রাজনীতি জনগণের জন্য। তাই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণ তাদের পছন্দের নেতা নির্বাচনের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে নেয়। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নামে ফ্যাসিবাদী নীতিপদ্ধতি জনগণের ওপর চাপিয়ে দিলেই সময়ের পরিক্রমায় বিপত্তি বাধে। যেমন ’৬৯ এর নির্বাচনের জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ রায় মরহুম শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে দেয়ার পরেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী মেনে নেয়নি। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ এ স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। যদিওবা এই স্বাধীনতা অর্জনের লড়াইয়ের যোগসূত্রিতা অনেক আগের, যা ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে শুরু হয়েছিল।
দেশের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার বয়স ৫০ বছর। ৫০ বছর পূর্বে পূর্ববাংলার জনগণ বলেছিল আমরা শোষণ ও বঞ্চনা থেকে বাঁচতে চাই। আর ৫০ বছর পরে এসে আমরা এখনো একই কথা বলছি। আমরা বলছি আমার ভোটের অধিকার নেই, নেই ভাতের অধিকার। জান-মালের নিরাপত্তা নাই, নাই স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি। যেখানে গুম-খুন মামুলি ব্যাপার। আমার সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার নাই। দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে বলছি কিন্তু এখনো দেশে কোটি কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমানার নিচে।
যে দলটি পাকিস্তানি শোষণের বিরুদ্ধে কথা বলেছিল, সেই দলের হাতে মানুষ নিষ্পেষিত! সেই দলটি ক্ষমতার অব্যবহার করে নিজেদের খয়েরখাঁ নির্বাচন কমিশন বসিয়ে নির্বাচনের আগের দিন ভোট বাক্স ভর্তি করে নির্বাচন ব্যবস্থার কবর রচনা করেছে। সেই চুরির নির্বাচনে ভুয়া জনপ্রতিনিধি হয়ে জনগণের সামনে দরাজকণ্ঠে বলা হচ্ছে আমরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত! আমরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনাকে সমুন্নত করছি! এদের নির্জলা মিথ্যার বেসাতি দেখে শয়তানও মুচকি হাসে! একটি দেশের জনগণের জন্য এমন অবস্থা কত হতাশার ও কষ্টের তা বলে-কয়ে শেষ করা যাবে না। সে যাই হোক প্রকৃত সত্য হলো দেশের মানুষ জুলুম নির্যাতনের কারণে নীরব থাকলেও তারা আওয়ামী লীগের চরিত্রকে স্বাধীনতা-পূর্ব পশ্চিম পাকিস্তানিদের মতই দেখে। এমন অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে দেশের মানুষ মুখিয়ে আছে।
দেশে এখন কার্যত একদলীয় রাজনীতি চলছে। বিরোধী মতের রাজনৈতিক অফিস, কর্মকাণ্ড বন্ধ। সংবিধান বা কাগজে কলমে রাজনীতি সবার জন্য উন্মুুক্ত থাকলেও এক নেতার একদেশ চলছে। মিডিয়াগুলো সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে কোনো সংবাদ প্রচারের জো নাই। দেশের মানুষের জীবন-মান অবস্থার মান অবনতি হচ্ছে। যদিওবা সরকারের এমপি, মন্ত্রী ও দলীয় নেতারা দেশ উন্নয়নের মহাসড়কে দাবি করে মাথাপিছু আয় বেড়েছে বলে বুলি আওড়াচ্ছে। কিন্তু বস্তবতা তার উল্টো।
নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী ক্রয়ক্ষমতার বাইরে, সাধারণ জনগণ প্রতিদিনের খাদ্যসামগ্রী কিনতেই প্রাণ যেন ওষ্ঠাগত। রাজধানীসহ সারা দেশে ৮-১০ বছর আগেও টিসিবির পণ্য কিনতে ১০-১৫ জনের বেশি লোক দেখা যেতো না। আর এখন সর্বত্র টিসিবির পণ্য কিনতে শত শত লোক দীর্ঘলাইন ধরছে। এ পরিস্থিতিতে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির দৌড়ে সাধারণ ও মধ্যবিত্ত জনজীবন অতিষ্ঠ। এসব কিসের আলামত? এরই মধ্যে আবার জ্বালানি এলপি গ্যাস, করোনার দোহাই দিয়ে গণপরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধি ও নতুন করে পানির দাম বৃদ্ধির প্রক্রিয়া চলছে। এ যেন দেশের জনগণকে ভাতে মারার চক্রান্ত চলছে...। আওয়ামী লীগের দলীয় নেতা ও সরকারি আমলারা সমস্বরে বলছেন, দেশে গণতন্ত্রের প্রয়োজন নাই; উন্নয়ন হলেই চলবে! উন্নয়নের নমুনা হিসাবে দৃশ্যমান মেট্রোরেল ও উড়াল সেতুগুলোকে জনগণের সামনে বারবার উপস্থাপন করছে। অথচ সেই পদ্মা সেতু থেকে শুরু করে প্রতিটি প্রকল্পের বাজেট নির্ধারিত বাজেটের চাইতে ৮-১০ গুণ বৃদ্ধি করেছে। অনেকে বলে থাকেন আওয়ামী লীগ উন্নয়ন তকমা দিয়ে তাদের আখের গোছাতেই এসব প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এটি বাহ্যিক উন্নয়নের নামে জনগণের সাথে বড় ধরনের ধোঁকা, যা বুঝতে কারো আর বাকি নাই। প্রশাসনের কিছু আমলা যেন এখন বড় আওয়ামী লীগ নেতার ভূমিকায়! এরা আওয়ামী নেতা-কর্মীদের চাইতে বড় আওয়ামী লীগ।
চট্টগ্রামের রাউজান থানার ইউপি ইলেকশনের খবর বেশ কয়েকটি জাতীয় পত্রিকা ফলাও করে ছাপিয়েছে। পত্রিকাসমূহের তথ্যমতে সেখানে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ছাড়া ভিন্ন কোনো প্রার্থী (অন্য কোন দলের বা স্বতন্ত্র) নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। যে কারণে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তারা নির্বাচিত হয়েছেন! এহেন ঘটনা ঘটেছে সারা দেশের শত শত ইউনিয়নে। এতে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছেন। তারা বলছেন আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা এত উঁচুঙ্গশীর্ষ যে তাদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো জনপ্রিয় প্রার্থী নাই। অথচ আসল ব্যাপার হলো আওয়ামী প্রার্থী তার বিরোধী মতের প্রতিদ্বন্দ্বীকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে বাধ্য করেছে। এমনকি দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থীকেও তারা হত্যাও করেছে।
আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের নানা প্রক্রিয়া চলছে। এই প্রক্রিয়ায় প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের সকল মতামতকে উপেক্ষা করে ক্যাঙ্গারো মার্কা বিরোধী দলের মতামতের ভিত্তিতে আওয়ামী সুবিধামাফিক নির্বাচন কমিশন গঠনের তোড়জোড় প্রক্রিয়া চলছে, যা আরেকটি পাতানো রাতের ইলেকশনের আয়োজনে চলছে তা হলফ করে বলা যায়। প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে বিরোধী মতকে দমনের সমস্ত চেষ্টা ইতোমধ্যে শুরু করেছে। করোনার নাম দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। এই প্রক্রিয়া আরো দীর্ঘতর হবে, যা করোনাকালীন পৃথিবীতে বিরল ঘটনা।
সরকারের এহেন অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক অবস্থার প্রেক্ষিতে পশ্চিমা বিশ্বের কয়েকটি দেশ সরকারের প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনসহ বেশ কয়টি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে আপত্তিকর প্রশ্ন তুলেছে ও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। যা দেশের জন্য অশনিসঙ্কেত! তাতেও সরকারের উচ্চমহলে কোনো ধরনের বিকার নাই। ভাবখানা ঠিক যেন এমন দেশ যদি রসাতলেও যায় তাতে কী?
দেশের রাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করে এই কথা বলতে দ্বিধা নেই যে, আওয়ামী লীগ দেশ ও বহিঃবিশ্বের সকল মতামতকে উপক্ষা করে যেকোনো মূল্যে আগামী নির্বাচন হাজার হাজার জনগণের জীবনের বিনিময়ে হলেও ক্ষমতায় আসতে চাইবে। নতুন বিরোধী দলের উত্থান হবে। দেশেবিরোধী দলসমূহের যে দৈন্যদশা তারা যদি ঐক্যবদ্ধভাবে জনগণকে সাথে নিয়ে এই সরকারের পতন নিশ্চিত করতে না পারে তাহলে আগামীতে আর বিরোধী দল বলতে আর কিছু থাকবে না। বিশেষ করে বিএনপির অস্তিত্ব ও জনসমর্থন একেবারে দুর্বল হবে। তার চেয়ে বড় বিষয় হলো দেশ সামগ্রিকভাবে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হবে। এতে দেশের নাগরিকজীবন চরমভাবে বিপন্ন হবে। আর সময়ের ব্যবধানে আওয়ামী লীগের পতন হবে, ন্যক্কারজনকভাবে। আর তা হবে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ গোলোযোগেই। লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট
আপনার মন্তব্য লিখুন