post

ইসলাম ও সংস্কৃতিতে বিনোদন ব্যবস্থা

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

ইসলাম মানুষের স্বভাব-প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল পরিপূর্ণ একটি জীবনবিধান। এর বিধানবলি যেমন সহজ সাবলীল, তেমনি তা সুষ্ঠু রুচিসম্পন্নও বটে। এ ব্যবস্থা মানবজাতির দেহ ও মনের সুস্থ বিকাশ সাধনে সবিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছে। ফলে মানুষের জীবনে নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের পাশাপাশি চিত্ত বিনোদনের ব্যাপারেও সঠিক ও যথার্থ নির্দেশনা পেশ করেছে। 

ইসলাম মানবজাতির জন্য আল্লাহ তাআলা প্রদত্ত সর্বজনীন ব্যবস্থার নাম। জীবনের প্রতিটি দিক ও বিভাগের রয়েছে ইসলাম প্রদত্ত সুন্দর, শাশ্বত কল্যাণময় পথ নির্দেশনা। এগুলো একদিকে যেমন মানবকল্যাণধর্মী, অন্যদিকে তা মানুষের সৃষ্টিগত স্বভাব ও চাহিদার অনুকূলে। এগুলো মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সাথে যেমন সম্পৃক্ত, তেমনিভাবে তা তার আধ্যাত্বিক জীবনকেও পরিশুদ্ধ করে তোলে। এ অমোঘ বিধান তার জীবনকে যাবতীয় অশুচি, অসুন্দর ও অশালীন কথা, কাজ ও পরিবেশ থেকে পরিচ্ছন্ন, শালীন ও নির্মল করে। তবে ইসলাম মানব জীবনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-নিরানন্দ সর্বক্ষেত্রে একটি সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়েছে। মানুষ দুঃখ যন্ত্রণা ও নানা প্রতিকূলতায় যেমন মানসিক চাপ অনুভব করে, তেমনিভাবে নানা উৎসব অনুষ্ঠানে একটু খুশি ও আমোদিত হয়ে মানসিক চাপমুক্ত হয়। দুঃখ দুর্দশায় ব্যথিত হওয়া কিংবা কারও মৃত্যুতে শোকাতুর হওয়া মানুষের স্বভাবজাত প্রবণতা। ইসলাম এটিকে অস্বীকার করে না; বরং নির্ধারিত সীমারেখা মেনে চললে ইসলামের দৃষ্টিতে এটি বৈধ। অন্যদিকে খুশি বা আনন্দ প্রকাশে ও ইসলাম সীমা ঠিক করে দিয়েছে, যা মেনে চলা একজন মুমিনের ঈমানের দাবি। এককথায়, মানব জীবনের আদি অন্ত সবকিছুর ব্যাপারেই সুন্দর নির্দেশনা রয়েছে ইসলামে। এ হিসেবে মানুষের চিত্ত বিনোদনের বিষয়টিও ইসলামে উপেক্ষিত নয়; বরং বিনোদন ব্যবস্থা সম্পর্কে ইসলাম অত্যন্ত সুন্দর ও ভারসাম্যপূর্ণ রীতিনীতি শিক্ষা দিয়েছে, যা নিঃসন্দেহে সুস্থ সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিনোদনের ব্যাপারে আমাদের সমাজে পরস্পরবিরোধী দু’টি ধারণা প্রচলিত রয়েছে। কেউ কেউ এর প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করেন এ যুক্তিতে যে, এতে অহেতুক মানুষের মূল্যবান সময়ের অপচয় হয় এবং তা মানুষের মাঝে নানারকম অন্যায় ও অশালীন প্রবণতা সৃষ্টি করে। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে তা মানব চরিত্রকে কলুষিত করে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে যায়। এ কারণে বিনোদন মানুষের জন্য কোনো মতেই উপকারী কিংবা প্রয়োজনীয় হতে পারে না। বিপরীতপক্ষে দ্বিতীয় ধারণা মতে- বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। 

মানুষের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতায় বিনোদনমূলক উপায়-উপকরণ গ্রহণ ও চর্চা বড়ই উপকারী। অনেক সময় তা মানুষের সামগ্রিক সুস্থতা ও জীবনের ভারসাম্য রক্ষায় আবশ্যক হয়ে পড়ে। বর্তমানে বিনোদনের ব্যাপারে অনেক বাড়াবাড়ি ও সীমালঙ্ঘন পরিলক্ষিত হয়। বিনোদনের নামে অনেক ক্রিয়াকলাপ সংঘটিত হয়, যা একদিকে যেমন রীতি-নৈতিকতা পরিপন্থি, তেমনিভাবে তা ইসলামের বিধিবিধানের সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিকও। এতে ব্যক্তি ও সমাজজীবনে নানা অনাচার ও অশ্লীল কর্মকাণ্ডের ব্যাপক প্রচলন ঘটে। সমাজে বহু রকম অরাজকতা ও আশালীনতার সয়লাব বয়ে যায়। তার কুপ্রভাবে মনুষ্যত্ব, মানবিকতা ও লজ্জাবোধ সমাজ থেকে লোপ পায়। সাথে সাথে তা সমাজ ও ব্যক্তিজীবনে স্বস্তি, শান্তি ও নির্মলতার পরিবর্তে নানা অশান্তি, অস্তিরতা ও অবিশ্বাসের বীজ বপিত হয়। বিনোদনের নামে এসব অনৈতিক কাজের চর্চার ফলে পারিবারিক জীবনে নেমে আসে আস্থাহীনতা ও অশান্তির কালো ছায়া। ছিন্ন হয়ে যায় পারিবারিক বন্ধন। যুবসমাজ হয়ে ওঠে মেধাহীন ও জ্ঞান চর্চার মহান ব্রত থেকে বিচ্যুত। এ কারণে একজন মুসলিম ব্যক্তির উচিত, কোন ধরনের বিনোদন ব্যবস্থা তার জীবনকে সুন্দর, শালীন ও শান্তিময় করবে, দূর করবে মনের অশান্তি, অস্থিরতা এবং জীবনকে করে তুলবে গতিময়, তা যথার্থভাবে অবগত হওয়া। পক্ষান্তরে কোন ধরনের বিনোদন চর্চায় তার জীবনে নেমে আসবে অশান্তির অমানিশা তা-ও অবগত হওয়া উচিত। এককথায় বিনোদানের ব্যাপারে ইসলাম উপস্থাপিত দিকনির্দেশনা ও বিধিবিধান মেনে চলার মাধ্যমেই সম্ভব অসুস্থ ও রুচিহীন বিনোদনের করাল গ্রাস থেকে নিজেকে এবং গোটা সমাজকে রক্ষা করা। পাশাপাশি সুস্থ ধারার বিনোদলমূলক কর্মকাণ্ড চর্চার মাধ্যমে অবসাদ, ক্লান্তি ও হতাশা বিদূরিত করে জীবনকে সুখময় করা যায়। এর মাধ্যমে মানুষ সর্বপ্রকার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সজাগ ও সচেতন থাকতে পারে। সর্বোপরি ইসলাম প্রদত্ত বিনোদনের উপায়গুলো চর্চার মাধ্যমে মানুষ মহান আল্লাহ প্রদত্ত জীবনকে সুস্থ ও সবল রেখে তাঁর ইবাদতে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে পারে। 

অভিধানিক দৃষ্টিতে বিনোদনের বিভিন্ন অর্থ পরিলক্ষিত হয়। যেমন : সানন্দে যাপন, কষ্ট অপনোদন, আমোদিত কারণ, তুষ্টি সাধন ইত্যাদি। ইংরেজিতে বিনোদন বোঝাতে একাধিক শব্দ ব্যবহৃত হয়। যেমন : Divertion [চিত্ত বিনোদন], Recreation [বিশ্রাম, বিনোদন], Sport [ক্রীড়া-কৌতুক] আরবিতে বিনোদনকে তাফরিহ বলা হয়। এর মূল অর্থ আনন্দ দান। মানুষ জীবন পরিক্রমায় নানাবিধ কাজ ও দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ক্লান্ত ও অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ফলে তাকে একটু বিশ্রাম বা আনন্দ উপভোগ করতে হয়। এভাবে কঠোর পরিশ্রমান্তে আত্মাকে সতেজকরণ ও নবশক্তি দানই হলো বিনোদন। আরবি ভাষায় বিনোদন বোঝাতে তারবিহ শব্দটিও ব্যবহৃত হয়। এটি রাওহোন শব্দ থেকে নির্গত। অর্থ হলো আত্ম। সুতরাং বলা যায়, বিনোদন আত্মার সাথে সম্পর্কিত একটি বিষয়। এর মাধ্যমে তৈরি হবে আত্মার প্রশান্তি, মনের সতেজতা, হৃদয়ে কর্মোদ্দীপনা, যা মানব মনের ক্লান্তি ও উদ্বেগ উৎকণ্ঠা দূর করে, অবসন্ন মনকে প্রফুল্ল ও আমোদিত করে।

গবেষকগণ বিনোদনের বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন। সংজ্ঞাগুলোর মধ্যে কয়েকটি নিম্নে উপস্থাপন করা হলো :

“যা মানব মনকে ক্লান্তিমুক্ত করে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দূর করার মাধ্যমে মনকে প্রফুল্ল ও আমোদিত করে।”

“বিনোদন হলো, ব্যক্তি অবসর সময়ে চর্চা করে এমন উপভোগ্য ইচ্ছামূলক কর্মতৎপরতা।”

“বিনোদন হলো, খেলাধুলা ও আনন্দ উপভোগের বৈধ উপায়ে আত্মাকে আনন্দিত করা এবং মনে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করা।”

“মানুষের অবসর সময়কে এমন সুন্দরভাবে কাজে লাগানো, যা তার মাঝে শারীরিক ও চিন্তাগত নতুন শক্তি সঞ্চার এবং প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করে।”

উপর্যুক্ত ৩য় সংজ্ঞা থেকে বোঝা যায় যে, বিনোদনের যেসব ব্যবস্থা বা উপায় অবলম্বন বৈধ নয়, তা বিনোদন হতে পারে না। যেমন : সেসব বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড- যা ব্যক্তির নিজের বা সামাজিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং যা দ্বারা নিনোদনের যে আসল উদ্দেশ্য তা অর্জিত হয় না।

অতএব, যেসব কর্মকাণ্ডে মনের অস্থিরতা বাড়ে, মানুষ হৃদয়হীন হয় অথবা দায়িত্ব পালনের অনাগ্রহী হয়ে পড়ে কিংবা কর্মস্পৃহা হারিয়ে নেতিবাচক চিন্তায় জড়িয়ে পড়ে, তা বিনোদন হতে পারে না। বিনোদন মানব জীবনের প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। তা মানব প্রকৃতির স্বাভাবিক দাবি। এতে ব্যক্তির কাজে গতি ফিরে আসে, মানসিক চাপ কমে এবং জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তোলে। মানুষ কাজের ফাঁকে ফাঁকে যদি একটু আনন্দ বা বিনোদন লাভ করতে পারে, তাহলে তার পুরো জীবনটাই আনন্দময় হয়ে ওঠে। পক্ষান্তরে মানুষ যখন কাজের ভারে নানাভাবে জর্জরিত হয়ে অশান্ত ও অস্থির হয়ে ওঠে, তখন তা তার জীবনকে দুঃখ ভারাক্রান্ত করে তোলে। তাই অবসর সময়ে নির্ধারিত সীমারেখা মেনে বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডের চর্চা মানুষের জন্য খুবই দরকার। এককথায়, মানুষের প্রশান্ত ও আনন্দ আহ্লাদপূর্ণ জীবনযাপনে সুস্থ বিনোদনের গুরুত্ব অপরিসীম। এক্ষেত্রে অন্যান্য জীবনের চেয়ে মানুষের রয়েছে স্বতন্ত বৈশিষ্ট্য। আক্বল ও মেধা মানুষকে করেছে অনন্য। বুদ্ধি ও চেতনায়, রুচি ও বৈশিষ্ট্য অন্যান্য সৃষ্টির ওপর মানবজাতির শ্রেষ্ঠত্বের ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- নিশ্চয় আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, আমি তাদেরকে স্থলে ও জলে চলাচলের বাহন দান করেছি, তাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ দান করেছি এবং তাদেরকে অনেক সৃষ্ট বস্তুর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।

মানবজাতিকে আল্লাহ তাআলা যে আক্বল তথা বোধশক্তি দান করেছেন, সে মেধা ও বিবেক-বুদ্ধিকে বিকাশ করতে হলে প্রয়োজন সুস্থ রুচিসম্পন্ন ও মানব প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যশীল বিনোদন। সুন্দর বিনোদান ব্যবস্থা মানুষের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের ক্ষেত্রে অনেকাংশে সহায়ক ভূমিকা রাখে। সুস্থ ধারার বিনোদন মানুষের আত্মিক, মানসিক ও শারীরিক চাহিদার মাঝে সমন্বয় সাধন করে। মানুষ যদি শারীরিক ও মানসিকভাবে সবল ও সুস্থ না হয়, তাহলে তার জীবনে নানা অসংগতি ও বৈপরীত্য দেখা দিতে পারে। এ কারণেই মানবজীবনে বিনোদন প্রয়োজন, যা তার কর্মময় জীবনকে গতিশীল রাখবে। সাথে সাথে তা এনে দেবে আত্মার প্রশান্তি, বিবেকের সুস্থতা ও সচলতা এবং শারীরিক নিরাময়তা। একজন মুমিন ব্যক্তি যেন তার জীবনকে ভারসাম্যপূর্ণ করে ঢেলে সাজায়, এজন্য রাসূলুল্লাহ সা. মানুষকে এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিদের্শনা দিয়েছেন। রাসূল সা. তাঁর সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল আস রা.-কে লক্ষ্য করে বললেন- নিশ্চয় তোমার শরীরের জন্য তোমার ওপর হক আছে, তোমার আত্মার জন্য তোমার ওপর হক আছে, তোমার স্ত্রীর জন্য তোমার ওপর হক আছে।

উক্ত হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, পরিবার-পরিজনের প্রতি যেমন ব্যক্তির দায়দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি নিজ দেহ ও আত্মার প্রতিও কিছু কর্তব্য অর্পিত রয়েছে। দেহের যত্ন নেওয়া অনাকাক্সিক্ষত ক্ষতি থেকে অঙ্গপ্রতঙ্গকে রক্ষা করা, শরীরকে প্রয়োজনীয় বিশ্রাম দেওয়া- এসব কিছুই শরীরের হক হিসেবে গণ্য। অন্যদিকে আত্মাকে আনন্দ ও প্রফুল্ল রাখা, অহেতুক দুশ্চিন্তা ও উৎকণ্ঠা থেকে মুক্ত রাখা আত্মার হকের মধ্যে পড়ে। কারণ, দুঃখ ও বিষণœতা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ব্যক্তিকে গতিহীন করে, নানাবিধ হতাশা ও আশঙ্কায় জীনকে দুর্বিষহ করে তোলে। তাই প্রয়োজন সুস্থ বিনোদনের, যা মানুষের মাঝে প্রসন্নতা এনে দেবে। এক্ষেত্রে রাসূল সা.-এর শেখানো নিম্নের দুআটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। সাইয়িদুনা আনাস ইবনু মালিক রা. থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. ইরশাদ করেন- “হে আল্লাহ! দুশ্চিন্তা ও পেরেশানি থেকে আমি আপনার কাছে আশ্রয় কামনা করছি।”

সুতরাং সুস্থ ও নির্মল বিনোদন মানুষের জন্য অত্যবশ্যক, যে বিনোদন ব্যবস্থায় থাকবে খুশি ও আনন্দ প্রকাশে শালীনতা, আনন্দ আহ্লাদ ও খুশি কিংবা রসাত্মক কথামালার মাধ্যমে মানুষের অবসর সময় উপভোগ ও উদ্যাপনের সুনির্দিষ্ট সীমারেখা। সুস্থ বিনোদনের মাধ্যমে মানুষের একগুঁয়েমি ভাব দূর হয় এবং তা মানুষকে সামাজিক মূল্যবোধসম্পন্ন উদার ব্যক্তিরূপে গড়ে তোলে। সুস্থ বিনোদন চর্চার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে চিন্তা-ভাবনায় ইতিবাচক দিক সৃষ্টি হয়, হরেক রকম অশুভ ও আশালীন কাজের প্রবণতা দূর হয়। এককথায়, মানুষের কর্মময় এ জীবনে আত্মিক সজীবতার জন্য বিশ্রাম ও বিনোদন খুবই প্রয়োজন। আজকাল মনোবিজ্ঞানীরা মানুষের সুস্থতার জন্য আনন্দ ও চিত্তবিনোদনকে খুবই গুরুত্ব দিচ্ছেন। বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রেও আনন্দ ও চিত্তবিনোদনকে ব্যাপক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অনেক মনোবিজ্ঞানী বলেছেন, চিত্তবিনোদন, হাসি-খুশি এমন এক অনৈচ্ছিক প্রতিক্রিয়া, যার ফলে মুখের ১৫টি মাংসপেশি একই সময়ে সংকুচিত হয় এবং দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস ঘটে। এ ছাড়াও মানুষ যখন হাসি ও প্রফুল্লতার মধ্যে সময় অতিবাহিত করে, তখন শরীরের রক্তপ্রবাহ দ্রুত সঞ্চালিত হয়। রক্তে এড্রেনালিন বেড়ে যায়। ফলে মানুষ সজীবনতা ও আনন্দ অনুভব করে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণ পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন- মানুষ মানসিক উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা ও আবেগের ভারসাম্যহীনতার কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়। এ হিসেবে আমরা বলতে পারি যে, মানুষের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য বিনোদনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি।

বিনোদন বা আনন্দ উপভোগ মানুষ নানারূপ ও ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে করে থাকে। কখনো তা হয় ক্রীড়া-কৌতুকে। আবার কখনো হয় অন্য রূপে। মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি সকলেই একই রকম নয়। নানা স্বাদ ও রুচি মানুষের মাঝে বিরাজ করে। মনের আনন্দ ও প্রশান্তি লাভ একটি আপেক্ষিক বিষয়। কেউ কোনো জিনিস দেখে কিংবা সম্পাদন করে আনন্দ লাভ করে। আবার কারও কাছে হতে পারে একই জিনিসটি দুঃখ-বেদনার। সুস্থ রুচিবোধের অভাবে মানুষ অনৈতিক কাজেও আনন্দ উপভোগ করলে তাও কিন্তু বিনোদন, তবে তা হলো বিনোদনের নামে এক প্রকার নৈরাজ্য। বিনোদনের বহুবিধ মাধ্যম এমন রয়েছে, যা আত্মার প্রশান্তি ও মনের স্থিরতা বয়ে আনে না; বরং তা মনে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। মানুষকে মানসিকভাবে অস্তির করে তোলে। সাথে সাথে দেহ মনও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এতে মানুষ হয়ে পড়ে নীতিহীন। জীবনে নেমে আসে নান রকম অবক্ষয়। প্রাশান্তির পরিবর্তে অস্থিরতা পেয়ে বসে। এ রকম কর্মকাণ্ড কোনো মতেই বিনোদন হতে পারে না। বিনোদন হবে এমন, যা মনকে প্রফুল্ল করে অন্তরে প্রশান্তি ও স্থিরতা ডেকে আনে। মানুষ জন্মের পর থেকেই আনন্দপ্রিয়। আনন্দময় জীবন লাভ তার স্বভাবের দাবি। মানুষ তারুণ্যে পদার্পণের সাথে সাথে আনন্দ উপভোগ বা বিনোদন যাপনের আগ্রহ বেড়ে যায়। বিনোদনের ধরন, প্রকৃতি, মানুষের রুচি, পরিবেশ ঐতিহ্য ও চিন্তা-চেতনার আলোকে বিকশিত হয়। পরিবেশ দ্বারা মানুষ প্রভাবিত হয়। মহান আল্লাহ বলেন, “(হে রাসূল) আপনি বলে দিন, প্রত্যেকই নিজ রীতি অনুযায়ী কাজ করে। অতঃপর আপনার পালনকর্তা বিশেষরূপে জানেন যে কে সর্বাপেক্ষা নির্ভুল পথে আছে।”

এখানে শাকিলতুন শব্দের ব্যাখ্যায় স্বভাব, অভ্যাস, প্রকৃতি, নিয়ত, রীতি ইত্যাদি বিভিন্ন অর্থ বর্ণিত রয়েছে। সবগুলোর সারমর্ম পরিবেশ। অভ্যাস, প্রথা ও প্রচলনের দিক দিয়ে প্রত্যেক মানুষের একটি অভ্যাস ও মানসিকতা গড়ে ওঠে। এ অভ্যাস ও মানসিকতা অনুযায়ী তার কাজকর্ম হয়ে থাকে। এ আয়াতে মহান আল্লাহ মানুষকে সর্তক করেছেন যে, মন্দ পরিবেশ, মন্দ সংসর্গ ও মন্দ অভ্যাস থেকে বিরত থাকা দরকার। মানবজাতির প্রতি আল্লাহ তাআলার অবারিত করুণা ও দয়ায় মানুষ সৃষ্টির সেরা হওয়ার গৌরব লাভ করেছে। এ হিসেবে মানুষের গতিবিধি অপরাপর কর্মকাণ্ড, আনন্দ-আহ্লাদ এমন হওয়া উচিত, যা তার মর্যাদার সাথে সংগতিপূর্ণ। বিনোদন হবে শোভন, মনোহর ও সুস্থ রুচিসম্পন্ন এবং নৈতিকতার সীমারেখা মেনে শালীনতা বজায় রেখে। শুধু তাই নয়; বিনোদনে চারিত্রিক মূল্যবোধ ও অটুট রাখা আবশ্যক। কারণ, মানুষের কাজকর্ম ও আনন্দ উপভোগে যদি নৈতিকতাই না থাকে; বরং চারিত্রিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটে, তাহলে মানুষের সব আয়োজন পাশবিকতায় রূপ লাভ করবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলার নিম্নোক্ত বাণী বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি ইরশাদ করেন- শপথ প্রাণের এবং যিনি তা সুবিন্যস্ত করেছেন তাঁর। অতঃপর তাকে তার অসৎকর্ম জ্ঞান দান করেছেন। যে নিজেকে শুদ্ধ করে, সে-ই সফলকাম হয়। যে নিজেকে কলুষিত করে, সে ব্যর্থ মনোরথ হয়।

উপর্যুক্ত আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, মানুষের মাঝে আল্লাহর আনুগত্য ও নাফরমানি করার উভয়ই প্রবণতা বিরাজমান। মানুষ যখন নিজের সামগ্রিক বিষয়ে আল্লাহর আনুগত্য অবলম্বন করে নিজেকে পাপাচার থেকে বাঁচিয়ে রাখে, তখনই তার জীবন সফলতায় উন্নীত হয়। আত্মপরিশুদ্ধির জন্য রাসূল সা. দুআ শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি যখন পবিত্র কুরআনের উপর্যুক্ত আয়াত তিলাওয়াত করতেন, তখন নিম্নোক্ত দুআ পাঠ করতেন : হে আল্লাহ! আমার আত্মায় তোমার ভয় সৃষ্টি করে দাও! আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে দাও। আল্লাহ! তুমিই সর্বোত্তম পরিশুদ্ধকারী, তুমিই তাঁর বন্ধু এবং অভিভাবক।

মানুষ যখন নানা অনাচার ও অনৈতিক কর্মকাণ্ড, অশালীন খেল-তামাশা এবং অশ্লীলতায় জড়িয়ে পড়ে, তখন তার জীবনটাই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। হতাশা ও নৈরাশ্য তার জীবনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। সুতরাং বিনোদনের ধরন পদ্ধতি কী রকম হবে তা নির্ভর করে ব্যক্তি, বয়স ও সামগ্রিক পরিবেশ পরিস্থিতির ওপর। মানুষের নানা দিক ও অবস্থা বিবেচনা করে বিনোদনের পদ্ধতি নির্ধারিত হওয়া উচিত। নিম্নে আমরা বিনোদনের নানান রূপ তুলে ধরেছি :

নারী পুরুষ সৃষ্টিগতভাবেই পরস্পর বিপরীতমুখী স্বভাব-চরিত্রের হয়ে থাকে। তাই বিনোদনের ধরন বা প্রকৃতিও নারী পুরুষ ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। পুরুষের জন্য তার সৃষ্টিগত স্বভাব-চরিত্রের সাথে সামঞ্জস্যশীল বিনোদনের তৎপরতা হয়ে থাকে। নারীর জন্য উপযোগী বিনোদন আলাদা হয়, যা পুরুষদের বিনোদন থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।

সব বয়সের মানুষের রুচি ও চাহিদা একই রকম হয় না; বরং তা ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। সে হিসেবে বিনোদন ব্যবস্থাও ব্যক্তির বয়সের সাথে মিল রেখে হয়ে থাকে। শিশুর জন্য যে বিনোদন ব্যবস্থা প্রযোজ্য হতে পারে, তা যুবকদের জন্য অনুপযোগী। এভাবে বয়স্কজনদের বিনোদন পদ্ধতিও তাদের বয়সের দিকটি বিবেচনা করে নির্ধারিত হয়ে থাকে।

শিক্ষার মান ও বিনোদন পদ্ধতি : সমাজজীবনে শিক্ষার প্রভাব অনেক বেশি। শিক্ষিত মানুষের চালচলন ও অশিক্ষিত মানুষের আচার-আচরণে বিরাট ব্যবধান পরিলক্ষিত হয়। সে কারণে বিনোদনের প্রকৃতিও অনেক সময় বক্তির শিক্ষাগত যোগ্যতার ওপর নির্ভর করে। এজন্য শিক্ষিত শ্রেণির বিনোদন প্রক্রিয়ার মধ্যে পার্থক্য থাকাটাই স্বাভাবিক।

অর্থ মানুষের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখে এবং অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ও অসচ্ছলতা মানুষের জীবনে প্রভাব বিস্তার করে। এ নিরিখে আমরা বলতে পারি, যে কোনো সমাজের বিনোদন পদ্ধতি তার আর্থিক সামর্থ্যরে আলোকে হয়ে থাকে। কারণ, বিনোদনের এমন অনেক মাধ্যম আছে, যেগুলো বিশাল অংকের আর্থিক ব্যয় দাবি করে। এজন্য দেখা যায়, সমাজের অনেক সম্পদশালী মানুষ আর্থিক সামর্থ্যরে জোরে নানারকম বিনোদনে ডুবে থাকে।

সময় মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বড় নিয়ামত। সময়ের সুষ্ঠু ব্যবহার মানুষের জীবনে সাফল্য যেমন এনে দেয়, তেমনি অপচয় কিংবা অপব্যবহার ব্যক্তির জীবনের নানা রকম ক্ষতি বয়ে আনে। তাই বিনোদনের জন্য সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সময়ে প্রাচুর্য আর স্বল্পতা বিচারে বিনোদনের ধরন প্রকৃতি ভিন্ন ভিন্ন হয়।  কোনো কোনো বিনোদন দীর্ঘ সময়জুড়ে হয় আবার কোনো কোনোটি স্বল্প মেয়াদি হয়।

যে কোনো বিষয় স্থান ও সময়ের চাহিদা ও প্রয়োজনের নিরিখে হয়ে থাকে। এ হিসেবে মানুষের বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড স্থান, কাল ও পাত্রভেদে নানা রকম হয়। বিনোদনের সকল প্রকৃতি ও ধরন সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না; বরং স্থান ও সুখের চাহিদার আলোকে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে হয়ে থাকে। মানব জীবনের কোনো কাজই লক্ষ্যহীন নয়; বরং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই তার সব কাজ পরিচালিত হয়। কাজেই বিনোদনের ও কতিপয় সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য রয়েছে। যেমন- 

বিনোদনের একটি লক্ষ্যমাত্রা হলো কাজের ভারে ক্লান্ত দেহ ও মনকে একটু আরাম দেওয়া। অবসর সময়ে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রতঙ্গকে বিশ্রাম দেওয়া। মোটকথা, ব্যস্ততম জীবনে মানুষের দেহ ও মনে যখন ক্লান্তি ও অবসাদ ভর করে, তখন একটু বিনোদন তার দেহ ও মনকে আরাম বা প্রশান্তিতে ভরে দেয়। বিনোদনের নানা রকম উপায়-উপকরণ ব্যবহারের ফলে মানুুষের শারীরিক পরিশ্রম হয়। এর মাধ্যমে শরীরের নানা অংশ বিভিন্ন প্রকার দূষিত পদার্থ থেকে মুক্ত হয় এবং অঙ্গপ্রতঙ্গ সচল থাকে। এককথায়, বিনোদন মানুষের শারীরিক ও মানসিক ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

মানুষের রয়েছে নিজস্ব ঝোঁক প্রবণতা, আগ্রহ ও অভ্যাস। প্রত্যেক মানুষের চাহিদা, মনের আগ্রহ ও পছন্দ-অপছন্দ একরকম নয়। কিন্তু কিছু মৌলিক বিষয় এমন রয়েছে, যেগুলো প্রতিটি মানুষের দেহ-মনের সুস্থতার জন্য অতীব জরুরি। তেমনিভাবে বিনোদন জীবনের সামগ্রিক ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখে। সময় মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে এক মহা নেয়ামত। মানবজীবনে এর মূল্য অপরীসীম। কারণ, এ সময়ই মানবজাতির উত্থান ও পতন, সফলতা-ব্যর্থতা ও উন্নতি-অগ্রগতি সবকিছুরই প্রধান উপলক্ষ্য। সময়ের সুষ্ঠু ব্যবহারে সফলতা অনিবার্য। এজন্য মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে সময়ের কসম করেছেন, যাতে সময়ের গুরুত্ব ফুটে উঠেছে। সাথে সাথে মানবজাতিকে আল্লাহ তাআলা এর ব্যাপারে যত্নশীল হওয়ার জন্য গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেন- “কসম সময়ের, নিশ্চয় মানুষ ক্ষতির মাঝে নিমজ্জিত।” ‘সময়’ মানবজীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানুষের সাথে সময়কে সম্পৃক্ত করলে সময়কে দু ভাগে ভাগ করা যায়।

সময়ের এ অংশে মানুষ বিভিন্ন দায়িত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত থাকে। এ সমস্ত কাজ বা দায়িত্ব আবার নানা প্রকারের হয়ে থাকে। যেমন- ক. শরীয়ত নির্ধারিত আবশ্যিক কার‌্যাবলি। খ. পানাহার ও নিদ্রা। গ. বিভিন্ন ধরনের প্রয়োজন পূরণ। ঘ. সামাজিক জীবনের বিভিন্ন দাবি ও কর্তব্য পালন। যেমন : আত্মীয়স্বজনের হক আদায় করা, অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া এবং অতিথির সৎকার করা। এভাবে সময়কে যথার্থ ও প্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করার মাধ্যমে ব্যক্তি তার জীবনকে সকল দিক থেকে ফলপ্রসূ ও সুন্দররূপে গড়ে তুলতে পারে। এটি সময়ের ঐ অংশ, যাতে মানুষ যাবতীয় প্রয়োজনীয় দায়িত্ব ও কাজকর্ম থেকে অবসর পায় এবং তার ওপর থাকে না দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের কোনো বাধ্যবাধকতা। সুতরাং বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড চর্চা করতে গিয়ে যেন কাজের ব্যাঘাত, সময়ের অপচয়, দায়িত্বে অবহেলা, সর্বোপরি শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির সম্মুখীন না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখা একান্ত বাঞ্চনীয়। মানুষ আশরাফুল মাখলুখাত। তার রুচিবোধ হবে অন্য প্রাণীর চেয়ে আলাদা। মানুষের আর অপরাপর প্রাণীর অভ্যাস, আচার-আচরণ ও কর্মকান্ডের মাঝে রয়েছে বিস্তর ব্যবধান। এজন্য একজন মুসলিম ব্যক্তির বিনোদনে থাকতে পারে না চরিত্রহীনতা ও অনৈতিকতা- যা মানুষের মনে উত্তেজনা সৃষ্টি করে, ব্যক্তিজীবনে অস্থিরতা ডেকে আনে; বরং প্রয়োজন এমন বিনোদন, যা মানব স্বভাবের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ও রুচিশীল।

ইসলাম সুষ্ঠু বিনোদন ব্যবস্থায় গুরুত্ব দিয়ে থাকে। মানুষের শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক ভারসাম্য রক্ষায় সুস্থ বিনোদনের বিকল্প নেই। সঠিক বিনোদন ব্যবস্থা মানুষকে যেমন কর্মক্ষম থাকতে সহায়তা করে, তেমনি তা সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশেও ভূমিকা রাখে। তদুপরি রুচিসম্মত বিনোদন মানুষকে নানাবিধ অপরাধকর্ম ও হতাশা থেকেও নিবৃত রাখে। এজন্য ঈমানদারগণ এমন কিছু চিত্তবিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড করবেন, যাতে আত্মার প্রশান্তি আসে। এ প্রসঙ্গে রাসূল সা. ইরশাদ করেন : “তোমরা মাঝেমধ্যে আত্মাগুলোকে বিশ্রাম দাও। কারণ, আত্মাসমূহ যখন ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন তা হয়ে যায় অস্থির।”

উপর্যুক্ত হাদিস দ্বারা আমরা বুঝতে পারি, আত্মাকে বিশ্রাম দেওয়া এবং বিনোদনের ব্যবস্থা করা খুবই জরুরি। কারণ, কাজকর্মে জর্জরিত ব্যাক্তির আত্মা কাজের চাপে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধন্ত গ্রহণে সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠে। তাই মানুষের স্বভাবজাত মনের সতেজতা রক্ষা করতে ইসলাম চিত্ত বিনোদনের ওপর গুরুত্ব দিয়ে থাকে। সাইয়িদুনা আলী রা.-এর একটি উক্তি এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়। তিনি বলেন- “নিশ্চয় অন্তরত সমূহের কামনা বাসনা, উৎসাহ উদ্দীপনা এবং হতাশা ও পিছটান রয়েছে। সুতরাং অন্তরের চাহিদা ও উৎসাহ ঠিক রেখে চলো। কারণ, মনকে যে কোনো বিষয়ে বাধ্য করলে তা অব্যবস্থিত হয়ে পড়ে।”

নিম্নে আমরা বিনোদনের গুরুত্ব বিষয়ক মুসলিম মনীষীগণের কয়েকটি উক্তি উল্লেখ করছি-

সাইয়িদুনা আলী রা. বলেন : তোমরা আত্মাসমূহকে প্রফুল্লতা দাও এবং তার জন্য প্রজ্ঞাপূর্ণ চমৎকার মজার বিষয় তালাশ করো। কারণ, দেহের মতো আত্মাও বিরক্ত এবং ক্লান্ত হয়ে পড়ে।

বিশিষ্ট সাহাবি উসামা ইবনু যায়িদ রা. আল্লাহ তাআলার যিকর-এর মাধ্যমে অস্তির আত্মায় প্রশান্তি আনতে বলেছেন। তিনি বলেন : আত্মাগুলোকে আনন্দ দাও যিকর-এর মাধ্যমে।

বিশিষ্ট তাবেয়ি হাসান আল বাসরী রহ. বলেন, এই অন্তকরণসমূহ জীবন্ত থাকে, আবার নির্জীবও হয়ে যায়। আত্মা যতক্ষণ জীবন্ত থাকে, তখন তুমি একে ফরজ ইবাদতের সাথে সাথে নফল বন্দেগিতেও নিয়োজিত রাখো। আত্মা নির্জীব হয়ে গেলে তুমি শুধু ফরজ ইবাদতে একে নিয়োজিত করো।

বিখ্যাত মুহাদ্দিস শিহাব আয-যুহ্রী রহ. বলেন : কোনো এক ব্যক্তি রাসূলূল্লাহ সা.-এর সাহাবিদের সাথে উঠা-বসা করতেন এবং তিনি তাঁদের সাথে কথাবার্তা বলতেন। তাদের পারস্পরিক কথাবার্তা যখন বেশি হয়ে যেত এবং কথা যখন তাদের কাছে ভারী হয়ে উঠত, তখন তিনি বলতেন, নিশ্চয় কানসমূহ কথা শুনতে অনীহা দেখাচ্ছে আর অন্তরগুলো বিতৃষ্ণা ভাব দেখাচ্ছে। অতএব, তোমরা তোমাদের নানা রকম কবিতা ও কথামালা উপস্থাপন করো।

উপর্যুক্ত মুসলিম পণ্ডিতগণের উক্তির মাধ্যমে এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, চিত্তবিনোদন ইসলামের দৃষ্টিতে উপেক্ষিত নয়; বরং ইসলাম একে উৎসাহিত করেছে। কারণ, এটি মানুষের স্বাভাবিক দাবি। কাজের পর একটু বিশ্রাম বা অবকাশ যাপন দেহ-মনের স্বাভাববিক চাহিদা। মানুষের কাজের গতি ও কর্মোদ্দীপনা বাড়াতে এর বিকল্প নেই। ইমাম কায়্যিম (রহ.) মানুষের সময়কে চার ভাগে ভাগ করেছেন। তিনি বলেন, তোমরা চেষ্টা করো, যেন তোমাদের সময়কাল চার অংশে বিভক্ত হয়। এক অংশেকে কেবল মহান আল্লাহর সাথে নির্ভৃতে সম্পর্ক গড়ে তুলে তাঁর ইবাদত-বন্দেগিতে লিপ্ত থাকবে। আরেক অংশ তোমাদের জীবনোপকরণ অর্জনের জন্য নির্দিষ্ট রাখবে। আরেক অংশ তোমাদের ভাই, বন্ধু, আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা-সাক্ষাতের জন্য বরাদ্দ রাখবে। চতুর্থ সময়ের একটি অংশ এমনভাবে নির্ধারিত রাখবে, যাতে তোমাদের বৈধ পন্থায় আনন্দ খুশি ও মজা করে সময় কাটাতে পারো। সময়ের এ অংশটির মাধ্যমেই তোমরা অপর তিনটি অংশের দায়িত্ব পালন করতে শক্তি সঞ্চয় করবে। 

মানুষের জীবনটাই আল্লাহ প্রদত্ত এক বড় নিয়ামত। দেহ ও মনের সুস্থতা হলো এক জীবনকে সফলতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়ার অন্যতম শর্ত। শরীয়তসম্মত পন্থায় চিত্তবিনোদন মানুষকে ইবাদত-বন্দেগি কাজকর্ম ও সামগ্রিক উৎপাদনে সক্ষম করে তোলে। সাথে সাথে এটি যুবসমাজকে স্থায়ী কর্মমুখর রাখে। তবে এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যে, চিত্তবিনোদনের সব উপায়-উপকরণ যেন কুরআন, সুন্নাহ এবং সাহাবা কেরাম রা.-এর সুমহান আদর্শের সাথে সামঞ্জস্যশীল হয়। অতএব, নিম্নোক্ত কয়েকটি দিক বিবেচনায় রাখলে বিনোদনের গুরুত্ব স্পষ্টভাবে ফুটে উঠবে। মানুষের স্বভাবজাত দাবি হিসেবে দেহ ও মনের ভারসাম্য রক্ষা করা খুবই জরুরি, যা সুস্থ বিনোদন ছাড়া সম্ভব নয়।

বর্তমান প্রযুক্তির যুগে নানা ধরনের অসুস্থ ধারায় বিনোদন এবং এসব বিনোদনের বহুবিধ উপায়-উপকরণ সহজলভ্য হওয়ায় যুব সমাজ তাতে ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে তা ব্যক্তি চরিত্র ও সুন্দর সমাজ ব্যবস্থার রুচিশীর ধারায় আঘাত হানছে। এমতাবস্থায় সুস্থ রুচির বিনোদন ব্যবস্থার প্রচলন সমাজের জন্য অত্যন্ত জরুরি, যা নিঃসন্দেহে ব্যক্তি ও সমাজকে অবক্ষয়ের হাত থেকে বাঁচাতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। নারী পুরুষের জন্য শরয়ী সীমারেখা মেনে পৃথকভাবে তাদের স্ব-স্ব স্বাভাব ও প্রকৃতি উপযোগী বিনোদন ব্যবস্থা সমাজে গড়ে তুললে তা নিজ নিজ প্রতিভা বিকাশে সহায়ক হবে। শরিয়তের সুনির্দিষ্ট সীমাখোর মধ্য থেকে যে সুস্থ ও রচিশীল বিনোদন চর্চা করা হয়, তাকে ইসলামে বৈধ ঘোষণা করেছে। সুস্থ রুচি পরিপন্থি যে কোনো গতানুগতিক ব্যবস্থাকে ইসলাম অনুমোদন দেয় না। এ ভিত্তিতে বিনোদনের এমন সব ব্যবস্থাকে ইসলাম বৈধতা দেয়, যা মানুষের শারীরিক ও মানসিক উন্নতি সাধানে সহায়ক ভূমিকা রাখে। বিনোদনের ধরন প্রকৃতি ও উদ্দেশ্যের ভিত্তিতেক এর বিধানের ভিন্ন রয়েছে। বিনোদন যদি ইসলামে নির্দেশিত নীতিমালার পরিপন্থি হয়, তবে তা নিরর্থক কথা ও কর্ম হিসেবে গণ্য হবে। এ জাতীয় বিনোদনের কারণে মানবজীবনের মূল্যবান সময় বিনষ্ট হয় এবং তা জীবনকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এরূপ চিত্তবিনোদন এমন একটি নিরর্থক কাজ, যা একজন ঈমানদার ব্যক্তির জন্য কখনো শোভা পায় না। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের অপ্রয়োজনীয় কাজ ও বিষয় থেকে দূরে থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন : আর (ঐ সকল মুমিন সফলকাম হয়েছে) যারা অনর্থক কথা ও কাজ থেকে বিমুখ থেকেছে। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে অন্য আয়াতে এসেছে : আর (দয়াময় আল্লাহর প্রিয় বান্দাহ হলো) যারা মিথ্যা কাজে যোগদান করে না এবং যখন অসার ক্রিয়াকর্মের সম্মুখীন হয়, তখন মান রক্ষার্থে ভদ্রভাবে চলে যায়।

উপর্যুক্ত কুরআনের আয়াতগুলো থেকে জানা যায়, একজন মুমিন ব্যক্তি অপ্রয়োজনীয় কথা, কাজ বা যে কোনো ধরনের বিষয় কিংবা কর্মতৎপরতায় লিপ্ত হতে পারে না। এ জাতীয় কার্যকলাপ তার জন্য শোভনীয়ও নয়। বিনোদন যদি ইসলামী নীতিমালার আলোকে সম্পন্ন করা হয় এবং এর উদ্দেশ্য ও হয় ইবাদতের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা, তবেই তা বৈধ। এর পক্ষে কয়েকটি দলিল নিম্নে উপস্থাপন করা হলো : আবদুল্লাহ ইবনু আমর রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. তাকে লক্ষ্য করে বলেন, হে আবদুল্লাহ! আমাকে কি জানানো হয়নি যে, তুমি দিনের বেলায় সাওম পালন করো এবং রাতের বেলায় জেগে জেগে আল্লাহর ইবাদত করো। তিনি জবাব দিলেন, হ্যাঁ, ইয়া রাসূলূল্লাহ সা.! রাসূল সা. বললেন, তুমি এরূপ করো না। তুমি সাওম পালন করবে, আবার মাঝে মাঝে সাওম ছেড়েও দেবে। নামাজের জন্য রাতে দাঁড়াবে, আবার ঘুমাবেও। কেননা, তোমার ওপর শরীরের হক রয়েছে, আত্মার হক রয়েছে। তোমার স্ত্রীরও অধিকার আছে।

উপর্যুক্ত হাদিসে ইঙ্গিত রয়েছে যে, মানুষ ইবাদত-বন্দেগিতে ভারসাম্য রক্ষা করা পরিবারের অধিকার আদায়ের সাথে সাথে দেহ ও মনের সুস্থতা নিশ্চিত করবে। কারণ, দেহ মনের সুস্থতা ছাড়া মানুষ আল্লাহর ইবাত পূর্ণাঙ্গভাবে করতে পারে না। তাই কাজের ফাঁকে অবসর সময়ে মানুষের সীমিত পরিসরে চিত্তবিনোদন উদ্যাপন করা শুধু বেধ নয়; বরং কোনো কোনো সময় জরুরিও হয়ে পড়ে। সহীহ মুসলিমের অপর বর্ণনায় রয়েছে, রাসূল সা. হযরত আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনিল আস রা.-কে লক্ষ্য করে বললেন : হে আবদুল্লাহ! নিশ্চয়ই তুমি তো সব সাওম পালন করো। সারা রাত জেগে থেকে ইবাদত করো। নিশ্চয় তুমি যদি এ রকম করতেই থাকো, তাহলে তোমার চোখ দুর্বল ও ক্লান্ত হয়ে পড়বে। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে, মানব শরীরের সুস্থতা, মনের প্রশান্তি ও পুরো জীবনের সঠিক ব্যবহার ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যাবশ্যকীয় এক বিধান। সে হিসেবে বিনোদন মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। 

আবু হুযাইফা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সালমান আল ফারসি রা. ও আবুদ দারদা রা.-এর মাঝে রাসূল সা. ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করে দিলেন। একদিন সালমান রা. আবুদ দারদা রা.-এর সাথে সাবাত করতে গিয়ে লক্ষ্য করলেন যে, তাঁর স্ত্রী উম্মু দারদা রা. জীর্ণ-শীর্ণ কাপড় পরে বির্মষ অবস্থায় রয়েছেন। তখন তিনি তাকে বললেন, তোমার এ কী দশা? তিনি বললেন, তোমার ভাই আবু দারদা দুনিয়াবিমুখ হয়ে গেছে। তারপর আবু দারদা রা. বাড়িতে এলেন। তিনি তার মেহমানের জন্য খাবার তৈরি করলেন। তারপর তাকে বললেন, খাও। তিনি নিজে বললেন, আমি রোজাদার। সালমান আল ফারসি রা. বললেন, তুমি না খেলে আমি খাচ্ছি না। বর্ণনাকারী বললেন, তারপর তিনি খেলেন। যখন রাত হলো, তখন আবু দারদা রা. রাতের নামাজের জন্য দাঁড়াতে গেলেন, কিন্তু সালমান রা. বললেন তুমি শুয়ে পড়ো। তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। তারপর আবার উঠতে চাইলেন, কিন্তু সালমান রা. বললেন ঘুমাও। অতঃপর যখন রাতের শেষাংশ হলো, তখন সালমান রা. বললেন এবার ওঠো। তারপর তারা দুজনে নামাজ আদায় করলেন। অঃতপর সালমান রা. আবুদ দারদা রা.-কে লক্ষ্য করে বললেন, তোমার ওপর তোমার প্রভুর হক আছে, তোমার ওপর তোমার নিজের নফসের হক রয়েছে। তোমার পরিবারের হক রয়েছে। প্রত্যেক হরদারকে তার হক প্রদান করো। তারপর আবু দারদা রা. রাসূলূল্লাহ সা.-এর কাছে এসে তা জানালে রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, সালমান সত্যই বলেছে।

উপর্যুক্ত হাদিসগুলো থেকে প্রমাণিত হয় যে, মানুষের আত্মার প্রশান্তি তথা বিশ্রামের প্রতি যত্নশীল হওয়া উচিত। সময়ের একটি অংশ আনন্দ ও প্রফুল্লতায় কাটানো বাঞ্চনীয়, যাতে কাজের প্রতি বিরক্তিকর ভাব দূর হয় এবং ক্লান্তি বিদূরিত হয়। সাথে সাথে পূর্ণ একাগ্রতা ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে আল্লাহ তাআলার ইবাদতে মশগুল থাকা যায়। ইসলামের প্রতিটি বিধানই যেহেতু সত্য, বলিষ্ট ও বাস্তুনিষ্ঠ, ভারসাম্যপূর্ণ ও মানবরুচির সাথে সামঞ্জস্যশীল, তাই অন্য কোনো বিনোদন ব্যবস্থার তুলনায় ইসলাম প্রদর্শিত বিনোদন ব্যবস্থা আলাদা ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। 

আল্লাহর প্রতি ঈমানের একান্ত দাবি হলো, মানুষের সমগ্র জীবনটাই সর্বাবস্থায় তার বন্দেগির অনুভূতি সজ্জীবিত থাকবে। জীবনের সকল কাজকর্ম একমাত্র তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী পরিচারিত হবে। জীবনের আনন্দ-নিরানন্দ ব্যস্ততা ও অবসর যাপন, ছোটখাটো সবটুকুই ইসলামী শরিয়তের আলোকে হওয়াটাই বান্দার বন্দেগির দাবি। এ নিরিখে একজন আল্লাহর বান্দা বিনোদনকে এভাবে গ্রহণ করবেন যে, আমার দেহ মনের সুস্থতা আমাকে হক্কুলাহ (আল্লাহর হক্ব) ও হক্কুল ইবাদ (বান্দাহর হক্ব) আদায়ে সক্ষম রাখবে। পূর্ণ একাগ্রতা নিয়ে আমার ওপর মহান আল্লাহ কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে পারব। তাহলে একজন মুমিন ব্যক্তি তার জীবনে যে সময়টুকু শরিয়ত নির্ধারিত সীমারেখা মেনে চিত্তবিনোদনে ব্যয় করবেন, তা নিঃসন্দেহে আল্লাহর বন্দেগির আওতায় গণ্য হবে। 

এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সা.-এর একটি হাদিস আমাদেরকে চমৎকার শিক্ষা প্রদান করে। তিনি বলেন, তোমাদের কেউ স্বীয় স্ত্রীর সাথে সহবাস করলে তাও সাদকা (সাওয়াব) হবে। এ কথা শুনে সাহাবিগণ বললেন, হে রাসূল! আমাদের কেউ তার স্ত্রীর কাছে গিয়ে যৌন চাহিদা পূরণ করলেও কি সে সাদাকার সাওয়াব পাবে? তখন রাসূলূল্লাহ সা. বললেন কেউ যদি তার যৌন চাহিদা হারাম পন্থায় পূরণ করে, তাহলে এতে কি গুনাহ হবে বলে তোমরা মনে করো না? তারা বললেন- হ্যাঁ, অবশ্যই গুনাহ হবে। রাসূলুল্লাহ সা. বললেন, এভাবেই তো বৈধ উপায়ে নিজ স্ত্রীর সাথে মেলামশা করলে আল্লাহর কাছে সাওয়াব পাওয়া যায়। এভাবে একজন মুমিন তাঁর সকল কার্যকলাপ কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে সম্পাদিত করে আল্লাহর বন্দেগির অন্তর্ভুক্ত করতে পারে। এ প্রসঙ্গে সাইয়িদুনা মুয়াজ ইবনু জাবাল রা.-এর উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন : আমি আমার নিদ্রাতেও আল্লাহর কাছে সওয়াবের আশা রাখি, যেমন আমি রাতে নির্ঘুম থেকে ইবাদতের মধ্যে সওয়াবের আশা করে থাকি।

সর্বাবস্থায় ইসলাম নির্দেশিত মৌলিক বিষয়গুলো অটুট রেখে স্থান, সময় ও পরিবেশের আলোকে বিনোদনের বিভিন্ন মাধ্যম মানুষ নির্ধারণ করতে পারে। খেয়াল রাখতে হবে, কোনো অবস্থাতেই যেন বিনোদন ব্যবস্থা ব্যক্তিকে পাপাচার ও সীমালঙ্ঘনের দিকে ধাবিত না করে। কারণ, যা হারামের দিকে নিয়ে যায়, ইসলাম তাকে হারাম ঘোষণা করেছে। দেহ, আত্মা ও বিবেক-বুদ্ধির সমন্বয়েই একজন মানুষ। কাজেই ইসলাম একটি স্বভাবগত জীবনব্যবস্থা হিসেবে মানুষের মানসিক, দৈহিক ও আত্মিক সব রকমের বৈধ চাহিদা পূরণের যথার্থ নির্দেশনা দিয়ে থাকে। মোটকথা ইসলামের বিনোদন পদ্ধতি মানবপ্রকৃতি ও রুচির সাথে পূর্ণ সামঞ্জস্যশীল।

মানবজীবনের বিভিন্ন দিক রয়েছে। যেমন : আত্মা, শরীর ও বিবেক। তার আরও রয়েছে নানা প্রকার ঝোঁক প্রবণতা। এগুলোর মাঝে সামগ্রিক সমতা ও পূর্ণতা না এলে মানবজীবনে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ইসলাম প্রদত্ত বিনোদন ব্যবস্থা মানুষের জীবনে ভারসাম্য এনে দেয়। ফলে মানষ অবসাদমুক্ত হয়ে প্রশান্তি ও স্থিরতা খুঁজে পায়। ইসলাম প্রদত্ত বিনোদন ব্যবস্থার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এটি বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ডকে আবশ্যিক কর্মকাণ্ডের ওপর প্রাধান্য দেয় না। বিনোদন চর্চা হবে অবসর সময়ে, যখন ব্যক্তি তার ওপর আবশ্যিকভাবে পালনীয় দায়দায়িত্ব থেকে মুক্ত থাকেন। সুতরাং ওয়াজিব ইবাদত, উর্পাজন, খাওয়া দাওয়া ঘুম ইত্যাদি প্রয়োজনীয় কাজের ওপর বিনোদনমূলক কাজ প্রধান্য পাবে না। অনুরূপভাবে আত্মীয়স্বজনের দেখাশোনা, রুগ্ন ব্যক্তির সেবা-যত্ন ইত্যাদির ওপর বিনোদনমূলক কর্মতৎপরতা অগ্রাধিকার পাবে না। ইসলামে বিনোদনের মূলনীতি। মূলগতভাবে বিনোদন হলো জাযেজ। ইসলামী শরিয়তের একটি বড় মূলনীতি হলো-যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো বিষয় হারাম হওয়ার সুস্পষ্ট দলিল না পাওয়া যাবে, ততক্ষণ তা হালাল হিসেবে গণ্য হবে।

এ প্রসঙ্গে রাসূল সা. বলেন : আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবে যা হালাল করেছেন তা হালাল, আর যা হারাম করেছেন তা হারাম। আর যে সব বিষয় নিয়ে তিনি নীরব রয়েছেন (হালাল কিংবা হারাম হওয়ার হুকুম বলেননি।) তাতে রয়েছে ছাড়। সুতরাং তোমরা আল্লাহ প্রদত্ত ছাড় গ্রহণ করো। কেননা, আল্লাহ তাআলা কোনো কিছু ভোলেন না। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সা. তাঁর এ বক্তব্যের পক্ষে (পবিত্র কুরআনের সূরা মারইয়ামের ৬৪ নং আয়াত) পড়লেন আর আপনার প্রভু বিস্মৃত হওয়ার নন। সুতরাং বিনোদনের উপায়-উপকরণ, ধরন প্রকৃতি যদি ইসলামি শরিয়াহর প্রতিষ্ঠিত মূলনীতির পরিপন্থি না হয়, তাহলে সে বিনোদন ব্যবস্থা জায়েজ বলে গণ্য হবে।

বিনোদন মানবজীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে ভারসাম্য আনয়নের মাধ্যম মাত্র। জীবনের কোনো এক দিকের ভারসাম্য বিনষ্ট হলে সুস্থ বিনোদনের মাধ্যমে জীবনের সে অংশের পরিপূর্ণতা লাভের জন্য প্রচেষ্টা চালাতে হয়। কিন্তু যদি এ সীমালঙ্ঘন করে বিনোদনকেই জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে পরিণত করা হয়, তখন সে বিনোদন বৈধতার গণ্ডি পেরিয়ে মাকরুহ বা হারামের পর্যায়ের চলে যায়। সুতরাং বিনোদন কোনো পেশা নয়। একে যদি পেশা হিসেবে গ্রহণ করা হয়, তখন তা আর বৈধ থাকে না। কেননা, এমতাবস্থায় তা ব্যক্তিকে ধীরে ধীরে ধর্মীয় ও অত্যাবশ্যকীয় কাজ থেকে দূরে নিয়ে যাবে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত এসব বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড ইসলাম কোনো অবস্থাতেই অনুমোদন দেয় না। কারণ, ইসলাম যেখানে ইবাদত-বন্দেগীর ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন পছন্দ করে না, সেখানে বিনোদনের মতো মুবাহ একটি বিষয় জীবনের উদ্দেশ্য বানানোকে মোটেও সমর্থন করে না। 

ইতঃপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে, ইসলামের দৃষ্টিতে বিনোদনমূলক তৎপরতা হলো প্রতিবিধানমূলক ব্যবস্থা, যা মানুষের দেহ মনের নানা অসংগতি দূর করতে সহায়তা করে। আবশ্যকীয় কর্মকাণ্ডই মানুষের জন্য মুখ্য বিষয় হিসেবে বিবেচিত হবে। বিনোদন তার অনুগামী মাত্র। এ থেকে আমরা কয়েকটি বিষয় বুঝতে পারি। যখন মানবজীবনের আবশ্যক কাজের সাথে বিনোদনমূরক কর্মকাণ্ডের বিরোধ দেখা দেয়, তখন আবশ্যক কাজই প্রাধান্য পাবে। আবু বারযাহ আল আসলামি রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূল সা. ইশার নামাজের পূর্বে ঘুমানো পর্যন্ত এবং তার পরে বিনা প্রয়োজনে জাগ্রত থেকে গল্প করাকে অপছন্দ করতেন। এ হাদিসের ব্যাখ্যায় হাফিজ ইবনু হাজর আল আসকালানি রহ. বলেন. সালাতুল ইশার পূর্বে ঘুমানোকে রাসূল সা. অপছন্দ করার কারণ হলো, এর মাধ্যমে হয়তো সালাতের ওয়াক্তই ছুটে যাবে। একইভাবে সালাতুল ইশার পরে অহেতুক গল্পগুজব ব্যক্তির সালাতুল ফজর কাজা হওয়ার কারণ হবে অথবা মুস্তাহাব ওয়াক্ত চলে যাবে।

উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে জানা যায়, মানুষের শরীরের আরাম ও প্রশান্তির জন্য ঘুম যদি ফরজ সালাত আদাযে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে, তাহলে সে ঘুমকে ইসলাম পছন্দ করে না। অপরদিকে শালীন ও সত্যাশ্রয়ী গল্প বলা বিনোদনের একটি অংশ হলেও সে গল্প যেন সালাতের কোনো ক্ষতি না করে সে দিকেও গুরুত্ব দিয়েছেন। মানুষের জীবনটাই হলো আল্লাহ তাআলা প্রদত্ত এক বড় আমানত। এ জীবনের আসল ব্রত হলো স্রষ্টা কর্তৃক দায়িত্বসমূহ সঠিকভাবে আদায় করা। মূল্যবান এ জীবনের বিরাট অংশজুড়ে বিনোদনে কাটানো ইসলাম সম্মত নয়। বিনোদন মানুষকে আসল দায়িত্ব পালনে সহায়তা করবে শুধু। এক্ষেত্রে সিরাতুর রাসূল সা. আমাদেরকে সঠিক নির্দেশনা দান করে। সাইয়িদুনা আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন : তুমি অধিক হেসো না। কারণ, অধিক হাসি অন্তরকে নির্জীব করে দেয়। এ হাদিস থেকে জানা যায়, হাসি মূলত বৈধ। তবে এক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন করাকে রাসূলূল্লাহ সা. পছন্দ করেননি। 

একবার সিমাক রা. জাবির রা.-কে লক্ষ্য করে বললেন: আপনি কি রাসূল সা.-এর সাথে উঠাবসা করতেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। রাসূল সা. দীর্ঘ সময় চুপ থাকতেন, কম হাসতেন। তাঁর সাহাবিগণ তাঁর উপস্থিতিতে কবিতা বলতেন এবং তাঁদের ব্যক্তিগত এমন কিছু বিষয় আলোচনা করতেন, যার ফলে সকলে হাসতেন এবং রাসূলুল্লাহ সা. অধিকাংশ সময় মুচকি হাসতেন। এ হাদিস থেকেও জানা যায় যে হাসি কিংবা রসাত্মক কোনো কথা স্বল্প পরিসরে করা যায়, এর জন্য বেশি সময় ব্যয় করা ঠিক নয়।

বিনোদনমূলক ব্যবস্থা কোনো মতেই ইসলামী শরিয়তের মূলনীতির পরিপন্থি হতে পারবে না। বিনোদনের এ মূলনীতিটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম যে সমস্ত কথা, কাজ আচার-আচরণ ও তৎপরতা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে, তা কখনো বিনোদনের উপায় হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না। এককথায়, এক্ষেত্রে শরিয়তের মূলনীতির বিরোধিতা থেকে বিরত থাকতে হবে। যেমন- এমন পন্থায় বিনোদন না করা, যাতে অন্যের প্রতি ঠাট্টা-বিদ্রুপ বা নিন্দা করা হয় অথবা কারও প্রতি ভয় প্রদর্শন কিংবা অন্যের সম্পদ নষ্ট না করা হয়।

মুমিনগণ কেউ যেন অপর কাউকে উপহাস না করে। কেননা, সে উপহাসকারী অপেক্ষা উত্তম হতে পারে। আর কোনো নারী যেন অপর নারীদের উপহাস না করে। কেননা, হতে পারে তারা তাদের চেয়ে উত্তম। তোমরা একে অপরের প্রতি দোষারোপ কোরো না। এবং অপরকে মন্দ নামে ডেকো না। কেউ বিশ্বাস স্থাপন করলে তাকে মন্দ নামে ডাকা গুনাহ। যারা এহেন কাজ থেকে তাওবা না করে, তারাই জালিম। মুমিনগন, তোমরা অধিক ধারণা করা থেকে বেঁচে থাকো। নিশ্চয় কতক ধারণা গুনাহ। আর গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না, তোমাদের কেউ যেন কারো পশ্চাতে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের মাংস ভক্ষণ করতে পারবে? বস্তুত তোমরা তো একে ঘৃণাই করো। আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয় তিনি তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।

উপর্যুূক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা ঈমানদারদেরকে কিছু বিষয় থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। সেগুলো হলো : ক. কারো প্রতি ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা। খ. কাউকে মন্দ নামে ডাকা। গ. কারো ব্যাপারে অহেতুক কু-ধারণা পোষণ করা। ঘ. কারো দোষ অšে¦ষণ করা। ঙ. পরনিন্দা করা।

তামাশাচ্ছলে অন্যের সম্পদ গ্রহণ করা প্রসঙ্গে রাসূল স. বলেন- অবশ্যই তোমাদের কেউ যেন তার ভাইয়ের সম্পদ (দ্রব্য সামগ্রী) খেলাচ্ছলে কিংবা ইচ্ছাকৃতভাবে নিয়ে না ফেলে। কোনো মুসলিমকে ভয় দেখানো সম্পর্কে তিনি বলেন- কোনো মুসলিমের জন্য অপর মুসলিমকে ভয় দেখানো বৈধ নয়। এমন বিনোদন না করা, যাতে অপর ভাইকে কথায় বা কাজে, শারীরিক বা মানসিক কিংবা আর্থিকভাবে কষ্ট দেওয়া হয়। মহান আল্লাহ বলেন : যারা বিনা অপরাধে মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করবে। রাসূল সা. ইরশাদ করেন, মুসলিম সেই ব্যক্তি, যার মুখ ও হাতের কষ্ট থেকে অপর মুসলিমগণ নিরাপদ থাকে।

সুতরাং বিনোদনের নামে এমন কর্মকাণ্ড কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না, যা নানাভাবে মানুষকে কষ্ট দেয় কিংবা কষ্টের কারণ হয়। আমাদের সমাজে দেখা যায়, বিনোদনের নামে আয়োজিত কর্মসূচিগুলো অনেক সময় মানুষের ইবাদত-বন্দেগি পালনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে, অসুস্থ ব্যক্তিকে অস্তির করে তোলে। মানুষের আরামের ঘুমকে দূর করে দেয়। আবার কোনো কোনো সময় যুব সমাজকে অধ্যয়নের মহান ব্রত থেকে বিচ্যুত করে চরিত্রহীনতার দিকে নিয়ে যায়। এসব কিছু ইসলাম প্রবর্তিত বিনোদন ব্যবস্থার সম্পূর্ণ পরিপন্থি।

বিনোদনের ক্ষেত্রে মিথ্যার আশ্রয় না নেওয়া এ প্রসঙ্গে রাসূল সা. বলেন, ঐ ব্যক্তির জন্য ধ্বংস, যে মানুষকে হাসানোর জন্য এমন কথা বলে, যাতে সে মিত্যার আশ্রয় নিয়েছে। উপর্যুক্ত হাদিস থেকে জানা যায়, মানুষকে আনন্দ বা খুশি করার জন্য মিথ্যা গল্পগুজব বলা বা ঘটনা বর্ণনায় মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া জায়েজ নেই। বিনোদনের যেন এমন না হয়, যাতে সম্পদের অপচয় হয় : পবিত্র কুরআন ও হাদিসের দৃষ্টিভঙ্গি হলো- যে কোনো বৈধ কাজেও যদি কেউ অপ্রয়োজনীয় খরচ করে, তা অপচয় হিসেবে গণ্য হবে। অতএব, যদি অবৈধ বিষয়ে অল্পও খরচ করে, তাহলে তাও অপচয় বলে বিবেচিত হবে। প্রথমটিকে কুরআনের ভাষায় ইসলাফ এবং দ্বিতীয়টিকে তাবজির বলা হয়। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন : আত্মীয়স্বজনকে তার হক দান করো এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকে ও এবং কিছুতেই অপব্যয় করো না। নিশ্চয় অপব্যয়কারীরা শয়তানে ভাই। শয়তান স্বীয় পালনকর্তার প্রতি অতিশয় অকৃতজ্ঞ।

আল কুরআনের উপর্যুক্ত আয়াতের মাধ্যমে আত্মীয়স্বজন, অসহায় ও মুসাফিরদের জন্য ব্যয়ের কথা বলা হয়েছে। মানুষের আয়-রোজগার থেকে এসব জরুরি খাতে ব্যয়ের সীমারেখা যেখানে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে এ কথাই বলা বাহুল্য যে, বিনোদনের মতো মুবাহ একটি বিষয়ে অযথা ব্যয় মোটেই ইসলামে অনুমোদিত হতে পারে না। বিনোদন যেন নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশার মাধ্যম না হয়।

ইসলাম নারী পুরুষের অবাধ সংমিশ্রণকে হারাম ঘোষণা করেছে। বিনোদনের নামে নারী পুরুষের অবাধ মেলামেশার মাধ্যমে অনৈতিক কাজে জড়ানো ইসলাম স্বীকৃত বিনোদন নয়। ইসলামের শিক্ষা হলো, পুরুষ তার নিজস্ব পরিমণ্ডলে বিনোদন উপভোগ করবে। পক্ষান্তরে নারী নিজ নিজ পরিধিতে ইসলামের সীমারেখা মেনে বিনোদন উপভোগ করতে পারবে। আল্লাহ তাআলা বলেন : তোমরা তাঁদের (নবী পত্মীদের) কাছে কিছু চাইলে পর্দার আড়াল থেকে চাইবে।

উপর্যুক্ত আয়াতে বিশেষভাবে নবী সা.-এর পত্মীগণের উল্লেখ থাকলেও এই বিধান সমগ্র উম্মতের জন্য প্রযোজ্য। এ বিধানের সারমর্ম এই যে, নারীদের কাছ থেকে ভিন্ন পুরুষের কোনো ব্যবহারিক বস্তু, পাত্র, বস্ত্র ইত্যাদি নেওয়া জরুরি হয়ে পড়লে সামনে এসে নেবে না; বরং পর্দার অন্তরাল থেকে চাইবে। এ থেকে জানা যায়, নারী পুরুষের সংমিশ্রণ তথা অবাধ মাখামাখি কিংবা পর্দাহীনভাবে উঠাবসা বা চলাফেরা ইসলামে নিষিদ্ধ। কাজেই বিনোদনের নামে ইসলাম এমন কোনো তৎপরতা বা আয়োজনকে সমর্থন দেয় না, যাতে নারী পুরুষের পারস্পরিক পর্দার বিধান লঙ্ঘিত হয়। বিনোদন এমন হবে না, যা ব্যক্তিকে শরিয়ত কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব অথবা সামাজিক দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখে।

ইতঃপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, বিনোদন মানুষের মুখ্য বিষয় নয়; বরং আনন্দময় জীবনের একটি সহায়ক উপায় মাত্র। এজন্য বিনোদনের যে সমস্ত উপায়-উপকরণ মানুষকে স্রষ্টার বন্দেগি থেকে গাফিল করে এবং সামাজিক নির্ধারিত দায়িত্ব পালনের অমনোযোগী করে তোলে। সর্বোপরি যা মানুষকে হারামের দিকে ধাবিত করে- এ রকম বিনোদন ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। বিশিষ্ট গবেষক আবু যুহরা রহ. বলেন : শরিয়ত প্রণেতা যখন বান্দার ওপর কোনো বিষয় পালন করা বাধ্যতামূলক করে দেন, তখন ওই বিষয় পালনের যা মাধ্যম তাও বান্দাহর কাছ থেকে প্রত্যাশিত। পক্ষান্তরে যখন শরিয়তপ্রণেতা কোনো বিষয় থেকে মানুষকে নিষেধ করেন, তখন ওই নিষিদ্ধ বিষয়ের প্রতি যেসব বিষয় ব্যক্তিকে ধাবিত করে তাও হারাম হিসেবে গণ্য।

বিনোদন যেন বিনোদনে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তির জন্য ক্ষতিকর না হয়। বিনোদন চর্চা করতে গিয়ে যদি তা ব্যক্তির শারীরিক, মানসিক ও আর্থিক ক্ষতি সাধনের কারণ হয়, তাহলে এটি ইসলামের দৃষ্টিতে অবৈধ। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন : নিজের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং অপরকে ক্ষতিগ্রস্ত করা ইসলামী নীতি নয়।

বিনোদন যদি মানুষের জীবনে লাভের চেয়ে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। কেননা, ইসলামী শরিয়তের প্রতিষ্ঠিত মূলনীতি হলো : ক্ষতি দূর করা কল্যাণ লাভের ওপর প্রাধান্য পাবে। সুতরাং এ মূলনীতির ভিত্তিতে বলা যায়, বর্তমানে প্রচলিত মুষ্টিযুদ্ধ ও কুস্তিখেলা ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম। কারণ, এসব খেলার বর্তমান পদ্ধতিতে খোলোয়াড়দের অঙ্গহানি, এমনকি মৃত্যুর সম্ভবনাও থাকে।

ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত এক পূণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থার নাম। ইসলামের এ পূর্ণাঙ্গতা রাসূল সা.-এর মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়েছে। ইসলামের প্রতিটি বিধানের পেছনে রয়েছে কিছু হিসত ও লক্ষ্য। সে হিসেবে রাসূল সা.-এর প্রচলিত বিনোদনের ও সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য বিদ্যমান ছিল।

রাসূলুল্লাহ সা.-এর যুগে চিন্তা পেরেশানি দূরীভূত করে মনের মধ্যে প্রফুল্লতা সঞ্চারের উদ্দেশ্যে বিনোদন ব্যবস্থার আয়োজন করা হতো। সাথে সাথে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ইসলাম ও সমাজ সেবায় উপযোগী করে গড়ে তোলাও বিনোদনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল। ইবনু উমার রা.থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা. বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অশ্বগুলোর দৌড় প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করলেন। (প্রতিযোগিতার স্থান ছিল) হাইফা থেকে ছানিয়্যাতুল বিদা পর্যন্ত। অন্যদিকে যে ঘোড়াগুলো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়, সেগুলোর দৌড় প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করলেন ছানিয়্যাতুল বিদা থেকে বনু যুরাইকের মসজিদ পর্যন্ত। ইবনু উমার রা.ও সে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলেন।

রাসূল সা.ও সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসা ও সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ় করা : রাসূল সা.-এর যুগে বিনোদনের একটি বড় লক্ষ্য ছিল, যেন তাঁর ও সাহাবায়ে কেরামের মাঝে পারস্পরিক ভালোবাসার বন্ধন দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়। সালামা ইবলু আকওয়া রা. থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : একবার রাসূলূল্লাহ সা. আসলাম গোত্রের একদল সাহাবির পাশ দিয়ে গেলেন, যারা তিরন্দাজি করছিল। রাসূল সা. তাঁদেরকে বললেন, হে ইসমাইলের বংশধর! তোমরা তিরন্দাজি করো। কেননা, তোমাদের পিতা ছিলেন তিরন্দাজ। তোমরা তির নিক্ষেপ করো, আমি অমুক গোত্রের সাথে আছি। রাসূল সা.-এর কথা বলার পর তির নিক্ষেপ প্রতিযোগিতায় রত একদল লোক তিরন্দাজি থেকে বিরত থাকল। অতঃপর রাসূল সা. তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন- কী হলো, তোমরা তিরন্দাজি করছো না কেন? তাঁরা বললেন, আমরা কীভাবে তিরন্দাজি করব, আপনি যে তাদের সাথে? তখন রাসূল সা. বললেন- তোমরা তির নিক্ষেপ করো, আমি তোমাদের প্রত্যেকের সাথে আছি।

উপর্যুক্ত হাদিস থেকে বোঝা যায়, রাসূল সা. স্বীয় সাহাবায়ে কেরামের সাথে এভাবে মিশতেন, যাতে তাঁদের পারস্পরিক সম্পর্ক মজবুত হয় এবং রাসূল সা.-এর সাথে তাঁদের প্রীতি ও ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। রাসূলূল্লাহ সা.-এর কিছু বিনোদনকর্ম এমন ছিল, যাতে পরিবার পরিজনকে আনন্দ দান ও তাঁদেরকে প্রফুল্ল করা হতো। উম্মুল মুমিনিন আয়িশা রা. থেকে বর্ণিত একটি ঘটনা এ বিষয়ের উজ্জ্বল প্রমাণ। তিনি বলেন : আমরা একবার রাসূল সা.-এর সাথে সফরে ছিলাম। আমরা এক জায়গায় যাত্রা বিরতি করলাম। রাসূল সা. আমাকে বললেন, এসো! আমি তোমার সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা দিই। আয়িশা রা. বলেন, সেই প্রতিযোগিতায় রাসূল সা.-কে পেছনে ফেলে আমি বিজয়ী হই। এ ঘটনার পর অন্য এক সফরে আমি রাসূল সা.-এর সাথে কোনো এক জায়গায় যাত্রাবিরতি করলাম। রাসূল সা. আমাকে বললেন, এসো! তোমার সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা দিই। আয়িশা রা. বলেন, এবারের প্রতিযোগিতায় রাসূল সা. আমার চেয়ে অগ্রগামী হয়ে বিজয়ী হলেন। অতঃপর রাসূল সা. আমার স্বন্ধে (হাত) রেখে বললেন, এ বিজয় (আগের বার) তোমার ওই বিজয়ী হওয়ার বদলায়।

উপর্যুক্ত বর্ণনার মাধ্যমে জানা যায়, রাসূল সা. পরিবার-পরিজনকে আনন্দ দানের জন্য মাঝেমধ্যে দৌড় প্রতিযোগিতাসহ নানা আনন্দদায়ক বিষয়ের অবতারণা করতেন, যা ছিল শরিয়তের সীমারেখার মধ্যেই। উক্ববা ইবনে আমির রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা. ইরশাদ করেন : প্রত্যেক খেলাই বাজে কাজ (অর্থহীন), তবে কেউ যদি তার তির নিয়ে তিরন্দাজি শেখে, তার ঘোড়াকে প্রশিক্ষণ দেয় এবং নিজের স্ত্রীর সাথে খেলাধুলা ও ফুর্তি করে (তাহলে দোষ নেই)। কেননা, এ কাজগুলো হক্ব বা সুসংগত কাজ। মানুষকে শারীরিক ও মানসিকভাবে শক্তিশালী করে গড়ে তোলা।

বিনোদনমূলক কর্মকাণ্ড চর্চার মাধ্যমে মানুষের শারীরিক ফিটনেস বজায় রাখা যায়। মানুষের দৈহিক সক্ষমতা বহাল রাখতে ইসলাম মানুষকে উৎসাহিত করেছে। কারণ, শারীরিক সবলতা ও সুস্থতা ব্যক্তির সামগ্রিক দায়দায়িত্ব পালনে খুবই জরুরি। এ প্রসঙ্গে রাসূল স. ইরশাদ করেন : দুর্বল মুমিনের চেয়ে শক্তিশালী মুমিন অনেক উত্তম এবং আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয়। সবার মধ্যেই কল্যাণ রয়েছে।

রাসূল সা.-এর যুগে প্রচলিত বিনোদনের আরেকটি লক্ষ্য ছিল মানুষকে এ কথা বোঝানো যে, ইসলামের বিধিবিধান উদারনৈতিক ও প্রশস্ত। এতে কোনো সংকীর্ণতা বা সীমালঙ্ঘন নেই। ইসলামে রয়েছে মানুষের প্রতিভা বিকাশের সুন্দর সুযোগ। এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ হলো- রাসূল সা. তাঁর স্ত্রী আয়িশা রা.-এর সাথে খেলাধুলা, তাঁর কন্যা ও মহিলা সাহাবিগণের খেলার সুযোগ করে দেওয়া ইত্যাদি। উম্মুল মুমিনিন আয়িশা রা. বলেন : আমি নবী সা.-এর উপস্থিতিতে ছোট বালিকাদের সাথে পুতুল সাজিয়ে খেলতাম, আমার কিছু সঙ্গিনী ছিল, যারা আমার সাথে খেলত। যখন রাসূল সা. ঘরে প্রবেশ করতেন, তখন তারা দৌড়ে পালাত। রাসূল সা. তাদেরকে ডেকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিতেন। তখন তারা আমার সাথে খেলত। অপর বর্ণনায় এসেছে, হাবশিরা যখন মসজিদে নববীতে তিরন্দাজি করছিল, তখন রাসূল সা. তাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন : যাতে করে ইহুদিরা জানতে পারে যে, আমাদের দ্বীনে প্রশস্ততা আছে আর আমি প্রেরিত হয়েছি তাওহিদি চিন্তা চেতনাপুষ্ট সরল-সহজ উদার দ্বীন সহকারে।

ইসলাম মানুষের স্বভাবজাত চাহিদা ও দাবি পূরণে সুস্থ, সুন্দর ও যৌক্তিক পন্থা উপস্থাপন করেছে। জীবনের কোনো দিক ও বিভাগ ইসলামে উপেক্ষিত নয়। এ হিসেবে আমরা দেখি, ইসলাম মানুষের চিত্ত বিনোদনের জন্য সুস্থ ধারার এমন অনেক পদ্ধতিও বিনোদমূলক কর্মকাণ্ড উপস্থাপন করেছে, যাতে কোনো সীমা লঙ্ঘনও নেই এবং যা দ্বারা মানুষের কোনো মৌলিক কর্ম সম্পাদনে ব্যাঘাতও ঘটে না। নিম্নে বিনোদনের কিছু ধরন তুলে ধরা হলো, যেগুলোর প্রমাণ ও অস্তিত্ব ইসলামের সোনালি যুগে পাওয়া যায়।

মানুষ আনন্দের সময় হাসে। হাসি হচ্ছে একপ্রকার মুখমণ্ডলীয় বহিঃপ্রকাশ, যা সচরাচরভাবে মুখের নমনীয় পেশিকে দু পাশে প্রসারিত করার মাধ্যমে অর্জিত হয়। মুখমণ্ডল ছাড়াও চোখের মধ্যে হাসির বহিঃপ্রকাশ ফুটে উঠতে পারে। হাসি আল্লাহ প্রদত্ত মানুষের প্রতি এক বড় নিয়ামত। হাস্যোজ্জল চেহারায় মানুষের সাথে কথা বলা রাসূল স. এর আদর্শ। মানুষের হাস্যোজ্জ্বল কথা বলে সময় কাটানোর তার স্বাস্থ্য রক্ষায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। তবে তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হলো, হাসি শুধু চিত্ত বিনোদনের মাধ্যম নয়; বরং হাসিমুখে কথা বলা আমাদের প্রিয় নবী সা.-এর সুন্নাতও। তিনি সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলতেন। 

হাদিসে একে অপরের প্রতি মুচকি হাসাকে সাদাকাহ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, তোমার ভাইয়ের প্রতি মুচকি হেসে কথা বলাটা সাদাকাহর সমতুল্য। তবে এক্ষেত্রে ইসলাম সীমালঙ্ঘন করে না। তাই মাত্রাতিরিক্ত হাসাহাসি কিংবা হাসানোকে ইসলাম বরাবরই নিরুৎসাহিত করেছে। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, অধিক হাসি অন্তরকে মেরে ফেলে।

কৌতুক করা মানে আমোদ ও মজা করা, আনন্দ উপভোগ করা। শরিয়তের সীমারেখা অনুসরণ করে কৌতুক করা এবং রসাত্মক কথা বলে মজা করা ইসলামে দূষণীয় নয়। এক্ষেত্রে শরিয়তের নির্দেশনা হলো- কৌতুক সত্য নির্ভর হবে এবং এর মাধ্যমে কারও মানসম্মান হরণ হবে না কিংবা কারও প্রতি বিদ্রুপ প্রকাশ পাবে না। কাজেই বিনোদনের নামে এমন কোনো কৌতুকের আশ্রয় নেওয়া যাবে না, যাতে মিথ্যার সংমিশ্রণ রয়েছে। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, বিশিষ্ট সাহাবি আবু হুরায়রা রা. বলেন, একবার সাহাবিগণ রাসূল সা.-কে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমাদের সাথে তো রসাত্মক কথাবার্তা বলেছেন! তখন তিনি বললেন, আমি তো সত্য কথাই বলছি।

রাসূলুল্লাহ সা. এ উক্তির মাধ্যমে সাহাবা কেরামের মধ্যে প্রচলিত একটি ভুল ধারণার অপনোদন করেছেন। সাহাবিগণ মনে করতেন, হাসি আনন্দ প্রকাশ কিংবা বৈধ উপায়ে মজা করা রাসূল স. এর জন্য মোটেও শোভনীয় নয়। তাই রাসূল সা.-কে কৌতুক করতে দেখে তাঁরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি দেখি আমাদের সাথে কৌতুকপূর্ণ কথাবার্তা বলছেন! রাসূল সা. তাঁদের ভুল ধারণা দূরীকরণার্থে বললেন, আমি তো সত্য কথা ছাড়া অন্য কোনো কথা বলি না।

প্রতিদিন কিছু না কিছু ব্যায়াম বা শরীরচর্চা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। ব্যায়ামের মধ্যে হাঁটা, দৌড়ানো, সাইক্লিং সাঁতারকাটা ইত্যাদি রয়েছে। যারা নিয়মিত পানিতে সাঁতার কাটে, তাদের হার্টবিট ভালো থাকে। সাঁতারকাটা চিত্তবিনোদনের একটি মাধ্যম। এতে শরীরের ব্যায়াম যেমন হয়, তেমনি আনন্দ উপভোগও করা যায়। সাঁতার কাটলে শরীর পুষ্ট হয়। ইসলামের দৃষ্টিতে সাঁতারকাটা মুবাহ অর্থাৎ বৈধ কাজ। ক্ষেত্র বিশেষে এটি মানুষের জন্য জরুরি হয়ে পড়ে। সাইয়িদুনা জাবির রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন- প্রত্যেক বিষয়ই যাতে আল্লাহর জিকর (স্মরণ) নেই তা খেলতামাশা হিসেবে গণ্য হবে, তবে চারটি কাজ এর ব্যতিক্রম। তা হলো- দুটি লক্ষ্যপানের মাঝে ব্যক্তির হাঁটা, ব্যক্তির ঘোড়া লালন পালন ও প্রশিক্ষণ দান, স্বীয় স্ত্রীর সাথে আমোদ-প্রমোদ করা ও সাঁতারকাটা শিক্ষা দেওয়া। সাইয়িদুনা উমার রা. আবু উবাইদা ইবনুল জাররা রা.-এর প্রতি লিখিত এক চিঠিতে বাচ্চাদের সাঁতার শেখানোর নির্দেশ প্রদান করেন।

সুস্থ শরীর ও মনের জন্য কোনো না কোনো ধরনের শরীরচর্চা প্রয়োজন। পরিমিত ব্যায়াম এবং সেই সাথে সুমিত পানাহার হলো শরীর ও মন সতেজ রাখার অন্যতম মাধ্যম। এ ছাড়া অবসর কালক্ষেপণের একটি ভালো উপায় হলো ব্যায়াম করা। আর হাঁটা ও দৌড়ানো হলো একটি সহজ সরল ব্যায়াম। ইসলাম যেহেতু একজন মুমিন ব্যক্তির শারীরিক সুস্থতার প্রতি গুরুত্বারোপ করে, সে কারণে হাঁটা ও দৌড়ানোর বিষয়টিও ইসলামে উপেক্ষিত নয়; বরং এ দুটির মাধ্যমে পারস্পরিক প্রতিযোগিতা করা ইসলামে সুপ্রমাণিত। এর দ্বারা ইসলাম মানুষকে হাঁটা ও দৌড়ানোর প্রতি উৎসাহিত করেছে। কারণ এর মধ্যমে শরীরচর্চা ও বিনোদন উভয়টিই অর্জিত হয়। রাসূল সা.-এর সোনালি যুগে আমরা এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখতে পাই। সাহাবায়ে কেরাম রা.-এর মধ্যেও এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিতেন। উম্মুল মুমিনিন আয়িশা রা. বলেন, তিনি কোনো একসময় সফরে রাসূল সা.-এর সাথে ছিলেন। এ সময় একবার আমি রাসূল সা.-এর সাথে দৌড় প্রতিযোগিতায় জিতে গেলাম। অতঃপর যখন আমার শরীর মোটা হলো তখন তাঁর সাথে প্রতিযোগিতায় তিনি আমার ওপর বিজয়ী হয়ে বললেন, এটা ঐ দিনের প্রতিযোগিতার বদলা।

ঘোড়ায় আরোহণ ও ঘোড়াদৌড় প্রতিযোগিতা আনন্দ আহ্লাদ ও চিত্তবিনোদনের একটি সুন্দর উপায়। এর মাধ্যমে ব্যক্তির শারীরিক ব্যায়াম হয়। ইসলাম এ ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করেছে। আবদুল্লাহ ইবনু ওমর রা. বলেন, নবী করীম সা. ঘোড়াদৌড় প্রতিযোগিতা করেছেন। যেটি জিতেছে, সেটিকে পুরস্কারও দিয়েছেন। সাইয়িদুনা উমার আঞ্চলিক প্রশাসকদের লক্ষ করে বলেন, তোমরা তোমাদের সন্তানদের সাঁতারকাটা ও তিরন্দাজি শিক্ষা দাও। ঘোড়ার পিঠে লম্প দিয়ে উঠে শক্ত হয়ে বসতেও তাদের অভ্যস্ত করো। ঘোড়ার মতো উটের পৃষ্ঠেও মানুষ আরোহণ করে বিনোদন উপভোগ করতে পারে। ইসলামে উটের ওপর আরোহণ এবং এর প্রতিযোগিতা দেওয়া বৈধ। রাসূলুল্লাহ সা. ও তাঁর সাহাবা কেরাম রা. উটের ওপর আরোহণ করেছেন।

মল্লযুদ্ধ বা কুস্তি এবং এর প্রতিযোগিতা বিনোদনের একটি উপায়। এতে রয়েছে সামরিক প্রশিক্ষণ ও অনুশীলন, শারীরিক যোগ্যতা অর্জন, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার দীক্ষা। এক্ষেত্রে শরিয়ত নির্ধারিত নিয়ম-কানুন মেনে চলে একে উপভোগ্য করে তোলা ইসলামে অনুমোদিত। রাসূলুল্লাহ সা. নিজেও প্রসিদ্ধ কুস্তিগির রুকানার সাথে কুস্তি করেছিলেন এবং তাকে ধরাশায়ী করেছিলেন। তবে বর্তমানে প্রচলিত কুস্তি- যা বিভিন্ন টেলিভিন চ্যানেলে সারাক্ষণ প্রদর্শিত হচ্ছে, তা ইসলামে বৈধ নয়। কারণ, এতে শরিয়তের বিধান লঙ্ঘিত হচ্ছে অবলীলায়। যেমন : এতে সতর অনাবৃত রেখে খেলা হয়। অন্যেকে প্রচণ্ড আঘাত করা হয়। এতে কোনো কোনো সময় অঙ্গহানি ঘটে। অনেক সময় অন্ধত্ব বরণও করতে হয়। আবার কখনো তা মৃত্যুরও কারণ হয়ে থাকে।

প্রাণী শিকার বড় উপকারী এবং কল্যাণময়। এ কাজে যেমন সামগ্রী মেলে, উপার্জন হয়, তেমনি তা ব্যায়াম চর্চাও বটে। আরব ও পৃথিবীতে অন্যান্য জাতিগুলোর বিপুল সংখ্যক লোকই এ শিকার কর্মের ওপর নির্ভরশীল হয়ে জীবনযাপন করেছে। এজন্য কুরআন ও হাদিসে এ বিষয়টির ওপর বিশেষ গুরুত্বরাপোক করা হয়েছে। ফিকহ গ্রন্থ রচয়িতাগন নিজ নিজ গ্রন্থেশিকার বিষয়ে স্বতন্ত্র অধ্যায় প্রণয়ন করেছেন। তাঁরা এর মধ্যে কী হালাল ও কী হারাম, এক্ষেত্রে কী ওয়াজিব ও কোনটি মুস্তাহাব, তা বিশদভাবে লিপিবদ্ধ করেছেন। ইসলাম আনন্দ উপভোগ কিংবা বিনোদনের মানসে প্রাণী শিকার বৈধ নয়। এক্ষেত্রে একজন মুসলিম ব্যক্তির কর্তব্য হলো আল্লাহর দেওয়া পবিত্র রিজিক তালাশের নিয়্যাত করে প্রাণী শিকার করা, যাতে তার হালাল উপার্জনের সাথে সাথে আনন্দ এবং চিত্তের বিনোদনও হয়ে যাবে।

দেশ ভ্রমণ করা মানুষ অনেক অজানা জিনিসের সন্ধান পায় এবং বহুরকম অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে। ভ্রমণের মাধ্যমে জীবনের একঘেঁয়েমি ভাব দূর করে মানুষ আনন্দ-উপভোগ করতে পারে। এতে মানুষের জ্ঞানের পরিধি সমৃদ্ধ হয়। মহান আল্লাহর নয়নাভিরাম অপরূপ সৃষ্টিরাজি অবলোকন করে তাঁর অপার শক্তি ও মহানত্ব অনুভব করতে পারে। এভাবে মানুষ মহান রবের শুকরিয়া আদায়ে সচেষ্ট হয়। দেশ ভ্রমণ করার ফলে মানুষের সামনে ভেসে ওঠে যুগে যুগে অভিশপ্ত জাতিগোষ্ঠীর ভয়াবহ পরিণতির নিদর্শাবলি। আল্লাহ তাআলা বলেন : তারা কি এ উদ্দেশ্যে দেশ ভ্রমণ করেনি, যাতে তারা সমঝদার হৃদয় ও শ্রবণশক্তিসম্পন্ন কর্ণের অধিকারী হতে পারে। বস্তুত চক্ষু তো অন্ধ হয় না; কিন্তু অবস্থিত অন্তরই অন্ধ হয়।

চিত্তবিনোদনের একটি অন্যতম উপায় হলো তিরন্দাজি। ঐতিহাসিকভাবে তিরন্দাজি মূলত পশু শিকার ও যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াইয়ের উদ্দেশ্যে উদ্ভাবন করা হয়। ইসলামে তির নিক্ষেপণ শরীয়তসম্মত একটি খেলা ও প্রশিক্ষণমূলক বিষয়। এটা ইসলামের দৃষ্টিতে কেবল খেলা ও হাস্য কৌতুকের ব্যাপারই নয়; বরং তা হলো শক্তি-সামর্থ্য অর্জন, প্রকাশ ও প্রমাণের অন্যতম মাধ্যমও। রাসূল সা. যখন সাহাবা কেরামকে তির নিক্ষেপে মশগুল দেখতেন, তখন তিনি সর্বোতভবে তাঁদের উৎসাহিত করতেন। বলতেন- তোমরা তির নিক্ষেপ করো, আমি তোমাদের সকলেরই সাথে আছি। শারীরিক সবলতা ও সুস্থতা অর্জন ইসলামে একটি কাক্সিক্ষত বিষয়। যে সমস্ত অনুশীলন ও শারীরিক কসরত মানুষকে সবল ও সুস্থ রাখে, তার মধ্যে ভার উত্তোলন ও বহন অন্যতম। এটা একটি বৈধ খেলা ও চিত্তবিনোদনের সুন্দর উপায়ও। ইসলামের সীমারেখা মেনে চলে সীমিত পরিসরে একজন মুমিন ব্যক্তি নিজের জীবন সচল ও সুস্থ রাখার মানসে ভার বহন বা উত্তোলন চর্চা করলে সেটা একদিকে যেমন শারীরিক ব্যায়াম হবে, তেমনিভাবে তা বৈধ একটি বিনোদন ব্যবস্থা হিসেবেও গণ্য হবে।

কবিতা আবৃত্তি এবং তা শ্রবণের মাঝে রয়েছে আনন্দ উপভোগের একপ্রকার উপাদান। এটি মানুষকে আকর্ষণ করে, ঝোঁক প্রবণতা সৃষ্টি করে এবং যে কোনো বিষয়ের প্রতি মোহিত করে তোলে। সমাজ, ব্যক্তি ও সৃষ্টিজগতের নানা বিষয়কে কবি তার মনোবীণায় ঝংকৃত করে কবিতার মাধ্যমে উপস্থাপন করে থাকেন। মানুষ অবসর সময়ে আনন্দ আহ্লাদ প্রকাশের নিমিত্তে সুন্দর অর্থসম্পন্ন ও রুচিশীল কবিতা আবৃত্তি কিংবা কবিতার আসর জমিয়ে বিনোদন উদ্যাপন করতে পারে। কবিতা আবৃত্তি ইসলামসম্মত বিনোদনের একটি বৈধ উপায়ও। রাসূল সা. অর্থপূর্ণ ও ভালো কবিতা রচনায় উৎসাহ দিয়েছেন। রাসূল সা. হযরত হাস্সান ইবনু সাবিত রা.-কে আল্লাহর রাসূলের প্রশংসা ও কাফিরদের নিন্দার জবাবে কবিতা রচনার জন্য উৎসাহিত করেছেন এবং তাঁর জন্য দুআ করেছেন। 

ইসলামী সংগীত বলতে ইসলামের মৌলিক নীতিমালা ও বিধিবিধান অক্ষুণ্ন রেখে দ্বীনি ভাবধারায় রচিত ও বাদ্যযন্ত্র বর্জিত গানকে বোঝানো হয়। এ জাতীয় সংগীত একদিকে মানুষকে সুমহান আদর্শের প্রতি অণুপ্রাণিত করে, অপরদিকে মানুষ অবসর সময়ে এরূপ সংগীত চর্চা বা শ্রবণ করে বিনোদন উপভোগ করতে পারে। প্রচলিত নানান অশ্লীল গান-বাজনা ও বেহায়াপনার বিপরীতে ইসলামী গান ও সংগীত চর্চা জাতীয় বৃহত্তর কল্যাণে খুবই দরকার। বই পড়া চিত্তবিনোদনের একটি অন্যতম উপায়। ভালো বই ব্যক্তির নির্জনতার সাথি। বইপুস্তক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভান্ডার। বই পাঠ যেমন ব্যক্তির মনকে আমোদিত ও প্রফুল্ল করে, তেমনিভাবে জ্ঞানের পরিধিকে করে বিস্তৃত। ব্যক্তিজীবনের সর্বোত্তম সময় হলো অধ্যয়নকাল। বই মানুষের এমন সঙ্গী, যা সাথিকে প্রলোভন দেখায় না, কৌশলের আশ্রয়ও নেয় না। মূলত বই ব্যক্তির একাকিত্বের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এটি হলো কৌতুক, হাসি ঠাট্টা, আনন্দ আহ্লাদ ও নানা রসপূর্ণ বিষয়ে ভরপুর এক অনন্য আধার। এভাবে দেখা যায়, যে কোনো ঘটনার আকর্ষণীয় বিবরণ ব্যক্তিকে আলোড়িত করে। কবিতা কিংবা উপকারী বইপুস্তকের নিবিড় অধ্যয়ন তার হৃদয়-মনে শান্তির আবহ গড়ে তোলে। এজন্য জ্ঞানগর্ভ ও রুচিশীল বই পাঠের মাধ্যমে মানুষ মনের আনন্দ ও আত্মার তৃপ্তি লাভ করতে পারে। তবে যে সমস্ত বই পুস্তক অশ্লীল ও বাজে কথাবার্তায় ভরপুর, তা একজন মুসলিম ব্যক্তির জন্য পাঠ করা বৈধ হতে পারে না। কারণ, এত ব্যক্তির চরিত্র ও নৈতিক মান ভূলুষ্ঠিত হওয়ার যথেষ্ট সম্ভবনা বিদ্যমান।

ইসলাম উপস্থাপিত বিনোদন ব্যবস্থা সত্যিই মানবজাতির জন্য কল্যাণকর এবং ভারসাম্যপূর্ণ। এতে মানুষের স্বভাবজাত চাহিদার প্রতি যেমন দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে, তেমনিভাবে তা প্রণীত হয়েছে নৈতিকতার সীমারেখা অক্ষুণœ রেখে। বিনোদনের প্রচলিত মাধ্যমগুলো যেখানে মানুষকে নানরকম অনৈতিক, অশালীন ও অশোভন কাজের দিকে ধাবিত করে, সেখানে ইসলামী বিনোদনমূলক উপায়গুলো মানুষকে সত্য, সুন্দর, শোভন ও মার্জিত আচার আচরণে অভ্যস্ত করে তোলে। ইসলাম মানুষের চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা গ্রহণ করাকে নিষেধ করে না বটে, কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হলো, তা যেন কোনো মতেই সততা ও বাস্তবতার পরিপন্থি না হয়। বিনোদন হবে মানুষের কাছে গৌণ একটি বিষয়। তা কখনো মানুষের নিকট মুখ্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারবে না। মানুষ তার মৌলিক দায়দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে মাঝেমধ্যে ক্লান্ত, শ্রান্ত ও অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়লে তা কাটিয়ে উঠতে অবরস সময়ে বৈধতার সীমারেখা অটুট রেখে একটু আমোদ-প্রমোদ ও আনন্দ-উল্লাস প্রকাশ করতে পারবে। এতে তার শারীরিক ও মানসিক ভারসাম্য বজায় থাকবে। এ করণেই ইসলাম সুস্থ ধারার বিনোদন ব্যবস্থাকে মুবাহ হিসেবে সাব্যস্ত করেছে। রাসূল সা. ও সাহাবা কেরামের সময়কালে শালীন ও রুচিশীল বিনোদন চর্চার প্রমাণ আমরা উল্লেখ করেছি। রাসূল সা. সাহাবা কেরামের সাথে আনন্দপূর্ণ ও রসাত্মক অথচ সত্য কথা বলতেন। এতে তাঁরা আনন্দবোধ করতেন।

লেখক : শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির