post

তুরস্ক

মুহাম্মদ নূরে আলম

১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

শতাব্দির দ্বিতীয় ভয়াবহ ভূমিকম্পে ধ্বংস্তুপে পরিণত হয়েছে তুরস্ক ও সিরিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা। ভূমিকম্পের পরে শতাধিক আফটারশক রেকর্ড বা ভূমিকম্প-পরবর্তী কম্পন অনুভূত হয়েছে। এর মধ্যে একটি কম্পন ছিলো মূল ভূমিকম্পের মতোই শক্তিশালী। এর আগে প্রায় ২০০ বছরে তুরস্কের ওই অঞ্চলে তেমন কোনো বড় ভূমিকম্প হয়নি। শুধু তুরস্কে ভূমিকম্পে যেসব এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার আয়তন প্রায় ৭০ হাজার বর্গ কিলোমিটার। ৬ ফেব্রুয়ারি সোমবার ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে অনুভূত ৭ দশমিক ৮ মাত্রার  ৪৫ সেকেন্ড স্থায়ী শক্তিশালী এই ভূমিকম্পে তুরস্কের প্রায় সাড়ে ৩ লাখ অ্যাপার্টমেন্ট ধ্বংস হয়ে একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে বলে জানিয়েছে প্রশাসন। সর্বশেষ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত স্থানীয় সময় শনিবার ১৮ ফেব্রুয়ারি ভূমিকম্পের ২৯৬ ঘণ্টা অর্থাৎ ১২ দিনেরও বেশি সময় পর এক শিশুসহ ৩ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পের ১৩ দিন পরে নিহতের সংখ্যা ৪৬ হাজার ছাড়িয়েছে। আহত লাখেরও বেশি মানুষ। দুই দেশ মিলে রোববার ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৪৬ হাজারের বেশি মানুষের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারকারীরা ধ্বংসস্তূপ থেকে কাউকে জীবিত উদ্ধারের আশা ছেড়ে দিলেও, তখনও দু-একজন করে উদ্ধার হচ্ছিলেন। ১৯ ফেব্রুয়ারি কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। এতে বলা হয়, ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে তখন পর্যন্ত ৪৬ হাজার ৪৪২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে তুরস্কের ৪০ হাজার ৬৪২ এবং সিরিয়ায় ৫ হাজার ৮০০ জন। জাতিসংঘ ধারণা করছে নিহতের সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। ভূমিকম্পটিকে গত ১০০ বছরের মধ্যে তুরস্কের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগ বলে উল্লেখ্য করা হয়েছে। এছাড়া অনেক মানুষ এখনও নিখোঁজ রয়েছে। এ অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার জন্য ১০০ কোটি ডলার সহায়তা চেয়েছে জাতিসংঘ। তুরস্কের পরিবেশ ও গৃহায়ণবিষয়ক মন্ত্রী মুরাত কুরুম জানিয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ৩০ হাজার বাড়ি নির্মাণ করা হবে। আগামী মাস (মার্চ) থেকেই এর কাজ শুরু হবে। ভূমিকম্পের কারণে তুরস্কে তিন মাসের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। উদ্ধারকারীরা তুরস্ক এবং সিরিয়ার ধ্বংসস্তূপ থেকে আরও জীবিত ও মৃতদের বের করে আনার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। বাংলাদেশসহ বিশে^র বিভিন্ন দেশ এই উদ্ধার কাজে অংশ গ্রহণ করেছে। তবে প্রচন্ড ঠান্ডার কারণে উদ্ধার কাজ ব্যাহত হচ্ছে। তুরস্ক-সিরিয়ায় আঘাত হানা ভয়াবহ ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষ। এর মধ্যে ১০ লাখের বেশি শিশু রয়েছে। এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। ভূমিকম্পনের উৎসস্থল দক্ষিণ তুরস্কে। গাজিয়ানতেপ প্রদেশের পূর্ব দিকে নুরদাগি শহর থেকে ২৬ কিলোমিটার পূর্বে ভূগর্ভের প্রায় ১৮ কিলোমিটার গভীরে। গত ৬ ফেব্রুয়ারি সোমবার ভোরে তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্ত অঞ্চলে সৃষ্ট শক্তিশালী এই ভূমিকম্পের সময় বেশিরভাগ মানুষ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল। বহুতল ভবন ধসে পড়ে ঘুমন্ত মানুষের ওপর। মোমের মতো ধসে পড়েছে একাধিক ভবন। ভয়াবহ এই ভূমিকম্পে বিস্তৃত এলাকা মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। ধসেপড়া হাজার হাজার ভবনের নিচ থেকে উদ্ধার করা হচ্ছে মৃত ও আহতদের। এমন অবস্থায় হাসপাতাল ও ধসেপড়া ভবনগুলোর সামনে স্বজনদের খুঁজতে ভিড় করছেন মানুষ। কোনও কোনও পরিবারে সকল সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। তুরস্ক-সিরিয়ার বাতাসে লাশের গন্ধ ও স্বজনদের আহাজারি চারিদিকে লাশের স্তূপ, কাঁদার লোকও নেই অনেক পরিবারে! এছাড়াও স্মরণকালের ভয়াবহ এ ভূমিকম্পে দেশ দুটির হাজার হাজার নাগরিকের মৃত্যুতে গত ৯ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ রাষ্ট্রীয়ভাবে একদিনের শোক পালন করে।

ভূমিকম্পের এক সপ্তাহ পর তুরস্কের কাছ থেকে আরও ক্রসিংয়ের মাধ্যমে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত সিরিয়ার ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকায় ত্রাণ সাহায্য বিতরণের অনুমোদনের জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কারণ সিরিয়ায় জাতিসংঘের মতে, হায়েত তাহরির আল-শাম সশস্ত্র গোষ্ঠীর সাথে অনুমোদনের সমস্যা জন্য সরকার-নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলি থেকে ত্রাণ ও উদ্ধার সহায়তা আটকে রাখা হয়েছে। সিরিয়ায় ৩ হাজার ৫০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। জাতিসংঘ বলছে, ভূমিকম্পের পর সিরিয়ায় ৫ দশমিক ৩ মিলিয়ন মানুষ গৃহহীন হতে পারে। তুরস্ক এবং সিরিয়ায় ৯ থেকে ১৫ লাখ মানুষের জন্য জরুরী গরম খাবার ও কাপড়ের প্রয়োজন। জাতিসংঘের সাহায্য প্রধান মার্টিন গ্রিফিথ বলেছেন, যে বিশ্ব এখনও পর্যন্ত উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার লোকদের কাছে ত্রাণ ও উদ্ধার সহায়তা পাঠাতে ব্যর্থ হয়েছে এবং সেখানে বেঁচে থাকা মানুষেরা নিজেদেরকে ‘ঠিকই পরিত্যক্ত বোধ করছে’। তুরস্কের মতো সিরিয়াতেও ভূমিকম্পে একই রকম ক্ষয়ক্ষতি হয়। তুরস্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফুয়াত ওকতায় বলেছেন, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত তুরস্কের ১০ টি শহর ও প্রদেশের স্কুল এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ থাকবে। শহর এবং প্রদেশগুলি হল কাহরামানমারাশ, হাতায়, গাজিয়ানটেপ, ওসমানিয়ে, আদিয়ামান, মালত্য, শানলিউরফা, আদানা, দিয়ারবাকির, কিলিস। ওকতায় আরও বলেছেন, হাতায় প্রদেশের বিমানবন্দরের সব ফ্লাইট স্থগিত করা হয়েছে, অন্যদিকে মারাস এবং আন্তেপের বিমানবন্দরগুলিতেও বেসামরিক ফ্লাইট বন্ধ ছিল। 

মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ (ইউএসজিএস) ইউএসজিএস’র তথ্যানুযায়ী, ভূমিকম্পটি এতই প্রবল ছিল যে ৭০০ কিলোমিটার দূরে রাজধানী আঙ্কারাতেও এটি অনুভূত হয়েছে। এছাড়া সিরায়ার আলেপ্পো, হামা এবং লাত্তাকিয়াসহ কয়েকটি অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তুরস্ক ও সিরিয়া উভয় দেশ দুর্যোগ ও জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। ১৯৩৯ সালের পর তুরস্ক এমন ভয়াবহ ভূকম্প দেখেনি। ভূমিকম্পের ফলে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে তুরস্ক এবং সিরিয়া। এটি একটি বড় ধরণের ভূমিকম্প ছিলো। যার মাত্রা ছিলো ৭ দশমিক ৮, যেটিকে ‘ভয়াবহ’ হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে। ফল্ট লাইন বরাবর প্রায় ১০০ কিলোমিটার ধরে এটি আঘাত হেনেছে এবং এর কারণে ভবনগুলোতে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে।

তুরস্কের ভূমিকম্পের কারণ

ভূকম্পনবিদরা বলছেন, দশকের অন্যতম শক্তিশালী এই ভূমিকম্পের ফলে তুরস্কের আনাতোলিয়া থেকে আরব ভূখণ্ড পর্যন্ত মাটির গভীরে ১০০ কিলোমিটারের (৬২ মাইল) মতো দীর্ঘ ফাটল তৈরি হয়েছে। মাটির নীচে আসলে কী ঘটেছে এবং এর প্রভাবটা কী তা-ও ব্যাখ্যা করেছেন তারা। ভূমিকম্পের কেন্দ্রবিন্দু ছিল তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলে গাজিয়ান্তেপ প্রদেশের নুরগাদি শহর থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার পূর্বে এবং ভূ-পৃষ্ঠের প্রায় ১৮ কিলোমিটার গভীরে ইস্ট আনাতোলিয়া ফল্টে। ফল্ট বলতে মাটির নীচে পাথর ও অন্যান্য খনিজের বিশালাকৃতির (শত বা হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ) খণ্ডগুলোকে বোঝায়। পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠ আলাদা বিট দিয়ে গঠিত, যাকে প্লেট বলা হয়, যা একে অপরের পাশাপাশি অবস্থান করে। এই প্লেটগুলি প্রায়শই নড়াচড়া করার চেষ্টা করে। কিন্তু পাশে থাকা অন্য আরেকটি প্লেটের সাথে ঘর্ষণের মাধ্যমে এই নড়াচড়া প্রতিরোধ করা হয়। তবে চাপ বেশি বেড়ে গেলে কখনো কখনো একটি প্লেট হঠাৎ করে ঝাঁকুনি দেয়ায় ভূ-পৃষ্ঠের উপরিভাগ সরে যায়। এবার এরাবিয়ান প্লেটটি উত্তর দিকে সরে যায় এবং উত্তর দিকে সরে যাওয়া আনাতোলিয়ান প্লেটে গিয়ে ধাক্কা দেয়। প্লেটগুলোর এ ধরণের ঘর্ষণের কারণে অনেক ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছে। এর কারণে ১৮২২ সালের ১৩ই অগাস্ট ৭ দশমিক ৪ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল। যা গত ৬ ফেব্রুয়ারি সোমবার হয়ে যাওয়া ভূমিকম্পের তুলনায় বেশ কম।

তা সত্ত্বেও, উনিশ শতকের ভূমিকম্পের ফলে এলাকার শহরগুলির প্রচুর ক্ষতি হয়েছিল, শুধু আলেপ্পো শহরেই সাত হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল। ক্ষতিকর আফটারশক প্রায় এক বছর ধরে চলতে থাকে। বর্তমান ভূমিকম্পের পরে ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি আফটারশক হয়েছে এবং বিজ্ঞানীরা মনে করছেন যে, এটি এই অঞ্চলে এর আগে হওয়া ভূমিকম্পের মতো হতে পারে। ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বরে তুরস্কের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। ওই সময় ৩০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। ১৯৭০ সাল থেকে এই ৫২ বছরে এই এলাকায় তিন বার রিখটার স্কেলে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প রেকর্ড করা হয়েছে। কিন্তু এখন থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে ১৮২২ সালে এই এলাকায় ৭ মাত্রার ভূমিকম্পে অন্তত  ২০ হাজার লোকের মৃত্যু হয়।    

ভূমিকম্প নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এটি এমন একটি অঞ্চল যেখানে গত দুইশো বছর বা তার চেয়েও বেশি সময় ধরে কোনও বড় ভূমিকম্প হয়নি বা কোনও সতর্কতা সংকেতও ছিল না। তাই প্রায়ই ভূমিকম্প মোকাবেলা করে এমন অঞ্চলের তুলনায় এখানকার প্রস্তুতির মাত্রা বেশ কম হবে। যুক্তরাজ্যের নটিংহ্যাম ট্রেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ স্টেভেন গোডবে বলেছেন, দুর্যোগের প্রথম ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্তদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা থাকে ৭৪ শতাংশ। ৭২ ঘণ্টা (তিন দিন) পর এটি নেমে আসে ২২ শতাংশে। আর পঞ্চম দিনে কোনো আহত বা ক্ষতিগ্রস্তের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ৬ শতাংশে চলে আসে। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের ইনস্টিটিউট ফর রিস্ক অ্যান্ড ডিজাস্টার রিডাকশনের প্রধান অধ্যাপক জোয়ানা ফাউর ওয়াকার বলেছেন, ‘এটা যেকোনো বছরের তুলনায় সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্প।

গত ১০ বছরের মধ্যে মাত্র দু’টি ভূমিকম্প এ মাত্রার ছিলো, আর এর আগের ১০ বছরে মাত্র চারটি ভূমিকম্প এ মাত্রার ছিলো। তবে শুধু কম্পনের শক্তির কারণেই এতো বেশি ধ্বংসযজ্ঞ হয়নি। এই ঘটনাটি ঘটেছে ভোরের দিকে, যখন মানুষ ঘরের ভেতরে ঘুমাচ্ছিল। ভবনের দৃঢ়তাও একটি বিষয়। এ বিষয়ে ব্লিউএইচও-এর শীর্ষ কর্মকর্তা অ্যাডেলহেইড মার্শাং বলেন, ভূমিকম্প যেসব অঞ্চলে সংঘটিত হয়েছে, তার মানচিত্র অনুসারে বলা যায় যে দুই কোটি ৩০ লাখ মানুষ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এদের মধ্যে ৫০ লাখ মানুষ অরক্ষিত অবস্থায় আছে। 

ভূমিকম্পে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শহর

ভূমিকম্পে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তুরস্কের হাতেয় প্রদেশ। গত ৮ ফেব্রুয়ারি বুধবার সেই অঞ্চলে যান তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। সেখানে তাকে ধীরগতির উদ্ধার অভিযান সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়। তিনি জানান, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি। আর এত বড় দুর্যোগ সামাল দেওয়ার মতো প্রস্তুতি নেওয়া অসম্ভব। কিন্তু তবুও সবাইকে উদ্ধার করা হবে বলে প্রতিশ্রতি দিয়েছেন তিনি। শুধুমাত্র হাতেয় প্রদেশেই মৃত্যু হয়েছে ৩ হাজার ৩০০ মানুষের। এ অঞ্চলের বেশিরভাগ ভবন ধসে পড়েছে। ধুলোয় মিশে গেছে পাড়ার পর পাড়া।  ভূমিকম্পে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তুরস্কের গাজিয়ানটেপ শহর। এই শহরে মৃতের সংখ্যাও তুলনামূলক বেশি। এখন পর্যন্ত কয়েক হাজার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে গাজিয়ানটেপ শহর থেকে। ঐতিহাসিকভাবে আন্তেপ নামে পরিচিত গাজিয়ানটেপ শহরটি সিরিয়ার সীমান্ত থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এই শহরের পরেই সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কাহরামানমারাস শহরটি। সেখানেও অসংখ্য মানুষের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। 

সাহায্যের জন্য ভয়েস নোট 

শতাব্দির দ্বিতীয় ভয়াবহ ভূমিকম্পের কবলে তুরস্ক-সিরিয়া। ধসে পড়া ভবনের ধ্বংসস্তূপে এখনো আটকা পড়ে আছে অনেকে। সাহায্যের জন্য আপ্রাণ আর্তনাদ করছে তারা। কাছে থাকা ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে নিজেদের অবস্থান উদ্ধারকারীদের নিকট পাঠানোর চেষ্টা করছে অনেকে। ইস্তাম্বুলে অবস্থিত তুর্কি সাংবাদিক ইব্রাহিম হাসকোলোগ্লু বিবিসিকে বলেছেন, ‘লোকেরা এখনও ভবনের নিচে রয়েছে, তাদের সাহায্যের প্রয়োজন। ধ্বংসস্তূপের নীচে থেকে তারা আমাকে এবং অন্যান্য সাংবাদিকদের ভিডিও, ভয়েস নোট এবং তাদের লাইভ অবস্থান পাঠাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেছেন, যেখানে প্রয়োজন সেখানে সাহায্য করার জন্য তিনি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। তারা আমাদের কাছে লোকেশন পাঠাচ্ছে কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারছি না। তুরস্কের জন্য সমস্ত আন্তর্জাতিক সহায়তা প্রয়োজন।

তুরস্কে তিন মাসের জরুরি অবস্থা ঘোষণা

হাজার হাজার মানুষ ধসে যাওয়া ভবনের নিচে আটকা পড়েছে। হঠাৎ করে হওয়া এমন মহাদুর্যোগে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা কামনা করেছে তুরস্ক। সাড়াও মিলেছে ব্যাপক। এরদোয়ান জানিয়েছেন, ‘আন্তর্জাতিক সাহায্যের জন্য আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা শুরু হয়েছে। ন্যাটো এবং ইইউ এর সহায়তার প্রস্তাব ছাড়াও ৪৫টি দেশ আমাদের সহযোগিতা করতে চেয়েছে। তুরস্ককে তাৎক্ষণিক সহযোগিতার প্রস্তাব দেওয়া দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে, সৌদি আরব, ইরান, রাশিয়া, কাতার, ইউক্রেন, ভারত, ইসরায়েল। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন অন্তত দশটি টিম এরই মধ্যে প্রেরণ করেছে।

ভয়াবহে ভূমিকম্পের পর এবার তুরস্কে রক্তের জন্য হাহাকার দেখা দিয়েছে। হাজার হাজার আহত ব্যক্তির চিকিৎসায় দরকার হচ্ছে বিভিন্ন গ্রুপের প্রচুর পরিমাণ রক্ত। এমন পরিস্থিতিতে তুর্কি রেড ক্রিসেন্টের প্রেসিডেন্ট কেরেম কিনিক গোটা জাতিকে ভূমিকম্পে আহতদের জন্য স্বেচ্ছায় রক্তদানের আহ্বান জানিয়েছেন। তুরস্কে তিন মাসের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। সোমবারের বিধ্বংসী ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ১০টি প্রদেশে তিনি এ জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ভাষণে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট বলেন, তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে উদ্ধার কাজ দ্রুত সম্পন্ন করার বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি বলেন, জরুরি অবস্থা ঘোষণার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোতে দ্রুত ত্রাণ কর্মীরা যেতে পারবেন। এছাড়া সেসব এলাকায় তাড়াতাড়ি আর্থিক সহায়তাও দেওয়া যাবে। তবে এ বিষয়ে কোনো বিশদ বিবরণ দেননি এরদোয়ান। তিনি আরও জানিয়েছেন, ১৪ মে তারিখে নির্বাচনের ঠিক আগে জরুরি অবস্থার অবসান হবে।

বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর বর্ণনায় তুরস্কের ভূমিকম্প

এটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। চোখের সামনে যা দেখছি এটা কোনোদিন ভাবিও নাই। বাংলাদেশি শিক্ষার্থী একজনই নিখোঁজ। আমার পরিচিত এক ছোট ভাইয়ের বন্ধু। ওর কাছে শুনেছি তারা একসঙ্গেই থাকত। কিন্তু নিখোঁজ ছেলেটা বের হতে পারেনি। ভবনটা মাটির সঙ্গে মিশে গেছে। এভাবেই তুরস্কের ভূমিকম্পের পরিস্থিতির কথা বলছিলেন দেশটির রাজধানী আঙ্কারায় বসবাস করা বাংলাদেশের শিক্ষার্থী হাফিজ মুহাম্মদ। শক্তিশালী ভূমিকম্পে দেশটির বেশ কয়েকটি শহরে ব্যাপক ক্ষতি হলেও আঙ্কারায় ক্ষতি তেমনটা হয়নি। তবে এখানেও ভূমিকম্প ভালোই দুলিয়েছে শহরটিকে। হাফিজ মুহাম্মদ বলেন, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত তিনটা শহরে এখনো বিদ্যুৎ নাই। বাকিগুলোতে বিদ্যুৎ অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। বিভিন্ন সংস্থা, সিটি করপোরেশন, রেড ক্রিসেন্ট, বড় বড় ব্যবসায়ীরা খাবার দিচ্ছে। তবে কোনো কোনো স্থানে পানির সমস্যা আছে। উদ্ধার কার্যক্রম জোরদার করলেও বহু ভবন ধ্বসে পড়ায় কুলায়ে উঠতে পারছে না। সামর্থের বাইরে চলে গেছে অনেক আগেই। এক শহরে হাজারখানেক ভবন ধ্বসে পড়েছে। তারা নিরবচ্ছিন্নভাবে উদ্ধার কার্যক্রম চালাচ্ছে। সাধারণ মানুষও যোগ দিয়েছে। প্রতিবেশী দেশগুলো থেকেও বহু উদ্ধারকর্মী এসেছে। ভূমিকম্পে কাহরামানমারাস ছাড়াও গাজিয়ান্তেপ, মালাতিয়া, আদানা, হাতাই, দিয়ারবাকির, আদিয়ামান, উসমানিয়ে, সানলিউরফা, কিলিস বিভাগের দুই হাজারের বেশি ভবন ধ্বংস হয়েছে। বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের খোঁজ নিয়ে শুনলাম সবাইকে উদ্ধার করা হয়েছে। 

স্টেডিয়াম, পার্কিংয়ে লাশের সারি

তুরস্ক-সিরিয়ার বাতাসে আহাজারি চারিদিকে লাশের স্তূপ, কাঁদার লোকও নেই অনেক পরিবারে! বিভিন্ন স্টেডিয়াম আর পার্কিং এরিয়ায় শত শত লাশ। কম্বলে ঢাকা লাশ। তার ভিতর দিয়ে শোকার্ত স্বজনরা খুঁজে ফিরছেন প্রিয়জনকে। সতর্কতার সঙ্গে লাশের মুখ থেকে কম্বল সরাচ্ছেন। চেষ্টা করছেন চিনতে। শনাক্ত করতে পারলে হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। তাদেরকে শান্তনা দেওয়ার কেউ নেই। সবারই এক অবস্থা। এ খবর দিয়ে অনলাইন আল জাজিরা বলছে- পরিবারের কেউ না কেউ মারা গেছেন প্রলয় ঘটানো ভূমিকম্পে। এসব লাশের মুখের কাপড় সরানোতেও হাত কাঁপছে অনেকের। কারণ, অনেক লাশের মুখ থেঁতলে গেছে। বিকৃত আকার ধারণ করেছে। দুর্বল হৃদপিণ্ডের কেউ তা দেখলে বড় আঘাত পেতে পারেন। সিরিয়ার নাদা নামের এক নারী এবং তার তুর্কি স্বামী একজন স্টাফের কাছে জানতে চাইছিলেন, তাদের এক ভাতিজি ও আন্টিকে খুঁজে পাওয়ার সর্বোত্তম উপায় কি। তুরস্কের দক্ষিণের আন্তাকিয়া শহরের কাছে হাতায় রিসার্স হাসপাতালের পার্কিংয়ে শুইয়ে রাখা হয়েছে কমপক্ষে ১০০ মৃতদেহ। নাদা ও তার স্বামীর প্রশ্নের জবাবে স্টাফদের একজন বললেন- আপনাদেরকে একজন একজন করে চেক করতে হবে। নাদার স্বামী নিজের নাম প্রকাশ করতে চান না। তিনি একটি বার্তা সংস্থাকে বলেছেন, আমার স্ত্রী তুর্কি ভাষায় কথা বলতে পারে না। আমি ঠিকমতো দেখতে পাই না। আমাদেরকে প্রতিটি মৃতদেহের মুখ চেক করতে হবে। আমাদের সাহায্যের প্রয়োজন। ওদিকে আল জাজিরার সাংবাদিক সুহাইব আল খালাফ বলছেন, বিরোধীনিয়ন্ত্রিত সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে সালকিন এলাকায় একটি হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলছেন, হাসপাতালের মর্গে আর লাশ রাখার কোনো স্থান ফাঁকা নেই। ফলে তারা বাধ্য হয়ে মৃতদেহ হাসপাতালের বাইরে রাখতে বাধ্য হয়েছেন। এতে সেখানে এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। উদ্বিগ্ন মানুষের বিস্ফারিত চোখ। ভয়ে, আতঙ্কে, প্রিয়জনের শোকে শুকিয়ে গেছেন তারা। তবু অপেক্ষা করছেন প্রিয়জনের মৃতদেহের জন্য। তা নিয়ে তারা নিজের হাতে দাফন করতে চান। হাসপাতাল থেকে মৃতদেহ সরিয়ে নিতে এখন ব্যবহার করা হচ্ছে সাধারণ যানবাহন। কারণ, সেখানে পর্যাপ্ত সংখ্যক এম্বুলেন্স নেই। 

লেখক : সাংবাদিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির