post

ইন্টারনেটের অবাধ ব্যবহার ধ্বংস করছে শিক্ষার্থীদের চরিত্র

ওয়াহেদুজ্জামান আহমেদ

চরিত্র মানুষের অমূল্য সম্পদ। বলা হয়-কারো টাকা হারানো গেলে সেটা তেমন কিছু ক্ষতি নয়, স্বাস্থ্য হারানো গেলে সেটা কিছুটা ক্ষতি, কিন্তু চরিত্র হারিয়ে ফেললে সেটা সার্বিক ক্ষতি। ইন্টারনেটের অবাধ ব্যবহারের সুযোগ বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের চরিত্র ধ্বংস করছে। যেটা জাতি হিসেবে মারাত্মক, লজ্জাকর ও ভয়ঙ্কর ক্ষতি। ইন্টারনেট নিজে অপরাধী নয় বরং ইন্টারনেটের অপব্যবহার করে প্রাণিকুল, মানুষ ও মানবতাকে চরম অপমান ও অবমাননা করার জন্য এক শ্রেণির মানুষ উঠে পড়ে লেগেছে। যেমন- সাদা কাপড়ে বিন্দু পরিমাণ দাগ লাগলে সেটা সবার চোখে পড়ে, তেমনিভাবে ব্যক্তিত্ব নষ্ট হলে চরিত্রে দাগ পড়ে যায়।

‘হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা) হতে বণিত, তিনি বলেন রাসূল (সা) ইরশাদ করেন, কোনো কিছুতে লজ্জা কেবল উক্ত বস্তুর সৌর্ন্দযকেই বৃদ্ধি করে, আর কোনো কিছুতে অশ্লীলতা কেবল উক্ত বস্তুকে কলুষিত এবং কলঙ্কিতই করে।’ (তিরমিজি : ১৯৭৪; ইবনু মাজাহ : ৪১৮৫)

বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের ব্যবহারের হার দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। এদেশে মোবাইল ফোনের ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নতির হিসাব কিরূপ তা বলাই বাহুল্য। সাধারণ খেটে খাওয়া কিছু মানুষ হয়তো এ দিয়ে বায়বীয় ব্যবসা করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু এর কিছু খারাপ দিক আমাদের বিব্রত করছে ও চরম লজ্জার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এদেশে মোবাইল ফোনের পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের হাতে নানা ধরনের আধুনিক ডিভাইস প্রতিনিয়ত ছড়িয়ে পড়ছে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে এগুলো কেন? স্কুলের বাচ্চাদের হাতে দামি মোবাইল ফোনসেট কে কিনে দিচ্ছে? ল্যাপটপ, আইপ্যাড, ট্যাব, আইফোন, স্মার্টফোন দিয়ে শিশু-কিশোরদের কাজ কী? বাবা-মাকে লুকিয়ে সেগুলো দিয়ে তারা কী করে? স্কুলে নিয়ে গিয়ে সহপাঠীদেরকে তারা কী দেখায়? অভিভাবকরা একবারও তা ভেবে দেখেছেন কি? এতদিন ভেবে না দেখে থাকলে আজই দেখুন আজই সতর্ক হোন!

প্রশ্ন হলো- বাংলাদেশে ইন্টারনেটে ঢুকলেই কি আমাকে লজ্জার মুখোমখি হতে হবে? এগুলো কি শুধু বিজ্ঞাপন? তবে কি ভাইরাস? না মোটেই নয়! তাহলে কি চরিত্র হননের মাধ্যমে আমাদের জাতীয় উন্নতি ও বিকশিত হওয়ার পথ রুদ্ধ করার হীন ষড়যন্ত্রের প্রক্রিয়া? হয়তো বা তাই! কারণ শিশুরাই যদি আমাদের ভবিষ্যৎ হয়, কিশোর-যুবরাই যদি বর্তমান শক্তি হয় তবে আমাদের এ শক্তি অবাধ ইন্টারনেটের অশ্লীলতার নিকট আজ পরাজিত হতে চলেছে!

ধরুন একটি অনলাইন পত্রিকায় ঢুকেছি। তার ডানে বাঁয়ে শত শত বিজ্ঞাপন। অশালীন, অরুচিকর অঙ্গভঙ্গি করে নানা বয়সের নারী-পুরুষের ছবি। হঠাৎ বিব্রতকর ক্যাপশন, আবেদনময়ী কোনো উলঙ্গ মডেলের বিজ্ঞাপন। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সামনে এই আবেদন করলে দোষটি কার? এগুলো নিয়ন্ত্রণ করার কেউ কি নেই? নয়-দশ বছর পূর্বে পড়াশুনা করার সময় একটি উন্নত দেশের অনেক পত্রিকা ঘেঁটেছি, অনেক ওয়েব পেজ সার্চ করেছি, এখনও সেসব দেশের ওয়েবসাইটে সার্চ করি। কই বর্তমানেও বিব্রত হবার মতো কোনো কিছু তো চোখে পড়ে না! কারণ তাদের দেশের কর্তৃপক্ষ সেগুলো ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন। গেটওয়েতে ফায়ারওয়াল দিয়ে সার্ভারগুলো লজ্জাস্কর জিনিস থেকে মুক্ত রাখেন। ক্যাম্পাস, হল সব জায়গায় শিক্ষামূলক ওয়েবপেজগুলো দেখা যায়, পড়া যায়। আপত্তিকর, উলঙ্গছবি, নীল মুভিগুলো ছেঁকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীরা সেগুলোর ধারে কাছে যেতে পারে না। সুতরাং শিক্ষার্থীদের সময় নষ্ট বা চরিত্র ধ্বংস হবার ফুরসত নেই!

এতো গেল একটি নির্দিষ্ট জায়গায় ইন্টারনেটের তথ্য নিয়ন্ত্রণের কথা। কিন্তু বাংলাদেশে কোথাও কোথাও সব জায়গায় ওপেন অ্যাকসেস! তার কী ব্যবস্থা হবে? আমরা বর্তমানে এমন এক পৃথিবীতে বাস করছি যেখানে আপনার হাতের মুঠোফোন দিয়েই যেকোনো ওয়েবসাইট থেকে যে-কোনো সময় যে-কোনো ভিডিও চালানো যায়। অনেক অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাউজিং সোসাইটি, সুপার মার্কেটের প্রাঙ্গণ থেকে বিনা খরচে হাতের মুঠোফোন বা ডিভাইসে ওয়াই-ফাই সংযোগ পাওয়া যায় আজকাল।

আর মোবাইল ফোনের যথেচ্ছ ব্যবহারেরই বা কী হবে? বহু কোম্পানি ফোন কল ছাড়াও তারা আজ ভিন্ন ব্যবসায় নেমে পড়েছে। সেটা কম রেটে ইন্টারনেট সেবা প্রদান। শিশু কিশোররা এটা লুফে নিচ্ছে। টিফিন না খেয়ে বাবা-মাকে ফাঁকি দিয়ে তারা দামি মোবাইল ফোনসেট ব্যবহার করে মুহূর্তেই নিষিদ্ধ জগতে ঢুকে পড়ছে! আর এটা ওপেন সিক্রেট! এটা মারাত্মক, লজ্জাস্কর ও ভয়ঙ্কর ক্ষতিসম্পন্ন পর্নোগ্রাফি। আর বলা হয়- পর্নোগ্রাফি ইন্ডাস্ট্রি বর্তমানে একটি মাল্টি-ট্রিলিয়ন ডলারের ইন্ডাস্ট্রি! যার উদ্দেশ্য এবং কাজই হলো আপনাদের প্রত্যেকেই যেন, কোনো না কোনোভাবে এসব নোংরামির ভোক্তা হন, সেটা নিশ্চিত করা এবং প্রতিটি নারী-পুরুষ ও শিশুর সামনে এইগুলো যেন উন্মোচিত হয়। তারা আশা করে আপনিও দেখবেন, আসক্ত হবেন এবং পরিণত হবেন আরও একজন ভোক্তায়! এটাই হলো আমাদের সমাজকে দেওয়া পর্নোগ্রাফির উপহার। এটা মানুষকে পরিণত করছে পশুতে, যৌনবিকারগ্রস্ত মানুষে। আপনাদের মধ্যেই দুর্ভাগ্যক্রমে কারও কারও এই আসক্তি রয়েছে এবং আপনারা এসব জঞ্জাল প্রায়ই দেখছেন।

বাচ্চারা মোবাইল ফোন সাথে নিয়ে ঘুমাতে পছন্দ করে! বাবা-মা আদর করে তাদের বাচ্চাদের বিভিন্ন দামি ডিভাইস কিনে দিয়ে বাসায় ওয়াই-ফাই সিস্টেম চালু করে দিয়েছেন। কোমলমতি বাচ্চারা সেগুলো দিয়ে গেম খেলে, চ্যাট করে, ভিডিও দেখে। ইন্টারনেট সার্চ করতে করতে অজানা-অন্ধকার জগতে ঢুকে পড়ে। ব্যস্ত বাবা-মা তা জানতে পারে না। একজন আক্ষেপ করে কয়দিন পূর্বে একটি পত্রিকায় লিখেছেন, ‘‘কয়দিন আগে একটা মেইল পেলাম, একজন টিনেজ বালকের থেকে, যে কিনা পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত। সে লিখেছে, ‘আমি নিজেকে মেরে ফেলতে চাই, আমি পারছি না বন্ধ করতে। আমি ১১ বছর বয়স থেকে এগুলো দেখছি। আমার বাবা-মা কিছু জানেন না।’’

অনেক বাচ্চা একা একা ঘুমাতে পছন্দ করে! বড়দের দেখলে মুখ লুকায়! ঘুম নষ্ট করে স্বাস্থ্যহানি ঘটায়। সকালে নিজে নিজে বিছানা ছেড়ে উঠতে চায় না, উঠতে পারেও না। অসুস্থতার কথা বলে স্কুল ফাঁকি দেয়। স্কুলে গেলেও ক্লাসের পিছনের সারিতে বসে তার আইপ্যাড, স্মার্টফোন কিংবা অনুরূপ কোনো মোবাইল ডিভাইসে নোংরা ছবি বা পর্নো ভিডিও ডাউনলোড করে সহপাঠীদের দেখায়। অধুনা কলেজ বিশ্বদ্যিালয়ের ক্লাসেও নোংরা ছবি দেখাদেখির এ সমস্যা প্রকট।

বাসায় অনেক বাচ্চাদের খাবার সময় পেরিয়ে গেলেও খেতে আসে না, ডাকাডাকি করলে চরম বিরক্তি প্রকাশ করে! অনেকে বাসার বাইরে যেতে চায় না, বেড়াতে যেতে মন চায় না। কেউ কেউ বাথরুমে মোবাইল ফোনসেট সাথে নিয়ে পানির ট্যাপ ছেড়ে দিয়ে লজ্জাকর পর্নোগ্রাফি দেখে। মোবাইল ফোনের খারাপ মেসেজিং বাচ্চাদের নোংরা থেকে নোংরামি করাতে শেখায়। শেষ পর্যন্ত নানা ঘটনায় চরম পর্যায়ে গিয়ে স্কুল বদল, কোচিং বদল, বন্ধুবিচ্ছেদ, মারামারি ও উভয় পরিবারের মধ্যে শত্রুতা এমনকি আত্মহত্যাও ঘটছে আজকাল!

ইউটিউবে পৃথিবীর প্রায় সব প্রাণীর যৌনকর্ম করার ভিডিও কে বা কারা দৈনিক আপলোড করে থাকে? এগুলো নিশ্চয়ই ভিনদেশের। কারণ বহুলাংশে ব্যবহৃত এ প্রাণীগুলোর জন্ম বা বসবাস বাংলাদেশে নয়। এটা কি এক ধরনের প্রাণী অধিকার সংরক্ষণ আইন বিরোধী জঘন্য অপরাধ নয়? এগুলো নিশ্চয়ই আমাদের দেশের শিশুদের তথা সব ঈমানদার মানুষের ঈমান হরণ করার জন্য। ইউরোপ-আমেরিকার সাদা মানুষ, এশিয়ার বাদামি মানুষ বা আফ্রিকার কালো মানুষগুলোর নির্লজ্জ যৌনকর্ম করার ভিডিও কে বা কারা সেঁটে দিচ্ছে তারা নিজেরা হয়তো এ বিষয়ে জানেনও না। হয়তো গোপন ক্যামেরায় তোলা হয়েছিল। এটা হয়তো কোনো কোনো মানুষের অবৈধ আয়ের পথ, ব্যবসার-ইন্ডাস্ট্রি! কিন্তু এটাও কি এক ধরনের মানবতা ও  নৈতিকতা বিরোধী জঘন্য অপরাধ নয়?

হজরত আবুজার গিফারি (রা) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা) আমাকে নসিহত করেন, যেখানেই থাকো না কেনো আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করো এবং গুনাহ সংঘটিত হয়ে গেলে তবে সাথে নেকি করে নাও, কেননা তা গুনাহকে মিটিয়ে দেবে আর মানুষের সাথে উত্তম আচরণ করো। (মুজামুল আওসাত, ৮৩৭, ১/২৪৪)

মানুষ বুদ্ধিসম্পন্ন ও লজ্জাশীল প্রাণীও বটে। সেজন্য মানুষ লজ্জাস্থান কাপড় দিয়ে ঢেকে যত্ন করে আবৃত করে রাখে। মানুষের পেটে মলমূত্র প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে পাকস্থলীর ভেতরে থাকে। বাইরে বের হলে দুর্গন্ধ ছড়ায়। ইন্টারনেটে প্রবৃত্তির এক শ্রেণির অমানুষ মলমূত্র ঢেলে লজ্জাস্থান খুলে একাকার করে উলঙ্গ নৃত্য করছে। সমাজকে চোখের সামনে এ ধরনের ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করবে কে বা কারা? পৃথিবীর সকল বিবেকবান রুচিশীল মানুষকে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা আশু জরুরি।

‘হজরত সাঈদ ইবনুল মুসাইয়াব (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল (সা) কে বলতে শুনেছি, লজ্জার স্বল্পতা কুফরি।’ (ইবনু আবি শায়বা: ৮/৩৭৭)

আমরা আজ সভ্য সমাজের সদস্য হওয়ার দাবি করেও এক কুৎসিত ও নির্লজ্জতার যুগে অবতীর্ণ হয়েছি। নৈতিকতার যুদ্ধে ইন্টারনেট প্রোভাইডারদের নিকট লজ্জা যেমন পরাজিত তেমনি পরাজিত সুস্থ মানসিকতা এবং মানবতা। এই বীভৎসতা ও লাগামহীন নির্লজ্জতা ছড়ানো কুচক্রীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ছাড়া গত্যান্তর নেই। অশ্লীলতা, অনৈতিকতা ও শয়তানির বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে জয়লাভ করা খুবই জরুরি। এই ক্ষতিকর বিষয় থেকে জীবনকে বাঁচানোর উত্তম উপায় হচ্ছে; নিয়মিত কুরআন-হাদিস অধ্যয়ন করা। সময়ের যথার্থ ব্যবহার করা। ইন্টারনেটকে ভালো কাজে ব্যবহার করা। জ্ঞান বৃিদ্ধর সাহিত্য অধ্যয়ন করা। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করা। মনকে সতেজ রাখার জন্য ভ্রমণ করা। তাহলেই মুক্তি মিলবে অন্ধকার জগৎ হতে। 

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, মনন ম্যাগাজিন

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির