এ বছর মারা গেছেন ৩২ জন, নির্যাতনে মৃত্যু হয়েছে ১৪ জনের। আহত হয়েছেন ৭৩ জন আর অপহরণের শিকার হয়েছেন ৫৯ জন। কারা হেফাজতে ৬৯ জন মারা যান। এসিড নিক্ষেপের শিকার হয়েছেন ৩৫ জন নারী, যার মধ্যে ৩ জন মারা গেছেন। এ বছর যৌন হয়রানির শিকার হয়ে ১০ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে ৫ জন নারী ও ১ জন পুরুষ নিহত হয়েছেন। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭৫২ জন নারী আর ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৬০ জন নারীকে। ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন দু’জন নারী। ৬৩ জন গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকান হন এই বছর। এদের মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের পর মারা গেছেন সাতজন এবং ২৭ জনের মৃত্যুর কারণ উদঘাটিত হয়নি। যৌতুকের শিকার হয়েছেন ২৯৮ জন নারী। তাদের মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ১০১ জন আর যৌতুকের জন্য শারীরিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে ১৮৭ জন নারীকে। এ ছাড়া যৌতুকের কারণে ১০ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন। ৩৭৩ জন নারী এ বছর পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ২৭৩ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে। পারিবারিক নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৫৪ জন নারী আর শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪৬ জন নারী। উপরের পরিসংখ্যানগুলো বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনের আলোকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে নেয়া হয়েছে। যেখানে রক্তাক্ত জনপদের প্রাণহীন লাশের মিছিল কতটুকু দীর্ঘ হয়েছে বা হচ্ছে তার একটি আইডিয়া সচেতন পাঠক সহজে অনুমান করতে পারবেন। হ লেখক : সাবেক সহসভাপতি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস ক্লাব

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির