post

মার্কিন নিষেধাজ্ঞা একটি বড় সতর্কসঙ্কেত

হারুন ইবনে শাহাদাত

০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২

সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী ২০২৩ সালের ডিসেম্বর নয় তো ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম দিকে হবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের পল্টন ট্র্যাজেডির পর ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসের ১১ তারিখে নতুন ধারার স্বৈরশাসনে কবলে পড়েছে বাংলাদেশ। ইতিহাসে যা ১/১১ নামে ব্যাপক কুখ্যাতি পেয়েছে। এরপর থেকে দেশে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, তাকে ভোটাধিকার ছিনতাই করে ক্ষমতা দখল ছাড়া অন্য কিছু বলতে রাজি নন নিরপেক্ষ রাজনীতি বিশ্লেষকরা। দখলদার সরকারের হামলা, মামলা, খুন, গুমসহ সীমাহীন অত্যাচার নির্যাতন ও মানবাধিকার হরণের কারণে নির্বাচন চলে গেছে নির্বাসনে। কিন্তু সদ্যসমাপ্ত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে স্বতন্ত্র ও বিদ্রোহী প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটের সাথে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের ব্যবধান জনমনে কিছুটা হলেও আশা জাগিয়েছে। এই আশার আলোয় আরো একটু তেল ঢেলে দিয়েছে আমেরিকার পক্ষ থেকে মানবাধিকার ও ভোটাধিকার হরণ প্রশ্নে এলিট ফোর্স র‌্যাবের ছয়জন কর্মকর্তা এবং বর্তমান পুলিশ প্রধানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা। এই নিষেধাজ্ঞা দেশের জন্য মর্যাদাকর কোনো বিষয় নয়। এটা কোন সচেতন নাগরিকের কাম্যও নয়, কিন্তু তারপরও তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন। কারণ আওয়ামী লীগের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিরোধী তেমন কোনো শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। সরকারের দমননীতি উপেক্ষা করে তারা প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখলেও পেরে উঠছে না। সরকার বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রাম দমনে অতীতের যেকোনো স্বৈরশাসকের চেয়ে বেশি দমনপীড়ন চালাচ্ছে। রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা একটি গণতান্ত্রিক দল, গণতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রামের একটা সীমা আছে, আমরা তো যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারি না।’ অর্থাৎ সরকার জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তাদের ভোটাধিকার হরণ করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। তাই বিরোধী দল রাজপথে দাঁড়াতে পারছে না। জনগণের অধিকার আদায়ে জোরালো ভূমিকা পালন করতে পারছে না। এমন অবস্থায় আমেরিকার এই চাপকে তারা ইতিবাচক হিসেবে নিচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুলের ভাষায়, ‘চাপ থেকে যদি ভালো কিছু হয়, ক্ষতি কী?’

তাই যদিও মনে হচ্ছে দেশের রাজনীতি অতীতের মতো উত্তাপ ছড়াচ্ছে না। কিন্তু তুষের আগুনের মতো ভিতরে ভিতরে ঠিকই জ্বলছে। রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, সেই আগুনের উত্তাপ কোনো নির্দিষ্ট দল, ব্যক্তি বা গোষ্ঠী টের পাচ্ছে এমনটা নয়। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বাধীন রাজপথের প্রধান বিরোধী শক্তি ২০ দলীয় জোট, স্বঘোষিত গৃহপালিত বিরোধী দল জাতীয় পার্টি (এরশাদ), ডান, বাম ও ইসলামপন্থীরাসহ সকল ধারার রাজনীতিই পুড়ছে। সেই আগুনের উৎসমুখ ভোটাধিকার হারানো এবং মানবাধিকার হারানো জনগণের হৃদয়ে জমাট বাঁধা ক্ষোভ এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু দেশের জনগণের প্রতিনিধি বিরোধী দলের দুঃসাহসী, ত্যাগী ও দক্ষ নেতৃত্বের অভাব এবং সরকারের দমনপীড়নের ভয়ে তেমন শক্তিশালী গণআন্দোলন গড়ে উঠছে না। সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ বিরোধী দলের মিছিল-মিটিং, সমাবেশ এমনকি ঘরোয়া বৈঠকের গণতান্ত্রিক অধিকারও কেড়ে নিয়েছে। জনগণের ভোটাধিকার হরণ করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে সরকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মানবাধিকার হরণে বাধ্য করছে। শুধু পুলিশ বাহিনী নয়, এলিট ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)কে ভিন্ন মত দমনের কাজে ব্যবহার করছে সরকার। অথচ ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ এই এলিট ফোর্স চারদলীয় জোট সরকার গঠন করেছে ভয়ঙ্কর অপরাধীদের দমন করার মহৎ উদ্দেশ্যে। এ ক্ষেত্রে এই বাহিনী যথেষ্ট দক্ষতা ও যোগ্যতা প্রমাণ করেছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে চারদলীয় জোট সরকারের সময় এই বাহিনী ব্যবহারের কোন নজির নেই। বিশ্লেষকরা মনে করেন, ১/১১-এর সরকারের সময় থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ভিন্নমত ও বিরোধী দল দমনে ব্যবহার করার খারাপ নজির সৃষ্টি হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় গত ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই চৌকস বাহিনীর ছয়জন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। যার প্রভাব পড়েছে দেশের গোটা রাজনীতির ওপর। বিশ্লেষকরা মনে করেন, সরকার গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষাকে গুরুত্ব না দিলে এর যে সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে তা কারো জন্য শুভ হবে না।

সরকার কি মিয়ানমারের অবস্থা দেখে শিক্ষা নিবে? সরকার লবিস্ট নিয়োগ করে সঙ্কট উত্তরণের পথ খুঁজছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এই পথে সমাধান না খুঁজে সরকারের উচিত গণতন্ত্র মানবাধিকার ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা পরিবর্তনে বিশ্বাসী সকল মতের নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সাথে সংলাপের মাধ্যমে সমাধান খোঁজা। এর বিপরীত পথ মিয়ানমার চীন, ইরান, উত্তর কোরিয়া, রাশিয়া, কিউবা, সিরিয়া, ভেনিজুয়েলার মতো গণতন্ত্রকে নির্বাসনে দিয়ে একদলীয় ব্যবস্থাকে চিরস্থায়ী করে নেয়া। এ পথে হাঁটলে শুধু সরকার নয় গোটা জাতিকেই এর জন্য খেসারত দিতে হবে। কারণ মার্কিন নিষেধাজ্ঞার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। এ ছাড়া মার্কিন নিষেধাজ্ঞা মানে শুধু মার্কিন নয়, কানাডা, ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ার তাদের অনুসরণ করবে। ফলে আমাদের উন্নয়ন সহযোগী সকল মিত্ররা আমাদেরকে বয়কট করবে। এর পরিণতি কতটা ভয়াবহ আমাদের নিকট প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের দিকে তাকালে খুব সহজেই উপলব্ধি করা যায়। একের পর এক বিদেশি কোম্পানি মিয়ানমার থেকে কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিচ্ছে। এবার সেই দলে যোগ দিয়েছে বিশ্বের জ্বালানি খাতের দুই বৃহৎ প্রতিষ্ঠান টোটাল ও শেভরন। শেলও জানিয়েছে আপাতত সেখানে আর কোনো কার্যক্রম চালাবে না। মিয়ানমারের সামরিক সরকারের অব্যাহত মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে ফরাসি প্রতিষ্ঠান টোটাল এনার্জিস ও যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন দেশটিতে তাদের কার্যক্রম বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত ২১ জানুয়ারি শুক্রবার এই ঘোষণা দিয়েছে প্রতিষ্ঠান দু’টি। দেশটির দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে ইয়াদানা গ্যাস প্রকল্পে আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথ বিনিয়োগে যুক্ত ছিল টোটাল ও শেভরন। প্রকল্প থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়ার কারণ হিসেবে দু’টি প্রতিষ্ঠান মিয়ানমারের সামরিক সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা উল্লেখ করেছে। টোটাল এনার্জিস তাদের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, ‘২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে মানবাধিকার, আইনের শাসনসহ মিয়ামারের পরিস্থিতির দিনকে দিন অবনতি হচ্ছে, যার কারণে আমরা পরিস্থিতি পুনঃমূল্যায়নে বাধ্য হয়েছি। আমরা মিয়ানমারের ইয়াদানা গ্যাস ক্ষেত্র এবং এমজিটিসি এর পরিচালনাকারী ও বিনিয়োগকারী হিসেবে টোটাল এনার্জিসের কোনো ক্ষতিপূরণ ছাড়াই চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। শেভরনের মুখপাত্র বলেছেন, মিয়ানমার পরিস্থিতি বিবেচনায় ইয়াদানা প্রাকৃতিক গ্যাস প্রকল্পে থেকে নিজেদের কার্যক্রম হস্তান্তরের মাধ্যমে দেশটি ছাড়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। মিয়ানমারের এই প্রকল্পে সর্বোচ্চ ৩১.২৪ শতাংশের মালিক টোটাল। অন্যদিকে তাদের অংশীদার শেভরনের রয়েছে ২৮ শতাংশ মালিকানা। বাকিটা মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় কোম্পানির মালিকানাধীন। এদিকে রয়্যাল ডাচ শেলও মিয়ানমারে তাদের কার্যক্রম বন্ধের খবর শুক্রবার নিশ্চিত করেছে। সমুদ্রে একটি ব্লকে উডসাইড এনার্জি ও মিয়ানমার পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানির সাথে তাদের যৌথ বিনিয়োগ কার্যক্রম ছিল। রয়টার্সকে প্রতিষ্ঠানের মুখপাত্র বলেন, অনুসন্ধান কাজ পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। যার কারণে এর সাথে কোনো উৎপাদন, বা সরকারের সাথে আমাদের কোনো লেনদেনও নেই।

বিদেশি কোম্পানির মিয়ানমার ছাড়ার হিড়িক শুধু এই তিন প্রতিষ্ঠানই নয় একে একে প্রায় সব বিদেশি বৃহৎ কোম্পানিই মিয়ানমার থেকে তাদের বিনিয়োগ গুটিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এতে আরো বিপাকে পড়ছে দেশটির অর্থনীতি। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্যানুযায়ী, শুধু টোটাল ও শেভরনই ইয়াদানা গ্যাস প্রকল্পের আয় থেকে সরকারকে বছরে এক শ’ কোটি ডলারের বেশি দিত কর ও বিভিন্ন ফি হিসেবে, যা দেশটির বিদেশি মুদ্রা আয়ের এককভাবে সবচেয়ে বড় উৎস ছিল। জ্বালানি খাতে ফ্রান্সের বৃহৎ প্রতিষ্ঠান ইডিএফ দেশটিতে ১৫০ কোটি ডলারের একটি যৌথ বিনিয়োগের পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পে জড়িত ছিল। তারা সেখান থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়েছে। মিয়ানমার ছেড়েছে ফরাসি নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রতিষ্ঠান ভোল্টালিয়াও। মিয়ানমারে সবচেয়ে বড় টেলিকম সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের মালিক নরওয়ের টেলিনর। তারাও গত বছর দেশটিতে তাদের ব্যবসা বিক্রি করে দেয়ার ঘোষণা দেয়। চলতি সপ্তাহে একটি বার্মিজ ডিজিটাল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছে তারা শেয়ার হস্তান্তর করবে। গত অক্টোবরেই ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে তামাকজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ-অ্যামেরিকান টোব্যাকো। দেশটিতে তাদের কর্মী বহরে ছিল এক লাখেরও বেশি মানুষ। জাপানি প্রতিষ্ঠান টোয়োটার মিয়ানমারে গত বছরই একটি কারখানা চালু করার কথা ছিল। সেটি তারা স্থগিত করেছে। সামরিক সরকার ক্ষমতা দখলের পরপরই দুটি কারখানার কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে আরেক জাপানি গাড়ি নির্মাতা সুজুকি। সামরিক অভ্যুত্থানে ধাক্কায় গত কয়েক বছর ধরে ক্রমবর্ধিষ্ণু তৈরি পোশাক শিল্পও। ইতালির বেনেটনের মতো ব্র্যান্ডগুলো এখন তাদের কাছ থেকে পোশাক কেনা বন্ধ করে দিয়েছে। জাপানের পানীয় পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কিরিন গত কয়েক মাস ধরেই মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সাথে তাদের ব্যবসায়িক সম্পর্কের ইতি টানার চেষ্টা করে আসছে। ড্যানিশ বহুজাতিক কোম্পানি কার্লসবের্গের প্রায় সাড়ে চার শ’ কর্মী আছে দেশটিতে। প্রতিষ্ঠানটি সেখানে কার্যক্রম সীমিত করার ঘোষণা দিয়েছে। সব মিলিয়ে এসব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধে বিদেশি বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও মিয়ানমারের সার্বিক অর্থনীতি আরো নাজুক পরিস্থিতিতে পড়ার শঙ্কা তৈরি হচ্ছে।

কী ভাবছেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা? মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বর্তমান ও সাবেক সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা জারি করায় দেশের পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সম্প্রতি রাজধানীতে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম আয়োজিত ইআরএফ ডায়ালগে অংশ নিয়ে বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান তার সংগঠনের তরফ থেকে উদ্বেগের কথা জানান। তিনি উল্লেখ করেন, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও এখনো তৈরী পোশাক রফতানিতে কোনো প্রভাব পড়েনি। তবে এর দৃশ্যমান সমাধান না হলে বা বিষয়টি প্রলম্বিত হলে তৈরী পোশাকের অর্ডার বাতিলসহ এ খাতে নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। তৈরী পোশাক খাতের রফতানিকারকরা তাদের দিক থেকে কাজ করে যাচ্ছেন বলেই মার্কিন ক্রেতাদের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখা সম্ভব হচ্ছে বলে তারা দাবি করছেন। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার প্রভাবসহ করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্টে আবারো লকডাউনের মতো সিদ্ধান্তের আশঙ্কা সামনে রেখে দেশের তৈরী পোশাক খাতসহ সব খাতের বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করারও তাগিদ দিয়েছেন ব্যবসায়ী নেতারা। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মার্কিন অভিযোগগুলো খুবই গুরুতর। এটি হঠাৎ করেই দেয়া দেয়নি। দেশের মানবাধিকার শুধুমাত্র আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিষয় নয়। এর সাথে দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক বাস্তবতা, গণতন্ত্র, সুশাসন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, আইনের শাসন, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, নাগরিক নিরাপত্তাসহ অনেক কিছুই জড়িত রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ও পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর তরফ থেকে বাংলাদেশে নানাভাবে মানবাধিকার ও জননিরাপত্তা লঙ্ঘনের অভিযোগে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী মার্কিন ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান সিনেটর বাংলাদেশে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারির দাবি তুলেছিলেন। সে সময় থেকে বিষয়টির উপর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের সতর্ক দৃষ্টি রাখা এবং প্রয়োজনীয় কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখা দরকার ছিল। এতদিনে হয়তো সরকার বুঝতে পারছেন, বিষয়টি হালকা বা অগ্রাহ্য করার মতো নয়। গার্মেন্টস রফতানির মতো প্রধান রফতানি খাতসহ আমাদের বাণিজ্য, অর্থনীতি ও আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক স্বার্থের বিপরীতে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বড় ধরনের সঙ্কট হিসেবে দেখা দেয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

আগামী নির্বাচন বাঁক বদলের সুযোগ? অতীতের ভুলের সংশোধনের সুযোগ হতে পারে আগামী ২০২৩ সালের জাতীয় নির্বাচন। এই নির্বাচনে জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতেই হবে। তা না হলে সঙ্কট কিছুতেই থামবে না। এ প্রসঙ্গে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত নির্বাচনে জয়লাভ করে ২০১৯ সালের ৭ই জানুয়ারি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ তৃতীয় মেয়াদে সরকার গঠন করে। এর আগে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয়েছিল একতরফা নির্বাচন। পরপর দুটি জাতীয় নির্বাচন ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় আগামী জাতীয় নির্বাচন কেমন হবে সেটি এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। বাংলাদেশে চলমান স্থানীয় নির্বাচনেও জাতীয় নির্বাচনের প্রভাব দেখা যাচ্ছে। বিরোধীদের ভোট বর্জন চলছে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হবার হারও বেশি। আর উপনির্বাচনসহ অনেক ক্ষেত্রে ভোটার উপস্থিতিও কমে গেছে উল্লেখযোগ্য হারে। এ বাস্তবতায় বাংলাদেশে আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে এ বছরটি হবে ঘটনাবহুল। নির্বাচনের প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে প্রস্তুতি এবং সরকারি ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বছর। নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা ফেমার প্রেসিডেন্ট মুনিরা খান মনে করেন আগামী নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বালেন, ‘নেক্সট যে ইলেকশন হবে, আমি মনে করি সব ইলেকশন এমনকি এখন যে ইউপি ইলেকশনগুলো হচ্ছে এগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় প্রত্যেকটা নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ এবং এই নির্বাচনগুলো যাতে সুষ্ঠু, অবাধ নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক হয়ে সেই প্রচেষ্টাই করতে হবে, না হয় গণতন্ত্র ত্রুটিপূর্ণ থেকে যায়। এখন আমাদের গণতন্ত্র উন্নতির প্রথম সোপান। সেটা যদি আমরা করে ফেলতে পারি আমরা পৃথিবীতে একটা ভালো জাতি হিসেবে পরিচিত হতে পারবো।’ যুক্তরাষ্ট্রের উইলসন সেন্টারের উপপরিচালক মাইকেল কুগলম্যান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতিতে গণতন্ত্র এখন অগ্রাধিকার পাচ্ছে। বাইডেন প্রশাসন বলেছে যে গণতন্ত্র হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির শীর্ষ অগ্রাধিকার। বাংলাদেশে র‌্যাবকে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার মধ্য দিয়ে একটা ইঙ্গিত আছে যে ২০২৩ সালের নির্বাচনে কী ঘটবে সেটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করবে। সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক কিভাবে এগিয়ে নেবে সেক্ষেত্রে এর প্রভাব থাকবে। মি. কুগলম্যান বলছেন, ‘আমি মনে করি আগামী নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু হবে। র‌্যাবকে নিষেধাজ্ঞা দেয়াটা বাইডেন প্রশাসনের একটা শক্তিশালী সঙ্কেত। আমি মনে করি বাংলাদেশের নির্বাচন ইস্যুটি বাইডেন প্রশাসন কঠোরভাবেই গণতন্ত্র ও মানবাধিকার লেন্সেই দেখছে। যেটা তাদের পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছে। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই আমি মনে করি গুরুত্বপূর্ণ হলো যুক্তরাষ্ট্র শুধুমাত্র ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিতে বাংলাদেশকে দেখবে না।’

যা করতেই হবে তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বিদেশিরা যাই বলুন না কেন, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও রাজনৈতিক সমঝোতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ নিশ্চিত করতে দৃশ্যমান ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রকাশিত উল্লিখিত এসব তথ্য-উপাত্ত ও সূচক নিঃসন্দেহে কার্যকর গণতন্ত্র, তথা সুশাসন অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতির পরিচায়ক নয়, বরং এ ক্ষেত্রে আমাদের যে ক্রম অবনতি ঘটছে, তারই প্রতিফলন। এটি সুস্পষ্ট যে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকারগুলো ক্রমাগতভাবে সঙ্কুচিত হয়েছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও বর্তমানে ভয়াবহভাবে ভূলুণ্ঠিত। আইনের শাসনের পরিবর্তে অন্যায় করে পার পেয়ে যাওয়ার এক অপসংস্কৃতি আমাদের ওপর জেঁকে বসেছে। আমাদের সংবিধানস্বীকৃত মৌলিক অধিকারগুলো আজ সর্বতোভাবে বিপন্ন। তাই গণতন্ত্র সুশাসন প্রতিষ্ঠার মূলমন্ত্র নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও এগুলো বহুলাংশে অধরাই থেকে গিয়েছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোই যারা ক্ষমতায় আছে কিংবা ক্ষমতায় ছিল কমবেশি দায়ী। তাই জাতি হিসেবে আমাদের আজ জেগে ওঠার সময় এসেছে, তা না হলে এর মাশুল ভবিষ্যতে আমাদের সবাইকেই গুনতে হবে।’

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির