post

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আতঙ্কে কাঁপছে বিশ্ব

হারুন ইবনে শাহাদাত

০৪ মে ২০২৩

রাশিয়ার আগ্রাসনের আগুনে জ্বলছে ইউক্রেন। গোটা বিশ্ব কাঁপছে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ আতঙ্কে। বিশ্বরাজনীতি, অর্থনীতি, কূটনীতি থেকে নিয়ে দুর্নীতি সবকিছুতেই রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে। কিন্তু কেন? রাশিয়া কি অদম্য। তাকে থামার মতো কোনো শক্তি কি পৃথিবীতে নেই? আসলে কি তাই? অবশ্যই না। রাশিয়া অদম্য নয়। বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ববাদী শাসনের ব্যাপক আধিপত্যের কারণেই বিশ্ববাসী এক অজানা আতঙ্কে আজ শঙ্কিত। আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিশ্বব্যাপী কর্র্তৃত্ববাদী শাসকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের বিকল্প নেই। যুদ্ধ শুরু করতে হবে সংশ্লিষ্ট দেশের ভিতর থেকেই। গোটা বিশ্বকে এখানে জড়ানোর প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই বিশ্বযুদ্ধ। কর্তৃত্ববাদী শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিটি দেশের গণতন্ত্রমনা মানুষরাই সোচ্চার। কারণ তারা জানেন, অন্যায়ের দুর্গের ধ্বংসস্তূপের ওপর নতুন সুরম্য প্রাসাদ গড়তে আন্দোলন সংগ্রাম আর যুদ্ধের প্রয়োজন হয়। শিকড়সহ অন্যায় উপড়ে ফেলে ন্যায়ের ফুল-ফসলে পৃথিবী সাজাতে প্রয়োজন যুদ্ধ। সেই ফুল ফসলের বাগানের সার জালিমের রক্ত- এই সবই দার্শনিক তত্ত্বকথা। তারা যুগে যুগে অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে মজলুম মানবতাকে জাগাতে এমন আগুনঝরা তত্ত্ব দিয়ে পৃথিবীকে বাঁচিয়েছেন জালিমদের আগ্রাসন থেকে। মানুষ যুদ্ধ করেছে, প্রাণ নিয়েছে, প্রাণ দিয়েছে।

সব সময়ই পৃথিবীর  কোনো না কোনো প্রান্তে যুদ্ধ চলে। এক প্রান্তে থামলে আরেক প্রান্তে শুরু হয়। যেমন সেই কবে শুরু হয়েছে ফিলিস্তিন, কাশ্মির আর মিয়ানমারের মুক্তি সংগ্রাম। থামার নাম নেই। বরং বিশ্ব মোড়লরা ইঁদুর-বিড়াল খেলছেন। সিরিয়ার মতো একটি সমৃদ্ধ মুসলিম দেশ কর্তৃত্ববাদী শাসনের আগুনে পুড়ছে। একটি সুষ্ঠু গণভোট এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে বিজয়ী সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার সহজ সমাধানের পথে না হেঁটে দুই বিশ্বমোড়ল নেমেছেন অস্ত্র-প্রতিযোগিতায় এবং ব্যবসায়। কাশ্মির সমস্যার সমাধানও আছে গণভোটেই, কিন্তু ...। এই সব কিন্তুর মাঝেই লুকিয়ে আছে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ ভবিষ্যতে কোন দিকে মোড় নিবে সেই সরল অঙ্কের জটিল ফলাফল।

কী সেই সরল অঙ্ক

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে প্রাণঘাতী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলছে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘এক বছরে এ যুদ্ধকে ঘিরে নানা সমীকরণে পটপরিবর্তন হয়েছে বিশ্ব রাজনীতির। এমন বাস্তবতায় পুরো বিশ্বে পড়ছে এ যুদ্ধের প্রভাব। ইউক্রেনে যুদ্ধের দামামা বাজার কয়েক সপ্তাহ আগেই ব্যাপক আকারে সামরিক মহড়ার মাধ্যমে অশনিসঙ্কেত পাঠায় রাশিয়া। পশ্চিমাদের শঙ্কা সত্যি করে ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাতে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে দেশটি। সেদিন ভোরের আলো ফোটার আগেই বিস্ফোরণ আর থেমে থেমে বিমান হামলার অ্যালার্ম বাজে ইউক্রেনে। আর ততক্ষণে পাল্টাতে শুরু করে বিশ্ব রাজনীতির দৃশ্যপটও। দ্বিধাবিভক্ত হতে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ।

যুদ্ধ শুরুর পর আতঙ্কিত ইউক্রেনীয়রা জীবন বাঁচাতে দেশ থেকে পালিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিলেও এক বছরের যুদ্ধে ইউক্রেনের সেনাসদস্যসহ হতাহত হন লাখো বেসামরিক নাগরিক। দীর্ঘদিন ধরে চলা যুদ্ধে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে ইউক্রেন। তবে বছরজুড়েই কূটনৈতিক কৌশল, সামরিক ও আর্থিক সহযোগিতায় ইউক্রেনকে নিশ্ছি দ্র নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে রাখতে মরিয়া পশ্চিমারা। ইউক্রেনের তদবিরে সাড়া দিয়ে অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, হিমার্স রকেট, আব্রামস, লিওপার্ড-টু ট্যাঙ্ক যুক্ত হয়েছে ইউক্রেনের অস্ত্র ভাণ্ডারে। এদিকে, একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আর শর্তের বেড়াজালে রাশিয়াকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমারা। তবে পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞার খড়গে উল্টো অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে জর্জরিত ইউরোপই। তেল নিয়ে তেলেসমাতি করার সুযোগও লুফে নেয় রাশিয়া। এতে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল এবং গমসহ নানা ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে যায়। মন্দার কবলে পড়ে বিশ্ববাসী। বছরজুড়ে ক্রিমিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার প্রধান সংযোগ সেতুতে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা, জাপোরিঝিয়া পারমাণবিক কেন্দ্রে হামলা, মস্কো-কিয়েভ খাদ্যশস্যচুক্তি ও নর্ডস্ট্রিম পাইপলাইনে রহস্যজনক ছিদ্র নিয়ে দ্বন্দ্বও কম হয়নি। সব ছাপিয়ে কূটনৈতিক শান্তি আলোচনায় যুদ্ধের পথ বন্ধ হবে কি না তা নিয়েও চলে বিশ্লেষণ। যদিও পুতিনের ক্রমাগত পরমাণু হামলার হুমকি, বাইডেনের কিয়েভ সফর ও চীনা প্রেসিডেন্টের রাশিয়া সফরের গুঞ্জন যুদ্ধ নিয়ে নতুন মেরুকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। পাশাপাশি এতোদিন কৌশলগতভাবে চীনের নিরপেক্ষ ভূমিকা দেখা গেলেও সম্প্রতি প্রকাশ্যে রাশিয়াকে সমর্থন দিয়ে উত্তেজনায় ঘি ঢালছে বেইজিং এমনটাই মনে করেন বিশ্লেষকরা।

রাশিয়া জানিয়েছে, পশ্চিমারা মস্কোর শর্ত মানলেই কেবল বন্ধ হবে যুদ্ধ। গত সেপ্টেম্বরের শেষদিকে রাশিয়া ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের লুহানস্ক ও দোনেৎস্ক এবং দক্ষিণাঞ্চলের জাপোরিঝিয়া ও খেরসন অঞ্চল দখলে নেয়। গণভোটের মাধ্যমে দখলকৃত সেই নতুন অঞ্চলগুলোর স্বীকৃতি চায় রাশিয়া। তবে ইউক্রেনের সার্বভৌম ভূখণ্ডে রাশিয়ার দখলদারিত্বকে পশ্চিমারা কখনোই স্বীকৃতি দেবে না বলে জানিয়ে দেয়। এ অবস্থায় ২০২৩ সালের বাজেটে রুশ প্রতিরক্ষা খাতের বিনিয়োগ পরিকল্পনায় এ বছরও চলমান যুদ্ধ বন্ধের সম্ভাবনা দেখছেন না বিশ্লেষকরা। রাশিয়া ও ইউক্রেনের সংঘাতের নেপথ্যে মূল কারণ হিসেবে রয়েছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোতে ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্তির চেষ্টা। ইইউ ও ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে ইউক্রেন। তবে ইউক্রেনের ন্যাটোভুক্ত হওয়া মানেই রাশিয়ার সার্বভৌমত্বের হুমকি উল্লেখ করে কিয়েভ ও তার মিত্রদের সতর্ক করে দেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এ নিয়েই মূলত টানাপড়েন শুরু হয়।

এ ছাড়া ২০১৪ সালে রুশপন্থী তৎকালীন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকে অঞ্চলটিতে আধিপত্য কমে যায় রাশিয়ার। অন্য দিকে, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে রুশ পন্থীদের বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দিয়ে তাদের ওপর দমন-পীড়ন চালায় ইউক্রেন সরকার। ইউক্রেন সরকারের বিরুদ্ধে রুশ প্রেসিডেন্ট সেখানে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করারও অভিযোগ করেন।

আর রুশ ভাষাভাষীদের রক্ষা করাও ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর অন্যতম কারণ হিসেবে প্রচারণা চালাচ্ছে রাশিয়া। বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত লুহানস্ক ও দোনেৎস্ককে স্বাধীন ঘোষণা করে গেল বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া। বিশ্লেষকরা মনে করেন, কর্তৃত্ববাদী একনায়কতান্ত্রিক শাসন মুক্তি তীব্র ইচ্ছা এই অঞ্চলের মানুষের মনে জাগ্রত হয়েছে, কমিউনিস্ট শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট হওয়ার কারণেই। কিন্তু সেই কমিউনিস্ট শাসকদের প্রেতাত্মারা এখনো বিদ্যমান। তারা গণতন্ত্রের নামে তাদের সাথে বারবার প্রতারণা করছে। 

সোভিয়েত ইউনিয়নের তিনটি প্রজাতন্ত্র- রাশিয়া, ইউক্রেন এবং বেলারুসের নেতারা সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য গোপনে একটি চুক্তিতে সই করেছিলেন ১৯৯১ সালের ডিসেম্বর মাসে। বাকি প্রজাতন্ত্রগুলোকে কিছু না জানিয়েই তারা এটি করেছিলেন। চুক্তিটি হওয়ার পর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচভ পদত্যাগ করেন এবং তার জের ধরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। সেসময় কঠিন সময় পার করছিলেন মিখাইল গর্বাচভ। ততদিনে পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্র ভেঙে পড়েছে। ১৯৮৯ সালে পতন হয়ে গেছে বার্লিন প্রাচীরের। কিন্তু তখনও পর্যন্ত টিকে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন যার নেতৃত্বে ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মিখাইল গর্বাচভ। কট্টরপন্থী কমিউনিস্টরা ১৯৯১ সালের আগস্ট মাসে গর্বাচভের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালায়। তারা গর্বাচভের গৃহীত উদারপন্থী কর্মসূচি ‘গ্লাসনস্ত পেরস্ত্রইকার’ ব্যাপারে খুশি ছিলেন না।  সেই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় গর্বাচভ বেঁচে গেলেন ঠিকই, কিন্তু নতুন এক সমস্যার মুখোমুখি হলেন। কারণ ইউক্রেনসহ সোভিয়েত ইউনিয়নের ১৫টি প্রজাতন্ত্রের অনেকগুলোতেই এর মধ্যে স্বাধীনতার দাবি জোরালো হয়ে উঠেছে।

ইউক্রেনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লিওনিদ ক্রাভচুক তখন পথ খুঁজছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে। তিনি বলেন, সেসময় স্বাধীন ইউক্রেন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তার প্রধান অগ্রাধিকার। ইউক্রেন, বেলারুস এবং রাশিয়া- এই তিনটি প্রজাতন্ত্রের নেতারা বৈঠকে বসেন ১৯৯১ সালের ডিসেম্বর মাসে। এই বৈঠকের জের ধরেই আকস্মিকভাবে পতন ঘটে সোভিয়েত ইউনিয়নের। বৈঠকটি হয়েছিল পশ্চিম বেলারুসে। ডেকেছিলেন বেলারুসের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট স্তানিস্লাভ শুশকেভিচ। তার সঙ্গে যোগ দেন রাশিয়ার নেতা তৎকালীন বরিস ইয়েলৎসিন এবং ইউক্রেনের লিওনিদ ক্রাভচুক। ইউক্রেন ততদিনে স্বাধীনতার আকাক্সক্ষার কথা ঘোষণা করে ফেলেছে। কিন্তু বেলারুস তখনও সেরকম কিছু করেনি। এর পরের দিন ১৯৯১ সালের ৮ই ডিসেম্বর সকাল নয়টায় এই তিন নেতা তাদের প্রধানমন্ত্রীদের নিয়ে আলোচনায় বসেন। বেলারুসের নেতা স্তানিস্লাভ শুশকেভিচ জানালেন যে বৈঠক শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির ব্যাপারে সমঝোতার প্রথম পরিচ্ছদটি লিখতে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পেরেছিলেন। 

‘আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই লাইনটি আমি মনে রাখবো। এটি ছিল আমাদের সমঝোতার শুরুর লাইন। কোনো ধরনের তর্কাতর্কি ছাড়াই এই লাইনটির ব্যাপারে আমরা একমত হয়েছিলাম। লাইনটি ছিল এরকম: ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা এবং আন্তর্জাতিক আইনের বিষয় হিসেবে ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকস বা ইউএসএসআর-এর কোনো অস্তিত্ব আর নেই।’ ইউএসএসআর-এর কোনো অস্তিত্ব থাকলেও রাশিয়া এই অঞ্চলে গণতন্ত্রের বিকাশ ঘটতে দেয়নি। পনেরোটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হলেও কাউকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে দেয়নি রাশিয়া। বিশেষ করে মুসলিম প্রধান অঞ্চলগুলোর স্বাধীনতাকামীদের সাথে রাশিয়া বার বার মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। বিশেষ করে চেচনিয়ার সাথে রাশিয়ার আচরণের নির্মম ইতিহাস বিশ্ববাসী কোনোদিন ভুলবে না। সেই সময়ই যদি ইউরোপসহ গোটা গণতান্ত্রিক বিশ্ব রাশিয়ার লাগাম টেনে ধরতো তাহলে হয়তো আজ ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর সাহস পেতো না। রাশিয়ার এই আগ্রাসী মনোভাব আজ গোটা বিশ্ব রাজনীতিকে নাড়িয়ে দিয়েছে। দেশে দেশে কর্র্তৃত্ববাদী শাসকরা মস্কোর দিকে মুখ ফিরিয়ে দুঃসাহসী হয়ে উঠছে। গণতন্ত্রকামী জনতার মুখ বন্ধ করতে চালাচ্ছে নিপীড়ন নির্যাতন।

ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনে পাল্টে যাচ্ছে ভূ-রাজনীতি

রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, প্রতিবেশী রাশিয়ায় ইউক্রেনের আক্রমণ উভয় দেশের সীমান্ত ছাড়িয়ে বিশ্বব্যবস্থাকে এলোমেলো করে দিয়েছে। শীতল যুদ্ধের পর প্রথমবারের নতুন মেরুকরণ হয়েছে। ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপি এক প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে প্রায় এক বছর ধরে চলমান সংঘাতটির ফলে বিশ্বে কেমন পরিবর্তন এসেছে। এই যুদ্ধ সংঘাত ও মুখোমুখি অবস্থানকে আরও প্রকাশ্যে নিয়ে এসেছে। বিশেষ করে ওয়াশিংটন ও বেইজিং-কেন্দ্রিক দেশগুলোর বিভক্ত হওয়া আরও বেড়েছে। গত বছর ডিসেম্বরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)-এর পররাষ্ট্রনীতি প্রধান জোসেফ বোরেল বলেছিলেন, আমরা একটি বহু মেরুর বিশ্বে প্রবেশ করেছি যেখানে সবকিছুই অস্ত্র, জ্বালানি, ডাটা, অবকাঠামো, অভিবাসন। ভূ-রাজনীতি একটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ, সবকিছুই ভূ-রাজনীতি। এশিয়ার মধ্যাঞ্চল, ককাস, বলকান, আফ্রিকা ও এশিয়া-প্রশান্ত অঞ্চল ছিল চীন, ইইউ, রাশিয়া ও তুরস্কের প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্র। অবকাঠামো প্রকল্পে অর্থায়ন বা বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষর, সামরিক বা কূটনৈতিক সহযোগিতার মাধ্যমে এই লড়াই চলমান ছিল। ইউক্রেন যুদ্ধ সবকিছুকেই নাড়া দিয়েছে। মধ্য এশিয়ায় সাবেক সোভিয়েত দেশগুলোতে রাশিয়ার প্রভাব দুর্বল হয়েছে। এতে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে তুরস্ককে নতুন ভূমিকায় হাজির করেছে।

ফ্রান্স-ভিত্তিক এফএমইএস থিংকট্যাংক-এর প্রধান পিয়েরে রাজৌক্স বলেন, এই বিশৃঙ্খল পুনর্গঠন বাস্তবতা কিন্তু হয়ত সাময়িক। অনিবার্যভাবে যুদ্ধের অবসান রাশিয়া ও ইউরোপকে দুর্বল করবে। একই সময়ে এই পরিস্থিতির বড় দুই সুবিধাভোগী হবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। ২০৪৯ সালে বিশ্বের শীর্ষ শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত লক্ষ্যের আলোকে ইউক্রেন যুদ্ধকে বিবেচনা করছে চীন। বেইজিংকে মস্কো সমর্থন করলেও পশ্চিমাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হয় এমন কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ এড়িয়ে গেছে দেশটি।

ইইউ ইনস্টিটিউট ফর সিকিউরিটি স্টাডিজ-এর এশিয়া বিশ্লেষক অ্যালিস একমান বলেন, চীন দূরে সরছে না। বরং রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আরও দৃঢ় করছে। পূর্ণ সহযোগিতা হয়তো করছে না চীন। এমনকি ইউক্রেনকে যে মাত্রায় সহযোগিতা করছে যুক্তরাষ্ট্র সেই মাত্রায় কোনও সহযোগিতা রাশিয়াকে দিচ্ছে না চীন। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরালো হয়েছে। কার্যত যুদ্ধের ফলে বেইজিংয়ের একটি করদ রাজ্য বা মুখাপেক্ষী হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে মস্কো।

অর্থনীতিবিদ ও নিষেধাজ্ঞা বিশেষজ্ঞ আগাথি দেমারাইস বলেন, চীনের সঙ্গে দরকষাকষির মতো অবস্থায় নেই রাশিয়া। চীন যা চাইবে তা পেয়ে যাবে। কিন্তু রাশিয়া যা চাইবে তা দিতে হবে না। রাজৌক্স বলছেন, ক্রেমলিন চীনের প্রতি নির্ভরশীলতা সীমিত রাখতে তুরস্ক, মধ্যপ্রাচ্য, ইরান ও আফ্রিকায় নিজেদের ভূ-রাজনীতি, অর্থনীতি ও কৌশলগত সম্পর্কে বৈচিত্র্য আনছে। রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র ভাণ্ডার চীনের চেয়ে বড়, যা দেশটিকে পুরোপুরি চীনের অধীনস্থ হয়ে পড়া থেকে ঠেকাবে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য এই যুদ্ধ সুযোগ ও ঝুঁকি নিয়ে এসেছে। একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে নিজেদের তুলে ধরার সুযোগ যেমন রয়েছে তেমনি আবারও ওয়াশিংটনের ছায়ায় পেছনে থাকার ঝুঁকিও।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিনিয়র ইউরোপীয় কর্মকর্তা বলেন, ইউরোপ খুব খারাপ করছে না, যুদ্ধের শুরু থেকে সামরিক সহায়তা, শরণার্থীদের ত্রাণ ও রাশিয়ার ওপর জ্বালানি নির্ভরশীলতা হ্রাস করে নিজেদের টিকে থাকার শক্তি ও সামর্থ্যের প্রমাণ দিচ্ছে। এই কর্মকর্তা আরও বলেন, জরুরি প্রয়োজনে সাড়া দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। কিন্তু ভবিষ্যৎ ও বৈশ্বিক পাটাতনে নিজেদের নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আরও অনেক কাজ বাকি। দেমারাইসের প্রশ্ন, স্পষ্টভাবে দুটি মেরু রয়েছে। একটি মার্কিন, অপরটি মিত্রদের নিয়ে চীন এবং রাশিয়া। ইউরোপ তৃতীয় ব্লক হবে নাকি হবে না কিংবা তারা কি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে থাকবে?

রাজৌক্স বলছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এখন পর্যন্ত ওয়াশিংটনের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কিয়েভকে সমর্থন করছে। ইউরোপীয় নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করতে চান। কিন্তু তারা বুঝতে পারছেন তারা এক বা দুটি রাজনৈতিক শর্তে নিজেদের একা অবস্থায় পেতে পারেন যদি বিচ্ছিন্নতাবাদী কেউ হোয়াইট হাউজে বসেন।

২০০৯ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছিলেন, একুশ শতকের গঠন হবে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্পর্কের ভিত্তিতে। এর মাধ্যমে ওয়াশিংটন নিজেদের মনোযোগ আটলান্টিক থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে নিয়ে আসে। কিন্তু ইউক্রেনে রুশ আক্রমণ দেখিয়ে দিচ্ছে ওবামার ভাইস-প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জন্য ইউরোপ থেকে গুটিয়ে নেওয়া এত সহজ নয়। ফ্রান্সের সেনা প্রধান বার্ট্রান্ড তুজস বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই পরিবর্তন রোধ করছে রাশিয়া, এতে লাভ হচ্ছে চীনের। যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই দ্রুত ইউরোপ প্রশ্ন সমাধান করতে হবে।

জাপানে মোতায়েন হওয়া মার্কিন কমান্ডার জেমস বিয়েরম্যান সম্প্রতি বলেছেন, এই যুদ্ধের ফলে তাইওয়ানকে ঘিরে চীনের সঙ্গে সম্ভাব্য সংঘাত বিষয়ে বেশ কিছু বিষয় শেখার রয়েছে। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে রাশিয়ার আক্রমণের পর আমরা ভবিষ্যৎ সংঘাত মোকাবেলায় ইউক্রেনীয়দের প্রস্তুত করতে শুরু করি, আমরা কিছু স্থান নির্বাচন করি যেগুলো থেকে আমরা সহযোগিতা দিতে পারি। এটাকে আমরা মঞ্চ প্রস্তুত করা বলতে পারি। এবং আমরা মঞ্চ প্রস্তুত করছি জাপানে, ফিলিপাইনে এবং অপর স্থানে।

ইউক্রেনকে মার্কিন ও ইইউর নেতৃত্বে বিভিন্ন দেশের পক্ষ অস্ত্র পাঠানোর পাশাপাশি রাশিয়ার অর্থনীতির ওপর ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। জ্বালানি খাতে রাশিয়া বড় রফতানি-কারক। জি-৭ ও ইইউর পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ মূল্য বেঁধে দেওয়ার ফলে এই জীবাশ্ম জ্বালানির বৈশ্বিক বাজার শেষ হয়ে গেছে বলে মনে করেন টোটাল এনার্জির প্রধান নির্বাহী প্যাট্রিক পিউয়ান্নি। তার কথায়, চীন ও ভারতের বড় ক্রেতা যখন ভিন্ন দামে রুশ তেল কেনা অব্যাহত রেখেছে তখন বৈশ্বিক তেলের মূল্যের ধারণার অর্থই বা কী থাকে? এটি একেবারে নতুন কিছু এবং ২০২৩-এর মধ্য দিয়ে আমাদের যেতে হবে। পরাশক্তিগুলো এক সময় সর্বত্র মুক্ত বাণিজ্যের পক্ষে সোচ্চার ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারীতে বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনে আঘাত পড়েছে। মহামারীর পর যুদ্ধে তা আরও বিপর্যস্ত হয়েছে।

আফ্রিকা থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মানুষের মৌলিক চাহিদা খাদ্য, উষ্ণতা ও আশ্রয়ের পেছনে ব্যয় বেড়েছে। করোনাভাইরাস মহামারী শুরুর আগে থেকেই জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে বৈশ্বিক সংকট ছিল।

জার্মানি-ভিত্তিক ফ্রেডেরিখ এবার্ট ফাউন্ডেশন এক গবেষণায় উল্লেখ করেছে, এই প্রভাব কমানোর চেষ্টা করে অনেক দেশের সরকার। তবু ২০২২ সালে প্রতিদিনের মৌলিক চাহিদা পূরণের ব্যয় কমানোর জন্য নজিরবিহীন বিক্ষোভ হয়েছে। 

বেশ কয়েকটি দেশে এসব বিক্ষোভ বৃহত্তর জাতীয় রাজনৈতিক সংকট, বড় ধরনের সহিংসতা, হতাহত ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের দাবি তুলেছে। সবচেয়ে বেশি ভুগছে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। কারণ তাদেরকে বিপুল পরিমাণ খাদ্য আমদানি করতে হয়। এ ছাড়া বিশ্বজুড়ে দরিদ্র দেশগুলোতে জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে সংকট তো ছিলই।’ এখন প্রশ্ন একটাই, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষের বিশ্বশক্তির করণীয় কী?

গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষের বিশ্বশক্তির করণীয়: আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, দেশে দেশে যুদ্ধ ছড়িয়ে দিয়ে বিশ্বযুদ্ধ বাধানো কোনো সমাধান নয়। 

পৃথিবীর প্রতিটি কর্তৃত্ববাদী সরকারের শাসনাধীন দেশেই আছে কোটি কোটি গণতন্ত্রকামী জনতা তাদেরকে জাগাতে হবে। তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। বাইরে থেকে নয় কৃর্ত্ববাদের শিকড় উৎপাটন করতে হবে ভিতর থেকেই। তবেই ইউক্রেন যুদ্ধের মতো ভয়াবহ সঙ্কট মোকাবেলা করতে পারবে এই বিশ্ব। 

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির