পরমাণু চুক্তি ইরানের ঐতিহাসিক বিজয়
জালাল উদ্দিন ওমর
০৭ আগস্ট ২০১৫
অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় গত ১৪ জুলাই পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে ইরানের সাথে বিশ্বের ছয় পরাশক্তির সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই চুক্তির একপক্ষ হচ্ছে ইরান আর অপর পক্ষ হচ্ছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ভেটোক্ষমতার অধিকারী পাঁচটি পরমাণু শক্তিধর দেশ- যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি। তবে ইসরাইল এই চুক্তির বিরোধিতা করেছে। চুক্তিটি ২০ জুলাই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদেও সর্বসম্মতভাবে পাস হয়েছে। চুক্তিটির সারসংক্ষেপ হচ্ছে- ইরান একটি নির্দিষ্ট সীমারেখা পর্যন্ত তার পরমাণু কর্মসূচি চালাবে, তবে পরমাণু বোমা বানাবে না। বিনিময়ে ইরানের ওপর আরোপিত অর্থনৈতিক অবরোধ উঠে যাবে। বিশ্বের সেরা ছয় পরাশক্তির সাথে ইরানের এই সমঝোতা চুক্তি বিশ্বরাজনীতির পরিমন্ডলে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা এবং নিঃসন্দেহে এটি ইরানের বিরল অর্জন। বিশ্বের সেরা ছয়টি ক্ষমতাধর রাষ্ট্রকে আলোচনার টেবিলে আনা এবং চুক্তিতে পৌঁছতে তাদেরকে রাজি করানো চাট্টিখানি কথা নয় এবং এটা অসাধ্য সাধন করার মতোই একটি বিষয়। এ ক্ষেত্রে ইরান তা সাধন করেছে। এটা ইরানের বিশাল একটি অর্জন এবং ঐতিহাসিক বিজয়। প্রকৃতপক্ষে ইরানের শক্তিই আজ ইরানকে এই মর্যাদা এনে দিয়েছে। কারণ শক্তি হচ্ছে শান্তি এবং নিরাপত্তার গ্যারান্টি। যার শক্তি আছে তাকে সবাই সমীহ এবং সম্মান করে। তাকে কেউ আঘাত করে না। তাই যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ব্রিটেন এবং ফ্রান্সসহ বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রসমূহকে কেউই আক্রমণ করে না। এসব দেশের কেউই একে অন্যকে আক্রমণ করেনি। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া একে অপরের চির দুশমন হলেও আজ পর্যন্ত এরা একে অন্যকে কখনও আক্রমণ করেনি এবং ভবিষ্যতেও আক্রমণ করার কোনো আশঙ্কা নেই। তাদের শক্তি তাদের শান্তি এবং নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করেছে। একইভাবে ইরানের শক্তিই আজ ইরানের শান্তি এবং নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করেছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সামরিক ক্ষেত্রে ইরানের শক্তিই আজ বিশ্বের সেরা ছয় পরাশক্তিকে ইরানের সাথে সমঝোতায় আসতে বাধ্য করেছে। এই বাস্তবতা থেকে সবারই শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। এই চুক্তির সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে ইরানের সাথে পশ্চিমা বিশ্বের দীর্ঘদিনের যে দ্বন্দ্ব, বৈরিতা এবং বাকযুদ্ধ; তা থেকে বিশ্ববাসী আপাতত মুক্তি পেল।
ইরান কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতা ও ঐতিহ্যের দেশ। রেজা শাহের রাজত্বকালে ইরান ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ১৯৭৯ সালে খোমেনির নেতৃত্বে ইরানে ইসলামপন্থীদের ক্ষমতারোহণ ছিল বিশ্বরাজনীতির ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। তখন থেকেই ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের বৈরিতা শুরু হয়। পরমাণু কর্মসূচি শুরু হলে ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের দ্বন্দ্ব আরও বেড়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘ ইরানের বিরুদ্ধে একের পর এক অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের পক্ষ থেকে ইরানের বিরুদ্ধে হামলার হুমকি চলতে থাকে। আর পরমাণু কর্মসূচি ধ্বংসের জন্য ইরানের বিরুদ্ধে ইসরাইলের সামরিক অগ্রাসনের হুমকি ছিল নিত্যদিনের চিত্র। বিপরীতে ইরানের নেতারা বরাবরই বলেছেন, তারা কিছুতেই পারমাণবিক কর্মসূচি পরিত্যাগ করবেন না, কারণ এটা তাদের গণতান্ত্রিক ও ন্যায্য অধিকার। এভাবে পরমাণু ইস্যুতে দীর্ঘদিন ধরেই ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং ইসরাইলের বাকযুদ্ধ চলেছে। অবশেষে দীর্ঘ আলোচনা শেষে পরমাণু কর্মসূচি ইস্যুতে ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং জার্মানির সমঝোতা হয়েছে। এর মাধ্যমে ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের পঁয়ত্রিশ বছরের তিক্ততার অবসানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
ইরানকে পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে বিরত রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমাদের এই দীর্ঘ প্রচেষ্টার প্রধান কারণ নাকি বিশ্বকে শান্তি ও নিরাপদ রাখা। যুক্তরাষ্ট্র, তার মিত্র এবং ইসরাইলের মতে ইরানের হাতে পরমাণু অস্ত্র থাকা নাকি বিশ্বের শান্তির জন্য হুমকি। ইরান যদিও বারবার বলেছে, তার পরমাণু কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ এবং এটা তার দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুৎচাহিদা মেটানোর জন্য, তবু যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের আশঙ্কা ইরান গোপনে পরমাণু বোমা তৈরির জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। আর এই অনুমানের ভিত্তিতেই ইরানের বিরুদ্ধে এত হুমকি এবং অবরোধ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এই অনুমান এবং আশঙ্কা কতটুকু সত্য? আমরা দেখেছি ইরাকে আগ্রাসনের আগে ইরাকে ব্যাপক গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার বহু অভিযোগ মার্কিনিরা করেছিল এবং সেই অস্ত্র থেকে বিশ্ববাসীকে মুক্তি দেয়ার জন্য ইরাকে হামলা করেছিল এবং ইরাক দখল করেছিল। অথচ ইরাক দখলের পর মার্কিনিরা সারা ইরাক তল্লাশির পরও সেইসব ব্যাপক গণবিধ্বংসী অস্ত্রের সামান্যতমও যখন খুঁজে পায়নি তখন মার্কিনিরাই আবার বলেছে-ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্র ছিল মর্মে তাদের রিপোর্টটি মিথ্যা ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তো তাদের ভুল স্বীকার করে ইরাক থেকে চলে যায়নি, ইরাকে হামলার জন্য ক্ষতিপূরণও দেয়নি বরং ইরাকের সবকিছুকে ধ্বংস করেছে। তাহলে ইরান গোপনে পরমাণু বোমা তৈরি করছে বলে যুক্তরাষ্ট্র যে অভিযোগ করছে তা কতটুকু সত্য? আর ইরান যদি পারমাণবিক বোমা তৈরি করেও থাকে তাহলে সেটা কি অপরাধ? যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স, চীন, ভারত, উত্তর কোরিয়া এবং ইসরাইল যদি বিশাল আকারের পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী হতে পারে, তাহলে ইরান পরমাণু বোমা বানালে তা অপরাধ হবে কেন? এটা তো এসব দেশের মতোই ইরানের গণতান্ত্রিক, ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত অধিকার। যুক্তরাষ্ট্রই সর্বপ্রথম পারমাণবিক বোমা তৈরি করে এবং ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্ট যথাক্রমে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলা চালায়, যাতে তিন লক্ষ মানুষ মারা যায়। এ ছাড়া ইসরাইল অঘোষিতভাবে পারমাণবিক বোমার অধিকারী হয়েছে। নিজেদের শক্তিমত্তা প্রমাণের জন্য এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ১০৩৮ বার, সাবেক সোভিয়েত ৭১৫ বার, ব্রিটেন ৪৫ বার, ফ্রান্স ২১০ বার, চীন ৪৫ বার, ভারত ৬ বার, পাকিস্তান ৫ বার এবং উত্তর কোরিয়া ১ বার পরমাণু বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। এ ছাড়া মজুদকৃত অস্ত্রের সঠিক পরিমাণ অনেক গুণ বেশি। এ অবস্থায় ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি করলে তা দোষণীয় হবে কেন এবং এ নিয়ে এত হইচই কেন? এর প্রকৃত কারণ হচ্ছে পাশ্চাত্যরা কখনই চায় না ইরানসহ কোন মুসলিম দেশই জ্ঞান-বিজ্ঞানে, সামরিক প্রযুক্তিতে দক্ষতা এবং শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করুক। ইরানের মতো একটি ইসলামপন্থী, জাতীয়তাবাদী এবং পাশ্চাত্যবিরোধী মুসলিম দেশের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র থাকুক এটা পশ্চিমা বিশ্ব কল্পনাই করতে পারে না। কারণ এর ফলে পশ্চিমাদের সাম্রাজ্য এবং আধিপত্যবাদের পতন হবে। এ জন্য তারা পাকিস্তানের পরমাণু কর্মসূচির বিরুদ্ধেও অনেক কথা বলেছে। তারা চায় মুসলিম দেশসমূহ চিরদিনই অনুন্নত ও পশ্চাৎপদ থাকুক। এদিকে ইরানের পরমাণু কর্মসূচির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা অত্যন্ত সরব হলেও ইসরাইলের পরমাণু কর্মসূচির ব্যাপারে তারা একেবারেই নীরব। এ ক্ষেত্রে বরং তারা উল্টো এর পৃষ্ঠপোষক। এখানে চলছে পাশ্চাত্যের সম্পূর্ণ ডাবল স্ট্যান্ডার্ড নীতি।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি বন্ধ এবং ইরানকে শায়েস্তা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা বিশ্ব অবিরাম প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। ১৯৭৯ সালে খোমেনির নেতৃত্বে ইরানে ইসলামপন্থীদের ক্ষমতা দখলের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল এবং পশ্চিমাদের সাথে ইরানের বৈরিতা চলছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সামরিক, সব ক্ষেত্রেই এই বৈরিতা। এসব মোকাবেলা করেই কিন্তু ইরান টিকে আছে এবং এগিয়ে গেছে। আয়তন, জনসংখ্যা, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং সামরিক, সব দিক দিয়েই ইরান শক্তিশালী একটি রাষ্ট্র। ইরানের ক্ষমতায় আছে একটি বিপ্লবী সরকার, যাদের পেছনে রয়েছে শক্তিশালী ও স্বতঃস্ফূর্ত জনসমর্থন, যারা ইসলামপন্থী, দেশপ্রেমিক, জাতীয়তাবাদী ও পাশ্চাত্যবিরোধী। ইরানের এই নেতৃত্ব কখনও জাতীয় স্বার্থকে বিসর্জন দেয়নি এবং জাতীয় স্বার্থে আপস করেনি। নিজস্ব স্বকীয়তাকে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে গেছে। তেল, গ্যাসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ ইরানের অর্থনীতিকে বরাবরই শক্তিশালী করেছে। রাজনৈতিকভাবেও তারা অত্যন্ত শক্তিশালী। ইরানের বর্তমান শাসকদের মধ্যে যে দেশপ্রেম, ঐক্য এবং দূরদর্শিতা রয়েছে তা সত্যিই প্রশংসনীয়। আর ঐক্যবদ্ধ জাতি মানেই শক্তি। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলসহ পশ্চিমাদের সাথে ইরানের বিরোধ থাকলেও, বিশ্বের অধিকাংশ শক্তিশালী রাষ্ট্রের সাথেই ইরানের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। ইরান বর্তমানে ন্যামের সভাপতি। বিশ্বের দুই বৃহৎ পরাশক্তি রাশিয়া এবং চীনের সাথে ইরানের রয়েছে দীর্ঘদিনের গভীর রাজনৈতিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক। এটা পশ্চিমাদের আরোপিত অর্থনৈতিক অবরোধ মোকাবেলায় এবং পশ্চিমাদের সাথে দরকষাকষিতে ইরানকে সাহায্য করেছে এবং শক্তি জুগিয়েছে। কিউবা, ভেনিজুয়েলা, উত্তর কোরিয়া, ব্রাজিলসহ অধিকাংশ ল্যাটিন আমেরিকার দেশের সাথেও ইরানের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। অর্থাৎ পশ্চিমা বিরোধী বলয়ের সাথে ইরানের ভালো সম্পর্ক। একইভাবে উদীয়মান পরাশক্তি ভারতের সাথেও রয়েছে ইরানের সখ্য। পাশাপাশি মুসলিমবিশ্বের শক্তিশালী দেশ পাকিস্তান, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, সিরিয়া এবং সুদানের সাথেও ইরানের রয়েছে নিবিড় একটি সম্পর্ক। একইভাবে ইসরাইলের চরম শত্রু ফিলিস্তিনের হামাস এবং লেবাননের হিজবুল্লাহর সাথে ইরানের রয়েছে অন্যরকম সেতুবন্ধ। এসব দেশ সবসময় পশ্চিমাদের মোকাবেলায় ইরানের পাশে থেকেছে, ফলে ইরান দুর্বল না হয়ে বরং শক্তি অর্জন করেছে। এভাবে ইরান বরাবরই পররাষ্ট্রনীতিতে একটি ভারসাম্যতা বজায় রেখেছে, যা তার অবস্থানকে সার্বিকভাবেই শক্তিশালী করেছে।
রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সফলতা অর্জনের পাশাপাশি ইরান প্রযুক্তি এবং সামরিক খাতেও যথেষ্ট দক্ষতা অর্জন করেছে। ইরান তৈরি করছে বিভিন্ন ধরনের পণ্য, গাড়ি এবং মেশিনারি। ইরান নিজস্ব প্রযুক্তিতে সেনাবাহিনীর জন্য তৈরি করেছে কামান, ট্যাংক, রকেট, ড্রোন এবং ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র। বিমানবাহিনীর জন্য তৈরি করেছে অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান এবং আকাশ থেকে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র। নৌবাহিনীর জন্য তৈরি করেছে অত্যন্ত দ্রুতগতির টর্পেডো আর অত্যাধুনিক ফ্রিগেট। স্বাভাবিকভাবেই সামরিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ইরানের সফলতা অনস্বীকার্য। এদিকে বিভিন্ন ধরনের সামরিক অস্ত্র তৈরির পাশাপাশি ইরান মহাকাশ প্রযুক্তিতেও হাত দিয়েছে। ইতোমধ্যেই ইরান তার নিজস্ব প্রযুক্তিতে মহাশূন্যে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠিয়েছে। ইরান তার নিজস্ব প্রযুক্তিতে চালু করেছে হেভি ওয়াটার তৈরির ইন্ডাস্ট্রি, যা প্রযুক্তি ক্ষেত্রে তার উন্নতিরই সাক্ষ্য বহন করে। এভাবে ইরান জ্ঞান, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির বিভিন্ন শাখায় একটি অবস্থান তৈরি করেছে। ইরান নিজেই ঘোষণা দিয়েছে, সে পরমাণু শক্তিধর দেশ। অপর দিকে শেখ সাদী, হাফিজ, রুমি, ফেরদৌসি এবং ওমর খৈয়ামের মতো বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যিকদের সাহিত্যে সমৃদ্ধ ইরানের চলচ্চিত্র আজ বিশ্বজুড়েই সমাদৃত। এভাবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ইরানের ব্যাপক অগ্রগতি ইরানকে সার্বিকভাবে শক্তিশালী করেছে। মোটকথা সর্বক্ষেত্রেই ইরান শক্তি অর্জন করেছে। আর এ শক্তির কারণেই ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল হামলা করেনি। বরং যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব আজ বাধ্য হয়ে ইরানের সাথে সমঝোতায় এসেছে। পশ্চিমাদের সাথে এই সমঝোতা চুক্তির কারণে বিশ্বব্যাপী ইরানের গ্রহণযোগ্যতা আরও বৃদ্ধি পাবে। ফলে রাজনৈতিকভাবে ইরান আরও শক্তিশালী হবে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবার কারণে ইরানের ব্যবসা-বাণিজ্য আরও চাঙ্গা হবে। ফলে ইরানের অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে। তবে এই চুক্তির ফলে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের সাথে ইরানের বৈরিতা কমে এলেও ইরানের অবস্থান আগের মতোই থাকবে। কারণ ইরানী নেতৃত্ব কখনই নিজেদের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, স্বকীয়তা, নিজস্ব সংস্কৃতি এবং জাতীয় স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে পশ্চিমাদের সাথে সম্পর্ক করবে না। সুতরাং এ চুক্তির ফলে ইরান সবদিকে লাভবান।
ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রসহ ছয় বিশ্বশক্তির সমঝোতা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। তা হলো একটি দেশ বা জাতি যদি ঐক্যবদ্ধ থাকে, লক্ষ্যপানে অটুট থাকে, বুদ্ধিমত্তা এবং কৌশলের সাথে পথ চলে, জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা করে, আবিষ্কারের নেশায় নীরবে কাজ করে, নিজস্ব সংস্কৃতির ওপর অবিচল থাকে আর জাতীয় স্বার্থ এবং স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রতি আপস না করে তাহলে সময়ের পরিক্রমায় উন্নয়ন, সমৃদ্ধি এবং শক্তি সবই অর্জিত হবে। সেই জাতি পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবেই। তখন সবাই সেই দেশ এবং জাতিকে সমীহ করে। ইরানের বেলায় আজ সেটিই প্রযোজ্য। যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রতিপক্ষ রাশিয়া এবং চীনের সাথে ইরানের সম্পর্ক ইরানকে বিশ্বরাজনীতির মঞ্চে দৃঢ় অবস্থান দিয়েছে। এ ছাড়া ভারত, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া, ভেনিজুয়েলা এবং ব্রাজিলের মতো দেশের সাথে সম্পর্ক ইরানকে দিয়েছে মজবুত একটি অবস্থান। ইরানের এই সামগ্রিক শক্তির কারণেই যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ^ আজ নত হয়েছে এবং ইরানের সাথে সমঝোতা করতে বাধ্য হয়েছে। ইরান যদি আজ দুর্বল হতো, তাহলে ইরানের অবস্থাও আজ ইরাক, আফগানিস্তান ও লিবিয়ার মতোই হতো। ভারতীয় বিএসএফ বাংলাদেশী সীমান্তে যতটা আগ্রাসী, চীন এবং পাকিস্তানের সীমান্তে ততটাই নমনীয়। কারণ চীন এবং পাকিস্তান শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। আর দুর্বল হলে আক্রমণ করে, সবল হলে সমীহ করে। ইসরাইলি সেনাবাহিনী প্রতিদিনই ফিলিস্তিনিদেরকে নির্যাতন করে। একইভাবে মিয়ানমারের লোকজন প্রতিনিয়তই রোহিঙ্গাদেরকে অত্যাচার করে। কারণ ফিলিস্তিনি এবং রোহিঙ্গাদের কোনো শক্তি নেই। সুতরাং শক্তিই যে শান্তি ও নিরাপত্তার গ্যারান্টি তা আবারও প্রমাণিত হলো। বাঘ, সিংহ এবং হাতির শক্তিই বনে তাদের নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করেছে। একইভাবে যে বাড়িতে কুকুর থাকে, সে বাড়িতে কিন্তু শিয়াল প্রবেশ করে না। সুতরাং পৃথিবীর বুকে আত্মমর্যাদা নিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচার জন্য সবারই উচিত শক্তি অর্জন করা। কারণ এই শক্তিই একটি জাতি এবং একটি দেশের শান্তি, নিরাপত্তা, উন্নয়ন, স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বসহ সবকিছুই নিশ্চিত করে।
লেখক : প্রকৌশলী ও কলামিস্ট
আপনার মন্তব্য লিখুন