প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম (১৯২০-১৯৯১) মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের মহান তাত্ত্বিক ও প্রধান সংগঠক। তিনি ছিলেন বহুমাত্রিক জ্ঞান সাধনার এক অনন্য সাধারণ বিরল ব্যক্তিত্ব। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে ‘পাকিস্তান তমদ্দুন মজলিসের’ মাধ্যমে। ১৯৪৭ সালের ১লা সেপ্টেম্বর প্রিন্সিপাল আবুল কাশেমের উদ্যোগে এবং নেতৃত্বে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপক ও ছাত্রের সহযোগিতার ভাষা আন্দোলনের এ ‘জনক সংগঠন’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম তখন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি একাধারে বুদ্ধিজীবী, প্রবন্ধকার, গবেষক, প্রাজ্ঞ অধ্যাপক, সমালোচক, গ্রন্থকার, সমাজসেবক, বিজ্ঞানী, পণ্ডিত, অতুলনীয় বাগ্মী, ভাষা সেনাপতি বাংলাদেশবাসীর নিজস্ব সাহিত্য, তমদ্দুন ও আদর্শিক সংগ্রামে আপসহীন অগ্রনায়ক এক সুমহান ব্যক্তিত্ব।
অসাধারণ সাংগাঠনিক প্রতিভা ও বুদ্ধিমত্তার অধিকারী এ মহান বুদ্ধিজীবী ছিলেন বাংলাদেশ ও বাংলাদেশী জাতির এক কালজয়ী সম্পদ। তাঁর সব পরিচয়ের পাশাপাশি আন্দোলন পরিচালনা করে তিনি যে বিষয়টিতে মহিমান্বিত হয়েছেন তা হচ্ছে সর্বপ্রথম ভাষা আন্দোলনের সূচনা করা। তাঁর প্রতিষ্ঠিত তমদ্দুন মজলিস পাকিস্তানি শাসকদের উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার বিরোধিতা করে। প্রিন্সিপাল আবুল কাশেমের নেতৃত্বে এ সংগঠন বাংলাকে উর্দুর সাথে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে প্রথম ভাষা আন্দোলনের সূচনা করেন। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন ধারাবাহিক সংগ্রামী কর্মসূচির মাধ্যমে গণমানুষের মধ্যে ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি করে ১১ মার্চ ১৯৪৮ দেশব্যাপী হরতাল, প্রতিবাদ, সভা-বিক্ষোভ প্রদর্শনসহ সকল কর্মসূচি সারাদেশে ছড়িয়ে দিয়ে প্রথম বিজয় ছিনিয়ে আনেন এবং পূর্ব বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিনকে তাদের সাথে ৮ দফা চুক্তি করতে বাধ্য করেন ১৫ মার্চ ১৯৪৮ সালে এই জন্য তমদ্দুন মজলিশকে ভাষা আন্দোলনের জনক সংগঠন এবং প্রিন্সিপাল আবুল কাশেমকে ভাষা আন্দোলনের জনক ও স্থপতি বলা হয়।
ভাষা আন্দোলনের জনক প্রবাদপুরুষ এ মহান ব্যক্তিত্বের জন্ম ২৮ শে জুন সোমবার ১৯২০ সন। জন্মস্থান ছেবন্দী, বরসা, চন্দনাইন, চট্টগ্রাম, পিতা মতিয়র রহমান। ১৯৩৯ সালে ৩টি বিষয়ে লেটারসহ মেট্রিকুলেশন, ১৯৪১ সালে প্রথম বিভাগে আইএসসি, ১৯৮৮ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় প্রথম স্থান লাভ করে বিএসসি (অনার্স) এবং ১৯৪৮ সালে একই বিষয়ে কৃতিত্বের সাথে এমএসসি পাস করেন। ১৯৮৬ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে লেকচারার হিসেবে যোগদান করে বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে অধ্যাপনা শুরু করেন। দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে (১৯৪৬-৫৫), চট্টগ্রাম সিটি নাইট কলেজে (১৯৫৪-৫৫), বাংলা কলেজের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল ১৯৬২-৮১। এ ছাড়া তিনি ছিলেন বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য, বাংলা একডেমির কাউন্সিলর (১৯৫৪-৬৪), ঢাকা আর্ট কলেজ ও ঢাকা সিটি কলেজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, সাপ্তাহিক সৈনিকের প্রতিষ্ঠাতা, খেলাফতে রাব্বানী পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ১৯৫২, যুক্তফ্রন্টের পক্ষ থেকে পূর্ববাংলা প্রাদেশিক আইন সভার সদস্য ১৯৫৪-৫৮, পাকিস্তান রাইটার্স গিল্ডের কার্যকরী কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম সমিতির সেক্রেটারি জেনারেল (১৯৪৭-৪৯) ছিলেন। অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী মহীয়সী নারী রাহেলা খাতুন তাঁর সহধর্মিণী ছিলেন।
প্রিন্সিপাল আবুল কাশেমের বিচরণক্ষেত্র বাংলাভাষা ও সাহিত্য, সমালোচনা সাহিত্য, ভাষা সংস্কার। অর্থনীতি, রাষ্ট্রনীতি, গবেষণা, বিজ্ঞান। পাঠ্যপুস্তক, গদ্য রচনা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সুবিস্তৃত। এ প্রক্রিমায় তিনি অনন্য সাধারণ, কোন কোন ক্ষেত্রে তিনি পথপ্রদর্শক, কখনওবা গভীর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ও প্রতিভাদীপ্ত উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী। তাঁর রচিত ও সম্পাদিত পুস্তিকা ও গ্রন্থের সংখ্যা ৭৫। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তাঁর কয়েকটি গ্রন্থ হলো- পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু (১৯৪৭), ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস (১৯৫২), আমাদের ভাষার স্বরূপ (১৯৬২), বাংলা প্রচলনের কয়েকটি সমস্যা (১৯৬৭), কোরানিক অর্থনীতি (১৯৭১), ইসলাম কী দিয়েছে কী দিতে পারে (১৯৫২), ইসলামের রাষ্ট্রীয় আদর্শ (১৯৮০), ঈর্ষা বনাম সাধনা (১৯৬৫), আধুনিক চিন্তাধারা (১৯৬৪), বিজ্ঞান বস্তুবাদ ও আল্লাহর অস্তিত্ব (১৯৬৯), বিবর্তনবাদ সৃষ্টিতত্ত্ব ও আল্লাহর অস্তিত্ব (১৯৭৬), বিজ্ঞান ধর্ম (১৯৮২), ইসলামী রাষ্ট্রনীতি (১৯৬৭), রাষ্ট্রবিজ্ঞান (১৯৬৪) শাসনতান্ত্রিক মূলনীতি (১৯৫৩), ৩৫টি বিজ্ঞানবিষয়ক পাঠ্যবই। তাঁর অসংখ্য প্রবন্ধ বিভিন্ন সেমিনার সঙ্কলনও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। ভাষা আন্দোলন এবং শিক্ষা আন্দোলনে অনন্য সাধারণ অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার ১৯৮২, একুশে পদক ১১৯৮৭, ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরস্কার ১৯৮৮, চট্টগ্রাম সমিতি পদক ১৯৮৮, রাইটার্স গিল্ড পুরস্কার ১৯৬৪, বাংলা কলেজছাত্র মজলিশ স্বর্ণপদক ১৯৬৪ লাভ করেন।
বাংলাদেশবাসীর আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক বুনিয়াদ সম্বন্ধে তাঁর ধারণা ছিলেন স্বচ্ছ, তাই সে ভিত্তির উপর যেকোন আঘাত, যেকোন হামলার মোকাবিলার জন্য তিনি ছিলেন প্রতি মুহূর্তে প্রস্তুত। এই দেশের ভৌগোলিক সীমারেখার মধ্যে এই দেশবাসীর বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বের ভিত্তি ইসলামের মৌল নীতিমালা তথা ইসলামের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি। তাই এই জীবনদৃষ্টি ও জীবনাদর্শের ওপর সম্ভাব্য সকল হামলার প্রতিরোধের জন্য তিনি কলম ধরেন। তিনি পদার্থবিজ্ঞানী। মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করলেন আল্লাহর অস্তিত্ব, শ্রেণীসংগ্রাম ও বিবর্তনবাদের ওপর। ইসলামী সমাজ রাষ্ট্রব্যবস্থা ও অবর্ণনীয়তার ওপর গ্রন্থ রচনা করেন। পুঁজিবাদ নয়, কমিউনিজম নয়, কুরআনিক অর্থনীতি মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান দিতে পারে এ প্রত্যয় সৃষ্টির জন্য তিনি লিখেন গবেষণামূলক গ্রন্থ। পুঁজিবাদী ও সামাজিক সা¤্রাজ্যবাদী বিশে^র বাইরে তাওহিদে বিশ্বাসী দেশগুলোকে নিয়ে তৃতীয় ব্লক গঠনের ডাক দেন তিনি। তমদ্দুন মজলিস যেমন সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ও স্বকীয় সাহিত্য-সংস্কৃতিকে লালন-পোষণের আন্দোলনের উদগাতা তেমনি আদর্শিক ক্ষেত্রে এদেশে ইসলামী আন্দোলনরত সূত্রপাতকারী। ইসলামের সুমহান আদর্শে খেলাফতে রাব্বানী পার্টি, ছাত্রশক্তি, একশোর মজলিশ গঠনে প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেন। জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাংলাভাষার উপযোগিতা প্রমাণের জন্য এক চ্যালেঞ্জ হিসেবেই তিনি মিরপুর বাঙলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। লিখেন বিজ্ঞানের ওপর অর্ধশতাধিক পাঠ্যপুস্তক বাংলা ভাষায়। বাংলাভাষার মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনাসহ জীবনের সকল কাজই যে করা যায় তারই সংশয়াতীত দৃষ্টান্ত স্থাপনই উদ্দেশ্য ছিল। সন্দেহবাদীদের সন্দেহ ভক্তদের জন্যই তিনি তাঁর একার মাথায় তুলে নিয়েছিলেন এই গুরুভার বোঝা। নিজেকে তিলে তিলে বিলিয়ে দিয়ে তিনি নির্মাণ করেছেন প্রত্যয়ের আত্মবিশ^াসের ভিত।
প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম আজ তার আমাদের মাঝে নেই। ১৯৯১ সালের ১১ মার্চ এ মহান কর্মবীর তার মহান প্রভুর সান্নিধ্যে চলে গেছেন। তাঁর বিরল জীবনের কর্মতৎপরতা আজ ফুলে ফলে সুশোভিত। মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা আজ বিশ^ব্যাপী স্বীকৃত হয়েছে। বাংলাভাষার জাতীয় মর্যাদার পরিপূর্ণ স্বীকৃতি লাভ সম্ভবপর হয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে। এদেশের শিক্ষার মাধ্যম বাংলা, সকল বিশ^বিদ্যালয়ই এখন বাংলা বিশ^বিদ্যালয় এই অর্থে যে বাংলার মাধ্যমেই এ দেশের সকল কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয়ে এখন শিক্ষাদান করা হচ্ছে। অগণিত লেখক লিখছেন বাংলাভাষায় কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক। ইসলামী জীবনাদর্শের আলোকে সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বাধিক পুনর্গঠনের জন্য সৃষ্টি হয়েছে দেশব্যাপী ব্যাপক ও গভীর সচেতনতা, লেখা হচ্ছে অজ¯্র পুস্তক-পুস্তিকা গ্রন্থাবলি। সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক ভিত্তি বিনির্মাণের জন্য এখন আর মাল-মসলা এবং উপায়-উপাদান উপকরণের অভাব নেই। প্রিন্সিপাল আবুল কাশেমের প্রতিভাদীপ্ত বিরল জীবন মূল্যায়ন করতে হলে এ পরিপ্রেক্ষিত ও অগ্রগতি অবশ্যই সামনে রাখতে হবে। বাংলাদেশে মাতৃভাষা বাংলা ও ইসলামী জাগরণের আজকের এই অবস্থা থেকে পেছনের দিকে তাকালে দেখা যাবে, এদেশে এসবের সূচনাপটে, প্রস্তুতিপটে অনবদ্য ভূমিকায় দাঁড়িয়ে আছেন একজন অসাধারণ মানুষ। আর তিনি হচ্ছেন প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম। লেখক : কলামিস্ট-ইতিহাসবিদ
আপনার মন্তব্য লিখুন