মনের মাঝে শূন্যতা-বিষণ্নতার ঢেউ মাঝে মাঝে আছড়ে পড়ে। যে ঢেউয়ের ক্ষিপ্রতা বেশ শক্তিশালী। শক্তিশালী সেই ঢেউ থেকে রক্ষার কত প্রাণপণ চেষ্টাই না করে থাকে মানুষ। তবে কেউ বেঁচে যায় আবার কেউ পথ হারায়। কখনো গভীরভাবে ভেবেছেন শূন্যতা- বিষণ্নতার গভীরতা কতটুকু? হৃদয়ের হাহাকার, বেদনার চিৎকার প্রকাশ করার ভাষা হারিয়ে ফেলে কেউ কেউ। দুমড়ে-মুচড়ে নিজেকে গুটিয়ে ফেলে। জীবন মানেই বোঝে কেবলই ব্যর্থতা। না পাবার হতাশায় নিমজ্জিত করে ফেলে অন্যসব সফলতার সনদ।
এই শূন্যতার ব্যাখ্যা একেকজনের কাছে একেকরকম। কেউ কাউকে কামনা করে ফিরে। কেউ অর্থ সংগ্রহে ব্যর্থতায় কুঁকিয়ে বেড়ায়, কেউ আবার সম্পদের মোহে ব্যর্থ হয়ে বিষণ্নতায় ভোগে। কেউ মানুষের ভালোবাসা অন্বেষণ করে বেড়ায়। নানা কিসিমের মানুষের নানা ব্যস্ততা। নানা অভিজ্ঞতা। বিচিত্র এ জীবন সংসারে নানা পরিবেশে নানা চালচিত্রের সম্মুখীন হতে হয় আমাদেরকে। এই তো জীবন। মহাকালের খেয়ায় বহমান এ তরী। আমরা সবাই যেন মাঝিমাল্লা।
দুই.
মানুষ মানুষকে পাঠ করে। এই পাঠ কখনো তাকে অন্যের প্রতি দুর্বল করে তোলে। আকর্ষণ করে। তার প্রেমে আবদ্ধ করে। আবার হিতে বিপরীতও ঘটে। এই মানুষ মানুষকে পাঠ করে দূরত্ব বজায় রাখে। এড়িয়ে চলে। ভুলে যায় সহসা। ঘৃণা করে। এই মানুষ মানুষকে পাঠ করে বীতশ্রদ্ধ হয়। বিতৃষ্ণা এনে দেয় মনে। এই মানুষ মানুষকে পাঠ করে অন্তরটাকে সমুদ্রের মতো করে ফেলে। তার সাথে আলাপ-সংলাপ কিংবা ছায়াদর্শনে ভালো লাগা বেড়ে যায়।
আপনি নিজেকে শুধু একা ভাবেন? আপনি শুধুই একা নন। আপনাকে কেউ না কেউ অনুসরণ করে। আপনার মতো হয়ে ওঠার চেষ্টা করে। কেন করে? এবার ভাবুন। আপনার ভেতর-বাহির কেউ না কেউ পড়ে ফেলে প্রকাশ্যে কিংবা একান্ত ভাবনায়, কল্পনায়। শত ব্যস্ততায় আপনাকে সে ভুলতে পারে না। এই যে ভালোবাসা। আপনি নিশ্চয় কোনো শাসন কিংবা বারণ তলব করেননি। এটা আসে একান্ত ভালো লাগা থেকে। এই ব্যক্তিত্বের মূল্য কত? আমি বলি, এর মূল্য নির্ধারণ অসম্ভব। অসীম-সীমাহীন। এই তৃপ্তি যে অনুভব করবে সে কেবলই মানুষকে ভালোবেসে যাবে। মানুষের ভালোবাসার জন্য নিজেকে উপযোগী করে তুলবে। এই আনন্দও অন্তহীন। যা পৃথিবীর কেনো কিছুর সাথেই তুলনা করা যায় না।
তিন.
মানুষের ভেতরে মানুষ বসবাস করে। মনের ভেতরে মন। এই মানুষই মানুষকে তালাশ করে বেড়ায় সারাক্ষণ। এই যে মানুষকে মানুষের তালাশের সন্নিহিত কারণও রয়েছে। মানুষের প্রতি মানুষের রয়েছে প্রভাব। একেক মানুষ একেক মানুষের দ্বারাই প্রভাবিত হয়। হৃদয়ের গভীরে স্থান করে নেয়। সহজ কথায় বলে থাকি রিলেশান বা সম্পর্ক। এই সম্পর্ক কীভাবে তৈরি হয়? ইচ্ছে করলেই মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক হয়? আমার কাছে মনে হয়- সম্পর্ক তৈরি করা খুবই কঠিন। ভিন্ন দেহের একজন মানুষের সাথে মনের আদান-প্রদান খুব সহজ ব্যাপার নয়। আবার মুহূর্তের মধ্যে এক দেখাতেই মানুষ মানুষের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে। মানে সম্পর্ক গড়ে তোলে। সম্বন্ধ তৈরি হয়। আর এই সম্বন্ধটা অনেকটা ম্যাজিকের মতো কাজ করে। অনেকটা বলতে পারেন ফার্স্ট লুকিং। সম্পর্কের প্রথম ধাপ তৈরি করে চোখ। চোখাচোখি। এক দেখাতেই তাকে পাঠ করে ফেলে। চিত্রশিল্পীর মতো মনের ভেতরে এঁকে ফেলে তার ছবি। ধীরে ধীরে মনে নিয়ে ফেলে তাকে। সম্পর্ক দু’ধরনের। বিশ^াস হয় না? একটু চোখ বন্ধ করে মিলিয়ে নিন। দেখবেন হুবহু মিলে গেছে। একটা সম্পর্ক হয়ে থাকে মেনে নেবার সম্পর্ক। কাজের সম্পর্ক কিংবা আশপাশের পরিবেশের চাপে। এই সম্পর্কের স্থায়িত্ব খুবই কম। এই সম্পর্ক বারবার ভেঙে যায়। অল্প আঘাতের বিশ্লেষণ হয় নানাদিক থেকে। এটা কেন হলো? এই হলো ভালোবাসার প্রতিদান! বলা যায় অভিযোগের শেষ থাকে না। আর মনে নেবার সম্পর্ক- যার ব্যাপ্তি অনেক দূর। যে সম্পর্ক মাঝে মাঝে মচকায় কিন্তু ভাঙে না। ঐ যে বললাম না, মানুষের প্রতি মানুষের প্রথম ভালো লাগাটা তাকে গভীর অনুরাগে আটকে ফেলে।
চার.
আমরা প্রতিদিন অনেক কিছু শিখছি। শেখার কোনো শেষ নেই। হ্যাঁ, অনেক কিছু দেখে শিখতে হয়। আবার ঠেকেও শিখতে হয়। একটা বিষয় খুবই স্পর্শকাতর যে, ব্যবহারিক জীবনের ব্যবহারিক সৌজন্য এটা আসলে কাউকে শিখিয়ে দেওয়া যায় না। কার সাথে কেমন ব্যবহার করতে হবে, কাউকে কীভাবে সম্মান দেখাতে হবে তা নিতান্তই একান্ত উপলব্ধির বিষয়। আর হৃদয় থেকে কেবলই উৎসারিত হয় শ্রদ্ধা, স্নেহ ও ভালোবাসা।
আমরা মহৎ মানুষের জীবনী পাঠ করি। অন্যকে পাঠ করে করে শোনাই। স্পিকারের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা বেড়ে যায়। অডিয়েন্স অনুপ্রাণিত হয়। কিন্তু মহৎ মানুষ কিংবা মহান মানুষ আমরা কেউই হতে চাই না কিংবা হই না। মানুষের মাঝে মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার সৌভাগ্য সবার হয় না। তবে যারা মানুষের হৃদয়ে নিজেকে আসীন করতে পারে তারা সফল ও ভাগ্যবান। তবে এই সফলতার পেছনে তাকে মেহনত করতে হয় দীর্ঘকালব্যাপী। মানুষকে মানুষ হয়ে কেবলই এই যোগ্যতা অর্জন করতে হয়।
পাঁচ.
এক মুমিন আরেক মুমিনের আয়নাস্বরূপ। হাদিসটি শুধু হাদিস হিসেবেই রেখে দিই আমরা। আমরা যে, এক মুমিনকে আয়নার সাথে তুলনা করি। এটা কি আমরা কেউই নির্ধারণ করেছি? নিশ্চয় না। মহানবী (সা) নির্ধারণ করেছেন। এক মুমিনের সাথে আরেক মুমিনের ব্যবহারিক জীবনের আদ্যোপান্ত বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন। আমরা প্রতিদিন নিজের চেহারা দেখার জন্য আয়নার ব্যবহারে কতই না পেরেশানি। একজন মুমিন ভাই কিংবা বোন হিসেবে আমার ব্যক্তিগত জীবনের ডায়েরিতে এই আয়না কতবার দেখি? একবার ভেবে দেখি! আমার জীবন। আমার অস্তিত্ব। সত্যি সত্যিই যদি আয়নায় নিজেকে খুঁজতাম। চেহারার মতো আমার অন্তরাত্মাকে খুঁজে বেড়াতাম তাহলে নিশ্চয় বদলে যেত আমার চরিত্র। বদলে যেত জীবনের বাঁক। নতুন আলোয় নিজেকে গুছিয়ে নিতাম সযতেœ। কিন্তু আজো কি পেরেছি- আপন আয়নাতে মুখ দেখতে? বরং আজ আয়নাতে মুখ লুকিয়ে ফেলার আয়োজন। নিজেকে ঢাকার ফন্দি। আদৌ কি নিজেকে লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হব? নিশ্চয় সে মহাদিনে দেদীপ্যমান আলোকরেখায় প্রকাশিত হবে জীবনের নানাদিক। এই মহাদিনে মহামুসিবতে পার করে দিও মাবুদ আমায়। কায়মনোবাক্যে এই হোক প্রার্থনা। জীবনের আরাধনা। নিজেকে নিজেই গুছিয়ে ফেলি।
ছয়.
আমরা দুনিয়াতে এসেছি। আবার আমরা এই দুনিয়া থেকে চলে যাব। আসার সময় নির্ধারণ আছে, যাওয়ার সময় নির্ধারণ নেই। আমরা প্রত্যেকের জায়গা থেকে ক্ষমতার দাপট দেখাই। ক্ষমতার অপব্যবহারও করি। অথচ এ বিষয়ে কারো ক্ষমতা প্রদর্শনের সুযোগ নেই। আমরা যে চলে যাব ধ্রুব সত্য। এই সত্যকে আমরা সবাই এক বাক্যে স্বীকার করি। কিন্তু উপলব্ধিতে নিই না। একবার চোখ বন্ধ করে দেখুন তো, আপনার আমার ক্ষমতার দৌরাত্ম্য। কেউ পাশে নেই। কেউ সাথে নেই। প্রতিদিন কিসের নেশায় ছুটছি। কোন মরীচিকা আমাদেরকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। তা অতিক্রম করবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি। নিশ্চয় আমাদের প্রতিটি কর্ম সংরক্ষণ করেন আল্লাহর কর্তব্যরত ফেরেস্তাগণ। এ ভয় আমাদেরকে তাড়িত করে। ভীতবিহ্বল করে। সজাগ করে। দৃষ্টিপাত করে।
প্রতিদিন নতুন নতুন কাজের ভিড়ে পুরাতন অনেক কাজের কথা কিংবা জরুরি অনেক বিষয় খুব সহসা ভুলে যাই। সঙ্গত কারণে সব বিষয় মনে থাকে না। তবে আপনার সে কাজের ফিরিস্তি কেউ না কেউ মনে রাখে, সংরক্ষণ করেন। তুলে রাখেন হৃদয়ে। অ্যালবামে। কারা সংরক্ষণ করে থাকেন আপনার কর্মসূচি-কর্মকাণ্ড? নিশ্চয় তারা আপনার স্বজন, আপনার প্রতিবেশী।
একটা বিষয় আমাদের সকলেরই দৃষ্টিগোচর- আমাদের কোনো স্বজন মৃত্যুবরণ করলে জানাজাপূর্ব পরিবারের পক্ষ থেকে মরহুম কিংবা মরহুমার জন্য দোয়া চাই। তার জীবনাচরণে কেউ কষ্ট পেলে ক্ষমা করবার অনুরোধ করি। আমরা ক্ষমার প্রতিশ্রুতিও দেই। কিন্তু কয়জনইবা মন থেকে ক্ষমা করতে পারি তা একান্ত ভাববার বিষয়।
আমি যে চলে যাব এটাকে মনে প্রাণে কি আদৌ বিশ্বাস স্থাপন করতে পেরেছি? যদিও আমরা বিশ্বাস কিংবা ঈমানের বিষয়টা মৌখিক স্বীকৃতিকেই বুঝি। কিন্তু আদতে মৌখিক স্বীকৃতি কেবলই ঈমানের দাবি পূরণ করে না সে বিষয়টা আমরা অধিকাংশই ওয়াকিবহাল নই।
জীবনের এই খেলাঘর ভেঙে যাবে একদিন। ভেঙে যাবে রঙিন স্বপ্ন; স্বপ্নপ্রাসাদ। অবশ্য আমার চলে যাওয়ায় যেন ভেঙে যায় মানুষের মন। আমার চলে যাওয়া যেন না হয় কারো খুশির কারণ। ভাবনার দুয়ারে আজ হানি আঘাত। আমাদের বন্ধন হোক সিসাঢালা প্রাচীরের মতো। আর এই বন্ধনের মাধ্যমে মুক্তির মনজিল হোক আমাদের ঠিকানা।
লেখক: কবি ও গবেষক
আপনার মন্তব্য লিখুন