post

ঐক্য ইসলামের অলঙ্কার

আবু মুমশাদ

০৮ জুন ২০২৩

মানুষের মুক্তির জন্য ঐক্য আবশ্যক। বিচ্ছিন্নতা একটি জাতিকে ধ্বংস করে দিতে পারে, আবার ঐক্য সেই জাতিকেই পৌঁছে দিতে পারে সমৃদ্ধির সোনালি শিখরে। ঐক্য গঠনের জন্য সবচেয়ে উন্নতমানের নির্দেশিকা আমাদের দান করেছেন প্রতিপালক নিজেই। আমরা কিভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকবো সে বিষয়ে পবিত্র কুরআনুল কারিমে আল্লাহ ইরশাদ করেন, “আর তোমরা একযোগে আল্লাহর রজ্জু সুদৃঢ়রূপে ধারণ কর এবং বিভক্ত হয়ে যেয়ো না এবং তোমাদের প্রতি আল্লাহর যে দান রয়েছে তা স্মরণ কর। যখন তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে তখন তিনিই তোমাদের অন্তঃকরণে প্রীতি স্থাপন করেছিলেন, অতঃপর তোমরা তাঁরই অনুগ্রহে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হলে এবং তোমরা অনল-কুণ্ডের ধারে ছিলে, অনন্তর তিনিই তোমাদের তা থেকে উদ্ধার করেছেন; এরূপে আল্লাহ তোমাদের জন্য স্বীয় নির্দেশনাবলি ব্যক্ত করেন, যেন তোমরা সুপথপ্রাপ্ত হও। (সূরা আলে ইমরান : ১০৩)। এভাবে আমাদের জীবনকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করতে ইসলামের ভূমিকা অনন্য। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে রাসূল সা.-ই হচ্ছে মানুষের জন্য একমাত্র নির্ভুল দর্শন ও জীবনাদর্শ। আল্লাহ পৃথিবীর বুকে এ জীবনাদর্শ প্রেরণ করেছেন এটিকে প্রবর্তিত ও বিজয়ী করতে এবং বিজয়ী রাখতে। আর এ কাজ করার জন্য মহান আল্লাহ মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর সংগঠিত হওয়া তথা একতা অনিবার্য করে দিয়েছেন। মানবজাতিকে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যেই সৃষ্টি করা হয়েছে। নামাজ রোজার মতো এই কাজটিও যে একটি বড় ইবাদত তা আমরা অনেক সময় বুঝতে ভুল করি। অন্যদিকে ইবলিস তো আছেই মানবজাতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে জাহান্নামে পৌঁছানোর জন্য। আর সে আল্লাহর উপর অহঙ্কার করে এই চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করেছে। সূরা আরাফের ১৭ নং আয়াতে শয়তানের এই চ্যালেঞ্জটি উল্লেখ করা হয়েছে- ‘তারপর অবশ্যই তাদের নিকট উপস্থিত হব, তাদের সামনে থেকে ও তাদের পেছন থেকে এবং তাদের ডান দিক থেকে ও তাদের বাম দিক থেকে। আর আপনি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবেন না।’ আল্লাহর বিধান, নিয়মশৃঙ্খলা তথা ইসলাম মেনে আমরা শয়তানের চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করবো- এটা প্রতিটি মানুষের ভিশন হওয়া উচিত। 

মানুষকে সত্য পথ থেকে বিভক্তি ও বিচ্ছিন্নতার পথে ধাবিত করে শয়তান প্রতিনিয়ত কিভাবে কাজ করে তার একটি চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন মানবতার বন্ধু মুহাম্মাদ সা.। হজরত আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ রা. বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ সা. আমাদের সামনে একটি সরল রেখা টানলেন। অতঃপর এর ডানে ও বায়ে আরও কয়েকটি রেখা টেনে বললেন, ডান-বামের এসব রেখা শয়তানের আবিষ্কৃত পথ। এর প্রত্যেকটিতে একটি করে শয়তান নিয়োজিত রয়েছে। সে মানুষকে ওই পথগুলোতে চলার উপদেশ দেয়। অতঃপর তিনি মধ্যবর্তী সরলরেখার দিকে ইশারা করে বললেন, ‘আর এটা আমার সরলপথ, সুতরাং তোমরা এরই অনুসরণ কর।’ (মুসনাদে আহমাদ-১/৪৩৫)। এ দৃষ্টান্তে সরলপথ বলে নবী-রাসূলদের অভিন্ন দ্বীনের পথই বোঝানো হয়েছে। এতে শাখা-প্রশাখা বের করা ও বিভেদ সৃষ্টি করা হারাম ও শয়তানের কাজ। এ সম্পর্কে হাদিসে কঠোর নিষেধাজ্ঞা বর্ণিত হয়েছে। রাসূল সা. আরও ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলিমদের জামায়াত (সংঘবদ্ধ জীবনব্যবস্থা) থেকে অর্ধ হাত পরিমাণও দূরে সরে পড়ে, সে নিজেই নিজের কাঁধ থেকে ইসলামের বন্ধন সরিয়ে দিল।’ (আবু দাউদ-৪৭৬০)।

ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারিনি বলেই আমাদের সমাজ আজ বিপথে চলছে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, প্রতারণা, সুদ, ঘুষ, চোগলখোরি, জুয়া, মাদক, গুম, খুন, যৌতুক, নারী নির্যাতন, ইভটিজিং, খাদ্যে ভেজাল, দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িক উসকানি, ব্যাংক ডাকাতি, বাহুবল দেখানো, জোর-জবরদস্তি, খামখেয়ালি, কালোবাজারি, সংখ্যালঘু মানুষের ঘরবাড়ি জমি-জমা বাগান ইত্যাদি জবর দখলসহ হেন কাজ নেই যা আমাদের সমাজ, দেশ ও জাতির ঘাড়ে চাপেনি। চলছে মিথ্যার প্রতিযোগিতা, ছিনতাই, রাহাজানি। আমরা এখন নানাবিধ নৈতিক অবক্ষয়ের স্বর্ণযুগে অবস্থান করছি। এ অবস্থায় আমাদের করণীয় নির্ধারণ করতে হবে পবিত্র কুরআন থেকেই। মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, “বিশ্বাসীদের মধ্যে যারা অক্ষম নয় অথচ ঘরে বসে থাকে তারা এবং যারা আল্লাহর পথে স্বীয় ধন-প্রাণ দ্বারা জিহাদ করে, তারা সমান নয়। যারা স্বীয় ধন-প্রাণ দ্বারা জিহাদ করে, আল্লাহ তাদেরকে তাদের উপর মর্যাদা দিয়েছেন যারা ঘরে বসে থাকে; আল্লাহ সকলকেই কল্যাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আর যারা ঘরে বসে থাকে তাদের উপর, যারা জিহাদ করে তাদেরকে আল্লাহ মহা পুরস্কার দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন।” (সূরা নিসা : ৯৫-৯৬)। তাই ঈমানদার ব্যক্তি হতাশ হয়ে বসে থাকতে পারে না। উম্মাহর ঐক্য গঠন এবং আল্লাহর জমিনে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে লড়ে যায় আজীবন।

সমাজের অনিষ্ট সাধনে ব্যস্ত কিছু লোক সারাটি জীবন বদমায়েশি কায়দায় অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে। জনগণের রক্ত-ঘামের বিনিময়ে অর্জিত সম্পদকে অবৈধভাবে জবরদখল করে। এদের কেউ কেউ সময়ের বিবর্তনে নিজেদের খোলস পাল্টায়। হয়তোবা হজ্জ আদায় করে, জুব্বা পাগড়ি পরে, সাদাদাড়ি-সাদাজুব্বা পরিচ্ছদে মসজিদের কর্তা হয়ে বসে। বনে যান সমাজের মোড়লেও। কিন্তু আল্লাহর জমিনে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠার ঘোর বিরোধিতা থেকে নিজেদের মুক্ত করেন না এরা। এদের সারা জীবনের অপকর্মের দায় মুক্তির জন্য ধর্মব্যবসায়ীদের কিছু টাকা পয়সা দিয়ে, মসজিদ, মাদরাসা, ইয়াতিমখানা, লিল্লাহ বোর্ডিং, খানকা, দরবার, আস্তানা, মাহফিল, অন্যকে হজ্জ করানো, দান-অনুদানে অগ্রগামী হিসাবে নিজেদের প্রদর্শন করে থাকে। এই মানুষগুলোই যখন রাস্তাঘাটে চলে তখন তারা চলার সুন্নত মেনে ডান দিক দিয়ে যেতে পারছেন না। তার গাড়িখানি নিশ্চয়ই বামদিক ধরে চলে। যখন সুদের ভার জাতির ঘাড়ে, আবেদ বান্দার টুপি-জামা-খাবার-জায়নামাজের ভিতর সুদ, জনপদের সর্বত্র ব্যভিচার মহামারীর মতই চলছে, পর্দা যখন এ জনপদে অচল, বিদেশী সংস্কৃতি জাতির ঘাড়ে চেপে আছে, শিরকের জগদ্বল পাথর পিষ্ট করছে ঈমান, পারিবারিক উচ্ছৃঙ্খলায় অবাধ্য সন্তানের কাছে পিতা অসহায়, নারীগণ অনেকেই বিজাতীয় কালচারে সোচ্চার হচ্ছে, জারজ সন্তানের ভিড়ে সভ্য মানুষ বিব্রত, হারাম ছাড়া উপার্জন অচল, জনজীবনে সর্বত্র আল্লাহ ও নবী সা. মনে হয় নির্বাসিত তখন মুসলমানদেরকে কুরআন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ না হয়ে বসে থাকার সময় কোথায়? 


আজ জনপদে যত প্রকারের অনাচার হচ্ছে তা কোনো নিরীহ ভদ্রলোক সৃষ্টি করে না। কারা করে? যারা প্রভাবশালী অবৈধ টাকায় বিত্তবান, পেশিশক্তির ছত্রছায়ায় থাকে। সকল অনাচার তারাই করে। কেননা তাদের থানা পুলিশ, আইন-আদালত, বিচার, ক্ষতি পূরণের কোনো ঝক্কিঝামেলায় পড়তে হয় না।

আবার অনাচারের কর্তারাই এবং আমলা শ্রেণির লোকেরা হারাম-হালাল মিশ্রিত অবৈধ কাঁচা টাকার ব্যাংক ব্যালান্স, গাড়ি, বাড়ি, ডিপোজিট, অবসর জীবনে পেনশন, বাড়ি ভাড়া, ইন্ডাস্ট্রি, ব্যবসা, অর্থ-সম্পদের মালিক। এরা আবার বিভিন্ন প্রকল্প দেউলিয়া হওয়ার কথা বলে দেশ ও জাতির আর্থিক মেরুদণ্ড ভেঙে গিলে খায়। ব্যাংক থেকে সুদের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার জোয়ারে ডুবন্ত ব্যক্তি ঋণখেলাপিরাই জীবনের অকর্মা সময় কোনো কোনো বুযুর্গের আসরে মারেফতের সবক নিয়ে রকেট ছাড়াই সাত আসমান ভ্রমণ করে আসেন। ক্ষেত্রবিশেষে আবার মাসয়ালা-মাসায়েলের ফয়সালা দিয়ে বসেন। কেননা কোনো কোনো মৌলভী মুফতিগণের বেতনের টাকা তাদের হাতে। হুজুর ব্যক্তি কথা বলেন কর্তাব্যক্তির মর্জি মেজাজ বুঝে। কারণ তাদের জাকাত-ফিতরা, দান-অনুদান, টাকা-পয়সা ওদের হাতেই। ইমাম সাহেবগণ আমলে সালেহ, আমরু বিল মারুফ নাহি আনিল মুনকার-এর প্রসঙ্গে শরিয়তের দিকনির্দেশনা কুরআন হাদিস থেকে বলতে পারছেন না। অনাচারের শরয়ী বিচারের প্রসঙ্গ বলতে পারছেন না। অপসংস্কৃতির হামলার মোকাবেলায় অনাচারের বিচার হচ্ছে না। 

আজ গোটা সমাজব্যবস্থা সাধারণ মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। স্বভাব চোরের কারণে জাতীয় কর্ম বাজেট বাস্তবায়ন হচ্ছে না। জাতীয় বাজেটের বিরাট অংশ চোরের পেটে যায়। হারাম অর্জিত বিত্তবান লোকেরাই মিহি ধুতির পাঞ্জাবি পরে হাজী সাহেব, পীরের মুরিদ, তাবলিগে চিল্লা দিয়ে সৎ সাধু সাজে। আবার ইসলামী বিধান শরিয়তের তারাই বিরোধিতা, প্রতিবন্ধকতা, দুশমনি করে। ঐসব লোকের টাকায় শাসক শ্রেণি ক্ষমতায় বসে। আর এক শ্রেণি বুজুর্গ মানুষের পেটও প্রকল্প, মাদ্রাসা, মসজিদ, খানকা, লিল্লাবোর্ডিং, ইয়াতিম খানা ইত্যাদি চলে।

সমাজের অনাচারের হোতা কর্তাদের দায় মুক্তির টাকা পয়সা খেয়ে যারা পেট মোটা করেন, আস্তানা, দরবার ঝকমকে, তকতকে করেন, টাকার বস্তা ব্যাংকে রাখেন, সাদা জুব্বা, পাঞ্জাবি আর মোটা মোটা তসবির দানা জপতে থাকেন, মারকাজে সময় লাগান, নিজেকে জান্নাতের হকদার মনে করেন, আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তোলেন। বলুনতো, আজ যদি নবী সা. অথবা সাহাবাগণ সমাজের এই করুণ দশা দেখতেন, তাহলে আপনারা কোনো ভূমিকা নিতেন? নিশ্চয়ই আপনারা নবী সা. ও সাহাবা রা.দের বিরুদ্ধে তথাকথিত ফতোয়া নিয়ে দাঁড়াতেন। বিরোধিতা করতেন। ইতিহাস এমনই সাক্ষ্য দেয়।

আপনারা কিন্তু মুফতি মাওলানা, সমাজের মানুষের নাজাতের জিম্মাদার। স্বয়ং নবী সা. নবুয়তি জিন্দেগির ২৩ বছর দ্বীন জারির কাজে আল্লাহর ইঙ্গিতে চলেছেন। মদিনায় হিজরতের দশ বছর সময় ২৭টি যুদ্ধে নিজে সেনাপতি ছিলেন। আর বিচক্ষণ প্রেসিডেন্ট হিসাবে ৮৫টি যুদ্ধের ব্যবস্থাপক ছিলেন। ব্যতিব্যস্ত সময় পার করেছেন। নবী সা. আর আশারায়ে মুবাশশারার (দশজন জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত) সাহাবাগণের জীবন পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, নবী সা.-এর পরে তাদের আয়েশি সুন্নত (লাউ, মধু আর কায়লুলা) পালনের একটু সময় ফুরসত মেলেনি। হাজারও প্রতিবন্ধকতার মোকাবেলা, ঘাত-প্রতিঘাত, যুদ্ধ, বিগ্রহের মাধ্যমে মানবতার মুক্তির কাজে, শান্তির সুবাতাস সৃষ্টির লক্ষ্যে, আল্লাহর দ্বীনকে ইহুদি, খ্রিষ্টান, মুশরিক, মুনাফিক, মুরতাদ, কাফের আর ঘাপটি মারা ইসলামের দুশমনদের শায়েস্তা করে সমুন্নত করেছেন, আল্লাহর দ্বীন ইসলামকে, পৃথিবীর সর্বত্র বিস্তৃত জনপদে, ইসলামী শাসন অনুশাসন কায়েমের জন্য জীবনের যেকোনো ঝুঁকি নিয়েছেন, জীবন, প্রাণ, ঘরবাড়ি, মাল, সম্পদ, স্ত্রী-পুত্র পরিজন, ব্যবসা, পিতা-মাতা, ভাই-বোন এবং আত্মীয় স্বজন বাজি রেখে ঈমানের দাবি আদায় করেছেন।

কিন্তু অবাক হতে হয় একশ্রেণির মানুষের আবিষ্কৃত জান্নাতে যাওয়ার তথাকথিত চোরা গলি দেখে। নবী সা. সাহাবাগণের ত্যাগ আর কুরবানি এদের কাছে অদৃশ্য। পবিত্র কুরআনের চর্চা নেই তাদের ব্যক্তি, সমাজ, পরিবেশ, কোথাও। শুধু কেবল তথাকথিত ফতোয়াবাজি আর দ্বিধাবিভক্তির ঠুনকো বিষয় নিয়ে মাতামাতি। যা শরিয়ত সিদ্ধ নয়।

কী অবাক করা কাণ্ড? আহলে হাদিসের নেতারা বলেন, সালাফি মসজিদে নামাজ পড়তে, মাযহাবীদের মসজিদের চেয়ে ঘরে নামাজ উত্তম। শিয়াগণ সুন্নিদের মসজিদে নামাজে সন্তুষ্ট না। আবার তথাকথিত আহলে সুন্নাত আল জামায়াতের নিন্দাবাদে ব্যস্ত। কাদিয়ানিরা মুসলমান দাবি করে মসজিদ বানায়। পীরপন্থীরা আলেম-ওলামাদের বলেন ওরা মারেফত বোঝে না। আলেম শ্রেণির লোকেরা বলেন পীরগিরি বিনা পুঁজির বাপ-দাদাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া আছে গোলটুপি লম্বা টুপির ঝগড়া, জামা প্যান্ট জুব্বা পাগড়ি তাসবিহ্ জিকিরের ধরন, ইবাদতের ধরনের ঝগড়া। মক্কা-মদিনার সাথে ঈদ রোজা পালনের ঝগড়া। অথচ সেখানে যখন ফজর ওয়াক্ত তখন কিন্তু তারা কর্মব্যস্ত। যখন ইশা ওয়াক্ত তখন তারা ঘুমে মগ্ন।

পবিত্র কুরআনের তরজমা, তাফসির, ব্যাখ্যা শিক্ষা নিয়ে কথা বললে ইসলামের শত্রুদের মন্তব্য হলো, এসব কুরআনের অপব্যাখ্যা। এছাড়া আছে স্বপ্নে পাওয়া দাওয়াতি তরিকার দাপট, দেওবন্দের এলেম, দিল্লির ইসলাম, মক্কা-মদিনার দ্বীন ইত্যাদির ঝগড়া, আছে কওমি ও আলিয়া এলেমের তাকাব্বারি। এ জাতীয় ঐক্য বিনষ্টকারী বিভেদ, ইসলাম আর মুসলমানদের দুর্বল, পঙ্গু করে দেশ ও জাতি নির্মূলে, ভিটে মাটি থেকে উচ্ছেদ করে, ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি এবং ঠিকানা মুছে দিচ্ছে। বস্তিবাসী আর শরণার্থী শিবিরে মুসলমানদের বন্দি করতে ইহুদি, খ্রিস্টান, মুশরিক, মুরতাদ এবং সেক্যুলারদের জন্য একটা মোক্ষম প্রিয়, কাম্য হাতিয়ার সৃষ্টি করে দিচ্ছেন আপনারা। আপনাদের সন্তানদের দিয়ে ওরা সন্ত্রাসী ইহুদিবাদী ইসলামিক স্টেট জঙ্গিগোষ্ঠী বানাচ্ছে। বন্ধ করুন এসব ঝগড়া প্রসঙ্গ। সূরা তাওবার ২৪ নং আয়াতে আল্লাহ যা বলেন তার মূল কথা হলো- কোনো ঈমানদার ব্যক্তি তার পিতা, সন্তান, ভাই, স্ত্রী, আত্মীয়-স্বজন, অর্জিত সম্পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য, পছন্দের বাড়িঘর, এর চেয়ে আল্লাহ, তাঁর রাসূল সা. এবং জিহাদকে যে প্রাধান্য দিতে না পারবে তাকে মৃত্যুর পরের জীবনের পরিণতি স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাদেরকে আল্লাহ তায়ালা হিদায়াত বঞ্চিত ফাসেক বলেছেন।

কুরআনের ঐ আয়াত কিন্তু মনসুখ হয় নাই। আল্লাহ উক্ত ৮টি বিষয়ের চেয়ে ৩টি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া ঈমান, ইসলাম, ইহসান, ইবাদত, জিকির, শরিয়ত, মারেফত, খেলাফত, আমলে সালেহ, সর্বোপরি নাজাত পাওয়ার একমাত্র উপায় বলেছেন। আয়াতে বর্ণিত তিনটি বিষয়ের চেয়ে যদি কোনো ব্যক্তি উক্ত ৮টির কোনো একটিকেও বেশি মহব্বত করে, তবে তাকেই হিদায়াত বঞ্চিত ফাসেক বলা হয়েছে। হোক ঐ ব্যক্তি হুজুর, আলেম, ইমাম, পীর, বুজুর্গ, হাজী, বড় মিয়া, বড় স্যার যে কেউ। এমনি আয়াত পবিত্র কুরআনে অসংখ্য অগণিত আছে। হাদিসে এর চেয়েও কঠিন হুঁশিয়ারি, পরিণতির কথা আছে। যদি আপনি ঈমানের দাবি করেন, ইসলামের দাবি করেন, তবে তো কুরআনের এ কথা মেনে নিতে হবে।

দেখেন আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার হাল। দেশের বড় বড় বিদ্যাপীঠ থেকে উচ্চ শিক্ষিত মানুষ, বিসিএস ক্যাডার হিসাবে ডিসি, এসপি, ম্যাজিস্ট্রেট, অ্যাডভোকেট, শিক্ষাবিদ, সচিব, বিচারপতি, চিন্তাবিদ হন। কিন্তু তাদের ভূমিকা, আচার-আচরণ, ব্যবহারে, রিক্সাওয়ালা, দিনমজুর, অধস্তন কর্মচারী, বাবার বয়সী মুরব্বি এবং সাধারণ মানুষের শুধুই বোবাকান্না শোনা যায়।

কেননা আমাদের সমাজ দর্শনে শিক্ষাব্যবস্থার কুচক্রী মহলের ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় আমরা ব্যর্থ। আমাদের এম.এ পাস সোনামানিক, পবিত্র কুরআন দেখে দেখেও পড়তে পারে না। ইতিহাস শিখতে গিয়ে পিকে হিট্টি, আর নিকলসনের বিকৃত তথ্য নিয়ে সাহাবাগণের মতো চরিত্র গঠনের প্রেরণা থেকে বঞ্চিত।

আরবি শিখতে গিয়ে নষ্ট কবি ইমরুল কায়েসের উলঙ্গপনা, আখতাল এবং মুনাব্বিদের মদ পানের বর্ণনা ছাড়া চরিত্রগঠনের কোনো উপরকণ নেই। অঙ্ক শিখতে গিয়ে দুর্নীতির দুর্দান্ত শিক্ষা অর্জন বৈ-আর কি পাচ্ছে। দর্শন শিখতে স্বয়ং আল্লাহর অস্তিত্ব অস্বীকার করছে। সমাজবিজ্ঞান রাষ্ট্রবিজ্ঞান শিখে দেশ চালাতে শিয়ালের চেয়ে ধূর্ত, সিংহের চেয়ে হিংস্র, অরাজকতা, ক্ষমতার জবর দখল, অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা, মিথ্যা, কুৎসিৎ অপকর্মের গডফাদারের প্রতিযোগিতা হচ্ছে।

পাশাপাশি যারা এক সময় ইংরেজি শিক্ষা হারাম বলে ধর্মীয় শিক্ষা নিয়ে জীবন যাপনের প্রত্যয়ী হলেন, তাদের অন্দর মহল থেকে নিষ্পাপ বাচ্চার লাশ, শিশু নির্যাতন, নারী নির্যাতন, হিল্লা তালাকের মত জঘন্য কাজও অবলীলায় জায়েজ হচ্ছে। মিলাদ, মাজার, পীর মুরিদির মত কুসংস্কার থেকে বের হতে পারছেন না। হিংসার আগুনে জ্বলে জ্বলে এক আলেম অন্য আলেমকে কাফের ফতোয়া দিচ্ছেন। দেশে ইসলামবিরোধী আইন পাস হলে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। কিন্তু টাই প্যান্ট কোট পরা লোক ইসলাম নিয়ে সত্য সঠিক বিষয়ে উদঘাটনের গবেষণা করলে তাদের কলিজায় আগুন লেগে যায়। এসব দেখে লেবাসধারীদের এখন আর কেউ সভ্য বলতে চায় না।

পবিত্র কুরআন যেখানে মানুষের জন্য বিজ্ঞানমনস্ক। যেমন- পবিত্র কুরআনের সূরা শামস, আল কামার, বুরুজ, নাজম, জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের জন্য। সূরা দুখান, যারিয়াত, হাদিদ পদার্থ বিজ্ঞানীদের জন্য। সূরা নামল, নাহল, বাকারা, আনয়াম, আনকাবুত প্রাণিবিজ্ঞানীদের জন্য। সূরা তাগাবুন, মুতাফফিফিন ব্যবসায় শিক্ষার জন্য। সূরা আশ শুরা, সাফফাত, মুল্ক রাজনীতিবিদদের জন্য। সূরা আশ শুয়ারা, কবি সাহিত্যিকদের জন্য, সূরা আলাক ও সূরা তিন চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের জন্য চর্চা ও গবেষণার উপায় উপকরণ মানবকল্যাণের জন্য অবারিত। এসব বিষয় যারা চিন্তা গবেষণা চর্চা করবে এবং মানবতার কল্যাণে উপস্থাপন করবে তাদের উৎসাহ দেওয়া, সহযোগী হওয়া ঈমানদার মানুষের কর্তব্য।

তাই ঈমান ও আমলের পরিপূর্ণ তৃপ্তির জন্য ইসলামের স্বাধীন পরিবেশ দরকার। আর সেই স্বাধীন পরিবেশ পাওয়া যাবে শুধু ইসলামী হুকুমত আল্লাহর জমিনে কায়েম হলেই। সে কারণে নবী সা. আমাদেরকে সেই স্বাধীন পরিবেশ তৈরির চেষ্টায় লেগে থাকতে শুধু বলেই ক্ষান্ত হননি বরং কঠিন ভাষায় আল্লাহ হুকুম করেছেন আর ঈমানের দাবিদারদেরকে দায়িত্ব পালন না করার পরিণতিও জানিয়ে দিয়েছেন। এ ছাড়া দেশ জাতি ও জনপদের শাসন প্রশাসনসহ প্রতিটি ক্ষেত্রকে দুর্নীতি অনাচার ও সন্ত্রাসমুক্ত, পাপমুক্ত দেখতে চাইলে, শান্তিপূর্ণ সমাজের সহাবস্থান কামনা করলে প্রয়োজন একটি পরিপূর্ণ ইসলামী দলের অধীনে আমাদের সংঘবদ্ধ হওয়া। আর সকল ভেদাভেদ ও বিচ্ছিন্নতা থেকে বেরিয়ে এসে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ হওয়া।

লেখক : কলামিস্ট ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির