post

শিপন আমার গর্ব

মোছা: মাহফুজা বেগম

২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫
শহীদ হাফেজ গোলাম কিবরিয়া শিপন চাঁদপুর জেলার মতলব থানায় ১৪ আগস্ট রোববার জন্মগ্রহণ করে। ছোটবেলা থেকে খুব বেশি চঞ্চল কিংবা খুব বেশি চুপচাপ- এ দুয়ের মাঝামাঝি সে ছিল। সে কোনো বিষয়ে আমাদেরকে ঝামেলা কিংবা পাওয়ার জন্য জোরাজুরি করতো না। পড়াশোনার প্রতি ছিল তার যথেষ্ট আগ্রহ। তার এই আগ্রহ দেখে আমি এবং তার বাবা সিদ্ধান্ত নিই তাকে হাফেজ বানাবো। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত গোড়ান নাজমুল হক সিনিয়র মাদরাসা থেকে পড়ার পর হেফজখানায় আমরা তাকে ভর্তি করিয়ে দিই। হেফজ শেষ করে তামিরুল মিল্লাত মাদরাসায় সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হয়। এখান থেকে দাখিলে ১১তম স্থান অধিকার করে। মানুষের সাথে সে খুব সহজেই মিশে যেত। হাসি এবং গল্পের মাধ্যমে যে কোন আসরকে প্রাণবন্ত করতে শিপনের জুড়ি ছিল না। মানুষের যে কোন বিপদ কিংবা সমস্যা সমাধানে সে দ্রুত সাড়া দিত। যেমন এক ছেলে অ্যাপেন্ডিসাইটিসের ব্যথা উঠলে তাকে ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তির পর দেখা গেল তার ওষুধের টাকা নেই। সে তার নিজের পকেটের টাকা দিয়ে ঐ ছেলের ওষুধ কিনে দেয় এবং সারারাত তার বিছানার পাশে থেকে সেবা-শুশ্রুষা প্রদান করে ভোরে পায়ে হেঁটে বাসায় ফিরে। এলাকার এক বৃদ্ধ লোকের কাছ থেকে ছিনতাইকারীরা টাকা পয়সা ছিনিয়ে নিলে ঐ লোকটিকে ৩০ টাকা রিকশা ভাড়া প্রদান করে তার নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে দেয়। এলাকায় সে এতই ভালো হিসেবে পরিচিত ছিল যে, চার বছর ধরে মসজিদে তারাবি পড়িয়েছে। সরকারি বিজ্ঞান কলেজে অর্থ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালে তার আচরণে মুগ্ধ হয়ে হিন্দু ছেলেরা পর্যন্ত বায়তুলমালে অর্থ প্রদানের আগ্রহ প্রকাশ করত। শহীদ হওয়ার আগের বছর ২০০৫ সালে গোড়ানের এক বাড়িতে তারাবির ইমামতি করে। শিপন এলাকার অনেক ছেলেকে কুরআন শরিফ পড়তে শিখিয়েছে। এলাকার এক ছেলের মা একদিন আফসোস করে বলছিলেন, আমার ছেলেকে কুরআন শেখাবে। সেও রাজি হয়েছিল কিন্তু তাকে এখনও কুরআন শেখাতে পারিনি। যে গরিব ছেলেদের বাবা টাকা দিতে পারত না তাদেরকে সে টাকা ছাড়াই পড়াতো। এলাকার ছেলেরা খারাপ হয়ে যাচ্ছে তাদেরকে ভালো করতে হবে- এই চিন্তায় সে সারাক্ষণ ব্যস্ত ছিল। সে সবাইকে মসজিদে নামাজ এবং কুরআনের আলোকে জীবন গড়ার তাগিদ দিতে ব্যতিক্রম আয়োজনের মাধ্যমে তাদেরকে দাওয়াত পৌঁছাতো। যেমন ব্যায়াম, ফুটবল, ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন। ফজরের নামাজের সময় ছেলেদেরকে নামাজের জন্য ডাকতো ভোরে যেন কেউ না ঘুমায় সে জন্য শহীদ মাসুম তাদেরকে সাথে নিয়ে মাঠে খেলতে যেতো। বাসায় ওর কারণে কেউই মুখ ভার করে রাখতে পারত না। সে থাকা অবস্থা তাকে অবশ্যই কথা বলতে হবে বা হাসতে হবে। কারণ তার একটি অভ্যাস ছিল কৌতুকের মাধ্যমে সবাইকে আনন্দ দেয়া। এই জিনিসটা আমার কাছে খুব ভালো লাগত। সে আমাকে কাছে ডেকে বসে বলতো, আমার কথা এখন শুনেন না, এমনও দিন আসবে কেউ আপনাকে ডাকবে না। এলাকায় ছাত্রদের মাঝে দাওয়াতি কাজের কারণে এলাকার প্রভাবশালী কিছু ব্যক্তি তার প্রচন্ড বিরোধিতা করে এবং তাকে হুমকি প্রদান করলেও সে তাদের সাথে সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করেছে। তারা দাওয়াতে সাড়া না দেয়ার খোঁজ নিয়েছে কেন তারা এলো না। এভাবে আল্লাহ তাকে সবার মাঝে একটি সুন্দর মানুষ হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠা করে নিষ্পাপ হিসেবে তার দরবারে নিয়েছেন। শহীদ হওয়ার কয়েকদিন আগে এক গরিব ছেলেকে ঈদের পাঞ্জাবি এবং তার বাড়িতে সেমাই-চিনি পাঠায় সে। এক অসুস্থ রোগীকে রক্ত দিয়ে সে অনেক দুর্বল হয়ে পড়ে, তার পরও আমি বললাম, তুমি রক্ত দিলে কিন্তু তোমার শরীর তো দুর্বল। সে বলল, আপনি যেমন আমার মা, আমার জন্য আপনার যেমন কষ্ট লাগে, তারও তো এরকম কষ্ট লাগে। রক্তের কারণে যদি সে বেঁচে যায় তবুও তো ভালো। নিজে রক্ত দেয়ার পাশাপাশি অন্যকেও উৎসাহী করত রক্ত দেয়ার ক্ষেত্রে। আজ আমার একটাই প্রত্যাশা-শিপন যে রকম কৌশলে দ্বীনের দাওয়াত দিত, সবাই যেন সে রকম কৌশলে এবং মানুষের উপকারের মাধ্যমে দ্বীনের দাওয়াত সকলের কাছে পৌঁছায়। আর আমার শিপনকে যেরকম নিষ্ঠুর ও নির্মমভাবে নির্যাতনের মাধ্যমে শহীদ করা হয়েছে, আমার ছেলে কুরআনে হাফেজকে তারা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার দাঁত পর্যন্ত শহীদ করেছে। তাই আমি এই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই এবং ভবিষ্যতে আর কোনো মায়ের বুক যেন এভাবে খালি না হয় এবং কোন সন্তানকে যেন এভাবে না মারা হয়। লেখিকা : শহীদ শিপনের মা

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির