post

ক্ষমতাসীনদের ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ড আগামী প্রজন্মকে ধর্মহীন করার ষড়যন্ত্র

মুহাম্মদ হাফিজুর রহমান

২১ মার্চ ২০২৩

একটি জাতির স্থিতি স্থায়িত্ব এবং উন্নতি নির্ভর করে তাদের বিশ্বাস, আদর্শ এবং চরিত্রের বিকাশ সাধন ও লালনের মাধ্যমে। আমরা যে ভূখন্ডের অধিবাসী বিশ্ব মানচিত্রে তার একটি পরিচয় আছে, পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ওআইসিসহ বিভিন্ন আন্তর্জতিক ইসলামী সংস্থার সদস্য। পৃথিবীর সকল মুসলিম দেশের সাথে আমাদের রয়েছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক। কুটনৈতিক যোগাযোগে পশ্চিমা দুনিয়াকে প্রাধান্য দিলেও বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন ইসলামী ভাবধারায় গঠিত। শতকরা নব্বই ভাগ মুসলমানের দেশে এখানকার মানুষের আদর্শ, চরিত্র ও ও ধর্মীয় বিশ্বাসের যে লালন, বিকাশ ও প্রসার দরকার ছিলো বিগত দেড় দশকে তা প্রসারিত না হয়ে বরং সংকুচিত হয়েছে। শাসকগোষ্ঠীর ইসলাম সংকোচন বা ধর্মীয় সংকোচন নীতিমালার কারণে পদে পদে ইসলামী আদর্শ ও বিশ্বাসের স্থানগুলো আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আদর্শ, বিশ্বাস, চিন্তা, চেতনা ও চরিত্রের বিকাশে সরকারের ভূমিকা ইতিবাচক না হয়ে বরং তা নেতিবাচক ধারায় পরিচালিত হয়েছে এবং হচ্ছে। সরকারের প্রতিটি কর্মকাণ্ড ইসলাম ও ইসলামী আদর্শের বিরুদ্ধে এক সর্বাগ্রাসী আগ্রাসান। আজ আমরা সরকারের নানান ভূমিকার অতি সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরার চেষ্টা করবো- 

ভিনদেশী নায়িকা-গায়িকার ব্যাপক আগমণ

বিগত কয়েক বছর যাবৎ সাংষ্কৃতিক কর্মকান্ডের নামে ভারতীয় এবং বিদেশী শিল্পীদের আগমণ ব্যাপক হারে বেড়েছে। ২০১০ সালে ভারতীয় অভিনেতা শাহরুখ খান একদল নর্তকী নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন নাচ-গাণ করার জন্য। তাদের নাচ-গাণের আসর বসেছিলো আর্মি স্টেডিয়ামে। সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা গেছে, আসন না পেয়ে একজন মন্ত্রী নাকি মাঠেই বসে পড়েছিলেন। সেই প্রদর্শনীর টিকেটের সর্বনিম্ম মূল্য ছিলো পাঁচ হাজার টাকা। এ প্রদর্শনীর দর্শক যারা ছিলো তারা সেখান থেকে কি অর্জন করেছিলো তা জানা না গেলেও মিডিয়ার প্রবল আগ্রহ এবং তাদের তখনকার খবর প্রকাশের ধরন দেখে বোঝা গেছে যে, একদল ভারতীয় নর্তকীয় নাচ-গাণে তারা বিশেষভাবে আহলাদিত হয়েছেন। এমনকি জনৈক মন্ত্রী মহোদয় এমন বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন যে, আসন না পেয়ে মাটিতে বসেই সেই নাচ উপভোগ করেছেন। এদেশে এসে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলই শুধু নয় মিডিয়াপাড়া গরম করেছিলেন আর এক ভারতীয় নারী অভিনেত্রী। তার আগমণ নিয়ে স্বয়ং প্রেসিডেন্টের মূখেও হাস্য রসাত্মক আবেগী বক্তব্য শোনা গেছে। এভাবে শত শত ভারতীয় এবং বিদেশী শিল্পীদের আগমণ এবং সাংষ্কৃতিক কর্মকাণ্ডের নামে যে বেলেল্লাপনা হচ্ছে তা কি সরকারের সহযোগিতা ব্যতীত সম্ভব? একবাক্যে উত্তর হবে, না। বিগত দেড় দশকে সবচেয়ে বেশি ভারতীয় নর্তকী আর গায়িকা এবং গায়কের আগমণ ঘটেছে ২০১৫ সালে। এ বছর অর্ধ শতাধিক কনসার্ট হয়েছে ভারতীয় শিল্পীদের আগমণ উপলক্ষ্যে। এ সকল কনসার্টে আর যাই হোক তরুণ এবং যুবকদের মাঝে এক ধরনের উম্মাদনা তৈরি ব্যতীত আর কিছু উপহার দেওয়া হয় না। 

বিদেশী বিশেষ করে ভারতীয় এ সব নায়িকা-গায়িকাদের বাংলাদেশে আসা এবং অনুষ্ঠান করার ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি ধাপ পার হতে হয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়, সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়, এবং অর্থ মন্ত্রনালয় এবং অনুষ্ঠান করার জন্য অবশ্যই স্থানীয় প্রশাসনের অনুমতি নিতে হয়। সরকারের অনুমতি এবং সহযোগিতায় এ সব অনুষ্ঠান করার মাধ্যমে জাতি কি অর্জন করে বিবেকবান প্রতিটি সচেতন মানুষকে তা ভাবা উচিৎ। যুব সমাজের মধ্যে এক ধরনের বেলেল্লাপনা আর দেউলিয়াত্ব উপহার দেওয়া ব্যতীত এ সকল শিল্পীদের আগমণ ও অনুষ্ঠান দ্বারা জাতি বিকল্প কোনো কিছু লাভ করে বলে মনে করার কোনো কারণ থাকতে পারে না। 

ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানী

শুধুমাত্র ভারতীয় শিল্পীদের কিংবা বিদেশী নায়িকা-গায়িকার আগমণই নয়, সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় যে সকল সাংষ্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয় তার কতটুকু জাতির নৈতিক ও আদর্শিক উন্নয়নের ভূমিকা রাখে? সংষ্কৃতিকে বলা হয় একটি জাতির দর্পন। একটি জাতির আদর্শ, বিশ্বাস, নৈতিকতা, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং স্বাভাবিক জীবনাচারের সামগ্রিক রূপ হচ্ছে সংষ্কৃতি। আমাদের দেশে বর্তমানে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় যে সকল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়, তা আমাদের যুব সমাজের ও তরুণদেরকে তাদের চরিত্র বিকাশ ও গঠনে কতটুকু ভূমিকা রাখে?  এর পাশাপাশি নতুন করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানীর। সাংষ্কৃতিক আদান প্রদান এবং নিজেদেরকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার শ্লোগণের মোড়কে ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানীর সিদ্ধান্ত শতকরা নব্বই ভাগ মুসলমানের ধর্মীয় বিশ্বাস এবং ধর্মীয় বিধানের অনুশীলনের সাথে এ সকল কর্মকাণ্ডের কি কোনো সম্পর্ক আছে? বানর হুতোম প্যাঁচা, ময়ুর আর বিভিন্ন পশুর আকৃতি ধরে নানান সাজে মিছিল করাকে বলা হয় হাজার বছরের সংস্কৃতি। এর সাথে ইসলাম ও মুসলিম জাতিসত্ত্বার কি কোনো সম্পর্ক আছে? মূলত পৌত্তলিকতার আদলে গোটা জাতিসত্ত্বাকে ইসলাম বিমূখ করার একটি প্রচ্ছন্ন প্রচেষ্টা বৈ কিছুই নয়। 

পাঠ্যপুস্তকে ইসলাম বিদ্বেষ

শিশুরা প্রথম শেখে তার পরিবারে, এরপর শেখে বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক তাঁকে জ্ঞান রাজ্যের এক নতুন দিগন্তে নিয়ে যায়। বিগত দেড় দশকে পাঠ্যপুস্তকে আমূল পরিবর্তন আনা হয়েছে। শিশুদের মন ও মনন থেকে ইসলামী ভাবধারা মূছে ফেলার জন্য এমন সব কবিতা গল্প সংযোজন করা হয়েছে যার সাথে মুসলিম জাতিসত্ত্বার কোনো সম্পর্ক নেই। একইভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে ইসলামী ভাবধারায় রচিত গল্প, প্রবন্ধ ও কবিতা। সহপাঠক্রমিক কার‌্যাবলী শিশুদের আত্মিক ও মনাসিক বিকাশে অনন্য ভূমিকা রাখে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় সহপাঠক্রমিক কার্যক্রমে এমন সব বিষয়াবলী যুক্ত করা হয়েছে তার দ্বারা শিশুরা তাদের জাতিসত্ত্বার পরিচয় লাভ করতে পারবে না বরং নিজেদের মুসলিম জাতিসত্ত্বাকে বাদ দিয়ে অন্য পরিচয়ে পরিচিত হয়ে বেড়ে উঠবে। ইসলামী সভ্যতা-সংষ্কৃতি ও শিক্ষার সাথে তাদের দূরত্ব দিনে দিনে শুধু বাড়তে থাকবে। এ সকল কার্যক্রমের সব কিছুই পরিচালিত হয় সরকারের পরিকল্পনার আওতায়। তার মানে সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পরিকল্পনার আওতায় একদল ইসলাম ও মুসলিম জাতিসত্ত্বাবিরোধী নব প্রজন্ম গড়ে ওঠার প্রবল পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। 

ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা

ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রেও এমন সব তুঘলকি কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হচ্ছে যে, আমাদের জাতিসত্ত্বার ভিত্তিমূলকে নাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এই জনপদের রয়েছে কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাস। অস্ট্রিক, রাঢ়, দ্রাবির, আর্য এবং মুসলিম শাসনের প্রাচীন সকল ইতিহাসকে অন্ধকারে রেখে ইতিহাসকে একটি খণ্ডিত সময়ের ফ্রেমে বাঁধাই করে নতুনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। এই জনপদে আটশ বছরের মুসলিম শাসনের সোনালী যুগকে নতুন প্রজন্মের মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা অবিরামভাবে চলছে। ইংরেজ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে হাজী শরীয়তউল্লাহ, তিতুমীর, মুন্সী মেহেরউল্লাহর মতো কালজয়ী বিপ্লবীদেরকে কলমের এক খোঁচায় নাই করে দেওয়া হয়েছে। জাতিসত্ত্বার বিকাশে ইসলামী আদর্শের ধারক ও বাহকদের কোনো ভূমিকা থাকতে পারে তা তরুণ প্রজন্মের মন থেকে মুছে ফেলার আয়োজন ষোলকলা পূর্ণ করেছে। দেশের সকল ইতিহাস, ঐতিহ্য আর অর্জন যেন একটিমাত্র পরিবারের, এমন এক নতুন ইতিহাস গোটা জাতিকে গলধকরণের চেষ্টা চলছে। 

ইসলামী বই বিপনন ও সংরক্ষণে বাধা

সাম্প্রতিককালে ইসলামী বইয়ের প্রকাশকরা নানামূখী বাধার সম্মূখীন হচ্ছেন। কারো কাছে ইসলামী বই পেলে তাকে জঙ্গি, জিহাদী বই আখ্যা দিয়ে গ্রেফতার করার হাজারো ঘটনা পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হয়েছে। মানুষের মনে একটি ভয় ঢুকে গেছে যে, তাদের কাছে ইসলামী বই থাকলে আবার পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যায় কি না? কিংবা জঙ্গি আখ্যা দিয়ে মামলা ঠুকে দিয়ে জেলখানায় পাঠায় কি না। সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা যদি আমরা পর্যালোচনা করি কি দেখতে পাই। ২০২২ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রকে গ্রেফতার করার পর আলামত হিসেবে যা আাদালতে পেশ করা হয়েছে তার মধ্যে একটি ছিলো কুরআনের অনুবাদের একটি কপি। এ ঘটনায় ১১ জন ছাত্রের ছাত্রত্ব বাতিল করা হয়েছিলো। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এ অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ঐ সকল ছাত্রের অভিভাকরা সাংবাদিক সম্মেলন করেছিলেন। সেই সম্মেলনে এক ছাত্রের মা আক্ষেপের সূরে বলেছিলেন, ‘‘আমার ছেলের টেবিলে কুরআন পাওয়া গেছে এ জন্য তাকে শিবির আখ্যা দিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে। কুরআন রাখা যদি অপরাধ হয়, তবে আল্লাহ কুরআন নাজিল করলো কেন?’’ এভাবে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন লোকের কাছে বিশেষ করে তরুণদের কাছে ইসলামী বই কিংবা কুরআন হাদীস পেলে তাকে সরকার বিরোধী কিংবা শিবির আখ্যা দিয়ে গ্রেফতার করা একটি স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়ে গেছে। এমনকি নানান সময়ে জঙ্গি অভিযোগে যাদের গ্রেফতার করা হয় তা নিয়েও রয়েছে নানান ধু¤্রজাল। সম্প্রতি রাজশাহী অঞ্চলের ৩৩ জন সাধারণ মানুষের নাম প্রকাশ করে পুলিশ বলেছে যে, তারা জঙ্গি ছিলো, এখন তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে। কিন্তু যাদেরকে জঙ্গি বলা হয়েছে তারা বলছে ভিন্ন কথা। তারা সাংবাদিকদের বলেছে, আমরা নিতান্ত খেটে খাওয়া মানুষ। আমরা জঙ্গি নই। তাদের বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন দৈনিক ও অনলাইন নিউজে। বাংলা ট্রিবিউনে প্রকাশিত সেই খবরের কিয়দংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি- ‘‘রাজশাহীর মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) বেলপুকুর থানার অভিযুক্ত ও জামিনপ্রাপ্ত ৩৩ জন জঙ্গি স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে বলে দাবি করে করছে পুলিশ। তবে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন অভিযুক্তরা। তাদের দাবি, তারা নিতান্তই সাধারণ মানুষ। বিভিন্ন সময় অন্যায়ভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের আটকে রেখে নির্যাতন করে মিথ্যা স্বীকারোক্তি নিয়েছে। মিথ্যা জঙ্গি মামলা দিয়েছে। অথচ জঙ্গিদের তারা ঘৃণা করেন। ১৬ মার্চ-২০২৩ বিকালে আরএমপির বেলপুকুর থানায় অভিযুক্ত ও জামিনপ্রাপ্ত ৩৩ জন আসামি হাজিরা দিতে আসেন। এ সময় গণমাধ্যমকর্মীরা তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরার বিষয়টি জানতে চাইলেই তারা নিজেদেরকে জঙ্গি না দাবি করে তীব্র প্রতিবাদ জানান। তাদের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে বলে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরেন।

তাদেরই একজন হায়াতুল্লাহ। তিনি বেলপুকুর থানাধীন ভড়াপাড়ার বাসিন্দা। তিনি দাবি করেন, ‘আমি রড মিস্ত্রির কাজ করি। আমাকে রাস্তার ওপর থেকে ধরে নিয়ে এসেছিল। আমি রাস্তা ফিরে যাচ্ছিলাম। কয়েকজন এসে বললো, চলো। আমি বললাম কোথায় যাবে, তারা বললো, স্যার ডেকেছে। কিছু কথা আছে। আমি বললাম, কী কথা এখানেই বলেন। তারা বললো, না যেতে হবে। আমাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো। এক রাত আটকে রেখে নির্যাতন করা হলো। ধরার সময়, আমার কাছে রড মিস্ত্রির কাজের উপকরণ সব নিয়ে নিয়েছে। পরে সামনে কিছু বই দিয়ে আমাকে মামলা দিয়েছে। বইয়ের মামলা দিয়েছে। আমার কী অপরাধ তাও বলেনি। র‌্যাব ধরেছিল। এখন থানায় হাজিরা দিচ্ছি।’

নাম প্রকাশ না করে আরেকজন গভীর নলকূপ মিস্ত্রি বলেন, ‘আমাকে দিয়ে কাজ করাবে বলে ডেকেছিল। একসঙ্গে বসে চা খেলাম। আমাকে বললো, দেখেন তো গাড়িতে লোক আছে না কি? গাড়ির কাছে গেলাম। ধাক্কা দিয়ে গাড়িতে তুলে নিলো। এরপর সাত দিন আটকে রেখে নির্যাতন করা হলো। এরপর রাতে হলিদাগাছি এলাকায় দুটা জিহাদি বই, একটা পিস্তল দিয়ে গ্রেফতার করলো। অথচ আমি জীবনে জঙ্গির কাজ করিনি। আমি মিস্ত্রি মানুষ। কাজ করেই সংসার চলে। এখনও এভাবেই চলছে।’

তাদের আরেকজন ফার্মেসি ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমি আসরের নামাজ পরে মসজিদ থেকে বের হওয়ার পর আমাকে আটক করা হয়েছিল। পরে গোয়েন্দা সংস্থার লোকই তদন্ত করে বলেছিল, তোমাকে কেন আটক করে নিয়ে আসা হয়েছে? তারা আমার কোনো জঙ্গি সম্পৃক্ততা পায়নি। আর আমি কোনোদিনই জঙ্গি ছিলাম না। জঙ্গিকে ঘৃণা করি। তারপরও ২০১৬ সালে আমার ফার্মেসির দোকান থেকে ডেকে এনে মামলা দিয়ে জেলে পাঠিয়েছিল। সেই মামলার জামিনে মুক্ত হয়ে এখনও হাজিরা দিচ্ছি।’’

সামগ্রিক চিত্র আসলে এমনই। একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে যদি ইসলামী বই, কুরআন হাদিস বহন, বিপনন ও সংরক্ষণে আতংকের মধ্যে থাকতে হয় তবে এর চেয়ে দুঃখের বিষয় আর কি হতে পারে। পুলিশের একটি স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে গেছে কারো কাছে ধর্মীয় বই পেলে তাকে জিহাদী/জঙ্গি বই বলে চালিয়ে দেয়ার অপপ্রয়াস। সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্দেশ ব্যতীত যে একাজ হচ্ছে না, সামগ্রিক পরিস্থিতি বিচারে তা ভালোভাবেই বোঝা যায়। 


মাহফিল/ধর্মীয় আলোচনা সভায় বাঁধা

 দেশে ব্যাপকহারে তাফসির এবং ওয়াজ মাহফিল হচ্ছে। কিন্তু এ সকল মাহফিল বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আগে প্রশাসন ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। প্রশাসন এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা যদি মনে করেন এই মাহফিল তাদের জন্য কোনোরূপ সমস্যা সৃষ্টি করবে কিংবা জনগণের মাঝে সরকারের ইসলাম বিরোধী কর্মকাণ্ড তুলে ধরা হবে অথবা এখানে এমনসব গঠনমূলক আলোচনা হবে যাতে মানুষ ইসলামকে জানা ও বোঝার জন্য আগ্রহী হবে তবে তারা নানান ছুতোয় সে সকল মাহফিল বন্ধ করে দেয়। দেশে যেহেতু তাফসীর মাহফিল এবং ওয়াজ মাহফিলের একটি আবহমান ধারা চলে আসছে, এ জন্য আয়োজকরা আগে থেকেই সরকারী দলের লোকদেরকে প্রধান অতিথি করে পোষ্টার ছাপেন। এ সকল মাহফিলে কোনো আলোচক যদি এমন কোনো আলোচনা করেন যা সরকার বা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে যায় তবে তারা মাহফিল বন্ধ করে দেন কিংবা আলোচককে আলোচনায় বাঁধা প্রদান করেন। সারাদেশে এমন অসংখ্য ঘটনা সংগঠিত হয়েছে। শুধু সরকার বিরোধী নয়, ইসলামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা সভা, সেমিনার সিম্পোজিয়ামে পুলিশ পাঠিয়ে বন্ধ করে দেওয়ার মতো অসংখ্য ঘটনা অহরহ ঘটছে। সম্প্রতি ঢাকার মিরপুরে একটি হোটেলে জাকাতের তাৎপর্য শীর্ষক আলোচনা সভায় পুলিশ হানা দিয়ে আলোচনা সভাটি বন্ধ করে দেয় এবং এতে উপস্থিত সবাইকে গ্রেফতার করে নাশকতার ষড়যন্ত্রের মামলা দিয়ে কোর্টে পাঠায়। সরকারের নানামূখি বাধার কারণে একজন তরুণ জনপ্রিয় আলোচককে দেশ ছাড়তে বাধ্য হতে হয়েছে। 


আলেমদের ওপর নির্যাতন

আলেম ও ইসলামপন্থীরা বর্তমানে দেশে কেমন আছেন? এ প্রশ্নের একবাক্যে উত্তর হচ্ছে, না তারা ভালো নেই। নানা অজুহাতে অসংখ্য আলেমকে কারাবন্দী করে রাখা হয়েছে। মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, মাওলানা মামুনুল হক, মাওলানা আমীর হামজা, মাওলানা রফিকুল ইসলাম মাদানীসহ সারাদেশের কারাগারে অসংখ্য আলেমকে নানান অজুহাতে গ্রেফতার করে কারাবন্দী করে রাখা হয়েছে। আলেমদের বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেফতার প্রমাণ করে তারা আলেমদেরকে সহ্য করতে পারছে না। ২০১৩ সালে হেফাজতের সমাবেশে নির্মম নির্যাতনের দৃশ্য জাতি অবলোকন করেছে।  মুফতী ফজলুল হক আমিনীকে ২০০৯ সালে গ্রেফতারের পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এর কিছুদিন পর তিনি ইন্তেকাল করেন। দার্শনিক, গবেষক ও ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা মুফতী কাজী ইবরাহীমকে একটি মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করে দীর্ঘদিন কারাগারে আটক রাখা হয়। এ ছাড়া মুফতী আলী হাসান উসামা, মুফতী জুনায়েদ আল হাবীবসহ অসংখ্য আলেমকে গ্রেফতার করে নির্যাতন করা হয়। ইসলামপন্থী জনতা ও আলেমদের ওপর সরকারের এ নির্যাতনের ধারাবাহিকতা অব্যহতভাবে চলছে। 


ইসলামী প্রতিষ্ঠানসমূহে আগ্রাসান

বর্তমান ক্ষমতাসীন মহল যদিও কথায় কথায় বলে তারা মদিনার শাসন পরিচালন করতে চায়। আবার মাঝে মাঝে শোনা যায় তারাই নাকি ইসলামের সবচেয়ে বড়ো সেবক, কিন্তু তাদের আমলেই ইসলামী প্রতিষ্ঠানসমূহ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে এবং হচ্ছে। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। ইসলামে রয়েছে মানব জীবনের সকল বিষয়ের সুস্পষ্ট নির্দেশনা। এ দেশের একদল ইসলামপ্রিয় মানুষ ইসলামের শ্বাশ্বত নীতিমালার আলোকে অর্থনৈতিক জীবন পরিচালনার জন্য গড়ে তোলেন ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিঃ। সততা নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও দক্ষমতার কারণে এ ব্যাংকটি দেশের এক নাম্বার ব্যাংকে পরিণত হয়। ইসলামী ভাবধারায় গড়ে ওঠে আরো বেশ কয়েকটি ব্যাংক। ইসলামী ভাবধারায় পরিচালিত এ ব্যাংকের অগ্রযাত্রা সহ্য করতে না পেরে সরকার একে একে সাতটি ইসলামী ব্যাংকে নিজেদের পছন্দের লোকদের দ্বারা দখলে নেয়। এভাবে মানুষকে তারা ইসলামী ব্যাংকিং ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিতশ্রদ্ধ করে তোলে। একইভাবে সারাদেশে ইসলামী ভাবধারায় প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দখল করে তার বৈশিষ্ট্যকে ধ্বংস করে। সরকারের লোকদের দ্বারা দখলকৃত কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে : মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম, রাজশাহীর মসজিদ মিশন একাডেমী, চাঁদপুরের আল আমীন একাডেমী ইত্যাদি। 

মাদককে সহজলভ্য করা

সরকার ২০২১ মাদকের জন্য একটি নতুন নীতিমালা করেছে। এ নীতিমালা অনুযায়ী মাদকের জন্য বয়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ২১ বছর। এ নীতিমালায় শহরের কিছু এলাকা নির্দিষ্ট করা হয়েছে যেখানে লাইসেন্স নিয়ে মাদকের ব্যবসা করা যাবে। একইভাবে প্রতি উপজেলায় মাদকের দোকানের লাইসেন্স দেওয়ার প্রস্তাবনা এ আইনে আছে। সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে তা কোনো মতেই পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। এটি আগামী প্রজন্মকে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করবে। এর ফলে অন্যায় অনাচার বৃদ্ধি পাবে। খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, ইভটিজিং, চারিত্রিক ও নৈতিক অধঃপতন গোটা জাতিসত্তার অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলবে। সমাজে একবার মদের অবাধ ব্যবহার চালু হয়ে গেলে আইন করে আর তা থামানো যাবে না। কোনো শুভ চিন্তা ও শুভ বুদ্ধি থেকে কর্তৃপক্ষ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মনে হয় না। আমরা ‘সোনার বাংলা’ গড়ার কথা বলি। সোনার বাংলা গড়ার জন্য অবশ্যই সোনার মানুষ দরকার। কোনো ব্যক্তি মাদকে আসক্ত হলে তার পক্ষে ন্যূনতম মানবীয় মূল্যবোধ ও চারিত্রিক সৌন্দর্য, সৌকর্য ধরে রাখা সম্ভব নয়। সরকার যে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে এটি দেশ, জাতি ও জনগণকে শুধু ধ্বংসের দিকেই নিয়ে যাবে। আমরা ইয়াবা বদীর কথা শুনেছি, তিনি সরকারী দলেরই একজন সংসদ সদস্য। মাদক সেবন, চোরাচালান, এবং ইয়াবা আমদানীতে প্রায়ই আওয়ামীলীগ, যুবলীগ এবং ছাত্রলীগ নেতাদের নাম উঠে আসে। তাদের বিরুদ্ধে সাময়িক কিছু ব্যবস্থা নিলেও পরে সরকারের আশির্বাদে তারা আবার রাজনীতিতে চাঙ্গা হয়ে ওঠেন। রাজনৈতিক পরিচয়ের আড়ালে তারা আবার মাদক ব্যবসাকে চালু করেন। ইসলাম মাদককে চিরকালের জন্য হারাম করেছে। এই নির্দেশ সত্ত্বেও মুসলমান নামধারীরা মাদকের সাথে জড়িত হয়ে পড়ছে। যদিও সরকার মাদকের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়ে রেখেছে কিন্তু সরকারী দলের যে সকল নেতা-কর্মী মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত তারা রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে পার পেয়ে যাচ্ছে। 

বিতর্কিত নারী নীতি

জাতিসংঘের সিডও নীতিমালার আলোকে ২০০৭ সালে সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরীর নেতৃত্বে নারী নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। সে সময় দেশের ইসলামপ্রিয় জনতার প্রবল আপত্তির মূখে তখনকার সরকার এই নীতিমালা বাস্তবায়নের পথ থেকে সরে আসে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর নারী উন্নয়ন নীতিমালা-২০১১ পাশ করে। এদেশের আলেম ও ইসলামপন্থীদের ব্যাপক আপত্তি এবং অভিযোগের পরেও তারা এই নীতিমালা অনুমোদন দেয়। নারীর সম্পদে সমান অধিকার, বিবাহ তালাকে পুরুষের মতো নারীর সমান ক্ষমতার মতো আরো অসংখ্য বিষয় আছে যা ইসলামের নির্দেশ ও আল্লাহর বিধানের বিপরীত। অথচ সরকার এই নীতিমালাকে আইন আকারে পাশ করেছে।  

মূলত সরকারের মূলনীতিই হচ্ছে ইসলামী বিধি বিধানের দমন এবং ইসলাম বিরোধী বিষয়গুলোর লালন। যার কারণে যেখানেই ইসলামের নাম উচ্চারিত হয় সেখানেই সরকারের পক্ষ থেকে খড়গ নেমে আসে। দেশের তরুণ যুবকরা ইসলামী অনুশাসন অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করতে সব সময় একটি আতংকের মধ্যে বসবাস করে। কখন আবার তাকে জঙ্গি কিংবা নাশকতাকারী হিসেবে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। ইসলামী প্রতিষ্ঠানগুলো সব সময় সরকারের নিপীড়নের ভয়ে তটস্থ থাকে। আলেমরা নির্যাতিত। ইসলামী বিধি বিধান পালনে পদে পাদে বাধার সম্মূখীন হতে হয়। গোটা পরিবেশটাই যেন সেক্যুলার তথা ইসলাম বিরোধী ঢঙয়ে গড়ে তোলা হচ্ছে। এ থেকে উত্তরণ হতে না পারলে আগামী প্রজন্ম একটি ধর্মহীন, আদর্শহীন জাতি হিসেবে গড়ে উঠবে। সরকারের এই সকল ইসলাম বিরোধী নীতিমালার বিরুদ্ধে বিবেকবান, ইসলামপ্রিয় জনতাকে সোচ্চার আওয়াজ তোলা সময়ের দাবী। 

লেখক : বিশিষ্ট কলামিস্ট ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির