post

নয়াপল্টন থেকে গোলাপবাগ মুক্তিকামী জনতার বিজয় অবশ্যম্ভাবী

মুহাম্মদ হাফিজুর রহমান

২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩

বাংলাদেশের রাজনীতির গতি-প্রকৃতিতে গণতন্ত্র শব্দটি যতো বেশি ব্যবহার হয়, বর্তমান ক্ষমতাসীনদের পক্ষ হতে এর অপব্যবহার ততো বেশি। বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কতটুকু বাস্তবায়িত আছে? এ প্রশ্নের জবাব পাওয়ার জন্য কাউকেই আর রাজনৈতিক অতিবোদ্ধা হওয়ার প্রয়োজন নেই। ক্ষমতাসীন মহলের বিরুদ্ধে কোনো কিছু বলার আগেই রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়ে যায়। কোনো মামলা ছাড়াই গ্রেফতার এখানে এখন একটি আইনসিদ্ধ! বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘটনা ব্যতীতই কাগজে কলমে ঘটনা তৈরি করে মামলা তৈরি করা হয়। ‘গায়েবি মামলা’ শব্দটি এখন কোর্ট কাচারির ভাষা হয়ে গিয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের নামে মামলার পাহাড় প্রতি থানায়। আজ ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৫ তারিখ যখন এ লেখাটি লিখছি সেদিন সুপ্রিম কোর্টে আগাম জামিন নেওয়ার জন্য এসেছিলেন কয়েক হাজার মানুষ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তাদের সংখ্যা ২৩ হাজার বলে উল্লেখ করেছে। এ মানুষগুলোর মধ্যে ১৫ বছরের কিশোর থেকে ৭৫ বছরের বৃদ্ধ আছেন, অতি দরিদ্র কৃষক, রিকশা শ্রমিক থেকে স্কুল-কলেজের শিক্ষক সব ধরনের মানুষই আছেন। বাংলাদেশের কোন মানুষটির জীবন আজ নিরাপদ? একবাক্যে বলা যায়, যিনি সরকারি দলের নেতা বা কর্মী নন, তারা ব্যতীত সকলেই আজ নিরাপত্তাহীনতার আতঙ্কে ভোগেন। গত ১৪ বছরের এক নায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা আওয়ামী লীগকে তার গণতান্ত্রিক চরিত্র থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। অথচ এই আওয়ামী লীগ এক সময় গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে। জনগণের  ভোটাধিকার নেই বিগত ১৪ বছর যাবৎ। মানুষ স্বাধীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারছে না। যদিও দিনের ভোট রাতে হয়েছে কিংবা কবরের মৃত মানুষও ভোট দিয়েছে। এখন যাদের বয়স ২৫ কিংবা ২৭ তারা জীবনে একবারও ভোটের মাধ্যমে তাদের জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করার সুযোগ পায়নি। প্রশাসন আর পেশিশক্তির জোরে ক্ষমতা চর্চা করলে তাদের কাছে জনগণের মতামত আর জনসমর্থনের কোনো মূল্য থাকে না। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে জনগণ যখন ফুঁসে ওঠে তখন তাদের অতি লজ্জাজনক পরাজয় বরণ করতে হয়। রাজনীতির গতি-প্রকৃতি আমাদেরকে সম্ভবত সে দিকেই নিয়ে যাচ্ছে। 

সময়ের বাস্তবতা বলে দিচ্ছে, আগামী দিনের রাজনীতির উষ্ণতা দিনে দিনে আরো বাড়বে। এ উষ্ণতা আরো বেশি তাপ বিকিরণ করবে। আকাশে মেঘ দেখলে বোঝা যায় বৃষ্টি হতে পারে। দূরের আকাশে কালো ধোঁয়া দেখলে সহজেই অনুমান করা যায় কোথাও আগুন লেগেছে। সরকারের দমন-পীড়নের মাত্রা এবং বিরোধী দলের রাজপথমুখিতা বলছে রাজনীতির উত্তাপ আরো বাড়বে। ক্ষমতাসীন মহলের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত জাতীয় পার্টি এবং ১৪ দলের জনসমর্থনহীন কয়েকটি রাজনৈতিক দল ব্যতীত সকল রাজনৈতিক দল এখন একটি দাবিতে একাট্টা। তারা একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ চায়। মানুষের মৌলিক অধিকার, ভোটাধিকার, কথা বলার অধিকার, সভা-সমাবেশ করার অধিকার, নির্বিঘেœ চলাচলের অধিকার, বাক-স্বাধীনতার তথা মতপ্রকাশের অধিকার চায়। অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, বেঁচে থাকার নিরাপত্তা, শিক্ষার নিরাপত্তা, ব্যক্তিসত্তার নিরাপত্তা আজ চরমভাবে ভূলুণ্ঠিত। এ সকল অধিকার আদায়ে যারা প্রথম সারিতে থাকবে জনগণ তাদের ডাকে ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধা করবেন না। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ তারই বার্তা দিচ্ছে। অন্যায় ও অবৈধভাবে ক্ষমতায় জেঁকে বসা ভোটারবিহীন এই সরকারের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলনের সম্মুখ সারিতে আছে বিএনপি। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকাসহ সারাদেশে তাদের দশটি বিভাগীয় সমাবেশ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। যারা বিএনপির সমাবেশে এসেছে তারা সবাই বিএনপির কর্মী বা সমর্থক নয়। ১৫ বছর যাবৎ একটি গণতন্ত্রহীন রাজনৈতিক কাঠামোয় নিষ্পেষিত জনগণ নতুন আলোর ঝলকানিতে আশাম্বিত হয়েই বিএনপির জনসভায় যোগদান করেছে। কিন্তু বিএনপি কি এ সমাবেশগুলো বাধা-প্রতিবন্ধকতাহীনভাবে করতে পেরেছে? তাদের একটি সমাবেশও প্রতিবন্ধকতমুক্ত ছিলো না। সিলেটের সমাবেশ ব্যতীত প্রতিটি সমাবেশের পূর্বে বাস, ট্রেন, লঞ্চ, ট্রলার, খেয়া পারাপারের নৌকা সব কিছু বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পরিবহন ধর্মঘটের নামে সকল কিছু বন্ধ করে দেয়ার পরও ক্ষমতাসীন মহল তৃপ্ত হতে পারেনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে বিরোধী নেতা-কর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি। গায়েবি মামলা এবং পথে পথে বাধা দেয়ার এক ঘৃণ্য নজির ক্ষমতাসীন মহল উপস্থাপন করেছে।

এত কিছুর পরও কি মানুষের উপস্থিতি ঠেকানো গেছে? তাদেরকে সমাবেশে যোগদান হতে কি বিরত রাখা গেছে? হামলা, মামলা, পথে পথে বাধা, যানবাহন নেই, অনিশ্চয়তা, শঙ্কা সকল কিছু মাড়িয়ে মানুষ সমাবেশে যোগদান করেছে। মোটরসাইকেলে, মালবাহী কাভার্ডভ্যানে, বাইসাইকেলে, নসিমন করিমনে, কখনো অটোরিক্সায় কখনো পায়ে হেঁটে মানুষ এ সকল সমাবেশে যোগদান করেছে। শুধু পায়ে হাঁটাই নয়, খেয়া পারাপারের নৌকা বন্ধ করে দেয়ার কারণে কলার ভেলায় চড়ে, নদী সাঁতড়িয়ে মানুষ এ সকল জন-সমাবেশে যোগদান করেছে। ঢাকার বাইরে জনসভাগুলোতে জনতার বাঁধভাঙা স্রােত দেখে সরকার সম্ভবতই ভয় পেয়ে গেছে। তাই তাদের সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টা ছিলো ঢাকার সমাবেশকে করতে না দেয়া। এ জন্য তারা একদিকে যেমন দলীয় কর্মীদেরকে সতর্ক রেখেছে অপর দিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে লজ্জাজনকভাবে ব্যবহার করেছে। ঢাকায় বিএনপির সমাবেশ ছিলো ১০ ডিসেম্বর। এক আগের ১৫ দিনের ঘটনাপ্রবাহ প্রমাণ করে সরকার আন্তরিকভাবেই চেয়েছিলো যাতে বিএনপি ঢাকায় সমাবেশ করতে না পারে। কিংবা সমাবেশ করলেও তাতে যেন বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। বিশৃঙ্খলায় সরকার একসঙ্গে দুটি লাভ খুঁজেছে। এক. দেশবাসী এবং বিদেশীদের বোঝানো যারা সরকারের কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করছে তারা আসলেই সন্ত্রাসী এবং নাশকতাকারী। দুই. মামলা দিয়ে ব্যাপক হারে গ্রেফতার করে আন্দোলন দমনের পথকে প্রশস্ত রাখা। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ক্ষমতাসীন মহল সব সময় বিরোধীদের ওপর খড়গহস্ত ছিলো। তারা কখনো কাক্সিক্ষত গণতান্ত্রিক আচরণ করেনি। 

সরকার কেন এত খড়গহস্ত? এ প্রশ্নের জবাব তাদের অতীত কর্মকাণ্ডের মাঝেই লুক্কায়িত। ২০০৬ সালে চারদলীয় জোট সরকারের ক্ষমতার মেয়াদ শেষান্তে শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর তারা মসৃণভাবে হতে দেয়নি। লগি-বৈঠার তাণ্ডবের মাধ্যমে এক বিভীষিকাময় পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছিলো। সারাদেশে সন্ত্রাস এবং রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলো। দলীয় নির্দেশে তাদের কর্মীরা সারাদেশে লগি-বৈঠা আর অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রাস্তায় নেমে আসে। রাজধানীসহ সারাদেশে তাদের হামলায় ২৮ জন মানুষ খুন হয়, আহত হয় কয়েক হাজার মানুষ। অফিস-আদালত বাসা-বাড়িতে ব্যাপকভাবে অগ্নিসংযোগ করা হয়। রাজনীতির সূতিকাগার পুরানা পল্টনে দিনভর তাদের হামলা অব্যাহত থাকে। প্রকাশ্য দিবালোকে মিডিয়ার ক্যামেরার সামনে ৬ জন তরুণকে পিটিয়ে হত্যা করার পর তাদের লাশের ওপর পৈশাচিক নৃত্য করে। তাদের এ বর্বরতার কারণে চারদলীয় জোট সরকারের ক্ষমতার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর যারা দায়িত্বভার নেয়ার কথা তারা অপারগতা প্রকাশ করে। রাজনৈতিক এক ভ্যাকুয়াম তৈরি হয়। এই ভ্যাকুয়ামকে কাজে লাগায় সেনাশাসনে আগ্রহী একদল মানুষ। মঈন-ফখরুদ্দীনের সরকার দু’ বছর দেশ শাসন করে। তাদের অধীনে ২০০৮ সালে যে নির্বাচন হয় তাতে অনেক সাজানো খেলা চলে, খালি চোখে যা দেখা যায়নি। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে।

২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসীন হয়ে আওয়ামী লীগ আবার একদলীয় বাকশালী শাসনের পথে হাঁটতে শুরু করে। আদালতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে কেয়ারটেকার সরকারব্যবস্থার বিরুদ্ধে রায় আনার ব্যবস্থা করে। সে রায়কে উপজীব্য করে ২০১১ সালে একতরফভাবে সংবিধান হতে কেয়ারটেকার সরকারব্যবস্থা বাতিল করে। এরপর ২০১৪ সালে বিনা ভোটেই ১৫৩ জনকে নির্বাচিত করে বাকি আসনগুলোতে নিজেরাই ব্যালটবাক্স ভর্তি করে। ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে করে নেয়। রাত্রিকালীন ভোটের সরকার এখন ক্ষমতায় আছে। তারা তাদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে যা কিছু করার তার সবই করেছে এবং করে যাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতি উৎসাহী কর্মকর্তা এবং তাদের হাতে নিয়োগ পাওয়া দলীয় কর্মীরা দেশে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে রাজনীতি দমনকে এক নাম্বার মিশন হিসেবে বেছে নেয়। কোনো কারণ ছাড়াই গ্রেফতার, গুম, খুনসহ এমন কোনো গর্হিত কাজ নেই যা তারা করছে না। তাদের ১৪ বছরের দুঃশাসনে জনগণ চরমভাবে নির্যাতিত। নির্যাতনের মাত্রা এমনভাবে বেড়ে গেছে, এখানে অন্যায় এবং জুলুমের বিরুদ্ধে কথা বলাকেও অন্যায় মনে করা হয়। দখল, হামলা, মামলা, চাঁদাবাজি, ব্যাংক দখল, বাড়ি দখল, বিশ^বিদ্যালয় দখল, হাসপাতাল দখল, ক্যাম্পাস দখল সব কিছু তাদের কাছে আইনসিদ্ধ হয়ে গেছে। লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে যাবার পরও তারা মনে করে কিছুই হয়নি। একটি ছাত্রসংগঠনের জেলা পর্যায়ের নেতা দু’হাজার কোটি টাকা পাচারের মামলায় গ্রেফতার হবার পর তাদের শ্রেণিচরিত্র এ থেকে অনুমান করা যায়। অন্যায় অপরাধ করতে করতে তারা নিজেদেরকে এমন এক জায়গায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছে যে, তাদের এখান থেকে সরে যাবার সেইফ এক্সিটের অতি সরু রাস্তাটিও তারা বন্ধ করে ফেলেছে। ক্ষমতা চর্চায় তারা যে অন্যায় ও অগণতান্ত্রিক রাস্তা আবিষ্কার করেছে, পৃথিবীর সকল স্বৈরশাসকই এ ধরনের কাজ করে থাকে। কিন্তু শেষ পরিণতি কারো জন্য সুখকর হয় না। সরকার এটা হয় বোঝে না, অথবা বোঝার পর সজ্ঞানেই এই জুলুম নির্যাতন এবং নিবর্তনের পথ বেছে নিয়েছে। 

ক্ষমতার রশিকে প্রলম্বিত করার জন্য তাদের কাছে এখন একটিই রাস্তা আছে। বিরোধী মতের কারো কথা শোনা হবে না, কাউকে কথা বলতে দেয়া হবে না। হামলা-মামলায় বিরোধী মতের মানুষকে পর্যুদস্ত করে দিতে হবে। চরম ফ্যাসিবাদী আচরণ শাসকগোষ্ঠীকে এমন স্বেচ্ছাচারী কর্মকাণ্ড করতে বাধ্য করছে যার প্রতিটিই তাদের জন্য বুমেরাং হচ্ছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তাদের দলীয় এক সভায় বলেছেন, পতন আসন্ন হলে সঠিক কাজটিও মানুষ ভুল পথে করে। এ দ্বারা কাদেরকে উদ্দেশ করেছেন তা তিনিই ভালো জানেন। তবে এ কথা বর্তমান শাসকগোষ্ঠীর জন্য শতভাগ প্রযোজ্য। ঢাকার বাইরে নয়টি সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে করার পরে ঢাকায় একটি সমাবেশ বিএনপি করবে, এতে সরকারের এমন আতঙ্কের কী বিষয় ছিল? সমাবেশ তো হলো। সমাবেশের কারণে জনজীবনে কোনো প্রকার অশান্তি কিংবা অস্বস্তি তৈরি হয়নি। বরং সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকাণ্ড জনজীবনে ভীতি, আতঙ্ক ও ত্রাসের জন্ম দিয়েছে। সরকারের তরফ থেকে খোঁড়া যুক্তি দেয়া হয়েছিলো যে, রাস্তায় সমাবেশ হলে মানুষের চলাচলে কষ্ট হবে, জনজীবনে অশান্তি তৈরি হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে সরকারের এ বক্তব্যকেই ডেলিভারি করা হয়েছে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা এমন ভাষায় কথা বলেছেন, যা রাজনৈতিক জনসভার বক্তব্যে দেয়া হয়ে থাকে। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তি যখন বলেন, ‘খেলা হবে’ তখন বুঝতে বাকি থাকে না, তারা দেশের রাজনীতিকে কোন জায়গায় নিয়ে গেছেন। ‘খেলা হবে’ শব্দটি কোনো রাজনৈতিক পরিভাষা হতে পারে না। এ ধরনের শব্দ পাড়ার মাস্তানরা ব্যবহার করে থাকে। প্রথমে এ বক্তব্য দিয়েছে গডফাদার হিসেবে পরিচিত তাদের দলেরই একজন। যার অতীত কর্মকাণ্ড রাজনীতির স্বাভাবিক আচরণের ব্যতিক্রম। 

সরকার তার খেলা খেলেছে। সরকারের টার্গেট ছিলো বিএনপিকে কোনোভাবেই নয়াপল্টনে তাদের দলীয় অফিসের সামনে সমাবেশ করতে দিবে না। সরকার তাদের এ টার্গেট অর্জন করলেও তারা যে ক্ষতি এবং লোকসানের কবলে পড়েছে তা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। সভা-সমাবেশ করা, দল করা, সঙ্ঘ গঠন করা প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। সংবিধান প্রতিটি নাগরিককে এ অধিকার দিয়েছে। কে কোথায় সমাবেশ করবে এটি যদি পুলিশের অনুমতি নিয়ে করতে হয়, তবে তাকে কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলা যায় না। পুলিশের দায়িত্ব হচ্ছে, সমাবেশ করতে গিয়ে কেউ ভায়োলেন্স করে কি না, এটা দেখা। জনমনে ভীতির সঞ্চার করে কি না, এটা দেখা। কারো সভা-সমাবেশ বন্ধ করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু বিগত ১৪ বছর যাবৎ তারা এ কাজটিই করে এসেছে। নয়াপল্টনে বিএনপি যাতে সমাবেশ করতে না পারে এ জন্য সরকার আগ বাড়িয়ে বিএনপি অফিসের সামনে বর্বর হামলা চালিয়েছে। যদিও পুলিশের তরফে বলা হয়েছে, বিএনপি কর্মীদের সরে যেতে বলার পরও তারা রাস্তা হতে না সরার কারণে পুলিশ অ্যাকশনে যেতে বাধ্য হয়েছে। সাম্প্রতিককালে বিএনপি অফিসের সামনে তো প্রতিদিনই এভাবে তাদের দলীয় কর্মীরা জড়ো হয়ে স্লোগান দেয়। ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশের দুদিন আগে কেন পুলিশের এই ম্যাসাকার? পুলিশ বলেছে, ‘বিএনপি অফিসে বোমা আছে’ এই তথ্যের ভিত্তিতে তারা বিএনপি অফিসে তল্লাশি চালিয়েছে। তল্লাশি পরিচালনার এটা কোনো নীতি হতে পারে না। কোনো কারণ ছাড়াই কর্মীদের ওপর লাঠিচার্জ, তাদের ওপর ব্যাপক গুলি বর্ষণ, সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ এবং কাঁদানো গ্যাস ছোড়া হয়েছে। এরপর দলের মহাসচিবের সামনেই তাদের বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতাসহ পাঁচ শতাধিক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দলের মহাসচিব বারবার অফিসে ঢুকতে চাওয়ার পরও তাকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। সরকারের খেলা এখানেই বন্ধ হয়নি। সমাবেশের ঠিক একদিন আগে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশ বাস্তবায়ন কমিটির সমম্বয়ক মির্জা আব্বাসকে গভীর রাতে গ্রেফতার করে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত পুলিশের কাছে কোনো কারণ বা ওয়ারেন্ট ছিলো না। জাতীয় নেতাদেরকে কোনো ওয়ারেন্ট ব্যতীত, যুক্তিযুক্ত কোনো কারণ ছাড়া গ্রেফতার করতো পাকিস্তান আমলের আইউব, ইয়াহিয়া সরকার। আমরা কি এখানো সেই আমলেই বাস করছি? 

দীর্ঘ দুই সপ্তাহের নাটকীয়তার পর সরকার ১০ ডিসেম্বর বেলা ১১টায় বললো যে, বিএনপিকে গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশ করার জন্য তারা অনুমতি দিয়েছে। সরকার এবং পুলিশের তরফে বারবার বলা হয়েছে, তারা অনুমতি দিয়েছে। বিএনপি পুলিশকে যে চিঠি দিয়েছে, তাতে তারা সমাবেশের কোনো অনুমতি চায়নি। সমাবেশ বাস্তবায়নে তারা সহযোগিতা চেয়েছে। বিএনপির পক্ষ হতে বেলা দুইটায় গোলাপবাগ মাঠে সমাবেশের ঘোষণা দেয়ার সাথে সাথে গোলাপবাগ মাঠে বিএনপি কর্মী এবং সাধারণ মানুষ আসতে শুরু করে। রাত আটটার মধ্যে পুরো মাঠ ভরে যায়। বিএনপির সমাবেশগুলোতে অভাবনীয় এই উপস্থিতি রাজনীতির এক নতুন চিত্র জাতির সামনে উপস্থাপন করে। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার এই উপস্থিতি ক্ষমতাসীনসহ গোটা দেশবাসীকে এই মেসেজই দিয়েছে যে, আওয়ামী লীগের দুঃশাসনে তারা চরমভাবে নির্যাতিত, নিপীড়িত। তারা এই দুঃশাসনের অবসান চায়। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে তারা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে চায়। জনতার এই আওয়াজ শাসকগণের বোঝার মতো মন এবং উপলব্ধিজ্ঞান আছে কি না বোঝা যাচ্ছে না। 

সমাবেশ বাস্তবায়ন নিয়ে সরকার যে আচরণ করলো, তাকে কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক আচরণ বলা যায় না। যারা দীর্ঘ সময় দেশ শাসন করেছে, যে দলের প্রতিষ্ঠাতা স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছে। সেই দলের অফিসে বর্বর হামলা, অফিস ভাঙচুর, তছনছ করা, কম্পিউটারসহ মালামাল নিয়ে যাওয়া একটি জনবান্ধব সরকারের আচরণ হতে পারে না। এরপর চারদিন যাবৎ তাদের অফিস অবরুদ্ধ করে রেখেছে। সরকার খোঁড়া যুক্তি দেখিয়েছিলো সমাবেশের রাস্তা বন্ধ হলে জনদুর্ভোগ বাড়বে, অথচ সেই সরকারের নির্দেশেই পুলিশ চারদিন যাবৎ বিএনপি অফিসের সামনের রাস্তা বন্ধ করে রেখেছিলো। ঐ এলাকায় বসবাসরত মানুষের চলাচলকেও নিয়ন্ত্রিত করে রেখেছিলো। এতো কিছুর পরও বিএনপির সমাবেশ সফল হয়েছে। সরকার হয়তো তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছে তারা বিএনপিকে নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে দেয়নি। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অবশ্য বলে ফেলেছেন, বিএনপির অর্ধেক পরাজয় হয়ে গেছে, তারা নয়াপল্টনে সমাবেশ করতে পারেনি। এতে কার লাভ আর কার ক্ষতি হয়েছে তা দেশের জনগণ পরিমাপ করে ফেলেছে। নয়াপল্টনে আন্দোলনের ঢেউ ওঠেনি এটা সত্য কিন্তু গোলাপবাগে ঠিকই গোলাপ ফুটেছে। ফুলের ঘ্রাণে মধু মক্ষিকার মতো জনতার বাঁধ ভাঙা স্রােত এসে মিশে গেছে একদিকে কমলাপুর অপর দিকে গুলিস্তান ও মতিঝিল পর্যন্ত। সমাবেশের দিন সরকারি দলের নেতা-কর্মীরা রাস্তার মোড়ে মোড়ে লাঠি ও দেশীয় অস্ত্র হাতে পাহারা বসিয়েছে। মানুষের মোবাইল মানিব্যাগ চেক করেছে। মোবাইলের মেসেজ চেক করেছে। প্রতিটি মানুষের মোবাইলে ব্যক্তিগত অনেক ছবি থাকতে পারে। মেসেজের ইনবক্সে ব্যক্তিগত-পারিবারিক অনেক তথ্য আদান-প্রদান হয়। এ মেসেজ পুলিশ কিংবা ছাত্রলীগ দেখতে পারে কি না? এমন প্রশ্ন দেশের আইনজ্ঞ, সাংবাদিকসহ অনেকেই করেছেন। কিন্তু সরকারের কান তো বধির হয়ে গেছে। এ সকল সমালোচনায় তাদের কিছু যায় আসে না। 

নয়াপল্টনে ম্যাসাকারে সরকারের টার্গেট ছিলো বিএনপিকে সমাবেশ করতে না দেয়া। কিন্তু এরপরও কেন সরকার সমাবেশ করতে দিলো? এর জবাব পাওয়া যাবে সরকারের কিছু আচরণে। বিএনপি অফিসে পুলিশের হামলা এবং গ্রেফতার অভিযান সম্পর্কে এর সুষ্ঠু তদন্তের দাবি করেছে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের কেন গ্রেফতার করা হয়েছে তারও কারণ ব্যাখ্যা করতে বলা হয়েছে এ বিবৃতিতে। ঢাকায় অবস্থানরত ১২টি দেশের কূটনীতিক কয়েকদিন আগে এক যৌথবার্তায় রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছে। এ সকল বিবৃতি সরকারকে মারাত্মক চাপে রেখেছে। সরকারের অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক অবস্থা ও বৈদেশিক সম্পর্ক অনেক টানাপড়েনের মধ্যে যাচ্ছে। যার কারণে সরকার বাংলাদেশে অবস্থানরত সকল দূতাবাসে একটি চিঠি দিয়ে কারণ ব্যাখ্যা করেছে, কেন তারা বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদেরকে গ্রেফতার করেছে। সরকারের এ বিবৃতি তাদের জন্য কতটুকু ফলদায়ক হবে তা সময়ই বলে দেবে। তবে বিদেশীদের কথায় কথায় ধমকানোর বাতিক সরকার তার মাথা থেকে নামিয়ে ফেললেই দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকর হবে। আমেরিকান রাষ্ট্রদূত মিস্টার পিটার হাস গিয়েছিলেন গুম হওয়া বিএনপি নেতা সাজেদুল ইসলাম সুমনের বাসায়। সেখানে যাওয়ার পর সরকারের মদদে যে তুলকালাম কাণ্ড ঘটানো হয়েছে, এতে সরকারের লাভের চেয়ে বরং লোকসানের পাল্লাই ভারী হয়েছে। যদিও আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূত যে সুমনের বাসায় গিয়েছে, তা তাদের জানা ছিলে না; এবং তিনি প্রশ্ন করেছেন, কারা পিটার হাসের যাওয়ার তথ্য প্রকাশ করেছে? আমাদের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশের জনগণ এবং বিদেশী সবাইকে বোকা ভাবে আর নিজেদেরকে অনেক বুদ্ধিমান মনে করেন। মূলত দীর্ঘদিন একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বদৌলতে ক্ষমতাসীনদের অন্তরে যে ফ্যাসিজমের জন্ম হয়েছে এতে তাদের এ রকম ভাবনাই স্বাভাবিক। সুমনের মা বলেছেন, পিটার হাস আসার দুদিন আগে থেকেই ভাটারা থানার ওসি নিয়মিত এ বাসার খোঁজখবর রাখছিলেন। এমনকি মিস্টার পিটার হাসের সাথেও পুলিশের স্কট ছিলো। এখানে সরকারের না জানার মতো যে তথ্য মন্ত্রী দিয়েছেন তা কোনো যুক্তিতেই গ্রহণযোগ্য নয়। 

মায়ের ডাক নামক একটি সংগঠনের ব্যানারে দীর্ঘদিন যাবৎ গুম হওয়া মানুষদের পরিবারের সদস্যরা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে কর্মসূচি পালন করছেন তাদের প্রিয়জনকে ফিরে পাওয়ার জন্য। এ ধরনের কর্মসূচি এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের ডকুমেন্টের ভিত্তিতে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলসহ অনেকগুলো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন গুম হওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের কাছে তথ্য চেয়েছিলেন। জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল এবং স্টেট ডিপার্টমেন্টের এ সকল বক্তব্যের জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা সত্যিই দুঃখজন। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আমরিকা এবং ইউরোপে কত মানুষ গুম হয় তা সিএনএন দেখিয়েছে। আওয়ামী লীগের মতো একটি বড়ো দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর বক্তব্য সরকারের পক্ষে না গিয়ে বরং বিপক্ষেই যাচ্ছে। যে কোনো ব্যক্তি সিএনএন এবং অন্যান্য ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখতে পারেন, আমেরিকা এবং ইউরোপে সরকারি বাহিনী কর্তৃক কোনো গুমের ঘটনা ঘটে না। এ সব দেশে যা হয় তা হচ্ছে, মিসিং। একজন মানুষ হঠাৎ হারিয়ে যায়। হারিয়ে যাওয়ার নানা কারণ রয়েছে। এ সকল দেশে পারিবারিক ব্যবস্থা ভেঙে গেছে। পারিবারিক অশান্তি, মাদকাসক্ততা. ডিপ্রেশন, বৃদ্ধ বয়সে কাক্সিক্ষত আচরণ না পাওয়া, ইত্যাদি কারণে বিভিন্ন মানুষ হারিয়ে যায়। এ ছাড়া বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ কর্তৃক অপহরণের ঘটনা ঘটে। কিন্তু তারা কখনোই নিজ দেশের কোনো নাগরিককে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক তুলে নিয়ে যায় না কিংবা তুলে নেয়ার পর অস্বীকার করে না। এ সকল ক্ষেত্রে ওয়েস্টার্ন দেশগুলোতে আইন ও বিচার খুব স্বচ্ছ। বিভিন্ন দেশে যুদ্ধবিগ্রহ কিংবা সা¤্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের জন্য আপনি তাদেরকে দশবার গালি দিতে পারেন। কিন্তু তারা নিজ দেশের জনগণের সাথে কখনো অগণতান্ত্রিক আচরণ করে না। নিজের পক্ষে না গেলে যে কোনো কিছুর বিরুদ্ধে পেশিশক্তির ব্যবহার আওয়ামী রেজিমের একটি বৈশিষ্ট্য। পিটার হাস সাজেদুল ইসলাম সুমনের বাসায় যাওয়ার পর সরকারি মদদে মায়ের কান্না নামক একটি সংগঠন দাঁড় করিয়ে তাকে অপমান ও অপদস্থ করার খেসারত আওয়ামী লীগকে সম্ভবত বড়ো মাপেই দিতে হবে। ইউএস অ্যাম্বাসেডর একটি ঘরোয়া মিটিং এ বাধাগ্রস্ত হওয়ার পর বাইডেন প্রশাসনের পক্ষ থেকে গভীর উদ্বেগ জানানো হয়েছে। যার ফলাফল সুদূরপ্রসারী হতে পারে। 

রাষ্ট্রদূতদেরকে থ্রেট করা বা বিদেশি দূতাবাসে চিঠি দেয়ার মাধ্যমে সরকার তার অসহিষ্ণু আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে একই সাথে তারা যে আন্তর্জাতিক চাপে আছে তার খোলস প্রকাশ করে দিচ্ছে। বাংলাদেশের জনগণ দীর্ঘদিন যাবৎ নানা বঞ্চনা আর জুলুমের মধ্য দিয়ে তাদের সময়কে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। জনগণ যেভাবে রাস্তায় নেমে এসেছে, তার প্রতিক্রিয়ায় সরকারের আচরণ তাদের জন্য বিপরীত ফল দিবে বৈ কি। আমরা ৫১তম বিজয় দিবস উদযাপন করে বিজয়ের ৫২তম বছরে পা রাখছি। কিন্তু স্বাধীনতা ও বিজয়ের মাধ্যমে কি পেলাম? বিজয় দিবসে আমরা পাকিস্তানিদের অনেক গালাগালি করি এবং করে আসছি। কিন্তু পাকিস্তানিদের চেয়ে কি উন্নত হতে পেরেছি? মতপ্রকাশের স্বাধীনতার র‌্যাংকিং করে reporters without borders press freedom. তাদের ডাটা অনুযায়ী ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২, যেখানে পাকিস্তানের অবস্থান ১৫৭তম। অবকাঠামো উন্নয়নে বিশ্বব্যাংকের র‌্যাংকিং স্কোরে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৯, এর বিপরীতে পাকিস্তানের অবস্থান ৬৬তম। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাংকিং বাংলাদেশের কোনো বিশ^বিদ্যালয় এক হাজারের মধ্যে নেই। অথচ এক হাজারের মধ্যে পাকিস্তানের ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে, কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ইউনিভার্সিটি চারশটির মধ্যে আছে। election integrity র‌্যাংকিং এ-ও বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়ে পিছিয়ে আছে। অথচ ১৯৭০ এর নির্বাচনের ফলাফল ইয়াহিয়া সরকার মেনে নেয়নি বলে আমরা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে আমরা স্বাধীন হয়েছি। আজ বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা এ দেশের জনগণ তাদের পছন্দমতো নেতা নির্বাচন করতে পারছে না। সকল বিচারে আওয়ামী লীগ শুধু দেশের মানুষের বিপরীতেই অবস্থান নেয়নি। তাদের বর্তমান কর্মকাণ্ড আমাদেরকে অনেক বেশি আন্তর্জাতিক চাপের মধ্যে ফেলবে, যা কারো জন্য শুভকর হতে পারে না। আওয়ামী লীগের ক্ষমতার মেয়াদ একদিন বেশি বৃদ্ধি পাওয়া মানে আরো একটি দিন ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া। 

দেশের জনগণের বৃহৎ অংশ আওয়ামী লীগকে আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না। বিদেশীরা সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের জবাব চাইছে। এ সকল বিষয় দেখে সরকার ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের মতো একতরফা নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া সম্ভব নয়। তাই তারা নতুনভাবে আবার জঙ্গি স্লট সামনে নিয়ে এসেছে। পত্রিকার সংবাদের লিংকে গেলে দেখা যায় জনগণ সরকারের এ সকল কারসাজির জবাবে কেমন সব ভাষা ব্যবহার করে থাকে। কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ফাঁসির আসামি ছিনতাইয়ের নাটক ফ্লপ হওয়ার পরে সরকার আরো একটি ভয়ঙ্কর খেলায় মেতে উঠেছে। ১০ ডিসেম্বর-২০২২ বিএনপির সমাবেশে সরকারের পদত্যাগ, নেতাকর্মীদের মুক্তি, কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন দেয়াসহ দশ দফা দাবি উত্থাপন করে। একই দিনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান এক ভার্চুয়াল মিটিংয়ে দশ দফা দাবি আদায়ে কর্মসূচি ঘোষণা করেন। বিএনপি আগে থেকেই বলে আসছিলো গণতান্ত্রিক আন্দোলনে শরিক সকল দলকে সাথে নিয়ে তারা যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তুলবে। জামায়াতে ইসলামীর আমীর যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবেই কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। কিন্তু কর্মসূচি ঘোষণার দুই দিনের মাথায় গভীর রাতে তাকে তার বাসা থেকে গ্রেফতার করে জঙ্গিবাদের সাথে সম্পৃক্ততার মতো ঘৃণ্য মামলা দিয়ে জনগণের আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহের নতুন খেলায় মেতে উঠেছে। এ দ্বারা তারা পশ্চিমাদের বোঝানোর চেষ্টা করছে যারা বর্তমানে বাংলাদেশে আন্দোলন করছে তারা উগ্রবাদে বিশ^াসী, জঙ্গি। এদেরকে মোকাবিলার জন্য আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকা জরুরি। অতএব তোমরা আমাদের সমর্থন দাও, যাতে আগামীতেও বিনা ভোটে আমরা ক্ষমতায় থাকতে পারি। কিন্তু সরকারের এ নাটক দেশের জনগণ এবং আন্তর্জাতিক মহলে কোনো ঠাঁই পায়নি এবং পাবেও না। 

জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান সকল মহলের কাছেই একজন ভদ্র সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। করোনাকালীন সময় হতে শুরু করে বিগত বন্যায় তিনি অসহায় মানুষের কাছে ছুটে গিয়েছেন দ্বিধাহীনভাবে। বন্যার্ত মানুষের সেবায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিজের কাঁধে করে খাদ্যসামগ্রী নিয়ে পৌঁছে গেছেন। মহালয়ার হিন্দু যাত্রীরা নৌকাডুবিতে নিহত হওয়ার পর তাদের বাড়িতে সাহায্য নিয়ে গেছেন। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন। অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছেন। শুধুমাত্র পত্রিকার সংবাদ দেখেছেন একজন অশীতিপর বৃদ্ধার থাকার ঘর নেই, তার ঘরের বন্দোবস্ত করেছেন। যেখানেই দুর্যোগ দুর্ঘটনা সেখানেই তিনি সবার আগে গিয়ে হাজির হয়েছেন। নিজ কাঁধে করে লাশ বহন করা, নিজেই দাফনের জন্য কবরে নেমে যাওয়া, কেউ অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাওয়া তার সভাবসুলভ বৈশিষ্ট্য। এমন একজন দরদি মানুষকে এবং তার পরিবারকে নিয়ে সরকারের ঘৃণ্য রাজনৈতিক খেলা অবশ্যই বুমেরাং হতে বাধ্য। সরকার বিরোধী মতকে দমনের জন্য যা করছে এর সবই তারা করছে চিরস্থায়ীভাবে ক্ষমতার মসনদকে পাকাপোক্ত করার জন্য। কিন্তু ক্ষমতা কারো জন্য স্থায়ী নয়। বিরোধী দলকে মোকাবিলা করার জন্য সরকারের এ সকল ফ্যাসিবাদী আচরণের বিরুদ্ধে জনতার বাঁধভাঙা যে জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে সে জোয়ারে সকল অন্যায় ও অবৈধভাবে ক্ষমতার মসনদ আঁকড়ে থাকা ফ্যাসিবাদের তখতে তাউস অবশ্যই ভেসে যাবে। গণতন্ত্রকামী, মুক্তিকামী জনতার বিজয় হবে ইনশাআল্লাহ।

লেখক : বিশিষ্ট কলামিস্ট ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির