post

আল্লাহর ফরজ বিধান ও আন্তর্জাতিক মিলনমেলা

এইচ. এম. মুশফিকুর রহমান

১২ মে ২০২৩

হজ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম একটি স্তম্ভ।  নবম হিজরিতে হজ ফরজ করা হয়।  এটি আরবি সনের ১২তম ও সর্বশেষ মাস জিলহজ মাসে পালিত হয়। হজ আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে, ইচ্ছা বা সঙ্কল্প করা। ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় হজ হলো নির্ধারিত সময়ে মক্কা মুকাররমায় অবস্থিত বায়তুল্লাহ শরিফে গমন করে হজ সংশ্লিষ্ট আনুষঙ্গিক কার‌্যাবলি নির্ধারিত স্থানে গিয়ে সম্পন্ন করা। এটি শারীরিক ও আর্থিক ইবাদতগুলোর মধ্যে অনন্য। প্রাপ্তবয়স্ক, স্বাধীন ও জ্ঞানবান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক ও আর্থিকভাবে সক্ষম প্রত্যেক মুসলমানের ওপর জীবনে একবার হজ করা ফরজ। পরে যতবার হজ পালন করা হবে সবগুলো নফল হিসেবে গণ্য হবে। 

হজ ফরজ হওয়ার দলিল 

সামর্থ্যবান মুসলমানদের ওপর হজ পালন করা ফরজ হওয়ার বিষয়টি কুরআন মাজিদের বেশ কিছু আয়াত এবং অসংখ্য হাদিসের মাধ্যমে প্রমাণিত। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘এ ঘরের হজ করা মানুষের ওপর আল্লাহর প্রাপ্য; যে লোকের সামর্থ্য রয়েছে এ পর্যন্ত পৌঁছার।’ (সূরা আলে ইমরান : ৯৭)। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আরও বলেন, ‘মানুষের মধ্যে হজের জন্য ঘোষণা প্রচার করো। তারা তোমার কাছে আসবে হেঁটে এবং সর্বপ্রকার কৃশকায় উটের পিঠে সওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত থেকে।’ (সূরা হজ : ২৭) 

নবীজি সা.-এর হাদিস দ্বারাও হজ ফরজ হওয়ার বিষয়টি প্রমাণিত। আবু হুরায়রা রা. বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা. আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণে বললেন, হে জনগণ! তোমাদের ওপর হজ ফরজ করা হয়েছে। অতএব, তোমরা হজ করো। এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল, হে আল্লাহর রাসূল! তা কি প্রতি বছর? রাসূলুল্লাহ সা. নীরব রইলেন এবং সে তিনবার কথাটি বলল। এরপর আল্লাহর রাসূল সা. বললেন, আমি ‘হ্যাঁ’ বললে প্রতি বছরের জন্য ওয়াজিব হয়ে যাবে অথচ তোমরা তা পালন করতে সক্ষম হবে না।’ (মুসলিম-৩১৪৮)


যথাসময়ে হজ পালনের নির্দেশ

কারও ওপর হজ ফরজ হওয়ার পর তা আদায়ে বিলম্ব করা উচিত নয়। কেননা আজকের সুস্থতা পরবর্তী সময়ে নাও থাকতে পারে। বর্তমানের ধন-সম্পদ ভবিষ্যতে চলেও যেতে পারে। তাই কুরআন-হাদিসে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি হজ পালনে উৎসাহিত করা হয়েছে। হজ পালনে বিলম্ব করতে হাদিস নিষেধাজ্ঞা এসেছে। হজরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘ফরজ হজ আদায়ে তোমরা বিলম্ব করো না। কারণ তোমাদের কারও জানা নেই তোমাদের পরবর্তী জীবনে কী ঘটবে।’ (মুসনাদে আহমদ-২৮৬৭)

অনেক ধনাঢ্য ব্যক্তিকে দেখা যায়, তারা বিভিন্ন অজুহাতে হজে বিলম্ব করে কিংবা হজ থেকে বিরত থাকে। কেউ বলে আগে একটা বাড়ি করি তারপর হজ করব। কেউ বলে, আগে ছেলেমেয়েদের বিয়ে দিয়ে পরে হজ করব। আবার কেউ বলে, এত তাড়াতাড়ি হজ করলে রাখতে পারব না, বয়স হোক তারপর হজ করব ইত্যাদি। কিন্তু এসব অজুহাত শরিয়তে গ্রহণযোগ্য নয় বরং ধন, স্বাস্থ্য হায়াত চিরস্থায়ী নয় বিধায় যথাসম্ভব হজ তাড়াতাড়ি আদায় করা উত্তম।

হজ মহান আল্লাহ পাকের নির্দেশ এবং মুসলমানদের গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। কোনোভাবেই এই মহান ইবাদতকে পরিত্যাগ করা উচিত নয়। তাই, যাদের ওপর হজ ফরজ হয়েছে তারা যেন দ্রুত যথাসময়ে হজ আদায় করে নেয়।


হজ করার ফজিলত

হজ একটি ফজিলতপূর্ণ ও মহিমান্বিত আমল। এর মাধ্যমে চির কাক্সিক্ষত জান্নাত লাভ করা যায় এবং জাহান্নাম হতে সুরক্ষিত থাকা যায়। বিভিন্ন হাদিসে নবীজি সা. হজ আদায় করার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হজ করল এবং এ সময় অশ্লীল কাজ ও গুনাহের কাজ থেকে বিরত থাকল সে নবজাতক শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসবে। (বুখারি-১৫২১, মুসলিম-১৩৫০)

অপর হাদিসে এসেছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, ‘তোমরা হজ ও উমরাহ সাথে সাথে করো,  কেননা এ দু’টি দারিদ্র্য ও গুনাহ এভাবে দূর করে, যেভাবে হাপর লোহা, স্বর্ণ ও রৌপ্যের ময়লা দূর করে। আর মকবুল হজের বিনিময় জান্নাত ব্যতীত কিছুই নয়।’ (ইবনে মাজাহ-২৮৮৭)

হাদিসে হাজীগণকে আল্লাহর প্রতিনিধিদল বলা হয়েছে এবং তাদের দোয়া কবুল ও মাগফিরাতের ঘোষণা  দেওয়া হয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবীজি সা. ইরশাদ করেন, ‘হজ ও উমরাহকারীগণ হলেন আল্লাহর প্রতিনিধি দল। তারা যদি তাঁর কাছে প্রার্থনা করে তিনি তা কবুল করেন। আর তারা যদি তাঁর কাছে ক্ষমা চান তিনি তাদেরকে ক্ষমা করে দেন।’ (ইবনে মাজাহ-২৮৯২)

হজের বিনিময় একমাত্র জান্নাত। হজের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়। হজ করলে আল্লাহ বান্দার গুনাহ মাফ করে দেন এবং হাজীগণ আল্লাহর নৈকট্য লাভের সুযোগ লাভ করে। বান্দাগণ হজের মাধ্যমে সর্বোচ্চ সফলতা অর্জন করতে পারে। আর তা হলো জান্নাত লাভের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা।  হাদিসে এসেছে, ‘হজে মাবরুর তথা মকবুল হজের প্রতিদান হলো একমাত্র জান্নাত।’ (তারিখুল কবির-১/১৩৩)


হজ দ্বারা গুনাহ মাফ হয় 

হজ দ্বারা বান্দাহর সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। হজের মাধ্যমে হাজীগণ মাতৃগর্ভ হতে ভূমিষ্ঠ হওয়া নবজাতক শিশুর মতো মাসুম তথা নিষ্পাপ হয়ে যায়। “নবীজি সা. ওমর রা.কে বললেন, ‘হে ওমর! তুমি কি জান না, নিশ্চয় ইসলাম মুসলমানদের পূর্বের সব গুনাহ মিটিয়ে দেয়, হিজরত মুহাজিরদের পূর্বের সব গুনাহ মুছে দেয় এবং হজ হাজীদের পূর্বের সব গুনাহ ঝেড়ে ফেলে।” (আত-তারগিব ওয়াত তারহিন-২/১৬৫)

রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘আরাফা দিবসের তুলনায় এমন কোনো দিন নেই, যেদিন আল্লাহ তায়ালা সর্বাধিক লোককে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দান করেন। আল্লাহ তায়ালা নিকটবর্তী হন, অতঃপর বান্দাদের সম্পর্কে ফেরেশতাদের সামনে গৌরব করে বলেন, তারা কী চায়?’ (মুসলিম : ৩১৭৯)


হজ না করার পরিণাম

হজ করার সামর্থ্য ও সক্ষমতা অর্জিত হওয়ার পরও হজ আদায় না করার পরিণতি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। শারীরিক ও আর্থিকভাবে সক্ষম হওয়ার পরও যদি কোনো ব্যক্তি হজ না করে, তাহলে তার ঈমানহারা হয়ে মৃত্যুবরণ করার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। তাই সক্ষমতা অর্জন হওয়ার পরও হজ আদায় না করা কোনোভাবেই সমীচীন নয়। হজরত আলী রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তি আল্লাহর ঘর পর্যন্ত পৌঁছার মতো সম্বল ও বাহনের অধিকারী হওয়ার পরও যদি হজ না করে, তবে সে ইহুদি হয়ে মারা যাক বা খ্রিষ্টান হয়ে মারা যাক, তাতে আল্লাহর কোনো ভাবনা নেই।’  (তিরমিজি-৮১২)

আর কেউ যদি হজ অস্বীকার করে বা কোনো ধরনের অবহেলা প্রদর্শন করে তবে সে আল্লাহর জিম্মার বাইরে বলে বিবেচিত হবে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘মানুষের মধ্যে যারা সেখানে (বায়তুল্লাহ) পৌঁছার সামর্থ্য রাখে তাদের ওপর আল্লাহর উদ্দেশ্যে এ গৃহের হজ করা ফরজ। আর কেউ যদি অস্বীকার করে, তাহলে জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টিজগতের প্রতি মুখাপেক্ষী নন।’ (সূরা আলে ইমরান : ৯৭)

এ ছাড়াও হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ তায়ালা হজ না করার পরিণতি সম্পর্কে বলেছেন, ‘যে বান্দাকে আমি দৈহিক সুস্থতা দিয়েছি এবং আর্থিক প্রাচুর্য দান করেছি, অতঃপর (গড়িমসি করে) তার পাঁচ বছর অতিবাহিত হয়ে যায় অথচ আমার দিকে (হজব্রত পালন করতে) আগমন করে না, সে অবশ্যই বঞ্চিত।’ (ইবনে হিব্বান-৩৭০৩)


হজের সময় ও নির্ধারিত স্থান

হজের নির্দিষ্ট সময়-শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজের প্রথম ১০ দিন। বিশেষত ৮ থেকে ১২ জিলহজ পর্যন্ত পাঁচ দিন। এ পাঁচ দিনই মূলত হজ পালন করা হয়। হজের নির্ধারিত স্থান-কাবা শরিফ, সাফা-মারওয়া, মিনা, আরাফা ও মুজদালিফা। (আসান ফিকাহ, খণ্ড : ০২, পৃষ্ঠা : ২৫১)


হজ ফরজ হওয়ার শর্ত 

হজ ফরজ হওয়ার জন্য পাঁচটি শর্ত রয়েছে। যথা : ১. মুসলিম হওয়া ২. বিবেকবান হওয়া, পাগল না হওয়া ৩. বালেগ হওয়া, প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া ৪. আজাদ বা স্বাধীন হওয়া অর্থাৎ কারো গোলাম বা দাস না হওয়া ৫.  দৈহিক ও আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান হওয়া।


হজ ও জাকাতের মধ্যে পার্থক্য

কারো ওপর জাকাত ফরজ না হয়েও তার ওপর হজ ফরজ হতে পারে। কেননা হজ ও জাকাতের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য রয়েছে। হজ ও জাকাতের মধ্যে পার্থক্য হলো, জাকাতের সম্পর্ক নির্ধারিত নিসাবের সাথে। হজের সম্পর্ক মক্কায় আসা-যাওয়ার খরচের সাথে। সুতরাং স্থাবর সম্পত্তির কিছু অংশ বিক্রয় করে কেউ যদি হজ আদায় করতে সক্ষম হয় এবং হজ থেকে ফিরে এসে বাকি সম্পত্তি দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে, তাহলে তার ওপর হজ ফরজ। (ইমদাদুল আহকাম-২/১৫২; আহসানুল ফাতাওয়া-৪/৫১৬)

একইভাবে ব্যবসায়ীর দোকানে যে পরিমাণ পণ্য আছে, তার কিছু অংশ বিক্রয় করলে যদি হজ করা সম্ভব হয় এবং ফিরে এসে যদি বাকি পণ্য দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা যায়, তাহলে তার ওপরও হজ ফরজ। (ইমদাদুল আহকাম-২/১৫৩)


হজ মুসলিম উম্মাহর মিলনমেলা

হজ মুসলিম উম্মাহর জন্য ভ্রাতৃত্বের এক মহা মিলনমেলা, বার্ষিক বিশ্ব সম্মেলন ও ইসলামী ঐক্যের প্রতীক। মহান আল্লাহ তায়ালা দিনে পাঁচবার পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জামায়াতে কিছুসংখ্যক মানুষের, তারপর সপ্তাহে একবার জুমার দিনে আরো কিছু বেশি মানুষের, তারপর বছরে দুইবার দুই ঈদের দিনে আরো কিছু বেশি মানুষের, তারপর বছরে একবার হজে আরাফার মাঠে বিশ্বের সব মানুষকে একত্রিত করার সুব্যবস্থা করেছেন। এটাই মুসলমানদের সবচেয়ে বড় সম্মেলন ও মিলনমেলা। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় আনন্দের জায়গা।

এ ধরনের বিশ্ব সম্মেলন অন্য কোনো ধর্ম বা জাতির মধ্যে সচরাচর দেখা যায় না। একমাত্র ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীরাই পৃথিবীর দিক-দিগন্ত থেকে ছুটে আসে বায়তুল্লাহর দিকে। সবাই মক্কা মুকাররমায় এসে তাদের স্বপ্নের জায়গা কা’বা তাওয়াফ করে আর ক্ষমার আশায় ‘লাব্বাঈকা আল্লাহুমা লাব্বাঈক’ ধ্বনি দিতে থাকে। তাদের এ আওয়াজে ওখানকার আকাশ ও বাতাস প্রকম্পিত হতে থাকে। হজ আমাদের যেমনি বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা দেয় ঠিক তেমনি ত্যাগ, সমতা, ক্ষমা, পাপের প্রতি ঘৃণাসহ অসংখ্য কল্যাণ কাজের বাস্তব প্রশিক্ষণ দান করে। রাজা-প্রজা, ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, নানা দেশের নানা ভাষা, বর্ণ, সাদা, কালো কোনো কিছুরই ভেদাভেদ থাকে না এ মিলনমেলায়। সবাই ছুটে চলে রবের আদেশ বাস্তবায়নে। সবারই একটা লক্ষ্য থাকে যে, নিজের গুনাহগুলো মাফ করিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন।


হজ হোক ঐক্যের মিলনমেলা

মুসলিম উম্মাহর নিকট জাতীয় পর্যায়ে হজের গুরুত্ব অপরিসীম। জীবনের দিক-নির্দেশনায় হজ মৌলিক ভূমিকা রাখে। বিশ্ব মানচিত্রে নিজেদের সঠিক পরিচয় নির্ণয়ে উদ্বুদ্ধ করে। একতার বন্ধনে প্রভুপ্রেমে নত হতে উৎসাহ দিয়ে যায় হজের বিধান। পরস্পরের মাঝে সম্প্রীতির লক্ষ্যে সব ধর্মেই কিছু আচার-অনুষ্ঠান আছে। যেখানে এসে নিজেরা সম্পর্ক রক্ষা করে চলে। কিন্তু ইসলাম ধর্মে প্রেমময় হজের সঙ্গে অন্য  কোনো ধর্মের তুলনা হয় না। 

হজ মুসলিম উম্মাহর ভ্রাতৃত্বের অনুপম নিদর্শন। সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও ঐক্যের সেতুবন্ধন। রাসূলে কারীম সা.-এর হাদিসে মুমিনদের এক দেহের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। হজের ইবাদতের মধ্যেই এক দেহ এক প্রাণের চোখ শীতল করা সেই অভাবনীয় দৃশ্য ফুটে ওঠে আপন মহিমাময়। হজের ইহরাম, তালবিয়া-  লাব্বাঈকা আল্লাহুম্মা লাব্বাঈক থেকে শুরু করে সর্বশেষ বিদায়ী তাওয়াফ পর্যন্ত একই ব্যঞ্জনা ধ্বনিত হয়। পবিত্র কাবার তাওয়াফ, সাফা মারওয়ায় সাঈ, আরাফায় অবস্থান, মিনায় কঙ্কর নিক্ষেপ ও তাওয়াফে জিয়ারতসহ হজের সব বিধানাবলির মধ্যে ঐক্যের সুবাস ছড়িয়ে আছে। তাই তো, আরাফার ময়দানে একই ইমামের পিছনে সবাই নামাজ পড়েন। মুসলিম উম্মাহর দিকনির্দেশনামূলক খুতবা প্রদান করে খতিব সাহেব। ব্যক্তি জীবন থেকে জাতীয় জীবনে কী করণীয়; বিস্তর আলোচনা করেন।

ইসলামের সব বিধান সংঘবদ্ধভাবে পালনের প্রতি গুরুত্ব এসেছে। যেমন- নামাজ জামায়াতের সঙ্গে আদায়ের তাগিদ করা হয়েছে। রোজা রাখার পর এক সঙ্গে অন্যকে নিয়ে ইফতার করার ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। কয়েকজন সফরে বের হলে একজনকে আমীর বানানোর নির্দেশ হাদিসে এসেছে। তেমনিভাবে হজের মতো মৌলিক ইবাদতও এক সঙ্গে আদায় করতে হয়। মোটকথা, ইসলামের সব বিধানের মধ্যে ঐক্যবদ্ধতার চিত্র ফুটে উঠেছে। তাই, ঐক্যবদ্ধভাবে ইসলামের বিধানাবলি পালনের মধ্যে আলাদা তাৎপর্য বহন করে। এ ক্ষেত্রে ইসলামী শরিয়ত একটি বিশেষ বার্তা দিতে চায়। আর তা হলো, সামগ্রিক জীবন পরিচালনায় মুসলিম উম্মাহকে একতাবদ্ধভাবে চলতে হবে।

হাদিসে গোটা মুসলিম উম্মাহকে এক দেহের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। নিজেদের মধ্যে পরস্পর ঐক্যবদ্ধ থাকার পাশাপাশি বিভেদ থেকে দূরে থাকার জন্য জোরালো নির্দেশ প্রদান করেছে কুরআনে কারিম। ইরশাদ হচ্ছে, ‘‘তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে ঐক্যবদ্ধভাবে আঁকড়ে ধর এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।’’ (সূরা আলে ইমরান : ১০৩) 

বায়তুল্লাহর হজ সারা বিশে^র মুসলমানদের মধ্যে সম্পর্কের সেতুবন্ধনের সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম। হজ উপলক্ষে বিশে^র মুসলমানদের যে মিলনমেলা ঘটে, তাতে ‘এক দেহ এক প্রাণ’-এর বাস্তব চিত্র ফুটে ওঠে। 

বর্তমান বিশ্বে ইসলাম যখন চরম হুমকির সম্মুুখীন। শতধা বিভক্ত মুসলিম উম্মাহ যখন অস্তিত্বের সংকটের সম্মুখীন, তখন হজের শিক্ষা আমাদের মধ্যে বাস্তবায়ন করে জাতীয় জীবনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। কারণ, হজ এমন একটি ইবাদত যাকে কেন্দ্র করে বিশ্বের মুসলমানরা একই সময়ে একই জায়গায় সমবেত হন। সুতরাং হজের সময় কাবার মিলনমেলাই হতে পারে বিশ্ব মুসলিমের ঐক্যবদ্ধতার মূল চেতনা। সেই চেতনায় উদ্যোগী হলে পতনোন্মুখ মুসলমানদের মধ্যে নতুন জীবনের সুবাতাস বইবে। সুন্দরের আলোক বিভায় শান্তির হিমেল পরশ জারি হবে। 

লেখক : প্রাবন্ধিক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির