post

আদর্শ ও নৈতিকতা পরিপন্থী পাঠ্যপুস্তক জাতির বুনিয়াদ ধ্বংস করবে

মুহাম্মদ হাফিজুর রহমান

২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

জাতিসত্ত্বার ভিত্তি নির্মিত হয় শ্রেণিকক্ষে। শ্রেণিকক্ষে পাঠ দান করা হয় পাঠ্যপুস্তক থেকে। শিক্ষানীতির ভিত্তিতে প্রণীত হয় শিক্ষা কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তক। একটি জাতির আদর্শ বিশ্বাস ও সংষ্কৃতির আলোকে নির্ণিত হয় তার শিক্ষাব্যবস্থা। আমাদের শিক্ষানীতিতে কি আছে এটা যদিও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তবে তার চেয়ে বড়ো কথা শিক্ষা কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তক কিভাবে রচিত হলো। পাঠ্যপুস্তকে যা আছে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা তাই শেখে। কোমলমতি শিক্ষার্থীরা শিক্ষানীতি ও শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু বোঝার বিষয় নয়। শিক্ষানীতি ও শিক্ষা কারিকুলামের আলোকে যে পাঠ্যপুস্তক রচিত হবে তাই শিক্ষার্থীরা পড়বে এবং শিখবে। শতকরা নব্বই ভাগ মুসলমানের আবাসভূমি বাংলাদেশ। এ দেশের শিক্ষানীতি ও শিক্ষা কারিকুলাম আমাদের আদর্শ, বিশ্বাস ও চিন্তার সাথে কতটুকু সুসামঞ্জস্য, তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। আমাদের জাতিসত্ত্বার বুনিয়াদকে ক্ষতিগ্রস্থ করার জন্য নানা সময় নানাভাবে আঘাত করা হয়েছে। শিক্ষার মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে নিয়ে অতি রাজনীতি অতীতে করা হয়েছে, বর্তমানেও এ ধারা অব্যহত আছে। যারা শিক্ষার মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট তারা কখনোই এ দেশের মানুষের চিন্তা ও আবেগের বিষয়গুলো ধারণ করে শিক্ষানীতি প্রণয়নের কাজটি করেছেন বলে প্রতীয়মান হয় না। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ২০০৯ সাল হতে শিক্ষানীতি প্রণয়নের কাজ শুরু করা হয়। শুরু থেকে এ শিক্ষানীতি নিয়ে চিন্তাশীল মহলের তুমুল আপত্তি ছিলো। এ সকল আপত্তির জবাবে বার বার বলা হয়েছে আদর্শিক ও নৈতিক বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হবে। কিন্তু বাস্তবে তার উল্টো বিষয়গুলোই ঘটে চলছে। শিশুদের মন নরম এবং কোমল। কোমল হৃদয়-জমিনে সুন্দরের চাষাবাদ হবে। আদর্শ, বিশ্বাস এবং ভালোবাসার সম্মিলনে ফুলের রেনু ফুটবে। সে ফুলের ঘ্রাণে আকাশ বাতাস সুরভিত হবে। স্বপ্নীল সমাজ বিনির্মাণে তারা ভূমিকা রাখবে। কিন্তু নতুন প্রণীত শিক্ষা কারিকুলামের আলোকে যে পাঠ্যপুস্তক রচিত হয়েছে তা কোনোভাবেই আমাদের জাতিসত্বার চিরায়ত বিশ্বাস এবং সংস্কৃতির সথে সঙ্গতিশীল নয়। ভুল দর্শন এবং ভুল চিন্তা থেকে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে এ পাঠ্যপুস্তক রচনা করা হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকে যে বিষয়গুলো সন্নিবেশ করা হয়েছে এ দ্বারা আদর্শ মানুষ তৈরির পরিবর্তে একদল কুপমন্ডক তৈরি হবে। জাতিসত্ত্বার বিনাস সাধনের জন্যই কি পাঠ্যপুস্তকে এ বিষয়গুলো সন্নিবিষ্ট করা হয়েছে? 

অত্র নিবন্ধের শুরুতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, জাতির ভবিষ্যৎ বুনিয়াদ নির্মিত হয় শ্রেণিকক্ষে। শিশু বয়সে পরিবার পিতা-মাতার কাছ থেকে শিশুরা আচার-আচরণ সহ অনেক কিছুই শেখে। কিন্তু শিশু মনে সবচেয়ে বেশি প্রতিভাত হয়ে শ্রেণিকক্ষে তার শিক্ষক তাকে যা পাঠদান করেন সে বিষয়ে। শিশু বয়সে তারা যা শেখে তাদের কোমল হৃদয় তাই ধারণ করে। বিদ্যালয়ের  পাঠ্যবইয়ের পাতা হতে তাকে যা শেখানো হয় সেটাকে সে চরম সত্য হিসেবে গ্রহণ করে। কিন্তু বর্তমান পাঠ্যপুস্তক হতে কি শিখবে আমাদের শিশুরা? বিজ্ঞানমনস্কতার নামে এক আজব ধরনের পাঠ্যসূচী ও পাঠ্যক্রম আমাদের জাতির ওপর চাঁপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। শতকরা নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশে ব্রাহ্মণ্যবাদী শিক্ষা ব্যবস্থা জোর করে হজম করানোর চেষ্টা চলছে। স্বাধীনতার বাহান্নটি বছর পার করলেও আজও আমরা আমাদের জাতিসত্বার আদর্শ ও বিশ্বাসের আলোকে কোনো শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি।

বিগত ১৪-১৫ বছর যাবৎ শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সমাজ সভ্যতা হতে ইসলামী তাহজিব তামাদ্দুন, ইসলামী পরিভাষা, ইসলামের প্রাকটিসিং বিষয়গুলোকে এমনভাবে বিদায় করা হয়েছে যে জাতির অস্তিত্ব আজ হুমকির সম্মূখীন। ইতঃপূর্বে যে সকল আদর্শিক ও নৈতিক বিষয়গুলো ছিলো তা বরং পর্যায়ক্রমে বাদ দেওয়া হয়েছে। এ কাজটি তারা আস্তে আস্তে করেছে।  পাঠ্যবই হতে কি বাদ দিয়েছে আর কি যোগ করেছে তা লিখতে হলে বিশাল কয়েকটি নিবন্ধ লিখতে হবে। পাঠকদের ধারণা দেওয়ার জন্য অতি সংক্ষেপে কিছু বিষয় তুলে ধরছি। 

যা বাদ দিয়েছে 

শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ভাঙা গড়ার খেলা সব সময়ই ছিলো। প্রত্যেক শাসনমালে পাঠ্যপুস্তকে কিছু সংযোজন বিয়োজন হয়েছে। তবে গত দেড় দশকে পাঠ্যপুস্তক হতে ইসলাম, ইসলামী পরিভাষা এবং আদর্শ ও নৈতিকতা সম্পন্ন বিষয়গুলো যেভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে তা আর কোনোকলেই ঘটেনি। যে সকল প্রবন্ধ, গল্প এবং কবিতা হতে শিক্ষার্থীরা তাদের জাতিসত্ত্বার পরিচয় লাভ করতে পারবে, ¯্রষ্টা ও নবী রাসূল সম্পর্কে জানতে পারবে, আদর্শ নৈতিকতা শিখতে পারবে এ সকল বিষয়কে বাদ দেওয়া হয়েছে।  দ্বিতীয় শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবই থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে ‘সবাই মিলে করি কাজ’ শিরোনামে হযরত মুহাম্মদ সা.-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী। তৃতীয় শ্রেণির বাংলা বই থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে ‘খলিফা হযরত আবু বকর’ শিরোনামে তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী। চতুর্থ  শ্রেণিতে বাদ দেওয়া হয়েছে ‘খলিফা হযরত ওমর-এর সংক্ষিপ্ত জীবন চরিত’। 

পঞ্চম শ্রেণির বাংলা বই থেকে ‘বিদায় হজ্জ’ নামক মুহাম্মদ সা.-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী বাদ দেওয়া হয়েছে, বাদ দেওয়া হয়েছে কাজী কাদের নেওয়াজের ‘শিক্ষা গুরুর মর্যাদা’ শীর্ষক কবিতা। কবিতাটিতে একজন ন্যায় পরায়ণ মুসলিম শাসকের মহত্ত্ব এবং শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে আচরণ কেমন হওয়া উচিৎ সেটির বর্ণনা ছিলো। একই বই থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে ‘শহীদ তিতুমীর’র জীবন চরিত। তীতুমীরের জীবন আমাদের জাতিসত্বার সাথে লেপ্টে থাকা এক বীরত্বগাথা ইতিহাস। সে ইতিহাস থেকে বিস্মৃত করে শিশুদেরকে শেকড়কাটা জাতিতে রূপান্তরের এক ঘৃণ্য আয়োজন করেছে বর্তমান পাঠ্যপুস্তক রচয়িতারা। ষষ্ঠ শ্রেণিরবাংলা বই থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লিখিত ‘সততার পুরস্কার’ নামক হাদিসের  শিক্ষামূলক তিন ব্যক্তির ঘটনা, বাদ দেওয়া হয়েছে ‘নীলনদ আর পিরামিডের দেশ’ নামক ভ্রমণ কাহিনী। এই শ্রেণির বাংলা বই থেকে আরো বাদ দেওয়া হয়েছে, মহাকবি কায়কোবাদের ‘প্রার্থনা’ কবিতা। সপ্তম শ্রেণির বাংলা বই থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে ‘মরু ভাস্কর’ নামে হযরত মুহাম্মদ সা.-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী। অষ্টম শ্রেণির বাংলা বই থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে  ‘বাবরের মহত্ত্ব’ এবং সুফিয়া কামালের ‘প্রার্থনা’ কবিতা। এ দুটি বিষয়ই আদর্শিক নৈতিক শিক্ষা সংবলিত। নবম-দশম শ্রেণির বাংলা বই হতে বাদ দেওয়া হয়েছে শাহ মুহম্মদ সগীর রচিত কবিতা ‘বন্দনা’ এবং কবি আওয়ালের ‘হামদ’। বন্দনা এবং হামদ দুটিই মহান স্রষ্টা আল্লাহর সাথে সম্পর্কিত। আল্লাহ, রাসূল, নবী, ফেরেশতা এ সকল শব্দগুলো পাঠ্যক্রম রচয়িতাদের মোটেও যে পছন্দ নয় তা তাদের কর্মকাণ্ড দেখেই বোঝা যায়। একই শ্রেণির  পাঠ্যবই থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে ‘জীবন বিনিময়’ নামক কবিতা। জীবন বিনিময় কবিতায় বাদশাহ হুমায়ুন ও বাবরের জীবনের এক মহত্তম বর্ণনা আছে, যা তাদের পছন্দ নয়। একই শ্রেণি হতে বাদ দেওয়া হয়েছে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত ‘উমর ফারুক’ কবিতাটি। মুসলিম সভ্যতার ইতিহাসকে বাদ দিয়ে তাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই উপমহাদেশে মুসলমানগণ সাথে আটশত বছর যে সর্বোত্তম শাসন ব্যবস্থা উপহার দিয়েছেন, তাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। যাতে করে আমাদের শিশুরা অতীতের সাথে সম্পর্কহীন একটি জাতিতে রূপান্তরের এ কাজটিই করা হয়েছে অত্যন্ত চাতুরতার সাথে। 

যা সংযুক্ত করা হয়েছে

একদিকে যেমন ভালো বিবষয়গুলো বাদ দেওয়া হয়েছে অপরদিকে তার পরিবর্তে আমাদের চিন্তা চেতনা এবং আদর্শ ও বিশ্বাস বিরোধী বিষয়গুলোকে স্থাপন করা হয়েছে। সংযুক্ত করা হয়েছে বিতর্কিত কবি ও  লেখকদের লেখা, যে সকল লেখায় মূলত প্রাধান্য আছে পৌত্তিলকতা এবং আল্লাহর অস্তিত্বহীনতা সম্পর্কে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রায় সকল  পাঠ্যবইয়ে জাতিসত্বার অস্তিত্ব বিরোধী এমন সব বিষয় তারা সংযুক্ত করেছে, আগামী প্রজন্ম যাতে তাদের আত্মপরিচয় ভুলে যেতে পারে। এর মধ্যে পঞ্চম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যে যুক্ত করা হয়েছে, স্রষ্টার অস্তিত্বে অবিশ্বাসী বিতর্কিত লেখক হুমায়ুন আজাদের ‘বই’ কবিতা। বই কবিতায় কুরআনের বিরুদ্ধে এক ধরনের চিন্তার বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে, যাতে আমাদের শিশু শিক্ষার্থীরা কুরআন সম্পর্কে বিতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠে।

ষষ্ঠ শ্রেণির বাংলা বইয়ে যুক্ত করা হয়েছে ‘বাংলাদেশের হৃদয়’ কবিতা এবং লাল গরু নামক প্রবন্ধ। যাতে রয়েছে হিন্দুদের ‘দেবী দুর্গা’র প্রশংসা, সম্ভবতই প্রশ্ন জাগে এ দেশে কতভাগ মানুষ দূর্গার পূজা করে? শতকরা নব্বই ভাগ মানুষের ওপর সেই দেবী দূর্গার বিষয়গুলোকে চাঁপিয়ে দেওয়া হয়েছে। একই শ্রেণির বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে ভারতের হিন্দুদের তীর্থস্থান রাঁচির ভ্রমণ কাহিনী। সপ্তম শ্রেণির বাংলা বইয়ে ‘লালু’ নামক গল্পের মধ্য দিয়ে শেখানো হচ্ছে পাঁঠাবলির বিধি-বিধান। স্কুল ও মাদরাসার ৬ষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে মুসলমানদেরকে এ দেশে আগন্তক, দাঙ্গাবাজ, দখলকারী ও লুটপাটকারী হিসেবে দেখানো হয়েছে। ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজিকে লাইব্রেরী ধ্বংসকারী ও লুটপাটকারী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে রুমানা নামক একটি মেয়ের পরিচয় শিক্ষা দেওয়ার নামে তার সকল পরিচয় উপস্থাপন করা হলেও তার ধর্মীয় ও দেশীয় পরিচয়কে কুটকৌশলের মাধ্যমে বাদ দেওয়া হয়েছে। একই বইয়ে মেসোপটমিও সভ্যতার ইতহাস বর্ণনা করতে মূর্তি আর দেব দেবীর সাথে শিশুদের সম্পৃক্ততাকে বৃদ্ধির অপচেষ্টা চালানো হয়েছে। আর্যদের বর্ণপ্রথাকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। অষ্টম শ্রেণির বইয়ে সংযুক্ত করা হয়েছেরামায়ণের সংক্ষিপ্ত রূপ; রামায়ণ মূলত হিন্দুদের ধর্মীয় গ্রন্থ। একটি শ্রেণিতে একশত জন ছাত্রের মধ্যে হয়তো আট-দশ জন হিন্দু ছাত্র থাকে, তাদের জন্য পৃথকভাবে রামায়ন পড়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তাই বলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্রদের তো রামায়ন পড়া বাধ্যতামূলক করা যায় না। অথচ এ কাজটিই করা হয়েছে চাতুরতার সাথে।

 নবম-দশম শ্রেণির বাংলা বইয়ে যুক্ত করা হয়েছে ‘আমার সন্তান’ কবিতা। এটি ‘মঙ্গল কাব্য’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত একটি কবিতা, এতে রয়েছে দেবী অন্নপূর্ণার প্রশংসা ও তার কাছে প্রার্থনামূলক বিষয়। একই শ্রেণিতে যুক্ত করা হয়েছে ভারতের পর্যটন স্পট ‘পালমৌ’ ভ্রমণ কাহিনী। ফকির লালনের ‘সময় গেলে সাধন হবে না’ শীর্ষক লেখায় রয়েছে বাউলদের বিকৃত যৌনাচার। ‘সাকোটা দুলছে’ কবিতায় দিয়ে ’৪৭-এর ভারত বিভক্তিকে বিতর্কিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এপার বাংলা ওপার বাংলা এক করে দেওয়ার গোপন অভিলাশ এতে চরিতার্থ করা হয়েছে। সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে পর্দা প্রথাকে অত্যন্ত ঘৃণ্য বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আমাদের মা-বোনদেরকে আটা ময়দার বস্তা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। জাতির জন্য সবচেয়ে চিন্তার এবং সর্বনাশা দিকটি হচ্ছে, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পাঠ্য করা হয়েছে ‘নিজেকে জানুন’ শীর্ষক যৌন শিক্ষার বই। কোমলমতি শিশুদের জেন্ডার শিক্ষা, তৃতীয় লিঙ্গ, বয়সন্ধিকালের বিষয়গুলো জানানোর নাম করে তাদেরকে অনৈতিকতা, ও চরিত্রহীনতার দিকে ধাবিত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

নতুন পাঠ্যপুস্তক আরো ভয়ংকর এবং মারাত্মক

বিগত দেড় দশকের এই পরিবর্তন আর সংযোজনের সাথে নতুন করে ২০২৩ সালে যে পাঠ্যবই দেয়া হলো তার বিভ্রান্তি আরো মারাত্মক। বিবর্তনবাদ, পর্দা প্রথার প্রতি বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি। পৌত্তলিকতার প্রতি এক ধরনের আগ্রহ সৃষ্টি করা। স্কুল-মাদরাসার বইয়ের পাতায় পাতায় মূর্তি আর বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে তারা একটি পৌত্তলিক জাতি  তৈরি করার পথকে প্রসস্ত করেছে। প্রতিটি বইয়ে নানান ভুল, অসঙ্গতি, জাতিসত্বা বিরোধী বক্তব্য আমাদের দেশের প্রতিটি নাগরিককে ভাবিয়ে তুলছে। কুকুর-বিড়ালের চিত্র, মুসলিম শাসকদের সূদীর্ঘ কালের ইতিহাসকে বিদ্রুপাত্মকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। শিশুদের সামনে খণ্ডিত ইতিহাস উপস্থাপনের মাধ্যমে তাদের আত্ম বিস্মৃত জাতি হিসেবে গড়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের সোনালী অতীতের বিখ্যাত ব্যাক্তিদের জীবনকে সম্পূর্ণ আড়াল করা হয়েছে। তিতুমীর, শাহাজালাল, হাজী শরীয়ত উল্লাহ, মুন্সী মেহের উল্লাহ আর ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে মুসলমানদের ভূমিকাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়েছে। মুসলিম শাসকদের সোনালী যুগকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

নতুন পাঠ্যপুস্তক ছাপার পূর্বেই এ নিয়ে বেশ আলোচনা ও বিতর্ক চলছিলো। কিন্তু কারো সমালোচনা এবং আলোচনাকে আমলে নেওয়া হয়নি। যে সকল বিষয়ে শিশুদের শেখার কোনো প্রয়োজন নেই সেই সকল অপ্রাসঙ্গিক বিষয় পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ভয়ঙ্কর ও ক্ষতিকর যে বিষয়গুলো নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক তার একটি হচ্ছে বিবর্তনবাদ। ডারউইনের বিবনর্তবাদ একটি বিতর্কিত মতবাদ। কোনোকালেই এটি সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য মতবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বিতর্কিত এই মতবাদটি ষষ্ঠ শ্রেণির শিশু শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যভুক্ত করা হয়েছে। আমাদের আদর্শ, বিশ্বাস এবং চিন্তা বিরোধী এই মতবাদ ষষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলনী বইয়ের ১১৪ ও ১১৫ পৃষ্ঠায় চিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ বইয়ের চিত্রে দেখানো হয়েছে মানুষ আগে বানর ছিল, আর সেখান থেকেই কালের বিবর্তনে ধাপে ধাপে মানুষে রূপান্তরিত হয়েছে। বইয়ের ১১৪ নং পৃষ্ঠার শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘খুঁজে দেখি মানুষের বিবর্তনের ইতিহাস’ এর পরের পৃষ্ঠায় ‘বিভিন্ন সময়ের মানুষ’ শিরোনামে চারটি ছবি প্রদর্শিত হয়েছে। এ চিত্রের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে মানুষ আগে বানর ছিল। এর পরে কয়েকটি ধাপে বানর থেকে মানুষ বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছে।

ডারউউনের তত্ত্ব কতটুকু গ্রহণযোগ্য?

ডারউইনের এ তত্ত্ব কোনোকালেই গ্রহণযোগ্য মত হিসেবে স্থায়িত্ব পায়নি। মানুষ সৃষ্টির এ ইতিহাস ডারউইনের স্বকল্পিত মতবাদ। ডারউইনের মতবাদকে স্বীকার করলে বিশ্ব সৃষ্টি এবং এর পরিচালনায় যে একজন স্রষ্টা ও প্রভূ আছেন তাকে প্রথমে অস্বীকার করে নিতে হয়। অথচ গোটা দুনিয়ায় ধর্ম বিশ্বাসী মানুষ হচ্ছেন বেশি। worldpopulationreview.com-এর তথ্য অনুযায়ী গোটা পৃথিবীতে এথিষ্ট বা ধর্মে অবিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা ৭%। বিশ্বের যে সকল দেশে এথিস্টদের বসবাস তা সবই অমুসলিম দেশ। শীর্ষ পাঁচটি এথিস্ট বসবাসকারী দেশ হচ্ছে চীন, জাপান, ভিয়েতনাম, রাশিয়া, জার্মানী। এ সকল দেশেও কিন্তু তাদের সংখ্যা কোনোক্রমে ২০% এর বেশি নয়। তার মানে এ সকল দেশেও  ৮০%  এর  বেশি  মানুষ ধর্ম  এবং  স্রষ্টায় বিশ্বাসী।  পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী এথিস্টদের সংগঠন হচ্ছে আমেরিকায়। তাদের সংগঠনের নাম AMERICAN ETHIESTS. এই সংগঠনের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যমতে আমেরিকায় নাস্তিক বা স্রষ্টায় অবিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা সর্বসাকুল্যে ৪%। আমাদের দেশে স্রষ্টা অবিশ্বাসী কিছু মানুষ আছে বলে শোনা গেলেও কোনো পরিসংখ্যান বা জরিপে তাদের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এ দেশে সকল মানুষই কোনো না কোনো ধর্মমতে বিশ্বাসী। শতকরা নব্বইভাগ মুসলমানের দেশে ডারইউনের এ মতবাদ কিভাবে পাঠ্য হতে পারে? কোন চিন্তার লোকেরা এ বিষয়গুলো পাঠ্যভুক্ত করেছে? স্রষ্টায় বিশ্বাসী প্রতিটি মানুষ গভীর আস্থা ও বিশ্বাসের সাথে যে বিষয়টি লালন করে তা হচ্ছে, গোটা সৃষ্টি জগতের একজন স্রষ্টা আছেন, তিনিই এ পৃথিবী পরিচালনা করছেন। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় আমেরিকায় এথিস্টরা সুসংগঠিত হলেও তাদের শিক্ষা, সংষ্কৃতিতে এ বিষয়কে উপজীব্য করা হয়নি। তাদের টাকায় লেখা রয়েছে WE TRUST IN GOD। সরকার প্রধানকে বাইবেলের ওপর হাত রেখে শপথ নিতে হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। এমনকি মুসলিম শিশুদের জন্য বেসরকারীভাবে ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। ইংল্যান্ডে মুসলিম এডুকেশন ট্রাস্ট কর্তৃক বিভিন্ন সরকারী স্কুলে ধর্মীয় শিক্ষক সরবরাহের ব্যবস্থা আছে। ইউরোপ আমেরিকার মতো দেশগুলোতে বিবর্তনবাদ পড়ানো হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাদের দেশে শিশুদের জন্য এ মতবাদ পাঠের কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এমনকি কোনো ধর্মমতের মানুষই এ মতবাদকে গ্রহণ করেনি। স্রষ্টার অস্তিত্বে যারা অবিশ্বাসী তারা কেবলমাত্র এ মতবাদকে গ্রহণ করতে পারে। এর দ্বারা বোঝা যায় কোনো মুসলিম দেশেই স্রষ্টা অবিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা গণনার মধ্যে পড়ে না।

ডারউইনের পেশকৃত বিবর্তনবাদ এক সময় পৃথিবীর এক বিরাট সংখ্যক মানুষ গ্রহণ করেছিলো বলে তাকে মানোত্তীর্ণ বা সত্যের মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ বলার কোনো সূযোগ নেই। ডারউইন একটি তত্ত্ব পেশ করেছেন মাত্র। এ তত্ত্বটি যে একমাত্র ডারইউনই পেশ করেছেন এমন নয়, তার পূর্বে আরো বেশ কয়েকজন এ তত্ত্ব পেশ করেছেন। তারা পৃথিবীর গোটা ব্যবস্থাপনাকে একটি যন্ত্রের সাথে তুলনা করেছেন। এ যন্ত্র নিজ ইচ্ছায় চলছে, চলতে গিয়ে কখনো কোনো পার্টস ছিটকে পড়ে অন্য যন্ত্রে রূপান্তর ঘটেছে। এ বিশ^ ব্যবস্থাপনা আপনা আপনিই পরিচালিত হচ্ছে। এর কোনো ¯্রষ্টা বা নিয়ন্তা নেই। প্রয়োজনের তাগিদে এ পৃথিবীর একটির পর একটি ঘটনা ঘটছে আর এক ধরনের প্রাণীর সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষও তেমন এক সৃষ্টি। পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণী তীব্র লড়াইয়ে লিপ্ত। এ লড়াইয়ের তিনি নাম দিয়েছেন টিকে থাকার সংগ্রাম। ডারউইনের পূর্বে আরো কয়েকজন বিজ্ঞানী দাবীদার ব্যক্তি এ মতবাদ পেশ করেছেন। তারা হচ্ছেন, বুফন, ডারউইনের দাদা আরাসমুস ডারউইন. লা মার্ক, রেনে ডেকার্টে, ও লেম্বার্ট। ফরাসী প্রকৃতি বিশারদ লা মার্ক বিবর্তনবাদকে বিষদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, তিনি তার বইতে লিখেছেন, যে সকল অঙ্গের ব্যবহার অতি দ্রুত হয়, তা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, যার ব্যবহার বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় না, তা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। লা মার্কের থিওরীর আলোকে চার্লস ডারউইন ব্যাখ্যা করেছেন যে, বানর বা শিম্পাঞ্জীর লেজ যেহেতু কম ব্যবহৃত হয়েছে তাই তা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে আজকের মানুষে পরিণত হয়েছে।

জীবনের কোনো এক পর্যায়ে চার্লস ডারউইন ম্যালথুসের জনসংখ্যা বিষয়ক প্রবন্ধগুলো পড়েন। এ প্রবন্ধ পাঠে  তার মনে ধারণা জন্মে যে, যারা সংগ্রামে টিকে থাকতে পারবে পৃথিবীতে তারাই স্থায়ী হবে। ডারউইন তার বইয়ে জিরাফের গলা বড় হওয়ার ব্যাখ্যায় বলেছেন, তীব্র খড়ার কারণে যখন তৃণলতা কমে গেছে তখন উচু ডালের পাতা খেতে খেতে এক সময় এর গলা বড় হয়ে গেছে। তিনি প্রাকৃতিক জ্ঞান অর্জনের জন্য ইউরোপ, অফ্রিকা এবং এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ সফর করেছিলেন। এ সফরে নানান অঞ্চলের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সাথে তার যেমন সাক্ষাৎ হয়েছে আবার বেশ কিছু মৃত প্রাণীর ফসিল সংগ্রহ করে সাথে নিয়ে গিয়েছেলেন। এগুলো থেকে তার ধারণা জন্মেছে যে, পৃথিবীতে একটি প্রাণী অপর প্রাণীর পরবর্তী প্রজন্ম। ডারউইনের মতবাদ সম্পর্কে জানার আগে আমাদের একটি বিষয়ে অত্যন্ত সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে যে, ডারউইনের এ মতবাদ যখন খ্যাতি অর্জন করে তখন গোটা ইউরোপ জুড়ে গীর্জা ও বিজ্ঞানের সাথে চরম দ্বন্দ্ব সংঘাত চলছিলো। ইউরোপে তখন গীর্জার একাধিপত্য চলছিলো। গীর্জার পাদ্রীরা নিজেদেরকে খোদার আসনে বসিয়ে জনগণের ওপর চরম জুলুম ও নির্যাতন করতো আবার পাদ্রীদের বড়ো একটি অংশ ছিলো যারা নিজেদেরকে কষ্টের পর কষ্টের মধ্যে নিপতিত করে স্রষ্টার ভালোবাসা অর্জনের চেষ্টায় রত থাকতো। ¯্রষ্টার ভালোবাসা পাবার আশায় দিনের পর দিন তারা না খেয়ে থাকতো, ভালো গমকে পঁচিয়ে তীব্র গন্ধযুক্ত আটা দিয়ে রুটি বানিয়ে খেতো। আরামের বিছানার পরিবর্তে কষ্টদায়ক পেড়েক ওয়ালা কাঠের চৌকিতে রাত যাপন করতো। বিয়ে সংসার, স্ত্রী ও সন্তান গ্রহণকে চরম পাপ মনে করতো। পাদ্রীদের এ আত্মনীপিড়ণমূলক নীতি দেখে জনগণের মনে এ ধারনা জন্মেছে, গীর্জা যে স্রষ্টার কথা বলে তিনি একজন চরম অত্যাচারী শাসক বৈ কিছুই নয়! জনগণ মনে করতো, মানুষকে দুঃখ-কষ্ট দিয়ে স্রষ্টা আনন্দ লাভ করেন- (নাউযুবিল্লাহ)। বস্তুত এ ধারণা যে সমাজে বর্তমান থাকে সেখানে স্রষ্টা সম্পর্কে ইতিবাচক ধারনা জন্ম নেওয়া সম্ভব নয়। আর এ কারণেই ডারউইনের সমসাময়িককালে তার মতবাদ দেশে দেশে সমাদৃত হয়। কিন্ত পরবর্তীতে জ্ঞান ও বিজ্ঞান গবেষণার উন্নতি এবং ইসলামী রেনেসার প্রভাবে এ মতবাদের অসারতা জনগণের কাছে পরিস্কার হয়ে যায়।

স্রষ্টা বিশ্বাসী মানুষ কি বিবর্তনবাদকে মেনে নিতে পারে?

বিবর্তনবাদের যে ছবি স্কুল ও মাদরাসার  পাঠ্যবইয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে, কোনো বিশ্বাসী মানুষ তাকে গ্রহণ করতে পারে না। শতকরা নব্বইভাগ মুসলমানের দেশে এ ধরণের কুশিক্ষাকে গ্রহণ করার কোনো সূযোগ নেই। মানুষ যদি তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে উপর্যুক্ত থিওরীগুলোর কোনো একটি বিশ্বাস করে তবে স্বাভাবিকভাবেই সে মনে করবে আমার সৃষ্টিই যেহেতু কোনো একটি দূর্ঘটনার ফল তবে সে তাঁর মানবীয় বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে উদ্দেশ্য লক্ষ্যহীন জীবন যাপনে অভ্যস্ত হবে। এ থিওরীগুলোর একটিও কোনো সুবিবেচনাপ্রসূত মতের ভিত্তিতে দেওয়া হয়নি। মানুষ এ পৃথিবীর কোনো বল্গাহীন প্রাণীও নয়, উদ্দেশ্যহীনভাবেও তাকে সৃষ্টি করা হয়নি। কোনো বানর কিংবা শিম্পাঞ্জী হতেও তাকে সৃষ্টি করা হয়নি। পৃথিবীর একজন চালক এবং স্রষ্টা যেমন আছেন একইভাবে তিনি তাঁর নিপুন হাতে এ মহাবিশ্ব পরিচালনা করছেন। মহাবিশ্বের ক্ষুদ্র এক গ্রহে হচ্ছে পৃথিবী। মহাবিশ্বের অন্যান্য নক্ষত্রগুলো পৃথিবীর চেয়ে কয়েকগুণ বড়োই শুধু নয়, কোনো কোনো নক্ষত্র কয়েক হাজার গুণ বড়ো। মানুষ নামক প্রাণী অন্য কোনো গ্রহে বা জগতে আছে কি-না, তা আমাদের জ্ঞানের অতীত। আমার যে গ্রহে বাস করি সেখানকার প্রধান নিয়ামক শক্তি মানুষ। এ পৃথিবীর যেমন একজন স্রষ্টা আছেন, একইভাবে মানুষকেও সেই স্রষ্টাই সৃষ্টি করেছেন। স্রষ্টা মানুষকে এক মহান উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন। এক বিশেষ মর্যাদা ও দায়িত্ব দিয়ে মানুষকে পাঠিয়েছেন। দুনিয়ার এ ক্ষণস্থায়ী জীবনই তার শেষ নয়, আবার এ জীবনের পরে তার পৃথিবীতে দ্বিতীয়বার ফিরে আসারও কোনো সূযোগ নেই। যিনি এ মহাবিশ্বের স্রষ্টা, পরিচালক, স্রষ্টা, রাজাধিরাজ তিনি  হলেন- আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। মানুষের সৃষ্টি রহস্য তিনিই মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন। 

মানুষ সৃষ্টির মূল রহস্য

মানুষ আল্লাহর এক অপরুপ সৃষ্টি। সুন্দর দেহ সৌষ্ঠব দিয়ে মহান স্রষ্টা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের হাত পা চোখ কান নাক সকল কিছুই অন্যান্য সকল প্রাণীর চেয়ে ব্যতিক্রম। সৃষ্টিরাজীর মধ্যে যতো প্রাণী আছে তাদের মাথা নিচের দিকে অবনমিত করা, কিন্তু মানুষ একমাত্র প্রাণী যে মাথা উচু করে হেটে বেড়োয়। পা-হীন সরীসৃপ প্রাণীগুলোকে আমরা মাটিতে চলাচল করতে দেখি, চার পা ওয়ালা প্রাণীকে আমরা জমিনে চলাচল করতে দেখি, লম্বা গলাযুক্ত জিরাফ কিংবা বিশাল বপুর জলহস্তিকেও আমরা দেখি। আফ্রিকার জঙ্গলে বসবাসরত বিশাল বপুর শিম্পাঞ্জী আমরা কেউ কেউ বাস্তবে অথবা বিভিন্ন চিত্রে আমরা দেখেছি। মানুষের সৃষ্টিকাঠামোর সাথে কিছুটা সাদৃশ্য থাকলেও এগুলো দেখতে কিম্ভুতকিমাকার। সৃষ্টিরাজ্যে যতো প্রাণী আছে তার মধ্যে মানুষের আকৃতিই সর্বোত্তম। মানুষের হাত-পাগুলো শরীরের আকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে দৈর্ঘ্য দেওয়া হয়েছে। এরচেয়ে যদি দৈর্ঘ্যরে পরিমাণ বেশী হতো কেমন দেখা যেতো, তা আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি? চোখগুলো ভ্রুযুগলের ওপরে না দিয়ে কপালের উপরিভাবে দিলে কেমন দেখা যেতো, তাও আমরা অনুমান করতে পারি। কোনো দূর্ঘটনার ফলে সৃষ্ট কোনো প্রাণীর সৃষ্টি সৌন্দর্য অথবা স্রষ্টাবিহীন কোনো কিছু এতো সুন্দর হতে পারে না। আমাদের হাতের আঙুলগুলো অনায়াসে আমরা নড়াচাড়া করতে ও ইচ্ছেমতো ব্যবহার করতে পারি। পা দুটোকে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করে যত্রতত্র ঘুরে বেড়োই। দেহের সাথে অপরাপর অঙ্গগুলোর কথা যদি আমার ভাবি, মাথা, কান, নাক, চোখ এগুলো বর্তমান আকৃতির চেয়ে যদি অনেক বড়ো কিংবা ছোট হতো দেখতে সুন্দর মানুষকে কেমন কিম্ভুতকিমাকার দেখা যেত ? এমন কিম্ভুতকিমাকার প্রাণী পৃথিবীতে আছে। কিন্তু মানুষকে আল্লাহ সেভাবে সৃষ্টি করেননি। কেননা, মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত। মানুষের চোখ, চোখের চাহনি, তার ভ্রু-যুগল, মাথার কালো কেশদাম সকল কিছুই সৌন্দর্যের এক প্রতিচ্ছবি। মানুষের আকার আকৃতি, তার গঠন-প্রকৃতি সকল কিছুই পৃথিবীর অপরাপর সৃষ্টিরাজির মধ্যে সর্বোত্তম। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেন- ‘‘আমি মানুষকে উত্তম আকৃতিতে সৃষ্টি করেছি’’ (সূরা তীন : ৪)

আল্লাহ মানুষকে শুধু সুন্দরভাবে সৃষ্টিই করেননি। মানুষকে গঠন করেছেন সকল কিছুর উপযোগী করে। অর্থাৎ এ পৃথিবীর আলো, পানি, বাতাস, আবহাওয়া সকল কিছুর সাথে যেন মানুষ নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে এর উপযোগী করে মানুষকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। শুধু উপযোগী করেই সৃষ্টি করেননি। পৃথিবী নামক গ্রহে যত সৃষ্টি আছে সকল কিছুর ওপর মানুষকে কর্তৃত্ব করার, এগুলোকে ভোগ-ব্যবহার করার শক্তি ও ক্ষমতা দিয়েছেন। পৃথিবীর বড়ো বড়ো প্রাণীর ওপর মানুষ তার বুদ্ধি-জ্ঞান দিয়ে কর্তৃত্ব করে। বিশালদেহী হাতির ওপর একজন মাহুত বসে তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। একপাল মহিষ অথবা ঘোড়াকে একজন রাখাল অনায়াসে একস্থান হতে অন্যস্থানে নিয়ে যায়। মাটির অভ্যন্তরের বিশাল বিশাল খনিজসম্পদ মানুষ আহরণ করে। সমুদ্রের বিশাল বিশাল ঢেউ মোকাবিলা করে জাহাজগুলো নিয়ন্ত্রণ করে এক বন্দর হতে অন্য বন্দরে নিয়ে যায়। খনিজ লোহাকে কাজে লাগিয়ে ধারালো অস্ত্র, ব্যবহার্য সামগ্রী, জাহাজ, বিল্ডিংসহ সকল কাজে ব্যবহার করছে মানুষ। পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করা,  বাতাসকে নিয়ন্ত্রণ করেই বিমান পরিচালনা করা- এ সকল কিছুই করছে মানুষ। উষর মরুর অনাবাদী ভূমিকে চাষাবাদের উপযোগী করে গড়ে তুলছে। সমুদ্রের তলদেশ হতে আন্ডারপাস তৈরি করে দুটি দেশের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করছে মানুষ। মহাকাশযান পরিচালনা করে মহাবিশ্বকে জানার চেষ্টা করছে। মানুষের দ্বারা এগুলো সম্ভব হচ্ছে এ কারণে যে, আল্লাহ মানুষকে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করার মতো বুদ্ধি, জ্ঞান এবং কৌশল দান করেছেন। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহর ঘোষণা- ‘‘তিনি যমীন ও আসমানের সমস্ত জিনিসকেই তোমাদের অনুগত করে দিয়েছেন। সবই তাঁর নিজের পক্ষ থেকে। এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্য বড়ো বড়ো নিদর্শন রয়েছ্’’ (সূরা জাসিয়া : ১৩)

আল্লাহই মানুষেরও স্রষ্টা এবং বানরেরও স্রষ্টা। মানুষকে আল্লাহ যে মর্যাদা ও দায়িত্ব কর্তব্য দিয়েছেন, তাকে যে সৌন্দর্য দিয়েছেন, পৃথিবীর আর কোনো প্রাণীকে তিনি তা দেননি। আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেন- ‘‘তিনি আসমান ও যমীনকে যথাযথভাবে সৃষ্টি করেছেন, তিনি তোমাদেরকে আকার আকৃতি দান করেছেন এবং অতি উত্তম আকার আকৃতি দান করেছেন। অবশেষে তাঁর কাছেই তোমাদেরকে ফিরে যেতে হবে’’ (সূরা তাগাবুন : ০৩)

মানুষকে আল্লাহ প্রথমে সুগঠিত করেছেন। তাঁর দেহের অঙ্গগুলো একটির সাথে আরেকটির সংযোজন আল্লাহর সৃষ্টি রহস্যের অনন্য বহিঃপ্রকাশ- এরপর তিনি তাতে রুহ ফুকে দিয়েছেন। এগুলো আল্লাহর একটি হুকুমের ব্যাপার। তিনি কুন-ফায়াকুনের মালিক, হও বললেই সকল কিছু হয়ে যায়। তারপরও তিনি মানুষকে সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে একটি ধারাবাহিকতা অবলম্বন করেছেন। আল্লাহ এই ধারাবাহিকতা বর্ণনা করে মানুষকে বোঝালেন তোমরা আমার যেনতেন সৃষ্টি নও। আমি যে মহান দায়িত্ব পালনের জন্য তোমাদের সৃষ্টি করেছি। সে জন্য আমি কুন-ফায়াকুনের মালিক হওয়া সত্বেও একটি নিয়ম এবং ধারাবহিকতার মধ্যে তোমাদের সৃষ্টি করেছি। তোমাদের জীবনের প্রতি পদে পদে তোমাদেরকে ধারাবাহিকতা, নিয়ম, শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে। একইসাথে তোমাদের দায়িত্ব,কর্তব্য এবং মর্যাদার কথা স্মরণ রাখতে হবে। সে কথাই কুরআনে নিম্মোক্ত ভাষায় বর্ণিত হয়েছে- ‘‘অতঃপর তিনি তাকে সুগঠিত করেছেন এবং তাতে ফুঁকে দিয়েছেন তাঁর রূহ হতে আর তোমাদের দিয়েছেন কান, চোখ ও অন্তর; অথচ তোমরা অতি সামান্যই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।’’ চার্লস ডারইউনের থিওরী যদি আমরা মেনে নেই তবে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে শিম্পাঞ্জী, বানর কিংবা ওরাংওটাংয়ের দেহের গঠন, তার আকৃতি, তার চেহারার লাবণ্যতা কি মানুষের মতো? ওটাতো এক প্রকার কিম্ভুতকিমাকার প্রাণী। অথচ মানুষের রূপ আবয়ব কত সুন্দর। যার বর্ণনা আল্লাহ কুরআনে দিয়েছেন। আমাদের শিশুদেরকে জীবনের শুরুতে তার স্রষ্টা সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার পরিবর্তে স্রষ্টায় বিশ্বাসী নয় এমন এক আজব তামাসামূলক মতবাদের দীক্ষা দেওয়ার যে প্রতারণামূলক ফাঁদ পাতা হয়েছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে আমাদের শাসককুল একদল ধর্মহীন, আদর্শহীন লম্পট নাগরিক তৈরির গভীর ষড়যন্ত্রে তারা লিপ্ত। 

পাঠ্যপুস্তক নতুনভাবে লিখতে হবে

এ দেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের চিন্তা, বিশ্বাস আর আদর্শের বিপরীতে কাদের নির্দেশে আর কোন স্বার্থে এবং কাদেরকে খুশি করার জন্য এ পাঠ্যপুস্তক রচনা করা হয়েছে তা দেশের প্রতিটি বিবেকবান নাগরিকের আবেগ ও বিবেকের প্রশ্ন। এ পাঠ্যবই ফেরত নিয়ে নতুন করে বই রচনা এখন প্রতিটি চিন্তাশীল নাগরিকের বিবেকের দাবী। আমাদের আদর্শ বিশ্বাস চিন্তা ও সংস্কৃতির সাথে সঙ্গতিশীল বিষয়গুলোকে ধারণ করে পাঠ্যবই নতুনভাবে রচনা করতে হবে। পাঠ্যবই রচনায় অবশ্যই কোন ভুল ও চিন্তা দর্শনের অধিকারী লোককে সম্পৃক্ত করা যাবে না। বই রচনায় দেশের বিদগ্ধজন, আলেম, ইসলামী চিন্তাবিদ ও প্রথিতযশা শিক্ষাবিদদের দায়িত্ব দিতে হবে।

লেখক : বিশিষ্ট কলামিস্ট ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির