আল কুরআনের আন্দোলন অদম্য
ড.মুহাম্মদ রেজাউল করিম
২৭ মার্চ ২০১৮
সত্য-মিথ্যার লড়াই পৃথিবীর শুরু থেকেই চলে আসছে। এ দুনিয়া নিষ্পাপ মানুষ হচ্ছেন নবী-রাসূলগণ। অথচ দুনিয়ায় সকল আম্বিয়ায়ে কেরাম দ্বীনের কাজ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। এ কাজে তাঁরা নানা রকম জুলুম-নির্যাতন, কারাবরণ, এমনকি শাহাদাতের নজরানাও পেশ করেছেন কিন্তু এ পথ থেকে পিছপা হননি। মানবতার বন্ধু আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মদ (সা) দীনে হকের দাওয়াত পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিতে বিভিন্ন সময় সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়েছে। এক মুতার যুদ্ধেই ৭০ জন হাফেজে কুরআন শাহাদাত বরণ করেছেন। পৃথিবীর শুরু থেকে আজ অবধি অসংখ্য দীনের মুজাহিদ জীবন বিলিয়ে আসছেন। শাহাদাতের সেই সিঁড়ি বেয়ে আজও এ জমিন উর্বর এবং প্রাণবন্ত। যে ভূখণ্ড আল্লাহর দীনের গোলামদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে সেখানেই দীনের মজবুত ঘাঁটিতে আত্মপ্রকাশ লাভ করেছে।
মূলত ইসলামী আন্দোলন কোনোকালেই মসৃণ পথ বেয়ে অগ্রসর হতে পারেনি। নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে ইসলামী আন্দোলন বিশ্বব্যাপী আলোকরশ্মি ছড়িয়েছে। আল কুরআনের আন্দোলন সময়ের বিবর্তনে নানা রকম ষড়ন্ত্রের শিকার ও বাধা-বন্ধুর পথ অতিক্রম করছে। প্রায় ১৫ শ’ বছর আগে মহাগ্রন্থ আল কুরআন অবতীর্ণ হয়ে অদ্যাবধি তা অবিকৃত থেকে মানব জীবনের সঠিক দিকেপালের ভূমিকায় আজও বিরাজমান। রুহের জগৎ থেকে শুরু করে কিয়ামতের বিচার দিবস পর্যন্ত আজ অবধি যা কিছু ঘটেছে এবং ঘটবে সব কিছুই আল কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ বলেছেন, “আমি কোনো কিছুই কুরআনে বা কিতাবে লিখতে ছাড়িনি।” (৬:৩৮) “আকাশে ও পৃথিবীতে যা কিছু গোপনীয় বিষয় আছে তা সবই সুস্পষ্টভাবে কিতাবে বর্ণিত হয়েছে।” (২৭:৭৫)
কিন্তু যখনই কুরআনের আলোয় আঁধার বা বাতিলকে সরিয়ে মানব সমাজকে আলোতে প্রত্যাবর্তনের নির্দেশনা দিয়েছে তখনই বাতিল শক্তি তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে তা রুখে দিতে উদ্যত হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত তাদের কওমের লোকেরা এ জন্য নবী ও রাসূলগণকে নানাভাবে জুলুম-নির্যাতন চালিয়েছে। কুরআনের আলো বিকশিত হওয়ার পথে অন্তরায় ছিল তৎকালীন মুশরিক ও কাফের গোত্র এবং তৎকালীন বিভিন্ন রাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠী। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইসলামকে দুনিয়ার বুকে বুলন্দ করার পথ দেখিয়েছেন।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার বান্দাদের পরিষ্কারভাবে বলেন, ‘নিশ্চয় আমিই কুরআন নাজিল করেছি আর আমিই তা হেফাজত করব।’ (সূরা হিজর, আয়াত নং ৯) মহাগ্রন্থ আল কুরআনে বলা হয়েছে, “তাঁর কাছেই অদৃশ্য জগতের চাবি রয়েছে। এগুলো তিনি ব্যতীত কেউ জানে না। স্থলে ও জলে যা আছে, তিনিই জানেন। কোন পাতা ঝরে না; কিন্তু তিনি তা জানেন। কোন শস্যকণা মৃত্তিকার অন্ধকার অংশে পতিত হয় না এবং কোন আর্দ্র ও শুষ্ক দ্রব্য পতিত হয় না; কিন্তু তা সব প্রকাশ্য গ্রন্থে রয়েছে।” (৬:৫৯)
যুগে যুগে আল কুরআনের আন্দোলন বাধার সম্মুখীন হয়েছে। বাংলাদেশে ১৯৮৫ সালের ১১ মে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঘটনা তারই অংশ। সে দিনের ঘটনা শুধু একটি স্মরণীয় ইতিহাস নয়, বাংলাদেশসহ পৃথিবীর মুসলমানদের জন্য এটি প্রেরণার উৎস। এটি একটি কালো অধ্যায় হয়ে থাকবে। মূলত ঘটনার সূত্রপাত ভারতে। ১৯৮৫ সালের ১০ এপ্রিল মহাগ্রন্থ আল কুরআন বাজেয়াপ্ত করার দাবি জানিয়ে পদ্মমল চোপরা ও শীতল শিং নামক দু’জন ভারতীয় নাগরিক কলকাতা হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দাখিল করেন। বিচারপতি পদ্মখস্তগীর বিচার বিশ্লেষণ না করেই রিট পিটিশনটি গ্রহণ করেন। আল কুরআন মুসলমানদের নিকট তাদের জীবনের চেয়েও প্রিয় গ্রন্থ। কুরআনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এ খবর দাবানলের মতো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। শুধু ভারত নয়, সারা দুনিয়ার মুসলমানের নিকট এ খবর পৌঁছে যায়। ভারতে শুরু হয় বিক্ষোভ।
বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও বিক্ষুব্ধ মুসলমানেরা রাস্তায় নেমে আসে। দলমত নির্বিশেষে বাংলাদেশের মুসলমানগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ঢাকায় জুমার নামাজ শেষে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। ‘কুরআনের অবমাননা জীবন দিয়ে রুখবো, দুনিয়ার মুসলমান এক হও’ ইত্যাদি শ্লোগানে ঢাকার রাজপথ প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের লেলিয়ে দেয়া পুলিশ বাহিনী ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের ওপর লাঠিচার্জ করে। বহু মুসল্লি আহত হন। এ ঘটনা ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের আরো ক্ষিপ্ত করে তুলে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ আলিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপাল হোসাইন আহমদকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠিত হয়। কমিটির বৈঠকে ১১ মে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ঈদগাহ ময়দানে বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং করে জনগণের নিকট খবর পৌঁছানো হয়। আয়োজকদের পক্ষ থেকে প্রশাসনকে জানিয়ে দেয়া হয় যে, এ কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হবে। সর্বস্তরের জনতার সাথে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরও এ কর্মসূচি সফল করার জন্য মাঠে-ময়দানে ব্যাপক তৎপরতা শুরু করে।
কিন্তু ‘শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে’ প্রশাসনকে বারবার অবহিত করার পরও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা সমাবেশ বানচালের ষড়যন্ত্র করে। বিশেষ করে ওই সময়কার কুখ্যাত ম্যাজিস্ট্রেট ওয়াহেদুজ্জামান মোল্লার নেতৃত্বে চক্রান্ত শুরু হয়। ১১ মে ম্যাজিস্ট্রেট ওয়াহিদুজ্জামান মোল্লা মাওলানা হুসাইন আহমদসহ কমিটির লোকদেরকে তার অফিসে ডেকে নেন এবং কর্মসূচি বন্ধ করার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। উপস্থিত ওলামায়ে কেরাম তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, এটা কোনো সরকারবিরোধী সমাবেশ নয়। কুরআনপ্রেমিক তৌহিদি জনতার সমাবেশ। এখানে কোন ধরনের হট্টগোল হবে না। নির্ধারিত সময়ে আমরা সংক্ষিপ্ত কথা বলে দোয়া ও মুনাজাতের মাধ্যমে কর্মসূচি সমাপ্ত করে দেবো। কিন্তু আলেমসমাজের কথায় কর্ণপাত না করে সমাবেশ বন্ধ করার জন্য চাপ সৃষ্টি করে।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হয় যে, আজকের সমাবেশ হবে না। এতে জনগণ আরো উত্তেজিত হয়ে পড়ে। দলে দলে মানুষ ঈদগাহ ময়দানের সামনে জড়ো হতে থাকে। ম্যাজিস্ট্রেট ওয়াহেদুজ্জামানের নির্দেশে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ঈদগাহ ময়দানে প্রবেশ করে ময়দান দখল করে নেয়। চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এ পরিস্থিতিতে কুখ্যাত ম্যাজিস্ট্রেট ও নাটের গুরু ওয়াহেদুজ্জামান মোল্লা পুলিশকে গুলি করার নির্দেশ দেন। পুলিশের গুলিতে আটজন শহীদ হন এবং বহু সংখ্যক আহত হন। শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করলেন-মাদরাসার ছাত্র শীস মোহাম্মদ, স্কুলছাত্র আব্দুল মতিন, রাশিদুল হক রাশিদ, রেলশ্রমিক নজরুল ইসলাম, রিকশাচালক মোক্তার হোসেন, কৃষক আলতাফুর রহমান সবুর, স্কুলছাত্র সেলিম ও সাহাবুদ্দিন। প্রশাসন বাধ্য হয়ে রাতে কারফিউ জারি করে। জনতার ভয়ে প্রশাসন ওয়াহেদুজ্জামান মোল্লাকে বদলি করে রাতের আঁধারে ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়।
আধুনিক সভ্যতার এই একবিংশ শতাব্দীতেও ইসলামের প্রাকভূমি আরবভূমিসহ গোটা বিশ্বে কুরআন ও ইসলামী আন্দোলনের ওপর অবর্ণনীয় ষড়যন্ত্র চলছে নিরন্তর। আর বাতিল ও কুফরি শক্তির এই ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় আজও দায়ীদের আত্মত্যাগ করতে হচ্ছে। ১১ মের ঘটনা তার এক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির ‘১১ মে দিনটিকে কুরআন দিবস’ হিসেবে পালন করে থাকে। সে ষড়যন্ত্র আজও থেমে থাকেনি। সেই মোল্লা ওয়াহিদুজ্জামানরা প্রতিনিয়ত বাংলাদেশসহ পৃথিবীর নানা প্রান্তে কুরআনের কর্মীদের হত্যা করছে। এ কারণে কুরআন দিবসটি শুধুমাত্র একদিনের গণ্ডির মধ্যে নেই বরং তা এখন প্রতিটি দিনে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কুরআন-বিরোধী শক্তিগুলোর তৎপরতা মূল্যায়ন করলে কুরআন দিবসের পরিধি অনেকাংশে ফুটে ওঠে। ইসলামী আন্দোলনের পথিকৃৎ আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সাহেবের সাজানো মিথ্যা মামলার রায়কে কেন্দ্র করে দেশের ইসলামপ্রিয় লাখো মুসলমানের বিক্ষোভ মিছিলে আওয়ামী লীগ সরকার গুলি চালিয়ে একদিনে ১৭৫ জনকে শহীদ করে। এরপর প্রতিনিয়ত সারাদেশের হাজারো ইসলামী আন্দোলন তথা কুরআনের দায়ীদের গুম-খুন করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগ সরকার ইসলামী আন্দোলনের ও কুরআনের স্কলার বিচারিক হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে শহীদ আমিরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, আবদুল কাদের মোল্লা ও জামায়াতে ইসলামীর নির্বাহী পরিষদ সদস্য মীর কাসেম আলীকে কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে শহীদ করে। এ ছাড়াও কারাপ্রকোষ্ঠে কুরআনবিরোধী জালিম আওয়ামী সরকারের পরিকল্পিত কারানির্যাতনে মারা যান মরহুম সাবেক আমিরে জামায়াত ভাষা সৈনিক অধ্যাপক গোলাম আযম, সাবেক নায়েবে আমির এ কে এম ইউসুফ। নির্যাতনে তারা এখানেই ক্ষান্ত হননি বরং মৃত্যুদন্ডাদেশ নিয়ে এখনো কারাগারে আছেন, নায়েবে আমির মাওলানা আব্দুস সোবহান ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ টি এম আজহারুল ইসলাম এবং যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ নিয়ে আছেন নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সাহেব।
আর এসব নির্র্যাতনের মূল লক্ষ্যই হলো কুরআনের আন্দোলনকে নিভিয়ে দেয়া। কিন্তু এ আন্দোলন যে কোন দিনই নিভে যাবে না তা আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনেই ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন, “এরা (কাফেররা) তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়, অথচ আল্লাহর ফয়সালা হলো তিনি তার নূরকে প্রজ্বলিত করবেন।” (সূরা সফ : ৮)
মহাগ্রন্থ আল কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আমি আমার রাসূলগণকে সুস্পষ্ট নিদর্শনসহ প্রেরণ করেছি এবং তাঁদের সাথে অবতীর্ণ করেছি কিতাব ও ন্যায়নীতি, যাতে মানুষ ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করে। আর আমি নাজিল করেছি লৌহ, যাতে আছে প্রচণ্ড রণশক্তি এবং মানুষের বহুবিধ উপকার। এটা এ জন্য যে, আল্লাহ জেনে নিবেন কে না দেখে তাঁকে ও তাঁর রাসূলগণকে সাহায্য করে। আল্লাহ শক্তিধর, পরাক্রমশালী।” (৫৭:২৫) আর মহা কিতাব আল-কুরআন নাজিল হয়েছে মহান আল্লাহ কর্তৃক বিশ্ববাসী এবং সমগ্র মানবজাতির জন্য সূসংবাদ ও সতর্কীকরণ হিসেবে মুহাম্মদ (সা)-এর ওপর যিনি শেষ রাসূল হিসেবে প্রেরিত হয়েছিলেন। মহান আল্লাহ নবী মুহাম্মদ (সা)-কে সুসংবাদ দিয়ে আল্লাহ বলেছেন, “আমি আপনাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপই প্রেরণ করেছি।” (২১:১০৭)
অতএব, কুরআনের পরে আর কোনো কিতাব জিন ও মানবজাতির জন্য আসবে না। তাই, যারা কুরআনের ওপর বিশ্বাস রাখে না; তাদের জন্য রয়েছে মহা অগ্নিকুণ্ড যেখানে তারা চিরকাল থাকবে। কুরআনের আয়াত গোপনকারী, অবমাননাকারী এবং বিকৃতকারীদের জন্য রয়েছে মহা দুঃসংবাদ।
কুরআনুল কারিমের আয়াত গোপনকারীদের পরিণাম সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেছেন, “নিশ্চয় যারা গোপন করে, আমি যেসব বিস্তারিত তথ্য এবং হেদায়েতের কথা নাজিল করেছি মানুষের জন্য কিতাবের মধ্যে বিস্তারিত বর্ণনা করার পরও; সে সমস্ত লোকের প্রতিই আল্লাহর অভিসম্পাত এবং অন্যান্য অভিসম্পাত-কারীগণেরও। তবে যারা তওবা করে এবং বর্ণিত তথ্যাদির সংশোধন করে মানুষের কাছে তা বর্ণনা করে দেয়, সে সমস্ত লোকের তওবা আমি কবুল করি এবং আমি তওবা কবুলকারী পরম দয়ালু।” (২:১৫৯-১৬০)
পৃথিবীতে বাতিলপন্থীরা যতভাবেই কুরআনের আন্দোলনকে নিঃশেষ করার পদক্ষেপ গ্রহণ করুক না কেন কুরআন আপন মহিমায় প্রজ্বলিত হবেই। মহান আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং এর হিফাজতের দায়িত্ব নিয়েছেন। আজ ইসলাম ও কুরআন শুধুমাত্র আরবদের মধ্যে নেই, তা এখন বিশ্বব্যাপী। ইসলামের এই অগ্রযাত্রা সম্পর্কে একজন বিখ্যাত প্রাচ্য ভাষাবিদ জার্মান পণ্ডিত ইমানুয়েল ডিউস বলেন, ‘কুরআনের সাহায্যে আরবরা মহান আলেকজান্ডারের জগতের চাইতেও বৃহত্তর জগৎ, রোম সাম্রাজ্যের চাইতেও বৃহত্তর সাম্রাজ্য জয় করে নিয়েছিলেন। কুরআনের সাহায্যে তারাই রাজাধিপতি হয়ে এসেছিলেন ইউরোপে যেথায় ভেনিসীয়রা এসেছিল ব্যবসায়ী রূপে আর ইহুদিরা এসেছিল পলাতক বা বন্দী রূপে।’
ইতিহাস সাক্ষী পৃথিবীতে ইসলাম ও ইসলামী আন্দোলনের ওপর জুলুমকারী অতীতের কোনো সম্প্রদায়ের পরিণতি ভালো হয়নি। যারাই ইসলামের ওপর আঘাত করেছে তারাই কালক্রমে ধ্বংস হয়েছে। তিনি জালেমকে অবকাশ দেন। কুরআনে এই প্রসঙ্গে ইরশাদ হয়েছে : আল্লাহ যদি মানুষকে তাদের জুলুমের কারণে সাথে সাথেই পাকড়াও করতেন তাহলে দুনিয়ার কোনো একটি প্রাণীকেও ছেড়ে দিতেন না। কিন্তু তিনি সবাইকে এক নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত অবকাশ দিয়ে থাকেন। যখন ঐ সময় এসে যায় তখন এক মুহূর্তও আগে বা পরে হতে পারে না। (নূরা নহল : ৬১)
আল্লাহ বলেন, “তাদের আগেও বহু লোক (সত্যকে খাটো করে দেখাবার জন্য) এমনি ধরনের চক্রান্ত করেছিল। তবে দেখে নাও, আল্লাহ তাদের চক্রান্তের ইমারত সমূলে উৎপাটিত করেছেন এবং তার ছাদ ওপর থেকে তাদের মাথার ওপর ধসে পড়ছে এবং এমন দিক থেকে তাদের ওপর আজাব এসেছে যেদিক থেকে তার আসার কোনো ধারণাই তাদের ছিল না। (সূরা নহল ২৬) মহাগ্রন্থ আল কুরআনে বলা হয়েছে, “তারপর যারা (নবীর দাওয়াতের বিরোধিতায়) নিকৃষ্টতম চক্রান্ত করছে তারা কি এ ব্যাপারে একেবারে নির্ভয় হয়ে গেছে যে, আল্লাহ তাদেরকে ভূগর্তে প্রোথিত করে দেবেন না অথবা এমন দিক থেকে তাদের ওপর আজাব আসবে না যেদিক থেকে তার আসার ধারণা-কল্পনাও তারা করেনি? (সূরা নহল : ৪৫)
উক্ত আয়াতের সমর্থনে হজরত আবু মুসা হতে একটি হাদিস বর্ণিত আছে। তিনি বলেন, রাসূলে কারিম (সা) ইরশাদ করেছেন যে আল্লাহ পাক জালিমকে অবকাশ দিয়ে থাকেন। পরিশেষে তাকে এমন শক্তভাবে পাকড়াও করেন যে তাকে আর ছাড়েন না। (বুখারি ও মুসলিম)
পক্ষান্তরে যারা জুলুমের শিকার হয়ে শাহাদাত বরণ করেন তাদের জন্য আল্লাহ তায়ালা নানা প্রকার পুরস্কারের ব্যবস্থা করে রেখেছেন দুনিয়া ও আখিরাতে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, “যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়, তাদেরকে মৃত বলো না, এরা তো আসলে জীবিত। কিন্তু তাদের জীবন সম্পর্কে তোমাদের ধারণা হয় না।” (সূরা বাকারা : ১৫৪)
কুরআনের আরেকটি সূরায় আল্লাহ বলেন, “যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তাদেরকে মৃত মনে করো না, তারা তো আসলে জীবিত। তারা তাদের রবের কাছ থেকে রিজিক পাচ্ছে।” (সূরা আলে ইমরান : ১৬৯)
বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বে বাতিল শক্তিগুলো ইসলামের নিশানা মুছে ফেলার জন্য নানা কৌশলে নির্যাতন চালাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলীয় শহর কুন্দুজে একটি মাদ্রাসায় হাফেজে কুরআনদের সনদ বিতরণ ও দস্তরবন্দী অনুষ্ঠানে ইহুদিবাদী ইসরাইল ও মার্কিন বিমানবাহিনী চলতি বছরের ২৫ এপ্রিল বোমা হামলা চালিয়ে কয়েকজন সাধারণ মুসলিমসহ ৭০ জন শিশু হাফেজে কুরআনকে শহীদ করে। যা ইতিহাসের বর্বরোচিত ঘটনা। আর এরূপ বর্বর হামলা মূলত মুললিম নামধারী আফগান শাসকদেরই প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় চালিয়ে যাচ্ছে বাতিলেরা। তারা কুরআন ও দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করে ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আল্লাহতায়ালা কুরআনে বলেছেন, “যারা ঈমানের পথ অবলম্বন করেছে, তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে। আর যারা কুফরির পথ অবলম্বন করেছে, তারা লড়াই করে তাগুতের পথে। কাজেই শয়তানের সহযোগীদের সাথে লড়ো, এবং নিশ্চিত জেনে রাখো, শয়তানের কৌশল আসলে নিতান্তই দুর্বল।” (সূরা নিসা :৭৬)
নশ্বর পৃথিবীতে আল্লাহতায়ালা মানবজাতিকে খলিফা হিসেবে প্রেরণ করেছেন। মানুষের জন্য ইসলামকে পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা হিসেবে দিয়েছেন। আর এই জীবনব্যবস্থার বাস্তবায়নে শয়তানি তথা তাগুতি শক্তির মোকাবেলা করার জন্য পথ বাতলিয়ে দিয়েছেন। দৃশ্যত গোটা বিশ্বে দু’টি শক্তির দ্বন্দ্ব বিরাজমান। একটি হলো হক আরেকটি হলো বাতিল। আর হকপন্থী শক্তি তথা ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা প্রতিনিয়ত শাহাদাতের অমিয় শুধা পান করছে। কিন্তু আল্লাহর ওয়াদা তিনি মুমিনদের বিজয় দান করবেন। ১৯৮৫ সালের ১১ মে কুরআন দিবস তা কার্যত এখন আর একটি দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বরং এখন প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্ত কুরআন দিবসের মতো ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে। পৃথিবীতে হয়ত এমন কোন মুহূর্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না যখন ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের রক্ত ঝরছে না। বাংলার প্রতিটি জনপদ এখন শহীদি রক্তে রঞ্জিত। শহীদের রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজ এখন আমাদের অনুষঙ্গ। মজলুমের আহাজারিতে আজ আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত। তাই কুরআনের কর্মীদের প্রতি মুহূর্তে কুরআন দিবসের অনুভূতিকে ধারণ করে এ জমিনে দায়ী ইলাল্লাহর ভূমিকা পালন করতে হবে। আল্লাহতায়ালা শহীদের সর্বোচ্চ মর্যাদা দান করুন, আমাদেরকে দীনের পথে কবুল করুন, আমিন।
লেখক : সহকারী সম্পাদক,
সাপ্তাহিক সোনার বাংলা
আপনার মন্তব্য লিখুন