বিশ্বনবী সা.-এর সামগ্রিক জীবন মুসলিম উম্মাহর জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। দাম্পত্য জীবনের যাবতীয় আচার-আচরণ ইসলামের আলোকে কিভাবে পরিচালিত হবে সে সম্পর্কে সম্যক অবগত না হলে মুসলিমদের ইবাদত থেকে যায় অপূর্ণাঙ্গ। বিশ্বনবীর দাম্পত্য জীবনের সমস্ত বিষয় উম্মাহর কাছে নিখুঁতভাবে বর্ণনা করেছেন তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী হজরত আয়িশা সিদ্দিকা রা.। তিনি ছিলেন অন্যতম কাতিবে হাদিস। পিতা আবু বকর রা.-এর খেলাফতকালে এবং অন্যান্য খোলাফায়ে রাশেদাকে নির্ভরযোগ্য মাসয়ালা দিয়ে সহযোগিতা করে ইতিহাসে অনন্য স্থান দখল আছেন তিনি। মুসলিম রমণীদের সব রকমের সমস্যার সমাধানে হজরত আয়িশা সিদ্দিকা রা.-এর এই তথ্যগুলো না জানলে সঠিকভাবে ইসলাম বুঝার ঘাটতি থেকে যায়। কারণ তিনি বালেগা হওয়ার শুরু থেকেই তামাম দুনিয়ার শিক্ষক মুহাম্মদ সা.-এর নিকট থেকে সবকিছু জেনে নিতেন। এর আগে পিতা আবু বকর রা.-এর কাছে ইলম চর্চা করেন। বিশ্বের যেকোনো পণ্ডিত যদি গভীরভাবে এই বিষয়গুলো পর্যালোচনা করতো তবে ইসলামের সুমহান আদর্শের কাছে নিজের মাথা অবনত করে দিতো। কিন্তু অস্বীকারকারী এবং জ্ঞানপাপীদের বুঝানোর তো কোনো উপায় নেই। যুগে যুগে ইসলামদ্রোহী শক্তি ইসলামের অবমাননায় নানারকম ফন্দি-ফিকির সৃষ্টি করেছে; কিন্তু ইসলামের অনুসারীরা জীবনের সবকিছুর বিনিময়ে ইসলামের সম্মান রক্ষায় সচেষ্ট থেকেছে, অদ্যাবধি সচেষ্ট আছে।
হজরত আয়িশা রা.-এর পরিচয়
হজরত আয়িশা রা. ছিলেন হজরত মুহাম্মদ সা.-এর সর্বকনিষ্ঠা স্ত্রী। ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক রা.-এর কন্যা। তার মায়ের নাম উম্মে রুম্মান। উপাধি সিদ্দিকা ও হুমায়রা। উপনাম উম্মুল মুমিনিন (বিশ্বাসীদের মাতা) ও উম্মু আবদুল্লাহ। তিনি হিজরতের পূর্বে ৬১৩-৬১৪ খ্রিস্টাব্দে মক্কায় জন্মগ্রহণ করেন। কুরাইশ বংশের নিয়ম অনুযায়ী জন্মের পর তার লালন-পালনের ভার দেওয়া হয় ওয়ায়েল নামে এক লোকের স্ত্রীর ওপর। শিশুকাল থেকেই তিনি ছিলেন প্রখর মেধার অধিকারিণী। ফলে ছোটবেলা থেকেই তার শিক্ষা জীবন শুরু হয়। এ সময় তাঁর আচার-আচরণ, চালচলন, কথাবার্তা ও মেধাশক্তি সকলকে মুগ্ধ করেছিল। শৈশবের বর্ণিল আভা কাটিয়ে উঠতে পারেননি বলেই তিনি অন্য শিশুদের মতো খেলাধুলা আমোদ-ফুর্তি ও দৌড়াদৌড়ি করতে ভালোবাসতেন।
হজরত আয়শা রা.-এর
সাংসারিক জীবন
হজরত খাদিজাতুত তাহিরা রা.-এর মৃত্যুর পর নবুওয়াতের দশম বছরে মহানবী সা.-এর সাথে হজরত আয়িশা সিদ্দিকা রা.-এর শুভবিবাহ সম্পন্ন হয়। এ বিবাহের ঘটক ছিলেন হজরত খাওলা বিনতে হাকিম। দেনমোহর নির্ধারিত হয় ৪৮০ দিরহাম। বিবাহের তিন বছর পর রাসূল সা.-এর সাথে হজরত আয়িশা রা.-এর দাম্পত্য জীবন শুরু হয়। তাঁর পিতা আবু বকর রা. এ বিবাহের কাজীর দায়িত্ব পালন করেন। হজরত আয়িশা রা. রাসূল সা.-এর অতি আদরের সহধর্মিণী ছিলেন। তিনি মহানবী সা.-এর স্ত্রীদের থেকে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন। রাসূল সা. বলেন, নারীজাতির ওপর আয়িশা রা.-এর মর্যাদা তেমন, যেমন খাদ্যসামগ্রীর ওপর সারিদের মর্যাদা। (বুখারি ও ইবনে মাজাহ) সারিদ হলো আরবের বিখ্যাত খাদ্য যা রুটি, গোশত ও ঝোলের সমন্বয়ে তৈরি হয়। রাসূল সা. আরো বলেন, আয়িশা রা. হলেন মহিলাদের সাহায্যকারিণী। (কানযুল উম্মাহ) একবার নবী করীম সা. হজরত আয়িশা রা.কে লক্ষ্য করে বললেন, হে আয়িশা, ইনি জিবরাইল (আ) তোমাকে সালাম দিচ্ছেন। (বুখারি) হজরত আয়িশা রা. নিজ বুদ্ধিমত্তা কর্ম-দক্ষতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে বিশেষ মর্যাদা অর্জন করেছিলেন। আজকের নারীসমাজও যদি হজরত আয়িশা রা.-এর মতো তপস্যা করেন তাহলে তারাও মর্যাদাবান হবেন। হজরত আয়িশা রা. ছিলেন বিচক্ষণ, বুদ্ধিমতী অসাধারণ জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারিণী। তিনি জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অসাধারণ ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। বিশেষ করে তাফসির, হাদিস, ফিকাহ ও আরবদের বিভিন্ন ঘটনা সম্পর্কে তাঁর অসাধারণ দক্ষতা ছিল। শরিয়তের বিভিন্ন মাসয়ালা মাসায়েল নীতিগত বিষয়ে তার পরামর্শ নেওয়া হতো। তুলনামূলক কম বয়স হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন নারীদের মধ্যে সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী। অনেক সাহাবি ও তাবেয়ি তার কাছ থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। তার বর্ণিত হাদিসের সংখ্যা ২২১০টি। তার মধ্যে ১১৪টি হাদিস ইমাম বুখারি ও ইমাম মুসলিম যৌথভাবে বর্ণনা করেছেন। ইমাম বুখারি ৫৪টি হাদিস এবং ইমাম মুসলিম ৬৯টি হাদিস এককভাবে তাদের কিতাবে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহর কিতাব ও সুন্নাতের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। ইবনে শিহাব জহুরী বলেন, তিনি (আয়িশা) মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বড় জ্ঞানী ছিলেন। (তাহজিবুত তাহজিব)
আল্লাহর হাবিব সা.-এর পবিত্র স্ত্রী আয়িশা রা.-এর কোনো সন্তান ছিল না। নবীজির ঘরে খাদিজা রা.-এর ছয়জন সন্তান জন্মগ্রহণ করেছিলো। চার কন্যা, দুই ছেলে। এটা দেখে আয়িশা রা.-এর মনেও আশা জাগ্রত হওয়া বিচিত্র কিছু ছিলো না! কিন্তু তিনি সন্তানের জন্য দোয়া করেছেন বা রাসূল সা.-এর কাছে দোয়া চেয়েছেন এমন কোনোও নজির হাদিসে নেই। অথচ তিনি ছিলেন বিশ্বনবী সা.-এর প্রিয়তমা স্ত্রী। সন্তান চাওয়া অন্যায় কোনো কিছু নয়। নবীজিকে বললেই হতো। তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করতেন। আয়িশা রা. এমনটা করেননি। নবীজি যখন ইন্তেকাল করেন তখন আয়িশা রা.-এর বয়স মাত্র ১৮। তিনি ইন্তেকাল করেছেন ৫৮ হিজরিতে। তার মানে নবীজির সা. পরও তিনি প্রায় ৪৭ বছর বেঁচে ছিলেন। এই দীর্ঘ সময় তিনি স্বামী সন্তান ও সংসার ছাড়াই কাটিয়ে দিয়েছেন। কখনো সন্তান বা সংসারের জন্য সামান্য আক্ষেপ করেছেন এমন কোনো প্রমাণ নেই। তিনি ইলমচর্চা, ইবাদত-বন্দেগি, শিক্ষকতা-ফতোয়া প্রদান করেই জীবনের পুরো সময়টা কাটিয়ে দিয়েছেন। বড় বড় সাহাবি রা.গণ তার কাছ থেকে পাঠ নিয়েছেন। তিনি মদিনার সমস্ত মহিলাকুলের শিক্ষিকা ছিলেন। সন্তান না হলে একজন মেয়ের জীবন ব্যর্থ হয়ে যায় না। স্বামী মারা গেলে একজন মেয়ের জীবন থমকে যায় না। মা-বাবা মারা গেলে একজন মেয়ের জীবন স্থবির হয়ে পড়ে না। সংসার না হলে একজন মেয়ের জীবন অর্থহীন হয়ে যায় না। এগুলো কোনোটাই জীবনের ব্যর্থতা বা সফলতার মানদণ্ড নয়। কোনো কিছু পাওয়া না পাওয়া আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা, এতে বান্দার ভালো বা মন্দ হওয়া প্রতিফলিত হয় না। আবার কখনো আল্লাহ তায়ালা যা ছিনিয়ে নেন, তার চেয়ে উত্তম কিছু বান্দাকে দান করেন। দুনিয়া একটি পরীক্ষার স্থান। কেউই এখানে পরীক্ষা দেওয়া ছাড়া থাকতে পারে না। সন্তানাদি থাকা যেমন পরীক্ষা, না থাকাও তেমনি পরীক্ষা। আয়িশা রা. বিষয়টা ভালোভাবে জানতেন এবং কর্মের মাধ্যমে তা মেনে দেখিয়ে দিয়েছেন। জীবনকে তিনি মানুষের কল্যাণে ব্যয় করেছেন। আল্লাহর ফায়সালার প্রতি সন্তুষ্ট থেকেছেন। সবর-শোকরের সাথে জীবন কাটিয়েছেন। চপল কিশোরী অবস্থায় বিয়ে হলেও তিনিই ছিলেন রাসূলে কারীম সা.-এর সবচেয়ে আস্থাভাজন স্ত্রী। হিজরতসহ জীবনের বহু বিষয়ে তিনি আয়িশা রা.-এর সাথে পরামর্শ করেছেন। ইফকের ঘটনায় আল্লাহ সরাসরি তার বিষয়ে আসমানি ওহি নাজিল করেছেন। তিনি কুরআন কারীমকে সাথী বানিয়েছেন, হাদিসচর্চাকে জীবনের অনুষঙ্গ বানিয়েছেন। সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারীদের মাঝে অন্যতম হয়ে আছেন আম্মাজান হজরত আয়িশা সিদ্দিকা রা.।
ইসলামের খিদমতে আয়িশা রা.
উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়িশা রা. শিক্ষাদানে নিয়োজিত ছিলেন। বিশেষভাবে নারীদের বিভিন্ন বিষয়ে তার কাছে জিজ্ঞাসা করা হতো। তিনি হাদিস শিক্ষাদানে বেশি সময় ব্যয় করতেন। একসাথে তার শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২০০ এর অধিক। অনেক বড় বড় সাহাবি তাঁর থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন। তিনি বিভিন্ন ঘটনা, প্রশ্নোত্তর এবং সামাজিক বাস্তবতার আলোকে শিক্ষা দিতেন। হজরত আবু মুসা আশয়ারী রা., আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা., আমর ইবনে আস রা. প্রমুখ সাহাবি তার হাদিসের পাঠদানে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন।
সাহাবি আবু মুসা আশয়ারী রা. বলেন, যখন কোনো হাদিস বুঝতে আমাদের অসুবিধা হতো আমরা সরাসরি আম্মাজান আয়িশা রা.-এর কাছে চলে যেতাম। ইবনে হাজার আসকালানি (রহ) তাকে ‘উম্মাহর ফকিহা’ হিসেবে বিবেচনা করতেন। রাসূল সা.-এর আর কোনো স্ত্রী ফতোয়া দেবার মতো স্ট্যাটাস অর্জন করতে পারেননি। রাসূলুল্লাহ সা. রাতের তাহাজ্জুদ সালাত সবসময় আয়িশা রা.-এর বিছানায় পড়েছেন। হাদিসে এসেছে, তিনি যখন সিজদা দিতেন তখন বিছানা সঙ্কীর্ণ হবার কারণে মা আয়িশা রা.-এর পা রাসূল সা.-এর মাথা স্পর্শ করতো আর তিনি পা গুটিয়ে ফেলতেন। আরো বিস্ময়ের বিষয় যে, বিবি খাদিজার রা.-এর পর আয়িশা রা.-এর সা. সাথে থাকাকালীন আল্লাহর রাসূল সা. ওহি পেয়েছেন, অন্য স্ত্রীগণের এ অভিজ্ঞতা হয়নি। সবশেষ ইন্তেকালের সময়ও রাসূলুল্লাহ সা. আয়িশার সান্নিধ্যে ছিলেন এবং তার হুজরাতেই তাকে শায়িত করা হয়। আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন, ‘আমাকে স্বপ্নে তোমাকে দেখানো হয়। একজন ফেরেশতা রেশমের টুকরোতে করে তোমাকে নিয়ে আসে। তিনি বলেন, ইনি আপনার স্ত্রী। অতঃপর আমি চেহারা খুলে তোমাকে দেখতে পাই। আমি বললাম, ইনি আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়ে থাকলে তা যেন অবধারিত হয়।’ (উম্মুল মুমিনিন, ইয়াসির ক্বাদিহ) একবার আমর বিন আস রা. রাসূল সা.- কে জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনার কাছে প্রিয়তম ব্যক্তি কে? তিনি বলেন, আয়িশা। আমি বললাম, পুরুষদের মধ্যে? তিনি বলেন, তাঁর বাবা’। (বুখারি-৩৬৬২) আবু মুসা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেছেন, ‘পুরুষদের মধ্যে অনেকে পূর্ণতা অর্জন করেছেন। তবে নারীদের মধ্যে পূর্ণতা অর্জন করেছেন কেবল মারইয়াম বিনতে ইমরান ও ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া। আর সব খাবারের মধ্যে সারিদ যেমন তেমনি সব নারীদের মধ্যে আয়িশা শ্রেষ্ঠ মর্যাদার অধিকারী।’ (বুখারি-৩৪১১) আয়িশা রা. ছিলেন নবী মুহাম্মদ সা.-এর তিনজন কুরআন মুখস্থকারী স্ত্রীদের মাঝে একজন। জনগণ তাকে নবীজি সা.-এর কাছ থেকে ‘সিদ্দিক’ (সত্যবাদী) উপাধি প্রাপ্ত আবু বকর রা.-এর কন্যা হিসেবে ‘সিদ্দিকা বিনতু সিদ্দিক’ (সত্যবাদীর কন্যা সত্যবাদিনী) বলে ডাকতো। ইসলামের ঐতিহ্য অনুসারে, তাকে ‘উম্মুল মুমিনিন’ (বিশ্বাসীদের মাতা) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
হজরত আয়িশা রা.-এর চরিত্র ও আদর্শ অতুলনীয়। তিনি তাঁর চারিত্রিক গুণাবলির দ্বারা সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছেন। আর তাঁর মধ্যে বহু গুণের সমন্বয় ঘটেছিল। তিনি ছিলেন অনন্য সুন্দরী, তীক্ষ্ণ মেধাসম্পন্ন, সত্যের সাধক, আদর্শ স্বামী সেবিকা, সদালাপী তথা মানবীয় চরিত্রের সকল গুণ তার মধ্যে বিদ্যমান ছিল। রাতের অধিকাংশ সময় তিনি ইবাদতে মশগুল থাকতেন। গরিব অসহায়দের দান সদকা করতেন। দানশীলতা, মিতব্যয়িতা, দয়া, পরোপকারিতা তাঁর ছিল চারিত্রিক ভূষণ। স্বামীর প্রতি ভালোবাসা তাঁর জীবনের অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল। রাসূল সা. তাঁর সাথে খেলাধুলা ও দৌড় প্রতিযোগিতা করতেন। মুসলিম উম্মাহর দাম্পত্য জীবনকে সুখ ও সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ করতে হজরত আয়িশা সিদ্দিকা রা.-এর জীবনী অতুলনীয় উদাহরণ।
লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক
আপনার মন্তব্য লিখুন