জান্নাতের বাগানে প্রস্ফুটিত একটি গোলাপ
মোবারক হোসাইন
০২ নভেম্বর ২০১৫
মহান রাব্বুল আলামিনের দ্বীনকে বিজয়ী করার প্রত্যয়ে যারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, তাদের পথ চলা নিঃসন্দেহে বর্ণনাতীত কঠিন। আর এ কাঠিন্যের মাপকাঠি দিয়েই মহান প্রভু তার অতি প্রিয় বান্দাদেরকে বাছাই করে নেন। কিছু বান্দার জীবনকে কবুল করে নিয়ে একটি আদর্শের বুনিয়াদ দুনিয়ার মানুষের জন্য তৈরি করেন সত্যের সাক্ষ্য রূপে। শহীদ ভাইদের স্মৃতি, তাদের আল্লাহ-প্রিয়তা আমাদেরকে অনুপ্রাণিত করে। পথ চলতে চলতে যখন নানা মোহ ভীতি আশঙ্কা আমাদের পথ আগলে দেয় তখন হৃদয়ের মাঝে অমর হয়ে থাকা শহীদের স্মৃতি আমাদের মনে আশার দ্বীপশিখা জালায়। As the stars that are starry in the time of our drakness অর্থাৎ শহীদরা মিল্লাতের জীবন, মিল্লাতের গৌরব দুর্যোগের রাহবার। হতাশাগ্রস্ত মুসাফিরের জন্য তারা দিশাহারা ধ্রুবতারা। শোহাদায়ে কারবালা মুজাহিদদের হৃদয়ে তাইতো সৃষ্টি করে চলছে বিপ্লবের জজবা।
সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব পৃথিবীর চিরন্তন ইতিহাস। মানুষ যখন অন্যায়, অত্যাচার আর অসত্যে নিমজ্জিত, শয়তান তার অনুসারীদের সাথে নিয়ে পৃথিবীতে শয়তানি শক্তির রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে ব্যস্ত; তখন আল্লাহ মানবজাতির কল্যাণে যুগে যুগে পাঠিয়েছেন অসংখ্য নবী-রাসূল ও তাদের সঙ্গী-সাথী হিসেবে প্রেরণ করেছেন দ্বীনের জন্য জীবন উৎসর্গকারী মর্দে মুজাহিদ। নবী-রাসূলদের পর তাদের উত্তরাধিকারীরা এ দায়িত্ব পালনে ব্রত হন। তারা শয়তানি শক্তি নির্মূলের জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করেন, এমনকি জীবনের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে সাক্ষী হয়ে আছেন।
শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা একটি প্রেরণার নাম। একটি আন্দোলনের নাম। যার অসাধারণ মেধা, অতুলনীয় চরিত্র, অনুপম কথামালা, অমায়িক ব্যবহার, পরোপকারী মনোভাব আর আল্লাহভীরু মানসিকতা আমাদের প্রেরণার উৎস। কিন্তু প্রভুর প্রেমে পাগল দ্বীনের পথে এ মুজাহিদ দুনিয়ার এ ক্ষুদ্র স্বার্থে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ থেকে ছিলেন অনেক দূরে। বাড়ি গেলেই সবার সাথে দেখা সাক্ষাৎ করতেন, খোঁজখবর নিতেন, সালাম বিনিময় করে তাদের পারিবারিক কুশলাদি জানতেন। নামাজে ডাকতেন, আর দরদভরা মন নিয়ে মানুষকে ইসলামের কথা বুঝাতেন।
শহীদের মিছিলে এক অগ্রসেনানী শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা। ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর, তিনি এই মিছিলে যোগ দেন। সেদিন ইসলামী আন্দোলনের ইতিহাসে রক্ত দিয়ে লিখে গেছেন নিজের নাম- শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা। চলে গেছেন জান্নাতে তাঁর প্রভুর সন্নিকটে। জীবন- মৃত্যুর মালিক আল্লাহ এবং মৃত্যুর ফয়সালা আসমানে হয়, জমিনে নয়। এ সময় এভাবে যদি আল্লাহ মৃত্যু নির্ধারণ করে থাকেন; তাহলে কারো সাধ্য নেই মৃত্যুকে ঠেকানোর। আর তা যদি না হয়ে থাকে তাহলে এমন কোন শক্তি নেই মৃত্যু কার্যকর করার। আর শাহাদাতের মৃত্যুই শুধু পারে জান্নাতের নিশ্চয়তা দিতে। ‘আমি কি ক্ষমা চেয়ে প্রার্থনা করব যে, আমাকে জান্নাত থেকে বাঁচাও?’ মৃত্যুকে জয় করল এ সাহসী উচ্চারণ। এ হলো আল্লাহ তায়ালার প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও ভালোবাসার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আল্লাহ তায়ালার অমিয় বাণী : ‘প্রত্যেক আত্মাকেই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে।’ পৃথিবীর জীবন ক্ষণস্থায়ী আর মৃত্যু এক অনিবার্য বাস্তবতা। মৃত্যুর পরবর্তী অবস্থা নিয়ে মতভেদ আছে, কিন্তু একদিন সবাইকে মরতে হবেÑ সে বিষয়ে ধর্ম-বর্ণ নির্বেশেষে কোন মতপার্থক্য নেই।
আব্দুল কাদের মোল্লা আমাদের প্রেরণা। তার অপরাধ তিনি মানুষকে কুরআন ও হাদিসের কথা বলতেন। ইসলামী আন্দোলন করাই তার বড় অপরাধ। তিনি বাংলাদেশেকে একটি ইসলামী কল্যাণরাষ্ট্রে পরিণত করার স্বপ্ন দেখতেন।
কাদের মোল্লার সংক্ষিপ্ত জীবনী
ফরিদপুর জেলার সদরপুর উপজেলার আমিরাবাদ গ্রামের মরহুম সানাউল্লা মোল্লার ছেলে আবদুল কাদের মোল্লা ১৯৪৮ সালের ২ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকায় ৪৯৩ বড় মগবাজারে গ্রিন ভ্যালি অ্যাপার্টমেন্টের ৮/এ ফ্ল্যাটে থাকতেন। কাদের মোল্লা ১৯৬১ সালে আমিরাবাদ ফজলুল হক ইনস্টিটিউশনে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। ১৯৬৬ সালে ফরিদপুরের সরকারি রাজেন্দ্র কলেজে বিএসসি প্রথম বর্ষে পড়ার সময় ছাত্র ইউনিয়ন ছেড়ে ইসলামী ছাত্রসংঘে যোগদান করেন।
১৯৬৮ সালে সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করে ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগে মাস্টার্সে ভর্তি হন কাদের মোল্লা। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবের শাসনকালেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থিত উদয়ন হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। এরপর ১৯৭৪ সালে তিনি সরকারি প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ফাউন্ডেশনে চাকরি নেন। এ সময় তার বিরুদ্ধে দেশের কোথাও হত্যা মামলা দাখিল করা হয়নি।
১৯৭৮ সালে তিনি ঢাকার রাইফেল পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পরে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮০ সালে বাংলাদেশে সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত ফুয়াদ আবদুল হামিদ আল খতিবের ব্যক্তিগত উদ্যোগে ও আর্থিক সহায়তায় দেশে মুসলমান ছেলে-মেয়েদের আন্তর্জাতিক মানের একটি ইংলিশ স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে গুলশান ১ নম্বর মার্কেটের দক্ষিণ পাশে ‘মানারাত ইন্টারন্যাশনাল স্কুল’ নামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, যা বর্তমানে মানারাত ইউনিভার্সিটি হিসেবে পরিচিত। সেখানে তিনি প্রায় এক বছর কাজ করেন।
১৯৮০ সালে তিনি দৈনিক সংগ্রামে নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ঢাকা মহানগর জামায়াতের কর্মপরিষদের সদস্য এবং এরপর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল পদে দায়িত্ব পান। পরে আবদুল কাদের মোল্লা জামায়াতের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল পদে দায়িত্ব পান। তিনি ১৯৮৬ ও ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদের নির্বাচনে ফরিদপুর-৪ (সদরপুর-চরভদ্রাসন) আসনে জামায়াত থেকে নির্বাচন করেন।
কাদের মোল্লা ১৯৯৫ সালে কেয়ারটেকার সরকার আন্দোলনে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে সর্বদলীয় লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য হিসেবে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন। এ ছাড়া ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তিনি সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।
উপেক্ষিত আন্তর্জাতিক মহল ও মানবাধিকার সংগঠনের উদ্বেগ
উদ্বিগ্ন অ্যামনেস্টি : আপিল বিভাগে ফাঁসির রায়ের পর এক বিবৃতিতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশবিষয়ক গবেষক আব্বাস ফয়েজ বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের রায় এবং কাদের মোল্লার ফাঁসি নিশ্চিত করার জন্য দৃশ্যত সরকারের অবিরাম প্রচেষ্টায় আমরা উদ্বিগ্ন। আমরা তার মৃত্যুদন্ড মওকুফের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই।
সংগঠনটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ওই বিবৃতিতে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদন্ড মওকুফের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে অ্যামনেস্টি। বিবৃতিতে মৃত্যুদন্ডের বিধান বাতিলেরও আহ্বান জানানো হয়।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ : আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায়ে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের মানদন্ড লঙ্ঘিত হয়েছে বলে বর্ণনা করে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।
এক বিবৃতিতে নিউ ইয়র্কভিত্তিক সংগঠনটির এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্র্যাড এডামস বলেন, ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সব সময় ১৯৭১ সালে সংঘটিত বর্বরতার বিচার চেয়ে আসছে। কিন্তু এই বিচার ন্যায়সঙ্গতভাবে ও আইনানুযায়ী হওয়া উচিত।’
এ ব্যাপারে এডাম জানান, কোনো কারণে মৃত্যুদন্ড দেয়া হলেও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা খুব জরুরি। আন্তর্জাতিক রীতি মেনে বাংলাদেশ সরকারের মৃত্যুদন্ডের মতো বর্বর শাস্তি থেকে বেরিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
তবে শুরু থেকেই যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে দেশে-বিদেশে তীব্র সমালোচনা হয়। জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সব মানবাধিকার সংগঠন এই বিচারের স্বচ্ছতা ও মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
এ দিকে ফাঁসির রায় স্থগিত রাখার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ব্রিটেনও আহ্বান জানিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিবৃতিতে বলা হয়, ইইউ সব পরিস্থিতিতে মৃত্যুদন্ডের বিরোধিতা করে। এতে আরও বলা হয়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ বিচারের শুরু থেকেই বারবার আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করা ও মৃত্যুদন্ডের বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে আসছে।
এ দিকে আব্দুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর স্থগিতের আহ্বান জানিয়ে ব্রিটেনের পররাষ্ট্রবিষয়ক মন্ত্রী সাঈদা ওয়ার্সি এক বিবৃতিতে বলেছেন, কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের দেয়া রায় রিভিউ করতে অনুমতি দেয়া হয়নি বলে আমরা জেনেছি। নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের আন্তর্জাতিক চুক্তি (আইসিসিপিআর) স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে সব নাগরিকের প্রতি সমানভাবে আইন প্রয়োগ করা উচিত বলেও মন্তব্য করেন ওয়ার্সি।
ওয়ার্সি বলেন, ‘কাদের মোল্লার মৃত্যুদন্ডে আমি উদ্বিগ্ন। ব্রিটেন সব পরিস্থিতিতে মৃত্যুদন্ডবিরোধী। এটা মানুষের মর্যাদা ক্ষুণœ করে।’
এ দিকে সৌদি আরবের প্রভাবশালী সংবাদপত্র সৌদি গেজেটে ৮ ডিসেম্বর প্রকাশিত এক নিবন্ধে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী টবি ক্যাডম্যান যুদ্ধাপরাধের বিচারের মান নিয়ে কড়া সমালোচনা করেছেন। কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করা হলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা আরও বৃদ্ধি পাবে বলেও হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন ক্যাডম্যান।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্বসম্প্রদায়ের মতামত উপেক্ষা করে কাদের মোল্লাকে জবরদস্তিমূলকভাবে মৃত্যুদন্ড দিলে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা মারাত্মকভাবে ক্ষুণœ হবে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্টদের ভবিষ্যতে জবাবদিহিতার মুখোমুখি, এমনকি কাঠগড়ায়ও দাঁড়াতে হতে পারে।
কাদের মোল্লার ফাঁসি বন্ধে
আন্তর্জাতিক চাপ
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় স্থগিত রাখার জন্য সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি হয়েছে। বিচারের ‘স্বচ্ছতা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলে ফাঁসির রায় স্থগিত রাখার জন্য সরকারের ওপর প্রকাশ্যেই চাপ দিয়েছে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া। জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে দুই স্বাধীন বিশেষজ্ঞ ও বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার গ্যাব্রিয়েলা নাউল ও ক্রিস্টফ হেইনস আপিলের সুযোগ না দিয়ে কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর না করার আহ্বান জানিয়েছেন।
এ দিকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করে দেশের বিরাজমান পরিস্থিতির পাশাপাশি আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকরের বিষয়ে ওয়াশিংটনের নেতিবাচক মনোভাবের কথা জানান।
হাসিনাকে এরদোগানের টেলিফোন : জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর না করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন মুসলিম বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী রিসেপ তাইয়েব এরদোগান।
আজীবন শহীদি মৃত্যু চেয়েছি : আইনজীবীদের কাদের মোল্লাÑ আব্দুল কাদের মোল্লা বলেছেন, আমি আজীবন শহীদি মৃত্যু কামনা করেছি। তার আইনজীবীরা কারাগারে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে কাদের মোল্লা তাদের এ কথা বলেন। পরে কাদের মোল্লার এ বক্তব্য সাংবাদিকদের জানান তার আইনজীবী এম তাজুল ইসলাম।
কাদের মোল্লার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে তার অন্যতম আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম দৈনিক আমার দেশকে জানান, মৃত্যুদন্ডের চূড়ান্ত আদেশপ্রাপ্ত একজন মানুষের সঙ্গে তার জীবনের প্রথম সাক্ষাতে তিনি মুগ্ধ ও স্তম্ভিত। তাজুল ইসলাম বলেন, নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কী করে একজন মানুষ এমন অবিচল ও শঙ্কাহীন থাকতে পারেন? একজন সত্যিকার ইসলামী আন্দোলনের নেতার মতোই স্মিত হেসে আমাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন তিনি। আইনি বিষয়ে পরামর্শের পাশাপাশি তিনি বলছিলেন তার নিজের কথা।
কাদের মোল্লা তাজুল ইসলামকে বলেছেন, তিনি জীবনে যেসব অপরাধের কথা চিন্তাও করেননি তার দায় তার ওপরে চাপানো হয়েছে। যে জায়গায় তিনি কখনও যাননি, যাদের কখনও দেখেননি, সেই জায়গায় ওই লোকদের হত্যার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে আনা হয়েছে। ভুয়া ও সাজানো লোকদের সাক্ষী বানিয়ে আদালতে আনা হয়েছে।
এমন কঠিন অবস্থায় কেমন লাগছে, জানতে চাইলে আইনজীবীকে কাদের মোল্লা বলেন, ‘আজীবন শহীদি মৃত্যু কামনা করেছি। অনেক আগে ছাত্রজীবনে শহীদ সাইয়েদ কুতুবের শাহাদাতের ইতিহাস বলতে গিয়ে অধ্যাপক গোলাম আযম আমার গলায় স্নেহের হাত রেখে বলেছিলেন, একদিন এই ফাঁসির দড়ি তোমার গলায়ও পরতে পারে।’ এ ইতিহাস বলতে গিয়ে ক্ষণিকের জন্য আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন তিনি। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, ‘আমি আব্দুল কাদের মোল্লা কোনো অপরাধ করিনি। তোমরা নিশ্চিত থাকো, মাথা উঁচু ছিল উঁচুই থাকবে। তোমরা কখনও আমার চোখে পানি দেখবে না, ইনশাআল্লাহ।’
জবানবন্দীতে যা বলেছিলেন কাদের মোল্লা : যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা চলাকালে আত্মপক্ষ সমর্থন করে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন জামায়াত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লা। জবানবন্দীতে কাদের মোল্লা বলেন, ১৯৭১ সালের ১২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের আমিরাবাদ চলে যান এবং মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়ই তিনি গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করেন। গ্রামে অবস্থানকালে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও হাইস্কুলের প্রায় ৩০ জন ছাত্রের সাথে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ থেকে ১ মে পর্যন্ত (পাকিস্তান সেনাবাহিনী ফরিদপুরে পৌঁছার দিন পর্যন্ত) অন্যদের সাথে তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ চালিয়ে যান। সেনাবাহিনীর জুনিয়র কমিশনড অফিসার (জেসিও) মফিজুর রহমান ডামি রাইফেল দিয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দেন।
জবানবন্দীতে কাদের মোল্লা আরো বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর এতদিন আমার বিরুদ্ধে কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতাদের সাথে এক সাথে মিছিল-মিটিং ও রাজনীতি করেছি। যাদের সাথে এতদিন রাজনীতি করলাম, মিছিল-মিটিং করলাম, সম্পর্ক রাখলাম, তারা এখন শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য ট্রাইব্যুনালে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করেছে। আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সংশ্লিষ্টতা ছিল না বা নেই। গত ৪০ বছর সময়ের মধ্যে কোনো পত্রপত্রিকায় বা কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে আমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উত্থাপন করা হয়নি। আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগগুলো মিথ্যা, বানোয়াট, কাল্পনিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
স্ত্রীকে লেখা আব্দুল কাদের মোল্লার
শেষ চিঠি
বিসমিল্লাহির রহমানির রাহিম। প্রিয়তমা জীবন সাথী পেয়ারী, আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। আজ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর খুব সম্ভব আগামী রাত বা আগামীকাল জেলগেটে আদেশ পৌঁছানোর পরই ফাঁসির সেলে আমাকে নিয়ে যেতে পারে। এটাই নিয়ম। সরকারের সম্ভবত শেষ সময়। তাই শেষ সময়ে তারা এই জঘন্য কাজটি দ্রুত করে ফেলার উদ্যোগ নিতে পারে। আমার মনে হচ্ছে তারা রিভিউ পিটিশন গ্রহণ করবে না। যদি করেও তাহলে তাদের রায়ের কোন পরিবর্তন হওয়ার দুনিয়ার দৃষ্টিতে কোনো সম্ভাবনা নেই। মহান আল্লাহ যদি নিজেই এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সিদ্ধান্ত কার্যকর করেন, তাহলে ভিন্ন কথা। অথচ আল্লাহর চিরন্তন নিয়মানুযায়ী সব সময় এমনটা করেন না। অনেক নবীকেও তো অন্যায়ভাবে কাফেররা হত্যা করেছে। রাসূলে করীম (সা) এর সাহাবায়ে কেরাম এমনকি মহিলা সাহাবীকেও অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে। আল্লাহ অবশ্য ঐ সমস্ত শাহাদাতের বিনিময়ে সত্য বা ইসলামকে বিজয়ী করার কাজে ব্যবহার করেছেন। আমার ব্যাপারে আল্লাহ কি করবেন তা তো জানার উপায় নেই। গতকাল ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং এসে আওয়ামী লীগকে শুধু সাহসই দেন নাই, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে চাপও দিয়েছেন। এবং সতর্ক করার জন্য জামায়াত-শিবিরের ক্ষমতায় আসার ভয়ও দেখিয়েছেন। এতে বুঝা যায় যে জামায়াত এবং শিবিরভীতি এবং বিদ্বেষ ভারতের প্রতি রক্তকণায় কিভাবে সঞ্চারিত। আমি তো গোড়া থেকেই বলে আসছি, আমাদের বিরুদ্ধে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে এটার সবটা ছকই ভারতের অঙ্কন করা। আওয়ামী লীগ চাইলে এখান থেকে পেছাতে পারবে না। কারণ তারা ভারতের কাছে আত্মসমর্পণের বিনিময়েই এবার ক্ষমতা পেয়েছে। অনেকেই নীতি নৈতিকতার প্রশ্নে কথা বলেন। আমাকেসহ জামায়াতের সকলকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে যে কায়দায় জড়ানো হয়েছে এবং আমাদের দেশের প্রেসের প্রায় সবগুলোই সরকারকে অন্যায় কাজে সহযোগিতা করছে, তাতে সরকারের পক্ষে নীতিনৈতিকতার আর দরকার কি? বিচারকরাই স্বয়ং যেখানে জল্লাদের ভূমিকায় অত্যন্ত আগ্রহভাবে নিরপরাধ মানুষকে হত্যার নেশায় মেতে উঠেছে তাতে স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের আশা অন্তত এদের কাছ থেকে করা কোনক্রমেই সমীচীন নয়। তবে একটি আফসোস, যে আমাদেরকে বিশেষ করে আমাকে যে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে মৃত্যুদন্ডাদেশ দেয়া হয়েছে, তা জাতির সামনে বলে যেতে পারলাম না। গণমাধ্যম বৈরী থাকায় এটা পুরোপুরি সম্ভবও নয়। তবে জাতি পৃথিবীর ন্যায়পন্থী মানুষ অবশ্যই জানবে এবং আমার মৃত্যু এই জালেম সরকারের পতনের কারণ হয়ে ইসলামী আন্দোলন অনেক দূর এগিয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। কালই সূরা আত-তাওবার ১৭ থেকে ২৪ আয়াত আবার পড়লাম। ১৯ নং আয়াতে পবিত্র কাবাঘরের খেদমত এবং হাজীদের পানি পান করানোর চাইতে মাল ও জান দিয়ে জেহাদকারীদের মর্যাদা অনেক বেশি বলা হয়েছে। অর্থাৎ স্বাভাবিক মৃত্যুর চাইতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আল্লাহর দেয়া ন্যায়ভিত্তিক ব্যবস্থা অর্থাৎ ইসলাম প্রতিষ্ঠার জেহাদে মৃত্যুবরণকারীদের আল্লাহর কাছে অতি উচ্চ মর্যাদার কথা আল্লাহ স্বয়ং উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ নিজেই যদি আমাকে জান্নাতের মর্যাদার আসনে বসাতে চান তাহলে আমার এমন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত। কারণ জালেমের হাতে অন্যায়ভাবে মৃত্যু তো জান্নাতের কনফার্ম টিকেট। সম্ভবত ১৯৬৬ সালে মিসরের জালেম শাসক কর্নেল নামের সাইয়্যেদ কুতুব, আবদুল কাদের আওদাসহ অনেককে ফাঁসি দিয়েছিলেন। “ইসলামী আন্দোলনের অগ্নিপরীক্ষা” নামক বিষয়ে বিভিন্ন শিক্ষাশিবিরে বক্তব্য শুনেছি। একাধিক বক্তব্যে অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেব বাম হাতটা গলার কাছে নিয়ে প্রায়ই বলতেন, ‘ঐ রশি তো এই গলায়ও পড়তে পারে’। আমারও হাত কয়েকবার গলার কাছে গিয়েছে। এবার আল্লাহ যদি তার সিদ্ধান্ত আমার এবং ইসলামের অগ্রগতির সাথে সাথে জালেমের পতনের জন্য কার্যকর করেন, তাহলে ক্ষতি কি? শহীদের মর্যাদার কথা বলতে গিয়ে রাসূলে করিম (সা) বারবার জীবিত হয়ে বারবার শহীদ হওয়ার কামনা ব্যক্ত করেছেন। যারা শহীদ হবেন, জান্নাতে গিয়ে তারাও আবার জীবন এবং শাহাদাত কামনা করবেন। আল্লাহর কথা সত্য, মুহাম্মদ (সা) এর কথা সত্য। এ ব্যাপারে সন্দেহ করলে ঈমান থাকে না। এরা যদি সিদ্ধান্ত কার্যকর করে ফেলে তাহলে ঢাকায় আমার জানাজার কোনো সুযোগ নাও দিতে পারে। যদি সম্ভব হয় তাহলে মহল্লার মসজিদে এবং বাড়িতে জানাজার ব্যবস্থা করবে। পদ্মার ওপারের জেলাগুলোর লোকেরা যদি জানাযায় শরিক হতে চায়, তাহলে আমাদের বাড়ির এলাকায়ই যেন আসে। তাদেরকে অবশ্যই খবর দেয়া দরকার। কবরের ব্যাপারে তো আগেই বলেছি আমার মায়ের পায়ের কাছে। কোন জৌলুসপূর্ণ অনুষ্ঠান বা কবর বাঁধানোর মতো বেদআত যেন না করা হয়। সাধ্যানুযায়ী ইয়াতিমখানায় কিছু দান খয়রাত করবে। ইসলামী আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সাহায্য সহযোগিতা করবে। বিশেষ করে আমার গ্রেফতার এবং রায়ের কারণে যারা শহীদ হয়েছে, অভাবগ্রস্ত হলে ঐসব পরিবারকে সাহায্য সহযোগিতার ব্যাপারে অগ্রাধিকার দিতে হবে। হাসান মওদুদের পড়াশুনা এবং তা শেষ হলে অতি দ্রুত বিবাহ শাদির ব্যবস্থা করবে। নাজনীনের ব্যাপারেও একই কথা। পেয়ারী, হে পেয়ারী, তোমাদের এবং ছেলেমেয়ের অনেক হকই আদায় করতে পারিনি। আল্লাহর কাছে পুরস্কারের আশায় আমাকে মাফ করে দিও। তোমার জন্য বিশেষভাবে দোয়া করেছি যদি সন্তান-সন্ততি এবং আল্লাহর দ্বীনের জন্য প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে আল্লাহ যেন আমার সাথে তোমার মিলিত হওয়ার ব্যবস্থা করেন। এখন তুমি দোয়া করো, যাতে আমাকে দুনিয়ার সমস্ত মায়া-মহব্বত আল্লাহ আমার মন থেকে নিয়ে শুধু আল্লাহ এবং রাসূলে করীম (সা) এর মহব্বত দিয়ে আমার সমস্ত বুকটা ভরে দেন। ইনশাআল্লাহ, জান্নাতের সিঁড়িতে দেখা হবে। সন্তানদেরকে সবসময় হালাল খাওয়ার পরামর্শ দেবে। ফরজ, ওয়াজিব, বিশেষ করে নামাজের ব্যাপারে বিশেষভাবে সকলেই যত্নবান হবে। আত্মীয়-স্বজনদেরকেও অনুরূপ পরামর্শ দেবে। আব্বা যদি ততদিন জীবিত থাকেন তাকে সান্ত্বনা দেবে।
তোমাদেরই প্রিয়
আব্দুল কাদের মোল্লা
ইতালির কবি দান্তে বলেছিলেন, অর্থাৎ নৈতিক সঙ্কটের সময় যারা নিরপেক্ষ থাকে তাদের জন্য দোজখের সবচেয়ে উত্তপ্ত জায়গাটি সংরক্ষিত আছে। কাজেই গণতান্ত্রিক ও নৈতিক বোধসম্পন্ন কোনো মানুষের পক্ষে এখন নীরব থাকা সম্ভব নয় একটি কঙ্কর নিয়ে হলেও গণতন্ত্রের পক্ষে আজ দাঁড়াতে হবে। থমাস জেফারসনের ভাষায় অর্থাৎ অবিচার যখন আইন হয়ে পড়ে প্রতিরোধ তখন কর্তব্য হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই সামনে উদ্ভূত পরিস্থিতির সব দায়টুকু এই নব্য বাকশালকেই নিতে হবে। হত্যা, নিপীড়ন, জিম্মি করে টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজি অব্যাহত রেখে ভয়-হুমকি-ধমকি দিয়ে রক্ত পিচ্ছিল করেছে এই অকুতোভয় সংগ্রামী কাফেলার। নির্যাতন, হত্যা ও সন্ত্রাসের শিকার এই সংগঠনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও মিডিয়া আগ্রাসন চালিয়েছে যৌথভাবে। সত্যকে মিথ্যা দিয়ে আর মিথ্যাকে সত্য দিয়ে ঢাকার অপপ্রয়াস চালিয়েছে হরদম। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের রক্তে ভাসছে দেশ। এই রক্তের বদলা অবশ্যই আল্লাহ দেবেন। আমরা মোটেই বিচলিত নই। আমরা দেশবাসীর দোয়া চাই। শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লার জীবনের বিনিময়ে যেন ইসলামী আন্দোলন, দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বকে আল্লাহ হেফাজত করেন। মহান আল্লাহর কাছে এটাই আমাদের কামনা।
লেখক : কেন্দ্রীয় সাহিত্য সম্পাদক, বিআইসিএস
আপনার মন্তব্য লিখুন