বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস
মতিউর রহমান আকন্দ
০৯ মে ২০১৬
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ক্যাবিনেট মিশন
লাহোর প্রস্তাবে ভারত বিভক্তি অনিবার্য হয়ে ওঠে। ভারত বিভক্ত হলে হিন্দুদের জন্য একটি এবং মুসলমানদের জন্য আরেকটি রাষ্ট্র গঠিত হবে। এ পরিস্থিতিতে গোটা ভারতে বসবাসকারী মুসলমানদের তাদের নিজ নিজ অবস্থানস্থল থেকে পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হতে হবে। লাহোর প্রস্তাব প্রণয়নকারীগণ স্পষ্ট এটা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। ব্রিটিশরা উপলব্ধি করে ভারতের দুই প্রান্তে হাজার মাইলের ব্যবধানে দু’টি পৃথক ভুখণ্ড নিয়ে একটি রাষ্ট্র গঠন করা হলে তাদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করা কঠিন হবে। নিরাপত্তা বজায় রাখাও সম্ভব হবে না। তাই ভারত অখন্ড রাখাই উত্তম। এ লক্ষ্য নিয়ে ‘ক্যাবিনেট মিশন’ পাঠানো হয়। ক্যাবিনেট মিশন ছিল ভারতকে অখন্ড রাখার শেষ প্রয়াস। ঐতিহাসিকগণ এ মিশনকে একটি ‘মিসজড অপরচুনিটি’ বা হারানো সুযোগ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলির উদ্যোগে গঠিত হয় এ মিশন। এ শক্তিশালী মিশনের সদস্য ছিলেন স্বয়ং ভারত সচিব লর্ড পেথিক লরেন্স, বাণিজ্যসচিব স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস এবং নৌসচিব লর্ড আলেকজান্ডার। ১৯৪৬ সালের ২৪ মার্চ ক্যাবিনেট মিশন ভারত আসেন।
মিশন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং নিখিল ভারত মুসলিম লিগের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হয়। এ দু’টি দল সাম্প্রদায়িক কলহ প্রতিরোধে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির শর্ত নিয়ে আপস করার পরিকল্পনা করে। গান্ধী-নেহেরুর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস নিরঙ্কুশ ক্ষমতা লাভের চেষ্টা করছিল। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বাধীন নিখিল ভারত মুসলিম লিগ আইনসভায় সমতার নিশ্চয়তাসহ রাজনৈতিক রক্ষাকবচের শর্তে ভারতকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে চেয়েছিলেন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনার পর ১৯৪৬ সালের ১৬ মে মিশন নয়া সরকার গঠনে তাদের পরিকল্পনা প্রকাশ করেন। এ পরিকল্পনা ১৬ মে’র পরিকল্পনা নামে পরিচিত হলো। পরিকল্পনায় বলা হয়-
হ একটি ঐক্যবদ্ধ ভারত ডোমিনিয়নকে স্বাধীনতা প্রদান করা হবে।
হ মুসলিমপ্রধান প্রদেশগুলোকে নিয়ে গ্রুপ গঠন করা হবে।
হ মধ্য ও দক্ষিণ ভারতের হিন্দুপ্রধান মাদ্রাজ, বোম্বাই, ইউনাইটেড প্রভিন্স, বিহার, সেন্ট্রাল প্রভিন্স ও উড়িষ্যাকে নিয়ে গঠন করা হবে ‘ক’ গ্রুপ।
হ বেলুচিস্তান, সিন্ধু, পাঞ্জাব ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশকে নিয়ে গঠন করা হবে ‘খ’ গ্রুপ এবং বাংলা ও আসামকে নিয়ে গঠন করা হবে ‘গ’ গ্রুপ।
হ কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে থাকবে পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা। অবশিষ্ট ক্ষমতা গ্রুপগুলোর কাছে অর্পণ করা হবে।
কংগ্রেস ক্যাবিনেট মিশনের পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে। জওহরলাল নেহেরু বলেন, “স্বাধীন ভারতে কোন গ্রুপ থাকবে না।” নেহেরুর এ উক্তি ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয় ও ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা পরিত্যক্ত হয়। কংগ্রেস ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যানের পর মুসলিম লিগ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মূল দাবিতে ফিরে যায়।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ও
শেখ মুজিবুর রহমান
কংগ্রেসের ভূমিকায় মুসলমানগণ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা ছাড়া আর কোন পথ নেই বলে মনে করতে থাকে। পরিস্থিতি এমন রূপ ধারণ করে যে, মুসলমানদের অস্তিত্ব রাখার জন্য আলাদা ভূখন্ড প্রয়োজন হয়ে পড়ে। মুসলিম নেতৃবৃন্দ এটা উপলব্ধি করেছিলেন।
শেখ মুজিবুর রহমান সবেমাত্র রাজনীতিতে যোগদান করেছেন। তিনিও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তার ভাষায় ‘তখন রাজনীতি শুরু করেছি ভীষণভাবে। সভা করি, বক্তৃতা করি। খেলার দিকে আর নজর নাই। শুধু মুসলিম লিগ, আর ছাত্রলীগ। পাকিস্তান আনতেই হবে, নতুবা মুসলমানদের বাঁচার উপায় নাই। খবরের কাগজ ‘আজাদ’, যা লিখে তাই সত্য বলে মনে হয়।’ -(অসমাপ্ত আত্মজীবনী : শেখ মুজিবুর রহমান)
যে ব্রিটিশ মুসলমানদের নিকট থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল তাদের ব্যাপারে শেখ মুজিবুর রহমানের আক্রমণাত্মক মনোভাব ছিল। তিনি লিখেছেন ‘কেমন করে ব্রিটিশরাজ মুসলমানদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিল, কি করে রাতারাতি মুসলমানদের সর্বস্বান্ত করে হিন্দুদের সাহায্য করেছিল, মুসলমানরা ব্যবসা-বাণিজ্য, জমিদারি, সিপাহির চাকরি থেকে কিভাবে বিতাড়িত হলো- মুসলমানদের স্থান হিন্দুদের দ্বারা পূরণ করতে শুরু করেছিল ইংরেজরা। কেন? মুসলমানরা কিছুদিন পূর্বেও দেশ শাসন করেছে তাই ইংরেজকে গ্রহণ করতে পারে নাই। সুযোগ পেলেই বিদ্রোহ করত। ওহাবি আন্দোলন কি করে শুরু করেছিল হাজার হাজার বাঙালি মুজাহিদ? বাংলাদেশ থেকে সমস্ত ভারতবর্ষ পায়ে হেঁটে সীমান্ত প্রদেশে যেয়ে জেহাদে শরিক হয়েছিল। তিতুমীরের জেহাদ, হাজী শরীয়তুল্লাহর ফারায়েজি আন্দোলন সম্বন্ধে আলোচনা করেই আমি পাকিস্তান আন্দোলনের ইতিহাস বলতাম। ভীষণভাবে হিন্দু বেনিয়া ও জমিদারদের আক্রমণ করতাম।’ -(অসমাপ্ত আত্মজীবনী : শেখ মুজিবুর রহমান)
ইংরেজরা দেশ দখল করার পর হিন্দুদের সহযোগিতায় মুসলমানদের কোণঠাসা করার চেষ্টা করে। মহাজন ও জমিদাররা মুসলমানদের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগে-
‘হিন্দু মহাজন ও জমিদারদের অত্যাচারেও বাংলার মুসলমানরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। তাই মুসলমানরা ইংরেজদের সাথে অসহযোগ করেছিল। তাদের ভাষা শিখবে না, তাদের চাকরি নেবে না, এই সকল করেই মুসলমানরা পিছিয়ে পড়েছিল। আর হিন্দুরা ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করে ইংরেজকে তোষামোদ করে অনেকটা উন্নতির দিকে অগ্রসর হয়েছিল। যখন আবার হিন্দুরা ইংরেজের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল তখন অনেকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলে মরতে দ্বিধা করে নাই। জীবনভর কারাজীবন ভোগ করেছে, ইংরেজকে তাড়াবার জন্য। এই সময় যদি এই সকল নিঃস্বার্থ স্বাধীনতা সংগ্রামী ও ত্যাগী পুরুষরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সাথে সাথে হিন্দু ও মুসলমানদের মিলনের চেষ্টা করতেন এবং মুসলমানদের ওপর যে অত্যাচার ও জুলুম হিন্দু জমিদার ও বেনিয়ারা করেছিল, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেন, তাহলে তিক্ততা আর বাড়ত না। হিন্দু নেতাদের মধ্যে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এবং নেতাজী সুভাষ বসু এ ব্যাপারটা বুঝেছিলেন, তাই তাঁরা অনেক সময় হিন্দুদের হুঁশিয়ার করেছিলেন। কবিগুরুও তাঁর লেখার ভেতর দিয়ে হিন্দুদের সাবধান করেছেন।’ -(অসমাপ্ত আত্মজীবনী : শেখ মুজিবুর রহমান)
হিন্দুরা মুসলমানদের দেখতো ঘৃণার চোখে। শেখ মুজিবুর রহমান যেসব হিন্দুদের সাথে লেখাপড়া করতেন, চলাফেরা করতেন তারাও তাকে দেখতো অবজ্ঞার চোখেÑ
একসাথে লেখাপড়া করতাম, একসাথে বল খেলতাম, একসাথে বেড়াতাম, বন্ধুত্ব ছিল হিন্দুদের অনেকের সাথে। আমার বংশও খুব সম্মান পেত হিন্দু মুসলমানদের কাছ থেকে। কিন্তু আমি যখন কোনো হিন্দু বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে যেতাম, আমাকে অনেক সময় তাদের ঘরের মধ্যে নিতে সাহস করত না আমার সহপাঠীরা।
একদিনের একটা ঘটনা আমার মনে দাগ কেটে দিয়েছিল, আজও সেটা ভুলি নাই। আমার এক বন্ধু ছিল ননীকুমার দাস। একসাথে পড়তাম, কাছাকাছি বাসা ছিল, দিনভরই আমাদের বাসায় কাটাত এবং গোপনে আমার সাথে খেত। ও ওর কাকার বাড়িতে থাকত। একদিন ওদের বাড়িতে যাই। ও আমাকে ওদের থাকার ঘরে নিয়ে বসায়। ওর কাকীমাও আমাকে খুব ভালবাসত। আমি চলে আসার কিছু সময় পরে ননী কাঁদো কাঁদো অবস্থায় আমার বাসায় এসে হাজির। আমি বললাম “ননী কি হয়েছে?” ননী আমাকে বলল, “তুই আর আমাদের বাসায় যাস না। কারণ, তুই চলে আসার পরে কাকীমা আমাকে খুব বকেছে তোকে ঘরে আনার জন্য এবং সমস্ত ঘর আবার পরিষ্কার করেছে পানি দিয়ে ও আমাকেও ঘর ধুতে বাধ্য করেছে।” বললাম, “যাব না, তুই আসিস।” আরও অনেক হিন্দু ছেলেদের বাড়িতে গিয়েছি, কিন্তু আমার সহপাঠীরা আমাকে কোনোদিন এ কথা বলে নাই। অনেকের মা ও বাবা আমাকে আদরও করেছেন। এই ধরনের ব্যবহারের জন্য জাতক্রোধ সৃষ্টি হয়েছে বাঙালি মুসলমান যুবকদের ও ছাত্রদের মধ্যে। শহরে এসেই এই ব্যবহার দেখেছি। কারণ আমাদের বাড়িতে হিন্দুরা যারা আসত প্রায় সকলেই আমাদের শ্রদ্ধা করত। হিন্দুদের কয়েকটা গ্রামও ছিল, যেগুলির বাসিন্দারা আমাদের বংশের কোনো না কোনো শরিকের প্রজা ছিল।’ -(অসমাপ্ত আত্মজীবনী : শেখ মুজিবুর রহমান)
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানকে নানা পরিবেশের সম্মুখীন হতে হয়। সকল প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে তিনি তার লক্ষ্যপানে এগিয়ে যান। তিনি লিখেছেন :
“আব্বা আমাকে এ সময় একটা কথা বলেছিলেন, বাবা রাজনীতি কর আপত্তি করব না, পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছ এ তো সুখের কথা, তবে লেখাপড়া করতে ভুলিও না। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবে না। আর একটা কথা মনে রেখ, ‘ঝরহপবৎরঃু ড়ভ ঢ়ঁৎঢ়ড়ংব ধহফ যড়হবংঃু ড়ভ ঢ়ঁৎঢ়ড়ংব’ থাকলে জীবনে পরাজিত হবা না। এ কথা কোনোদিন আমি ভুলি নাই।
আর একদিনের কথা, গোপালগঞ্জ শহরের কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তি আমার আব্বাকে বলেছিলেন, আপনার ছেলে যা আরম্ভ করেছে তাতে তার জেল খাটতে হবে। তার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে, তাকে এখনই বাধা দেন। আমার আব্বা যে উত্তর করেছিলেন তা আমি নিজে শুনেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘দেশের কাজ করছে, অন্যায় তো করছে না; যদি জেল খাটতে হয়, খাটবে; তাতে আমি দুঃখ পাবো না। জীবনটা নষ্ট নাও তো হতে পারে, আমি ওর কাজে বাধা দিব না। আমার মনে হয়, পাকিস্তান না আনতে পারলে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না।’ অনেক সময় আব্বা আমার সাথে রাজনৈতিক আলোচনা করতেন। আমাকে প্রশ্ন করতেন, কেন পাকিস্তান চাই? আমি আব্বার কথার উত্তর দিতাম।
একদিনের কথা মনে আছে, আব্বা ও আমি রাত দুইটা পর্যন্ত রাজনীতির আলোচনা করি। আব্বা আমার আলোচনা শুনে খুশি হলেন। শুধু বললেন, শেরেবাংলা এ. কে. ফজলুল হক সাহেবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যক্তিগত আক্রমণ না করতে। একদিন আমার মা’ও আমাকে বলেছিলেন, ‘বাবা যাহাই কর, হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছুই বলিও না।’ শেরেবাংলা মিছামিছিই ‘শেরেবাংলা’ হন নাই। বাংলার মাটিও তাঁকে ভালবেসে ফেলেছিল। যখনই হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছু বলতে গেছি, তখনই বাধা পেয়েছি। একদিন আমার মনে আছে একটা সভা করছিলাম আমার নিজের ইউনিয়নে, হক সাহেব কেন লিগ ত্যাগ করলেন, কেন পাকিস্তান চান না এখন? কেন তিনি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সাথে মিলে মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন? এই সমস্ত আলোচনা করছিলাম, হঠাৎ একজন বৃদ্ধ লোক যিনি আমার দাদার খুব ভক্ত, আমাদের বাড়িতে সকল সময়ই আসতেন, আমাদের বংশের সকলকে খুব শ্রদ্ধা করতেন- দাঁড়িয়ে বললেন, ‘যাহা কিছু বলার বলেন, হক সাহেবের বিরুদ্ধে কিছুই বলবেন না। তিনি যদি পাকিস্তান না চান, আমরাও চাই না। জিন্নাহ কে? তার নামও তো শুনি নাই। আমাদের গরিবের বন্ধু হক সাহেব।’ এ কথার পর আমি অন্যভাবে বক্তৃতা দিতে শুরু করলাম। সোজাসুজিভাবে আর হক সাহেবকে দোষ দিতে চেষ্টা করলাম না। কেন পাকিস্তান আমাদের প্রতিষ্ঠা করতে হবে তাই বুঝালাম। শুধু এইটুকু না, যখনই হক সাহেবের বিরুদ্ধে কালো পতাকা দেখাতে গিয়েছি, তখনই জনসাধারণ আমাদের মারধর করেছে। অনেক সময় ছাত্রদের নিয়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি, মার খেয়ে। কয়েকবার মার খাওয়ার পরে আমাদের বক্তৃতা করতাম। তার ফল বেশি ভালো হতো না। উপকার করার চেয়ে অপকারই বেশি হতো। জনসাধারণ দুঃখ পেতে পারে ভেবে দাবিটা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করতাম।
পাকিস্তান দুইটা হবে, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে। একটা বাংলা ও আসাম নিয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র; আর একটা ‘পশ্চিম পাকিস্তান’ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে- পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান, সীমান্ত ও সিন্ধু প্রদেশ নিয়ে। অন্যটা হবে হিন্দুস্তান। ওখানেও হিন্দুরাই সংখ্যাগুরু থাকবে তবে সমান নাগরিক অধিকার পাবে হিন্দুস্তানের মুসলমানরাও। আমার কাছে ভারতবর্ষের একটা ম্যাপ থাকত। আর হবীবুল্লাহ বাহার সাহেবের ‘পাকিস্তান’ বইটা এবং মুজিবুর রহমান খাঁ সাহেবও ‘পাকিস্তান’ নামে একটা বিস্তৃত বই লিখেছিলেন সেটা; এই দুইটা বই আমার প্রায় মুখস্থের মত ছিল। আজাদের কাটিংও আমার ব্যাগে থাকত।” -(অসমাপ্ত আত্মজীবনী : শেখ মুজিবুর রহমান)
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিষয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের বিশ্বাস ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা না হলে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না। তিনি বলেছেন, ‘অখন্ড ভারতে যে মুসলমানদের অস্তিত্ব থাকবে না এটা আমি মন প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতাম। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হিন্দু নেতারা ক্ষেপে গেছেন কেন? ভারতবর্ষেও মুসলমান থাকবে এবং পাকিস্তানেও হিন্দুরা থাকবে। সকলেই সমান অধিকার পাবে। পাকিস্তানের হিন্দুরাও স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বাস করবে। ভারতবর্ষের মুসলমানরাও সমান অধিকার পাবে। পাকিস্তানের মুসলমানরা যেমন হিন্দুদের ভাই হিসেবে গ্রহণ করবে, ভারতবর্ষের হিন্দুরাও মুসলমানদের ভাই হিসাবে গ্রহণ করবে। এই সময় আমাদের বক্তৃতার ধারাও বদলে গেছে। অনেক সময় হিন্দু বন্ধুদের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এ নিয়ে আলোচনা হতো। কিছুতেই তারা বুঝতে চাইত না। ১৯৪৪-৪৫ সালে ট্রেনে, স্টিমারে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে তুমুল তর্ক-বিতর্ক হতো। সময় সময় এমন পর্যায়ে আসত যে, মুখ থেকে হাতের ব্যবহার হওয়ার উপক্রম হয়ে উঠত। এখন আর মুসলমান ছেলেদের মধ্যে মতবিরোধ নাই। পাকিস্তান আনতে হবে এই একটাই স্লোগান সকল জায়গায়।’
জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠা
লাহোর প্রস্তাবের ঠিক ১৭ মাস ২ দিন পর ১৯৪১ সালের ২৬শে আগস্ট প্রতিষ্ঠিত হয় জামায়াতে ইসলামী। জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মওদূদী যে দর্শনকে সামনে রেখে জামায়াত প্রতিষ্ঠা করেন তা তার ভাষায়:
প্রকৃতপক্ষে এ কোন আকস্মিক ঘটনা ছিল না যে, কোন এক ব্যক্তির মনে হঠাৎ এক খেয়াল চাপলো যে, সে একটা দল বানাবে এবং কিছু লোক একত্র করে সে একটা দল বানিয়ে ফেললো। বরঞ্চ এ ছিল আমার ক্রমাগত বাইশ বছরের অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ, গভীর অধ্যয়ন ও চিন্তা-গবেষণার ফসল, যা একটা পরিকল্পনার রূপ ধারণ করে এবং সে পরিকল্পনার ভিত্তিতেই জামায়াতে ইসলামী গঠিত হয়। (“জামায়াতে ইসলামীর ঊনত্রিশ বৎসর যাপন” অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণ)
মাওলানার পর্যবেক্ষণ ও অধ্যয়নের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে জানতে পারা যায় যে, সে সময়ে উপমহাদেশের মুসলিম সমাজের মধ্যে এতোটা বৈষম্য-বৈপরীত্য বিরাজ করছিল যে, তার থেকে স্বভাবতই মানুষের মনে বহু প্রশ্নের উদয় হতো। কিন্তু খেলাফত আন্দোলন চলা পর্যন্ত এসব প্রশ্ন মনের মধ্যেই চাপা ছিল। একদিকে মুসলমানদের মধ্যে এ অদম্য প্রেরণা ছিল যে, তুরস্কের খেলাফত এবং পবিত্র স্থানগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে জীবন বিলিয়ে দিতে হবে। অপরদিকে জালিয়ানওয়ালাবাগের নৃশংস হত্যাকান্ড সারা দেশে প্রতিহিংসার দাবানল প্রজ্বলিত করে, যার ফলে স্বাধীনতা আন্দোলন জোরদার হয়ে পড়ে। তারপর গান্ধীর নেতৃত্বে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং অসহযোগ আন্দোলন, অতঃপর তুর্কি জাতীয়তাবাদ ও তার প্রত্যুত্তরে আরব জাতীয়তাবাদের উত্থান, তারপর খেলাফতের বিলোপ সাধন ও ভারতে খেলাফত আন্দোলনের পতন, শুদ্ধি আন্দোলন, স্বামী শ্রদ্ধানন্দের হত্যা, মুসলমানদের প্রতি পাশ্চাত্য সভ্যতা, ধর্মহীনতা ও নাস্তিকতার আগ্রাসী হামলা, ধর্মহীন ভৌগোলিক রাষ্ট্রগঠনের জন্য এক জাতীয়তাবাদের কলরব ও হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ভেঙে যাওয়ার পর দেশব্যাপী হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা-হাঙ্গামা, সাহিত্যের মধ্যে নাস্তিকতা, অশ্লীলতা ও কমিউনিজমের ক্রমবর্ধমান প্রভাব, জওহরলাল নেহেরুর সমাজতন্ত্রের পুরোধার পদে সমাসীন হওয়া প্রভৃতি সবকিছুই ১৯২৪ সালের পর থেকে পরবর্তী পনেরো বছর পর্যন্ত এমন সব ঘটনা যার প্রত্যেকটির ওপর তীক্ষè দৃষ্টি রাখেন জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা এবং সেসবের উপর গভীরভাবে চিন্তা-গবেষণা করে তিনি নি¤œ সিদ্ধান্তে পৌঁছেন :
“মুসলমানদের বাঁচার উপায় থাকলে শুধু এর মধ্যেই আছে যে, তাদেরকে আবার নতুন করে জাতির মুবাল্লিগের ভূমিকা পালন করতে হবে। শুধুমাত্র এ পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমেই তারা সেসব জটিলতা থেকে মুক্ত হতে পারে যার মধ্যে তারা এখন নিমজ্জিত আছে। ..... এ কথা তাদের মনে বদ্ধমূল করে দিতে হবে যে, ইসলামের নিজস্ব একটা জীবন বিধান আছে। তার নিজস্ব সাংস্কৃতিক ব্যবস্থা আছে, নিজস্ব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা আছে, তার নিজস্ব চিন্তাধারা আছে, নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থা আছে যা সবদিক দিয়ে পাশ্চাত্য সভ্যতা ও তার সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো থেকে অনেক ভালো ও উচ্চমানের। সভ্যতা-সংস্কৃতির ব্যাপারে কারো কাছে হাত পাততে হবে-এ ধারণা তাদের মন থেকে মুছে ফেলতে হবে।”
‘জামায়াতে ইসলামীর ঊনত্রিশ বৎসর যাপন’ অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণ।
জামায়াত প্রতিষ্ঠাতা বলেছেন- জামায়াতে ইসলামী তাঁর দীর্ঘ বাইশ বছরের চিন্তা-গবেষণার ফসল। তাঁর মনের গভীরে বহু সূক্ষ্ম প্রশ্ন জমাট বাঁধে- যার উত্তর তালাশ করতে গিয়ে তাঁকে একটি জামায়াত গঠনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হয়। তিনি বলেন-
“আমাদের ইতিহাসের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ ও ফলপ্রসূ ঘটনা এই যে, আমাদের দেশে ঊনবিংশ শতাব্দীতে হাজার হাজার মাইল দূর থেকে এসে একটি অমসুসলিম জাতি আমাদের ঘাড়ের উপরে মজবুত হয়ে চেপে বসে। ..... এ ঘটনা আমাদের জন্য কয়েক দিক দিয়ে প্রণিধানযোগ্য।”
“প্রথম প্রশ্ন যার জবাব আমাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে তা হলো এই যে, এ ঘটনা ঘটলোই বা কেন? এটা কি কোন আকস্মিক দুর্ঘটনা ছিল যা বিনা কারণে আমাদের উপরে এসে পড়েছে? এ কি প্রকৃতির কোন অন্যায়-অত্যাচার- যা বিনা অপরাধে আমাদের উপরে করা হয়েছে আমরা কি ঠিক সঠিক পথেই চলছিলাম, কোন দুর্বলতা, কোন দোষ-ত্রুটি আমাদের ছিল না? অথবা প্রকৃতপক্ষে বহুদিন যাবৎ আমরা আমাদের মধ্যে কিছু দুর্বলতা ও কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি পোষণ করে আসছিলাম-যার শাস্তি একটা বৈদেশিক শক্তির গোলামি হিসাবে আমাদের উপর নেমে এলো?”
“দ্বিতীয় প্রশ্ন এই যে, এই যে বিপদটা বাইরে থেকে এসে আমাদের ঘাড়ে চাপলো, একি শুধু একটি গোলামির অভিশাপ ছিল, না তা সাথে করে এনেছিল নিজস্ব চরিত্র, চিন্তাধারা, ধর্ম, সভ্যতা-সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতির অন্যান্য বহু অভিশাপ?”
“তৃতীয় প্রশ্ন এই যে, এসব বিপদ-অভিশাপের মুকাবিলায় আমাদের ভূমিকা কী ছিল?” -(মুসলমানদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ)।
স্মরণ করা যেতে পারে যে, ১৯৩৭ সালে ভারতের ছয়টি প্রদেশে কংগ্রেসের হিন্দু মন্ত্রিসভা গঠিত হওয়ার পর তাঁরা ভারতে ‘রামরাজ্য’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছিলেন। তাঁদের এ স্বপ্ন সফল হতে পারে যদি একজাতীয়তার ভিত্তিতে ব্রিটিশ ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এ উদ্দেশ্যে ১৯৩৭ সালে কংগ্রেস মুসলমানদের গণসংযোগ আন্দোলন (গঁংষরস গধংং ঈড়হঃধপঃ গড়াবসবহঃ) শুরু করে। সে সম্পর্কে মাওলানা বলেন-
“মুসলিম গণসংযোগ অভিযান শুরু হয়- যার কর্মীবাহিনী ছিল মুসলমান কমিউনিস্ট। পরিতাপের বিষয় এই যে, আলেমদের একটি দলও তাদের সাথে সহযোগিতা করে। তাঁরা বলতেন, হিন্দু-মুসলমান মিলে এক জাতি হতে পারে এবং এ জাতির মধ্যে এমন এক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রচলন হতে পারে- সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। এ মতবাদ খন্ডন করে আমি ঐসব প্রবন্ধ লিখি- যা “মুসলমান আওর মওজুদা সিয়াসি কাশমকাশ”-তৃতীয় খন্ড, এবং ‘মাসালায়ে কমুমিয়ত’ নামে প্রকাশিত হয়। .... আমি আমার সর্বশক্তি এ কাজে নিয়োজিত করি যাতে করে মুসলমানদেরকে হিন্দু জাতীয়তার মধ্যে মিশে একাকার হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করা যায়।” -(ঊনত্রিশ বৎসর যাপন অনুষ্ঠানে ভাষণ)
তারপরের ঘটনা মাওলানার ভাষায়:
“তারপর ১৯৩৯ সাল এবং তারপরের কথা। মুসলিম লিগের আন্দোলন জোরদার হয়। পাকিস্তান আন্দোলনের প্রস্তুতি হতে থাকে। অবশেষে ১৯৪০ সালে আন্দোলন পাকিস্তান প্রস্তাবের রূপলাভ করে। .... সে সময়ে আমার মনের মধ্যে যে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা হলো এই যে, মুসলমানদের মধ্যে এ অনুভূতির সঞ্চার করা হোক যে, তারা নিছক একটা জাতি নয়, বরঞ্চ একটা মুবাল্লিগ জাতি, একটা মিশনারি জাতি। তাদের এমন এক রাষ্ট্র কায়েম করা উচিত যা হবে একটা মিশনারি রাষ্ট্র। এ উদ্দেশ্যে আমি ধারাবাহিক প্রবন্ধ লেখা শুরু করি- যা মুসলমান আওর মওজুদা সিয়াসি কাশমকাশ তৃতীয় খন্ড নামে প্রকাশিত হয়।”
তারপর মাওলানা বলেন-
যখন আমি দেখলাম যে, আমার সবকিছু অরণ্যে রোদন হয়ে পড়ছে, তখন দ্বিতীয় পদক্ষেপ-যা আমি সমীচীন মনে করলাম তা এই যে, নিজের পক্ষ থেকে একটি জামায়াত গঠন করা উচিত- যা চরিত্রবান লোক নিয়ে গঠিত হবে এবং ঐসব ফিতনার মোকাবিলা করবে-যার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। সে সময় যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আমার মনে ছিল তা ছিল এই যে, অবস্থা যেদিকে চলছে তাতে একটা সংকট এটা হতে পারে যে, পাকিস্তান সংগ্রামে মুসলিম লিগ বিফল মনোরথ হবে এবং ইংরেজ ভারতে এক ভারতীয় জাতীয়তার ভিত্তিতে একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করে তা হিন্দুদের হাতে তুলে দিয়ে চলে যাবে। তখন কি করতে হবে? দ্বিতীয় অবস্থা এ হতে পারে যে, মুসলিম লিগের উদ্দেশ্য সফল হবে এবং দেশ বিভক্ত হয়ে যাবে। এ অবস্থায় কয়েক কোটি মুসলমান যে ভারতে রয়ে যাবে, তাদের কি দশা হবে এবং স্বয়ং পাকিস্তানে ইসলামের দশাটাই বা কি হবে? এ ছিল এমন এক পরিস্থিতি যখন আমি এ দৃঢ় সিদ্ধান্ত করলাম যে, ‘জামায়াতে ইসলামী’ নামে একটি জামায়াত গঠন করা হোক।” -(ঊনত্রিশ বৎসর পালন অনুষ্ঠানে ভাষণ)
যেসব পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে জামায়াতে ইসলামী গঠন অপরিহার্য হয়েছিল, তা আজকের প্রেক্ষাপটে যথার্থই উপলব্ধি করা যায়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরবর্তী বছরগুলো এ জামায়াতের অপরিহার্যতা দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
“দুনিয়াকে ভবিষ্যতের অন্ধকার যুগ থেকে রক্ষা করে তাকে ইসলামের নিয়ামত দ্বারা ভূষিত করার জন্য এতোটুকু যথেষ্ট নয় যে এখানে ইসলামের সঠিক ধারণা ও মতবাদ বিদ্যমান আছে, বরঞ্চ সঠিক মতবাদের সাথে একটি সত্যনিষ্ঠ দলেরও প্রয়োজন। এ দলের সদস্যদেরকে ঈমানের দিক দিয়ে সুদৃঢ় ও অবিচল হতে হবে এবং আমলের দিক থেকে হতে হবে প্রশংসনীয় ও উচ্চমানের। কারণ তাদেরকে সভ্যতা-সংস্কৃতির ভ্রান্ত অবস্থা ও রীতিনীতির বিরুদ্ধে কার্যত বিদ্রোহ করতে হবে এবং এ পথে আর্থিক কোরবানি থেকে শুরু করে কারাদন্ড এমনকি ফাঁসির ঝুঁকিও নিতে হবে।”
তিনি আরো বলেন, “আমার এমন এক স্বাধীনতা প্রয়োজন যার সাহায্যে আমি পতনোন্মুখ ইসলামী শক্তিকে সামলাতে পারি, জীবনের যাবতীয় সমস্যাবলি মুসলমান হিসেবে সমাধান করতে পারি এবং হিন্দুস্তানে মুসলিম জাতিকে একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে দেখতে পারি। ....... আমরা যদি মুসলমান থাকতে চাই এবং স্পেন ও সিসিলিতে মুসলমানদের যে দুর্দশা হয়েছিল ভারতের মুসলমানদের ক্ষেত্রে তা দেখতে যদি আমরা না চাই, তাহলে আমাদের জন্য একটি মাত্র পথই খোলা আছে। তা হলো এই যে, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের মুখ কুফরি সরকারের দিক থেকে সত্যনিষ্ঠ সরকারের দিকে ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা আমরা করবো। এ উদ্দেশ্যে আমাদেরকে এক সর্বাত্মক সংগ্রামের জন্য বদ্ধপরিকর হতে হবে। তার পরিণাম সাফল্য হোক অথবা মৃত্যু। আমি মনে করি এ জাতিকে বাঁচাতে হলে এই শেষ সুযোগটি বাকি আছে। আমাদের বিশেষ মহল যতই পথভ্রষ্ট হোক না কেন আমাদের জনসাধারণের মধ্যে ঈমানের এক দমিত অগ্নিশিখা বিদ্যমান আছে এবং এটাই আমাদের শেষ সম্বল। এটা নির্বাপিত হওয়ার পূর্বে এ থেকে আমরা অনেক কাজ নিতে পারি। শর্ত এই যে কিছু এমন মর্দে মুমিন দাঁড়িয়ে যেতে হবে খালেস নিয়তের সাথে আল্লাহর পথে সংগ্রাম করার জন্য।”
মুসলমানদের সার্বিক মুক্তি বিধানই ছিল জামায়াত প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য। এ সার্বিক মুক্তির মধ্যে মুসলমানদের আশু রাজনৈতিক মুক্তির প্রতি সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন জামায়াত প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা মওদূদী। বস্তুত ১৯৪১ সালে জামায়াতে ইসলামী গঠন ছিল হিমালয়ান উপমহাদেশে মুসলিম জীবনে ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলনের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। এই ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলনের পুনরুত্থান ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। উপমহাদেশীয় মুসলমানদের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক জীবনের সাথে এর সম্পর্ক অচ্ছেদ্য।
উপমহাদেশ বিভক্তি
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পশালীর আ¤্রকাননে স্বাধীনতার যে আলো নিভে গিয়েছিল, ১৯০ বছর পর ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট পাকিস্তান ও ভারতের স্বাধীনতা লাভের মধ্য দিয়ে সে আলো আবার প্রজ্বলিত হয়। ৩০ কোটি জনসংখ্যার ৯৮ বছরের পুরনো একটি প্রশাসনিক ইউনিট ১৯৪৭ সালে বিভক্ত হয়ে যায়। ব্রিটিশ ভারতের সাড়ে ৯ কোটি মুসলমানের মধ্যে ৬ কোটি পাকিস্তানে বসবাস করার সুযোগ পায়। বাকি সাড়ে তিন কোটি মুসলমান ভারতে অবস্থান করতে বাধ্য হয়।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস অখন্ড ভারত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলেও মুসলিম লিগের তীব্র আন্দোলনে উপমহাদেশ বিভক্ত হয়। অবশ্য এ কথা ঠিক যে, উপমহাদেশ বিভক্ত না হলে অখন্ড ভারত হতো বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শক্তি। পরাশক্তি হওয়ার সকল উপাদানও ব্রিটিশ ভারতের ছিল। কংগ্রেসের অঘোষিত সাম্প্রদায়িক মনোভাবই ছিল উপমহাদেশ বিভক্তির জন্য দায়ী। উপমহাদেশ বিভক্ত হওয়ায় জাতি হিসাবে মুসলমানরা প্রথমে একটি এবং পরে আরো একটি স্বাধীন রাষ্ট্র লাভ করে এ কথা সত্যি। তবে এ কথাও সত্যি যে, উপমহাদেশ বিভক্তিকালে ব্রিটিশরা অশান্তির এমন বীজ বপন করে গেছে যা থেকে এখনো রক্তক্ষরণ ঘটছে। দু’টি প্রতিবেশী দেশের মধ্যে তিনবার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছে।
উপমহাদেশ বিভক্তির বিয়োগান্ত ঘটনা বহু লেখক ও চিন্তাবিদের বিবেককে আলোড়িত করেছে। এ নিয়ে কত বইপত্র লিখা হয়েছে তার হিসাব নেই। তবে এ ঘটনা অবলম্বনে ভারতের বিখ্যাত লেখক ও সাংবাদিক খুশবন্ত সিংয়ের লেখা ‘ট্রেন টু পাকিস্তান’ নামে একটি উপন্যাস সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত উপন্যাসটিতে উপমহাদেশ বিভক্তির বিষময় চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সদ্যোজাত ভারত থেকে লাখ লাখ মুসলমানকে খালি হাতে পাকিস্তানে এবং একইভাবে পাকিস্তান থেকে লাখ লাখ হিন্দু ও শিখকে ভারতে পাড়ি জমাতে হয়েছে। তখন ট্রেনই ছিল যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম। উদ্বাস্তু বহনকারী ট্রেনগুলোতে লুটতরাজ চালানো হয়। সীমান্ত পারাপারের সময় ট্রেন লাইনচ্যুত করে পরিকল্পিতভাবে নরহত্যা চালানো হতো। শত শত লাশ নিয়ে ট্রেনগুলো গন্তব্যে পৌঁছাতো। খুশবন্ত সিংয়ের উপন্যাসের এ মানবিক বিপর্যয়ই স্থান পেয়েছে।
১৯৪৭ সালের ৩০ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশরা ঘোষণা করে যে, তারা ১৯৪৭ সালের ৩০ জুনের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে। এ ঘোষণা সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে ১৯৪৭ সালের ৩ জুন ভারত বিভক্তির পরিকল্পনা এবং ১৫ আগস্টের মধ্যে ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘোষণা দেয়া হয়। ৩ জুন বা ‘মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনার ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান ডোমিনিয়ন নামে উপমহাদেশে দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ব্রিটিশ ভারতের শেষ ভাইসরয় অ্যঅডমিরাল লর্ড মাউন্টব্যাটেন ১৯৪৭ সালের ৩ মে এ পরিকল্পনা পেশ করেন। তার পরিকল্পনা ‘মে পরিকল্পনা’ হিসেবে পরিচিত।
কংগ্রেস সভাপতি পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু মে পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, এ পরিকল্পনা ভারতকে বলকানীকরণের একটি প্রচেষ্টা। মে পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় পরবর্তী মাসে আরেকটি পরিকল্পনা পেশ করা হয়। এ পরিকল্পনা ‘৩ জুন পরিকল্পনা’ হিসেবে পরিচিত।
১৯৪৭ সালের জুন নাগাদ কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ উপলব্ধি করতে সক্ষম হন যে, অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরই ডাইরেক্ট অ্যাকশন এবং সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বিস্তার রোধের একমাত্র উপায়। সরদার প্যাটেল মন্তব্য করেন যে, ‘বিশৃঙ্খল, গোলাযোগপূর্ণ ও দুর্বল বৃহত্তর ভারতের চাইতে আয়তনে অপেক্ষাকৃত ছোট একটি ঐক্যবদ্ধ ভারতই উত্তম।’ কংগ্রেস ও মুসলিম লিগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ম্যারাথন বৈঠক শেষে ১৯৪৭ সালের ৩ জুন মাউন্টব্যাটেন তার পরিকল্পনা বলেন :
হ পাঞ্জাব ও বঙ্গদেশের প্রাদেশিক পরিষদের অমুসলিমপ্রধান জেলাগুলো থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ দু’টি গ্রুপে অধিবেশনে মিলিত হবেন। দু’টি গ্রুপের কোনো একটি গ্রুপ প্রদেশে বিভক্তির অনুকূলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে ভাইসরয় সংশ্লিষ্ট প্রদেশের ভৌগোলিকভাবে সন্নিহিত মুসলিমপ্রধান ও অমুসলিমপ্রধান অঞ্চলগুলোর সীমানা নির্ধারণে একটি বাউন্ডারি কমিশন নিয়োগ করবেন।
হ সিন্ধুর প্রাদেশিক পরিষদ বিদ্যমান গণপরিষদ নাকি নয়া গণপরিষদে যোগদান করবে সে ব্যাপারে তাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
হ উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে একটি গণভোট অনুষ্ঠান করতে হবে।
হ ভারত অথবা পাকিস্তানে যোগদান প্রশ্নে বেলুচিস্তানকেও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
হ বঙ্গদেশের প্রাদেশিক পরিষদ বিভক্তির প্রস্তাব গ্রহণ করলে আসামের সিলেট জেলা আসামের অংশ হিসেবে থাকবে নাকি নয়া প্রদেশের সঙ্গে যোগদান করবে সে প্রশ্নে সেখানে একটি গণভোটের আয়োজন করতে হবে।
হ ডোমিনিয়ন মর্যাদায় দু’টি উত্তরাধিকারী রাষ্ট্রের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করে ভারত ও পাকিস্তানকে ব্রিটিশ কমনওয়েলথে রাখার উদ্দেশ্যে এ ধরনের মর্যাদা দানের ব্যবস্থা রাখা হয়।
হ দেশীয় রাজ্যগুলোর দু’টি ডোমিনিয়নের যে কোনোটিতে যোগদান কিংবা স্বাধীন থাকার সুযোগ থাকবে। এসব রাজ্যের সীমানা নির্ধারণে একটি বাউন্ডারি কমিশন গঠন করা হবে।
১৪ জুন কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি বঙ্গদেশ ও পাঞ্জাব বিভক্তি অনুমোদন করে এবং একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। এ প্রস্তাবের আলোকে ‘র্যাডক্লিফ লাইন’ অনুযায়ী দু’টি দেশের সীমানা নির্ধারণ করা হয়। ব্রিটিশ সরকার আইনজীবী স্যার সিরিল র্যাডক্লিফের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করে। এ কমিশনের রিপোর্ট ‘র্যাডক্লিফ লাইন’ বা ‘র্যাডক্লিফ রোয়েদাদ’ হিসাবে পরিচিত। ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন দু’টি অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হয়। একটি অঞ্চল ছিল বর্তমান বাংলাদেশ বা পূর্ব পাকিস্তান এবং অন্যটি বর্তমান পাকিস্তান বা পশ্চিম পাকিস্তান। ব্রিটিশ ভারতের হিন্দুপ্রধান অঞ্চলগুলো নিয়ে গঠিত হয় ভারত এবং মুসলিমপ্রধান অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান।
১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টে অনুমোদিত ‘ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্স অ্যাক্ট’-এর আওতায় উপমহাদেশ বিভক্ত করা হয়। দু’টি নয়া ডোমিনিয়নের আইনগত কাঠামো নির্ধারণে ১৯৩৫ সালে প্রণীত ‘গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট’ গ্রহণ করা হয়। ব্রিটিশ ভারত বিভক্তির পর পাকিস্তান জাতিসংঘের নয়া সদস্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়। হিন্দুপ্রধান প্রদেশগুলো নিয়ে গঠিত অন্য ডোমিনিয়ন ভারত ইউনিয়ন হিসেবে পরিচিতি গ্রহণ করে এবং দেশটি ব্রিটিশ ভারত জাতিসংঘের সদস্য ছিল।
৫৬২টি দেশীয় রাজ্যকে ভারত অথবা পাকিস্তানে যোগদানের স্বাধীনতা দেয়া হয়। পাঞ্জাব ও বাংলা বিভক্তি নিয়ে গোলযোগ দেখা হয়। ব্রিটিশ ভারতের সকল প্রদেশ ও দেশীয় রাজ্য হয়তো পুরোটাই যোগ দিয়েছিল ভারতে নয়তো পাকিস্তানে। কিন্তু পাঞ্জাব ও বঙ্গদেশের ক্ষেত্রে এ নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটে। এ দু’টি প্রদেশকে বিভক্ত করা হয় কোথাও কোথাও জেলায় জেলায়, কোথাও মহকুমায় মহকুমায়, কোথাওবা মহকুমা কিংবা গ্রাম পড়ে মুসলিমপ্রধান পাকিস্তানে। আবার কোথাওবা মুসলিমপ্রধান জেলা, মহকুমা অথবা গ্রাম পড়ে হিন্দুপ্রধান ভারতে।
উপমহাদেশ বিভক্তিকালে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনী, ভারতীয় সিভিল সার্ভিস, ভারতীয় রেলওয়ে ও কেন্দ্রীয় অর্থ তহবিলসহ অন্যান্য সম্পদ বণ্টন করা হয়। ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যাক্ট, ১৯৪৭-এর আওতায় ভারত বিভক্তি ও ব্রিটিশ ভারতীয় সা¤্রাজ্য বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। ভারত বিভক্তিতে ১ কোটি ২৫ লাখ মানুষ উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়। নিহত হয় কমপক্ষে ১০ লাখ লোক। ১৯৭৪ সালের ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে ভারত ও পাকিস্তান নামে দু’টি দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। ভারতের শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন যাতে যোগ দিতে পারেন সেজন্য ১৪ আগস্ট করাচিতে পাকিস্তানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। পাকিস্তান সার্বভৌম ভারতের কাছ থেকে পৃথক হয়ে যাচ্ছে এমন একটি ধারণা এড়িয়ে যাওয়া ছিল একদিন আগে এ অনুষ্ঠান আয়োজন করার উদ্দেশ্য। অন্য দিকে ভারত ১৫ আগস্টকে স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করছে। বিভক্তির পর পাকিস্তানে স্থানীয় সময় চালু হওয়ায় দেশটি ১৪ আগস্ট স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করছে। বর্তমান পাকিস্তান ও সাবেক পশ্চিম পাকিস্তানের স্থানীয় সময় ছিল ভারতের চেয়ে ৩০ মিনিট পেছনে। বর্তমান বাংলাদেশ বা সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের স্থানীয় সময় ছিল ভারতের চেয়ে ৩০ মিনিট এগিয়ে। সুতরাং টেকনিক্যালি ১৪ ও ১৫ আগস্টের মধ্যবর্তী রাত ছিল দু’দেশের স্বাধীনতা লাভের সময়। ভারতের কাছে যখন ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয় তখন সাবেক পশ্চিম পাকিস্তান সময় ছিল ১৪ আগস্ট রাত সাড়ে ১১টা। ইউনিয়ন জ্যাক বা ব্রিটিশ পতাকা নামিয়ে চাঁদ তারা শোভিত সবুজ পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়। ভারতের তিনরঙা পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে দেশটির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়। ক্ষমতা গ্রহণের ঐতিহাসিক মুহূর্তে নেহেরু তার বিখ্যাত ভাষণ ‘ট্রিস্ট উইথ ডেস্টিনি’ প্রদান করেন।
ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করলে ইতিহাসের বৃহত্তম অভিবাসন শুরু হয়। সীমান্ত প্রতিষ্ঠিত হওয়া মাত্র ১ কোটি ৪৫ লাখ লোক সীমানা অতিক্রম করে। পাকিস্তানি অংশে বসবাসকারী প্রায় ৭৫ লাখ হিন্দু ও শিখ ভারতে এবং ভারতীয় অংশে বসবাসকারী ৭০ লাখ মুসলমান পাকিস্তানে অভিবাসন করে। কোথাও অভিবাসন ঘটেছিল স্বেচ্ছায় কোথাওবা বলপ্রয়োগে। এক পক্ষ অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে সহিংসতায় লিপ্ত হওয়ায় গান্ধী আমরণ অনশন করতে বাধ্য হন। আক্ষরিক অর্থে ৩০ লাখ লোক নিখোঁজ হয়ে যায়। ২০ শতাংশ মুসলমান ভারতে অবস্থান মেনে নেয়। পশ্চিমবঙ্গে থেকে যায় ২৫ শতাংশ মুসলমান। অন্য দিকে ৩০ শতাংশ হিন্দু পূর্ববঙ্গে অবস্থান করতে থাকে। বঙ্গদেশ বিভক্তি সত্ত্বেও পূর্ববঙ্গে সহিংসতার মাত্রা ছিল খুবই নগণ্য। বিভক্তির প্রথম দু’বছর বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানরা নিজেদের স্বধর্মের দেশে অভিবাসন করে। ১৯৭৪ সালের বাদবাকি সময়ে ১০ লাখ লোক এক দেশ থেকে অন্য দেশে স্থানান্তরিত হয়। এক হিসাবে বলা হয়েছে যে, ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত ৫০ লাখ হিন্দু পূর্ব থেকে উচ্ছেদকৃত ৭২ লাখ ২৬ হাজার মুসলমান পাকিস্তানে পাড়ি জমায়। একইভাবে পাকিস্তান থেকে উচ্ছেদকৃত ৭২ লাখ ৪৯ হাজার হিন্দু ও শিখ ভারতে আশ্রয় নেয়। পশ্চিমে ১ কোটি ১২ লাখ বা ৭৮ শতাংশ লোক বিনিময় করা হয়। সবচেয়ে বেশি লোক বাস্তুচ্যুত হয় পাঞ্জাবে। ভারত থেকে ৫৩ লাখ মুসলমান পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে স্থানান্তরিত হয়। অনুরূপভাবে পাকিস্তান থেকে ৩৪ লাখ হিন্দু ও শিখ ভারতের পূর্ব পাঞ্জাব রাজ্যে স্থানান্তরিত হয়। নবগঠিত দু’টি দেশের সরকার এত বিপুলসংখ্যক লোকের অভিবাসন এবং সীমান্তের উভয় পাশে ব্যাপক সহিংসতা ও নরহত্যা মোকাবিলার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। এক হিসাবে বলা হয়েছে যে, ৫ লাখ লোক হত্যাকান্ডের শিকার হয়। কম করে হিসাব করলে ২ লাখ এবং বেশি করে হিসাব করলে অন্তত ১০ লাখ লোকের মৃত্যু হয়। ৫৫ লাখ শরণার্থী আশ্রয় নেয় তারা মূলত এসেছিল ভারতের পূর্ব পাঞ্জাব, হরিয়ানা, হিমাচল, জম্মু ও কাশ্মির এবং রাজস্থান থেকে। সিন্ধুতে যেসব শরণার্থী বসতি স্থাপন করে তাদের অধিকাংশ এসেছিল ভারতের উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ গুজরাট ও রাজস্থান থেকে। ওয়াগাহ ও মোনাবাও সীমান্ত পথে তারা সিন্ধুতে প্রবেশ করে। কমসংখ্যক মুহাজির বিমান ও জাহাজে করে এসেছিল।
উর্দুভাষী মুহাজিরদের বেশিরভাগ সিন্ধুর বন্দর নগরী করাচি, হায়দরাবাদ, শুক্কুর, নওয়াবশাহ ও মিরপুরখাসে বসতি স্থাপন করে। এ ছাড়া বহু উর্দুভাষী মুহাজির পাঞ্জাবের লাহোর, মুলতান, বাহওয়ালপুর ও রাওয়ালপিন্ডিতে বসতি গড়ে তোলে। সিন্ধুতে অভিবাসীদের সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ৪০ হাজার। তাদের দুই-তৃতীয়াংশ ছিল শহুরে। ১৯৪৭ সালে করাচির জনসংখ্যা ছিল ৪ লাখ। ১৯৫৩ সালে এ নগরীর লোকসংখ্যা দাঁড়ায় ১৩ লাখে।
(চলবে)
আপনার মন্তব্য লিখুন