দুনিয়ায় কুরআনি সমাজ গড়তে হলে সমাজে ও রাষ্ট্রে কুরআনি আইন চালু করতে হবে। কুরআনি আইন চালু করতে হলে প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থা যদি বিপরীত ধর্মী হয়, তাহলে ওই রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিবর্তন করতে হবে। কিন্তু প্রচলিত এবং প্রতিষ্ঠিত বিপরীতধর্মী রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিবর্তন করা মুখের কথা নয়; বরং তা ভীষণ কঠিন এবং দুঃসাধ্য ব্যাপার। প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থা কুরআনি আইনের পরিপন্থি হলে তাদেরকে বলা হয় তাগুতিশক্তি। আর তাগুতি শক্তি সহজেই ক্ষমতা ছাড়তে নারাজ। তারা প্রয়োজনে কুরআনি আইন প্রতিষ্ঠাকারীদের বিরুদ্ধে তুমুল সংঘর্ষ সৃষ্টি করবে, ব্যাপক বাধার সৃষ্টি করবে, পাকড়াও করে জেলবন্দি করবে, গুম করবে, হত্যা করবে; এমনকি দেশত্যাগে বাধ্য করবে। এরা ইতিহাসের আবু জাহেল, আবু লাহাব, ফেরাউন এবং নমরুদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে।
এতকিছুর পরও কুরআনি আইন প্রতিষ্ঠাকারীদের বসে থাকলে চলবে না। তাদের কুরআনি দাওয়াতের মাধ্যমে লোক তৈরির কাজ অব্যাহত রাখতে হবে, সংঘবদ্ধ হতে হবে। সততা, উদারতা, নৈতিকতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, মহানুভবতা, ভালোবাসা, শৃঙ্খলাবোধ এবং আনুগত্যের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধভাবে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। যে আন্দোলনের অনুসারীরা কুরআনের আইন প্রতিষ্ঠা করতে চায়, ওই আইন সর্বাগ্রে তাদের নিজেদের জীবন, সংগঠন এবং দলের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। অতঃপর আন্দোলনের এ ধারা নিরবচ্ছিন্ন গতিতে আজীবন; এমনকি কিয়ামত পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে অব্যাহত রাখতে হবে। কেননা তাগুতিশক্তির দল আজীবন ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য আন্দোলন, সংগ্রাম, লড়াই অব্যাহত গতিতে চালিয়ে যাবে। সুতরাং যারা ওই তাগুতি শক্তিকে উৎখাত করে কুরআনি আইন প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাদেরকে কুরআন-এর আইন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, সংগ্রাম, লড়াই অপ্রতিহত গতিতে অব্যাহত রাখতে হবে।
আল কুরআনে আল্লাহ পাকের ঘোষণা-
‘আল্লাজিনা আমানু ইয়ক্বতিলুনা ফি সাবিলিল্লাহী, ওয়াল্লাজিনা কাফারূ ইয়ক্বতিলুনা ফি সাবিলিত-তগুত’ অর্থাৎ যারা আল্লাহর রাহে ঈমান এনেছে, তারা আল্লাহর রাস্তায় লড়াই-সংগ্রাম অব্যাহতভাবে চালিয়ে যেতে থাকবে। অপরপক্ষে যারা কুফুরির পক্ষে ঈমান এনেছে, তারাও তাগুতিশক্তির পক্ষে লড়াই-সংগ্রাম অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাবে।এভাবে দৃঢ় চিত্তে জিহাদি চেতনায় চলার পথে অনেককে শহিদি মৃত্যুর কোলে আশ্রয় নিতে হতে পারে। এভাবে অব্যাহত লড়াই-সংগ্রামের একপর্যায়ে কুরআনি বিজয় অবশ্যম্ভাবীভাবে সফল হবে বলে আল্লাহ তায়ালানিশ্চয়তা দিয়ে ঘোষণা করেছেন-
‘ওয়া-দাল্লাহুল্লাজীনা আমানু মিনকুম ওয়া আমিলুচ্ছালিহাতি লা ইয়াছ তাখলি ফান্নাহুম ফিল আরদ্ব’ অর্থাৎ আমি আল্লাহ ওয়াদা করছি, যারা ঈমান আনার পর অব্যাহতভাবে আমলে সলেহ অর্থাৎ তাগুতের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাবে, তাদেরকে আমি অবশ্যই দুনিয়ার খেলাফত (নেতৃত্ব) দান করব। আল্লাহ তায়ালা যে ঘোষণা দিয়েছেন, নবি মুহাম্মাদ (সা.)-কে সেই খেলাফতের নেতৃত্ব দিয়েছেন, আবু বকর সিদ্দিক (রা.) এবং খোলাফায়ে রাশেদার সকল খলিফাদেরকে এবং তৎপরবর্তী ইমামুল মুরসালিনগণদেরকেও সেই একই নেতৃত্ব দিয়েছেন। সেই নেতৃত্ব আমাদেরকেও দেবেন বলে আল্লাহ তায়ালার সুস্পষ্ট ওয়াদা রয়েছে। দুনিয়ার বুকে সকল প্রকার তাগুতি জালিম নেতৃত্বের বিরুদ্ধে মুমিনদের অব্যাহত লড়াই-সংগ্রামের ফলশ্রুতিতে আল্লাহ তায়ালার ওই নিশ্চিত ওয়াদা । এক্ষেত্রে মহান আল্লাহ তায়ালা ওই সকল মুমিনদের জন্য আরও একটি যুগান্তকারী ঘোষণা দিয়েছেন। আল কুরআনে এরশাদ হয়েছে-
‘তু-মিনূনা বিল্লাহি ওয়া রাসুলিহি ওয়া তুজাহিদুনা ফি সাবিলিল্লাহি বি আম ওয়ালিকুম ওয়া আনফুছিকুম, যালিকুম খাইরুল্লাকুম ইন কুনতুম তা-লামুন।’ (সূরা আন-নুর : ৫৫)
অর্থাৎ যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান এনেছে, তারা আল্লাহর পথে অব্যাহতভাবে লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাবে তাদের জান-মাল সম্পদ দিয়ে এবং এটাই তাদের জন্য সর্বাপেক্ষা উত্তম কার্যবিধি, যদি তারা সঠিকভাবে বুঝে থাকে।
আল্লাহ আরও ঘোষণা করেছেন- ‘যদি মুমিনরা এ কর্মবিধিতে সফল হতে পারে, তাহলে তাদের সকল অপরাধ ক্ষমা করে দেওয়া হবে এবং সকলকে এমন সব পুষ্পশোভিত বাগ্বাগিচায় প্রবেশ করানো হবে, যেসবের তলদেশ দিয়ে সুললিত ঝরনাধারা সদা প্রবাহিত থাকবে এবং ওই শান্তিময় জান্নাতের অতি উত্তম আবাসে চিরকাল তারা অবস্থান করবে। এটা তাদের জন্য মহা সাফল্য।’
আল্লাহ তায়ালা আরও ঘোষণা করেছেন-“এছাড়া তোমরা মুমিনরা আরও একটি জিনিস বড়োই পছন্দ করো, সেটি হলো মহান আল্লাহর সাহায্য এবং আসন্ন বিজয় আর এক্ষেত্রে মুমিনদের জন্য রয়েছে বড়োই সুসংবাদ।” (সূরা সাফ : ১৩)
আল কুরআন ঘোষিত উক্ত সব ঘোষণাসমূহের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো-
১. মহান আল্লাহ তায়ালার মূল টার্গেট, মূল ভিশন, মূল মিশন- দুনিয়াতে খেলাফতের নেতৃত্বে আল্লাহর কুরআনি আইন চালু করা। ‘আন আকিমুদ দ্বীন’, ‘লি ইয়ুজহিরাহু আলা দ্বীন’ অর্থাৎ, কুরআনি সংবিধান প্রতিষ্ঠা করা। কুরআনের এই পদ্ধতির এজাহার করা অর্থাৎ বিজয়ী করা।
২. এ মহান কার্যটি সম্পন্ন করতে হলে আমলে সলেহকারী অর্থাৎ সৎকর্মশীল জীবন ও সম্পদ কুরবানকারী একদল সুশৃঙ্খল এবং আনুগত্যশীল মরদে মুজাহিদের প্রয়োজন ।
৩. এ মুজাহিদ আসমান থেকে সরাসরি অবতরণ করবে না; বরং দুনিয়ার মানুষের ভেতর থেকেইএ রকম একটি অকুতোভয়, সংগ্রামী, লড়াকু জনগোষ্ঠী নীতি-নৈতিকতা, সততা, চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং সফল নেতৃত্বের যোগ্যতায় আমল- আখলাকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তৈরি হতে হবে ।
৪. আর এজন্য প্রয়োজন একদল সৎকর্মশীলদের মাধ্যমে জনগণের কাছে ব্যাপকভাবে দাওয়াতি কাজ করে বুঝিয়ে, চিন্তায়-চেতনায় মস্তিষ্ককে কুরআনি ধারণায় উজ্জীবিত করা।
প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে এরূপ কুরআনি সংবিধানিক শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য জামায়াতে ইসলামী স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে নিরলস এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। শুরু থেকেই এদেশের অন্যান্য ইসলামী দল হিসেবে পরিচিত খানকা, ফেরকা, মাজারপূজারি, ভান্ডারি গ্রুপগুলো জামায়াতে ইসলামীর এরূপ কুরআনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চিরন্তন আন্দোলনকে ক্ষমতালোভী, ভোটখুরি, নাজায়েজ, গঁজাাখুরি, মতলবি, মতবাদী এরূপ বিভিন্ন বিশেষণে ও বীভৎস ভাষায় গালি-গালাজ এবং জনগোষ্ঠীকে বিভ্রান্ত করে জামায়াতকে ইহুদিবাদীদের দালাল হিসেবে চিহ্নিত করে আসছে। আর ফতোয়াবাজি প্রোপাগান্ডা করে আসছিল সেই সত্তরের দশক থেকে নব্বই পেরিয়ে ২০০০ সালের পরবর্তী প্রায় ৪০টি বছর সময়কাল ধরে। এরপর আলিমদের শিরোমণি মুহতারাম হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) যখন প্রপাগান্ডাকারীদের সকল আগল উপেক্ষা করে ‘বটবৃক্ষের’ মর্যাদার প্রতীক নিয়ে ভোটের ময়দানে অবতীর্ণ হলেন, তখন অন্যান্য ইসলামী দল, গ্রুপ, ফেরকা খানকা, মাজার পূজারি ভান্ডারিদের চোখ খুলল এই বলে যে, ইসলামী দল করে তাহলে ভোট করা যায়। এবারে কিন্তু জামাতের বিরুদ্ধে ভোটখুরির মতো অপবাদের কিছুটা হলেও পরিসমাপ্তি ঘটল। আরও ভাববার বিষয়, এদেশের আরেক শীর্ষ আলেমে-দ্বীন আল্লামা আজিজুল হক সাহেব যখন চরম বাম-ধর্মনিরপেক্ষবাদীদের সমর্থনপুষ্ট আওয়ামীলীগের প্রধান নেতৃত্বের সাথে পাঁচ দফা চুক্তিবদ্ধ হয়ে ক্ষমতার মসনদের আকাক্সক্ষায় নির্বাচনী ময়দানে কোমর বেঁধে নেমে পড়ার পরাকাষ্ঠা দেখালেন, তখন ইতঃপূর্বের প্রোপাগান্ডাকারীরা আরেক দফা সরে গিয়ে জামায়াত ভোটখোর আর ক্ষমতালোভী; এ অপবাদের মোহান্ধ থেকে আর একটু সরে গিয়েআর পিছিয়ে না থেকে এবারে তারা নিজেরাই ভোট আর ক্ষমতার লাগাম রশ্মির আলোক ঝলকানিতে মেতে উঠলেন। এমনি করে দেখা গেল, ২০০১ সাল থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে এমন কোনো ইসলামী কিংবা ধর্মীয় দল আর অবশিষ্ট থাকল না, যারা জাতীয় কিংবা স্থানীয় সকল পর্যায়ের নির্বাচনী ময়দানে ভোট প্রাপ্তির উদগ্র কামনায় রাজনৈতিক নেতৃত্বের খায়েস পূরণে কিলবিলিয়ে নড়ে ওঠেননি। এখন এসব বিভিন্ন ধারার বিভাজিত দল আর গ্রুপের স্বরূপ উন্মোচিত হয়ে সরলসোজা সমীকরণে তারা বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে- ধর্মে আর কর্মে , নির্বাচনে আর ভোটে, ক্ষমতায় আর নেতৃত্বে একাকার হতে হবে।
এখন প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হচ্ছে- ওহে! বাহে! এদেশে জামায়াতে ইসলামী পঞ্চাশ বছর ধরে কুরআনি নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে, সংগ্রামে, নির্বাচন নেতৃত্বে, ভোটে এবং সমর্থনের যে ধারা চালু রেখেছিল, তাতে কেন তোমরা প্রচণ্ড বাধার সৃষ্টি করে, ফতোয়াবাজি করে একদল জনগোষ্ঠীকে নিয়ে ভুলের খান্দকে হাবুডুবু খাচ্ছিলে? তোমরা কি তখন কুরআনি ধারণার মূল কনসেপশন বুঝে উঠতে পারো নাই? নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করে শুধু কেবল জামায়াতবিরোধিতায় উম্মত্তছিলে? তবে হ্যাঁ- এখন যদি বুঝে থাকো, তবে বলতেই হয়- “হোয়াট জামায়াত থিংকস্ টুডে, আদার ইসলামী পার্টিস থিংকস্ টুমরো” অর্থাৎ জামায়াত আজকে যা চিন্তা করে, অন্যান্য ইসলামী দলগুলোর তা রপ্ত করতে আরও অনেক দিন সময় লেগে যায়।তৎকালীন ভারতেও এমন একটি প্রবাদ চালু ছিল, “হোয়াট বাঙালি থিংকস্ টুডে, অল ইন্ডিয়া থিংকস্ টুমরো।” অর্থাৎ ভারতবর্ষে আজ বাঙালিরা যা চিন্তা করে, অন্যান্য ভারতবাসীকে তা বুঝতে পরবর্তী দিন পর্যন্ত সময় লেগে যায়। এক্ষেত্রে জামায়াতের দূরদর্শী চিন্তা চেতনার ব্যাপারে অন্যান্য ইসলামী দলগুলোরও অনুরূপ অবস্থা।
এখন বোঝা গেল- ইসলামী নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় কুরআনি মর্ম কথা হলো, “ইন্নি যায়িলুন ফিল আরদ্বি খলিফা” অর্থাৎ নিশ্চয়ই আমি দুনিয়াতে আমার প্রতিনিধির নেতৃত্ব চালু করতে চাই। যে নেতৃত্ব দুনিয়াতে আমার কুরআন ঘোষিত দ্বীনি সংবিধান বিজয়ী করবে ‘আনা আকিমুদ্দিন’ অর্থাৎ দ্বীন কায়েম করবে।
আর এক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী এদেশে পাইওনিয়ারের দায়িত্ব পালন করে আসছে এবং অদ্যবধি পালন করে যাচ্ছে। আগামীতেও তারা দৃঢ়চিত্তে ওই দায়িত্বই পালন করে যাবে বলে ইস্পাত কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যারা এ দেশে আল্লাহর কুরআনি কনসেপশনের আলোকে দ্বীন কায়েম করতে বদ্ধপরিকর, তাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে দ্বীন বিজয়ের এ লড়াই সংগ্রামে ইস্পাত-কঠিন শপথ নিয়ে অংশগ্রহণ করা সময়ের দাবি।
লেখক : সাবেক এমপি
আপনার মন্তব্য লিখুন