তুরস্কের সঙ্গে সিরিয়ার বৈরিতা দীর্ঘদিনের। রাশিয়া; চীন ও ইরানের মধ্যে বৈশ্বিক ক্ষমতার যে মেরুকরণ শুরু করেছে তাতে এ বৈরিতা তীব্র নেতিবাচক ভূমিকা পালন করছে। এ কারণেই বৈরিতার এ পথ ধরে নতুন এক মানচিত্র তৈরির চেষ্টা করছে এই তিন রাষ্ট্র, যাতে করে তাদের এ জোটবদ্ধ শক্ত অবস্থান পশ্চিমা মোড়ল রাষ্ট্রকে অন্তত এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে ডেকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েফ এরদোয়ান। সংলাপের আমন্ত্রণ জানান তিনি। এ আমন্ত্রণ গ্রহণে সিরিয়ার প্রেসিডেন্টও কালক্ষেপণ করেননি। আগ্রহের বার্তা দিয়েছেন দ্রুতই। শুধু আঞ্চলিক শক্তি অর্জনের কারণেই এরদোয়ান এ আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তেমনটি ভাবার সুযোগ নেই। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সু-সম্পর্ক তৈরি করে আঞ্চলিক শান্তি বজায় রাখা এরদোয়ানের একটি উদ্দেশ্য হলেও, এমন সংলাপের পেছনে আরও কিছু বিষয় সংযুক্ত রয়েছে। প্রথম বিষয় হচ্ছে- তুরস্কে অবস্থানকারী সিরিয়ার শরণার্থীদের নিরাপদে ও স্বেচ্ছায় দেশে ফেরত পাঠানো। এর পাশাপাশি কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (পিকেকে) এবং সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস (এসডিএফ)-এর হুমকিও রয়েছে। এই গোষ্ঠীগুলোকেও সমন্বিতভাবে মোকাবেলা করতে চান এরদোয়ান।
এ প্রস্তাবে বাশার আল আসাদের সাড়া দেওয়ার কারণ অবশ্য একটু ভিন্ন। মূলত; মিত্র রাশিয়ার চাপের কারণে আসাদ এ আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। তবে এই সংলাপ কোথায় এবং কখন অনুষ্ঠিত হতে পারে, সে ব্যাপারে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। বিষয়টি এখনও উদ্যোগ গ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে। এরদোয়ানের আমন্ত্রণ জানানোর পর এ সংক্রান্ত আলোচনা আটকে গেছে বলে আসাদ নিজেও স্বীকার করেছেন। পূর্ববর্তী নিরাপত্তা পর্যায়ের বৈঠকে তিনি বিষয়টি নিয়ে কথাও বলেন। ওই বৈঠকে সিরিয়া থেকে তুর্কি সেনাদের পুরোপুরি প্রত্যাহারের দাবিও তোলে ইরান। নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ানোর এটাও এক ধরনের খেলা। তুরস্কের সৈন্যদেরকে সিরিয়ায় মোতায়েন রাখার ব্যাপারে রাশিয়াও এখন আগ্রহী। কারণ, এর মধ্য দিয়ে সিরিয়ায় ইরানের প্রভাবকে কিছুটা দুর্বল করা সম্ভব হবে।
এরদোয়ানের সাথে আসাদ যে সুবিধা আদায়ের জন্য বৈঠক করতে রাজি হয়েছেন তার মধ্যে একটি হচ্ছে- সিরিয়া থেকে তুরস্কের সৈন্যবাহিনীকে সরিয়ে নেওয়া। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে- সিরিয়ার বিরোধী দলগুলোর ওপর থেকে তুরস্কের সমর্থন প্রত্যাহারে রাজি করানো। সিরিয়ার এ দুটি দাবি ইরানের স্বার্থের অনুকূলে। আসাদ খুব ভালো করেই জানেন- এসডিএফ-এর সাথে লড়াই করে জিততে পারা কঠিন হবে। কারণ, এই প্রতিষ্ঠানকে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন দেয়। অন্যদিকে তুরস্কের অবস্থান খুবই স্পষ্ট- তারা সিরিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহার করবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টিকে প্রত্যাহার করা যাচ্ছে। একই সঙ্গে সিরিয়ার শরণার্থীরা তুরস্ক থেকে নিজ দেশে ফিরছে। তুরস্কের কর্মকর্তারা জানান- আঙ্কারা সিরিয়ার বিরোধী দলকে সমর্থন দেওয়া অব্যাহত রাখবে। সেক্ষেত্রে সংলাপের সাফল্য নিয়েও সন্ধিহান দামেস্ক। কারণ, সফল সংলাপের জন্য আঙ্কারাকে অবশ্যই সিরিয়ার বিরোধী দলকে সমর্থন দেওয়া বন্ধ করতে হবে বলে মনে করে দামেস্ক।
বর্তমানে সিরিয়ার ওপরে রাশিয়া ও ইরানের প্রভাব বেশ অনেকটাই। বহু বছর ধরে চলমান সহিংসতার কারণে সিরিয়ার সেনাবাহিনী অকার্যকর হয়ে পড়ার কারণে নতুন সমীকরণের সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতি নতুন এক ভারসাম্য সৃষ্টি করেছে। এরদোয়ান, আসাদ ও তাদের বেশ কয়েকটি প্রতিবেশী দেশ এই দুই নেতার মধ্যে বৈঠক দেখতে আগ্রহী। এটি ছবি তোলার একটি বড় সুযোগ তো বটেই, পাশাপাশি তাদের যে লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য রয়েছে সেগুলো পূরণের ক্ষেত্রেও কার্যকর ভূমিকা রাখবে। সংঘাতের শুরু থেকেই আসাদের লক্ষ্য ছিল- যেকোনোভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকা। তার প্রায় সকল সিদ্ধান্তই রাশিয়া এবং ইরানের মাধ্যমে প্রভাবিত। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলছেন তিনি। দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা তেহরানের সঙ্গে সখ্যতা রক্ষা করে চলে। তবে সেখানে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ রয়েছে। এ কারণে তুরস্ক এবং সিরিয়ার মধ্যে আলোচনার জন্য, ইরান ও রাশিয়া চাপ প্রয়োগ করলে দামেস্ককে তা মেনে নিতে হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গোয়েন্দা ‘মিডল ইস্ট আই’-কে জানিয়েছে- এরদোয়ান সংলাপের প্রস্তাব দেওয়ার পর, সে ব্যাপারে মন্তব্য করার জন্য বেশ কয়েকদিন সময় নিয়েছে সিরিয়ার গোয়েন্দা সংস্থা। তাদের দাবি ছিল- প্রথমে সিরিয়া থেকে তুর্কি সেনাদের প্রত্যাহারের ব্যাপারটি নিশ্চিত হয়ে আলোচনায় বসবে। কারণ, তারা সবাই জানে এই আলোচনার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হবে নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সহযোগিতা। সিরিয়ার এই অবস্থান ইরানের পক্ষে গেলেও তুরস্কের এটা গ্রহণ করার কোনো কারণ নেই। ওই সময় সিরিয়ার পক্ষ থেকে তুরস্কের সেনা প্রত্যাহারের প্রস্তুতির জন্য তিন বছরের সময় বেঁধে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এই সময়ের মধ্যে সিরিয়া থেকে পুরোপুরি সেনা প্রত্যাহার করতে হবে। এছাড়া ওই সম্ভাব্য বৈঠকে দূতাবাস পুনরায় খুলে দেওয়া, কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরায় স্থাপন এবং সিরিয়ার যেসব এলাকায় আঙ্কারা সমর্থনে বেসামরিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা পরিচালিত হয় সেগুলো বন্ধ করা নিয়ে আলোচনা হবে। এরপর সিরিয়া সরকার ওই এলাকাগুলোর দায়িত্ব নিবে। সন্ত্রাস বিরোধী ব্যবস্থা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত এসব নিয়ে কাজ করা হবে।
রাশিয়ার সহযোগিতা নিয়ে সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের সেনাবাহিনীকে একটি পেশাদার বাহিনীতে তৈরি করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই বাহিনীকে এমনভাবে তৈরি করা হচ্ছে- যেন সংকট পরবর্তী সিরিয়ায় তারা ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হয়। বর্তমানে রাশিয়া চাচ্ছে যে, দামেস্ক যেন আঙ্কারার সাথে বৈঠকে বসে। ফোরাত নদীর পূর্বাঞ্চলে যৌথ সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছে সিরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তুরস্ক যদি বিরোধী পক্ষকে সহায়তা দেওয়া বন্ধ করে তাহলে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করা হবে। এরপরে পুরোটা সিরিয়ার সেনাবাহিনীর সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত হবে। সিরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্রের তথ্য হচ্ছে- দামেস্কে অবস্থিত ইরানি দূতাবাস সিরিয়া সরকারের ওপরে তুরস্কের বাহিনীকে দ্রুত প্রত্যাহারের ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনেকদিন থেকেই চাপ দিয়ে আসছে। নিরাপত্তা বাড়ানো এবং সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোকে ভেঙে দেওয়ার জন্য গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ের সমন্বয় বাড়ানোর কথা বলছেন তারা। একই সঙ্গে ইরান সিরিয়া সরকারকে ঋণ দেওয়ার পরিমাণ বাড়িয়েছে, যাতে করে সিরিয়ার অর্থনীতির ওপর নিয়ন্ত্রণ আরও জোরালো হয়।
দামেস্কে অবস্থিত রাশিয়ার দূতাবাস আঙ্কারার সঙ্গে দ্রুত আলোচনায় বসার জন্য বাশার আল আসাদের ওপর চাপ দিচ্ছে। সিরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র এই তথ্য নিশ্চিত করেছে। রাশিয়ার মূল লক্ষ্য হচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্রকে সিরিয়া থেকে বের করে দেওয়া। রাশিয়া মনে করে- সিরিয়া, রাশিয়া ও তুরস্কের সমন্বিত বাহিনী দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম। ইরান ও তার মিলিশিয়া বাহিনীকে সিরিয়ার প্রয়োজন নেই। এভাবেই সিরিয়ার বেশিরভাগ প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। গত মাসের শেষের দিকে প্রকাশিত এক খবরে দেখা যায়- সিরিয়া ও তুরস্কের নেতাদের মধ্যে একটি বৈঠকের আয়োজন করতে চাই ইরাক সরকার। দামেস্ক ইরাকের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি। এর মাধ্যমে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায়- তারা আরও সময় নিতে চাচ্ছে।
এই বৈঠকের ব্যাপারে দুই পক্ষের মত একেবারেই দুই বিপরীত পক্ষে অবস্থিত। রাশিয়া ও চীনের প্রভাব থাকলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে সিরিয়া ও তুরস্কের মধ্যে কোনো বৈঠকের মাধ্যমে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু অর্জন সম্ভব নয়। কিন্তু ছবি তোলার জন্য হলেও এরদোয়ান ও আসাদের এই ইভেন্টে অংশ নেওয়ার আগ্রহ আছে। পাশাপাশি চাহিদা বিপরীত হলেও দু-পক্ষ জোর করেই নিজ নিজ এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য মুখিয়ে আছে।
লেখক : আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক
আপনার মন্তব্য লিখুন