post

স্মৃতিতে ২৮ অক্টোবর প্রেক্ষিত রাজশাহী আনিসুর রহমান

২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫
২০০৬ সালে ২৮ অক্টোবর। বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাস একটি পরীক্ষার দিন। এই দিনে বাতিল শক্তি বাংলাদেশ থেকে ইসলামী আন্দোলনকে নিশ্চিহ্ন করার চক্রান্ত করেছিল। আমি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। সবেমাত্র সদস্য শপথ নিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি তখন মাহবুবুল আলম সালেহী ভাই। আমরা বিভিন্ন চ্যানেলের মাধ্যমে জানতে পারলাম বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে আওয়ামী হায়েনাদের সাথে আমাদের ভাইদের সংঘর্ষ চলছে। রাজশাহীতে সেই দিন কিছু না ঘটলেও আমরা চিন্তামুক্ত ছিলাম না। সতর্কতাস্বরূপ সালেহী ভাই আমাদেরকে ইসলামী ছাত্রশিবির রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস এবং ট্রাস্ট পাহারা দেয়ার জন্য দায়িত্ব দেন। সকাল থেকে শুরু করে সারাদিন পাহারা, রাত হলেও বাতিলরা সেদিন আমাদের আশপাশেও আসতে পারেনি। তবে আমাদের কাছে উত্তরবঙ্গের অনেক জেলা থেকে সংবাদ আসে যে বিভিন্ন জায়গায় আক্রমণ চালাচ্ছে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। ২৮ অক্টোবর গাইবান্ধার সাদুল্যাপুর উপজেলার জামায়াত অফিসে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা লগি-বৈঠার তান্ডব চালিয়ে প্রতিটি কক্ষ ভাঙচুর করে এবং লুটপাট করে মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে যায়। গাইবান্ধা জেলার সাথীয়া (বাগরপারা) উপজেলা জামায়াত অফিসে একই সময় তান্ডব চালিয়ে অফিসের প্রতিটি জিনিসপত্র নষ্ট করে চেয়ার টেবিলগুলো ভাঙচুর করে। সাদুল্যাপুর থানার তৎকালীন জামায়াত সেক্রেটারি এনামুল হকের ব্যক্তিগত মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে এবং তাকেও আহত করে। কুড়িগ্রাম জেলায় লগি-বৈঠা দিয়ে পিটিয়ে আমাদের প্রিয় ভাই রফিকুল ইসলাম ভাইকে নির্মমভাবে হত্যা করে। অসংখ্য ভাইকে আহত করে। গোটা জেলা শোকে মুহ্যমান হয়ে যায়। পুড়িয়ে দেয় মোটরসাইকেলসহ অনেক জিনিসপত্র। সন্ত্রাসীদের আক্রমণে বালিয়া জামায়াত অফিস যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ২৮ অক্টোবর খুব কম জায়গায় হত্যাযজ্ঞের ঘটনা ঘটলেও ২৯ অক্টোবর প্রায় প্রতিটি জেলা শহরে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের সাথে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের সংঘর্ষ হয়। বিশেষ করে রাজশাহী মহানগরীর সাহেব বাজার জিরো পয়েন্টে আমাদের সমাবেশ ছিলো। সমাবেশে যোগদানের জন্য সকাল থেকেই আমরা রওনা দেই। কেউবা বাসযোগে, কেউবা সাইকেলে, কেউবা রিকশায়। আবার অনেকে নৌকাযোগে যেতে থাকে বিনোদপুর আবাসিকসহ কয়েকটা এলাকায়। আমরা সেদিন জাহাজঘাট থেকে নৌকাযোগে শহরের প্রাণকেন্দ্র পদ্মা গার্ডেনে পৌঁছেছিলাম। ওপার থেকে কাঁচাবাজার হয়ে জিরো পয়েন্টে গিয়েছিলাম। শহরের দিকে যাওয়ার পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি বিনোদপুরে ইসলামিয়া কলেজের মাঠে আমাদের ডেকে নিয়ে বলেছিলেন- হয়তোবা আজ আমাদের অনেক ভাইকে হারাতে হতে পারে। সবাই দোয়া কালেমা পড়ে আল্লাহর ওপর ভরসা করে বের হন। সাহেব বাজারে যাওয়ার পর আমাদের গ্রুপটা দাঁড়িয়ে যায়। সমাবেশ বাম দিকে ঠিক আওয়ামী লীগের অফিসের কাছাকাছি। গ্রুপ লিডার ছিলেন তৎকালীন রাজশাহী কলেজের সভাপতি জুয়েল ভাই। ঠিক ২টার সময় মহাগ্রন্থ আল-কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে আমাদের সমাবেশ শুরু হয়। রাজশাহী মহানগরীর তৎকালীন সভাপতি রোকন উদ্দিন ভাই যখন বক্তব্য দিচ্ছিলেন ঠিক সেই সময় আওয়ামী জানোয়ার সন্ত্রাসীরা ফজলে হাসেন বাদশা ও খায়রুজ্জামান লিটনের নেতৃত্বে আমাদের সমাবেশে নারকীয়ভাবে হামলা চালায়। আমরা আমাদের অবস্থান থেকে যথাসাধ্য চেষ্টা করি মোকাবেলা করার। ফজলে হোসেন বাদশার নেতৃত্বে তারা আসছিলো, বাটার মোড় দিয়ে পালিয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সভাপতি দেলাওয়ার হোসাইন সাইদী ভাই আহত হন। এক পর্যায়ে যখন র‌্যাব এসে মাঝখানে দাঁড়িয়ে যায় তখন যার যার মত সরে পড়তে থাকে। বেলা শেষে সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয় অফিস মহানন্দায় পৌঁছালাম তখন দেখছিলাম অনেক ভাই আহত হয়ে পড়ে আছেন। তাদের কাউকে ক্ষতস্থানে বরফ দেয়া হচ্ছে। কাউকে হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। সালেহী ভাই সবার খোঁজখবর নিচ্ছেন। ২৯ অক্টোবরও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, নীলফামারী, সিরাজগঞ্জ, পাবনাসহ উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ জায়গায় হামলা চালিয়ে অনেক ভাইকে আহত করে। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর নিঃসন্দেহে ইসলামী আন্দোলনপ্রিয় মানুষের জন্য একটা কঠিন পরীক্ষা ছিল। এই পরীক্ষাতে আমি মনে করি মহান রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে উত্তীর্ণ করেছেন। বাতিলের পাহাড়সম ষড়যন্ত্রের মুখে কতিপয় মর্দে মুজাহিদ নির্ভীকচিত্তে দাঁড়িয়ে থাকা কম ঈমানের পরিচয় নয়। কিন্তু আমরা লক্ষ্য করছি, ২৮ অক্টোবরের খুনিরা আজও ঘুরে বেড়াচ্ছে। ইসলামের বিরুদ্ধে নিত্য নতুন ষড়যন্ত্র করছে, তাদেরকে কিছুই বলা হচ্ছে না। সত্যিই এটা বেদনাদায়ক। আমরা এই সকল শহীদের হত্যাকারীদের বিচার হয়তবা পৃথিবীর কোন আদালতে পাবো না। তবে কাল কিয়ামতে আমরা অবশ্যই আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে এই সকল খুনিদের বিচার পাবোই পাবো। যে সকল ভাইকে ২৮ অক্টোবরে হারিয়েছি আল্লাহ তায়ালা যেন তাদের শাহাদাতের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করেন এবং জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করুন। আমিন। লেখক : কেন্দ্রীয় প্রকাশনা সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির