রিজিকের পরিচয় করে
রিজিক শব্দের অর্থ অনেক ব্যাপক। রিজিক আরবি শব্দ। আল্লামা ইবনে ফারিস (রহ) তাঁর অভিধানে লিখেছেন, ‘সময় অনুযায়ী আসা দানকে রিজিক বলা হয়। এ ছাড়া রিজিক শব্দটি শুধু ‘দান’ অর্থেও ব্যবহৃত হয়। রিজিক মানে হলো সময় অনুযায়ী প্রদান করা আল্লাহ তায়ালার বিশেষ দান’ (মাকায়িসুল লোগাহ, পৃষ্ঠা ৩৩৩)। বিখ্যাত আরবি অভিধানপ্রণেতা আল্লামা আবু নসর জাওহারি (রহ) লিখেছেন, ‘যার মাধ্যমে মানুষ উপকৃত হয়, তা-ই রিজিক।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘রিজিক মানে বিশেষ দান।’ (আস সিহাহ, পৃষ্ঠা ৪৪০)
আল্লাহ তায়ালা যাকে চান অঢেল ধন-সম্পদ দান করেন। আর যাকে চান অল্প দেন। রিজিক মানে শুধু খাদ্যসামগ্রী নয়, বরং জীবন-উপকরণের সবকিছু। অর্থাৎ সব প্রাণীর জীবন-উপকরণের দায়িত্ব আল্লাহ তায়ালা নিজেই গ্রহণ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বান্দার তাকদিরে যা লিখে রেখেছেন এবং যতোটুকু লিখে রেখেছেন, তা সে ততোটুকু পাবেই। চাই সে অক্ষম হোক বা সক্ষম। আল্লামা ইবনে মানজুর (রহ) লিখেছেন, ‘রিজিক দুই প্রকার:
১. দেহের জন্য রিজিক হলো খাদ্য।
২. অন্তর ও আত্মার জন্য রিজিক হলো জ্ঞান’ (লিসানুল আরব, ইবনে মানযুর, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ২৩৯)।
রিজিক মানে হলো সেই সব উপহার, সম্পদ বা সুযোগ যা মানুষের জীবনে সঠিক সময়ে আসে এবং তার জীবিকার জন্য উপকারী হয়। পবিত্র কুরআনে রিজিক শব্দটি ১২৩ বার এসেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রিজিক কীভাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে তা বলা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “আর জমিনে বিচরণকারী প্রতিটি প্রাণীর রিজিকের দায়িত্ব আল্লাহরই।” (সূরা হুদ, আয়াত : ৬)
মহান আল্লাহ রিজিকদাতা। তার আছে অফুরন্ত রিজিক যা তিনি তার বান্দাদের মধ্যে বিতরণ করেন। তার রিজিক প্রত্যেকের কাছে পৌঁছে যায়। আল্লাহ তায়ালার রুবুবিয়্যাতের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো: তার বান্দাদের প্রয়োজনের কথা বলার আগেই বা চাওয়ার আগেই বান্দার প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা করে দেওয়া।
মা’কাল ইবনু ইয়াসার থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: “তোমাদের রব বলেন, হে বনি আদম, তুমি আমার ইবাদতের জন্য মনোনিবেশ করো, আমি তোমার অন্তরকে সচ্ছলতায় ভরে দেবো, তোমার হাত রিজিক দ্বারা পূর্ণ করে দেবো। হে বনি আদম, তুমি আমার থেকে দূরে যেয়ো না, ফলে আমি তোমার অন্তর অভাবে পূর্ণ করে দেবো এবং তোমার দুহাতকে কর্মব্যস্ত করে দেবো।” (হাকেম)
রিজিক বোঝার জন্য প্রয়োজন তাকদিরের প্রতি ঈমান:
ইবনু মাসউদ (রা) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, সত্যবাদী ও সত্যবাদী বলে স্বীকৃত আল্লাহর রাসূল (সা) বলেছেন: তোমাদের প্রত্যেকেরই জন্ম হয় এভাবে যে, তার মায়ের পেটে (প্রথমে তার মূল উপাদান) শুক্ররূপে চল্লিশ দিন পর্যন্ত থাকে। অতঃপর তা চল্লিশ দিন পর্যন্ত লাল জমাট রক্তপিণ্ডরূপ ধারণ করে। তারপর পরবর্তী চল্লিশ দিনে মাংসপিণ্ডের রূপ ধারণ করে। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা একজন ফিরিশতাকে চারটি বিষয় লিখে দেওয়ার জন্য পাঠন। তিনি তখন (১) আমল; সে কী কী আমল করবে, (২) তার মৃত্যু, (৩) তার রিজিক ও (৪) তার নেককার বা দুর্ভাগা হওয়ার বিষয় আল্লাহর হুকুমে তার তাকদিরে লিখে দেন, তারপর তন্মধ্যে রুহ প্রবেশ করান। অতঃপর সে সত্তার কসম, যিনি ব্যতীত প্রকৃত আর কোনো ইলাহ নেই! তোমাদের মধ্যে কেউ জান্নাতবাসীদের আমল করতে থাকে, এমনকি তার ও জান্নাতের মধ্যে মাত্র এক হাত দূরত্ব থাকে, এমন সময় তার প্রতি তাকদিরের লিখা তার সামনে আসে। আর তখন সে জাহান্নামিদের কাজ করতে থাকে এবং জাহান্নামে প্রবেশ করে। তোমাদের কোনো ব্যক্তি জাহান্নামিদের মতো আমল করতে শুরু করে, এমনকি তার ও জাহান্নামের মধ্যে এক হাত দূরত্ব অবশিষ্ট থাকে। এমন সময় তার প্রতি সে লেখা (তাকদির) সামনে আসে, তখন সে জান্নাতিদের কাজ করতে শুরু করে, ফলে সে জান্নাতে প্রবেশ করে। সাহাবাগণ তখন রাসূল (সা)-কে জিজ্ঞেস করেন, ‘তাহলে কি আমরা আমল করব না?’ রাসূল (সা) বলেন, ‘অবশ্যই আমল করবে। কেননা প্রত্যেকের তাকদির অনুযায়ী তার বদ আমল বা নেক আমল করা তার জন্য সহজ করে দেওয়া হয়।’ (বুখারি ও মুসলিম)
আল্লাহ তায়ালাই একমাত্র রিজিকদাতা:
রিজিকের জিম্মাদারি একমাত্র তাঁর। তিনি ছাড়া আর কোনো রিজিকদাতা ছিল না, এখনো নেই, ভবিষ্যতেও থাকবে না। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা রিজিকদাতা। শক্তির আধার ও পরাক্রমশালী।’ (সূরা জারিয়াত, আয়াত : ৫৮)
পবিত্র কুরআনে কারিমের অন্য জায়গায় বলা হয়েছে, ‘পৃথিবীর প্রত্যেক জীবের জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহর। তিনি জানেন তারা কোথায় থাকে এবং কোথায় সমাপিত হয়। সবকিছুই (উল্লেখ) এক সুবিন্যস্ত কিতাবে (লওহে মাহফুজে) রয়েছে।’ (সূরা হুদ, আয়াত, ৬)
ওপরের আয়াতে এ কথা স্পষ্ট যে রিজিকদাতা একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। তিনি ছাড়া আর কোনো রিজিকদাতা নেই। মানুষসহ সব প্রাণীর রিজিকের দায়িত্ব তাঁর জিম্মায়।
তালাশ করার শর্তে রিজিক নির্ধারিত:
প্রত্যেক মানুষের রিজিক নির্ধারিত। একজন মানুষ যা কিছু পান বা লাভ করেন, পূর্বনির্ধারিত ছিল বলে তিনি তা পেয়ে থাকেন। যা কিছু মানুষ পান না বা লাভ করেন না, নির্ধারিত ছিল না বলেই তিনি তা পাননি বা লাভ করেননি। নির্ধারিত রিজিকে কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না। কেউ এক মুঠো বেশি রিজিক পাবেন না, এক মুঠো কমও পাবেন না। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, “আমি তোমাদের পৃথিবীতে ঠাঁই দিয়েছি এবং তোমাদের জন্য তাতে রেখেছি জীবনোপকরণ। তোমরা অল্পই কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো।” (সূরা আরাফ, আয়াত : ১০)
রিজিক আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে নির্ধারিত। তার তালাশ করা বা অনুসন্ধান করা বান্দার দায়িত্ব। আল্লাহ তায়ালা রিজিক নির্ধারণ করে রেখেছেন বলে তার মানে এই নয়, সে রিজিক আপনা আপনি আমাদের কাছে এসে হাজির হবে। আকাশ থেকে রিজিক নাজিল হবে, আর বান্দা কেবল তা গ্রহণ করে ধন্য হবে। আল্লাহ তায়ালার ওপর পূর্ণ ভরসা রেখে প্রয়োজন ও চাহিদা অনুয়ায়ী রিজিক অনুসন্ধান করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, “অতঃপর নামাজ শেষ হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে এবং আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করবে আর আল্লাহকে অধিক স্মরণ করবে, যাতে তোমরা সফল হতে পারো।” (সূরা জুমআ, আয়াত : ১০)
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা)-এর বর্ণনায় আছে যে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘হালাল রিজিক অন্বেষণ করা দ্বীনের ফরজগুলোর পর অন্যতম ফরজ।’ (সুনানুল কুবরা, বাইহাকি, খণ্ড ৬, হাদিস : ১১,৬৯৫)
রাসূলুল্লাহ (সা) আরও বলেছেন, ‘হে মানুষ! আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করো এবং উত্তম ও ভারসাম্যপূর্ণ পন্থায় রিজিক অনুসন্ধান করো। কারণ, কোনো প্রাণী তার জন্য বরাদ্দকৃত রিজিক প্রাপ্ত না হয়ে মৃত্যুবরণ করবে না। যদিও রিজিক লাভ করাটা তার জন্য বিলম্বিত হয়। সুতরাং আল্লাহকে ভয় করো ও ভারসাম্যপূর্ণ পন্থায় রিজিক তালাশ করো। যা হালাল, তা গ্রহণ করো; যা হারাম, তা পরিত্যাগ করো।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২,১৪৪)
আমরা দুনিয়াতে হালাল না হারাম উপায়ে খাচ্ছি, সেটা নির্ভর করছে আমি আল্লাহ তায়ালার উপর কতটুকু তাওয়াক্কুল বা ভরসা করছি। কেননা, আল্লাহ তায়ালা বলেন, দুনিয়ায় বিচরণকারী এমন কোনো প্রাণী নেই, যার রিজিকের দায়িত্ব আল্লাহর ওপর নেই। তাদের স্থায়ী এবং অস্থায়ী অবস্থানস্থল সম্পর্কে তিনি অবহিত। সব কিছুই একটি সুস্পষ্ট কিতাবে লেখা আছে। (সূরা হুদ: ৬)
এ প্রসঙ্গে হাদিসে আল্লাহর রাসূল (সা) বলেন, ‘আদম সন্তান মৃত্যু থেকে যেভাবে পালিয়ে বেড়ায়, রিজিক থেকেও যদি সেভাবে পালিয়ে বেড়াত; তবুও তার রিজিক তার কাছেই পৌঁছাত।’ (সিলসিলা, আস সহিহ : ২/৬৭২)
হজরত ইমাম শাফিয়ি (রহ) বলেন, ‘যা কিছু তোমার জন্য লিখিত সেটি পাহাড়ের চূড়ায় থাকলেও তোমারই হবে। আর যা কিছু তোমার জন্য লেখা হয়নি, সেটি দুই ঠোঁটের মধ্যখানে থাকলেও তোমার হবে না।’
মহান আল্লাহ আমাদের সঠিক পথ, হালাল ও প্রশস্ত কামাই রোজগার ও রিজিক এর ব্যবস্থা করে দিন। সব প্রকার হারাম কামাই রোজগার ও রিজিক থেকে হিফাজত করুন।
রিজিকের স্তরসমূহ:
রিজিকের অনেক অনেক স্তর রয়েছে। রিজিকের সর্বনিম্ন স্তর হচ্ছে টাকা, পয়সা, অর্থ এবং সম্পদ। রিজিকের সর্বোচ্চ স্তর হচ্ছে শারীরিক এবং মানসিক সুস্থতা। রিজিকের সর্বোত্তম স্তর হচ্ছে পুণ্যবান স্ত্রী এবং পরিশুদ্ধ নেক সন্তান। রিজিক এর পরিপূর্ণ স্তর হচ্ছে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি।
সর্বনিম্ন স্তর
রিজিকের সর্বনিম্ন স্তর হলো আর্থিক সচ্ছলতা। এটাই একমাত্র স্তর নয়; রিজিক বলতে শুধু ধনসম্পদ, টাকাপয়সায় সচ্ছলতা অর্জন এমনটি বোঝা এবং এমন বুঝের ওপর অটল থাকা অজ্ঞতার পরিচায়ক। রিজিকের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, দুনিয়াতে যা কিছু মানুষকে উপকৃত করে, সবই রিজিক। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, “ধনসম্পদ আর সন্তানসন্ততি পার্থিব জীবনের শোভা।” (সূরা কাহাফ, আয়াত : ৪৬)
আমরা যে ধনসম্পদ উপার্জনের জন্য লালায়িত থাকি, পবিত্র কুরআন ও হাদিসে তাকে ফিতনা ও পরীক্ষা বলা হয়েছে। রিজিকের প্রথম ও প্রধান স্তর ভেবে যা অর্জনের নেশায় ডুবে থাকি, প্রকৃত অর্থে তা রিজিকের সর্বনিম্ন স্তর ও শোভামাত্র। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, “জেনে রাখো! নিশ্চয়ই তোমাদের ধনসম্পদ ও সন্তানসন্ততি ফিতনা বা পরীক্ষা। আর আল্লাহর কাছে রয়েছে মহাপুরস্কার।” (সূরা আনফাল, আয়াত : ২৮)
রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘প্রত্যেক উম্মতের জন্য ফিতনা রয়েছে। আর আমার উম্মতের ফিতনা হলো ধনসম্পদ।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২৩৩৬; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১৭৪৭১)
সর্বোচ্চ স্তর
রিজিকের সর্বোচ্চ স্তর হলো শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, “এবং আমি যখন অসুস্থ হই; তখন তিনিই (আল্লাহ) আমাকে সুস্থতা দান করেন।” (সূরা শুয়ারা, আয়াত : ৮০)
ইবনে আব্বাস (রা)-এর বিবরণে আছে যে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘এমন দুটি নিয়ামত রয়েছে, বেশিরভাগ মানুষ যার ব্যাপারে ধোঁকায় পতিত সুস্বাস্থ্য ও অবসর।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৪১২; ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪১৭০)
রাসূলুল্লাহ (সা) সুস্থতাকে উৎকৃষ্ট নিয়ামত আখ্যা দিয়ে বলেছেন, সুস্বাস্থ্য ও সুস্থতা অর্থসম্পদের চেয়েও মূল্যবান নিয়ামত। তিনি আরও বলেন, ‘তাকওয়ার অধিকারী (খোদাভীরু) মানুষদের ধনসম্পদের মালিক হওয়াতে কোনো দোষ নেই। আর খোদাভীরু মানুষের জন্য সুস্থতা ধনসম্পদের চেয়ে অধিক উত্তম। মনের প্রফুল্লও নিয়ামতরাজির অন্তর্ভুক্ত।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২১৪১)
সর্বোত্তম স্তর
রিজিকের সর্বোত্তম স্তর হলো পুণ্যবতী স্ত্রী ও নেককার সন্তানসন্ততি। একজন স্বামীর জন্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ পুণ্যবতী স্ত্রী। একইভাবে একজন স্ত্রীর জন্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সম্পদ পুণ্যবান স্বামী। নারীর সংস্পর্শ ছাড়া কোনো পুরুষের জীবন এবং পুরুষের সংস্পর্শ ছাড়া কোনো নারীর জীবন পূর্ণতা লাভ করে না। দাম্পত্য জীবনে স্ত্রী যদি পুণ্যবতী হন এবং স্বামী যদি হন পুণ্যবান, স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয় সংসার। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘পার্থিব জগৎ হলো ক্ষণিকের উপভোগের বস্তু। আর পার্থিব জগতের সর্বোত্তম সম্পদ হলো পুণ্যবতী স্ত্রী।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৪৬৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৬৫৬৭)
পুণ্যবতী স্ত্রীর পাশাপাশি নেক সন্তান বান্দার প্রতি আল্লাহ তায়ালার সর্বোত্তম উপহার। আল্লাহ তায়ালা সুসন্তানকে দুনিয়ার শোভা বলে ইরশাদ করেছেন, “ধনসম্পদ ও সন্তানসন্ততি দুনিয়ার জীবনের শোভা।” (সুরা কাহাফ, আয়াত : ৪৬)
প্রত্যেক মা-বাবা একটি বিষয় গভীরভাবে উপলব্ধি করে থাকবেন সুসন্তান মানে পরিবারের স্বস্তি। মা-বাবার চক্ষু শীতলকারী সন্তানসন্ততি মানে সুখ। আর এ সুখই হলো রিজিকের সর্বোত্তম স্তরের অংশবিশেষ।
পরিপূর্ণ স্তর
রিজিকের পরিপূর্ণ স্তর হলো আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি। প্রত্যেক মুমিন-মুসলিম বান্দার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হওয়া উচিত আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, “আল্লাহর সন্তুষ্টি হচ্ছে সবচেয়ে বড় এবং এটিই সবচেয়ে বড় সাফল্য।” (সূরা তওবা, আয়াত : ৭২)
আবু উমামা আল বাহেলি (রা)-এর বর্ণনায় আছে যে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা শুধু ওই আমল কবুল করবেন, যা শুধু তাঁর জন্য করা হবে এবং যে আমল দ্বারা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা উদ্দেশ্য হবে।’ (নাসায়ি, হাদিস : ৩১৪০)
আবশ্যক স্তর
রিজিকের আবশ্যক স্তর হলো ঈমান। মুসলিমের জীবনে ঈমান অর্জনের চেয়ে বড় কোনো রিজিক ও নিয়ামত নেই। ঈমানের নিয়ামত যাদের অর্জন হয়েছে, সৌভাগ্যবান তারা। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, “তারা ইসলাম গ্রহণ করে আপনাকে ধন্য করেছে মনে করে। বলুন, তোমরা ইসলাম গ্রহণ করে আমাকে ধন্য করেছো মনে কোরো না; বরং আল্লাহ তায়ালাই ঈমানের দিকে পরিচালিত করে তোমাদের ধন্য করেছেন, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।” (সূরা হুজুরাত, আয়াত : ১৭)
অন্যান্য স্তর:
কোনো কোনো গবেষক কুরআন-হাদিসের বিভিন্ন বর্ণনার আলোকে জ্ঞান বা হিকমা অর্জন করা এবং মুমিন বান্দাদের ভালোবাসা প্রাপ্তিকেও রিজিকের স্তর হিসেবে ব্যক্ত করেছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, “তিনি যাকে ইচ্ছা প্রজ্ঞা দান করেন এবং যাকে প্রজ্ঞা দান করা হয়, নিশ্চয়ই তাকে প্রভূত কল্যাণ দেওয়া হবে। জ্ঞানবান ব্যক্তিরা ছাড়া কেউ এটা উপলব্ধি করতে পারে না।” (সূরা বাকারা, আয়াত : ২৬৯)
মুমিন বান্দার প্রতি মুমিন বান্দার ভালোবাসাও এক প্রকার রিজিক বা নিয়ামত। কারণ, আল্লাহ তায়ালা যে বান্দাকে ভালোবাসেন, তার প্রতি ঈমানদারদের মনে ভালোবাসা সৃষ্টি করে দেন। আবু হুরায়রা (রা) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা যখন কোনো বান্দাকে ভালোবাসেন, তখন তিনি জিবরাইল (আ)-কে ডেকে বলেন, আমি অমুক বান্দাকে ভালোবাসি; তাই তুমিও তাকে ভালোবাস। কাজেই জিবরাইল (আ) তাকে ভালোবাসেন। অতঃপর জিবরাইল (আ) আসমানে ঘোষণা করে বলেন, আল্লাহ অমুক বান্দাকে ভালোবাসেন, তোমরাও তাকে ভালোবাস। তখন তাকে আসমানবাসীরা ভালোবাসেন এবং পৃথিবীবাসীদের মধ্যেও তাকে গ্রহণীয় বানানো হয়।’ (বুখারি, হাদিস : ৭৪৮৫)
কী কী আমলের মাধ্যমে রিজিক বৃদ্ধি ঘটে এবং আয়-উপার্জনে বরকত আসে:
১. তওবা-ইস্তিগফার করা
তওবা-ইস্তিগফার করার মাধ্যমে বান্দার রিজিক বাড়ে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘আমি তাদের বলেছি, নিজ প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই তিনি অতিশয় ক্ষমাশীল। তিনি আকাশ থেকে তোমাদের ওপর প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণ করবেন এবং তোমাদের ধনসম্পদ ও সন্তানসন্ততিতে উন্নতি দান করবেন এবং তোমাদের বাগবাগিচা এবং নদীনালা দান করবেন।” (সূরা নুহ, আয়াত : ১০-১২; সূরা ওয়াকিয়া, আয়াত : ৮২)
ইবনে আব্বাস (রা)-এর বিবরণে আছে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি লাগাতার তওবা-ইস্তিগফার করবে; আল্লাহ তায়ালা সঙ্কট থেকে উত্তরণের পথ বের করে দেবেন; সব দুশ্চিন্তা মিটিয়ে দেবেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে রিজিকের ব্যবস্থা করে দেবেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস : ১,৫১৮; ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩,৮১৯; মুস্তাদরাকে হাকেম, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ২৯১, হাদিস : ৭,৬৭৭)
২. পরহেজগারি অবলম্বন এবং আল্লাহর ওপর ভরসা রাখা
যেসব কাজকর্ম বা আমলে রিজিকে প্রবৃদ্ধি ঘটে; তার মধ্যে তাকওয়া-পরহেজগারি অবলম্বন করা এবং তাওয়াক্কুল বা আল্লাহর প্রতি ভরসা রাখা অন্যতম। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, “আর যে আল্লাহর তাকওয়া অর্জন করবে, আল্লাহ তার জন্য উত্তরণের পথ বের করে দেবেন এবং তিনি তাকে এমন উৎস থেকে রিজিক দান করবেন, যার কল্পনাও সে করতে পারবে না।” (সূরা সাদ, আয়াত : ৩৫)
রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি যথার্থভাবে ভরসা রাখো। তিনি তোমাদের সেভাবে রিজিক দান করবেন, যেভাবে তিনি পাখিদের দান করে থাকেন। পাখিরা সকালে ক্ষুধার্ত অবস্থায় (খালি পেটে) বাসা থেকে বের হয় এবং সন্ধ্যায় উদর পূর্ণ করে বাসায় ফেরে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২,৩৪৪; ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪,১৬৪)
৩. হজ-ওমরাহ পালন
বারবার হজ ও ওমরাহ পালন করার দ্বারা রিজিকে প্রবৃদ্ধি ঘটে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা)-এর বিবরণে আছে যে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘তোমরা লাগাতার হজ ও ওমরাহ পালন করতে থাকো। কারণ, এর দ্বারা এমনভাবে অভাব ও গুনাহ দূরীভূত হয়; যেমনভাবে কামারের হাপর লোহা ও সোনা-রুপার ময়লা দূর করে দেয়।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৮১০; নাসায়ি, হাদিস : ২,৬৩১)
৪. হিজরত করা এবং জিহাদে অংশ নেওয়া
আল্লাহ তায়ালার রাস্তায় হিজরত করা ও জিহাদে অংশগ্রহণ করার দ্বারা রিজিকে বরকত হয়। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, “আর যে ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার রাস্তায় হিজরত করবে; জমিনে বহু আশ্রয়স্থল ও সচ্ছলতা পাবে সে।” (সূরা নিসা, আয়াত : ১০০)
ইবনে উমর (রা)-এর বর্ণনায় আছে যে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘আমার বর্শার ছায়াতলে আমার রিজিক রাখা হয়েছে।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৫,৬৬৭; বায়হাকি, হাদিস : ১,১৫৪)
৫. সময়মতো নামাজ আদায় এবং ইবাদতের জন্য নিজেকে মুক্ত করা
সময়মতো দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করলে রিজিক বাড়ে। নামাজ আদায় করার ফাঁকে ফাঁকে কাজ ও ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হবে; কাজ ও ব্যবসা-বাণিজ্য করার ফাঁকে ফাঁকে নামাজ নয়। একই সঙ্গে আল্লাহ তায়ালার ইবাদত পালনে নিজেকে ঝামেলামুক্ত করতে হবে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, “আর আপনি পরিবার-পরিজনকে নামাজ আদায়ের আদেশ দিন এবং নিজেও তার ওপর অটল থাকুন। আমি আপনার কাছে কোনো রিজিক চাই না। আমিই আপনাকে রিজিক দিই। আর মুত্তাকিদের জন্যই শুভ পরিণাম।” (সূরা ত্বহা, আয়াত : ১৩২)
আবু হুরায়রা (রা) বর্ণনা করেছেন যে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা বলেন, “হে আদম সন্তান! আমার ইবাদতের জন্য তুমি তোমার অন্তরকে খালি করো। আমি তোমার অন্তরকে অভাবমুক্ত হিসেবে পরিপূর্ণ করে দেবো এবং তোমার দরিদ্র্যের পথ দূর করে দেবো। আর যদি তা না করো; আমি তোমার হাত (দুনিয়ার) ব্যস্ততায় পূর্ণ করে দেবো এবং তোমার অভাব মেটাব না।’ (তিরমিজি, হাদিস-২,৪৬৬; ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪,১০৭; মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৮,৬৯৬)
৬. আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা
রিজিক বৃদ্ধির অন্যতম আরেকটি আমল হচ্ছে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা। আত্মীয়ের সঙ্গে সদাচরণ করতে এবং তাঁদের হক যথাযথভাবে আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহ তায়ালা। (সূরা নিসা, আয়াত : ৩৬; সুরা বনি ইসরাইল, আয়াত : ২৬)
আনাস ইবনে মালেক (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা)-কে আমি বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কামনা করে তার রিজিক প্রশস্ত করে দেওয়া হোক এবং আয়ু দীর্ঘ করা হোক, সে যেন তার আত্মীয়দের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখে।’ (বুখারি, হাদিস : ৫,৯৮৫; মুসলিম, হাদিস : ৪,৬৩৯)
৭. আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় এবং দান-সদকা করা ও হিজরত করা
দান-সদকা করার মাধ্যমে রিজিক বাড়ে। আল্লাহ-তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, “আর তোমরা যা কিছু আল্লাহর জন্য ব্যয় করো; তিনি তার বিনিময় দেবেন। তিনিই উত্তম রিজিকদাতা।” (সূরা সাবা, আয়াত : ৩৯)
রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘প্রতিদিন সকালে দু’জন ফেরেশতা অবতরণ করে। তাদের একজন বলে, হে আল্লাহ! দানকারীকে তার দানের জন্য উত্তম প্রতিদান দিন। অপরজন বলে, হে আল্লাহ! কৃপণকে ধ্বংস করে দিন।’ (বুখারি, হাদিস : ১,৪৪২, মুসলিম, হাদিস : ১,০১০)
আল্লাহর পথে হিজরত করার মাধ্যমে রিজিক বেড়ে যায়। মহান আল্লাহর ঘোষণা, “যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে হিজরত করবে, সে পৃথিবীতে বহু আশ্রয়স্থল এবং প্রাচুর্য প্রাপ্ত হবে।” (সূরা নিসা : ১০০)
৮. শোকর আদায় বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
যেসব কাজকর্ম বা আমলে রিজিক বাড়ে, তার মধ্যে অন্যতম হলো আল্লাহ তায়ালা যেসব নিয়ামত দান করেছেন, তার শোকর আদায় করা বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। কারণ, শোকর আদায় করার দ্বারা নিয়ামত বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, “যদি তোমরা শোকর আদায় করো, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের (নিয়ামত) বাড়িয়ে দেবো। আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, নিশ্চয় আমার আজাব বড় কঠিন।” (সূরা ইবরাহিম, আয়াত : ৭)
৯. বিয়ে করা
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, “তোমাদের মধ্যে যারা অবিবাহিত এবং তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা সৎকর্মপরায়ণ, তাদের বিয়ে করিয়ে দাও। তারা যদি নিঃস্ব হয়, আল্লাহ-তায়ালা নিজ অনুগ্রহে তাদের সচ্ছল করে দেবেন। কারণ, আল্লাহ তায়ালা প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।” (সূরা নূর, আয়াত : ৩২)
রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘তিন শ্রেণির মানুষকে সাহায্য করাকে আল্লাহ তায়ালা নিজ দায়িত্ব হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। তিন শ্রেণির প্রথম শ্রেণি হলো, যিনি বিয়ে করে পবিত্র জীবন যাপন করতে ইচ্ছুক। দ্বিতীয়ত হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার পথে জিহাদকারী এবং তৃতীয়ত হলো মুকাতাব গোলাম- যে চুক্তির অর্থ পরিশোধের ইচ্ছা পোষণ করে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১,৬৫৫; ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২,৫১৮)
১০. গরিব-অসহায়ের প্রতি সদয় হওয়া
যেসব কাজকর্ম বা আমলে রিজিক বাড়ে, তার অন্যতম হলো গরিব-অসহায় মানুষের প্রতি সদয় হওয়া। রাস্তাঘাটে গরিব-অসহায় মানুষকে হাত বাড়াতে দেখলেই সবাইকে এক পাল্লায় মেপে খারাপ আচরণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘তাদের (ধনী লোকদের) সম্পদে প্রার্থী (দরিদ্র) ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।’ (সূরা জারিয়াত, আয়াত : ১৯)
রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে থাকা দুর্বলদের কারণে তোমাদের সাহায্য করা হয় এবং রিজিক প্রদান করা হয়।’ (বুখারি, হাদিস : ২,৮৯৬)
১১. আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা
যেসব কাজকর্ম বা আমলে রিজিক বাড়ে, এর মধ্যে অন্যতম হলো আল্লাহ তায়ালার কাছে প্রার্থনা করা। কারণ, আমরা এমন এক স্রষ্টার সৃষ্টি যিনি চাইলে খুশি; না চাইলে অখুশি। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, “তোমাদের প্রতিপালক বলেন, তোমরা আমাকে ডাকো; আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেবো।” (সূরা মুমিন, আয়াত : ৬০)
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা)-এর বিবরণে আছে যে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অভাবে পতিত হওয়ার পর মানুষের কাছে সোপর্দ করে, অর্থাৎ অভাব দূরীকরণে মানুষের ওপর নির্ভরশীল হয়; তার অভাব মোচন করা হয় না। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি অভাবে পতিত হওয়ার পর প্রতিকারের জন্য আল্লাহ তায়ালার ওপর নির্ভরশীল হয় (দোয়া-প্রার্থনা করে) অবিলম্বে অথবা বিলম্বে আল্লাহ তায়ালা তাকে রিজিক দান করেন।’ (তিরমিজি, হাদিস : ২,৮৯৬ ও ২,৩২৬; মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ৪২১৯)
১২. রিজিক অর্জনের চেষ্টায় থাকা
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, “অতঃপর নামাজ সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে (জমিনে) ছড়িয়ে পড়ো আর আল্লাহর অনুগ্রহ (রিজিক) সন্ধান করো এবং আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করো; যাতে তোমরা সফলকাম হও।” (সূরা জুমা, আয়াত : ১০)
পবিত্র কুরআন ও হাদিস থেকে জানা যায়, বেশ কিছু কাজে মানুষের রিজিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কাজগুলো হলো:
১. পাপকাজে লিপ্ত হওয়া
যেসব কাজে মানুষের রিজিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়; তার মধ্যে অন্যতম হলো গুনাহ বা পাপাচারে লিপ্ত থাকা। সাওবান (রা)-এর বিবরণে আছে যে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘সৎকর্ম মানুষের আয়ুষ্কাল বাড়াতে পারে এবং দোয়া মানুষের তাকদির রদ (পরিবর্তন) করতে পারে। আর মানুষ তার পাপ কাজের কারণে প্রাপ্য রিজিক থেকে বঞ্চিত হয়।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪,০২২)
২. কৃতজ্ঞতা আদায় না করা
মানুষ যখন প্রাপ্ত নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করে না, তখন তার থেকে সে নিয়ামত ছিনিয়ে নেওয়া হয় আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মানবজীবন এবং কমে যায় রিজিক। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, “আর যদি অকৃতজ্ঞ হও, তবে মনে রেখো, আমার শাস্তি বড়ই কঠোর।” (সূরা ইবরাহিম, আয়াত : ৭)
৩. মিথ্যা কসম খাওয়া ও ধোঁকা দেওয়া
মিথ্যা কসম খাওয়া এবং মানুষকে ধোঁকা দিলে আয়-উপার্জনের বরকত চলে যায়। আর বরকত চলে যাওয়া মানে রিজিক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘বেচাকেনা করার সময় তোমরা অধিক কসম করা থেকে সাবধান থেকো। কারণ, মিথ্যা কসমের দ্বারা বিক্রি বেশি হয়, কিন্তু বরকত ধ্বংস হয়ে যায়।’ (মুসলিম, হাদিস : ১,৬০৭)
রাসূূলুল্লাহ (সা) আরও বলেছেন, ‘ক্রেতা ও বিক্রেতা যতক্ষণ পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন করা কিংবা বাতিল করার সুযোগ রয়েছে। যদি তারা সত্য বলে এবং পণ্যের প্রকৃত অবস্থা ব্যক্ত করে, তাহলে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত হবে। আর যদি মিথ্যা বলে এবং পণ্যের দোষ গোপন করে, তাহলে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ের বরকত ধ্বংস হয়ে যাবে।’ (বুখারি, হাদিস : ২,০৭৯)
৪. সুদের কারবার করা
সুদের মাধ্যমে ব্যবসা বৃদ্ধি হয়, আপাতদৃষ্টে এমনটা মনে হলেও সুদের কারবারের দ্বারা ব্যবসার বরকত নষ্ট হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, “আল্লাহ সুদকে ধ্বংস করে দেন এবং সাদাকাকে বর্ধিত করে দেন।” (সূরা বাকারা, আয়াত : ২৭৬)
৫. জাকাত না দেওয়া
জাকাত ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ বা মৌলিক বিধান। জাকাতের বিধান প্রণয়ন করে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে ভারসাম্য ঠিক রেখেছে ইসলাম। সঠিকভাবে জাকাতের বিধান আদায় না করলে রিজিকের বরকত উঠিয়ে নেওয়া হয় এবং এতে রিজিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, ‘যখন কোনো জাতি জাকাত আদায় করা বন্ধ করে দেয়; আসমান থেকে তখন বৃষ্টিবর্ষণ বন্ধ করে দেওয়া হয়। পৃথিবীর বুকে যদি কোনো চতুষ্পদ জন্তু না থাকত, তাহলে আর কখনো বৃষ্টি হতো না।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৪,০১৯)
শেষ কথা:
রিজিক নিয়ে মানুষ খুব বেশি দুশ্চিন্তায় ভোগে। এটাও একটি মনোরোগ। অথচ আল্লাহ তায়ালা তার জন্য রিজিকের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। অপরদিকে সে আমলের ব্যাপারে উদাসীন। অথচ আল্লাহ এর দায়িত্ব তার ওপরেই ন্যস্ত করেছেন। যেই আল্লাহ তাকে সৃষ্টি করেছেন তিনি তার রিজিকের দায়িত্বও গ্রহণ করেছেন। সুতরাং ঈমানদারের উচিত রিজিকের ব্যাপারে দুশ্চিন্তায় না ভুগে নিজের কাজ করে যাওয়া এবং আল্লাহর ওপর তায়াক্কুল করা।
ইয়া আল্লাহ! ইয়া রাজ্জাক! আমরা আপনার সুমহান দরবারে পবিত্র রিজিক ভিক্ষা চাই। আপনি আমাদের আমৃত্যু নেয়ামতপূর্ণ রিজিকের ওপর রাখুন। আমাদেরকে অভাব দেবেন না। অভাব সহ্য করার মতো শক্তি আমাদের নেই। আপনিই সর্বোত্তম রিজিক দানকারী মহান রব।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের রিজিক নিয়ে দুশ্চিন্তা থেকে বেঁচে থাকা ও সম্মানজনক জীবিকা অর্জন করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক
আপনার মন্তব্য লিখুন