আবেগ, অনুভূতি ও প্রেরণায় শহীদ রেজবুল হক প্লাবন
মো: ফয়সাল কবির রানা
২৪ এপ্রিল ২০১৮
“যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয় তাদের তোমরা মৃত বলো না বরং তারা জীবিত কিন্তু তোমরা তা উপলব্ধি করতে পারো না।” (সূরা বাকারা : আয়াত-১৫৪)
ছায়া ঢাকা সুনিবিড় পত্রপল্লবে সাজানো গাইবান্ধা জেলার অন্তর্গত শহর থেকে অদূরে ফুলছড়ি উপজেলার একটি ছোট্ট গ্রাম কাতলামারী। আঁকাবাঁকা মেঠোপথ, নদী-নালা, খাল-বিল সব কিছুই সাজানো। গ্রামের মানুষগুলোও যেনো মাটির স্পর্শে বেড়ে ওঠা-নদী ভাঙনের সাথে যুদ্ধ করা সবুজ সৈনিক। মসজিদ, মক্তব, স্কুল, দিগন্ত বিস্তৃত ফসলি জমি আর ফুল ফলে সুশোভিত গ্রামটিতে এলে যে কোনো ব্যক্তিই আকৃষ্ট হবেন। প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করা এমনি একটি মুসলিম মধ্যবিত্ত পরিবারে ১৯৮৭ সালের ৫ আগস্ট জন্মগ্রহণ করে ছেলেটি।
বাবা একজন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট, মা গৃহিণী আর ছোট বোনকে নিয়ে তাদের পরিবার। লেখাপড়ার প্রয়োজনে থাকতে হতো তার দাদাবাড়ি পলাশবাড়ি উপজেলার পবনাপুর গ্রামে। ২য় শ্রেণী পর্যন্ত দাদাবাড়ি লেখাপড়ার পর ভর্তি হন গৃধারিপুর ইউনিয়নের ‘দারুল ইসলাম একাডেমি’তে। সেখানে ৩য় শ্রেণীতে লেখাপড়া করার সময় ১৯৯৬ সালে তার মা ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ছেলেটি তখন তার বাবা আর ছোট বোনকে নিয়ে নিজের স্বপ্নগুলোকে সাজিয়ে নেয়। ডাক্তার প্রথমে বুঝে উঠতে পারেননি যে, তার মায়ের ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে। তাই সে প্রতিজ্ঞা করে বড় হয়ে ডাক্তার হবে। মানুষকে সঠিক চিকিৎসা সেবা প্রদান করবে।
কিন্তু মায়ের অভাববোধের কাছে তার ডাক্তার হবার স্বপ্নটি ধূসর হতে থাকে। লেখাপড়ায় সামান্য ব্যাঘাত ঘটে। তার বাবা তাকে ১৯৯৭ সালে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার শিবরাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আবাসিক ব্যবস্থাপনায় ভর্তি করিয়ে দেন। সেখানে ৪র্থ ও ৫ম শ্রেণি পাস করে তাকে চলে আসতে হয় পলাশবাড়ি প্রফেসর পাড়ায় তাদের নিজ বাসায়। সেখানে পলাশবাড়ি এসএম পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়। তখন থেকে ছেলেটির সহপাঠী ছিলো মিজানুর রহমান মিজান (পরবর্তীতে পলাশবাড়ি উপজেলা সভাপতি)। স্কুলে মেধাবী ছাত্রদের মধ্যে ছেলেটি ছিলো মিশুক প্রকৃতির ও স্পষ্টবাদী। তার স্মৃতিগুলো দাওয়াতি কাজের ক্ষেত্রে আজও প্রেরণা জোগায়। ষষ্ঠ থেকে ৭ম শ্রেণিতে ২য় স্থান অধিকার করে ছেলেটি। এরপর ৮ম শ্রেণিতে বৃত্তি লাভ করে। ৯ম শ্রেণিতে আবারও মেধাতালিকায় ২য় স্থান লাভ করে। ৮ম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত অবস্থায় শুরু হয় নতুন করে পথ চলা এবং স্থানীয় সংগঠনের ভাইয়েরা আবিষ্কার করেন আমাদের প্রিয় কাফেলার ১২৩তম শহীদ রেজবুল হক সরকার প্লাবন ভাইকে।
যেভাবে দাওয়াত পেলেন
আমাদের কাফেলায়
পলাশবাড়ির তৎকালীন থানা সেক্রেটারি ছিলেন তাজুল ইসলাম মিলন ভাই। আমার সাথে এই মিলন ভাইয়ের পরিচয় হয় ২০০২ সালে তিন দিনব্যাপী সাথী টি.সি’র প্রথম দিন রাতে। রাত প্রায় ১১টা, ঘুমের বিরতি চলছে। এমন সময় মিলন ভাই পাশ থেকে আমার পরিচয় জানতে চাইলে আমি নাম ও দায়িত্ব বললাম (আমি তখন গাইবান্ধা শহর সাথী শাখার স্কুল বিভাগের পরিচালক)। মিলন ভাইয়ের সাথে সেদিনই বিস্তারিত কথা হয় আমার। প্লাবন ভাই ৮ম শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় মিলন ভাইয়ের মাধ্যমেই এই কাফেলার দাওয়াত পান। মা হারা ছেলেটির মুখের দিকে তাকালে মনে হতো যেন মায়া আর মমতার এক নিদারুণ হাতছানি। পরবর্তীতে এই সম্পর্ক হৃদ্যতাপূর্ণ ও আরও প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। প্লাবন ভাই মিলন ভাইকে আপন বড় ভাইয়ের চেয়েও আপন করে নেয় যে ‘ইন্নামাল মু’মিনুনা ইখওয়াতুন’ এর যেনো এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি। প্লাবন ভাই প্রতিদিন ফজরের নামাজ ঠিকমত পড়ছে কি না তা দেখার দায়িত্ব নেন মিলন ভাই।
সামাজিক ও বন্ধুপ্রতিম
সাধারণত বাড়ির গাছের কোন ফল স্কুলে নিয়ে বন্ধুদের খাওয়ানোর কথা আমরা খুব কম চিন্তা করতাম। সেই সময় ছিলো নভেম্বর মাস শীতের সময়। প্লাবন ভাইয়ের বাড়িতে একটা আম গাছ ছিলো যে গাছে বছরে তিনবার আম হতো। প্লাবন ভাই কাঁচা আম নিয়ে ক্লাসে আসতেন। বন্ধুদের আম খাওয়াতেন। স্যার জিজ্ঞাসা করতো, “কিরে এই অসময়ে আম কোথা থেকে এলো”? প্লাবন ভাই বলতেন, “স্যার, আল্লাহ আমাকে এ গাছটি বোনাস হিসেবে দিয়েছেন। তাই আমি আমার বন্ধুদেরকে বোনাসের অংশ বিতরণ করলাম।” স্যার খুশি হয়ে প্লাবন ভাইয়ের জন্য দোয়া করতেন।
ফরজ নামাজের ব্যাপারে সচেতন
প্লাবন ভাই ছিলেন ইবাদতের প্রতি সচেতন। ক্লাসের সবাইকে নিয়মিত নামাজের দাওয়াত দিতেন। নামাজের জন্য ক্লাসের বন্ধুদের নিয়ে একসাথে স্যারের নিকট গিয়ে ছুটি চাইতেন। স্যার তাদের এই আন্তরিকতা ফিরিয়ে দিতে পারলেন না। তিনি নিজেই সবার জন্য টিফিনের সময় নামাজের ঘর খুলে দিলেন। মাসখানেক পরে দেখা গেলো, জোহরের নামাজের সময় স্কুলের শত শত ছাত্র এক সাথে জামায়াতে নামাজ আদায় করছে। আর সেই সাথে স্কুলে দাওয়াতি কাজের সুন্দর পরিবেশ তৈরি হয়ে গেল।
নফল ইবাদতে আন্তরিক
শুধু ফরজ ইবাদত নয়, নফল ইবাদতের প্রতিও প্লাবন ভাই ছিলেন সদা সচেতন। পবিত্র মাহে রমজানে লাইলাতুল-কদরের রাতে অনেকেই মসজিদে বালিশ নিয়ে যেত। অর্ধেক রাত্রি ইবাদত আর বাকি অর্ধেক রাত্রি ঘুম। প্লাবন ভাইয়ের নিকট এটি ছিলো অপছন্দনীয়। বন্ধুদেরকে প্লাবন ভাই বলতেন, “আমরা তো মসজিদে আসি নামাজের জন্য। সেখানে আবার বালিশ কেন? আল্লাহকে ডাকতে, আল্লাহকে পেতে এতো অবহেলা কেন আমাদের?”
স্কুল দাওয়াতে সৃজনশীল কৌশল
ক্লাসের ফাঁকে কিশোরকণ্ঠ বিক্রি করতেন প্লাবন ভাই। স্কুলের মাঠে ক্রিকেট খেলা হলে প্লাবন ভাই কিশোরকণ্ঠ নিয়ে ছুটে যেতেন উপহার দেয়ার জন্য। বাউন্ডারির যে পাশে বল বেশি চার ছয় হতো সে পাশে প্লাবন ভাই কিশোরকণ্ঠ রেখে দিতেন। চার বা ছয় মারার সাথে সাথে বল কুড়াতে গিয়ে কিশোরকণ্ঠ উপহার পেয়ে যেতো খেলোয়াড়রা। স্মিত হাসি দিয়ে কিশোরকণ্ঠ হাতে নিয়ে চলে আসতো। কিশোরকণ্ঠ পাঠক ফোরাম গঠন করে ক্লাসের বন্ধুদের নিয়ে কিশোরকণ্ঠ পাঠ করতেন প্লাবন ভাই। অল্প দিনের মাঝে ২০ জন সদস্য সংগ্রহ করে ফোরামের পরিধি বড় করলেন তিনি।
অপসংস্কৃতির তীব্র বিরোধী
বাড়িতে ডিশ সংযোগ নেয়ার কথা শুনে প্লাবন ভাই ডিশ সংযোগের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিবাদ করেছিলেন। কারণ তিনি জানতেন, বাড়িতে ডিশ সংযোগ চালু হলে অপসংস্কৃতি তার বাড়িতে প্রবেশ করবে। তাই তিনি প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, “যদি ডিশ সংযোগ নেয়া হয় তাহলে আমি বাড়ি আসবো না।” এর পর ডিশ নেয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল হয়।
জ্ঞান পিপাসু ও শহীদি চেতনায়
প্লাবন ভাই
নিয়মিত লেখাপড়ার পাশাপাশি প্লাবন ভাইয়ের বিভিন্ন ইসলামী বই পড়ার প্রতি ঝোঁক প্রবণতা ছিলো। বিশেষ করে শহীদ ভাইদের জীবনী পড়ার জন্য তার মন ব্যাকুল হয়ে থাকতো। কোনো শহীদের জীবনী পেলে দ্রুত শেষ করে তারপর ফেরত দিয়ে আরেকটা নিয়ে যেতেন। ‘আসহাবে রাসূল (সা:)-এর জীবন কথা’, ‘যে অতীত প্রেরণা জোগায়’, ‘প্রেরণার বাতিঘর’ সহ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ ভাইদের ইতিহাস, বিশেষ করে শহীদ আব্দুল মালেক ও শহীদ আহমাদ জায়েদ ভাইয়ের কথা প্রায়ই জিজ্ঞেস করে বলতেন, “ভাই, আমি কি শহীদ হতে পারবো? ওনারা দ্বীনের জন্য কত কষ্ট করেছেন!” মিছিলে যাওয়ার তীব্র ইচ্ছা ছিলো প্লাবন ভাইয়ের। স্কুল দায়িত্বশীল হওয়ায় মিছিলে যাওয়ার অনুমতি ছিলো না। প্লাবন ভাই যুক্তি দিতেন, “আপনারা মায়াজ ও মুয়াজ (রা)-এর ইতিহাস জানেন তাহলে আমাকে নিষেধ করেন কেন? চাঁপাইনবাবগঞ্জের শহীদ শিষ মোহাম্মদ ভাই কি আমার থেকে বয়সে বড় ছিলো?”
ইতঃপূর্বে তার মায়ের অভাব পূরণ করার জন্য বাবা আজাদুল হক সরকার দ্বিতীয় বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন। প্লাবন ভাই তখন ৩য় শ্রেণির ছাত্র। অনেক চিন্তা ভাবনা করে তিনি প্লাবন ভাইয়ের আপন খালাকে বিয়ে করেন। যেন মায়ের অভাবটা খালা নিজেই পূরণ করতে পারেন। শাহাদাতের পর আমরা বহুবার গিয়েছি প্লাবন ভাইয়ের বাসায়। সব সময় মনে হয়েছে তিনিই প্লাবন ভাইয়ের গর্ভধারিণী মা। একজন শহীদের ছোট বোন ও পিতার সেবা করার কারণে আল্লাহ যেন তাকে সে মর্যাদাই দিয়েছেন। মাতৃতুল্য এই নারী আজও বড় বোন ও ছেলে হারানোর বেদনা নিয়েই সংসারের হাল ধরে আছেন শক্ত হাতে।
২০০৫ সালে পলাশবাড়িতে এস.এস.সি ও দাখিল ফলপ্রার্থীদের নিয়ে শিক্ষাশিবির অনুষ্ঠানে শিবিরের তৎকালীন কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক জনাব মোকসেদুল কামাল বাবু ভাই সকলের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করেছিলেন- “এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাবে কে কে?” শুধুমাত্র প্লাবন ভাই সেদিন হাত তুলে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, “ভাইয়া আমি জিপিএ-৫ পাবো ইনশাআল্লাহ।” প্লাবন ভাই জিপিএ-৫ ঠিকই পেয়েছিলেন। কিন্তু সেই রেজাল্ট তার দেখার সুযোগ হয়নি। মহান আল্লাহ চেয়েছিলেন তার প্রিয় বান্দাকে দুনিয়া ও আখিরাতে দুই জায়গায় মর্যাদা দিতে। আর তাই দুনিয়ায় জিপিএ ৫ পাওয়ার পাশাপাশি শহীদি মৃত্যুর মত আখিরাতের বিশাল মর্যাদা দিয়ে তাকে কাছে টেনে নিয়েছিলেন।
শহীদ হওয়ার প্রেক্ষাপট
গাইবান্ধার পলাশবাড়ি বরাবরের মতোই উত্তরবঙ্গে ইসলামী আন্দোলনের এক দুর্বার ঘাঁটি। বাতিল শক্তির কাছে তা স্পষ্ট। এখানে ইসলামী ছাত্রশিবির সমস্ত আন্দোলন সংগ্রামের নিয়ামক শক্তি। এ জন্য বাতিলের রক্তচক্ষু কখনও পলাশবাড়ির ময়দান এড়িয়ে যায় না। গাইবান্ধার জেলার অধিকাংশ নেতৃত্ব সরবরাহের কারখানা হলো এই পলাশবাড়ির ময়দান। ২০০৫ সালের ১৩ জুন পলাশবাড়ি পৌর শাখার তৎকালীন সভাপতি মোজাম্মেল ভাইকে শিবির ত্যাগ করার জন্য হুমকি দেয় যুবদল নামের সন্ত্রাসী মতিয়ার ও সাইফুর। একই দিনে উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি আবু বকর সিদ্দিক ও শিবিরের সাবেক জেলা সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক ভাইকে বাজারে আসার সময় অতর্কিত আক্রমণ করে আহত করে তারা। বিকেলে তারা জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক শ্লোগান ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে মিছিল মিটিং করে। তাদের সাথে যোগাযোগ করে দায়িত্বশীলদের আহত করার কারণ জানতে চাওয়া হয় ও বক্তব্য প্রত্যাহার করতে বলা হয়। কিন্তু তাদের থেকে কোনো সাড়া না পাওয়ায় যুবদলের-ছাত্রদলের অব্যাহত টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের প্রতিবাদে মিছিল করে উপজেলা জামায়াত। মিছিলে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে যুবদল সভাপতি রুবেল ও বিএনপি সেক্রেটারি জুয়েল। দুই দলের মুখোমুখি অবস্থানে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় অতিরিক্ত পুলিশ টহল করতে থাকে। পুলিশের অনুরোধে শহর থেকে মিছিল সরিয়ে নিয়ে অফিসে মিটিং এ বসে উপজেলা জামায়াত ও শিবির নেতৃবৃন্দ। গাইবান্ধা জেলা জামায়াতের আমীর ডাঃ আব্দুর রহিম সরকার ও শিবিরের গাইবান্ধা জেলা তৎকালীন সভাপতি তাজুল ইসলাম ভাই পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ ভাবে সমাধানের তাগিদ দেন।
ইতোমধ্যে শিবিরের সাবেক জেলা সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক ভাই ও পলাশবাড়ি উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি আবু বকর ভাই এবং ছাত্রশিবিরের তৎকালীন পলাশবাড়ি পৌর সভাপতি মোজাম্মেল ভাই আহত হওয়ার কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। আহত ভাইদের দেখার জন্য আবেগতাড়িত হয়ে আমাদের সেই প্রিয় ভাইটি শহরের পরিস্থিতির কথা জেনেও ছুটে আসতে থাকেন। স্যারের প্রাইভেট শেষ করে আসা প্লাবন ভাইয়ের হাতে তখনও বই-খাতা কলম ছিলো। আলাদা রাস্তা না থাকায় যুবদলের অফিসের সামান্য পাশ দিয়েই আসতে হয়েছিলো তাকে। কিন্তু স্কুলের কাজে সক্রিয় থাকার কারণে প্লাবন ভাইকেও তারা চিনে ফেলে। সাথে সাথে সন্ত্রাসীরা চিৎকার করে ওঠে, “ঐ শালা শিবির যাচ্ছে ধর ওকে।” সময়ের পরিবর্তনে অত্যাচারের বর্ণনার শব্দগুলো এখন আমাদের নিকট অতি পরিচিত। প্লাবন ভাইকে যেখানে আক্রমণ করেছিলো তার প্রায় ৫০ গজ দূরেই ছিল প্লাবন ভাইয়ের বাবার কাপড়ের দোকান। সংঘর্ষ চলাকালীন দোকান বন্ধ করে তিনি দোকানের ভেতরেই ছিলেন। তিনি এতটুকুও বুঝতে পারেননি যে তার কলিজার টুকরা ছেলেকে প্রায় ১৫-২০ জন সন্ত্রাসী উপর্যুপরি আঘাত করছে। গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে প্রথমে পলাশবাড়ি উপজেলা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। অবস্থার আরও অবনতি হলে তাকে রংপুর মেডিক্যাল এবং পরের দিন অর্থাৎ ১৪ জুন তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ২০০৫ সালের ১৫ জুন সকাল ৯ টায় আমাদের সবাইকে ছেড়ে চিরদিনের জন্য বিদায় নেন এই অদম্য মেধাবী, দুরন্তপনা স্বভাবের পরোপকারী, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়কারী আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রা) ও মুসায়াব বিন উমাইরের (রা) উত্তরসূরি প্রিয় আমাদের প্রিয় প্লাবন ভাই।
জানাজা
রেজবুল হক সরকার প্লাবন ভাইয়ের শাহাদাতের খবরে সারা দেশে কাফেলার ভাইদের মাঝে শোকের ছায়া নেমে আসে। কেন্দ্রীয় সংগঠনের ডাকে দোষীদের উপযুক্ত শাস্তির দাবিতে তাৎক্ষণিক দেশব্যাপী বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। শহীদের লাশ নিয়ে আসা হয় বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটে। সেখানে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের বক্তব্য শেষে জানাজার নামাজের ইমামতিত্ব করেন বিশ্ব বরেণ্য মোফাসসিরে কুরআন আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। প্রথম জানাজা শেষে দ্বিতীয় জানাজার জন্য নিয়ে আসা হয় পলাশবাড়ি তার সেই স্মৃতিবিজড়িত এস.এম পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে। শহীদের মুখখানি এক নজর দেখতে আসা আপামর জনসাধারণ এবং শহীদের সাথী ভাইদের গগনবিদারী আর্তনাদে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। পলাশবাড়ির ইতিহাসে শহীদ প্লাবনের জন্য আসা এত বিশাল উপস্থিতির জানাজা আমরা কখনও লক্ষ করিনি।
জানাজায় উপস্থিত ছিলেন ইসলামী ছাত্রশিবিরের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল জনাব ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ, গাইবান্ধা জেলা আমির ডা. আব্দুর রহীম সরকার, ছাত্রশিবিরের তৎকালীন কেন্দ্রীয় কার্যকরী পরিষদের অন্যতম সদস্য জনাব দিদারুল আলম মজুমদার, ড. রেজাউল করিম ভাইসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজের ছাত্র এবং সর্বস্তরের জনতা।
শিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল ড. শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, “আজ আমরা আরও একজন আবদুল মালেক ভাইকে হারালাম। মাত্র কয়েকদিন পরেই যখন রেজাল্ট বের হবে তখন শত শত শিক্ষার্থী নিজের রেজাল্ট পেয়ে খুশি হয়ে পিতা-মাতার মুখে মিষ্টি তুলে দিবে কিন্তু আমার প্লাবন ভাইয়ের মা যখন আমাকে জিজ্ঞাসা করবে, ‘আমার প্লাবনের রেজাল্ট তো পেলাম কিন্তু আমার প্লাবন কোথায়?’ তখন তার সামনে আমরা কী জবাব নিয়ে উপস্থিত হবো? আমাদেরকে শহীদের রেখে যাওয়া অসম্পূর্ণ কাজ সম্পন্ন করতে হবে।”
শহীদের পিতা জনাব আজাদুল হক সরকার বলেন, “এই দেখুন বাতিলের আক্রমণে ভেঙে পড়া আমার কলিজার টুকরা ছেলের চোয়ালসহ নিচের পাটির ৭টি দাঁত। হে আল্লাহ, তুমি সাক্ষী থেকো আমার সন্তান তোমার রাসূল (সাঃ) এর দাঁত শহীদ হওয়া সুন্নাত পালন করেছে। তুমি তার শাহাদাতকেও কবুল কর।”
উপস্থিত সকলেই সমস্বরে বলে ওঠে ‘আমিন-আমিন-আমিন।’
দাফন
মন খারাপ থাকলে মাঝে মাঝে প্লাবন ভাই একা বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতেন। তাকে জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, “আমার কিছু ভালো লাগে না ভাইয়া, আমি মায়ের কাছে যাবো।” মহান আল্লাহ প্লাবন ভাইয়ের হৃদয়ের আকুতি কবুল করেছেন। তাকে তার মায়ের কাছে নিয়ে গেছেন। ছোটবেলার সেই পবনাপুর গ্রামে ৩য় জানাজা শেষে মায়ের কবরের পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন আমাদের প্রিয় প্লাবন ভাই। তার সেই আম গাছটিও কিছুদিন পর মারা গেলো। বছর ঘুরে দিনটি আসলে মনে পড়ে প্রিয় শহীদ প্লাবন ভাইয়ের কথা, কিন্তু কেন? এ প্রশ্নের উত্তর মহান আরশের মালিক আল্লাহ পাকই ভালো জানেন। মহান আল্লাহ আমাদের প্রিয় ভাইটিকে শহীদের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করুন। (আমিন)
আপনার মন্তব্য লিখুন