post

তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতায় সাংস্কৃতিক উচ্ছ্বাস আমাদের করণীয়

ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ

০৭ জুলাই ২০২৩

তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে পৃথিবী এখন হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। সোশ্যাল মিডিয়াও এখন শহর নগর পেরিয়ে গাঁও-গেরামের প্রতিটি জনপদে। স্মার্টফোনের সুবাদের রাতারাতি সকলেই স্মার্ট হতে চায়। স্কুলপড়য়া ছাত্রছাত্রীদের হাতে এখন বইখাতার চেয়ে স্মার্ট ফোনটাই বেশি মজাদার। স্কুলের নানা কাজে তথ্যপ্রযুক্তির সংযুক্তির ফলে এটাকে সবচেয়ে জরুরি বলে উপস্থাপন করার সুযোগও পাচ্ছে আমাদের তরুণরা। গুগলের লেখাপড়া যতক্ষণ চলে তার চেয়ে শতগুণ সময় কেটে যায় মিডিয়ার অলিগলিতে। ফেসবুক এখন আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নয়, বরং চটকদার অশ্লীল মিনি সিনেমায় পরিণত হয়েছে। রিলস, শর্টফিল্ম, টিকটকসহ বিভিন্ন নামে এখন চরম নোংরামি ছড়িয়ে গেছে। এসব বিষয়বস্তুর প্রভাব এখন ছড়িয়ে গেছে সামাজিক জীবনের প্রতিটি ধাপে। সর্বত্র এখন এর বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কর্মসূচি গ্রহণ এখন ব্যাপক গুরুত্বের দাবিদার। 

একসময় বিনোদন সংস্কৃতি ছিল পার্বণিক উৎসবের মতো। রাজাবাদশাহদের জলসাঘরে সঙ্গীত নৃত্যের আয়োজন থাকলেও সাধারণ মানুষের কাছে এসব ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন লোকজ অনুষ্ঠানই ছিল সাধারণ মানুষের বিনোদনের খোরাক। কিন্তু বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষতায় বিনোদনের পুরো বাক্স এখন সকলের ঘরে ঘরেই শুধু নয়, মোবাইল ও ইন্টারনেট টেকনোলজির মাধ্যমে সকলের হাতের তালুবদ্ধ হয়ে পড়েছে। ফলে আমাদের শিশুরাও এখন সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ‘ইঁচড়ে পাকা’ শব্দকে টেক্কা দিয়ে অবাক হবার মতো নানা রকম কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। এটা যতটা পজিটিভ ক্ষেত্রে দেখা যায় তার কোন অংশেই কম দেখা যাচ্ছে না নেগেটিভ সাইটে। অন্যদিকে খেলার মাঠসহ ক্রীড়া-বিনোদনের স্থান, সময় ও পরিবেশ সঙ্কুচিত হওয়ার ফলে আমাদের স্বপ্নের নতুন প্রজন্ম কম্পিউটার, ল্যাপটপ এবং ভিডিও গেমসকে নেশার মতো আঁকড়ে ধরেছে। ফলে শারীরিকভাবেও যেমন তারা অনেকটা দুর্বল হয়ে গড়ে উঠছে তেমনি চিন্তাগতভাবেও তাদের অন্যরকম একটা অবস্থান তৈরি হচ্ছে। ক্রমশ পাপেট সোসাইটি তৈরি হতে চলেছে। কারণ, তাদের ব্যবহৃত বিনোদন মাধ্যমগুলো আমাদের দেশজ এবং স্বকীয় কালচারের ভিত্তিতে তৈরি নয়। সুতরাং পরিবেশ পরিপ্রেক্ষিত এবং আশা-আকাক্সক্ষার সমন্বয় করতে চাইলে এখনই নতুনভাবে চিন্তা করার মোক্ষম সময়।

আধুনিকতা শব্দটি ‘ওয়েস্টার্ন কালচার’-এর ফ্যাশনে উত্তর-আধুনিকতার নামে প্রকারান্তরে চিন্তা ও বাহ্যিকতায় পশ্চিমাবিশ্বের প্রতিচ্ছবি হিসেবে প্রচলিত হয়ে আসছে। আর তারই একজন সম্মানিত সদস্য হিসেবেই আমরা নিজেদেরকে মানিয়ে নিচ্ছি; এমনকি পশ্চিমা সংস্কৃতির ধারক বাহক হিসেবে ভাবতে গর্ববোধ করছি। মুসলিম সংস্কৃতির মূলকথা ঈমান বা বিশ্বাস হলেও পশ্চিমাবিশ্ব সংস্কৃতি বলতে চিত্তবিনোদনের উপায়কেই উপস্থাপিত করছে। কেননা বিশ্বাসের ভিতে আঘাত করতে বাধা যতটা প্রকট হবে, চিত্তবিনোদনের নামে অশ্লীল গান, নৃত্য, নগ্নতা, উলঙ্গপনা প্রভৃতির নেশায় বাগিয়ে নেওয়া ততটা কঠিন নয়। তাইতো মডার্নিজম, সোস্যালিজম তথা আধুনিকতা ও সামাজিক আভিজাত্যের খোলসে যুবক-যুবতীর নগ্নতা, লিভটুগেদার, নারী দেহের উলঙ্গ প্রদর্শনী এসব নির্লজ্জতা ও রুচিহীনতাকে শিল্প সৌকর্যের নান্দনিক বিষয় হিসেবে উপস্থাপিত করা হয়ে থাকে। সে প্রেক্ষিতে খেলাধুলা থেকে শুরু করে যে কোনো আনুষ্ঠানিকতায় যে যত নগ্নতা প্রদর্শন করতে সক্ষম সে ততটা অভিজাত, উন্নত, উত্তরাধুনিক ও মুক্ত সংস্কৃতির সার্থক শিল্পী হিসেবে বিবেচিত। নারীদেহের নগ্ন উপস্থাপনাকে আধুনিক শিল্পের নান্দনিকতার পূর্ণাঙ্গ রূপ হিসেবে কবিতায়, গল্পে, প্রবন্ধে, নাটকে, সিনেমায় কিংবা অন্য কোনো বিনোদন অনুষ্ঠানে সার্থকভাবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সত্যিকার অর্থে নারী-সৌন্দর্যকে নান্দনিকতার মোড়কে নগ্নচিত্রে উপস্থাপিত করে নৈতিক পদস্খলনকে বাহন বানিয়ে শয়তান মানব মনে ছড়িয়ে পড়ে ।

বিশ্বাস সব সময়ই পরিবর্তনশীল। তাই মনের সামনে বিভিন্ন চিত্র প্রদর্শিত হতে হতে যেটা হৃদয়গ্রাহী ও মনে ক্রিয়াশীল হবে সেটার প্রতিই সৃষ্টি হবে বিশ্বাস। আর বিশ্বাস সৃষ্টির প্রধান বাহন প্রচার বা মিডিয়া। যে জাতি সংবাদ ও তথ্যপ্রযুক্তি তথা গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে যত উন্নত সে জাতির বিশ্বাস, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, সভ্যতা তথা জীবনযাত্রা ততটা সমৃদ্ধ এবং সেই সমৃদ্ধ ইতিহাস ও আত্মবিশ্বাসের ওপর ভর করেই তারা বিশ্বকে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে। তাই মহানবীসহ সা. মুসলমানগণ শুধুমাত্র ধর্মীয় বিষয়েই সচেতন ছিলেন না বরং রাজনীতি, সমাজ, দর্শন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সমরনীতি প্রভৃতি ক্ষেত্রেও তারা সচেতনতার সাথে সংবাদ ও তথ্য সংগ্রহ করেই পথ চলতেন। এমনকি চরম নির্যাতনের মধ্যে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পূর্বে মহানবী সা. মদিনার সঠিক অবস্থা অবগত হওয়ার জন্য বিশ্বস্ত সাহাবি হযরত মুসাব রা.কে প্রেরণ করেছিলেন। যে যুগে কাগজের প্রচলন না থাকলেও তথ্য সংরক্ষণের জন্য মহানবী সা. ও সাহাবিগণ খুবই তৎপর ছিলেন এবং চামড়া, হাড়, গাছের ছাল, পাতা এমনকি পাথরে খোদাই করে তথ্য সংরক্ষণ করেছিলেন। সুতরাং বিজ্ঞানের এ চরম উৎকর্ষতা ও উত্তর-আধুনিককালে সেই মুসলিম জাতি সংবাদ ও তথ্যপ্রযুক্তির অঙ্গনে পিছিয়ে থাকবে তা কল্পনা করা যায় না।

বাংলাদেশে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর অভাব যতটা তার চেয়ে বেশি অভাব মূল্যবোধসম্পন্ন সুনাগরিক। এ ধরনের নাগরিক তৈরি করতে পারলেই কাক্সিক্ষত সোনালি স্বপ্নের সোনার দেশ গড়া সম্ভব। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে, বাংলাদেশ স্বাধীনতার চার দশক পার করলেও এ পর্যন্ত শিক্ষানীতি নিয়ে শুধু পরীক্ষা নিরীক্ষাই চলছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমাদের ক্ষমতাসীন সরকারও এখন আবার ধর্মনিরপেক্ষতার মোড়কে ধর্মহীন শিক্ষানীতির দিকেই জাতিকে নিয়ে যাবার সকল প্রয়াস সম্পন্ন করেছে। বাংলাদেশের মতো একটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের দেশে এ ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা কতটা কল্যাণকর হবে তা বিভিন্ন সেমিনার সেম্পোজিয়াম ও চিন্তাশীল বিশ্লেষকদের মতামত থেকে সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে। 

আধুনিক বিশ্বে প্রচারমাধ্যম বা মিডিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অথচ বিশ্বব্যাপী তথ্যপ্রযুক্তি এবং সাংস্কৃতিক মিডিয়ার নিয়ন্ত্রণ এখন পুরোদমে পাশ্চাত্য জগতের অমুসলিমদের হাতে। পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েট প্রেস বা এপির সদর দফতর যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে অবস্থিত। ইউনাইটেড প্রেস ইন্টারন্যাশনাল বা ইউপিআই একটি মার্কিন বার্তাসংস্থা। রয়টারের ঠিকানা ব্রিটেন এবং এএফপির সদর দফতর ফ্রান্সে। এ চারটি বার্তা সংস্থাই বিশ্বের সংবাদ প্রবাহের সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এ ছাড়াও বিবিসি, সিএনএন, স্কাই নিউজসহ ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সবগুলো কেন্দ্রই অমুসলিমদের দখলে। যেসব মানুষ উন্নয়নশীল বিশ্বে নিজেদের মতলব হাসিলের মতো কাজ করতে করতে স্থানীয় জনগণের বোধ বিশ্বাস তথা স্বকীয় সংস্কৃতিবৃক্ষের শেকড়কাটার কাজ করছে এ সকল মিডিয়া তাদেরকে উদারপন্থী, মানবতাবাদী ও দেবতার আসনে আসীন করতে যথাসম্ভব সকল প্রক্রিয়া অবলম্বন করে। পক্ষান্তরে উন্নয়নশীল বিশ্বে তথা বিশেষত মুসলিমবিশ্বে যখন প্রকৃত দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনচেতা কোনো দেশ বা দলের বিরুদ্ধে নির্যাতন চলে কিংবা কোন দেশের সংখ্যালঘু মুসলমানগণ যখন নির্যাতিত হয় তখন তারা সে বিষয়ে নিশ্চুপ থাকে কিংবা তাদের কর্মসূচি ও অবস্থাকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে। অন্যদিকে সালমান রুশদি, তসলিমা নাসরিন কিংবা দাউদ হায়দারের মতো মুসলিম নামধারী ব্যক্তিদের টাকার বিনিময়ে খরিদ করে যখন স্বজাতীয় মুসলমানদের বোধ-বিশ্বাসে আঘাত হানে তখন তারা এ কর্মকাণ্ডকে ব্যক্তি স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বলে সমর্থন ও মদদ জোগায়। অবশ্য এটা তাদের দোষের কিছু নয়। কারণ তাদের মিডিয়া তাদের কথা বলবে, এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু যখন তারা বিশ্বমানবতাবাদী হিসেবে নিজেদেরকে উপস্থাপন করতে চায়, তখনই এ বেদনা বেশি অনুভূত হয়।

আমাদের স্বকীয় সংস্কৃতিকে বিপন্ন করে তোলার জন্য বাংলাদেশে চলছে নানা ষড়যন্ত্র। নাস্তিক্যবাদ, পুঁজিবাদ, বিকৃত ধর্মীয় ও কুসংস্কারবাদী মতবাদের ওপর আঘাত হেনে চলেছে নানাভাবে। বাঙালি সংস্কৃতি বা মানবধর্ম নামে এদেশের মানুষকে ইসলামের মূল আদর্শ থেকে বিচ্যুত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। অন্যদিকে বিনোদন-সংস্কৃতির মাধ্যমে আল্লাহ-রাসূলের সরাসরি বিরোধিতা না করে ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও প্রগতির নামে অশ্লীলতার প্রসার ঘটিয়ে নৈতিক অবক্ষয়ের বিষ ছড়াচ্ছে। বিশ্বাসের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান না নেওয়া এবং এর পাশাপাশি ইসলামী সংস্কৃতির কোনো মডেল না থাকায় দেশবাসী এ সংস্কৃতিকে গোগ্রাসে গিলছে, কেননা এ সংস্কৃতিসেবীদের অনেকেই মুসলমান নামধারী। তাদের নির্মিত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে আল্লাহ্ ও রাসূল সা. নামও উচ্চারিত হয়। অথচ এ সংস্কৃতি যে নৈতিকতার জন্য কত বড় মারাত্মক তা আজও কারো বোধগম্য হয়নি।

একবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি চরম উৎকর্ষতার শীর্ষে অবস্থান করছে। এ সময় আমাদেরকেও সংবাদ ও তথ্যপ্রযুক্তির দিকে অবশ্যই উন্নয়ন ঘটাতে হবে। বর্তমানে সংবাদমাধ্যমে গণসচেতনতা তৈরি যেমন সহজ হয়েছে, তেমনি হলুদ সাংবাদিকতায় বিভ্রান্ত হওয়ারও সুযোগ অনেক বেশি। বিভ্রান্ত ও মিথ্যা সংবাদের জন্য ঘটে যায় হাজারো বিবাদ। হলুদ সাংবাদিকতা ও বিভ্রান্ত সংবাদ এতটাই মারাত্মক যে, এজন্য সংবাদ সচেতন মুসলিম জনগোষ্ঠীও ইসলামের সূচনালগ্ন থেকে ধাপে ধাপে বহুমুখী ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। বিশেষ করে অলিদ ইবনে উকবা রা. কর্তৃক প্রেরিত ভুল সংবাদের ভিত্তিতেই মহানবী সা. বনী মুস্তালিক গোত্রের মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে যাচ্ছিলেন। এ ছাড়া মারওয়ান কর্তৃক সংবাদ জালিয়াতির কারণে হযরত ওসমান রা. এর হত্যাকাণ্ড এবং একই প্রক্রিয়ায় কারবালার প্রান্তরে ইমাম হোসাইন রা.-এর পরিবারের হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে। পরবর্তীতে মিথ্যা ও ভুল সংবাদ পরিবেশনের প্রেক্ষিতে স্পেন বিজয়ী সেনাপতি মুসা বিন নুসাইর, তারিক বিন যিয়াদ এবং সিন্ধু বিজয়ী সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিমের ভাগ্যে জুটেছিল নির্মম পরিণতি, যা মুসলিম বিশ্বের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে। গ্রানাডার মুসলমানদের নির্মম পরিণতি ও ‘এপ্রিল ফুল’সহ আধুনিক কালের হাজারো দুঃখজনক পরিণতির জন্য তথ্য বিভ্রাট ও হলুদ সাংবাদিকতাই দায়ী। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তি ও বিজ্ঞানে চরম উৎকর্ষতার যুগে শুধুমাত্র যোগ্যতা নয়, সততাসহ নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন সাংবাদিক, সংবাদপত্র এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া তথা সত্যসচেতন গণমাধ্যমের আজ বড় বেশি প্রয়োজন।

সংস্কৃতির এমন সঙ্কটময় মুহূর্তে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি চর্চার গতিবেগ তাদের চেয়ে দ্বিগুণ বৃদ্ধি করে সামনে এগোনো দরকার। অথচ এখনও আমরা নিজেদের সংস্কৃতির স্বরূপ নিয়ে সংশয়িত। আমরা কারা, আমাদের সংস্কৃতি কোনটি, এর প্রকৃতিই বা কেমন- এসব বিষয়ে আজো আমাদের পরিচ্ছন্ন ধারণা নেই। আজ অপসংস্কৃতি যখন ফুলে-ফলে সুশোভিত হয়ে গোটা জাতির আহার জোগাচ্ছে(?) তখন তার উচ্ছিষ্টাংশ নিয়ে আমরা গবেষণা শুরু করেছি যে, এটা কেমন ধরনের ফল, জাতিসত্তাকে বাঁচানোর জন্য আমাদেরকে এর বিকল্প কোনো ফলের গাছ রোপণ করতে হবে কিনা? এতে কেউ প্রয়োজন অনুভব করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে চায়, কেউবা সিদ্ধান্ত গ্রহণেও সংশয়িত হয়ে ইসলামকে জাতির সামনে অত্যন্ত কঠিন ও ভয়ের বস্তু হিসেবে তুলে ধরছে। ফলে আজও আমরা জাতির সামনে সংস্কৃতির কোনো মডেল দাঁড় করাতে পারিনি। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সাথে সাথে তৈরি হয়েছে হাজারো ছিদ্রপথ। তাই সমকালীনবিশ্বেও প্রতিযোগিতামূলক আধুনিক জ্ঞান অর্জনের কোনো বিকল্প নেই, সেটা হোক মিডিয়া কিংবা বিনোদন মিডিয়া। বর্তমান বিশ্ব-প্রেক্ষাপটের শরয়ী সমাধান কী হবে; তা নিয়ে বর্তমান সময়ের আলিমদের গবেষণা এখন সময়ের দাবি। ১৯২৬ সালে এক বক্তৃতাতে জ্ঞান অর্জনের উপর গুরুত্বারোপ করে ইকবাল বলেছিলেন, “যারা নিজেরা সংবাদপত্র পড়তে অপারগ তারা যেন অন্যদের কাছ থেকে শুনে নেয়, কেননা সমকালীন বিশ্বে যেসব জাতি কর্মতৎপর রয়েছে তাদের মধ্যে অধিকাংশ জাতিই মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে।’

স্বকীয় আদর্শের প্রচার ও প্রসারে ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে গণমাধ্যমের কাজ ও সংস্কৃতিচর্চা শুরু হয়েছে, এটা আমাদের জন্য বড় আশার দিক। ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবীরা আন্তরিকভাবেই প্রচলিত অপসংস্কৃতির বিরোধী। অশ্লীলতা, বেহায়াপনাকে পারিবারিক ঐতিহ্যগতভাবেই মুসলিম সমাজে অপছন্দনীয়; সেইসাথে ইসলামী চেতনায় উজ্জীবিত ছাত্র ও যুবকদের পক্ষ থেকেও বিভিন্নভাবে এ কাজকে ত্বরান্বিত করার প্রয়াস চলছে। অন্যদের তুলনায় অতি সামান্য আকারে হলেও তাদের প্রচেষ্টায় রাজধানী ও মহানগরীসহ দেশের প্রধান প্রধান শহরে বেশ কিছু পত্র-পত্রিকা, এনজিও, সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংগঠনসহ ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলার প্রয়াস চলছে। তাদের মাধ্যমে কিছু জাতীয় ইস্যু পালন ছাড়াও অপসংস্কৃতির প্রতিরোধে সাহিত্য সামগ্রীসহ গান, নাটক, শর্টফিল্ম প্রকাশিত হয়েছে, যদিও তা পুরোপুরি আধুনিক মানের হয়ে ওঠেনি। সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় নিয়মিত সাহিত্যসভা, লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশনা, নাটক মঞ্চায়ন ও সঙ্গীতচর্চা প্রভৃতির ক্ষেত্রে অনেকটা আশার আলো ছড়াতে সমর্থ হয়েছে। দক্ষতা ও যোগ্যতার ক্ষেত্রে ঘাটতি থাকলেও যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাব ও নিজেদের আস্থাহীনতা যেমন পেছনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে তেমনি অর্থনৈতিক সঙ্কট, নাট্যমঞ্চ সঙ্কট, তথ্য সন্ত্রাসে বিভ্রান্তি হওয়া, আন্তর্জাতিক চক্রান্ত, দুনিয়ার চ্যালেঞ্জ-স¤পর্কে অসেতন ও বেখবর এক শ্রেণির ইসলামপন্থীদের বাধা, আধুনিক প্রযুক্তির অজ্ঞানতা, সর্বোপরি সংস্কৃতির সঠিক মডেল না পেয়ে এ অভিযানে বিজয়ের টার্গেট না হয়ে আত্মরক্ষামূলক অবস্থান নেওয়া হয়েছে। এসব সীমাবদ্ধতার ফলে এ প্রয়াস সাধারণ জনগণের মাঝে কাক্সিক্ষত আবেদন সৃষ্টিতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

শিশুর হাসি ফুলের মতো ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বময়। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। বিষয়টি মাথায় রেখে তাদের উপযোগী বিনোদন না দিতে পারলে ডোরেমন-মটুপাতলুসহ অনৈকতাসম্পন্ন কার্টুনে তাদেরকে আবদ্ধ করে রাখবেই। মানসম্মত সিরিয়াল না দিতে পারলে ভারতীয় চ্যানেলের সিরিয়ালে আমাদের নারী সমাজকে আটকে রেখে ঐতিহ্যবাহী পরিবারিক কাঠামোকে চিরতরে ভেঙে খান খান করে দেবে। অন্যদিকে হিন্দি ও কাটপেস্ট ফিল্মে আমাদের যুবসমাজকে যেমন ধ্বংসের অতল গহ্বরে নিয়ে যাবে তেমনি ইন্টারনেটের অনৈতিক ওয়েবসাইটগুলো মুখিয়ে আছে যুবসমাজের নৈতিক অবক্ষয় তৈরির জন্য। নোংরা রিলস এবং শর্টফিল্মের জ্বালায় সোশ্যাল মিডিয়া পুরোদস্তুর গরম হয়ে থাকছে।

এমতাবস্থায় বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সাথে সাথে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে মানসম্পন্ন ও আদর্শিক প্রক্রিয়ায় বিনোদন-সংস্কৃতির সঠিক ধারণা উপস্থাপন করতে হবে। দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষকতার জন্য প্রতিষ্ঠিত সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহকে আরো সহযোগিতা প্রদান করা দরকার। প্রয়োজনীয় অঞ্চলে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে উন্নতমানের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এখন সময়ের দাবি। বিশেষ করে মিডিয়া অঙ্গনে লোক তৈরির জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা জরুরি। বিভাগীয় শহর ছাড়াও দেশের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রসমূহে নিজস্ব বলয়ে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান গড়তে উৎসাহিত করা দরকার। শর্টফিল্ম, গান, ছোটো ছোটো বিষয়ের আধুনিকীকরণ কওে উপস্থাপনার মাধ্য্যমে রিলসের জায়গা দখল করতে হবে। সুষ্ঠু পরিকল্পনার ভিত্তিতে জ্ঞানচর্চা আরো বৃদ্ধি করতে হবে। যোগ্যতার ভিত্তিতে জনশক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য মজবুত সাংস্কৃতিক সংগঠন ও বিশ্বাসী ঘরানার মিডিয়া ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলাও এখন সময়ের দাবি। আল্লাহ সুবহানাহু ও’তাআলা আমাদেরকে যুগের সকল প্রকার জাহিলিয়াতকে যথাযথভাবে মোকাবিলা করার তাওফিক দান করুন। আমিন। 

লেখক : প্রফেসর, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির