post

শিক্ষাব্যবস্থার আদর্শিক ভিত্তি

৩১ মার্চ ২০১৫

মু. সাঈদুর রহমান#

Shikhkhaশিক্ষা আমাদের কাছে অতি পরিচিত একটি শব্দ। মানবসভ্যতার বয়স যত দিন শিক্ষার বয়সও তত দিন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন প্রথম মানব সৃষ্টির পর যেদিন তাকে সবকিছুর নাম শেখালেন, সে দিনই মানবসভ্যতার জ্ঞানের সূত্রপাত। সব কিছুর নাম শেখানোর মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বাস্তবিক পক্ষে হজরত আদম (আ)কে বস্তুজগৎ সম্পর্কে জ্ঞান দিয়েছেন। মাটি দিয়ে হজরত আদম (আ)কে সৃষ্টি করার পর তার মধ্যে রূহ ফুঁকে দিয়ে এবং পরবর্তীতে একটি ভুলের মাধ্যমে বাস্তব প্রশিক্ষণ দিয়ে তাকে দুনিয়ায় পাঠিয়ে দিলেন মহান আল্লাহ। এরপর জীবন-যাপনের সামগ্রিক হেদায়েতের জন্য ‘হুদা’ বা জীবনবিধান। আর এই জীবন-যাপনের পদ্ধতির সর্বশেষ সংস্করণ হলো ‘আল কুরআন’ যা শেষ নবী (সা)-এর ওপর নাজিল হয়। শিক্ষার সংজ্ঞা শিক্ষার সংজ্ঞা এক কথায় দেয়া খুবই কঠিন। কোন তাত্ত্বিকতায় না গিয়ে অত্যন্ত সংক্ষিপ্তভাবে বড় বড় শিক্ষাবিদগণ যেভাবে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করেছেন, তার মধ্যে মহাকবি মিল্টনের সংজ্ঞাটিই অধিকতর গ্রহণীয়। তাঁর মতে, শিক্ষা হলো দেহ, মন এবং আত্মার সমন্বিত উন্নতি সাধন। জন, ডিউই, জে এস ব্রনারসহ আধুনিক বহু শিক্ষাবিদই শিক্ষাব্যবস্থাকে এমন একটি অব্যাহত পদ্ধতি হিসেবে দেখেছেন, যার মাধ্যমে প্রজন্ম তৈরির কাজ করা হয়। জাতীয় আদর্শ এবং ঐতিহ্যকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছানো এবং সময়ের সাথে খাপ খাওয়ানোর যোগ্যতা অর্জন করানো শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হওয়া উচিত। প্লেটোর মতে, কোন দেশের শিক্ষাব্যবস্থা রচিত হওয়া উচিত সেই দেশের সংবিধানের আদর্শ অনুযায়ী। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার শেষের কবিতায় শিক্ষাকে তুলনা করেছেন পরশপাথরের সাথে, তাঁর চিন্তা অনুযায়ী শিক্ষা হলো পরশপাথর, তার থেকে ছিটকে পড়া আলোটাই হচ্ছে কালচার। মহাকবি আল্লামা ইকবালের মতে, শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো খুদি বা আত্মার উন্নতি সাধন। খুদি উন্নত হলে সেই মানুষের সমস্ত কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণ এবং সুষমামন্ডিত করতে সক্ষম। বিখ্যাত মনীষী স্ট্যানলি হল বলেছেন, ‘ওভ ুড়ঁ ঃবধপয ুড়ঁৎ পযরষফৎবহ ঃযৎবব জ’ং ৎবধফরহম, ৎিরঃরহম, ধৎরঃযসবঃরপ ধহফ ষবধাব ঃযব ভড়ঁৎঃয ৎ-ৎবষরমরড়হ, ুড়ঁ বিষষ মবঃ ধ ভরভঃয ঃযধঃ রং ৎধংপধষরঃু. পবিত্র কুরআন শরীফের সূরা আল বাকারার ১৫১ নম্বর আয়াত, সূরা আলে ইমরানের ১৬৪ নম্বর আয়াত এবং সূরা জুমুয়ার ৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নবীদের কাজ সম্পর্কে যে কয়েকটি কথা বলেছেন তার সমন্বিত রূপ হলোÑ ‘তাদের ভেতর থেকে আমি একজন রাসূল (সা) পাঠিয়েছি, যিনি তাদেরকে আল্লাহর আয়াত পড়ে শুনান আর শিক্ষা দেন কিতাবের জ্ঞান, হিকমত এবং তাদের অন্তরকে করেন পবিত্র।’ মহাগ্রন্থ আল কুরআনে হাকিমের সংজ্ঞাটিই বিস্তারিত, সঠিক যুগোপযোগী এবং সমন্বিত সংজ্ঞা। শিক্ষাব্যবস্থার মূলনীতি একটি মূল্যবোধ ছাড়া প্রকৃত শিক্ষা হতে পারে না। মন এবং আত্মার উন্নতির জন্য উন্নতমানের নৈতিক মূল্যবোধ অপরিহার্য। পাশ্চাত্য সভ্যতা দীর্ঘ সাধনার পরও সামাজিক ও বস্তুগত কিছু নিয়ম কানুনের মাধ্যমে মূল্যবোধ লালন ও শিক্ষার মাধ্যমে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তা হস্তান্তর করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। সেখানে বস্তুগত ও প্রযুক্তিগত অনেক উন্নতি হওয়ার পরও প্রকৃত অর্থে সে শিক্ষাব্যবস্থা কোনো আদর্শ মানুষ তৈরি করতে সক্ষম হয়নি। বরং দিনদিন সেখানকার অবস্থার অবনতিই ঘটেছে। পাশ্চাত্যের শিক্ষাবিদ, সমাজবিদ, রাজনীতিবিদ, ধর্মগুরু সকলেই এখন উদ্বিগ্ন। ধর্ম ছাড়া মূল্যবোধ লালন করা সম্ভব নয়, ধর্ম ছাড়া কোন শিক্ষাও হতে পারে না। ধর্মীয় মূল্যবোধের লালন ছাড়া সত্যিকারের মানুষ গড়া সম্ভব নয়। সেহেতু শিক্ষাব্যবস্থা নির্মিত হওয়া উচিত ধর্মীয় মূল্যবোধ অনুযায়ী। দুনিয়ার মানুষকে ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা, মানবতাবোধ, মানুষে মানুষে সাম্য, ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে মানবতার কল্যাণ কামনা করার জন্য ধর্মই মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে। স্বাভাবিক একটা উদাহরণ লক্ষ করলে বোঝা যায়, ‘বিজ্ঞানের প্রতিটি জিনিসের বিশেষ করে রাসায়নিক পদার্থসমূহের স্বতন্ত্র ধর্ম রয়েছে। একে ব্যবহার করতে গেলে সেই ধর্ম অনুযায়ীই ব্যবহার করতে হয়। সুতরাং কোন দেশে সত্যিকারের মানুষ গড়তে হলে সেই দেশের রাষ্ট্রধর্ম এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের ভিত্তিতেই শিক্ষানীতি প্রণীত হওয়া অপরিহার্য। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বাংলাদেশের প্রায় সকল ধর্মের লোকই বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহ আছেন এবং তিনি একক ক্ষমতার অধিপতি, মানুষের ইহলৌকিক জীবনটাই একমাত্র জীবন নয়, মৃত্যুর পরও একটা জীবন আছে এবং সেখানে ইহকালীন কাজের জবাবদিহিতা করতে হবে এবং শাস্তি ও পুরস্কার সম্পর্কে সকলের প্রায় একই বিশ্বাস। সকল ধর্মের মানুষই বিশ্বাস করেন, সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ প্রদত্ত আইন কানুনের আলোকে জীবন পরিচালনা করার মাধ্যমেই রয়েছে সত্যিকারের সফলতা। এটাকে জনগণের সাধারণ বিশ্বাস এবং মূল্যবোধ হিসেবে ধরে নিলে প্রত্যেক জাতির নিজ ধর্ম জানার অধিকার একটি মৌলিক মানবীয় অধিকার। আমাদের সংবিধানেও  সে অধিকার সংরক্ষিত। তাই শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত নিজ নিজ ধর্মের মৌলিক নীতিমালা, আনুষ্ঠানিক ইবাদত এবং ধর্মের দার্শনিক ভিত্তি শিক্ষার অধিকার রয়েছে। প্রতিটি ধর্মেই সামাজিক বিধিবিধান, আইন-আদালত, বিচারপদ্ধতি, পারস্পরিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় অধিকার বা রাজনীতি তথা জীবনের অনেক অধ্যায় সম্পর্কে কম বেশি আলোকপাত করা হয়েছে। রাজনীতির রূপরেখা, অর্থনৈতিক কাঠামো, সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ, এবং ব্যক্তি, পরিবার বিধিবিধান প্রভৃতি শিক্ষার মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে পড়াশুনা করলে একজন হিন্দু ছাত্রের হিন্দুত্বের যদি ক্ষতি না হয়, পুঁজিবাদী তথা পাশ্চাত্যের গণতন্ত্র সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করলে যদি কোন বৌদ্ধ ছাত্রের ধর্মে আঘাত না লাগে, মানবসৃষ্টির তত্ত্ব সম্পর্কে বস্তুবাদী এবং ডারউইনের মতবাদের ওপর পড়াশুনা করলে যদি কোন খ্রিস্টান ছাত্রের ধর্মানুভূতিতে আঘাত না লাগে, তাহলে এসব ক্ষেত্রে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গিতে পড়াশুনা করলে অন্যান্য ধর্মের লোকদের আপত্তির যুক্তিসঙ্গত কোন কারণ থাকতে পারে কি? এতে তাদের ক্ষতির পরিবর্তে লাভই বেশি হবে, জ্ঞানভান্ডার সমৃদ্ধ হবে। বাংলাদেশ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি। স্বাধীনতা আমাদের অহঙ্কার। এ দেশে ইসলামের মূূলনীতি অনুযায়ী একটি শিক্ষাব্যবস্থা রচিত হওয়া গণতন্ত্রের দাবি, কারণ আমাদের দেশের জনসংখ্যার ৮৭ ভাগ লোকই ইসলাম ধর্মের। তাই অন্যান্য সকল ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে ইসলামের মূলনীতি ও নৈতিক মূল্যবোধ অনুযায়ী একটি সমন্বিত শিক্ষাব্যবস্থা রচিত হবে এটা খুবই স্বাভাবিক। আমরা বাংলাদেশের কোটি কোটি ছাত্র-জনতা এমন একটি নৈতিক শিক্ষাব্যবস্থা চালুর প্রত্যাশা করছি। লক্ষ শহীদের রক্তে অর্জিত আমাদের লাল-সবুজের পতাকা উড্ডীন রাখতে সক্রিয় মূল্যবোধের শিক্ষাব্যবস্থার বিকল্প নেই। লেখক : সেন্ট্রাল স্পোর্টস সেক্রেটারি, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির