﴿هُوَ الَّذِي جَعَلَكُمْ خَلَائِفَ فِي الْأَرْضِ ۚ فَمَن كَفَرَ فَعَلَيْهِ كُفْرُهُ ۖ وَلَا يَزِيدُ الْكَافِرِينَ كُفْرُهُمْ عِندَ رَبِّهِمْ إِلَّا مَقْتًا ۖ وَلَا يَزِيدُ الْكَافِرِينَ كُفْرُهُمْ إِلَّا خَسَارًا﴾﴿قُلْ أَرَأَيْتُمْ شُرَكَاءَكُمُ الَّذِينَ تَدْعُونَ مِن دُونِ اللَّهِ أَرُونِي مَاذَا خَلَقُوا مِنَ الْأَرْضِ أَمْ لَهُمْ شِرْكٌ فِي السَّمَاوَاتِ أَمْ آتَيْنَاهُمْ كِتَابًا فَهُمْ عَلَىٰ بَيِّنَتٍ مِّنْهُ ۚ بَلْ إِن يَعِدُ الظَّالِمُونَ بَعْضُهُم بَعْضًا إِلَّا غُرُورًا﴾
অনুবাদ
(৩৯) তিনিই তোমাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছেন। এখন যে কেউ কুফরি করবে তার কুফরির দায়ভার তার ওপরই বর্তাবে এবং কাফিরদের কুফরি তাদেরকে এ ছাড়া আর কোনো উন্নতি দান করে না যে, তাদের রবের ক্রোধ তাদের ওপর বেশি বেশি করে উৎক্ষিপ্ত হতে থাকে এবং কাফিরদের জন্য ক্ষতি বৃদ্ধি ছাড়া আর কোনো কিছু নেই। (৪০) (হে নবী!) তাদেরকে বলো, তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে তোমাদের যেসব শরিককে ডাকো কখনো কি তোমরা তাদেরকে দেখেছো? আমাকে বলো তারা পৃথিবীতে কি সৃষ্টি করেছে? অথবা আকাশসমূহে তাদের কি শরিকানা আছে? (যদি এ কথা বলতে না পারো তাহলে তাদেরকে জিজ্ঞেস করো) তাদেরকে কি আমি কোনো কিতাব লিখে দিয়েছি যার ভিত্তিতে তারা (নিজেদের এ শিরকের জন্য) কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণপত্র লাভ করেছে? না বরং এ জালিমরা পরস্পরকে নিছক মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েই চলছে। (সূরা ফাতির : ৩৯-৪০)
নামকরণ
প্রথম আয়াতের فاطر শব্দটিকে এ সূরার শিরোনাম করা হয়েছে। এর মানে হচ্ছে, এটি সেই সূরা যার মধ্যে ফাতির শব্দটি এসেছে। এর অন্য নাম الملائكةএবং এ শব্দটিও প্রথম আয়াতেই ব্যবহৃত হয়েছে। এটি আল কুরআনের ৩৫তম সূরা। এ সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং এর আয়াত সংখ্যা ৪৫টি। আরবি ফাতির: فاطر ; অর্থ আদি স্রষ্টা। এ প্রসঙ্গে তাফসিরে ইবন কাছিরে এসেছে,
عن ابن عباس قال كنت لا أدري ما فاطر السموات والأرض، حتى أتاني أعرابيان يختصمان في بئر، فقال أحدهما لصاحبه أنا فطرتها، أنا بدأتها. فقال ابن عباس أيضًا { فَاطِرِ السَّمَوَاتِ وَالأرْضِ } بديع السموات والأرض .
আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রা. বলেন, আমি শব্দের সঠিক অর্থ সর্বপ্রথম এক বেদুঈন থেকে জেনেছি। ঐ লোকটি তার এক সাথী বেদুঈনের সাথে ঝগড়া করতে করতে এলো। একটি কূপের ব্যাপারে তাদের বিরোধ ছিলো। ঐ বেদুঈনটি বলল أنا فطرتها أنا بدأتها আমিই প্রথমে ওটা বানিয়েছি। ইবন আব্বাস রা. বলেন, فَاطِرِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ এর অর্থ: পৃথিবী এবং আসমানসমূহের উদ্ভাবক। (দুররুল মানসুর, ৭ম খ-, পৃ: ৩; শুয়াবুল ঈমান-১৬৮২; তাফসিরুল কুরআনুল আজিম, ষষ্ঠ খ-, পৃ: ৫৩২)
নাজিলের সময়কাল
বক্তব্য প্রকাশের অভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য থেকে এ কথা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সম্ভবত মাক্কি জীবনের মধ্য যুগে সূরাটি নাজিল হয়। এ যুগেরও এমন সময় সূরাটি নাজিল হয় যখন ঘোরতর বিরোধিতা শুরু হয়ে গিয়েছিল এবং মহানবী সা.-এর দাওয়াতকে ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য সব রকমের অপকৌশল অবলম্বন করা হচ্ছিল।
বিষয়বস্তু ও মূল বক্তব্য
সূরার বক্তব্যের উদ্দেশ্য হচ্ছে, মহানবী সা.-এর তাওহিদের দাওয়াতের মোকাবিলায় সে সময় মক্কাবাসীরা ও তাদের সরদারবৃন্দ যে নীতি অবলম্বন করেছিল, উপদেশের ভঙ্গিতে সে সম্পর্কে তাদেরকে সতর্ক ও তিরস্কার করা এবং শিক্ষকের ভঙ্গিতে উপদেশ দেওয়াও। বিষয়বস্তুর সংক্ষিপ্ত সার হচ্ছে, হে মূখের্রা! এ নবী যে পথের দিকে তোমাদেরকে আহবান করছেন তার মধ্যে রয়েছে তোমাদের নিজেদেরই কল্যাণ। তার বিরুদ্ধে তোমাদের আক্রোশ, প্রতারণা ও ষড়যন্ত্র এবং তাকে ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য তোমাদের সব ফন্দি-ফিকির আসলে তাঁর বিরুদ্ধে নয় বরং তোমাদের নিজেদের বিরুদ্ধেই চলে যাচ্ছে। তার কথা না মানলে তোমরা নিজেদেরই ক্ষতি করবে, তার কিছুই ক্ষতি করতে পারবে না। তিনি তোমাদের যা কিছু বলছেন সে সম্পর্কে একটু চিন্তা করে দেখো তো, তার মধ্যে ভুল কোনটা? তিনি শিরকের প্রতিবাদ করছেন। তোমরা নিজেরাই একবার ভালো করে চোখ মেলে তাকাও। দেখো, দুনিয়ায় শিরকের কি কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে? তিনি তাওহীদের দাওয়াত দিচ্ছেন। তোমরা নিজেরাই বুদ্ধি খাটিয়ে চিন্তাভাবনা করে দেখো, সত্যিই কি পৃথিবী ও আকাশম-লীর স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর এমন কোনো সত্তার অস্তিত্ব আছে যে আল্লাহর গুণাবলি ও ক্ষমতার অধিকারী? তিনি তোমাদেরকে বলছেন, এ দুনিয়ায় তোমরা দায়িত্বহীন নও বরং তোমাদের নিজেদের আল্লাহর সামনে নিজেদের কাজের হিসেব দিতে হবে এবং এ দুনিয়ার জীবনের পরে আর একটি জীবন আছে যেখানে প্রত্যেককে তার কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে হবে। তোমরা নিজেরাই চিন্তা করো, এ সম্পর্কে তোমাদের সন্দেহ ও বিস্ময় কতটা ভিত্তিহীন। তোমাদের চোখ কি প্রতিদিন সৃষ্টির পুনরাবৃত্তি প্রত্যক্ষ করছে না? তাহলে যে আল্লাহ এক বিন্দু শুক্র থেকে তোমাদের সৃষ্টি করেছেন তাঁর জন্য তোমাদেরকে পুনরায় সৃষ্টি করা আবার অসম্ভব হবে কেন? ভালো ও মন্দের ফল সমান হওয়া উচিত নয়, তোমাদের বুদ্ধিবৃত্তি কি এ কথার সাক্ষ্য দেয় না? তাহলে তোমরাই বলো যুক্তিসঙ্গত কথা কোনটি ভালো ও মন্দের পরিণাম সমান হোক? অর্থাৎ সবাই মাটিতে মিশে শেষ হয়ে যাক? অথবা ভালো লোক ভালো পরিণাম লাভ করুক এবং মন্দ লোক লাভ করুক তার মন্দ প্রতিফল? এখন তোমরা যদি এ পুরোপুরি যুক্তিসঙ্গত ও সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত কথাগুলো না মানো এবং মিথ্যা খোদাদের বন্দেগি পরিহার না করো উপরন্তু নিজেদেরকে অদায়িত্বশীল মনে করে লাগাম ছাড়া উটের মতো পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকতে চাও, তাহলে এতে নবীর ক্ষতি কী? সর্বনাশ তো তোমাদেরই হবে। নবীর দায়িত্ব ছিল কেবলমাত্র বুঝানো এবং তিনি সে দায়িত্ব পালন করেছেন।
বক্তব্যের ধারাবাহিক বর্ণনায় নবী করীম সা.কে বারবার এ মর্মে সান্ত¡না দেওয়া হয়েছে যে, আপনি যখন উপদেশ দেওয়ার দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করছেন তখন গোমরাহির ওপর অবিচল থাকতে যারা চাচ্ছে তাদের সঠিক পথে চলার আহবানে সাড়া না দেওয়ার দায় আপনার ওপর বর্তাবে না। এই সাথে তাকে এ কথাও বুঝানো হয়েছে যে, যারা মানতে চায় না তাদের মনোভাব দেখে আপনি দুঃখ করবেন না এবং তাদের সঠিক পথে আনার চিন্তায় নিজেকে ধ্বংস করেও দেবেন না। এর পরিবর্তে যেসব লোক আপনার কথা শোনার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে তাদের প্রতি আপনার দৃষ্টি নিবন্ধ করুন।
ঈমান আনয়নকারীদেরকেও এ প্রসঙ্গে বিরাট সুসংবাদ দান করা হয়েছে। এভাবে তাদের মনোভাব বাড়বে এবং তারা আল্লাহর প্রতিশ্রুতির প্রতি আস্থা স্থাপন করে সত্যের পথে অবিচল থাকবে। (তাফহীমুল কুরআন, ১২ খ-, পৃ: ১৯৯-২০০)
৩৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যা
هُوَ الَّذِي جَعَلَكُمْ خَلَائِفَ فِي الْأَرْضِ ۚ فَمَن كَفَرَ فَعَلَيْهِ كُفْرُهُ ۖ وَلَا يَزِيدُ الْكَافِرِينَ كُفْرُهُمْ عِندَ رَبِّهِمْ إِلَّا مَقْتًا ۖ وَلَا يَزِيدُ الْكَافِرِينَ كُفْرُهُمْ إِلَّا خَسَارًا.
৩৯) তিনিই তোমাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছেন। এখন যে কেউ কুফরি করবে তার কুফরির দায়ভার তার ওপরই বর্তাবে এবং কাফিরদের কুফরি তাদেরকে এ ছাড়া আর কোনো উন্নতি দান করে না যে, তাদের রবের ক্রোধ তাদের ওপর বেশি বেশি করে উৎক্ষিপ্ত হতে থাকে এবং কাফিরদের জন্য ক্ষতি বৃদ্ধি ছাড়া আর কোনোকিছু নেই।
এখানে خَلَائِف শব্দটি خَلِيْفَةٌ এর বহুবচন। এর অর্থ, স্থলাভিষিক্ত, প্রতিনিধি। অর্থাৎ আমি মানুষকে একের পর এক ভূমি, বাসগৃহ ইত্যাদির মালিক করেছি। একজন চলে গেলে অন্যজন তার স্থলাভিষিক্ত হয়। এতে আল্লাহ তায়ালার দিকে রুজু করার জন্য শিক্ষা রয়েছে। তা ছাড়া, আয়াতে উম্মাতে মুহাম্মাদিকেও বলা হতে পারে যে, আমি বিগত জাতিসমূহের পরে তাদের স্থলাভিষিক্তরূপে তোমাদেরকে মালিক ও ক্ষমতাশালী করেছি। সুতরাং পূর্ববর্তীদের অবস্থা থেকে তোমাদের শিক্ষা গ্রহণ করা অবশ্য কর্তব্য। (মুয়ালিমুত তানযিল, তাফসিরে বাগভী, ষষ্ঠ খ-, পৃ: ৪২৫; তাফসীর মাআরেফুল কুরআন, পৃ: ১১২৫)
এর দু’টি অর্থ হতে পারে। এক, পূর্ববর্তী প্রজন্ম ও জাতিদের অতিবাহিত হওয়ার পর এই পৃথিবীর বুকে তিনি তোমাদেরকে তাদের জায়গায় স্থাপন করেছেন। দুই, তিনি পৃথিবীতে তোমাদেরকে বিভিন্ন জিনিস ব্যবহার করার যে ক্ষমতা দিয়েছেন তা তোমাদের এ জিনিসগুলোর মালিক হওয়ার কারণে নয় বরং মূল মালিকের প্রতিনিধি হিসেবে তোমাদের এগুলো ব্যবহার করার ক্ষমতা দিয়েছেন।
এখানে খিলাফতের দায়িত্ব প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা মানুষ সৃষ্টির শুরুর কথা এভাবে বলেছেন,
وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلَائِكَةِ إِنِّي جَاعِلٌ فِي الْأَرْضِ خَلِيفَةً.
“আবার সেই সময়ের কথা একটু স্মরণ কর যখন তোমাদের রব ফিরিশতাদের বলেছিলেন, “আমি পৃথিবীতে একজন খলিফা-প্রতিনিধি নিযুক্ত করতে চাই।” (সূরা বাকারা : ৩০)
খলিফার দায়িত্ব শুধুমাত্র সম্মান বা মর্যাদার জন্য নয় বরং এতে পরীক্ষার উদ্দেশ্যও নিহিত রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَهُوَ الَّذِي جَعَلَكُمْ خَلَائِفَ الْأَرْضِ وَرَفَعَ بَعْضَكُمْ فَوْقَ بَعْضٍ دَرَجَاتٍ لِيَبْلُوَكُمْ فِي مَا آَتَاكُمْ إِنَّ رَبَّكَ سَرِيعُ الْعِقَابِ وَإِنَّهُ لَغَفُورٌ رَحِيمٌ.
“তিনিই তোমাদের করেছেন দুনিয়ার প্রতিনিধি এবং যা কিছু তোমাদের দিয়েছেন তাতে তোমাদের পরীক্ষার উদ্দেশ্যে তোমাদের কাউকে অন্যের ওপর অধিক মর্যাদা দান করেছেন। নিঃসন্দেহে তোমার রব শাস্তি দেওয়ার ব্যাপারে অতি তৎপর এবং তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও করুণাময়।” (সূরা আনআম : ১৬৫)
অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“এখন তাদের পরে আমি পৃথিবীতে তোমাদেরকে তাদের স্থলাভিষিক্ত করেছি, তোমরা কেমন আচরণ করো তা দেখার জন্য।” (সূরা ইউনুস : ১৪)।
আল কুরআনে অন্যত্র এসেছে,
“এবং পৃথিবীতে তোমাদের খলিফা করবেন, তারপর তোমরা কেমন কাজ করো তা তিনি দেখবেন।” (সূরা আ’রাফ : ১২৯)
পৃথিবীর প্রতিনিধিত্ব সত্য সহকারে শাসন কর্তৃত্ব পরিচালনা করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
(আমি তাকে বললাম) “হে দাউদ! আমি তোমাকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেছি, কাজেই তুমি জনগণের মধ্যে সত্য সহকারে শাসন কর্তৃত্ব পরিচালনা করো এবং প্রবৃত্তির কামনার অনুসরণ করো না, কারণ তা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিপথগামী করবে। যারা আল্লাহর পথ থেকে বিপথগামী হয় অবশ্যই তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি, যেহেতু তারা বিচার দিবসকে ভুলে গেছে। (সূরা সোয়াদ : ২৬)।
ঈমান ও সৎ ‘আমলের সমন্বয়ে আল্লাহ তায়ালা খিলাফতের দায়িত্ব ও রাষ্ট্র পরিচালনার মহান কর্তৃত্ব দিয়ে দ্বীনের মজবুতি দিয়ে দেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তোমাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান আনবে ও সৎ কাজ করবে তাদেরকে তিনি পৃথিবীতে ঠিক তেমনিভাবে খিলাফত দান করবেন যেমন তাদের পূর্বে অতিক্রান্ত লোকদেরকে দান করেছিলেন, তাদের জন্য তাদের দ্বীনকে মজবুত ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করে দেবেন, যাকে আল্লাহ তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তাদের (বর্তমান) ভয়-ভীতির অবস্থাকে নিরাপত্তায় পরিবর্তিত করে দেবেন। তারা শুধু আমার বন্দেগি করুক এবং আমার সাথে কাউকে যেন শরিক না করে। আর যারা এরপর কুফরি করবে তারাই ফাসিক।” (সূরা নূর : ৫৫)। পৃথিবীর নেতৃত্ব, কর্তৃত্ব ও উত্তরাধিকারী প্রদান এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“আমি সঙ্কল্প করেছিলাম, যাদেরকে পৃথিবীতে লাঞ্ছিত করে রাখা হয়েছিল তাদের প্রতি অনুগ্রহ করবো, তাদেরকে নেতৃত্ব দান করবো, তাদেরকেই উত্তরাধিকারী করবো। পৃথিবীতে তাদেরকে কর্তৃত্ব দান করবো। এবং তাদের থেকে ফিরাউন, হামান ও তার সৈন্যদেরকে সে সবকিছুই দেখিয়ে দেবো, যার আশঙ্কা তারা করতো।” (সূরা ক্বাসাস : ৫-৬)।
وَاذْكُرُوا إِذْ جَعَلَكُمْ خُلَفَاءَ مِنْ بَعْدِ قَوْمِ نُوحٍ وَزَادَكُمْ فِي الْخَلْقِ بَسْطَةً فَاذْكُرُوا آَلَاءَ اللَّهِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ.
“আর তোমরা স্মরণ করো সেই সময়ের কথা, যখন তোমাদের রব নূহের সম্প্রদায়ের পর তোমাদেরকে তাদের স্থলাভিষিক্ত করেন এবং অত্যন্ত স্বাস্থ্যবান ও সুঠাম দেহের অধিকারী করেন। কাজেই আল্লাহর অপরিসীম শক্তির কথা স্মরণ রাখো, আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে।” (সূরা আ’রাফ : ৬৯)।
“কে তিনি যিনি আর্তের আহবানে সাড়া দেন, যখন সে তাকে ডাকে কাতরভাবে এবং কে তার বিপদ-আপদ-দুঃখ দূর করেন? আর (কে) তোমাদের পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেন? আল্লাহর সাথে কি আর কোন ইলাহ (এ কাজ করেছে)? তোমরা সামান্যই উপদেশ গ্রহণ করে থাক।” (সূরা নামল : ৬২)। যদি পূর্বের বাক্যের এ অর্থ গ্রহণ করা হয় যে, তোমাদেরকে তিনি পূর্ববর্তী জাতিদের স্থলাভিষিক্ত করেছেন তাহলে এ বাক্যটির অর্থ হবে, যারা অতীত জাতি সমূহের পরিণাম থেকে কোনো শিক্ষাগ্রহণ করেনি এবং যে কুফরির বদৌলতে জাতিসমূহ ধবংস হয়ে গেছে সেই একই কুফরি নীতি অবলম্বন করছে তারা নিজেদের এ নির্বুদ্ধিতার ফল ভোগ করবেই। আর যদি এ বাক্যটির এ অর্থ গ্রহণ করা হয় যে, আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে পৃথিবীতে ক্ষমতা দান করেছেন তাহলে এ বাক্যের অর্থ হবে, যারা নিজেদের প্রতিনিধিত্বের মর্যাদা ভুলে গিয়ে স্বাধীন সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে বসেছে অথবা যারা আসল মালিককে বাদ দিয়ে অন্য কারো বন্দেগি করেছে তারা নিজেদের এ বিদ্রোহাত্মক কর্মনীতির অশুভ পরিণাম ভোগ করবে। (তাফহীমুল কুরআন, ১২ খ-, পৃ: ২২৫)
খিলাফতের দায়িত্ব পালনের ব্যত্যয় ঘটলে পরিণাম ভয়াবহ হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“এবং তাদেরকেই পৃথিবীতে স্থলাভিষিক্ত করেছি আর যার আমার আয়াতকে মিথ্যা বলেছিল তাদের সবাইকে ডুবিয়ে দিয়েছি। কাজেই যাদেরকে সতর্ক করা হয়েছিল (এবং তারপরও তারা মেনে নেয়নি) তাদের পরিণাম কী দেখো!” (সূরা ইউনুস : ৭৩)
অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“স্মরণ করো সেই সময়ের কথা, যখন আল্লাহ আদ জাতির পর তোমাদেরকে তার স্থলাভিষিক্ত করেন এবং পৃথিবীতে তোমাদেরকে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন যার ফলে আজ তোমরা তাদের সমতল ভূমিতে বিপুলায়তন প্রাসাদ ও পাহাড় কেটে বাসগৃহ নির্মাণ করছো। কাজেই তাঁর সর্বময় ক্ষমতার স্মরণ থেকে গাফেল হয়ে যেয়ো না এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না।” (সূরা আ’রাফ : ৭৪)
এ আয়াতের শুরুতেই মহান আল্লাহ পৃথিবীতে মানুষকে উত্তরাধিকারী করার কথা বলেছেন। এই বিষয়টিকে মুফাসসিরগণ দুইভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এক, পৃথিবীতে আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষকে প্রতিনিধিত্ব দান এবং দুই, অতীত জাতিগুলোর পরে পরবর্তী জাতির উত্তরাধিকার প্রাপ্তি। দুই ধরনের ক্ষেত্রেই এই আয়াতে মানুষের প্রতি আল্লাহ তায়ালার দয়া ও অনুগ্রহ ফুটে উঠেছে। মহান আল্লাহ মানুষকে এই ভূপৃষ্ঠের ওপর কর্তৃত্ব দান করে গোটা প্রকৃতির সব সুযোগ সুবিধা ভোগ করার অনুমতি দিয়েছেন। ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন মানুষ মাত্রই বলবেন, যিনি এই মহা অনুগ্রহ দান করেছেন তাকে সঠিকভাবে চিনতে এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষ এই বিশ্বজগতের ¯্রষ্টাকে চেনে না এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না। এই অকৃতজ্ঞতা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তায়ালাকে অস্বীকার বা তাঁর কুফরি করার শামিল। কিন্তু এই কুফরি করার ফলে আল্লাহর কোনো ক্ষতি হয় না বরং যে কুফরি করে সে ব্যক্তিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কারণ, আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের কৃতজ্ঞতার মুখাপেক্ষী নন; এমনকি পৃথিবীর বুকে একজন বান্দা না থাকলেও আল্লাহর কিছু যায় আসে না। যেদিন পৃথিবীতে কোনো মানুষ ছিল না সেদিনও তিনি ছিলেন এবং যেদিন কেউ থাকবে না সেদিনও তিনি থাকবেন। কিন্তু যারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে, ঈমান আনবে ও নেক আমল করবে তারা দুনিয়া ও আখিরাতে আল্লাহর রহমত বা দয়া লাভ করবে এবং অকৃতজ্ঞ ও কাফির বান্দারা আল্লাহর ক্রোধের শিকার হয়ে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে।
এখানে এর অর্থ, আল্লাহর নিকট কুফরি কোনো উপকার তো করবেই না, বরং তাতে আল্লাহর ক্রোধ ও অসন্তুষ্টি আরো বৃদ্ধি পাবে এবং মানুষের নিজেরই ক্ষতি আরো বেশি হবে। (তাফসীরে আহসানুল বায়ান)
আল্লাহর বাণী, কাফিরদের কুফরির শাস্তি তাদের পেতেই হবে। একের শাস্তি অপরে বহন করবে না। এ ব্যাপারে তাফসিরে ইবন কাছিরে আছে,
“আর তারা যত কুফরির দিকে অগ্রসর হয়, তাদের ওপর আল্লাহর অসন্তুষ্টি তত বেড়ে যায়। ফলে আখিরাতে তাদের ক্ষতিও আরো বেড়ে যায়। পক্ষান্তরে মু’মিনের বয়স যত বেশি হয় ততই আল্লাহ তাকে বেশি ভালোবাসেন এবং তার সওয়াব বৃদ্ধি পায় এবং জান্নাতে তার মর্যাদার স্তর বৃদ্ধি পায়। আর আল্লাহ রাব্বুল আ’লামিনের কাছে তিনি পছন্দনীয় হয়।” (তাফসীরুল কুরআনিল আজিম, ৬ষ্ঠ খ-, পৃ: ৫৫৭)
৪০ নং আয়াতের ব্যাখ্যা
(হে নবী!) তাদেরকে বলো, তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে তোমাদের যেসব শরিককে ডাকো কখনো কি তোমরা তাদেরকে দেখেছো? আমাকে বলো তারা পৃথিবী কি সৃষ্টি করেছে? অথবা আকাশসমূহে তাদের কি শরিকানা আছে? (যদি এ কথা বলতে না পারো তাহলে তাদেরকে জিজ্ঞেস করো) তাদেরকে কি আমি কোন কিতাব লিখে দিয়েছি যার ভিত্তিতে তারা (নিজেদের এ শিরকের জন্য) কোন সুস্পষ্ট প্রমাণপত্র লাভ করেছে? না বরং এ জালিমরা পরস্পরকে নিছক মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েই চলছে।
এখানে বলা হয়েছে, তোমাদের শরিক শব্দ ব্যবহার করার কারণ হচ্ছে এই যে, তারা তো আসলে আল্লাহর শরিক নয়, মুশরিকরা নিজেরাই তাদেরকে আল্লাহর শরিক বানিয়ে রেখেছে। অথচ শিরক মারাত্মক অপরাধ ও সবচেয়ে বড় কবীরা গোনাহ।
শিরক মারাত্মক অপরাধ। আল্লাহ বলেন,
“তুমি আল্লাহর সাথে শিরক করো না। নিশ্চয়ই শিরক সবচেয়ে বড় অপরাধ।” (সূরা লুকমান : ১৩)
শিরক করলে জান্নাত হারাম এবং জাহান্নাম অবধারিত হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنصَارٍ.
“নিশ্চয়ই যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থাপন করে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করেছেন এবং তার বাসস্থান হবে জাহান্নাম। আর অত্যাচারীদের কোন সাহায্যকারী নেই।” (সূরা মায়িদা : ৭২)
শিরক করলে সব আমল বরবাদ হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
“যদি তারা শিরক করে তাহলে তাদের আমলসমূহ বরবাদ হয়ে যাবে।” (সূরা আন‘আম : ৮৮)
শিরক করলে সব আমল বরবাদ ও ক্ষতিগ্রস্তদের শামিল হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنْ الْخَاسِرِينَ.
“আপনার প্রতি এবং আপনার পূর্ববর্তীদের প্রতি আদেশ করা হয়েছে যে, যদি আপনি আল্লাহর সাথে শরিক স্থাপন করেন তাহলে আপনার আমল নষ্ট হয়ে যাবে এবং আপনি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবেন।” (সূরা যুমার : ৬৫)
আল্লাহ ব্যতীত অন্যদের অর্চনা করলে জাহান্নামের ইন্ধন হতে হবে। আল্লাহ বলেন,
إِنَّكُمْ وَمَا تَعْبُدُونَ مِن دُونِ الله حَصَبُ جَهَنَّمَ.
“অবশ্যই তোমরা এবং তোমাদের যেসব মাবুদকে তোমরা পূজা করো, সবাই জাহান্নামের ইন্ধন হবে। (সূরা আম্বিয়া : ৯৮)
শিরক ব্যতীত অন্যান্য অপরাধ আল্লাহ মাফ করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
إِنَّ اللهَ لاَ يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللهِ فَقَدْ افْتَرَى إِثْمًا عَظِيمً.
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন না, যে লোক তাঁর সাথে শিরক করে। আর তিনি এর চেয়ে নিম্নপর্যায়ের পাপ যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন। আর আল্লাহর সাথে যারা শিরক করে, নিশ্চয়ই তারা মহাপাপে জড়িয়ে মিথ্যা রচনা করে।” (সূরা নিসা : ৪৮)
শিরক ধ্বংসকারী মারাত্মক অপরাধ। এ ব্যাপারে সহিহ সনদে হাদিসে এসেছে,
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ اجْتَنِبُوا السَّبْعَ الْمُوبِقَاتِ. قِيلَ يَا رَسُولَ اللَّهِ وَمَا هُنَّ قَالَ الشِّرْكُ بِاللَّهِ وَالسِّحْرُ وَقَتْلُ النَّفْسِ الَّتِى حَرَّمَ اللَّهُ إِلاَّ بِالْحَقِّ وَأَكْلُ مَالِ الْيَتِيمِ وَأَكْلُ الرِّبَا وَالتَّوَلِّى يَوْمَ الزَّحْفِ وَقَذْفُ الْمُحْصَنَاتِ الْغَافِلاَتِ الْمُؤْمِنَاتِ.
“আবু হুরাইরা রা, বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, তোমরা সাতটি ধ্বংসকারী বিষয় হতে দূরে থাকবে। সাহাবিগণ বললেন, সেগুলি কী? রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, ১) আল্লাহর সাথে অন্যকে শরিক করা, ২) জাদু করা, ৩) নাহকভাবে (অন্যায়ভাবে) কোনো মানুষকে হত্যা করা, যা আল্লাহ হারাম করেছেন, ৪) সুদ খাওয়া, ৫) ইয়াতিমের মাল (অন্যায়ভাবে) ভক্ষণ করা, ৬) জিহাদের ময়দান থেকে পালিয়ে যাওয়া এবং ৭) সরলা নির্দোষ মু’মিনা মহিলাদের নামে ব্যভিচারের অপবাদ দেওয়া।” (বুখারি-২৬১৫, ৬৪৬৫; মুসলিম-২৭২; সুনানু আবি দাউদ-২৮৭৬; ইবনে হিব্বান-৫৫৬১; সুনানুন নাসাঈ-৩৬৭১; শুয়াবুল ঈমান-২৮৪, ৪৩০৯, ৬৬৫৮; কানযুল উম্মাল ফি সুনানিল আকওয়াল ওয়াল আফয়াল-৪৪০৩৯; মিশকাতুল মাসাবিহ-৫২। সনদ: সহিহ)
কোনোক্রমেই শিরক করা যাবে না। যদি সেজন্য হত্যাও করা হয়, কিংবা আগুনে জ্বালিয়েও দেওয়া হয়। সহিহ হাদিসে এসেছে,
عَنْ مُعَاذٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ أَوْصَانِى رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم بِعَشْرِ كَلِمَاتٍ قَالَ لاَ تُشْرِكْ بِاللهِ شَيْئًا وَإِنْ قُتِلْتَ وَحُرِّقْتَ وَلاَ تَعُقَّنَّ وَالِدَيْكَ وَإِنْ أَمَرَاكَ أَنْ تَخْرُجَ مِنْ أَهْلِكَ وَمَالِكَ وَلاَ تَتْرُكَنَّ صَلاَةً مَكْتُوبَةً مُتَعَمِّداً فَإِنَّ مَنْ تَرَكَ صَلاَةً مَكْتُوبَةً مُتَعَمِّداً فَقَدْ بَرِئَتْ مِنْهُ ذِمَّةُ اللهِ وَلاَ تَشْرَبَنَّ خَمْراً فَإِنَّهُ رَأْسُ كُلِّ فَاحِشَةٍ وَإِيَّاكَ وَالْمَعْصِيَةَ فَإِنَّ بِالْمَعْصِيَةِ حَلَّ سَخَطُ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ وَإِيَّاكَ وَالْفِرَارَ مِنَ الزَّحْفِ وَإِنْ هَلَكَ النَّاسُ وَإِذَا أَصَابَ النَّاسَ مَوْتٌ وَأَنْتَ فِيهِمْ فَاثْبُتْ وَأَنْفِقْ عَلَى عِيَالِكَ مِنْ طَوْلِكَ وَلاَ تَرْفَعْ عَنْهُمْ عَصَاكَ أَدَباً وَأَخِفْهُمْ فِى اللهِ.
“মুআয ইবন জাবাল রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. আমাকে ১০টি বিষয়ে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ১) আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করবে না। যদিও তোমাকে হত্যা করা হয় বা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, ২) তুমি তোমার পিতা-মাতার অবাধ্য হবে না। যদিও তারা তোমাকে তোমার পরিবার ও মাল-সম্পদ ছেড়ে বেরিয়ে যেতে বলেন, ৩) ইচ্ছাকৃতভাবে কখনো ফরজ সালাত ত্যাগ করবে না। তার পক্ষে আল্লাহর জিম্মাদারি উঠে যাবে, ৪) কখনোই মাদক সেবন করবে না। কেননা এটিই হল সকল অশ্লীলতার মূল, ৫) সর্বদা গোনাহ থেকে দূরে থাকবে। কেননা গোনাহের মাধ্যমে আল্লাহর ক্রোধ আপতিত হয়, ৬) সাবধান! জিহাদের ময়দান হতে পলায়ন করবে না। যদিও সকল লোক ধ্বংস হয়ে যায়, ৭) যদি কোথাও মহামারী দেখা দেয়, এমতাবস্থায় তুমি যদি সেখানে থাক। তাহলে তুমি সেখানে দৃঢ়ভাবে অবস্থান করবে মৃত্যুর ভয়ে পালাবে না, ৮) তোমার সামর্থ্য অনুযায়ী তোমার পরিবারের জন্য ব্যয় করবে (অযথা কৃপণতা করে তাদের কষ্ট দিবে না), (৯) তাদের ওপর থেকে শাসনের লাঠি তুলে নিবে না এবং ১০) তাদেরকে সর্বদা আল্লাহর ভয় দেখাবে।” (মুসনাদু আহমাদ-২২০৭৫; কানযুল উম্মাল ফি সুনানিল আকওয়াল ওয়াল আফয়াল-৪৪০৪৮; মিশকাতুল মাসাবিহ-৬১; সহিহুত তারগিব ওয়াত তারহিব-৫৭০; ইরওয়াউল গলিল-২০২৬। সনদ: হাসান ও সহিহ)
সবচেয়ে বড় গোনাহ শিরক করা। সহিহ হাদিসে এসেছে,
عن أنس بن مالك رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ عن النبي صلى الله عليه و سلم قال أكبر الكبائر الإشراك بالله وقتل النفس وعقوق الوالدين وقول الزور أو قال وشهادة الزور.
‘‘আনাস ইবন মালিক রা. হতে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ সা. হতে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, সবচেয়ে বড় কবিরা গোনাহ হলো আল্লাহর সাথে শিরক করা, মানুষ হত্যা করা, পিতা-মাতার অবাধ্যতা করা এবং মিথ্যা কথা বলা বা মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া।’’ (বুখারি-৬৪৭৭, ৬৫২১; কানযুল উম্মাল ফি সুনানিল আকওয়াল ওয়াল আফয়াল-৭৮০৮; সুনানুল বাইহাকি আল কুবরা-১৫৬২৮, ২০৬১৮; মিশকাতুল মাসাবিহ-৩৭৭৭। সনদ: সহিহ)
শিরক করা অবস্থায় ইন্তিকাল নিশ্চিতভাবে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। সহিহ বর্ণনায় এসেছে,
عَنْ جَابِرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ أَتَى النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم رَجُلٌ فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ مَا الْمُوجِبَتَانِ فَقَالَ مَنْ مَاتَ لاَ يُشْرِكُ بِاللَّهِ شَيْئًا دَخَلَ الْجَنَّةَ وَمَنْ مَاتَ يُشْرِكُ بِاللَّهِ شَيْئًا دَخَلَ النَّارَ.
“জাবির ইবন আবদুল্লাহ রা. হতে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সা.-এর নিকট উপস্থিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, ইয়া রাসূলাল্লাহ সা.! ওয়াজিবকারী (অবশ্যম্ভাবী) দুটো জিনিস কী? তিনি বললেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে বিন্দুমাত্র শরিক না করে, এমতাবস্থায় ইন্তিকাল করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শরিক করা অবস্থায় ইন্তিকাল করবে সে জাহান্নামে যাবে।” (মুসলিম-২৭৯; মুসনাদু আহমাদ-১৫২০০; সুনানুল বাইহাকি আল কুবরা-১৩০৭৫; কানযুল উম্মাল ফি সুনানিল আকওয়াল ওয়াল আফয়াল-২৭৯, ৩১৫, ৩৫২, ১৪৪০; মিশকাতুল মাসাবিহ-৩৮। সনদ: সহিহ)
৪০ নং আয়াতে শিরক সম্পর্কে কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপন করে আল্লাহর কল্পিত শরিকদের সম্পর্কে মুশরিকদেরকে দলিল পেশ করার জন্য রাসূলুল্লাহ সা.-এর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। বলা হচ্ছে, এসব কল্পিত শরিকরা পৃথিবীর বুকে কোনো কিছু সৃষ্টি করেছে কি? যদি করে না থাকে তাহলে তোমরা বিশ্বজগতের স্রষ্টার সাথে তাদেরকে কিভাবে শরিক করো? যুক্তির বিচারে যে কোনো কিছু সৃষ্টি করেনি সে কি উপাসনার যোগ্য হতে পারে? কিংবা যুগে যুগে নবী-রাসূলদের কাছে পাঠানো কিতাবে কি এমন কোনো উপাস্যের কথা বলা হয়েছে যাদের উপাসনা তোমরা করছ? এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর মুশরিকদের কাছে ছিল না বা এখনো নেই। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
قُلْ هَلْ مِنْ شُرَكَائِكُمْ مَنْ يَبْدَأُ الْخَلْقَ ثُمَّ يُعِيدُهُ قُلِ اللَّهُ يَبْدَأُ الْخَلْقَ ثُمَّ يُعِيدُهُ فَأَنَّى تُؤْفَكُونَ.
“তাদেরকে জিজ্ঞেস করুন, তোমরা যাদেরকে (আল্লাহর সাথে) শরিক করেছ, তাদের মধ্যে কি এমন কেউ আছে, যে প্রথমে সৃষ্টি করেছে, তারপর আবার সৃষ্টি করবে? বলুন, একমাত্র আল্লাহই সৃষ্টি করা শুরু করেছেন, অতঃপর পুনরায় সৃষ্টি করেন। তাহলে তোমরা কোন্ উল্টো পথে পরিচালিত হচ্ছো? (সূরা ইউনুস : ৩৪)
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন,
وَلَئِن سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَسَخَّرَ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ ۖ فَأَنَّىٰ يُؤْفَكُونَ.
“যদি তুমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করো পৃথিবী ও আকাশসমূহ কে সৃষ্টি করেছেন এবং চন্দ্র ও সূর্যকে কে নিয়ন্ত্রিত করে রেখেছেন তাহলে অবশ্যই তারা বলবে আল্লাহ, এরপর এরা প্রতারিত হচ্ছে কোন দিক থেকে?” (সূরা আনকাবুত : ৬১)
অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَلَئِن سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ ۚ قُلِ الْحَمْدُ لِلَّهِ ۚ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْلَمُونَ
“যদি তুমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, পৃথিবী ও আকাশম-লী কে সৃষ্টি করেছেন, তাহলে তারা নিশ্চয়ই বলবে আল্লাহ। বলো, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহরই জন্য। কিন্তু তাদের মধ্য থেকে অধিকাংশ লোক জানে না।” (সূরা লুকমান : ২৫)
অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَلَئِن سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ ۚ قُلْ أَفَرَأَيْتُم مَّا تَدْعُونَ مِن دُونِ اللَّهِ إِنْ أَرَادَنِيَ اللَّهُ بِضُرٍّ هَلْ هُنَّ كَاشِفَاتُ ضُرِّهِ أَوْ أَرَادَنِي بِرَحْمَةٍ هَلْ هُنَّ مُمْسِكَاتُ رَحْمَتِهِ ۚ قُلْ حَسْبِيَ اللَّهُ ۖ عَلَيْهِ يَتَوَكَّلُ الْمُتَوَكِّلُونَ.
“তোমরা যদি এদের জিজ্ঞেস করো জমিন ও আসমান কে সৃষ্টি করেছে? তাহলে এরা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ। এদের বলে দাও, বাস্তব ও সত্য যখন এই তখন আল্লাহ যদি আমার ক্ষতি করতে চান তাহলে আল্লাহকে বাদ দিয়ে যেসব দেবীদের তোমরা পূজা করো তারা কি তাঁর ক্ষতির হাত থেকে আমাকে রক্ষা করতে পারবে? কিংবা আল্লাহ যদি আমাকে রহমত দান করতে চান তাহলে এরা কি তাঁর রহমত ঠেকিয়ে রাখতে পারবে? তাদের বলে দাও, আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। ভরসাকারীরা তারই ওপর ভরসা করে।” (সূরা যুমার : ৩৮)
আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন,
وَلَئِن سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ خَلَقَهُنَّ الْعَزِيزُ الْعَلِيمُ.
“তোমরা যদি এসব লোকদের জিজ্ঞেস করো, জমিন ও আসমান কে সৃষ্টি করেছে, তাহলে এরা নিজেরাই বলবে, ঐগুলো সেই মহাপরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী সত্তা সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা যুখরূফ : ৯)
বরং তারা কেবল অলীক কল্পনার পেছনে ছোটে এবং এসব কল্পিত উপাস্য পরকালে আল্লাহর কাছে সুপারিশ করে তাদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেবে বলে পরস্পরকে ধোঁকা দেয়। তাদের ধারণা মতে, এসব ধর্মীয় নেতা, পীর, পুরোহিত, গুরু, প-িত, মাশায়েখ ও দরগাহের খাদেম এবং এদের এজেন্টরা নিছক নিজেদের দোকানদারির পসরা সাজিয়ে বসার জন্য জনসাধারণকে বোকা বানাচ্ছে এবং নানা গাল গল্প তৈরি করে লোকদেরকে মিথ্যা ভরসা দিয়ে চলছে যে, আল্লাহকে বাদ দিয়ে অমুক অমুক সত্তার শরণাপন্ন হলে তোমাদের দুনিয়ার সব কাজের সমাধা হয়ে যাবে এবং আখিরাতে তোমরা যতই গোনাহ নিয়ে হাজির হও না কেন তারা তা ক্ষমা করিয়ে নেবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَمَا أَمْوَالُكُمْ وَلَا أَوْلَادُكُمْ بِالَّتِي تُقَرِّبُكُمْ عِنْدَنَا زُلْفَى إِلَّا مَنْ آَمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا فَأُولَئِكَ لَهُمْ جَزَاءُ الضِّعْفِ بِمَا عَمِلُوا وَهُمْ فِي الْغُرُفَاتِ آَمِنُونَ.
“তোমাদের এই ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি এমন নয় যা তোমাদেরকে আমার নিকটবর্তী করে; হ্যাঁ তবে যারা ঈমান আনে ও সৎকাজ করে। এরাই এমন লোক যাদের জন্য রয়েছে তাদের কর্মের দ্বিগুণ প্রতিদান এবং তারা সুউচ্চ ইমারতসমূহে নিশ্চিন্তে-নিরাপদে থাকবে।” (সূরা সাবা : ৩৭)
وَالَّذِينَ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَى إِنَّ اللَّهَ يَحْكُمُ بَيْنَهُمْ فِي مَا هُمْ فِيهِ يَخْتَلِفُونَ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي مَنْ هُوَ كَاذِبٌ كَفَّارٌ.
“আর যারা তাঁকে (আল্লাহ) ছাড়া অন্যদেরকে অভিভাবক বানিয়ে রেখেছে (আর নিজেদের এ কাজের কারণ হিসেবে বলে যে) আমরা তো তাদের ইবাদত করি শুধু এই কারণে যে, সে আমাদেরকে আল্লাহ পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিবে। আল্লাহ নিশ্চিতভাবেই তাদের মধ্যকার সেসব বিষয়ের ফায়সালা করে দিবেন যা নিয়ে তারা মতভেদ করেছিলো। আল্লাহ এমন ব্যক্তিকে হিদায়াত দান করেন না, যে মিথ্যাবাদী ও হক্ব অস্বীকারকারী।” (সূরা যুমার : ৩)
এখানে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, আমার লেখা এমন কোনো পরোয়ানা কি তাদের কাছে আছে যাতে আমি এ কথা লিখে দিয়েছি যে, অমুক অমুক ব্যক্তিকে আমি রোগ নিরাময় বা কর্মহীনদের কর্মসংস্থান অথবা অভাবীদের অভাব পূরণ করার ক্ষমতা দিয়েছি কিংবা অমুক অমুক ব্যক্তিকে আমি আমার ভূপৃষ্ঠের অমুক অংশের কর্তৃত্ব দান করেছি এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার লোকদের ভাগ্য ভাঙা-গড়ার দায়িত্ব এখন তাদের হাতে, কাজেই আমার বান্দাদের এখন তাদের কাছেই প্রার্থনা করা উচিত, তাদের কাছেই নজরানা ও মানত করা উচিত এবং যেসব নিয়ামতই তারা লাভ করে সে জন্য ঐ সব ছোট খোদাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। এ ধরনের কোনো প্রমাণপত্র যদি তোমাদের কাছে থাকে তাহলে তা সামনে হাজির করো। আর যদি তা না থাকে তাহলে তোমরা নিজেরাই চিন্তা করো, এসব মুশরিকি আকিদা-বিশ্বাস, চিন্তা- চেতনা ও কর্মধারা তোমরা কিসের ভিত্তিতে উদ্ভাবন করেছো? তোমাদেরকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, পৃথিবী ও আসমানে কোথাও তোমাদের এসব বানোয়াট উপাস্যদের আল্লাহর সাথে শরিক হবার কোন আলামত পাওয়া যায়? এর জবাবে তোমরা কোনো আলামত চিহ্নিত করতে পারো না। তোমাদেরকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে, আল্লাহ কি তাঁর কোনো কিতাবে এ কথা বলেছেন অথবা তোমাদের কাছে বা ঐসব বানোয়াট উপাস্যদের কাছে আল্লাহর দেওয়া এমন কোনো পরোয়ানা আছে যা এ মর্মে সাক্ষ্য দেয় যে, তোমরা যেসব ক্ষমতা-ইখতিয়ার তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট করছো আল্লাহ নিজেই তাদেরকে সেগুলো দান করেছেন? তোমরা এটাও পেশ করতে পারো না। এখন যার ভিত্তিতে তোমরা এ আকিদা তৈরি করে নিয়েছো সেটি কি? তোমরা কি আল্লাহর সার্বভৌম কর্তৃত্বের মালিক, যার ফলে আল্লাহর ক্ষমতা ইখতিয়ার যাকে ইচ্ছা ভাগ বাটোয়ারা করে দিচ্ছো? (তাফহীমুল কুরআন, ১২ খ-, পৃ: ২২৬-২২৭)
বরং এরা আপসে একে অন্যকে পথভ্রষ্ট করতে থেকেছে। তাদের দলপতি ও পীররা বলত যে, এ সকল মা’বুদ তাদের উপকার করবে, তাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেবে এবং তাদের জন্য সুপারিশ করবে। অথবা এই সকল বাক্য শয়তান মুশরিকদেরকে বলত। অথবা তাদের ঐ প্রতিশ্রুতিকে বুঝানো হয়েছে যা তারা একে অপরের সামনে বলাবলি করত যে, তারা মুসলিমদের ওপর বিজয়ী হবে। যাতে তারা নিজেদের কুফরির উপর অটল থাকার উৎসাহ পেত। (তাফসীরে আহসানুল বায়ান)
কাতাদাহ এ আয়াতের তাফসিরে বলেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন, “বলুন, তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে তোমাদের যে সব শরিকদের ডাক, তাদের কথা ভেবে দেখেছ কি? তারা জমিনে কিছু সৃষ্টি করে থাকলে আমাকে দেখাও, তারা এর মধ্য থেকে কিছুই সৃষ্টি করেনি। অথবা আসমানের সৃষ্টিতে তাদের কোনো অংশ আছে কি? না, তারা আসমান সৃষ্টিতেও শরিক নয়। এতে তাদের কোন অংশীদারিত্ব নেই। না কি আমরা তাদেরকে এমন কোন কিতাব দিয়েছি যার প্রমাণের উপর তারা নির্ভর করে। অর্থাৎ নাকি তাদেরকে আমরা কোনো কিতাব দিয়েছি যা তাদেরকে শিরক করতে নির্দেশ দেয়? (জামিউল কুরআন ফি তাবিলিল কুরআন, ইবন জরীর আত ত্বাবারী, ২০ খ-, পৃ: ৪৮০)
তাফসিরে ইবন কাছিরে এসেছে, আকাশম-লীর সৃষ্টিতে তাদের কি অংশ রয়েছে? তারা তো অণু পরিমাণ জিনিসেরও মালিক নয়। এমনকি খেজুরের বিচির সাদা আবরণেরও তারা মালিক নয়। তাই তারা যখন সৃষ্টিকারী নয় এবং সৃষ্টিতে অংশীদারও নয় বরং অণু পরিমাণ জিনিসেরও মালিক নয় তখন তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে তাদেরকে কেন ডাকছো? তাফসিরুল কুরআনিল আজিম, ৬ষ্ঠ খ-, পৃ: ৫৫৭।
بل إنما اتبعوا في ذلك أهواءهم وآراءهم وأمانيهم التي تمنوها لأنفسهم، وهي غرور وباطل وزور.
“প্রকৃত ব্যাপার এই যে, তোমরা শুধু তোমাদের প্রবৃত্তি ও খেয়াল খুশির পিছনে লেগে রয়েছো। দলিল প্রমাণ কিছুই নেই। তোমরা বাতিল, মিথ্যা ও প্রতারণায় জড়িয়ে পড়েছো। এভাবে একে অপরকে তোমরা প্রতারিত করছো।” (তাফসিরুল কুরআনিল আজিম, ৬ষ্ঠ খ-, পৃ: ৫৫৭)
কিয়ামতের কঠিন মুসিবতের দিন এসব অনুসারীরা তাদের নেতৃস্থানীয় ভ্রষ্ট নেতাদের সাথে কী ব্যবহার করবে, সে প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَقَالُوا رَبَّنَا إِنَّا أَطَعْنَا سَادَتَنَا وَكُبَرَاءَنَا فَأَضَلُّونَا السَّبِيلَا﴾﴿رَبَّنَا آتِهِمْ ضِعْفَيْنِ مِنَ الْعَذَابِ وَالْعَنْهُمْ لَعْنًا كَبِيرًا.
“আরো বলবে, “হে আমাদের রব! আমরা আমাদের সরদারদের ও বড়দের আনুগত্য করেছিলাম এবং তারা আমাদের সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করেছে। হে আমাদের রব! তাদেরকে দ্বিগুণ আযাব দাও এবং তাদের প্রতি কঠোর লানত বর্ষণ করো।” (সূরা আহযাব : ৬৭-৬৮)
অন্যত্র আল্লাহ বলেন,
وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا رَبَّنَا أَرِنَا اللَّذَيْنِ أَضَلَّانَا مِنَ الْجِنِّ وَالْإِنسِ نَجْعَلْهُمَا تَحْتَ أَقْدَامِنَا لِيَكُونَا مِنَ الْأَسْفَلِينَ.
“সেখানে এসব কাফির বলবে, ‘হে আমাদের রব, সেই সব জিন ও মানুষ আমাদের দেখিয়ে দাও যারা আমাদের পথভ্রষ্ট করেছিলো। আমরা তাদের পদদলিত করবো, যাতে তারা লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়।” (সূরা হামীম আস সাজদাহ : ২৯)
শিক্ষা
১. আমরা যেমন অতীত জাতিগুলোর স্থলে বর্তমানে পৃথিবীতে অবস্থান করছি তেমনি একদিন আমাদের অনুপস্থিতিতে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মগুলো এ পৃথিবীর নিয়ামত ভোগ করবে। কাজেই আমাদের যা কিছু আছে তা নিয়ে যেন অহঙ্কার না করি এবং আল্লাহর অকৃতজ্ঞ বান্দা না হই।
২. কুফরি অনেক বড় গোনাহের ক্ষেত্র তৈরি করে এবং মানুষকে ধ্বংসের অতল গহ্বরে টেনে নিয়ে যায়।
৩. ইসলামের দাওয়াত দেওয়ার অন্যতম পদ্ধতি হলো, প্রশ্ন উত্থাপন করে শ্রোতার যুক্তি ও বিবেককে জাগিয়ে তোলা।
৪. কুফর ও শিরকের কোনো যৌক্তিক ভিত্তি নেই। ভুল চিন্তাদর্শনের ওপর ভিত্তি করে কাফির ও মুশরিকরা মানুষকে ধোঁকা দেয়।
লেখক : প্রধান মুহাদ্দিস (সহকারী অধ্যাপক), বিজুল দারুল হুদা কামিল স্নাততকোত্তর মাদরাসা, বিরামপুর, দিনাজপুর
আপনার মন্তব্য লিখুন