বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস
মতিউর রহমান আকন্দ
১২ ডিসেম্বর ২০১৬
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক
প্রথম গোলটেবিল বৈঠক ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস বর্জন করেছিল। অপর দিকে মি. গান্ধী লবণ আইন অমান্য আন্দোলন শুরু করেন। কংগ্রেসের এ আন্দোলন ছিল এককভাবে নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য। আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়ে ছাত্ররা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস বর্জন করে। শ্রমিকরা ধর্মঘটের ডাক দেয়। সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন। সেই সাথে সন্ত্রাসবাদী তৎপরতাও বৃদ্ধি পায়। বাংলার চট্টগ্রামে মাস্টারদা সূর্যসেন এবং প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নেতৃত্বে ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল অস্ত্রাগার লুণ্ঠন হয়। উল্লেখ্য, ১৯৩২ সালে প্রীতিলতা মৃত্যুবরণ করেন এবং ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি সূর্যসেন ও তারেকেশ্বয়ের ফাঁসি হয়।
সরকার আন্দোলনকারীদেরকে কঠোর হস্তে দমন করার চেষ্টা করেন। সরকারের সাথে একটি আপস নিষ্পত্তিতে উপনীত হওয়ার জন্য স্যার তেজবাহাদুর সাপ্রু, ভুপালের নবাব হামীদুল্লাহ্ খান, শ্রীনিবাস শাস্ত্রী এবং শ্রী জয়াকর প্রমুখ নেতৃবৃন্দ মি. গান্ধীর সাথে আলোচনায় মিলিত হন। আলোচনায় একটি আপসের ক্ষেত্র তৈরি হয়। বড়লাটের সাথে গান্ধীজির সরাসরি আলাপ আলোচনার পর কংগ্রেস দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করতে সম্মত হয়।
১৯৩১ সালের আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিতব্য গোলটেবিল বৈঠকে কংগ্রেসের একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে মি. গান্ধী লন্ডন যাত্রা করেন। কংগ্রেস দীর্ঘ আলোচনার পর স্থির করে যে, আর কোন প্রতিনিধি পাঠানোর প্রয়োজন নেই। কংগ্রেসের পক্ষে দাবির অপরিহার্যতা এবং মূল নীতির ভিত্তিতে আপস সম্ভব হলে কিংবা ব্রিটিশ সরকারকে তা স্বীকার করাতে চেষ্টা করতে সক্ষম হলে কংগ্রেসের কার্যকরী সমিতির সব সদস্যকে মি. গান্ধী লন্ডনে আহ্বান করবেন। মূল বিষয় আপস না হলে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন নেই এবং অধিকসংখ্যক প্রতিনিধি পাঠানোরও দরকার নেই। লন্ডনে পৌঁছে তিনি জানতে পারেন যে সরকার মুসলমানদের ন্যায় তফ্শিলি সম্প্রদায়কেও একটা স্বতন্ত্র সম্প্রদায় হিসাবে গণ্য করতে বদ্ধপরিকর। গান্ধী তা মেনে নিতে রাজি ছিলেন না এবং তিনি তার প্রতিবাদে ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন। কংগ্রেসের চাহিদা মত কাজ করার অভিপ্রায় ব্রিটিশ সরকারের ছিল না। কংগ্রেসের প্রতিনিধি হিসেবে মি. গান্ধী গোলটেবিল বৈঠক ত্যাগ করলেও বৈঠক থেমে থাকেনি। এ বৈঠককে কংগ্রেস নেতিবাচকভাবে তুলে ধরতো।
পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু তার ‘টুওয়ার্ড ফ্রিডম’ বইয়ে ব্রিটিশ ভারতীয় প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বদানকারী আগা খানকে যোগ্য হিসেবে উল্লেখ করলেও তাকে ভারতের স্বার্থ অর্জনে যথাযথ প্রতিনিধি হিসেবে মেনে নিতে পারেননি। বইয়ের ২১৯ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন:
“কায়েমি স্বার্থবাদীদের এই বৈঠকে, যেখানে সা¤্রাজ্যবাদী, সামন্ততন্ত্রী মূলধনী বণিক, ধার্মিক, সাম্প্রদায়িকতাবাদী সকল শ্রেণীর সমাবেশ, সেখানে ব্রিটিশ ভারতীয় প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব আগা খাঁর ন্যায় যোগ্যপাত্রেই অর্পিত হইয়াছিল; কেননা তাতে একাধারে কমবেশি ও সকল বিভিন্ন স্বার্থের সমাবেশ আছে। আজীবন তিনি ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদ ও ব্রিটিশ শাসকশ্রেণীর সহিত ঘনিষ্ঠভাবে মিশিয়াছেন। তিনি অধিকাংশ কাল ইংল্যান্ডেই বাস করেন, কাজেই আমাদের শাসকগণের স্বার্থ ও মত তিনি ভালোভাবেই ব্যক্ত করিতে পারেন। গোলটেবিল বৈঠকে তিনি সা¤্রাজ্যবাদী ইংল্যান্ডের একজন যোগ্য প্রতিনিধি হইতে পারিতেন, কিন্তু অদৃষ্টের এমনি নিষ্ঠুর পরিহাস যে, তিনিই যেন ভারতের যথার্থ প্রতিনিধি।”
দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক চলে ১৯৩১ সালের ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এ বৈঠকে জিন্নাহ্ ও অন্যদের সাথে আল্লামা ইকবালও যোগ দেন। দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠকে মৌলিক ও প্রধান বিষয় ছিল সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধান। বৈঠকে যোগ দেয়ার আগে মি. জিন্নাহ্ বোম্বাই গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘মুসলমানরা যদি সংগঠিত না হয় তাহলে তাদের মুক্তি নেই।’ বৈঠকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রামজে ম্যাকডোনাল্ড সভাপতিত্ব করেন। শুরুতেই তিনি বলেন, ‘যদি ভারতীয় প্রতিনিধিগণ সংখ্যালঘু সমস্যা সমাধানে অক্ষম হন, তাহলে সকলে সম্মত হলে তিনি এর সালিশি করবেন।’ সবাই সম্মত হন। ভারতীয়দের প্রধান দু’টি পক্ষ হিন্দু ও মুসলমানদের পক্ষে আপসরফা সম্ভব হয়নি। অন্যান্য সংখ্যালঘিষ্ঠ দলসমূহের প্রতিনিধি ও মুসলিম প্রতিনিধিগণ একটি ঐকমত্যে পৌঁছান। তারা স্বতন্ত্র নির্বাচন সমর্থন করেন এবং দাবি করেন তারা ব্রিটিশ ভারতের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৪৬ ভাগ।
কোন ভালো ফল ছাড়াই নিছক আলাপ আলোচনা ও তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক শেষ হয়। দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার পর গান্ধী একটা নতুন প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, ‘হিন্দু মুসলিম সমঝোতার প্রশ্নটি মুলতবি রাখা হোক ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হোক।’ মি. জিন্নাহ এ প্রস্তাবের জবাবে বলেন, আমাদের সামনে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান হওয়া।
গোলটেবিলে গান্ধী কংগ্রেস ও তাদের স্বার্থ আদায়ে ব্যর্থ হন। এ পর্যায়ে আবার তিনি আইন অমান্য আন্দোলনে ফিরে যান। ১৯৩২ সালের ৪ জানুয়ারি গান্ধী ও কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের গ্রেফতার করা হয়। ফলে আন্দোলন আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে পড়ে।
দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক শেষে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রামজে ম্যাকডোনাল্ড বলেন, ‘যেহেতু ভারতীয় প্রতিনিধিগণ নিজেদের মধ্যে একমত হতে পারেননি, সেহেতু ব্রিটিশ সরকার যথাসম্ভব ন্যায়পরায়ণতার সাথে প্রয়োজনীয় রক্ষাকবচসহ সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধান করবে।’ ঘোষণা অনুযায়ী ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে একটা সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ ঘোষণা করা হয়। এ রোয়েদাদে পৃথক নির্বাচন মেনে নেয়া হয়।
তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠক
তৃতীয় গোলটেবিল বৈঠক শুরু হয় ১৯৩২ সালের ১৭ নভেম্বর। চলে ৩৮ দিন। বৈঠকে জিন্নাহকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। কংগ্রেসও যোগ দেয়নি। এ বৈঠককে বলা হয় ‘জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটি’র বৈঠক। বৈঠকে স্বতন্ত্র সিন্ধু প্রদেশ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। স্যার স্যামুয়েল ঘোষণা করেন, ‘ভারতের প্রস্তাবিত আইন সভায় মুসলিমদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষিত থাকবে।’
বিভিন্ন আইন সভায় মুসলমানদের আসনসংখ্যা ও নির্বাচন প্রথা নিয়ে হিন্দু সদস্যগণ তাদের চিরাচরিত বৈরী ভূমিকা পালন করে। ১৯২৮ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সম্মেলনে হিন্দুগণ যে আপসহীন মনোভাব ব্যক্ত করে সম্মেলনকে ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন, গোলটেবিল বৈঠককে অনুরূপভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত করার চেষ্টা তাঁরা করছিলেন। কিন্তু আগা খানের সুযোগ্য নেতৃত্বে মুসলমান নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে মি. মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ এমন যোগ্যতা ও যুক্তিতর্কের মাধ্যমে তাদের ন্যায্য দাবি-দাওয়াগুলি পেশ করেছিলেন যে তার অধিকাংশই ব্রিটিশ সরকার মেনে নিতে রাজি হন।
আগা খান ও মি. মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ব্যতীতও স্যার মুহাম্মদ শফি, স্যার আবদুল হালিম গজনভী, স্যার আকবর হায়দারী প্রমুখ নেতৃবৃন্দের ভূমিকাও ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। যুক্তিতর্কে হার মেনে নিয়ে পন্ডিত মদনমোহন মালব্য, ডা: মুঞ্জে, শ্রী জয়াকর প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অন্যান্য হিন্দু সদস্যগণের সাথে পরামর্শক্রমে আইনসভায় মুসলমানদের আসন বণ্টন ও নির্বাচন প্রথা মীমাংসার ভার অর্পণ করেন তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র্যামজে ম্যাকডোনাল্ডের ওপর।
ম্যাকডোনাল্ড অতীতে হিন্দুপ্রীতির পরিচয় দিয়েছিলেন এবং কংগ্রেসের দৃঢ় সমর্থক ছিলেন বলে তার ওপর হিন্দুদের গভীর আস্থা ছিল। কিন্তু তিনি যে সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ (Communal Award) ঘোষণা করেন তাতে বিভিন্ন আইনসভায় মুসলমান ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের জন্য আসনসংখ্যা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। পৃথক নির্বাচন প্রথাকেও স্বীকৃতি দেয়া হয়। শুধু আসনসংখ্যায় কিছু রদবদল করে উভয়ের গ্রহণযোগ্য করার চেষ্টা করা হয়।
ম্যাকডোনাল্ডের ঘোষণায় হিন্দুগণ বিস্ময় বিমূঢ় হয়ে পড়েন। কারণ তারা কখনো এরূপ আশা করেননি। বিশেষ করে তফশিলি সম্প্রদায়ভুক্ত হিন্দুদের জন্যও পৃথক নির্বাচনের প্রস্তাবে তাঁরা খুব মর্মাহত হয়ে পড়েন। মি. গান্ধী তখন জারবেদা জেলে কারাজীবন যাপন করছিলেন। তিনি পৃথক নির্বাচনের প্রতিবাদে আমরণ অনশন ধর্মঘটের কথা ঘোষণা করেন।
ভারত শাসন আইন
তিনটি গোলটেবিল আলোচনার ফল হিসেবে ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৩ সালে ভারতের শাসনতন্ত্রের ওপর একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করেন। শ্বেতপত্রে ভারতে একটি ফেডারেল বা যুক্তরাষ্ট্র গঠন করার কথা বলা হয়। দুই কক্ষবিশিষ্ট ফেডারেল আইন সভায় থাকবে রাজ্যসভা (উচ্চতর সভা) ও আইনসভা (নিম্নতর সভা)। রাজ্যসভার মেয়াদ হবে ৭ বছর। আইনসভার মেয়াদ হবে ৫ বছর। মুসলিম লীগ সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ ও শ্বেতপত্র দু’টোকেই গ্রহণ করেন। কংগ্রেস শ্বেতপত্র প্রত্যাখ্যান করে। এর দ্বারা সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদকেও প্রত্যাখ্যান করে।
১৯৩৪ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে কংগ্রেস অংশগ্রহণ করে। এ নির্বাচনে কংগ্রেস মোট ৫৫টি আসন পায়। সরকার পক্ষ ৫০টি এবং জিন্নাহ্র নেতৃত্বে লীগ ২২টি আসন পায়। জিন্নাহর নেতৃত্বাধীন ২২টি ভোট যেদিকে যাবে তারাই জয়ী হবে। পার্লামেন্টের অধিবেশন বসলো ১৯৩৫ সালে। শ্বেতপত্রের ভিত্তিতে একটি রিপোর্ট ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পেশ করা হয়। রিপোর্টের সমালোচনা করে কংগ্রেস পাল্টা প্রস্তাব পেশ করেন। মি. জিন্নাহ ফেডারেল পরিকল্পনা এবং প্রাদেশিক সরকার পরিকল্পনা বিষয়ে বক্তব্যে তার মতামত তুলে ধরেন। বিতর্ক শেষে সংশোধনী প্রস্তাবগুলো ভোটে দেয়া হয়। ভোটে জিন্নাহ উত্থাপিত তিনটি প্রস্তাবই পাস হয়। এটা ছিল মুসলমানদের একটা বড় পার্লামেন্টারি বিজয়।
অনেক আলোচনা পর্যালোচনার পর অবশেষে ‘১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন’ বা শাসনতন্ত্র লিপিবদ্ধ হলো। প্রদেশে কিছুটা দায়িত্বশীল সরকার এবং কেন্দ্রে ফেডারেল সরকার প্রতিষ্ঠা ছিল---এ আইনের বিষয়বস্তু বা উদ্দেশ্য। প্রচুর রক্ষাকবচের মাধ্যমে আসল ক্ষমতা বড়লাট ও প্রাদেশিক গভর্নরদের হাতে রয়ে যায়। কংগ্রেস নেতা জওহরলাল নেহেরু এ ভারত শাসন আইনকে ‘কৃতদাসের সংবিধান’ বলে অভিহিত করেন। তিনি ঘোষণা করেন ‘এ আইনের বলে ভারতের ওপর দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে, কিন্তু ক্ষমতা অর্পিত হয়নি। তাই এটা সর্বতোভাবে বর্জনীয়।’
ভারত শাসন আইন সম্পর্কে মুসলিম লীগ তার মতামত প্রকাশ করে বলে, ‘বিভিন্ন দল ও প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বারংবার অসন্তোষ ও অস্বীকৃতি ঘোষণা করার পরও ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের আদলে গঠিত যে শাসনতন্ত্র ভারতবাসীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে ভারত মুসলিম লীগ তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে। মুসলিম লীগ মনে করে যে, প্রাদেশিক পরিকল্পনায় বহু আপত্তিকর বিষয় রয়েছে যার ফলে সরকারের সামগ্রিক শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রিসভা ও আইন পরিষদের প্রকৃত ক্ষমতা নস্যাৎ করা হয়েছে। এতদসত্ত্বেও দেশের বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এই প্রাদেশিক পরিকল্পনা কাজে লাগানো উচিত। মুসলিম লীগের সুস্পষ্ট অভিমত এই যে, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অন্তর্ভুক্ত নিখিল ভারত ফেডারেল পরিকল্পনা মূলত খারাপ। এটা অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল। পশ্চাৎমুখী ও ক্ষতিকর এবং ব্রিটিশ ভারত বনাম ভারতীয় দেশীয় রাজ্যসমূহের প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ ভারতের পক্ষে ক্ষতিকর এবং ভারতের দেশীয় রাজ্যসমূহের প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ ভারতের পক্ষে ক্ষতিকর এবং ভারতের বহু আকাক্সিক্ষত পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন অর্জনের পথে প্রতিবন্ধকতা ও বিলম্ব সৃষ্টি করবে। সেই কারণে এটা সম্পূর্ণরূপে গ্রহণের অযোগ্য।’
মূলত কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ উভয়েই ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের তীব্র সমালোচনা করে।
১৯৩৭ সালের এপ্রিল মাস থেকে এ নতুন ভারত শাসন আইন চালু হবে বলেও ঘোষণা করা হয়।
কংগ্রেস নতুন আইনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। এ নির্বাচনে হিন্দুরা ঐক্যবদ্ধভাবে কংগ্রেসের পতাকাতলে সমবেত হয়। ভারতের সাতটি প্রদেশে কংগ্রেস মন্ত্রিত্ব গঠন করে এবং তাদের আড়াই বছরের শাসনে মুসলমানদের ওপর অন্যায়, অবিচার ও নিষ্পেষণ চালায়, যার প্রতিক্রিয়া স্বরূপ মুসলমানদের পাকিস্তান আন্দোলনের পথ উন্মুক্ত হয়।
১৯৩৭ সালের নির্বাচন
বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে ১৯৩৭ সালের নির্বাচন একটি স্মরণীয় ঘটনা। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে ১৯৩৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে হিন্দুরা ঐক্যবদ্ধভাবে কংগ্রেসের পতাকাতলে সমবেত হয়। কিন্তু মুসলমানরা মুসলিম লীগ ছাড়াও একাধিক মুসলিম দল ও গ্রুপে বিভক্ত হয়ে নির্বাচন করে। এ বিভক্তির ফলে গোটা ভারতের ৪৮৪টি মুসলিম আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ ১০৮টি আসন পায়। গোটা ভারতের ৮০৮টি হিন্দু আসনের মধ্যে কংগ্রেস পায় ৭১১টি আসন। নির্বাচনে হিন্দুদের ঐক্য ও সংখ্যাধিক্য কংগ্রেসকে ১১টি প্রদেশের মধ্যে ৬টি প্রদেশে সরকার গঠন এবং কয়েকটিতে কোয়ালিশন করার অবাধ সুযোগ এনে দেয়।
কম সিট পেলেও ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে সর্বভারতীয় একক বৃহৎ মুসলিম সংগঠন হিসেবে মুসলিম লীগ আবির্ভূত হয়। আর কংগ্রেস রূপান্তরিত হয় হিন্দু সংগঠন হিসেবে।
নির্বাচনের পর মি. জিন্নাহ মুসলিম লীগকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেন। তিনি চেষ্টা করেন মুসলিম লীগ, কংগ্রেস ও অন্যান্য দলসমূহের মিলিত মন্ত্রিসভা গঠনের, যাতে একসাথে চলা ও কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল বাংলা এবং পাঞ্জাবে কংগ্রেসের সাথে যৌথ মন্ত্রিসভা গঠনের প্রস্তাব করেন জিন্নাহ।
কংগ্রেস তা শুধু প্রত্যাখ্যানই করেনি যৌথ মন্ত্রিসভা গঠনের যে শর্ত আরোপ করে তা মুসলিম লীগের জন্য অত্যন্ত অপমানকর। উত্তর প্রদেশের জন্য কংগ্রেস যে শর্ত আরোপ করে তা হলো :
(ক) মুসলিম লীগকে উত্তর প্রদেশ অ্যাসেম্বলিতে পৃথক দল হিসেবে সকল কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে।
(খ) সকল মুসলিম লীগ সদস্যকে কংগ্রেস দলে যোগদান করতে হবে।
(গ) উত্তর প্রদেশ মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি বোর্ড ভেঙে দিতে হবে।
বাংলায় কৃষক-প্রজা পার্টি ও মুসলিম লীগ এ দু’টি দলের পার্লামেন্টারি সংগ্রাম ছিল সুদূরপ্রসারী। এ নির্বাচন ছিল জনগণের অর্থনৈতিক কল্যাণ-অকল্যাণের দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মুসলিম লীগ বিশ্বাস করতো মুসলিম সংহতির প্রয়োজনীয়তা।
কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে নিখিল ভারতীয় ভিত্তিতে একটি নির্বাচনী মৈত্রী হয়। বোম্বাই, যুক্তপ্রদেশ, মাদ্রাজ ও বিহারে যুক্তভাবে নির্বাচন সংগ্রাম চলে। বাংলার নির্বাচনেও তার ঢেউ লাগে। কংগ্রেসের সমর্থক জমিয়তে-ওলামায়-হিন্দ্ মুসলিম লীগের প্রার্থীদের ভোট দেয়ার জন্য ফতোয়া জারি করে।
মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে প্রচারণায় প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হয়। কৃষক-প্রজা পার্টির কোন তহবিল ছিল না। তবে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ছিল এ পার্টির প্রধান পুঁজি। জমিদারি উচ্ছেদ, মহাজনি শোষণ অবসান, কৃষি খাতের দুরবস্থা দূরীকরণ প্রভৃতি গণদাবির মোকাবেলায় মুসলিম লীগের কোন গণকল্যাণের কর্মসূচি ছিল না। কৃষক-প্রজা পার্টির গণসম্পৃক্ত কর্মসূচি ও জনসেবার দৃষ্টান্ত ছিল চোখে পড়ার মত। মুসলিম ছাত্র তরুণরা প্রগতিবাদী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কৃষক প্রজা পার্টির সমর্থক ছিলো।
শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী খাজা সাহেবের দ্বিগুণ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। ময়মনসিংহ অঞ্চলে ১৬টি মুসলিম সিটের মধ্যে কৃষক-প্রজা পার্টি ১১টি আসনে বিজয় লাভ করে। মুসলিম লীগ মাত্র ৫টি আসন পায়। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ময়মনসিংহ জেলাতে অনেকগুলো নির্বাচনী সভায় বক্তব্য রাখেন। তারপরও মুসলিম লীগ প্রার্থীদের পরাজয় ঘটে।
১১৯টি মুসলিম আসনের মধ্যে কৃষক-প্রজা পার্টি ৪৩টি আসন পায়। মুসলিম লীগ পায় ৩৮টি। জমিদারি উচ্ছেদের চরমপন্থী দাবির জন্য অধিকাংশ বর্ণহিন্দু কৃষক-প্রজা পার্টির বিরোধী ছিল। নির্বাচনের ফলাফলে শ্বেতাঙ্গ সদস্য, এক ডজন হিন্দু রাজা মহারাজা ও বিশ জন তফশিলি হিন্দু মুসলিম লীগকে সমর্থন করলেও তারা মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারেনি। পক্ষান্তরে কৃষক-প্রজা পার্টি তা পারে। এ অবস্থায় মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস উভয় দলই কৃষক-প্রজা পার্টির সঙ্গে আপস করতে চায়। কিন্তু কংগ্রেস কৃষক-প্রজা পার্টির আপস চেষ্টা ব্যর্থ হয়। কংগ্রেস নেতাদের সাথে বিচ্ছেদের পর মুসলিম লীগের সাথে সরকার গঠনে আপস চূড়ান্ত হয়। ঠিক হয় ১১ জনের মন্ত্রিসভা হবে। মুসলমান ৬, হিন্দু ৫। মুসলিম ৬ জনের মধ্যে কৃষক-প্রজা ৩, মুসলিম লীগ ৩। হিন্দু ৫ জনের মধ্যে বর্ণহিন্দু ৩, তফসিলি হিন্দু ২ জন। শেরেবাংলা একে ফজলুল হক প্রধানমন্ত্রী।
হক-মন্ত্রিসভা গঠিত হলো। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে কৃষক-প্রজা-কর্মীদের অসন্তোষ দেখা দেয়। মন্ত্রীদের অন্তর্বিরোধের খবর সংবাদপত্রে প্রকাশ হতে থাকে। ১৯৩৭ সালের অক্টোবর মাসে পুনরায় মন্ত্রিসভা গঠন করতে হয়। কৃষক-প্রজা-নেতা হক সাহেবের মন্ত্রিসভাকে জমিদার মন্ত্রিসভা আখ্যা দেয়া হয়। এ মন্ত্রিসভার দশ জনের মধ্যে ছয়জনই ছিলেন জমিদার। ১৯৩৮ সালের এপ্রিলে বাজেট সেশনে এ মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে অনাস্থা দেয়া হয়। অনাস্থা প্রস্তাবের ফলে মন্ত্রিসভায় অন্তর্বিরোধ দূর হয়ে যায়। কংগ্রেস দল এক বাক্যে এ অনাস্থা প্রস্তাব সমর্থন করে। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। হক মন্ত্রিসভা টিকে যায়।
ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব
১৯৪০ সালের ২২ মার্চ লাহোরে মুসলিম লীগের ঐতিহাসিক সাধারণ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এই অধিবেশনে মুসলিম লীগ সভাপতি কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। তিনি তার ভাষণের এক অংশে বলেন:
“আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে ভারতে স্বাধীনতা চাই কিন্তু তা ভারতের সকলের জন্য হওয়া চাই, কেবল একটি অংশ বা তার চাইতেও খারাপ যা কংগ্রেসের ক্ষমতাসীন দলের স্বাধীনতা এবং মুসলমান ও সংখ্যালঘুদের দাসত্ব হলে চলবে না। গত সাড়ে ৩ বছরের অভিজ্ঞতার ফলে আমরা এখন অত্যন্ত আশঙ্কাগ্রস্ত এবং কাউকে বিশ্বাস করতে পারি না। নিজেদের অন্তর্নিহিত শক্তি ব্যতীত আর কারো উপর আপনারা নির্ভর করতে পারেন না। এই হচ্ছে আপনাদের একমাত্র শ্রেষ্ঠ রক্ষাকবচ। আমাদের একটা দাবি হচ্ছে অবস্থানুযায়ী যথাসম্ভব শীঘ্র অথবা যুদ্ধের অব্যবহিত পরে ভারতের ভাবী শাসনতন্ত্র সামগ্রিকভাবে নতুন করে পরীক্ষা করে দেখতে হবে এবং ১৯৩৫ সালের আইন সম্পূর্ণ বাতিল করতে হবে। বৃটিশ সরকারকে কোন ঘোষণা করতে বলার উপর আমাদের আস্থা নেই, এই সব ঘোষণা করার কোনো মূল্য নেই। .... যেকোনো সংজ্ঞায় মুসলমানরা একটা পৃথক জাতি।”
কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ মুসলিম লীগের ঐতিহাসিক লাহোর সম্মেলনে যে ভাষণ দেন তা ‘জি অ্যালানা রচিত ‘পাকিস্তান আন্দোলন ঐতিহাসিক দলিলপত্র’ গ্রন্থে হুবহু উল্লেখ করা হয়েছে। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ তার ভাষণে বলেন :
ভদ্র মহোদয় ও ভদ্র মহিলাগণ,
আমরা পনেরো মাস পর আবার অধিবেশনে মিলিত হয়েছি। মুসলিম লীগের গত অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৩৮ সালের ডিসেম্বরে পাটনায়। এরপর অনেক ঘটনাই ঘটে গেছে। ১৯৩৮ সালের পাটনা অধিবেশনের পর মুসলিম লীগ কি কি অবস্থার সম্মুখীন হয়, প্রথমে আমি সেগুলিই সংক্ষেপে বলব। আপনাদের মনে আছে, আমাদের ওপর ন্যস্ত অন্যতম কাজ ছিল সারা ভারতে মুসলিম লীগকে সংগঠিত করা যেটা আমরা এখনো সম্পূর্ণ করতে পারিনি। তবে এই কাজে আমরা গত পনেরো মাসে যথেষ্ট অগ্রসর হতে পেরেছি। আমি আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে সকল প্রদেশেই মুসলিম লীগ কমিটি গঠিত হয়েছে। পরবর্তী ব্যাপার হল আইনসভার প্রতিটি উপনির্বাচনে আমাদের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। আমাদের কষ্টের সময়ে মুসলমানরা যে প্রচন্ড সাহস দেখিয়েছেন সেজন্য তাদের অভিনন্দন জানাই। একটি মাত্র উপনির্বাচনেই আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী মুসলিম লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে জয়লাভ করে। যুক্তপ্রদেশ (টচ)-এর সর্বশেষ কাউন্সিল নির্বাচনে অর্থাৎ আইনসভার উচ্চকক্ষে মুসলিম লীগের সাফল্য ছিল শতকরা একশত ভাগ। মুসলিম লীগকে সংগঠিত করার পক্ষে আমরা যা যা করেছি সেগুলোর সবিস্তারে বর্ণনা করে আপনাদের আর বিরক্ত করতে চাই না। তবে আমি আপনাদের একথা বলতে পারি যে কাজটি দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে।
পরের বিষয়টি হলো, আপনাদের মনে আছে যে আমরা পাটনা অধিবেশনে মহিলাদের একটি কমিটি গঠন করেছিলাম। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আমি মনে করি আমাদের জীবন সংগ্রাম ও কাজে অংশগ্রহণের সকল সুযোগ আমাদের মহিলাদের দেয়া অবশ্যই প্রয়োজন। পর্দানশিন হয়েও বাড়ির ভিতরে থেকে মহিলারা অনেক কিছু করতে পারেন। তারা যাতে মুসলিম লীগের কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে সে লক্ষ্যেই আমরা কমিটি গঠন করেছিলাম। এই কেন্দ্রীয় কমিটির লক্ষ্য ছিল : (১) প্রাদেশিক ও জেলার মুসলিম লীগ কমিটি গঠন করা, (২) মুসলিম লীগের সদস্য করতে মহিলাদের তালিকাভুক্ত করা, এবং (৩) সারা ভারতে মুসলিম মহিলাদের মধ্যে প্রচারাভিযান চালানো যাতে তাদের মধ্যে অধিকতর রাজনৈতিক সচেতনতা গড়ে তোলা যায়। যদি সেটা জাগিয়ে তোলা যায় তাহলে মনে রাখবেন, আপনাদের সন্তান-সন্ততিদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছুই থাকবে না; (৪) মুসলিম সমাজের উন্নতির জন্য মহিলাদের যা করণীয় সে সম্পর্কে তাদের পরামর্শ ও নির্দেশনা প্রদান করা। আমি আনন্দের সাথে আপনাদের জানাচ্ছি যে, এই কেন্দ্রীয় কমিটি তার কাজ অত্যন্ত নিষ্ঠা ও গুরুত্ব সহকারে শুরু করেছে। কমিটি ইতোমধ্যে প্রচুর দরকারি কাজ করেছে। এ বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই যে, তাদের সম্পাদিত কাজের প্রতিবেদন যখন আমরা পর্যালোচনা করতে বসব তখন মুসলিম লীগের প্রতি তাদের অবদানের জন্য তাদের প্রতি খুব কৃতজ্ঞ হব।
১৯৩৯ সালের জানুয়ারি থেকে প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আমাদের অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়। নাগপুরে আমাদের বিদ্যামন্দির সমর্থকদের মোকাবিলা করতে হয়। সমগ্র ভারতে বরদা পরিকল্পনাও আমাদের মোকাবিলা করতে হয়। যেসব প্রদেশে কংগ্রেস সরকার সেখানেও আমরা দুর্ব্যবহার ও নির্যাতনের শিকার হই।
কিছু কিছু ভারতীয় রাজ্য যেমন জয়পুর ও ভবনগরে মুসলমানদের প্রতি যে অন্যায় আচরণ করা হয় সেটাও আমাদের মোকাবিলা করতে হয়। ক্ষুদ্র রাজ্য রাজকোটে যে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু দেখা দেয় সেটাও আমাদের মোকাবিলা করতে হয়। রাজকোট ছিল সংগ্রেসের জন্য অগ্নিপরীক্ষা। সেটা ভারতে এক-তৃতীয়াংশ এলাকাকে প্রভাবিত করতে পারত। এভাবে ১৯৩৯-এর জানুয়ারি থেকে যুক্ত ঘোষণার সময় পর্যন্ত বিভিন্ন ইস্যুর মোকাবিলা করতে হয়। যুদ্ধ ঘোষণার পূর্বে মুসলমানদের জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ ছিল কেন্দ্রীয় সরকারব্যবস্থায় ফেডারেল পরিকল্পনা বাস্তবায়ন। আমরা জানতাম কি ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু মুসলিম লীগ চতুর্দিক থেকেই এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলছিল। আমরা ঠিক করেছিলাম ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে যে ফেডারেশনের পরিকল্পনা আছে ওটা আমরা কিছুতেই মেনে নেব না। আমি নিশ্চিত যে, কেন্দ্রীয় ফেডারেল সরকার গঠন না করতে, ব্রিটিশ সরকারকে প্রবৃত্ত করতে আমাদের অবদান নেহাত কম ছিল না। ব্রিটিশদের মনে এই ধারণা সৃষ্টিতে মুসলিম লীগের ভূমিকা নেহাত কম নয়। আপনারা জানেন যে ব্রিটিশরা অত্যন্ত একরোখা জাতি। তারা খুব রক্ষণশীলও। তারা অত্যন্ত চালাক হলেও তারা কোন কিছু খুব ধীরে ধীরে বুঝে। যুদ্ধ ঘোষণার পর ভাইসরয় স্বাভাবিকভাবেই মুসলিম লীগের সাহায্য চাইলেন। একমাত্র তখন তিনি বুঝলেন যে, মুসলিম লীগও একটা শক্তি। আপনাদের অবশ্যই মনে আছে যুদ্ধ ঘোষণার সময় পর্যন্ত তিনি কেবল গান্ধী ছাড়া আমার কথা ভাবতেনই না। আমি বেশ দীর্ঘ সময়ের জন্য আইনসভায় একটা গুরুত্বপূর্ণ দলের নেতা ছিলাম। বর্তমানে আমি কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলিম লীগের নেতৃত্ব দেয়ার যে সম্মান অর্জন করেছি সেটা থেকেও তা ছিল বড়। তবুও এর আগে ভাইসরয় আমার কথা কখনো চিন্তা করেননি। সুতরাং যখন গান্ধীর সাথে আমিও ভাইসরয়ের আমন্ত্রণপত্র পেলাম তখন অবাক হয়ে নিজে নিজে ভাবলাম কেন এত হঠাৎ করে আমার পদোন্নতি ঘটল। আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম যে, কারণ হল “সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ”, আমি হলাম যার প্রেসিডেন্ট। আমার বিশ্বাস কংগ্রেস হাই কমান্ডের কাছে এটাই ছিল সবচেয়ে বড় আঘাত, কারণ এতে ভারতের পক্ষ থেকে কথা বলার তাদের একক কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যায়। গান্ধীর ও তার দলের হাই কমান্ডের মনোভাব থেকে এ কথা স্পষ্ট যে, এই আঘাত তারা এখনো ভুলতে পারেননি। আমার কথা হলো, আমি চাই আপনারা বুঝুন আপনাদের নিজেদের সংগঠিত হওয়ার মূল্য, তাৎপর্য ও গুরুত্ব কতটুকু। এ ব্যাপারে আমি আর কিছুই বলব না।
(সূত্র : বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস- আব্বাস আলী খান)
(চলবে)
আপনার মন্তব্য লিখুন