post

ইসলামী রাজনীতির মাঠে কতিপয় ‘চমকপ্রদ’ ঘটনা

সরদার আবদুর রহমান

২৩ অক্টোবর ২০২৩

রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে নানাবিধ ঘটনাবলি। এর মধ্যে সময়ের প্রেক্ষাপটে কোনো কোনোটি বিশেষ চমক সৃষ্টি করে। তবে এমনও কিছু ঘটনা আছে যা চোখের আড়ালেই থেকে যায় কিংবা আলোচনায় সেভাবে আসে না। এমন কিছু বিষয় ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রে ঘটেছে- যা অন্তরালেই থেকে গেছে। এমনই রাজনীতির মাঠের কতিপয় ‘চমকপ্রদ’ ঘটনা সম্পর্কে এখানে আলোকপাত করা হলো।

আইউব খানকে রুখতে বিখ্যাত আলেমদের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান

রাজনীতির ইতিহাসে ১৯৬৪ সালের নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ইসলামপন্থীদের ঐতিহাসিক ভূমিকার কথা লিপিবদ্ধ রয়েছে। বিশেষত আইউব খানের মতো শক্ত প্রার্থীর মোকাবিলায় একজন মজবুত প্রার্থী দাঁড় করানোর বিষয়ে বিখ্যাত আলেমদের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান ছিল স্মরণীয়। এ বিষয়ে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত “বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র” গ্রন্থে বিস্তারিত বিবরণ উল্লিখিত রয়েছে। এখানে সংক্ষেপে তা উদ্ধৃত হলো।

‘‘বিশ্ববিখ্যাত ও দেশবরেণ্য ওলামায়ে কেরামের ফতোয়া: বর্তমান পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপ্রধান পদে মহিলার নির্বাচন জায়েজ” শিরোনামে আলেমদের যে বক্তব্য পাওয়া যায় তাতে নাম রয়েছে মাওলানা আশরাফ আলী থানভী, মাওলানা সৈয়দ সোলেমান নদভী, মাওলানা মুফতি মোহাম্মদ শফী, মাওলানা সাইয়েদ আবুুল আলা মওদুদী, মাওলানা আতাহার আলী, মাওলানা শামছুল হক (ফরিদপুরী), মাওলানা নূর মোহাম্মদ আযমী, মাওলানা তাজুল ইসলাম, শর্ষিনার পীর শাহ মাওলানা মোহাম্মদ ছিদ্দিক, মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম প্রমুখ।

হজরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (র) বলেন : ‘‘হজরত বিলকিসের মুসলমান হবার পর তাঁর রাষ্ট্রাধিকার কেড়ে নেবার কোনো প্রমাণ নাই বরং তার রাজ্য যে আগের মতোই বহাল ছিল, ইতিহাসে তার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। বিলকিসের রাজত্ব ও রাজ্য শাসন পদ্ধতির প্রতি কুরআনে কোনোরূপ অবজ্ঞা বা অসমর্থন জ্ঞাপন করা হয়নি। উসুলে ফিকাহর সুবিদিত বিধান হচ্ছে, কুরআন বা হাদিসে যদি অতীতের কোনো ঘটনা বা ব্যবস্থাকে কোনোরূপ অবজ্ঞা বা অসমর্থন প্রকাশ না করে বর্ণনা করা হয় তবে তা শরীয়তে প্রমাণ হিসেবে গৃহীত হতে পারে। সুতরাং বর্ণনা থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় মহিলার নেতৃত্ব চলতে পারে।” (সূত্র: দৈনিক আজাদ, ২২ অক্টোবর ১৯৬৪)

মাওলানা সৈয়দ সোলায়মান নদভী সাহেব বলেন : “রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালনের জন্য ইসলাম যেসব শর্তারোপ করেছে তা পালন করা কোনো মহিলার পক্ষে দুঃসাধ্য। এ জন্যই নারী জাতিকে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শুধু এই কারণে যদি কেহ মনে করেন যে কোনো অবস্থায়ই মহিলা মুসলমানদের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিয়ে পারেন না, তবে তা ভুল হবে। কারণ যখন জাতি কোনো ফেতনা-ফাসাদের সম্মুখীন হয় এবং সে ফেতনা থেকে রক্ষা করতে পারে এমন কোনো ব্যক্তিত্ব জনগণের দৃষ্টিতে কোনো মহিলা ব্যতীত আর না থাকে, তবে উক্ত মহিলাকেই জাতির নেতৃত্ব প্রদান করতে হবে।”

হজরত মাওলানা মুফতী মোহাম্মদ শফী সাহেব বলেন : “গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মহিলা রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া ইসলামী শিক্ষা ও ঐতিহ্যের খেলাফ নহে। (সূত্র: দৈনিক জঙ্গ, ৩ নভেম্বর, ১৯৬৪)।

মাওলানা সাইয়েদ আবুুল আলা মওদুদী সাহেব বলেন : “বলা হচ্ছে যে, ইসলামে কোনো নারীকে মুসলমানদের নেতা বা রাষ্ট্রপ্রধান বানানো যায় না। এই ব্যাপারে বিশেষ করে আমার লেখা বই থেকে নানা উদ্ধৃতি পেশ করা হচ্ছে। আর আমি সময় ও সুযোগ দেখে ইসলামের নীতি পরিবর্তন করে ফেলি বলে আমার নামে অভিযোগ তোলা হচ্ছে। এর জওয়াবে আমি অবশ্যই জিজ্ঞেস করতে পারি যে, ইসলামের দৃষ্টিতে নারীকে মন্ত্রী ও পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি এবং বিদেশে রাষ্ট্রদূত বানানো যায় কি? ছেলে বা মেয়েদের সহ-শিক্ষাব্যবস্থা কি ইসলামসম্মত? পুরুষ ও মেয়েলোকের একত্রিত হয়ে একই অফিসে কাজ করা কি জায়েজ? স্টেজে নেমে মেয়েদের নাচ, গান করা কি ইসলাম সমর্থন করে? উড়োজাহাজে যুবতি মেয়েরা সেবিকা হয়ে পুরুষ যাত্রীদের মধ্যে মদ পরিবেশন করে, তা কি জায়েজ আর এসব যদি না-জায়েজ কাজই হবে তাহলে আজ পর্যন্ত এ ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশ মেনে কাজ করা হয়নি কেন? এ সব ব্যাপারে ইসলামের কথা স্মরণ করা হয়নি কেন? আর আজ নারীর রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার প্রশ্নেই কেবল ইসলামের দোহাই দেওয়া হয় কেন? এ হচ্ছে পাল্টা প্রশ্ন। কিন্তু বর্তমান মুহূর্তে আমাদের সামনে বিষয়টি এতো সাদাসিধেভাবে উপস্থিত হয়নি যে, নারী মুসলমানদের আমীর হতে পারে কিনা তা নিয়েই আমরা মাথা ঘামাতে বসব। বরং আমরা বর্তমানে এক বিশেষ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে আছি, তা হচ্ছে এই :

- দেশে এক জবরদস্তিমূলক অত্যাচারী ও স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থা চালু হয়ে রয়েছে, তা আমাদের ধর্ম, চরিত্র, তাহজীব-তামাদ্দুন, অর্থনীতির পক্ষে অত্যন্ত মারাত্মক।

- দেশে মুহতারিমা ফাতিমা জিন্নাহ ব্যতীত অপর কোনো ব্যক্তিত্ব এমন নেই যাকে কেন্দ্র করে দেশের বিরাটসংখ্যক লোক একত্রিত হতে পারে, আর নির্বাচনে সফলতা লাভ করতে পারে ও এ উপায়ে বর্তমান স্বৈরতন্ত্রী জালেম শাসন ব্যবস্থাকে খতম করে দেওয়ার কোনো সম্ভাবনা হতে পারে। 

- মুহতারিমা ফাতিমা জিন্নাহর প্রার্থী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের সাধারণ জনতা তাঁর সমর্থনে কোমর বেঁধে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। 

- তাঁর পরিবর্তে অপর কোনো ব্যক্তিকে দাঁড় করানো কিংবা এই নির্বাচনী সংগ্রামে নিরপেক্ষ থাকার মানে বর্তমান প্রেসিডেন্ট আইউব খানকেই সাহায্য করা।

এমতাবস্থায় আমাদের সামনে আসল প্রশ্ন হচ্ছে এই যে একজন মেয়েলোকের রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া কি শরীয়াতে এতই আপত্তিকর যে তাঁকে সমর্থন না করে তার বিপরীত বর্তমান জবরদস্তি আর অত্যাচার জুলুমের শাসনকে মেনে নিতে হবে? আমার মতে ইসলামী শরীয়াত সম্পর্কে সামান্য জ্ঞান রাখে এমন কোনো ব্যক্তিই বলতে পারে না যে, একজন নারীকে রাষ্ট্রপ্রধান করার পরিবর্তে এই স্বৈরাচারী ও জালেম শাসনকে কবুল করা উচিত। বরং আমি তো বলব, একজন নারীকে রাষ্ট্রপ্রধান বানানো যদি এক আনা দোষের কাজ হয় তাহলে তার মোকাবিলায় বর্তমান অত্যাচারী ও জালেম শাসনকে বাঁচিয়ে রাখলে কমপক্ষে দশগুণ বেশি গুনাহ হবে। এছাড়া, একথাও মনে রাখতে হবে যে, ইসলামের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্রপ্রধানের পুরুষ হওয়া একটি শর্ত বটে, কিন্তু নারীর রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া ইসলামী শরীয়াতে সম্পূর্ণ হারাম- এমন হারাম যে, অত্যন্ত ও সাংঘাতিক প্রয়োজন দেখা দিলেও তা জায়েজ হবে না, এমন কথা কেউই বলতে পারে না। কুরআন-হাদিস থেকে যদি কেউ তা প্রমাণ করতে পারেন তবে করুন, আমরাও দেখব। আসলে ইসলামের সাধারণ নিয়মের মধ্যে আমরা কোনোই পরিবর্তন করছি না, না তার কোনো সংশোধন করার চেষ্টা করছি। কিন্তু বর্তমানের এই বিশেষ ধরনের অবস্থার কতিপয় প্রয়োজন দেখা দেওয়ার কারণে একজন মহিলাকে রাষ্ট্রপ্রধান করা জায়েজ মনে করছি মাত্র। কেননা, এ কাজ যে চূড়ান্ত ও স্থায়ীভাবে হারাম- এ কথা প্রমাণ করার কোনো দলিলই আমরা শরীয়াতে পাইনি, এখন একজন নারীকে যদি আমরা মেনে না নেই, তাহলে তার অপেক্ষা বহুগুণ বেশি বড়ো অন্যায়কে মেনে নিতে হয় এবং তা এতো বড়ো যে, শুধু নৈতিক দৃষ্টিতেই নয়, ইসলামের দৃষ্টিতেও তা অত্যন্ত বড়ো অন্যায় কাজ হয়ে পড়ে।” (২৯ নভেম্বর ১৯৬৪ পল্টন ময়দানে প্রদত্ত বক্তৃতা থেকে)।

মাওলানা আতাহার আলী সাহেব বলেন : “দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে মুহতারিমা ফাতেমা জিন্নাহকে রাষ্ট্রপ্রধান পদে ভোট দেওয়া যেতে পারে না বলে একশ্রেণির আলেম ও পীর নামধারী স্বার্থবাজ ব্যক্তি পবিত্র কুরআন ও হাদিসের যে ধরনের বিকৃত উদ্ধৃতি ও অপব্যাখ্যা দান করছেন তা আমি গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ করেছি। আরো পরিতাপের বিষয় এই যে, দেশের সরলপ্রাণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার কুমতলবে ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ হতে সেসব বিকৃত উদ্ধৃতি ও অপব্যাখ্যামূলক তথ্যের ভিত্তিতে অসংখ্য পুস্তক-পুস্তিকা ঘরে ঘরে বিলিবণ্টন করা হচ্ছে। এমতাবস্থায় খাঁটি সচেতন কোনো আলেম ও পীরের পক্ষে কিছুতেই নিশ্চিন্ত বসে থাকা উচিত নয়।”

শর্ষিনার পীর মাওলানা শাহ মোহাম্মদ সিদ্দীক সাহেব বলেন : একনায়কত্বমূলক সরকার কর্তৃক ইসলাম ও শরীয়তে ইসলামের খেলাফ কতকগুলো কাজ হওয়ায় দেশের জনসাধারণ, বিশেষ করে ওলামায়ে কেরাম এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু এই সরকার সে সবের প্রতি কর্ণপাত না করায় দেশের জনসাধারণ ও রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন হক্কানি ওলামায়ে কেরামের সরকার পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত শরীয়তের দাবিতে একান্তই সময়োপযোগী এবং শরীয়তসম্মত। এই পরিপ্রেক্ষিতে দেশের চিন্তাশীল নেতৃবৃন্দ এবং ওলামায়ে কেরামের সিদ্ধান্তকে আমি আন্তরিকভাবে সমর্থন জানাচ্ছি এবং আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমি আন্তরিকভাবে আবেদন জানাচ্ছি যে, জনসাধারণ কর্তৃক অকুণ্ঠভাবে সমর্থিত সম্মিলিত বিরোধী দলকে ইসলামের মহান স্বার্থে কমিয়াব করুন। (সূত্র: দৈনিক আজাদ, ১৫ ডিসেম্বর, ১৯৬৪)।

মাওলানা মোহাম্মদ আবদুর রহীম সাহেব বলেন : নারীর রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া জায়েজ নাই বলে শর্ষিনা হতে সম্প্রতি যে ফতোয়া প্রকাশিত হয়েছে, তা সম্পূর্ণ মনগড়া কথায় পূর্ণ। তাতে যেসব দলিলের উল্লেখ করা হয়েছে, তার কোনো একটি দ্বারাও একথা প্রমাণিত হয় না যে, নিতান্ত প্রয়োজনে ঠেকেও কোনো সময়ই নারীকে রাষ্ট্রপ্রধান করা শরীয়তসম্মত নয়।

এই নির্বাচনে আইউব খান বিপুল ভোটে বিজয়ী হওয়ার কথা ঘোষণা করা হয়। তবে নির্বাচনে কারচুপিরও অভিযোগ ওঠে। আবদুল হকের বর্ণনা মোতাবেক রাওয়ালপিণ্ডিতে কমিশনের কেন্দ্রীয় অফিসে ব্যালটপত্র পরীক্ষার সময় মিস জিন্নার প্রধান পোলিং এজেন্ট (মি. হাসান এ. শেখ) উপস্থিত থাকতে অস্বীকার করেন। নির্বাচন পরিচালকের পক্ষপাতদুষ্ট পদ্ধতির তীব্র সমালোচনা করে তিনি এক টেলিগ্রাম প্রেরণ করেন। 

সোহরাওয়ার্দী-মওদুদী সাক্ষাৎ

তৎকালীন পাকিস্তান বিশেষত পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন সুপ্রতিষ্ঠিত। তিনি জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা সাইয়েদ আবুুল আ’লা মওদুদীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। এই ঐতিহাসিক ঘটনা ইতিহাসের প্রায় আড়ালে থেকে গেছে। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের এ সম্পর্কিত একটি বিবরণ প্রদান করেন রাজনীতিক-লেখক অধ্যাপক গোলাম আযম। বিবরণটি এরূপ:  

“পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভিন্ন মর্যাদা ছিল। তাছাড়া তিনি উর্দুভাষী হওয়ায় পাকিস্তানের জনগণের নিকট সুবক্তা হিসেবেও জনপ্রিয় ছিলেন। তাই তাঁরই নেতৃত্বে ৯ নেতার এক প্রতিনিধি দল পশ্চিম-পাকিস্তান সফরে যান। শহীদ সোহরাওয়ার্দী পশ্চিম-পাকিস্তানে সর্বপ্রথম মাওলানা মওদুদীর বাড়িতে যেয়ে তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন। এ সাক্ষাৎ সম্পর্কে মাওলানা মওদুদীর নিকট থেকে সরাসরি আমি যা অবগত হয়েছি, তা উল্লেখ করছি: 

শহীদ সোহরাওয়ার্দী ৯ নেতার প্রতিনিধি হিসেবে হাজির হলেন। জনগণের ভোটে নতুন গণপরিষদ গঠনের দাবি সম্পর্কে মাওলানা অবহিত ছিলেন। সোহরাওয়ার্দী সাহেব ৯ নেতার পক্ষ থেকে উত্থাপিত দাবি সম্পর্কে মাওলানা মতামত জানতে চাইলেন। মাওলানা বললেন, জনগণের নির্বাচিত গণপরিষদের প্রণীত ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র আইউব খান বাতিল করে দিলেন। আমরা রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ এর প্রতিবাদ করতে পারলাম না। দেশ রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত সেনাপ্রধান অন্যায়ভাবে দেশ শাসনের ক্ষমতা দখল করলেন। আমরা প্রতিরোধ করতে সক্ষম হলাম না। E.B.D.O (ইলেকটিভ বড়িস ডিসকোয়ালিফিকেশন অর্ডিন্যান্স-এবডো) জারি করে ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে আপনিসহ সকল রাজনৈতিক নেতাকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করলেন। এরও কোনো প্রতিকার করা সম্ভব হলো না।

তথাকথিত বুনিয়াদী গণতন্ত্র চালু করে আইউব খান নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের মর্যাদা হাসিল করলেন। মনগড়া শাসনতন্ত্র কমিশন গঠন করে নতুন শাসনতন্ত্র চালু করে সে অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদে নির্বাচনও করিয়ে নিলেন। আমরা নির্বাচন প্রতিরোধ করার চেষ্টাও করলাম না। কেন্দ্রে ও প্রদেশে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা সরকারও গঠন করে ফেললেন আমরা কোথাও এ স্বৈরশাসকের গতিরোধ করতে কিছুই করতে পারলাম না। আমাদের ব্যর্থতার বিরাট তালিকা নিয়ে জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন গণপরিষদ গঠন ও নতুন শাসনতন্ত্র রচনার দাবি করা কি বাস্তবসম্মত? ১ জুন থেকে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করার পর আমরা বিবৃতি দিতে সক্ষম হলাম। আমরা সরকারের সমালোচনা করার সুযোগটুকু পেলাম। স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে জনমত গঠন করা ও গণ-আন্দোলনের সূচনা করার পরিকল্পনা নেবার সময় এসেছে। এখন আমরা যদি রাজনৈতিক আন্দোলন করতে চাই, তাহলে আইউব খানের জারি করা শাসনতন্ত্রকে সংশোধন করার দাবি জানাতে পারি।

মাওলানার এ দীর্ঘ বক্তব্যের পর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মাওলানার যুক্তির সাথে একমত হলেন। ৯ নেতার দাবি যে অবাস্তব সে কথা তিনি উপলব্ধি করলেন। তিনি ৯ নেতার মধ্যে উপস্থিত নেতাদের সাথে মতবিনিময়ের জন্য একদিন সময় চাইলেন। পরদিন আবার বৈঠক করার সময় নির্ধারণ করে সোহরাওয়ার্দী সাহেব বিদায় নিলেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী সর্বপ্রথম মাওলানা মওদুদীর নিকট কেনো গেলেন?

পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলসমূহের মধ্যে একমাত্র জামায়াতে ইসলামীই সামরিক শাসন প্রত্যাহারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পুনর্বহাল হয়। মুসলিম লীগ তো আইউব খানই দখল করে নেন। এ দলের যারা ঐ সংগঠনে যোগদান করেননি তাদের নতুন করে সংগঠিত হতে স্বাভাবিকভাবেই বিলম্ব হয়। অন্যান্য দলের মধ্য থেকেও আইউব খান কিছু নেতাকে ভাগিয়ে নিতে সক্ষম হন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী নিজের দল আওয়ামী লীগকে পুনর্বহাল না করে অন্যান্য দলের সাথে মিলে গণতান্ত্রিক আন্দোলন করার পক্ষে ছিলেন। পাকিস্তানভিত্তিক আর কোনো দলই তখন উল্লেখযোগ্য ছিল না। তাই শহীদ সোহরাওয়ার্দী আইউববিরোধী আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালনের জন্য মাওলানা মওদুদীর ওপরই সবচেয়ে বেশি আস্থা পোষণ করতেন। তাই পশ্চিম পাকিস্তান সফরে গিয়ে মাওলানার সাথেই প্রথম সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁর সাথে মতবিনিময়ের পরই দুজনে একমত হয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। জনাব সোহরাওয়ার্দী ১৯৬২ সালের ৫ই ডিসেম্বর বৈরুতের কন্টিনেন্টাল হোটেলে নিঃসঙ্গ অবস্থায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তিকাল করেন। তার মতো এক গতিশীল নেতার অভাবে পূর্ব ও পশ্চিম-পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের সম্মিলিত গণতান্ত্রিক আন্দোলন সাংগঠনিক রূপ পেলো না।”

মওদুদী-মুজিব সাক্ষাৎ

মাওলানা আবুুল আ’লা মওদুদীর সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাত এবং রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনার বিষয়ও পাদপ্রদীপের আলোয় আসেনি। সেই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের বিবরণ দিতে গিয়ে রাজনীতিক-লেখক অধ্যাপক গোলাম আযম মাওলানা মওদুদীর সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের সাক্ষাতের একটি বিবরণ দিয়েছেন। এটি নিম্নরূপ:

“চৌধুরী মুহাম্মদ আলী সাহেবের ড্রইংরুম থেকে বের হয়ে গাড়ি কাছে আসার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। দেখলাম, শেখ মুজিব ও তাজউদ্দীন একসাথে আসছেন। হঠাৎ আমি তার দিকে এগিয়ে গিয়ে হাত মিলিয়ে বললাম, ‘আপনি কি করতে চাচ্ছেন বুঝতে পারছি না। চলুন না মাওলানা মওদুদীর সাথে বসে আলাপ করি।’ তিনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন। ইস্ট-পাকিস্তান হাউজ থেকে যে সরকারি গাড়িতে এসেছিলেন সে গাড়িকে চলে যেতে বললেন। তিনি ও তাজউদ্দীন আমার সাথে জামায়াতের গাড়িতে উঠলেন।

একটু আগেই মাওলানা বৈঠক থেকে বাড়িতে ফিরে গেলেন। আমাদের গাড়ি মাওলানার চেম্বারের সামনে থামলে আমি শেখ মুজিবকে পাশের বৈঠকখানায় বসিয়ে মাওলানাকে ভেতরে খবর দিলাম। মাওলানা সাথে সাথেই চেম্বারের দরজা খুলে শেখ সাহেবকে অভ্যর্থনা জানিয়ে ভেতরে নিয়ে গেলেন। খবর পেয়ে মিয়া তোফায়েল মুহাম্মদও হাজির হলেন। তাজউদ্দীন শেখ সাহেবের পাশেই বসলেন। আমি ও মিয়া সাহেব পাশাপাশি বসলাম। আলোচনার সূচনার উদ্দেশ্যে আমি বললাম, ‘মাওলানা, আপনার সাথে যোগাযোগ না করেই আমি শেখ সাহেবকে নিয়ে এলাম। তিনি কী চান তা তাঁর কাছ থেকে শুনবার উদ্দেশ্যেই আমি নিয়ে এসেছি। এখন শেখ সাহেব বলুন।’

শেখ মুজিব উর্দু ও ইংরেজি উভয় ভাষা মিলিয়ে প্রায় ১০/১২ মিনিট তার বক্তব্য রাখলেন। তিনি বললেন, ‘মাওলানা সাহেব, আমি ৬ দফার আন্দোলন শুরু করার পরই আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। আমি জেলে থাকা অবস্থায়ই আমার ৬ দফার সাথে আরও ৫ দফা যোগ করে ছাত্ররা ১১ দফার আন্দোলন সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়। আযম সাহেব ৬ দফা সম্পর্কে শুরু থেকে এ পর্যন্ত একই ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু মাওলানা ভাসানী আজব চিজ। তিনি প্রথমে ৬ দফা ডিসমিস (বাতিল) বলে ঘোষণা করলেন। অথচ আমার অনুপস্থিতিতে ১১ দফা নিয়ে মাতামাতি করছেন। ছাত্র ও শ্রমিক মহলে ১১ দফার ব্যাপক সমর্থন রয়েছে। মাওলানা ভাসানী গোলটেবিল বৈঠকেও যোগদান করলেন না। তাঁর উদ্দেশ্য মোটেই ভালো নয়। তিনি জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন চালাচ্ছেন। আমি যদি ৬ দফার বদলে DAC-এর ৮ দফা মেনে নেই, তাহলে আমার বিরুদ্ধে মাওলানা ছাত্র ও শ্রমিকদেরকে ক্ষেপিয়ে তুলবেন। জনগণের মধ্যে ৬ দফাসহ ১১ দফা যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে এর ফলে আমি বিরাট সমস্যায় পড়েছি। মাওলানা ভাসানী বিরাট এক ফেতনা। তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কঠিন।’

একটানা এ কথাগুলো বলার পর একটু থেমে আবেগময় কণ্ঠে বললেন, ‘মাওলানা সাহেব, মেহেরবানি করে ৬ দফাকে সমর্থন করে আমাকে সাহায্য করুন। দেখবেন, আমি মাওলানা ভাসানীকে দেশ থেকে তাড়াবো।’

মাওলানা অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বললেন, ‘আপনি যদি আপনার দলীয় দাবিতে অনড় থাকেন তাহলে গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হবে এবং মাওলানা ভাসানী আরও মযবুতভাবে কায়েম হবে। মাওলানা চান যে, গোলটেবিল বৈঠক বানচাল হয়ে যাক। আপনার এ পদক্ষেপ মাওলানার উদ্দেশ্যই পূরণ করবে। মনে রাখবেন, ৭/৮ বছরের আন্দোলনের ফলে গণতন্ত্র এখন আমাদের দুয়ারে হাজির। গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হলে আবার সামরিক শাসন অনিবার্য হয়ে পড়বে। গোলটেবিল বৈঠককে সফল করুন এবং গণতন্ত্র বহাল হতে দিন। আগামী নির্বাচনে আশা করি আপনি ভালো করবেন। ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাসখন্দ ইস্যুকে ভিত্তি করে সম্মিলিতভাবে গণতান্ত্রিক আন্দোলন ৬ দফার কারণেই আপনার দল শরীক হতে পারেনি। এবার তো আপনার দল DAC-এ শরীক হয়ে ৮ দফা প্রণয়নে একমত হয়েছে। আপনার দলীয় দাবি অপর ৭ দলকে মেনে নিতে বাধ্য করতে পারেন না।

প্রেসিডেন্ট আইউব ৮ দফা মেনে নিতে সম্মত হয়েই গোলটেবিল বৈঠক ডেকেছেন। আপনি কেমন করে আশা করতে পারেন যে, DAC-এর অন্যান্য দল আপনার দাবি মেনে নেবে? গোলটেবিল বৈঠককে সফল করে গণতন্ত্রকে এক্ষুণি বহাল করার মহাসুযোগ নষ্ট করবেন না। দেশে অবিলম্বে নির্বাচন হতে দিন। নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে দলীয় মেনিফেস্টো অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করবেন। আমি বিষয়টা বিশেষভাবে বিবেচনা করার জন্য পরামর্শ দিচ্ছি।’

ইতোমধ্যে চা-নাস্তা এলো। শেখ সাহেব আর কিছুই বললেন না। একটু চা খেয়ে বিদায় নিলেন। যে গাড়িতে করে নিয়ে এসেছিলাম, সে গাড়িতেই ইস্ট-পাকিস্তান হাউজে পৌঁছাবার জন্য সাথে গেলাম। গাড়িতে আমি মাওলানার কথাগুলোকে সিরিয়াসলি বিবেচনা করার জন্য কয়েকবার তাগিদ দিলাম। সারা পথে মাঝে মাঝে দু’এক কথা আমিই বললাম। তারা দুজনই গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন। কোনো কথাই আর বললেন না। আমাকে তার পক্ষে কনভিন্স করার চেষ্টা করলেন না, মাওলানার যুক্তি সম্পর্কেও কোনো মন্তব্য করলেন না। ইস্ট-পাকিস্তান হাউজে পৌঁছলে গাড়ি থেকে নেমে আমার সাথে হাত মিলিয়ে নীরবে চলে গেলেন। মুখে অত্যন্ত বিমর্ষ ভাব লক্ষ্য করলাম। তার স্বভাবসুলভ সৌজন্য হাসিটুকুও দেখা গেল না।”

১৯৬৯ সালের ১৩ মার্চ প্রেসিডেন্ট আইউব খান গোলটেবিল বৈঠক-এর সমাপ্তিকালে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন এবং ফেডারেল পার্লামেন্টারি পদ্ধতি প্রবর্তনের দাবি মেনে নেওয়ার ঘোষণা দেন। উল্লেখ্য, গণতন্ত্রে উত্তরণের লক্ষ্যে সকল রাজনৈতিক দলের ঐক্য গড়া, ঘোষিত দফাগুলোর পক্ষে জনমত গঠন এবং গোলটেবিল বৈঠককে সফল করার জন্য জামায়াতে ইসলামীর ভূমিকা ছিল বলিষ্ঠ ও দায়িত্বশীল।

পল্টনের জনসভায় হামলার নেপথ্যে

১৯৭০ সালে প্রকাশ্য রাজনীতি শুরু হওয়ার পর প্রায় প্রতি রোববার ছুটির দিনে ঢাকার পল্টন ময়দানে জনসভা হতো। প্রথম রোববার পড়েছিল ৪ জানুয়ারি। ওই দিন আতাউর রহমান খানের জাতীয় লীগ সভা করেছিল। পরের রোববার ১১ই জানুয়ারি ছিল আওয়ামী লীগের জনসভা। তার পরের রোববার ১৮ জানুয়ারি ছিল জামায়াতে ইসলামীর জনসভা। ওই দিন পল্টনে তুলকালাম হয়। লেখক মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর গ্রন্থে এর একটি বর্ণনা দিয়েছেন। “সিরাজুল আলম খান আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন, জামায়াতের সভা পণ্ড করে দিতে হবে। হয়েছিলও তাই। পরের রোববার ২৫ জানুয়ারি ছিল পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টির (পিডিপি) সভা। সভাপতিত্ব করবেন নুরুল আমিন। ওই মিটিংয়েও হামলা করে তা বানচাল করে দেওয়া হয়েছিল। এসবের নাটের গুরু ছিলেন সিরাজুল আলম খান। পরে তিনি এ ব্যাপারে কথা বলেছিলেন ছাত্রলীগের সংগঠক আবুু করিমের সঙ্গে। তার কাছ থেকেই বিষয়টি জানা। সিরাজুল আলম খানের অবশ্য এ ব্যাপারে রাখঢাক ছিল না। ঢাকায় জামায়াতকে আর নুরুল আমিনকে মিটিং করতে দেবো না- এটাই ছিল তাঁর কথা। তিনি এক কথার মানুষ। আবুু করিমের সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারলাম:

আবুু করিম : সিরাজ ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনারা যদি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন, ১৯৭০ সালে জামায়াতকে মিটিং করতে দিলেন না কেন? আসলেই কি জামায়াতের মিটিং ভেঙেছিলেন? ‘হে, ইট ইজ মি।’ সিরাজ ভাই নিজে এটা আমাকে বলেছে। 

মহিউদ্দিন আহমদ : আমিও তো ছিলাম ওই মিটিংয়ে।

করিম : সিরাজ ভাই বলেছেন, ‘ইট ইজ মি।’ ‘ইট ইজ মি’ মানে পার্টি ডিসিশন না।

মহি : তাঁর ডিসিশনই তো?

করিম : উনি এটা কীভাবে অর্গানাইজ করেছেন, সেটাও বলেছেন আমাকে। ওনার কিছু পরিচিত লাকড়ি বিক্রেতাকে ভাড়া করেছেন। জামায়াত তো পল্টনে প্যান্ডেল-ট্যান্ডেল করেছে। এর বাইরে যে সলিমাবাদ রেস্টুরেন্ট, এর কর্মচারীরা সবাই হচ্ছে সিরাজুল আলম খানের চামচা। এরা পরে আমাদের বিনা পয়সায় খাওয়াত। এই রেস্টুরেন্টে লাকড়ি লাগে দৈনিক দুই মণ বা তিন মণ। উনি অর্ডার দিয়েছেন ৩০০ মণ। ঘটনাটা কি আপনি বুঝতে পেরেছেন? লাকড়ির একটা পাহাড় হয়ে গেছে সেখানে। তখন ছোটো চিরকুটের মাধ্যমে ওনার যত ক্যাডার, যেমন আফতাব, মধু, বুলবুল, বদিউল, মাহবুব থেকে আরম্ভ করে, মানে তখনকার দিনে যারা যারা ছিল। 

মহি : মানে ‘গ্রুপের’ লোকজন।

করিম : মানে লাকড়ির অভাব নাই। জামায়াত মিটিং আরম্ভ করেছে। মিটিংয়ের একপর্যায়ে ওরা শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে কী একটা সেন্টেন্স বলছে...জিব্বা টাইনা ছিঁড়া ফেল। এই যে পেটানো আরম্ভ করল। মুহূর্তের মধ্যে মিটিং রণক্ষেত্র।

মহি : ওই দিন দুজন নিহত, ৫০০ আহত।

করিম : মানে নিহত তো পত্রিকায় ওভাবে আসে নাই। 

মহি : পত্রিকায় এভাবেই এসেছে, ১৯ জানুয়ারি ১৯৭০।” 

সরকার গঠনে বিএনপিকে সমর্থন

১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হলেও সরকার গঠনের মতো ন্যূনতম সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। তাদের আসন সংখ্যার ঘাটতি ছিল ১১টি। এটি পূরণ করতে অন্য দলের দ্বারস্থ হতে হয়। আওয়ামী লীগও চেষ্টা করতে থাকে সরকার গঠনের। এতে সংকট দেখা দিলে শেষ পর্যন্ত জামায়াত তার সমর্থন বিএনপিকে প্রদান করে। ফলে ১৯ মার্চ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ বিএনপির চেয়ারপাসন বেগম খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী করে একটি মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেন।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির সরকার গঠনের নেপথ্যের একটি ‘চমকপ্রদ’ চিত্র মওদুদ আহমদ তাঁর গ্রন্থের টিকায় উল্লেখ করেন। এটি নিম্নরূপ: “কোনো রাজনৈতিক দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় কোনো দল সংবিধান অনুযায়ী সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রদর্শনের মতো সমর্থন অর্জন করে সরকার গঠন করতে পারে তা নির্ণয়ের জন্য বিচারপতি সাহাবুদ্দীনকে কিছুকাল সময় অপেক্ষা করতে হয়। ফলাফলে দেখা যাবে যে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে উভয়েই অন্যদের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠনের উপযোগী ১৫১ জন সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে সক্ষম ছিল। তবে ১৪০টি আসনে জয়লাভ করে বিএনপি ছিল তুলনামূলকভাবে সুবিধাজনক স্থানে। কারণ সরকার গঠনের জন্য দলটির প্রয়োজন ছিল মাত্র ১১টি আসনের সমর্থন। কিন্তু আওয়ামী লীগের জন্য প্রয়োজন ছিল নির্বাচনে জোটবদ্ধ সকল বামপন্থী ও অন্যান্য দল, গোটা জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন। অনেক কারণে শেষোক্ত দুই দলের সঙ্গে সমঝোতা করা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে ১৩টি আসন অর্জনকারী বামপন্থী দলগুলো বিএনপিকে সমর্থনদানে প্রস্তুত থাকলেও শেষাবধি তা কাজ করেনি। জেনারেল এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত করে আবার এতো তাড়াতাড়ি তাকে জোটের শরিকভুক্ত করে সরকারে নিয়ে নেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া ছিল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ের জন্যই বিব্রতকর কাজ। এ সময় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল নুরুদ্দীন খান এই অচলাবস্থা নিরসনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। জামায়াত ও বিএনপিকে এক ঘরে নিয়ে আসার ব্যাপারে তিনি মধ্যস্থতা করেন। একজন সাবেক মন্ত্রী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জি. ডব্লিউ. চৌধুরীর বাসভবনে এ নিয়ে চূড়ান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে জেনারেল নুরুদ্দীন, বেগম খালেদা জিয়া, অধ্যাপক গোলাম আযম ও মতিউর রহমান নিজামী উপস্থিত ছিলেন। এই বৈঠকের পরে জামায়াতে ইসলামী সরকার গঠনে বিএনপিকে সমর্থনদানের ব্যাপারে সম্মতি প্রদান করে এবং এ মর্মে রাষ্ট্রপতিকে লিখিতভাবে অবহিত করে নিশ্চয়তা প্রদান করে।

তথ্য-সূত্র:

১. হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র (দ্বিতীয় খণ্ড),

২. অধ্যাপক গোলাম আয : জীবনে যা দেখলাম (৩য় খণ্ড),

৩. মহিউদ্দিন আহমদ : প্রতিনায়ক সিরাজুল আলম খান, ঢাকা : প্রথমা, মার্চ ২০২১,

৪. মওদুদ আহমদ : বাংলাদেশে গণতন্ত্র, ১৯৯১-২০০৬।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

আপনার মন্তব্য লিখুন

Abdur Rahman

- 3 months ago

চমৎকার লেখা।

md Golam Mostafa Kamal

- 2 months ago

অনেক অজানা বিষয় জানতে পারলাম, নিয়মিত ভাবে জামায়াতে ইসলামীর তথ্য তুকে ধরার অনুরোধ।

md Golam Mostafa Kamal

- 2 months ago

অনেক অজানা বিষয় জানতে পারলাম, নিয়মিত ভাবে জামায়াতে ইসলামীর তথ্য তুকে ধরার অনুরোধ।

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির