post

ওহির সূচনা ও দাওয়াতের প্রারম্ভিক পদ্ধতি

মুহাদ্দিস ডক্টর এনামুল হক

আল্লাহ তায়ালা মনোনীত ইসলাম পূর্ণাঙ্গ ও ভারসাম্য জীবন ব্যবস্থা। দুনিয়ায় শান্তি ও আখেরাতে মুক্তির জন্য আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে অগণিত নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। পাশাপাশি আপামর জনগোষ্ঠীদের হেদায়াতের জন্য ওহিভিত্তিক নির্দেশনা প্রদান করেছেন। ওহির আলোকে আল্লাহ তায়ালা প্রেরিত নবী-রাসূলগণ দাওয়াতি ময়দানে মানুষকে সত্য ন্যায়ের পথে পরিচালিত করেছেন। তাঁদের দাওয়াতি কাজের পদ্ধতি অনুযায়ী আল্লাহর জমীনে তাঁর দ্বীন কায়েমের আন্দোলনে কেয়ামত পর্যন্ত অটল ও অবিচল থাকা প্রত্যেক ঈমানদারদের অবশ্যই অপরিহার্য কর্তব্য।

ওহির সূচনা

আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক নবী-রাসূলদের প্রতি প্রেরিত বার্তাকেই ওহি হিসেবে বোঝানো হয়। আল কুরআনুল কারিমে এসেছে, ‘আমি আপনার প্রতি ওহি পাঠিয়েছি, যেমন করে ওহি পাঠিয়েছিলাম নূহের প্রতি এবং সে সকল নবী-রাসূলের প্রতি যারা তাঁর পরে প্রেরিত হয়েছেন। আর ওহি পাঠিয়েছি, ইসমাঈল, ইব্রাহীম, ইসহাক, ইয়াকুব ও তাঁর সন্তানবর্গের প্রতি এবং ঈসা, আইয়ুব, ইউনূস, হারুন ও সুলায়মানের প্রতি। আর আমি দাউদকে দান করেছি যবুর গ্রন্থ।’ (সূরা আন নিসা, আয়াত: ১৬৩)

এই ওহি বিভিন্ন ধরণ ও পদ্ধতিতে নাযিল হয়েছে। আল কুরআনে বলা হয়েছে, ‘কোনো মানুষের জন্য এমন হওয়ার নয় যে, আল্লাহ তার সাথে কথা বলবেন। কিন্তু ওহির মাধ্যমে অথবা পর্দার অন্তরাল থেকে অথবা তিনি কোনো দূত প্রেরণ করবেন, অতঃপর আল্লাহ যা চান, সে তা তাঁর অনুমতিক্রমে পৌঁছে দেবে। নিশ্চয় তিনি সর্বোচ্চ প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা আশ শূরা, আয়াত: ৫১)

ওহির আভিধানিক অর্থ

ওহি (আরবি: وحي‎‎) শব্দের মৌলিক অর্থ দুটি। ১. গোপনীয়তা (الخفاء), ২. দ্রুততা (السرعة)। আভিধানিক অর্থ এমন গোপন ও দ্রুত সংবাদ যা শুধু ঐ ব্যক্তিই জানেন, যার নিকট তা প্রেরণ করা হয়েছে। অন্যদের কাছে তা গোপন থেকে যায়। (মাবাহিছ ফী উলূমিল কুরআন, পৃ: ৩২)

এ শাব্দিক অর্থের প্রেক্ষিতে ওহি নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলোকে অন্তর্ভূক্ত করে;

১. মানুষের অন্তরে স্বভাবগত ইলহাম (الإلهام الفطري للإنسان كالوحي لأم موسى ) : যেমন- আল্লাহ তায়ালা মূসা (আ) এর মায়ের অন্তরে ইলহাম করেন। আল কুরআনে এসেছে, ‘এবং মূসা জননীর অন্তরে আমি ইশারা নির্দেশ করলাম, শিশুটিকে স্তন্যদান করতে থাকো।’ (সূরা আল ক্বাসাস, আয়াত: ৭)

২. কোনো প্রাণীর অন্তর্মূলে গচ্ছিত ইলহাম (الإلهام الغريزي للحيوان كالوحي إلى النحل) : যেমন মৌমাছির প্রতি প্রেরিত আল্লাহর ইলহাম। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমার প্রতিপালক মৌমাছির অন্তরে ইঙ্গিত দ্বারা নির্দেশ দিয়েছেন গৃহ নির্মাণ করো পাহাড়ে, বৃক্ষে ও মানুষ যে গৃহ নির্মাণ করে তাতে।’ (সূরা আন নাহল, আয়াত: ৬৮)

৩. অতি দ্রুত কোনো ইঙ্গিত করা (الإشارة السريعة على سبيل الرمز والإيحاء) : যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘কাজেই সে মিহরাব থেকে বের হয়ে নিজের সম্প্রদায়ের সামনে এলো এবং ইশারায় তাদেরকে সকাল ও সাঁঝে আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করার নির্দেশ দিলো।’ (সূরা মারইয়াম, আয়াত: ১১)

৪. আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে ফেরেশতাগণের জন্যে অবশ্য পালনীয় নির্দেশ (ما يلقيه الله تعالى إلى ملائكته من أمر ليفعلوه ): যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর সেই সময়, যখন তোমার রব ফেরেশতাদের প্রতি প্রত্যাদেশ করেছিলেন, এই বলে, আমি তোমাদের সাথে আছি, অতএব তোমরা ঈমানদারদেরকে অবিচল রাখো।’ (সূরা আনফাল, আয়াত: ১২)

আল্লামা রাগিব ইসফাহানী (র) বলেন, ‘ওহির মূল অর্থ দ্রুত গতিশীল ইশারা। এ ইশারা ইঙ্গিত কথা দ্বারাও সম্পন্ন হতে পারে। এমন শব্দেও হতে পারে, যার কোনো সঠিক রূপ নেই। আবার এটা কোনো অঙ্গের ইশারা এবং লিখনীর সাহায্যেও হতে পারে।’ (আল মুফরাদাত ফী গারিবীল কুরআন, পৃ: ৫১৫)

মূলত ওহি হচ্ছে, এমন সূক্ষ্ম ও গোপন ইশারা, যা ইশারাকারী ও ইশারা গ্রহণকারী ছাড়া তৃতীয় কেউ টের পায় না। এ সম্পর্কের ভিত্তিতে এ শব্দটি ইলকা বা মনের মধ্যে কোনো কথা নিক্ষেপ করা ও ইলহাম বা গোপনে শিক্ষা ও উপদেশ দান করার অর্থে ব্যবহৃত হয়।

ওহির পারিভাষিক অর্থ

ওহির পারিভাষিক অর্থ হলো, ‘আল্লাহ তায়ালার বাণী, যা তাঁর নবীগণের মধ্য থেকে কোনো নবীর ওপর নাযিল করা হয়েছে।’ (মাবাহিস ফী উলমিল কুরআন, পৃ: ২৯)

ওহির সূচনায় নাযিলের পদ্ধতি

প্রথমত আল্লাহ তায়ালা পুরো কুরআনুল কারিম লাওহে মাহফুজ হতে দুনিয়ার আসমানে বাইতুল ইযযত এ নাযিল করেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় আমি এ কুরআন ক্বদরের রাতে নাযিল করেছি।’ (সূরা আল ক্বদর, আয়াত: ১)

পরবর্তীতে মক্কায় ১৩ বছর ও মদিনায় ১০ বছর মিলে ২৩ বছর নবুওয়তী জীবনে পর্যায়ক্রমে কুরআন নাযিল হয়েছে। আল্লাহর বাণী, ‘আর এ কুরআনকে আমি সামান্য সামান্য করে নাযিল করেছি, যাতে তুমি থেমে থেমে তা লোকদেরকে শুনিয়ে দাও এবং তাকে আমি (বিভিন্ন সময়) পর্যায়ক্রমে নাযিল করেছি।’ (সূরা আল ইসরা, আয়াত: ১০৬)

এ বিষয় অনস্বীকার্য যে, মুহাম্মদ (সা) এর ৪০ বছর বয়সে প্রথম ওহি নাযিল হয়। হেরাগুহায় ধ্যানমগ্ন থাকাকালীন সময়ে একদিন জিবরাইল (আ) এসে বললেন, ‘পড়ুন আপনার প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। যিনি সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্তপিন্ড থেকে। পড়–ন, আপনার পালনকর্তা মহা দয়ালু, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না।’ (সূরা আল-আলাক : ১-৫)

এরপর রাসূলুল্লাহ (সা) ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ফিরে গেলেন। খাদীজা (রা)-কে ডেকে বললেন, আমাকে কম্বল দিয়ে আবৃত করে দাও, আমাকে কম্বল দিয়ে আবৃত করে দাও। তিনি খাদীজার নিকট পুরো ঘটনা বর্ণনা করলেন এবং নিজের জীবন নিয়ে আশঙ্কার কথা বললেন। খাদীজা (রা) তাকে সান্ত¡না দিয়ে বললেন, ‘না, তা কখনও হতে পারে না। আল্লাহর কসম! তিনি আপনাকে লাঞ্চিত বা অপমানিত করবেন না। আপনি আত্মীয়তার বন্ধন সুদৃঢ়কারী, গরীব-দুঃখীর সাহায্য-সহযোগিতাকারী, অতিথিপরায়ন ও মানুষের বিপদে-আপদে সাহায্যকারী।’ (সহিহুল বুখারী, হাদীস নং ৩, ৪৬৭০, ৬৫৮১; সহিহ মুসলিম, হাদীস নং ৪২২)

উপর্যুক্ত ধরণ ও পদ্ধতিতে ওহির সূচনা ও নাযিল হয়। যা কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। ওহিভিত্তিক নির্দেশনার মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সা) দাওয়াতি কাজ শুরু করেন।

আল্লাহ তায়ালা নবী-রাসূলগণের নিকট বিভিন্ন ধরণ ও পদ্ধতিতে ওহি নাযিল করেন। সেসব হলো-

১. স্বপ্নযোগে (الرويا الصالحة في النوم): নবীগণের স্বপ্ন ওহি। সহিহ হাদীসে এসেছে, “নবীগণের স্বপ্নও ওহি”। (সহিহুল বুখারী, হাদীস নং ১৩৫, ৮১২; সনদ: সহিহ)

স্বপ্নের ওপর আমল করা তাঁদের জন্যে অপরিহার্য। ইবরাহীম (আ) এর স্বপ্ন এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। আল কুরআনে এসেছে, ‘সে পুত্র যখন তার সাথে কাজকর্ম করার বয়সে পৌঁছল তখন একদিন ইবরাহীম তাকে বললেন, হে পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখি তোমাকে আমি যাবেহ করছি, এখন তুমি বল তুমি কি মনে করো? সে বলল, ‘হে আব্বাজান! আপনাকে যা হুকুম দেওয়া হচ্ছে তা করে ফেলুন, আপনি আমাকে ইনশাআল্লাহ সবরকারীই পাবেন।’ (সূরা আস সাফ্ফাত, আয়াত: ১০২)

আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা) সম্পর্কে সহিহ সনদে এসেছে, ‘উম্মুল মুমিনীন ‘আয়িশা (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (সা) এর নিকট সর্বপ্রথম যে ওহি আসে, তা ছিল নিদ্রাবস্থায় বাস্তব স্বপ্নরূপে। যে স্বপ্নই তিনি দেখতেন তা একেবারে প্রভাতের আলোর ন্যায় প্রকাশিত হতো।’ (সহিহুল বুখারী, হাদীস নং ৩, ৪৬৭০, ৬৫৮১; সহিহ মুসলিম, হাদীস নং ৪২২)

অন্য বর্ণনায় এসেছে, সূরা আল কাউসার স্বপ্নযোগে নাযিল হয়েছে। হাদীসটি হচ্ছে, ‘আনাস ইবনে মালিক (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমরা রাসূলুল্লাহ (সা) এর মজলিসে উপস্থিত ছিলাম। হঠাৎ তার ওপর অচৈতন্য ভাব চেপে বসল। অতঃপর তিনি মুচকি হেসে মাথা তুললেন। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার হাসির কারণ কী? তিনি বললেন, এই মাত্র আমার ওপর একটি সূরা নাযিল হয়েছে। তিনি তিলাওয়াত করলেন, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম, নিশ্চয়ই আমরা তোমাকে কাউসার দান করেছি। অতএব তুমি তোমার প্রতিপালকের জন্য সালাত আদায় করো এবং কুরবানি দাও। তোমার কুৎসা রটনাকারীরাই মূলত শিকড়কাটা, নির্মূল।’ (সহিহ মুসলিম, হাদীস নং ৯২১)

২. অন্তঃকরণে ঢেলে দেওয়া বা ইলহাম এর মাধ্যমে ওহি নাযিল (النفث في روعي او الالهام) :.

‘আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, পবিত্র আত্মা (জিবরাঈল) আমার অন্তরে ফুঁকে দিয়েছেন।’ (মিশকাতুল মাসাবীহ : ৫৩০০)

৩. পর্দার আড়াল হতে (من وراء حجاب) : জাগ্রত অবস্থায় পর্দার আড়াল হতে ওহি নাযিল হওয়া। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অতপর মূসা যখন আমার নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হলো এবং তার রব তার সাথে কথা বললেন তখন সে আকূল আবেদন জানাল, হে প্রভু! আমাকে দর্শনের শক্তি দাও, আমি তোমাকে দেখব।’ (সূরা আল আরাফ, আয়াত: ১৪৩)

অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘আমি মূসার সাথে কথা বলেছি, ঠিক যেমনভাবে কথা বলা হয়।’ (সূরা আন নিসা, আয়াত: ১৬৪)

মানবতার বন্ধু মুহাম্মাদ (সা) এর মিরাজ রাতে পর্দার আড়াল থেকে ওহি নাযিল হয়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘কোনো মানুষই এ মর্যাদার অধিকারী নয় যে, আল্লাহ তার সাথে সরাসরি কথা বলবেন। তিনি কথা বলেন হয় ওহির মাধ্যমে, অথবা পর্দার আড়াল থেকে কিংবা তিনি কোনো বার্তাবাহক (ফেরেশতা) পাঠান এবং সে তার হুকুমে তিনি যা চান ওহি হিসেবে দেন। তিনি সুমহান ও সুবিজ্ঞ।’ (সূরা আশ শূরা, আয়াত: ৫১) 

৪. ঘন্টার ধ্বনির ন্যায় (صلصلة الجرس) : রাসূলুল্লাহ (সা) এর নিকট অধিকাংশ সময় এ পদ্ধতিতে ওহি নাযিল হতো। পাথরের ওপর পাথর পতিত হলে যে শব্দ হয় তাকেই সালসালাতুল জারাস (صلصلة الجرس) বলা হয়। এটাকে ঘন্টার ধ্বনির মতো এজন্য বলা হতো যে, এ শব্দ ধারাবাহিক ও বিরতীহীনভাবে হতেই থাকত। এটি অত্যন্ত কষ্ট ও সর্বাধিক কঠিন পদ্ধতি। তীব্র শীতের সময়ও রাসূলুল্লাহ (সা) এর কপাল হতে ঘাম ঝরে পড়ত। হাদীসে এসেছে, ‘উম্মুল মুমিনীন ‘আয়িশা (রা) হতে বর্ণিত, হারিস ইবনে হিশাম (রা) আল্লাহর রাসূল (সা)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনার নিকট ওহি কিরূপে আসে?’ আল্লাহর রাসূল (সা) বললেন, কোনো কোনো সময় তা ঘণ্টা বাজার মতো আমার নিকট আসে। আর এটি-ই আমার ওপর সবচেয়ে বেদনাদায়ক-কষ্টকর হয় এবং তা শেষ হতেই মালাক (ফেরেশতা) যা বলেন আমি তা মুখস্থ করে নেই, আবার কখনো মালাক (ফেরেশতা) মানুষের রূপ ধারণ করে আমার সাথে কথা বলেন। তিনি যা বলেন আমি তা মুখস্থ করে নেই। ‘আয়িশা (রা) বলেন, আমি তীব্র শীতের সময় ওহি নাযিলরত অবস্থায় তাঁকে দেখেছি। ওহি শেষ হলেই তাঁর ললাট হতে ঘাম ঝরে পড়ত।’ (সহিহুল বুখারী : ২, ৩০৪৩; সহিহ মুসলিম : ৬২০৫০)

৫. ফেরেশতা মানুষের আকৃতিতে ওহি নাযিল করা (في صورة البشر) : কখনো কখনো জিবরাঈল (আ) মানুষের আকৃতিতে ওহি নিয়ে আসেন। তবে সাধারণত: বিখ্যাত সাহাবী দাহইয়াতুল কালবী (রা) এর আকৃতিতে আগমন করতেন। আবার কখনো তিনি অপরিচিত লোকের আকৃতিতে ওহি নিয়ে আগমন করতেন। হাদীসে এসেছে, ‘উম্মুল মুমিনিন ‘আয়িশা (রা) হতে বর্ণিত, হারিস ইবনে হিশাম (রা) আল্লাহর রাসূল (সা)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনার নিকট ওহি কিরূপে আসে?’ আল্লাহর রাসূল (সা) বললেন,-- আবার কখনো মালাক (ফেরেশতা) মানুষের রূপ ধারণ করে আমার সাথে কথা বলেন। তিনি যা বলেন আমি তা মুখস্থ করে নেই।’ (সহিহুল বুখারী : ৩০৪৩; সহিহ মুসলিম : ৬২০৫) 

৬. ফেরেশতার নিজ আকৃতিতে ওহি নাযিল (في صورته الاصلية) : কখনো কখনো জিবরাঈল (আ) তাঁর আসল আকৃতিতে রাসূলুল্লাহর (সা) নিকট ওহি নিয়ে আসতেন। এরূপ ঘটনা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জীবনে তিনবার ঘটেছে। একবার রাসূলুল্লাহ (সা) জিবরাঈল (আ)-কে তাঁর নিজস্ব আকৃতিতে দেখার ইচ্ছা পোষণ করেন, তখন তিনি তাঁর আপন আকৃতিতে আগমন করেন। দ্বিতীয়বার মিরাজের সময়, তৃতীয়বার নবুওয়তের প্রাথমিক অবস্থায় মক্কার আজইয়াদ নামক স্থানে। জিবরাঈল (আ) এর ছয়শত পাখা ছিল। হাদীসে এসেছে, ‘আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) হতে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ (সা) হতে বর্ণনা করেন, এবং তিনি তাঁকে আরেকবার দেখেছিলেন। তিনি বলেন, তিনি জিবরাঈল (আ) কে সিদরাতুল মুনতাহায় দেখেন, আর তার ছয়শত ডানা ছিল।’ (আল আত্বরাফুল মুসনাদ লি ইবনে হাজর আসকালানী, ১২ খ-, পৃ: ১২৫)

৭. আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক সরাসরি ওহি নাযিল: কোনো কোনো নবী-রাসূলদের সাথে আল্লাহ তায়ালা সরাসির কথা বলে ওহি নাযিল করেন। মুহাম্মাদ (সা)ও কখনো কখনো আল্লাহর সাথে কথোপকথন করেছেন। হাদীসে এসেছে, ‘আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস ও মুয়ায ইবনে জাবাল (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, আমার রব আমার নিকট আগমন করেন। অতঃপর তিনি বলেন, উর্ধ্ব জগতের ফেরেশতাগণ কী নিয়ে মতভেদ করেছেন?’ (মুসনাদু আহমাদ : ৩৪৮৪, ২২১০৯) 

৮. ইসরাফীল (আ) কর্তৃক ওহি নাযিল (وحي اسرافيل): ওহি বন্ধ থাকাকালীন সময়ে রাসূলুল্লাহ (সা) কে সান্ত¡না দানের দায়িত্ব অর্পন করা হয় ইসরাফীল (আ)-কে। হাদীসে এসেছে, ‘আমির শা’বী (রা) হতে বর্ণিত, মহানাবী (সা) এর নিকট তিন বছর ইসরাফীল (আ) ওহি সহ বিভিন্ন বিষয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় এবং এরপরে জিবরাঈল (আ) কে দায়িত্ব দেওয়া হয়। (উমদাতুল ক্বারী শারহিল বুখারী, ১ম খ-, পৃ: ১০৫-১০৬)

দাওয়াতের প্রারম্ভিক পদ্ধতি

শিশুকাল থেকেই মুহাম্মাদ (সা) ছিলেন একজন ব্যতিক্রম ও অসাধারণ বালক। কথা-বার্তা, চাল-চলন, আচার-ব্যবহারে তিনি উত্তম আদর্শবান হিসেবে গড়ে উঠেছিলেন। ছোট বেলায় তাঁর দাদা বড় বড় মজলিসে মুহাম্মদ (সা)-কে নিজ চাদরের ওপর বসাতেন। আরবের কুরাইশ নেতাদের সামনে তাঁকে সাইয়্যেদ বা নেতা বলে ডাকতেন। এ ছাড়া যখন তিনি হালিমা সাদিয়ার ঘরে লালিত-পালিত হচ্ছিলেন তখন তিনি অন্যান্য বালকদের মতো কথা না বলে শুদ্ধ আরবি ভাষায় কথা বলতেন। ইসলাম আগমনের পূর্বে আরবে যে শিরক ও মূর্তি পূজার প্রচলন ছিল, সে সময়েও মুহাম্মাদ (সা) তাওহীদের প্রতি বিশ্বাসের ক্ষেত্রে দৃঢ়তা অবলম্বন করেন। তিনি কখনো কোনো মূর্তির সামনে মাথা নত করেননি, মূর্তির নামে পশু যবেহ করেননি এবং যবেহকৃত পশুর গোশতও তিনি কে নোদিন ভক্ষণ করেননি। আল্লাহ রব্বুল আলামিন তাঁকে এসব কাজ থেকে হেফাজত করেছেন।

দাওয়াতি কাজের পদ্ধতি ও কৌশল

দাওয়াতি কাজের পদ্ধতি সম্পর্কে মহান আল্লাহ বিভিন্ন আয়াতে নির্দেশনা দিয়েছেন। দাওয়াতের ময়দানে অনেক ক্ষতি ও লোকসানের মুখোমুখিও হতে পারে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর নিশ্চয়ই আমরা ভীতি, অনাহার, প্রাণ ও সম্পদের ক্ষতির মাধ্যমে এবং উপার্জন ও আমদানি হ্রাস করে তোমাদের পরীক্ষা করব। এ অবস্থায় যারা সবর করে এবং যখনই কোন বিপদ আসে বলে, “আমরা আল্লাহর জন্য এবং আল্লাহর দিকে আমাদের ফিরে যেতে হবে।’ (সূরা আল বাক্বারা, আয়াত: ১৫৫-১৫৬)

জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিমত্তার সাথে দাওয়াত দান : ইসলামের সাধারণ নির্দেশনা হলো, মুমিন দ্বীনি কাজের ক্ষেত্রে প্রজ্ঞার পথ অনুসরণ করা। এ ব্যাপারে আল্লাহ বলেন, ‘তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে দাওয়াত দাও প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তা ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে এবং তাদের সাথে বিতর্ক করো সর্বোত্তম পদ্ধতিতে।’ (সূরা আন নাহল, আয়াত: ১২৫)

ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দেওয়া : আল্লাহ তায়ালা মুসলিমদের ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দিতে এবং শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধাচরণ উপেক্ষা করতে বলেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘লোকে যা বলে তাতে তুমি ধৈর্য ধারণ করো এবং সৌজন্যসহ তাদের পরিহার করে চলো।’ (সূরা মুজ্জাম্মিল, আয়াত: ১০)

মন্দের মোকাবিলায় ভালো দিয়ে সর্বোচ্চ শিষ্টাচার প্রদর্শন : আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের বিরোধী পক্ষের সাথে সর্বোচ্চ শিষ্টার ও প্রজ্ঞাপূর্ণ আচরণের নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘(হে নবী!) সৎকাজ ও অসৎকাজ কখনো সমান নয়। তুমি অসৎকাজের জবাব ভালো দিয়ে দাও, যা সবচেয়ে ভালো, তাহলে দেখবে যার সাথে তোমার শত্রুতা ছিল, সে অন্তরঙ্গ বন্ধুরূপে পরিণত হয়ে গেছে। এ গুণের অধিকারী করা হয় কেবল তাদেরই, যারা ধৈর্যশীল, এ গুণের অধিকারী করা হয় কেবল তাদেরই, যারা মহাভাগ্যবান।’  (সূরা হামীম সাজদাহ, আয়াত: ৩৪)

শত্রুর প্রতিও সুবিচার করা : আদল বা ন্যায়বিচার ইসলামের অন্যতম প্রধান শিক্ষা। ইসলাম শত্রুর সঙ্গে সুবিচার করার নির্দেশ দিয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘সুবিচার করো, এটাই আল্লাহভীতির বেশি নিকটবর্তী।’ (সূরা আল মায়িদা, আয়াত : ৮)

জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে দাওয়াতের পদ্ধতি আপডেট করা: আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সব বিষয়ের ইলম শিক্ষা দিয়েছেন। যুগ যুগান্তরে সে শিক্ষা উম্মাহকে অনুপ্রাণিত করবে। সর্বপ্রথম ওহির নির্দেশনাও শিক্ষা প্রসঙ্গে। আল্লাহ বলেন, ‘পড়, তোমার রব বড়ই অনুগ্রহশীল। যিনি কলমের সাহায্যে জ্ঞান শিখিয়েছেন। মানুষকে এমন জ্ঞান শিক্ষা দিয়েছেন যা সে জানত না।’ (সূরা আল আলাক, আয়াত: ৩-৫)

সামাজিক কাজে অংশ গ্রহণের মাধ্যমে দাওয়াত: মানুষ সামাজিক জীব। হেতু মানুষের সুখে-দুঃখে, বিপদে-আপদে তার পাশে সহযোগিতার মাধ্যমে ইসলাম নির্দেশিত দাওয়াত দেওয়া অধিক ফলপ্রসূ।

জনগণের মেজায ও ভাষায় দাওয়াত দান করা: এ ব্যাপারে আল কুরআনে এসেছে, ‘এবং আমরা যেখানেই কোনো রাসূল প্রেরণ করেছি, তিনি তার জাতির জনগণের ভাষায়ই সে পয়গাম পৌঁছিয়েছেন, যেন তিনি তাদেরকে খুব ভালোভাবেই ভাব প্রকাশ করে বুঝাতে পারেন, অতঃপর আল্লাহ যাকে চান গোমরাহ করেন আর যাকে চান হেদায়েত দান করেন, তিনি প্রবল পরাক্রমশালী ও জ্ঞানী-কৌশলী।’ (সূরা ইবরাহীম, আয়াত: ৪)

সহজভাবে দাওয়াত প্রদান: এ ব্যাপারে সহিহ সনদে এসেছে,‘আনাস ইবনে মালিক (রা) থেকে বর্নিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, তোমরা (দীনের দাওয়াত) সহজ করো, কঠিন করো না। সুসংবাদ দাও, বীতশ্রদ্ধ করো না।’ (সহিহুল বুখারী : ৬৯, ৫৭৭৪; সহিহ মুসলিম : ৪৬২৬) 

রাসূলুল্লাহ (সা) এর দাওয়াতি কাজের প্রারম্ভিক অবস্থা তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত:

ক) ইসলামী দাওয়াতের প্রস্তুতি ও সূচনা

খ) গোপনে ইসলামের দাওয়াত 

গ) প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত

ক) ইসলামী দাওয়াতের প্রস্তুতি ও সূচনা 

জ্ঞান অর্জনের নির্দেশনা: ওহি নাযিলের পূর্বে তিনি আল্লাহ তায়ালার নৈকট্যলাভ ও আনুগত্য করার জন্য কঠোর চেষ্টা-সাধনা করতেন। আল্লাহর ইচ্ছানুযায়ী তিনি নিজেকে প্রস্তুত করেছেন। তিনি যখন মায়া-মমতা, ভালোবাসা, বীরত্ব, ধৈর্য, কষ্ট ও পরিশ্রমসহ সকল গুণের অধিকারী হয়েছিলেন, তখন আল্লাহ তায়ালা হেরাগুহায় ধ্যানমগ্ন থাকাবস্থায় তাঁর নিকট প্রথম ওহি নাযিল করে বললেন, “পড় তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা আল আলাক, আয়াত: ১-২) ওহি নাযিলের এ প্রারম্ভিক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা রাসূলুল্লাহ (সা)-কে পড়া ও জ্ঞান শিক্ষার প্রতি আহ্বান করেছেন।

নৈতিকতার প্রশিক্ষণ ও চরিত্র গঠন

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন প্রথম থেকেই রাসূলুল্লাহ (সা)-কে দাওয়াতের উপযোগী করে গড়ে তুলতে উত্তম চরিত্র গঠনের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ (সা) এ সম্পর্কে বলেন, ‘আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, আল্লাহ আমাকে উত্তম শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়েছেন।’ (কানযুল উম্মাল ফী সুনানিল আকওয়াল ওয়াল আফয়াল : ১৮৬৭৩, ৩১৮৯৫) 

আল কুরআনের ভাষ্য অনুযায়ী বোঝা যায়, তিনি চরিত্রের সর্বোত্তম স্থানে পৌঁছেছিলেন। আল্লাহ বলেন, ‘আপনি সর্বোচ্চ চরিত্রের অধিকারী।’ (সূরা আল কলম, আয়াত: ৪) 

এভাবে আল্লাহ তাঁকে দৈহিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক ও নৈতিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তৈরি করেন। নবুওতের পূর্বে মক্কার কোনো অশ্লীল কাজে তিনি কোনোদিন অংশগ্রহণ করেননি। এটি তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের এক অসাধারণ ও ব্যতিক্রম উপস্থাপনা।

রাত জেগে ইবাদাতের নির্দেশনা : আল্লাহ তায়ালা রাসূলুল্লাহ (সা)-কে দাওয়াতি কাজের উপযোগী করে গড়ে তুলতে রাত জেগে ইবাদতের নির্দেশ দিয়েছেন। আল কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, “হে চাদর আবৃত! রাতে সালাতে দাঁড়াও কিছু অংশ ছাড়া। রাতের অর্ধেক কিংবা তার চেয়ে কিছুটা কম। অথবা তার চেয়ে একটু বাড়াও। আর স্পষ্টভাবে ধীরে ধীরে কুরআন আবৃত্তি কর। নিশ্চয় আমি তোমার প্রতি এক অতি ভারী বাণী নাযিল করছি।” (সূরা আল মুয্যাম্মিল, আয়াত: ১-৫)

এ আয়াতে রাতের কিছু অংশে জাগ্রত হয়ে আল্লাহর ইবাদত করতে ও কুরআন অধ্যয়ন করতে বলা হয়েছে। এটা এ জন্য যে, দাওয়াতের যে বিরাট দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তার জন্য আল্লাহর সহযোগিতা কামনা করতে হবে। আর এ রাত জাগরণের ফলে ইক্বামাতে দাঈর আত্মা হবে পবিত্র, শক্তিশালী এবং শরীর হয়ে উঠবে পরিশ্রম উপযোগী। আর এমনভিাবে আল্লাহর নিকট থেকে সব ধরণের নুসরত, অনুগ্রহ ও অনুকম্পা লাভ করা যাবে।

ইসলামী দাওয়াতের সূচনা : রাসূলুল্লাহ (সা) পূর্ণ এক বছর রাতের পুরো অংশ অথবা আংশিক ইবাদাতে কাটাতে লাগলেন। এমনি এক সময়ে আল্লাহ তায়ালা রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ওপর ওহি নাযিল করে বলেন, “হে বস্ত্রাবৃত! উঠো, অতঃপর সতর্ক করো। আর তোমার রবের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করো। আর তোমার পোশাক-পরিচ্ছদ পবিত্র করো। আর অপবিত্রতা বর্জন কর। আর অধিক পাওয়ার আশায় দান করো না। আর তোমার রবের জন্যই ধৈর্যধারণ কর।” (সূরা আল মুদ্দাচ্ছির, আয়াত: ১-৭)

উপর্যুক্ত আয়াতসমূহ অবতীর্ণের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সা)-কে দাওয়াতি কাজ করার নির্দেশ প্রদান করা এবং সাথে সাথে ইসলামী সমাজ বিনির্মানের জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করার কথাও বলে দেওয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা) এই দাওয়াতি মিশন থেকে মুসলিম উম্মাহ ও দায়ী ইলাল্লাহদের জন্য শিক্ষা হচ্ছে, পৃথিবী যতদিন থাকবে ততদিন উক্ত পদ্ধতিতে ইসলামী দাওয়াতের কাজ অব্যাহত রাখতে হবে।

খ) ইসলামী দাওয়াতের দ্বিতীয় পর্যায় গোপনে ইসলামের দাওয়াত

আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ প্রাপ্ত হয়ে রাসূলুল্লাহ (সা) ইসলামী দাওয়াতের কাজ শুরু করলেন। তিনি সর্ব প্রথম সবচেয়ে নিকট আত্মীয়দের কাছে দাওয়াত দেওয়ার টার্গেট নির্ধারণ করলেন। সে মোতাবেক প্রথমে তিনি তাঁর স্ত্রী খাদিজা (রা)-কে দাওয়াত দেন এবং খাদিজা (রা) সর্বপ্রথম এ দাওয়াত কবুল করেন। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর নিকটতম ব্যক্তিদের মধ্যে আলী (রা) ও যায়েদ ইবনে হারেসা (রা)-কে দাওয়াত দেন এবং তারাও দাওয়াত কবুল করেন। তখন আলীর (রা) বয়স ছিল দশ ও যায়েদের (রা) বয়স ছিল পনেরো বছর। এভাবে রাসূলুল্লাহ (সা) প্রথমে পরিবারের মাঝে দাওয়াতি কাজ করেন। এরপর রাসূলুল্লাহ (সা) সিদ্ধান্ত নিলেন, জাহেলী সমাজে অত্যন্ত চরিত্রবান এবং তাঁর সবচেয়ে নিকটতম বন্ধু আবু বকর (রা)-কে দাওয়াত দেবেন। আবু বকর (রা) সাথে সাথেই দাওয়াত কবুল করলেন এবং বললেন, আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কুরবান হোক, আপনি সত্যবাদী। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, মুহাম্মদ (সা) আল্লাহর রাসূল। আবু বকর (রা) ইসলাম কবুল করার পর বললেন, আমার কাছে এমন এক ব্যক্তির সন্ধান আছে যে ইসলামের এ দাওয়াত গ্রহণ করবে। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, আমাকে তার কাছে নিয়ে চলো। আবু বকর (রা) আরকাম ইবনে আরকামের বাড়ীতে নিয়ে গেলেন। তাকে বলা হলো, হে আরকাম ইবনে আরকাম বলো, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই। আরকাম ইবনে আরকাম জবাবে বললেন, ‘হে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহ (সা) আপনি সত্য বলেছেন। আমি স্বাক্ষ্য দিচ্ছি আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং আরো স্বাক্ষ্য দিচ্ছি মুহাম্মদ (সা) আল্লাহর রাসূল।’

রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন, আবু বকর ছিলেন তৎকালীন সমাজে একজন গণ্যমান্য ও প্রভাবশালী ব্যক্তি। ঈমান আনার পর তিনি সমাজের এমন কিছু ব্যক্তিবর্গকে দাওয়াতের জন্য বেছে নেন যাদের ওপর তার দৃঢ় আস্থা ও বিশ্বাস ছিল। যখন তিনি তাদেরকে দাওয়াত দেন তারা সকলে সে দাওয়াত গ্রহণ করেন। এভাবে রাসূলুল্লাহ (সা) তিন বছর গোপনে দাওয়াতি কাজ করলেন। এসময় যারা ইসলাম কবুল করেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন- উসমান, যুবাইর, আব্দুর রহমান ইবনে আউফ, সা’দ ইবনে আবী ওয়াক্কাস, তালহা ইবনে যুবাইর, আবু উবাইদা ইবনেুল জাররা, আবু সালামা ইবনে আবদিল আসাদ, উসমান ইবনে মাজউন, উবাইদা ইবনে হারিস, সাঈদ ইবনে যায়িদ ইবনে আমির ও তার স্ত্রী এবং উমরের বোন ফাতিমা, আসমা বিনত আবী বকর, খাব্বাব ইবনেুল আরাত, উমাইর ইবনে আবীল ওয়াক্কাস, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, আব্দুল্লাহ ইবনে জাহাশ, আয়শা ইবনে আবী রবীয়া, জা’ফর ইবনে আবী তালিব, মা’মার ইবর হারিস, হাতিব ইবনে হারিস, সুমাইয়া, ইয়াসির, আম্মার ইবনে ইয়াসির, সুহাইব ইবনে সিনাস। এভাবে গোপন দাওয়াতে যারা ইসলাম কবুল করেন তাদের সংখ্যা ছিল ৬০ জন। যার মধ্যে ১২জন মহিলা এবং ১৪ জন গোলাম ছিল। 

গ) ইসলামী দাওয়াতের তৃতীয় পর্যায়

প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত

রাসূলুল্লাহ (সা) দৃঢ় কদমে অব্যাহতভাবে দাওয়াতি কাজ করে যাচ্ছিলেন। এমন সময় আল্লাহ তায়ালা প্রকাশ্যে দাওয়াত দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘সুতরাং তোমাকে যে আদেশ দেওয়া হয়েছে, তা ব্যাপকভাবে প্রকাশ্যে প্রচার কর এবং মুশরিকদের পরোয়া করো না।’ (সূরা আল হিজর, আয়াত: ৯৪)

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘আর তুমি তোমার নিকটাত্মীয়দেরকে সতর্ক করো। আর মুমিনদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করে, তাদের প্রতি তুমি তোমার বাহুকে অবনত করো। তারপর যদি তারা তোমার অবাধ্য হয়, তাহলে বলো, তোমরা যা করো, নিশ্চয় আমি তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।’ (সূরা আশ শুআরা, আয়াত: ২১৪-২১৬)

এ আয়াত নাযিল হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সা) প্রকাশ্যে তাঁর দাওয়াতি মিশন শুরু করেন। আলী (রা) বলেন, এ সময় রাসূলুল্লাহ (সা) আমাকে ডাকলেন এবং বললেন, আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন ভয় প্রদর্শনের জন্য। অতঃপর আমি তা থেকে চুপ থাকি। তারপর জিবরাঈল আসলেন এবং বললেন, হে মুহাম্মদ! তোমাকে যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তুমি যদি তা পালন না করো তাহলে তোমাকে শাস্তি দেওয়া হবে। আল্লাহ বলেন, ‘হে রাসূল! তোমার রবের পক্ষ থেকে তোমার কাছে যা কিছু নাযিল করা হয়েছে তা মানুষের কাছে পৌঁছাও। যদি তুমি এমনটি না করো তাহলে তোমার দ্বারা তার রিসালাতের হক আদায় হবে না। মানুষের অনিষ্টকারিতা থেকে তোমাকে আল্লাহ রক্ষা করবেন। নিশ্চিতভাবে জেনে রাখো, তিনি কখনো কাফেরদেরকে (তোমার মোকাবিলায়) সফলতার পথ দেখাবেন না।’ (সূরা আল মায়িদা, আয়াত: ৬৭)

আল কুরআনেও এভাবে কঠিন ভাষায় রাসূলুল্লাহ (সা) কে দাওয়াতি কাজের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘আর যদি তাদের উপেক্ষা তোমার ওপর কঠিন মনে হয়, তাহলে যদি তুমি পারো যমীনে কোনো সুড়ঙ্গ অথবা আসমানে কোনো সিঁড়ি অনুসন্ধান করতে, অতঃপর তাদের কাছে কোনো নিদর্শন নিয়ে আসতে (তবে করো)। যদি আল্লাহ চাইতেন তিনি অবশ্যই তাদেরকে হেদায়াতের ওপর একত্র করতেন। সুতরাং তুমি কখনো মূর্খদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।’ (সূরা আল আনআম, আয়াত: ৩৫) 

রাসূলুল্লাহ (সা) প্রকাশ্যে দাওয়াতি কাজে নিম্নোক্ত পদ্ধতি অবলম্বন করেন:

সামষ্টিক খাওয়ার আয়োজন করে দাওয়াতি কাজ : ইসলামের দাওয়াত প্রদানের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা) আলী (রা)-কে সামষ্টিক খাওয়ার আয়োজন করতে বললেন। আলী (রা) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কথা মতো সামষ্টিক খাওয়ার আয়োজন করলাম এবং সকলকে জমায়েত করলাম। তারা সংখ্যায় মোট ৪০ জন। তাদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর চাচা আবু তালিব, হামযা, আব্বাস, আবু লাহাব, ও অন্যান্যরা ছিলেন। আলী (রা) খাবার পরিবেশন করলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, হে আব্দুল মুত্তালিবের বংশধর, আমি আপনাদের জন্য ইহকাল ও পরকালের এমন কল্যাণ নিয়ে আগমন করেছি, যা আরবের কোনো ব্যক্তি তার স্বজাতির জন্য কোনোদিন আনয়ন করেনি। আমি আপনাদেরকে সে কল্যাণের দিকে আহ্বান জানাচ্ছি। সত্যের এ আহবানে কে সাথী হবেন আসুন। পথ প্রদর্শক তার সাথীদের সাথে কখনো মিথ্যা বলে না। আল্লাহর শপথ, যদি সকল লোক মিথ্যা কথা বলে আমি আপনাদের নিকট মিথ্যা বলব না। যদি সকল লোক ধোঁকা দেয় আমি আপনাদের ধোঁকা দেবো না। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই এবং আমি বিশেষভাবে আপনাদের ও সকল মানুষের নিকট আল্লাহর রাসূল হিসেবে মনোনীত। আল্লাহর শপথ যেভাবে তোমরা নিদ্রা যাও সেভাবে মৃত্যুবরণ করবে। যেভাবে তোমরা নিদ্রা থেকে উঠো সেভাবে কবর থেকে জাগ্রত হবে। তোমরা যে কাজই করো না কেন আল্লাহর কাছে তার হিসাব দিতে হবে। ভাল কাজের জন্য ভাল পুরস্কার, মন্দ কাজের জন্য মন্দ পুরস্কার পাবে। মনে রেখো, জান্নাত চিরস্থায়ী এবং দোযখও চিরস্থায়ী। আল্লাহর শপথ, হে আব্দুল মুত্তালিবের বংশধর! আমি তোমাদের নিকট যে উত্তম জিনিস নিয়ে এসেছি, আমার জানা মতে জাতির মধ্যে কোনো যুবক তা নিয়ে আসেনি। আমি দুনিয়া ও আখিরাতের কল্যাণ নিয়ে এসেছি। তাঁর কথা শুনে সকলে একটু নরম সুরে কথা বলল। কিন্তু আবু লাহাব বলল, চলো সে আমাদেরকে ধ্বংস করে দেবে। 

সাফা পাহাড়ে জমায়েত করে দাওয়াত প্রদান : একদিন রাসূলুল্লাহ (সা) সকাল বেলা সাফা পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে বললেন, يَا صَبَاحَاهْ ‘হে প্রভাত কালের বিপদ!’ এ কথা বলে তিনি মক্কার প্রতিটি গোত্রের নাম ধরে ডাকতে লাগলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) এর আওয়াজ শুনে সকল বংশের লোকেরা ঘর থেকে বের হয়ে আসলো। যে নিজে আসতে পারেনি সে খবরের জন্য অন্যকে পাঠাল। সকলে উপস্থিত হলে রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, “আমি যদি বলি যে, এ পাহাড়ের অপর পাশে এক বিরাট শত্রুবাহিনী রয়েছে তারা তোমাদের ওপর এখনই আক্রমন করবে। তাহলে কি তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করবে? সকলে জবাব দিল, আমাদের জানামতে তুমি কখনো মিথ্যা কথা বলোনি। তখন রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, আল্লাহর আযাব আসার পূর্বে আমি তোমাদের সাবধান করে দিচ্ছি তোমরা সে আযাব থেকে বাঁচার চেষ্টা করো।” (সহিহুল বুখারী, হাদীস নং ৪৫২৩, ৪৬৮৭, ৪৬৮৮)

এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সা) এর চাচা আবু লাহাব ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠল, “তোমার সর্বনাশ হোক, এ জন্যই কি আমাদেরকে একত্রিত করেছ?” এর পরই আল্লাহ তায়ালা সূরা লাহাব নাযিল করে বলেন, ‘ধ্বংস হোক আবু লাহাবের দুহাত এবং সে নিজেও ধ্বংস হোক। তার ধন-সম্পদ এবং যা সে অর্জন করেছে তা তার কাজে আসবে না। অচিরেই সে দগ্ধ হবে লেলিহান আগুনে। আর তার স্ত্রীও যে ইন্ধন বহনকারী।’ (সূরা লাহাব, আয়াত: ১-৪) আবু লাহাব শেষ পর্যন্ত মারাত্মক প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে। (সহিহুল বুখারী, হাদীস নং ৪৪৯২)

ঘ) মক্কার পাশ্ববর্তী এলাকায় ইসলামের দাওয়াত

হজ্জের মৌসুমে দাওয়াত : মক্কার কাবা ঘর বিশ্বের মানুষের কাছে যুগ যুগ ধরে অত্যন্ত সম্মানিত হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আ) এর অনুসারী হিসেবে পৃথিবীর সব এলাকা থেকে মক্কার এ ঘর তাওয়াফ করতে আসত। ইসলামের আগমনের পূর্বেও এ ঘর ছিল ধর্মীয় ও সাহিত্য উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু রাসূলুল্লাহ (সা) এর যুগেও মক্কার উকায, মাজনা, জিল-মিজায উৎসবে যে কবিতার আসর বসত সেখানে রাসূলুল্লাহ (সা) ইসলামের দাওয়াত দিতেন। তিনি প্রত্যেক গোত্রের লোকদেরকে আহ্বান করে বলতেন, “হে মানুষ সকল বলো, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই তাহলে তোমরা সফলকাম হবে।” (মুসনাদু আহমাদ : ১৬০২৩)

তায়িফে দাওয়াত: মক্কায় দাওয়াতি কাজে আশানুরূপ ফল না পেয়ে রাসূলুল্লাহ (সা) তায়েফ গমন করেন। সেখানে তিনি বনু সাকীফ গোত্রের নেতৃস্থানীয় তিন ভাইকে দাওয়াত দেন। তারা হলো, আবদে ইয়ালীন, মাদউদ এবং হাবীব। তারা রাসূলুল্লাহ (সা) এর দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করল এবং তায়িফের যুবক, গোলাম ও দুষ্ট লোকদেরকে রাসূলুল্লাহ (সা) এর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিলো। তারা নানা ভাষায় গালা-গালি করতে করতে তাঁর পিছু পিছু ছুটল। রাস্তার দুপাশ থেকে পাথর দিয়ে মারতে মারতে ক্ষত-বিক্ষত করল। রাসূলুল্লাহ (সা) এর পবিত্র চরণযুগল থেকে রক্ত প্রবাহিত হতে লাগল। তিনি বসে পড়লে তাঁর দুবাহু ধরে আবার উঠিয়ে দেওয়া হতো। শেষ পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (সা) তায়েফ থেকে তিন মাইল দূরে পথের পাশে একটি খেজুর বাগানে আশ্রয় নেন। যে বাগানের মালিক ছিল উতবা ও সাইবা। তারা উভয়ে তখন বাগানে অবস্থান করছিল। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর এ অবস্থা দেখে তাদের ক্রীতদাস আদ্দাসকে ডেকে কিছু আঙ্গুর নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা) এর কাছে পাঠালেন। তিনি আঙ্গুর হাতে নিয়ে বিসমিল্লাহ বলে খেতে শুরু করেন। আদ্দাস আশ্চার্য হয়ে বলল, খাওয়ার সময় এ দেশের মানুষ তো এ ধরণের বাক্য পড়ে না। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, তুমি কোন দেশের লোক? তোমার দ্বীন কি? আদ্দাস বলল, আমি খৃষ্টান, নিনওয়া দেশে আমার বাড়ি। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, তুমি ইউনুস পয়গম্বর এর দেশের মানুষ। আদ্দাস বলল, আপনি কীভাবে জানেন? রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, তিনিও নবী ছিলেন, আমিও নবী। আমরা ভাই ভাই। এ কথা শুনে আদ্দাস রাসূলুল্লাহ (সা) এর হস্তদয় চুম্বন করতে লাগলেন এবং তিনি ইসলাম কবুল করলেন। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর এ অবস্থা দেখে দুজন ফেরেশতা এসে বলল, হে মুহাম্মাদ! আপনার অনুমতি পেলে তায়িফের বড় দুটি পাহাড় চাপা দিয়ে এদেরকে ধ্বংস করে দেবো। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, না তারা বেঁচে থাকুক। হয়ত এমন এক সময় আসবে তাদেরই বংশ থেকে আল্লাহ এমন সন্তান জন্ম দেবেন, যারা এক আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৩য় খ-, পৃ: ১১১)

আন্তর্জাতিক বিশ্বে দাওয়াত: জাফর ইবনে আবু তালিব (রা) এর নেতৃত্বে হাবশায় হিজরতের ফলে ইসলামের সুমহান বাণী মক্কার বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। হাবশা হিজরতের ফলে নাজ্জাশী জাফর ইবনে আবু তালিবের মুখে আল কুরআনের বাণী শুনে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সাহাবীদেরকে সাহায্য-সহযোগিতার ঘোষণা দেন এবং দাওয়াতি কাজে সহযোগিতা করেন। বাদশা নাজ্জাশী আল কুরআনের বাণী শুনে বলেন, হে মুসলমানগণ! তোমাদের প্রতি ও তোমাদের নবীর প্রতি ধন্যবাদ। মুহাম্মদ একজন সত্যবাদী নবী সে কথা আমি ইঞ্জিলে পড়েছি। আল্লাহর শপথ, যদি আমার ওপর রাজ্য শাসনের ভার অর্পিত না হতো তাহলে আমি শেষ নবীর খেদমত উপস্থিত হয়ে তাঁর পাদুকায় মাথা রেখে জীবনকে ধন্য করতাম। নিজ হাতে পাত্র নিয়ে তাঁকে অজু করাতাম। তাঁর পদসেবায় একমাত্র মুক্তির পথ। বাদশা নাজ্জাশীর ইসলাম গ্রহণ ও মুসলমানদেরকে নিরাপদে বসবাস করার সুযোগ প্রদানের কারণে জাফর (রা) হাবশাতে ইসলামী দাওয়াতের জন্য প্রচার কেন্দ্র স্থাপন করেন। বাদশা নাজ্জাশীর ইসলাম গ্রহণের সংবাদ মদিনায় পৌঁছার পর সেখানকার আউস ও খাজরাজ গোত্রদ্বয় মক্কাতে এসে হজ্জের মৌসুমে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করে মদিনাতে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। যা রাসূলুল্লাহ (সা) এর মদিনা হিজরতের পথ সুগম করে। হাবশায় ইসলামের আগমন ও নাজ্জাশীর ইসলাম গ্রহণের সংবাদ দ্রুত সিরিয়াতেও পৌঁছে যায়। সেখানেও বহু সংখ্যক লোক ইসলাম গ্রহণ করে। 

চিঠি পত্রের মাধ্যমে দাওয়াত : আন্তর্জাতিক বিশে^ ইসলামের দাওয়াত সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে রাসূলুল্লাহ (সা) এবার পত্রের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় দাওয়াত দেওয়ার পরিকল্পনা করলেন। সর্বপ্রথম তিনি রোম স¤্রাট হিরাক্লিয়াস-এর নিকট দাহিয়াতুল কালবীকে (রা) দিয়ে পত্র লিখে পাঠান। পত্রের ভাষা ছিল এরূপ:

‘‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূলুল্লাহ (সা) এর পক্ষ থেকে রোমের প্রধান হিরাক্লিয়াসের নিকটে হিদায়াতের অনুসারীদের প্রতি সালাম। অতঃপর আপনাকে ইসলামের দিকে আহ্বান করছি। ইসলাম গ্রহণ করে সর্ব প্রকার অকল্যাণ থেকে মুক্ত থাকুন, আল্লাহ আপনাকে দ্বিগুণ পুরস্কার দেবেন। ঈসা (আ) ও মুহাম্মদ (সা) এর প্রতি ঈমান আনার কারণে, যদি আপনি এতে সম্মত হন তাহলে আপনার প্রজাদের পাপের জন্য আপনি দায়ী থাকবেন, কেননা সাধারণ জনগণ তাড়াতাড়ি ইসলাম গ্রহণ করে। হে কিতাবীগণ, তোমরা এমন কথার দিকে আস, যেটি আমাদের মধ্যে ও তোমাদের মধ্যে সমান যে, আমরা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কারো ইবাদাত না করি। আর তার সাথে কোন কিছুকে শরীক না করি এবং আমাদের কেউ কাউকে আল্লাহ ছাড়া রব হিসেবে গ্রহণ না করি। তারপর যদি তারা বিমুখ হয় তবে বল, তোমরা সাক্ষী থাক যে, নিশ্চয় আমরা মুসলিম।’ (সহিহুল বুখারী : ৭, ২৭৮২, ৪২৭৮)

পত্র পাওয়ার পর হিরাক্লিয়াস এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য আরবের কোনো লোককে দরবারে আনার জন্য বললেন। ঘটানাক্রমে এ সময় ইসলামের প্রধান শত্রু আবু সুফিয়ানকে পাওয়া গেল। তাকে স¤্রাটের দরবারে ডেকে আনা হলো এবং কিছু প্রশ্ন করা হলো। স¤্রাট আবু সুফিয়ানের নিকট থেকে সকল বিষয় অবগত হয়ে বললেন, হে আবু সুফিয়ান তুমি যা বলেছ তা যদি সত্য হয়, তাহলে তিনি সত্য সত্যই আল্লাহর নবী, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আমার বিশ্বাস আমার পদতলস্থ ভূভাগ শীঘ্রই তাঁর করতলগত হবে। একজন রাসূলুল্লাহ (সা) আগমন করবেন এ সম্পর্কে আমি অবগত ছিলাম। কিন্তু তিনি যে আরবে আবির্ভূত হবেন, এ কথা আমি জানতাম না। আমার যদি সুযোগ হতো তাহলে নিশ্চয়ই আমি তাঁর খেদমতে উপস্থিত হতাম এবং তাঁর পবিত্র পদযুগল ধৌত করে নিজেকে ধন্য করতাম। 

অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সা) পারস্য স¤্রাটের নিকট আব্দুল্লাহ ইবনে হুজাইফা (রা) এর মাধ্যমে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে পত্র প্রেরণ করেন এবং হুজাইফাকে বললেন, তুমি বাহরাইনের শাসনকর্তা মুনযিরের হাতে পত্রখানা দিয়ে তাকে কিসরার নিকট পৌঁছে দিতে বলবে। পারস্য স¤্রাট পত্র পড়ে বলল, আমার নিকট এভাবে কে পত্র লিখেছে? শুরুতে আল্লাহর নাম, তারপর প্রেরকের নাম, তারপর স¤্রাটের নাম। এ কত বড় অপমান! এ অপমান সহ্য করা যায় না। এ কথা বলে তিনি পত্রখানা ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলেন।

এরপর রাসূলুল্লাহ (সা) মিসরের রাজা মুকাওকিসের নিকট বিশিষ্ট সাহাবী হাতিব ইবনে আবি বালতায়া (রা) এর মাধ্যমে দাওয়াত সম্বলিত পত্র প্রেরণ করেন। পত্র পাওয়ার পর মুকাওকিস প্রকাশ্যভাবে ইসলাম গ্রহণ না করলেও তিনি রাসূলুল্লাহ (সা) এর নবুওয়াত স্বীকার করে নেন এবং খুশি হয়ে বাদশা উপঢৌকন স্বরূপ পাঁচটি কিবতি পোশাক ও এক হাজার দ্বীনার প্রেরণ করেন।

আবিসিনিয়ার বাদশা নাজ্জাশী জাফর ইবনে আবু তালিবের নিকট থেকে পূর্বেই ইসলামের দাওয়াত পান এবং রাসূলুল্লাহ (সা) এর নবুওয়াতকে মেনে নেন। ৬ষ্ঠ হিজরীতে রাসূলুল্লাহ (সা) রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আমর ইবনে উমাইয়া আদ দারীমীকে (রা) বাদশা নাজ্জাশীর দরবারে দূত হিসেবে পত্রের মাধ্যমে ইসলামের দাওয়াতনামা প্রেরণ করেন। নাজ্জাশী পত্রখানা পড়ে প্রকাশ্যে ইসলামের ঘোষণা দেন এবং আমর ইবনে উমাইয়ার নিকট চিঠির উত্তর দেন।

এছাড়াও মুহাম্মদ (সা) নাজরানবাসীদের নিকট, ইয়ামামার বাদশাহর নিকট, বাহরাইনের সম্রাট এবং ওমানের সম্রাট এর নিকট দাওয়াত সম্বলিত পত্র প্রেরণ করেন, যা ইসলামের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত রয়েছে।

পরিশেষে বলা যায়, রাসূলুল্লাহ (সা) ছিলেন এই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ দাঈ ইলাল্লাহ। তিনি তাঁর জীবনের প্রতিটি মূহুর্ত ব্যয় করেছেন ওহিভিত্তিক ইসলামী দাওয়াতের প্রচার-প্রসার তথা ইসলামের সুমহান আদর্শ মানুষের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। বর্তমান প্রেক্ষিতে আমরাও একজন মুসলিম ও রাসূলুল্লাহ (সা)-এর উম্মত হিসেবে ইসলামের সুমহান আদর্শের দাওয়াত পৌঁছে দেওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ (সা) কর্তৃক নির্দেশিত পদ্ধতি ও কৌশল অবলম্বন করতে পারি। এতে দাওয়াতি কাজে ব্যাপক সফলতা আসবে এবং আল্লাহর জমিনে তাঁর দ্বীন কায়েমের মাধ্যমে আখেরাতেও উত্তম প্রতিদান পাব। মহান আল্লাহ আমাদের তাওফিক দান করুন। আমীন।।

লেখক: প্রধান মুহাদ্দিস (সহকারী অধ্যাপক)

বিজুল দারুল হুদা কামিল মাদরাসা, 

বিরামপুর, দিনাজপুর।

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির