post

এই সংগ্রাম এই শ্লোগান

ইয়াসিন মাহমুদ

১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

জীবনের বিভিন্ন প্রান্তে সময় তার নিজস্ব নিয়মে আমাদেরকে নিয়ে যায় অমোঘ বাস্তবতার মধ্য দিয়ে। যাররূপ ও রংবদলায় ক্ষণে ক্ষণে। আর জীবনাভিধানে সংকট ও সময় যেন পরস্পর সম্পূরক শব্দ। কিন্তু সংকট সঙ্কুল এই সময়ের দৈর্ঘ্য লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকলে কতটা আর এই সংকটের সাথে সহাবস্থানে কাটিয়ে দেওয়া যায় ? আজকে আমরা যেসময়  অতিক্রম করছি তা বড়ই দুঃসহ আর দুর্বিষহ ক্রান্তিকাল। পুরো জাতির উপর চেপে বসেছে এক জগদ্দল পাথর। বুকে চাপা দেওয়া পাথরকে বয়ে নিয়ে পার করতে হয় সারা দিনমান। ধৈর্য ও সহ্যেরও তো একটা সীমানা ও পরিধি থাকে। কত দিন কত রাত পার করা যায় এভাবে? উপায় বলুন। নতুন কৌশল। উপায় একটাই-পরিবর্তন। কিভাবে পরিবর্তন। জাগরণ; মানুষ ও মানবতার জাগরণ-গণজাগরণ। একটি গণজাগরণের জন্য অপেক্ষা আর কতকালের? পাঞ্জেরী? রাত পোহাবার কত দেরি? কাক্সিক্ষত সেই গণজাগরণের আগ্নেয়গিরি ফুঁসে উঠবে কার ডাকে? সাধারণ মানুষ নাকি নেতৃবৃন্দ। নিশ্চয়ই-নেতৃবৃন্দ। সময় গড়িয়েছে বহু সময়। বলা যায়- জাগরণের জনরোষ এখন দ্বিপ্রহরের গনগনে রোদ যেন। তারপরও কি আমরা জাগবো না? সন্ধ্যার লালিমাভাও কিন্তু অস্তমিত হতে চলেছে। একটি সুপ্রভাত অথবা গাঢ় অন্ধকার রাত্রি অপেক্ষা করছে আমাদের ভাগ্যে। 

আমরা নিশ্চয় সকালকে ভালোবাসি। সকালের অপেক্ষায় থাকি। সেই সকালের প্রত্যাশায় শুধু ঘুমের ঘোরে বেলার পর বেলা কাটিয়ে দিবো? বরং সকালকে ডেকে আনতে হবে প্রয়োজনে। আমাদের দৃঢ়তা ও আমাদের প্রত্যয়ে আসবে নতুন ভোর। শুভ সকাল। প্রত্যাশার বাংলাদেশ। আজ নয় কাল আসবে রে সেদিন। উড়বে পতাকা, বাজবে সুখের বীণ। কেটে যাবে সকল আঁধার। কবির কলম থেকে কালির অক্ষরে নেমে আসে জাগরণের আহ্বান, কবি মতিউর রহমান মল্লিক লেখেন- 

এই সংগ্রাম এই শ্লোগান

আজ মুক্তির জন্যে সংগ্রাম

জনতার দাবি নিয়ে সত্যের পথ ধরে

মুক্তির জন্যে সংগ্রাম।

দুই.

দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝি পথ

ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মত?

কে আছো জোয়ান, হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যৎ।

এ তুফান ভারী, দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।

- কাজী নজরুল ইসলাম।

সময়ের পালাবদলে নিজের ছায়াও নাকি অচেনা লাগে, বিরোধীতা করে বসে, বেসামাল হয়, উল্টোপথে চলে। তবে ছায়াসঙ্গীকে তাড়ানো যায় না; ছায়াকে আপন করে নিতে হয়। ছায়ার মতো যাপনের সময়ও মাঝে মাঝে অনুকূলে থাকে না। প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে ফিরতে হয় আপন নীড়ে; গন্তব্যে। তুফান ছোটে বলে তাকে সমুদ্র বলে। জোয়ার-ভাটার খেলা তো এটাই। জোয়ার মানে ছুটে চলা সীমানার পানে। ভাটা মানে গতিহীন, থেমে যাওয়ার আয়োজন-থেমে যাওয়া জীবনের সাথে বেমানান। গতিই জীবন আর তুফান সীমাহীন গতি। জোয়ারের রয়েছে স্থিতিশীলতা। তুফান মানে ঝুঁকি। অনিশ্চয়তা। এই অনিশ্চয়তার মাঝে জীবনের মানে অনুসন্ধান করার ভেতরেই আছে স্বার্থকতা। কাক্সিক্ষত মানজিলে পৌঁছানোই কেবল সফলতা।

তিন.

স্বাধীনতা, স্বাধীকার, সমানধিকার, ন্যায়বিচার এমনিই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় না বরংসংগ্রামের তৎপরতায় তা আদায় করে নিতে হয়। আর তা না হলে হতে হয় বঞ্চিত; আহত হৃদয় নিয়ে বিলাপ ছাড়া কিছুই জোটে না।জীবন সমস্তই একটি সংগ্রাম। একটি আন্দোলনের নাম। আর এখানে বিজয় অর্জনই কেবল স্থায়ী করবে আসল আবাস, আপন ঠিকানা,কাক্সিক্ষত উত্তরাধিকার। কিন্তু পিছিয়ে পড়লে; থমকে গেলে পরাজয়ই কেবল ভাগ্য। লাঞ্ছনা ও অভিসম্পাত নিয়তি। আর বিজয়ের লক্ষে ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস ও বুকে হিম্মত থাকলে বিজয় অবশ্যসম্ভাবী। ম্যালকম এক্স তার ঐতিহাসিক ভাষণে বলেন- এই সংগ্রাম হয় ব্যালট, না হয় বুলেট অর্জিত হবে। হয় স্বাধীনতা অর্জিত হবে, না হয় মৃত্যু। তুমি যদি এর জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত না হও তবে তোমার অভিধানে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি ব্যবহার করবে না।

চার.

সংগ্রাম মুখর এই জীবনের রাজপথে নিরাশা যেমন চারিদিক থেকে জেঁকে ধরে তেমনি আঁধারের পর্দা ভেদ করে আলোকরশ্মি জানান দেয় সময় ও সুযোগ বুঝে। সম্প্রতি মুসলিম দুনিয়ার জন্য আশার বাণী, সফলতার সোনালী আলোর প্রকাশ হয়ে এলেন করাচী শহরের নব নির্বাচিত মেয়র ইঞ্জিনিয়ার হাফিয নাঈম উর রহমান। তিনি মেয়র নির্বাচিত হবার পর সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন-আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহু আকবার। আমরা এই শহরে অনেক লাশ বহন করেছি। কিন্তু আল্লাহর উপর ভরসা করে এই অন্ধকারেও আমরা আলোর চেরাগ জ্বালিয়েছিলাম। আমাদের তরুণেরা, আমাদের বৃদ্ধরা, আমাদের ছাত্ররা, আমাদের মা-বোনেরা নিজেদের রক্ত দিয়ে এই শহরে আলোর চেরাগ জ্বালিয়েছিলেন। আমার ঐ সময়ের কথাও মনে আছে, যখন শুধু মাত্র দারসুল কুরআন অনুষ্ঠানে যোগ দেবার অভিযোগে অপরাধী হিসেবে তুলে নিয়ে যাওয়া হতো। আমার ঐ সময়ের কথাও মনে আছে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে দারসুল কুরআন বন্ধ করার ঘোষণা দেওয়া হতো। আমার ঐ সময়ের কথা মনে আছে, এই শহরে মহিলাদের বোরকা ধরে টানা হতো। আমার ঐ সময়ের কথা মনে আছে, কোন জায়গায় নির্বাচনে দাঁড়ানো মানেই নিজের মৃত্যুকে ডেকে নিয়ে আসার শামিল ছিলো। আমার ঐ সময়ের কথা মনে আছে, ছাত্রজীবনে প্রতিদিন নফল নামাজ পড়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে হতো। মনে মনে ভাবতাম, আজই হয়তো আমার জীবনের শেষ দিন। আলহামদুলিল্লাহ। এই সময়গুলো আমরা মোকাবেলা করে এসেছি। নিশ্চয় তা কেবলই মহান রবের একান্ত রহমত ও দয়া ব্যতিত অন্য কিছু নয়। আর তিনি আমাদের শক্তি দিয়েছেন বলে আমরা ময়দানে টিকেছিলাম। অনেক দিন পর্যন্ত অনিশ্চিত একটা লড়াই ছিলো। আজকের এই বিজয়ে সবকিছুরই মূলে আল্লাহর খাস রহমত।

পাঁচ.

কী সুখে ঘুমাও তুমি

কেটে যায় দিন

খাতায় রয়েছে জমে

কত শত ঋণ।

-কবি গোলাম মোহাম্মদ

সময় চলে যাচ্ছে তার নিজস্ব গতিতে। সে কারো জন্যে এক মুহূর্তও অপেক্ষা করে না। আর এটাই সময়ের ধর্ম ও ধরন।পিছনে ফিরে তাকালে দেখতে পাবো দূর নীলিমায় দূর সীমানায় চলে এসেছি। অনেক পথ হাঁটতে হাঁটতে আমরা শ্রান্ত- ক্লান্ত। আমরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে যেমন আমাদের যাত্রাপথের সীমানা চোখের দৃষ্টিতে ধরা পড়ছে না। আবার এটাও ঠিক আমরা এখনো গন্তব্যের কিনারে ভিড়তে পারিনি। কিন্তু কেবলই আমরা হেঁটে চলেছি। এভাবে আর কতদূর আমরা হেঁটেই যাবো। আমরা যেসময় পার করে এসেছি-এ এক লম্বা সময়। দীর্ঘসফর তো বটে। আর এই দীর্ঘ পরিক্রমায় আমাদের হিসেবের খাতায় জমে গেছে অনেক ঋণ। এ ঋণ অপরিমেয় ও অপরিশোধিত রয়ে গেলো কেবলই। কিন্তু না, এ ঋণ শোধিবার সময় এখনই। এ ঋণ না শোধিলে আগামীর প্রজন্ম আমাদেরকে ক্ষমা করবে না। এ ঋণ শোধিবার দায় এখন আবশ্যকীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য। এখানে ব্যর্থ হলে তা হবে বড়ই বেদনার।  যে দায় এড়ানো কিংবা না দেখার ভান করা হবে চরম বোকামী। বরং নতুনভাবে আন্দোলিত হওয়া। সমাজ, দেশ ও জনতাকে জাগিয়ে তোলাই একমাত্র মুক্তির পথ।

ছয়.

আমাদের সামনে বাধার পাহাড়। সামনে টলমল রক্ত নদী বহমান। আবার মুক্তির মঞ্জিলও খুব কাছাকাছি। নিকটতম অতীতের মতো। তবে এ মুক্তি ছিনিয়ে আনতে কেবলই প্রয়োজন দুঃসাহস। ইস্পাতদৃঢ় হিম্মত। 

দুর্যোগ ও দুর্ভোগ যেন জীবনের আয়নায় পরিচিত প্রতিবিম্ব। আমাদের ইচ্ছায়- অনিচ্ছায় এই শব্দ দুটি জীবনের পথ খুঁজে দেয়। আবার দিশেহারা করে তোলে। বুকের ভেতর তোলপাড় করে দহন দুপুর। এ সময়ে আমরা অনেকে নিশ্চুপ হয়ে যাই। নিজেকে আড়াল করে রাখি। পালাই পালাই খেলি। অবশ্য বিপ্লবীরা এ সময়কে নিয়ে নিত্য খেলা করে। আনন্দও পায়। খারাপ সময়কে থোড়াই কেয়ার করে এগিয়ে চলেন। এ সময় যেমন নিজেকে সতেজ রাখেন। সমাজ ও সমাজের মানুষকে সতেজ রাখতে মুখ্য ভূমিকা রাখেন।যেখানে জীবন নিয়ে টানাটানি; জীবনের খেলাঘরে আপন মানুষ পর হয়ে যায় সেসময়ে কেবলই একজন বীর মুজাহিদের মুখে দেখি বিপ্লবের হাসি। এ হাসি স্বপ্নের। এ হাসি এগিয়ে যাবার প্রত্যয়ের। দুঃসময় যেমন দুমড়ে- মুচড়ে ফেলে চারিদিক থেকে। আবার পথও দেখায়। আলোর পথ। সীরাত মুস্তাকিমের। জীবনের কাছে হেরে যাবার সময়গুলোতেও জে¦লে দিতে হয় আলোর পিদিম। হীরকজ্যোতি। তাই দুর্যোগে শুধু মুখ লুকিয়ে বসে থাকার নয় বরং ঐক্যবদ্ধভাবে জেগে ওঠারও সময়। কবি মতিউর রহমান মল্লিকও সেই আহ্বান জানিয়েছেন এভাবে-

 এই দুর্যোগে এই দুর্ভোগে আজ

 জাগতেই হবে, জাগতেই হবে তোমাকে

 জীবনের মরুবিয়াবানে

প্রাণ আনতে হবে, আনতেই হবে তোমাকে।

লেখক : কবি ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির