post

ইস্তাম্বুলের বিজয় এবং কিছু কথা

প্রফেসর ড. নাজমুদ্দিন আরবাকান অনুবাদ : বুরহান উদ্দিন

০৮ ডিসেম্বর ২০১৫
আজ নতুন একটি যুগের এবং নতুন একটি বিজয়ের প্রয়োজন। যার জন্য সমগ্র মানবতা আজ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। নতুন একটি শান্তিময় দুনিয়া গঠন করার জন্য আমাদের এই মুসলিম জাতি পুনরায় নেতৃত্ব দেবে। সম্মানিত একটি জাতির এবং সম্মানিত একটি ইতিহাসের উত্তরাধিকারীগণ এই বিজয়ের পতাকাবাহী হিসেবে কাজ করবে। ইস্তাম্বুল বিজয়ের খুব বেশি আগে নয় মাত্র ৫০ বছর পূর্বে ১৪০০ সালের শুরুর দিকে তইমুর লং যখন আনাতলিয়াতে আক্রমণ করছিল তখন সবাই ভেবেছিল যে সব কিছুই ধ্বংস হয়ে গেছে। মুসলিমবিশ্ব সবচেয়ে বড় দুর্দশায় নিপতিত হয়েছিল। কিন্তু মাত্র ৫০ বছরের মধ্যে আমাদের এই জাতি সব কিছুকে সাজিয়ে গুছিয়ে, ইস্তাম্বুলের বিজয়ের মধ্য দিয়ে একটি যুগের অবসান ঘটিয়ে নতুন এক সোনালি যুগের সূচনা করেছিল। তেমনিভাবে আজও একটি নতুন যুগের নতুন একটি বিজয়ের প্রয়োজন। কিন্তু এর জন্য ইস্তাম্বুলের বিজয়কে খুব ভালোভাবে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। আমাদের প্রিয়নবী মানবতার মুক্তির দূত মুহাম্মদ সা: এই হাদিসের মাধ্যমে আমাদেরকে ইস্তাম্বুুল বিজয়ের সুসংবাদ দান করেছিলেন। অর্থাৎ অবশ্য অবশ্যই ইস্তাম্বুল বিজিত হবে। সেই বিজয়ের সেনাপতি কতই না উত্তম সেনাপতি আর সেই বিজয়ের সৈনিকগণ কতই না উত্তম। (মুসনাদে আহমাদ) এই হাদিস থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। কী বলা হয়েছে এই হাদিসে? ‘লাতুফতাহান্নাল কন্সতান্তিনিয়্যাতা’ এই কথা বলা হয়েছে। এখানে লামে তাকিদ এবং নুনে সাকিলা এর দ্বারা বক্তব্যকে জোরালো করা হয়েছে। অর্থাৎ ইস্তাম্বুল অবশ্য অবশ্যই বিজিত হবে। বিজয়ের জন্য মৌলিক শর্ত হলো এমন দৃঢ়বিশ্বাস। অর্থাৎ যদি বিজয় করতে চাই তাহলে অবশ্যই আমাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে। দৃঢ়ভাবে এবং সন্দেহাতীতভাবে আমাদেরকে বিশ্বাস করতে হবে। মুহাম্মদ সা: “অবশ্যই অবশ্যই বিজয় হবে”- এই কথা বলার কারণে মুসলমানগণ এই সম্মানের অংশীদার হওয়ার জন্য বহুবার বিজয়াভিযান পরিচালনা করেছে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাদের মধ্য থেকে এই মহান সম্মান, সুলতান মুহাম্মদ ফাতিহকে নসিব করেছেন। সুলতান মুহাম্মদ ফাতিহ তার বাল্যকাল থেকেই ইস্তাম্বুল বিজয়ের স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে উঠেছিলেন। এই হাদিস শরিফে বর্ণিত এই বিরল সম্মানের অংশীদার হওয়ার জন্য তিনি রাতদিন কঠোর সাধনা করেছিলেন। বলতে গেলে, ইস্তাম্বুুল বিজয়ের জন্য সুলতান ফাতিহ পাগলপারা হয়ে গিয়েছিলেন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ও তাঁকে এই মহান সম্মানের ভাগীদার করেছিলেন। সুতরাং আমরা যে দাওয়াত এবং আন্দোলনকে বিশ্বাস করি সেই আন্দোলনকে তার লক্ষ্যপানে পৌঁছানোর জন্য আমাদেরকেও সেই আন্দোলনের জন্য পাগলপারা হতে হবে। সুলতান মুহাম্মদ ফাতিহ সিংহাসনে সমাসীন হওয়ার সাথে সাথেই দিন রাত কঠোর পরিশ্রম করে ইস্তাম্বুুলের বিজয়ের জন্য সকল প্রকার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছিলেন। দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর শহর ইস্তাম্বুলের বিজয়ের জন্য তিনি সকল কিছুকে সুসংহত করেছিলেন। ২ লাখ সৈন্যের অংশগ্রহণে এক বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করেন। এর পাশাপাশি তিনি প্রচুর পরিমাণে আগুনের গোলা তৈরি করেন। এগুলো ছিল সেই সময়ের সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তি। “ঈমান খাসি ছাগল থেকেও দুধ করতে পারে।” এই কথার ওপর আস্থা রেখে পাহাড়ের ওপর দিয়ে জাহাজ চালিয়েছিলেন। যদি একটি বিজয় চাই তাহলে ঈমান, আত্মবিশ্বাস, আগ্রহের পাশাপাশি সেই সময়ের সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তির অধিকারী হতে হবে এবং সবচেয়ে উন্নত পন্থা গ্রহণ করতে হবে। ১৪৫৪ সালের ৬ এপ্রিল বাইজান্টাইন সম্রাটকে আত্মসমর্পণের আহবান জানান। এটা হলো মুসলমানদের মূলনীতি। রক্তপাত যাতে না হয় এই জন্য তিনি এই আহবান জানিয়েছিলেন। কিন্তু বাইজান্টাইনগণ এটাকে গ্রহণ না করে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সুলতান ফাতিহও আক্রমণের নির্দেশ দান করেন। এর আগে তিনি তার সকল সেনাবাহিনীকে নিয়ে নামাজ আদায় করেন এবং বিজয়ের জন্য মহামহিম সম্রাট আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে দোয়া করেন। দোয়া করার সময় অসহায় এক বান্দার মতো আকুতি মিনতি করে দোয়া করেন। দোয়া করার পর সেনাবাহিনীকে আক্রমণের নির্দেশ দিয়ে, তিনি তার ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করার সময় পাহাড়সমূহকে কাঁপিয়ে দিচ্ছেন এমন এক নরশার্দূলের ন্যায় তাঁকে দেখা যাচ্ছিল। ইয়া আল্লাহ! কত বিশাল এক যুদ্ধ, কত বড় উদ্যম, কত মহান এক প্রয়াস। ২৯ মে ফজরের সময় প্রাচীরগুলোকে ভেঙে ফেলা হয়েছিল। ইস্তাম্বুুলের বিজয় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। বাইজান্টাইনের প্রাচীরে সর্বপ্রথম ইসলামের পতাকা উত্তোলন করার ভাগ্য উলুবাতলি হাসানের হয়েছিল। সুলতান মুহাম্মদ ফাতিহর সেনাবাহিনী ভেঙে ফেলা প্রাচীরের ভেতর দিয়ে তীব্রতার সাথে স্রোতের মত ইস্তাম্বুলে প্রবেশ করেছিল। এইভাবে একটি যুগের পতন হয়ে অন্য যুগের সূচনা হয়েছিল। ইস্তাম্বুল বিজয় হওয়ার পর বিজয়ী সেনাপতি সুলতান মুহাম্মদ ফাতিহ আল্লাহ তালার শুকরিয়া আদায় করার জন্য আয়াসুফিয়াকে (ঐধমরধঝঁভরুধ) মসজিদে রূপান্তরিত করেন এবং ২ রাকাত শুকরানা নামাজ আদায় করেন। এর পর তিনি হজরত আইয়ুব আল আনসারির কবর জিয়ারত করতে যান। এইভাবে সুলতান মুহাম্মদ ফাতিহ এত বড় বিজয়ের পর অত্যন্ত বিনয়ী হয়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের শুকরিয়া জ্ঞাপনের এক অনুপম দৃষ্টান্ত পেশ করেন। আজ আমরা মুসলিম হিসেবে, প্রাচীরের সামনে অবস্থানকারী সেনাবাহিনীর মত। আমরা আজ নতুন এক বিজয়ের স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছি। আগামী দিনের বিজয়ের জন্য নতুন উদ্দামে লড়ে যাচ্ছি। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি তিনি আমাদেরকে এমন মর্যাদাসম্পন্ন একটি জাতির উত্তরাধিকারী করেছেন। ইস্তাম্বুলের বিজয় থেকে আমরা যে সকল শিক্ষা নিতে পারি এর মধ্যে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো হজরত আইয়ুব আল আনসারি রা:। জিহাদের ঘোষণা শুনার সাথে সাথে হজরত আইয়ুব আল আনসারি রা:, কুরআনে কারিম বন্ধ করে সাথে সাথে উঠে দাঁড়ান। তার সন্তানগণ তাঁকে এই বলে বাধা দেন, “বাবা তুমি বস, বসে বসে কুরআন পড়, নিজেকে বিপদের মুখে ঠেলে দিও না।” উত্তরে তিনি তাদেরকে বলেছিলেন, “হে আমার প্রিয় সন্তানরা, তোমরা আমাকে বলছ তুমি বস বসে কুরআন পড়। কিন্তু আমি যখন কুরআন পড়ি, কুরআন তখন আমাকে বলে উঠে দাঁড়াও জিহাদ কর। এই মহান সাহাবী ৯০ বছর বয়সে ইস্তাম্বুলের প্রাচীরের কাছে আসেন। তার বয়সের কারণে তার নিরাপত্তার জন্য সৈন্যগণ তাঁকে তাদের পেছনে রাখতে চেয়েছে কিন্তু তারা তাঁকে তা করতে পারেনি। যুদ্ধের সেই কঠিন মুহূর্তে আগুন এবং তীরের নিচে দাঁড়িয়ে তিনি সৈন্যদেরকে “দুনিয়াবি কাজে মশগুল হয়ে জিহাদ থেকে দূরে থেকে নিজেদেরকে হুমকির মুখে ঠেলে দিও না” এই আয়াতটি স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন এবং তরুণ সৈন্যদেরকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিয়েছিলেন। এত ত্যাগ তিতিক্ষার পর মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর বাইজান্টাইনের প্রাচীরের পাদদেশে তাঁকে শাহাদাত নসিব করেন। “ইসলাম কেমন একটি দ্বীন?” এই বিষয়ে যদি কেহ উৎসাহ বোধ করেন সে যেন ৯০ বছর বয়সে ইস্তাম্বুল বিজয়ের উদ্দেশ্যে যুদ্ধ করতে আসা হযরত আইয়ুব আল আনসারি রা:-এর দিকে তাকায়। ইসলামের মূল রূপ হলো এটা। দ্বীন ইসলাম হলো, জিহাদের দ্বীন। এই জন্য আপনারা শুধুমাত্র নামাজ পড়বেন, তাসবিহ তাহলিল পাঠ করবেন এই কথা বলা হলো মূর্খতা। যদি তাই হতো এই মহান সাহাবী, রাসূল সা: মদিনায় হিযরত করার পর যার ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তিনি মদিনা থেকে পৃথক না হয়ে সেখানে সবচেয়ে সুন্দর পদ্ধতিতে নামাজ পড়তেন এবং তাসবিহ তাহলিলে মশগুল থাকতেন। ইস্তাম্বুুলের বিজয়ের জন্য হযরত আকশেমসেদ্দিনের ভূমিকাও অনেক বিশাল। তাকেও আমাদেরকে আমাদের আদর্শ হিসেবে স্মরণ করতে হবে। তিনি ছিলেন একজন বড় আলেম। ইস্তাম্বুুলের বিজয়াভিযানে তিনি আমাদের জন্য এক অনুপম দৃষ্টান্ত। ফাতিহর একজন উস্তাদ হিসেবে, প্রতিটি গুহায় গিয়ে গিয়ে তিনি সৈন্যদেরকে উৎসাহ উদ্দীপনা জুগিয়েছিলেন। সুলতান মুহাম্মদ ফাতিহ যখন ইস্তাম্বুল বিজয় করেছিলেন তখন তিনি ছিলেন ২১ বছরের একজন টগবগে যুবক। ইস্তাম্বুলের বিজয় যেমন অনেক বড় এবং মহান একটি ব্যাপার ঠিক তেমনিভাবে যারা ২১ বছর বয়সে এই বিজয়ের জন্য ঈমানের বলে বলীয়ান কাজ করেছেন তারাও তেমন মহান এবং মর্যাদাবান। একটি দেশের আসল শক্তি ট্যাংক, ক্ষেপণাস্ত্র এবং অর্থবিত্ত নয়। বরং একটি দেশের আসল শক্তি হলো ঈমানের বলে বলীয়ান যুবসমাজ।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির