post

নতুন আলোয় আলোকিত বালকান অঞ্চল

০৩ মার্চ ২০১৫

হাফিজুর রহমান#

Antorjatikইউরোপের পূর্ব ও দক্ষিণের দেশগুলো বালকান অঞ্চল নামে পরিচিত। মূলত খ্রিষ্টান অধ্যুষিত ইউরোপে যে কয়টি মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র বিদ্যমান এর সবগুলোই এ অঞ্চলে অবস্থিত। কিন্তু এ অঞ্চলটি বারবারই বিশ্ব পরাশক্তি এবং প্রভাবশালীদের শকুনের দৃষ্টির শিকার। বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মোড়ল রাষ্ট্রগুলো যথাÑ জার্মানি, ফ্রান্স ও ইতালির প্রভাবে এ অঞ্চলটি আজও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। বর্তমানে আমেরিকার অতিরিক্ত প্রভাব খাটানোর ব্যাপারটা মারাত্মক অবস্থার সৃষ্টি করেছে। আলবেনিয়া, বসনিয়া-হার্জেগুবিনা, বুলগেরিয়া, গ্রিস, কসোভো, মেসিডোনিয়া, মন্টিনিগ্রো, সার্ভিয়া, রোমানিয়া, ক্রোয়েশিয়া, শেন্টাভেনিয়া এবং তুরস্ক (তুরস্কের ইউরোপ অংশ) এই দেশগুলো বালকান অঞ্চল নামে পরিচিত। এর মধ্যে আলবেনিয়া, বসনিয়া-হার্জেগুভিনা, কসোভো এবং তুরস্কের জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ১০০ ভাগই মুসলমান। এর বাইরে মেসিডোনিয়া, মন্টিনিগ্রোতেও জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ মুসলমান। বাকি রাষ্ট্রগুলো খ্রিষ্টান অধ্যুষিত হলেও কিছুকিছু জায়গায় মুসলমানরা বসবাস করে। সংখ্যার দিক থেকে এ রাষ্ট্রগুলোতে কোথাও মুসলমানরা দ্বিতীয় কোথাওবা তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে। একাদশ, দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত এ দেশগুলো মূলত রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। রোমান সাম্রাজ্যের তৎকালীন রাজধানী ইস্তাম্বুলের পাশে এ দেশগুলোর অবস্থান হওয়ায় এ অঞ্চলের আলাদা একটি গুরুত্ব ছিল। তখন এ অঞ্চলটা মূলত পূর্ব ইউরোপ হিসেবে পরিচিত ছিল আর তখনও এখানে জাতি রাষ্ট্রের উদ্ভব তেমনভাবে শুরু হয়নি। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে যখন উসমানী খিলাফত শক্তিশালী হতে থাকে এবং রোমানদের শক্তি কমতে শুরু করে। তখনই বুলগেরিয়া, সার্ভিয়াকিং বা বসনিয়ার মত দেশগুলোতে রাজারা নিজেরা শক্তিশালী হতে শুরু করে। তখন এ অঞ্চলগুলো একচেটিয়া খ্রিষ্টানদের দখলে ছিল। পরবর্তীতে উসমানী খিলাফতের খলিফারা ইস্তাম্বুল বিজয়ের মাধ্যমে রোমানদের পরাজিত করার পর এ রাষ্ট্রগুলো তাদের অধীনে আসে। মুসলমানরা ব্যাপক দাওয়াতি কাজ শুরু করে। তুরস্ক থেকে দায়ীরা এ অঞ্চলগুলোতে সফর করা বা বসবাস করা শুরু করেন। সাধারণ জনগণ ইসলামের মহানুভবতা দেখে ইসলামের প্রতি তাদের আগ্রহ সৃষ্টি হয় এবং ধীরে ধীরে লোকজন দলে দলে ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়। উসমানী খলিফারা এ অঞ্চলে ইসলামের বিকাশ ও ইসলামী শিক্ষায় জনগণকে শিক্ষিত করার লক্ষ্যে ব্যাপক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেন। বিশেষ করে ব্যাপক মাদরাসা ও মসজিদ নির্মাণ করা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানী খিলাফতের পতনের পর এ দেশগুলোতে পরাশক্তিরা জবরদখল শুরু করে। জার্মানি, ইতালি এবং ফ্রান্স দেশগুলোকে দখল করে নেয়। এর পাশাপাশি পরাশক্তিদের এই দখলদারিত্ব নিয়েও প্রায়ই যুদ্ধ বাধত। আর এই যুদ্ধগুলোতে প্রাণ গিয়েছে লাখো বালকানবাসীর। বিশ্বমোড়লরা অনেকটা দাবা খেলার মতোই এ অঞ্চলের মানুষগুলোকে নিয়ে খেলেছে। বিশেষ করে মুসলমানদের নিয়ে পরবর্তী সময়ে এ অঞ্চলের খ্রিষ্টান অধ্যুষিত দুই প্রভাবশালী দেশ যুগোস্লাভিয়া ও সার্বিয়ার শাসকদের জুলুমের শিকারও হয়েছে অহরহ। অতগুলো বাইরের সমস্যা মোকাবেলা করার চেয়ে নিজেদের ভেতরের কমিউনিস্ট ও সোসালিস্ট ধারার শাসকরা আরও বেশি ক্ষতি করেছে মুসলমানদের। বর্তমান সময়ে বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর মতোই রাষ্ট্রপরিচালনায় আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রভাব স্বভাবতই অনেক বেশি। কিন্তু ইদানীং এ অঞ্চলের মুসলিম দেশগুলোতে খ্রিষ্টান মিশনারিগুলোর প্রচুর দাওয়াতি কাজ এবং গরিব মুসলমানদের  পেছনে অনেক বেশি অর্থ বিনিয়োগ মুসলমানদের জন্য নতুন হুমকি। এমনকি মসজিদগুলোতে নামাজের পর খ্রিষ্টান ধর্মও তাদের নানা অনুষ্ঠানে দাওয়াতের লিফলেটও বিতরণ করতে দেখা যায় কোথাও কোথাও। যদিও আলবেনিয়া কিংবা কসোভোর কয়েকজন ভাইকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম যে, খ্রিষ্টান মিশনারিগুলোর এ দাওয়াতে খ্রিষ্টান ধর্ম সরাসরি গ্রহণ করেছে, এই সংখ্যাটা খুবই কম বরং মুসলমানদের সংখ্যা ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে। কিন্তু তাদের সংস্কৃতি ও জীবনধারা সহজেই মুসলমানদের জীবনে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। তবে মেসোডোনিয়া ও মন্টিনিগ্রোর জনসংখ্যার একটি বড় অংশ মুসলমান। মেসোডোনিয়ার জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ৩৩ ভাগ ও মন্টিনিগ্রোর জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ১৯ ভাগ মুসলমান, যদিও রাষ্ট্র দুটো খ্রিষ্টান শাসকদের দ্বারা পরিচালিত। বালকান অঞ্চলে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানো ও বিকাশের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান উসমানী খেলাফতের খলিফাদের। কিন্তু উসমানী খেলাফতের পতনের পর দুর্বল নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক অপরিপক্বতার কারণে মুসলিম রাষ্ট্রগুলো প্রায়ই আগ্রাসনের শিকার হয়েছে। বর্তমানে দেশগুলো পূর্ণ স্বাধীনতা পেলেও এখনো রাষ্ট্রগুলো পূর্ণ অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জন করতে পারেনি। তথাপি এখানে আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রভাব খুব বেশি। তারপরও তারা স্বাধীনভাবে ধর্ম-কর্ম পালন করতে পারছে। এখন শুধু প্রয়োজন যোগ্য নেতৃত্বের, প্রয়োজন আলি ইজ্জত বেগোভিচের মতো নেতার। যারা দেশগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন এবং বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে নেতৃত্ব দেবেন। লেখক : পিএইচডি গবেষক, গাজি ইউনির্ভাসিটি, আনকারা, তুরস্ক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির