post

বাংলাদেশের রাজনীতি সরকার ও বিরোধী দল (১৯৭১

গাজী নজরুল ইসলাম

০১ জুলাই ২০২৪

রাজনীতি বা রাষ্ট্রনীতি হলো দলীয় বা নির্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মধ্যে ক্ষমতার সম্পর্কের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ বিষয়ক কর্মকাণ্ডের সমষ্টি। উদাহরণস্বরূপ, সম্পদের বন্টন হলো এমন একটি কর্মকাণ্ড।

অপরপক্ষে-রাজনীতি হলো, কর্তৃত্ব ও ক্ষমতার ভিত্তিতে গঠিত সামাজিক সম্পর্ক। উইলিয়াম কেরি রাজনীতি শব্দের অর্থ করেছেন রাজ্য (the king) + নীতি (Justice), অর্থাৎ রাজার ‘ন্যায় বিচার’। ইংরেজি পলিটিক্স শব্দটি এসেছে অ্যারিস্টটলের ধ্রুপদী রচনা politika/পলিটিকা থেকে যা প্রাচীন গ্রীক শব্দ থেকে উদ্ভূত। (উইকিপিডিয়া)

উইকিপিডিয়া তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশের রাজনীতি একটি সংসদীয় প্রতিনিধিত্বশীল গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যে সংঘটিত হয় যেখানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সরকারের প্রধান এবং এটি একটি বহুদলীয় সরকার ব্যবস্থা।

(প্রথম পর্ব) :
বাংলাদেশের রাজনীতির অতীত প্রেক্ষাপট

১০ জানুয়ারি ১৯৭২, মুক্তির পর মরহুম প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং পরে প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৭০ সালের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা নতুন রাষ্ট্রের অস্থায়ী সংসদ গঠন করেন। মুক্তিবাহিনী ও অন্যান্য মিলিশিয়াদের একত্রিত করে একটি নতুন বাংলাদেশী সেনাবাহিনী গঠন করা হয়। যাদের কাছে ভারতীয় বাহিনী ১৭ মার্চ তাদের নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তর করে। ১৯৭২ সালে নতুন একটি সংবিধান ঘোষণা করা হয় এবং ঐ সংবিধানের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিব ও তার দল সংখ্যাগরিষ্ঠতার সাথে জয়লাভ করেন। শেখ মুজিবের ক্ষমতার উচ্চতায়, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সশস্ত্র শাখা গণবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত বামপন্থী বিদ্রোহীরা একটি মার্কসবাদী সরকারের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে সরকার জাতীয় রক্ষী বাহিনী গঠন করে বামপন্থী বিদ্রোহী দমনে কঠোর ভূমিকা রাখে। দমন অভিযানসমূহ পরিচালনার পাশাপাশি সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধেও নৃশংস মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ চাঞ্চল্যকর রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডেরও সুকঠিন অভিযোগ উত্থাপিত হয়। ওই সময়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অনেকেই জাতীয় রক্ষী বাহিনীর আচরণে অসন্তুষ্ট ছিলেন। ১৯৭৫ সালের  ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর ক্ষুদ্ধ একটি দলের দ্বারা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পরিসমাপ্তি ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশে বহুল আলোচিত  মুজিব অধ্যায়ের।

দ্বিতীয় পর্ব (১৯৭৫-৮০) :
সামরিক অভ্যুত্থান এবং প্রেসিডেন্সিয়াল শাসন

১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিচারপতি জনাব সায়েম সাহেবের কাছ থেকে জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি এবং সিএমএলএ-এর পদ গ্রহণ করেন। ১৯৭৮ সালের জুন মাসে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পর জেনারেল জিয়া তার রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষকে গণতান্ত্রিকরূপ প্রদানের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। দেশীয় মুসলিম ঐতিহ্যের ওপর জোর দিয়ে জেনারেল জিয়া একটি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী ধারণার ঐতিহ্যকে তুলে ধরেন। ১৯৭৯ সালে সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, ঐ নির্বাচনে বিএনপি ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে পরিগণিত হয়। রাষ্ট্রপতি জিয়া বাংলাদেশে সর্বপ্রথম বহুদলীয় গনতন্ত্রের প্রবর্তনসহ সংবিধানে মুক্তবাজার অর্থনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। সমাজতন্ত্রকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার হিসেবে পুনঃসংজ্ঞায়িত করেন। তিনি তার বৈদেশিক নীতিমালায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার সাথে কাজ করার ওপর জোর দেন। প্রেসিডেন্ট জিয়ার নেতৃত্বে দেশে দ্রুত অর্থনীতি ও শিল্পায়নের উদ্যোগ বৃদ্ধি পায়। তিনি একটি জনপ্রিয় খাদ্য কর্মসূচি পরিচালনা করেন। প্রেসিডেন্ট জিয়া তার শাসনামলে ২১টি অভ্যুত্থানের মোকাবিলা করেন। যার মধ্যে একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা ছিল বিমান বাহিনীর তার এক সময়কার একান্ত সহকারী কর্নেল আবু তাহেরকে দেশদ্রোহীতার জন্য গ্রেফতার এবং মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা। এ ধারাবাহিকতায় সশস্ত্র বাহিনীতে তার অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে অনেকেরই ওই একই রকম পরিণতি ভোগ করতে দেখা যায়।  

আরো একটি চূড়ান্ত অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টায় ১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের সার্কিট হাউজে রাত্রি যাপনকালে নির্মমভাবে নিহত হন।

তৃতীয় পর্ব (১৯৮১-১৯৮২) :
বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের আমল

জিয়াউর রহমানের পর রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন উপরাষ্ট্রপতি বিচারপতি জনাব আব্দুস সাত্তার। যদিও তিনি নির্বাচনে জনসাধারণ কর্তৃক নির্বাচিত হন তবুও তার তৎকালীন প্রতিদ্বন্দ্বী ড. কামাল হোসেন তাকে ভোটে কারচুপির জন্য অভিযুক্ত করেন।

তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপির অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের কারণে বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের প্রেসিডেন্সি মন্ত্রিসভার পুনর্বিন্যাস ঘটানো হয় এবং উপরাষ্ট্রপতির পদ থেকে মির্জা নুরুল হুদা পদত্যাগ করেন। ওই সময়ে উত্তর-পূর্ব ভারতে বিদ্রোহ এবং বার্মায় মুসলিম সহিংসতা ঘটনার প্রেক্ষাপটে দেশে একটি জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ গঠন করা হয়। জনাব আব্দুস সাত্তার সাহেব বয়স্কতার কারণে স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগতে থাকেন। এমতাবস্থায় ১৯৮২ সালে দেশে জেনারেল এরশাদের নেতৃত্বে আরেকটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে এবং রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তার ও তার বেসামরিক সরকারকে বহিষ্কার করে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন।

চতুর্থ পর্ব (১৯৮৩-১৯৯০) :
হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদের আমল

লেফটনেন্ট জেনারেল হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ  সামরিক আইন জারি করেন এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহন করেন। তিনি মন্ত্রী পরিষদের রাষ্ট্রপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন এবং ডেপুটি মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটর হিসেবে নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনী প্রধানদের নিয়োগ দেন। জনাব এরশাদের মার্শাল ল’ শাসনের অধীনে রাজনৈতিক নিপীড়ন ব্যাপক মাত্রায় বৃদ্ধি পায়। তবে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণে এরশাদ সরকার এক যুগান্তকারী ভূমিকা রেখে দেশের ১৯ টি জেলাকে ৬৪ টি জেলায় বিন্যাস করেন এবং থানাগুলোকে উপজেলা পরিষদে উন্নয়ন করে উপজেলা ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন।

এরশাদ সাহেব তৎকালীন সোভিয়েত বিরোধী জোটের পক্ষে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি জোরদার করেন এবং ১৯৮৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হন। তার কার্যক্রমের অন্যতম ছিল মূলত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অর্থনীতি, হালকা উৎপাদন, কাঁচামাল ও সংবাদপত্রসহ ভারী শিল্পে ব্যক্তি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা এবং বিদেশি কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশে বিনিয়োগে আহ্বান জানানো। তিনি দুর্নীতি ও রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান চালু করেন এবং সমস্ত রাজনৈতিক দল ও ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এরপর সংসদ ভেঙে দিয়ে ১৯৮৮ সালের মার্চ মাসে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত করেন। দেশের সকল বিরোধীদল ওই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে। ক্ষমতাসীন জাতীয় পার্টি ৩০০ আসনের মধ্যে ২৫১ টি আসন লাভ করে। ১৯৮৮ সালের জুন মাসে সংসদে প্রায় সহস্রাধিক বিল পাস হয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংযোজন এবং ঢাকার বাইরের শহরগুলোতে উচ্চআদালত গঠন করে বিচার  কার্যক্রম পরিচালনা করা। পরবর্তীতে শহরগুলোতে হাইকোর্টের বিকেন্দ্রীকরণের বিধান সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ের ভিত্তিতে স্থগিত করা হয়।

পঞ্চম পর্ব (১৯৯০-১৯৯১) :
প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার 

জেনারেল এরশাদের শাসনকাল নির্মম স্বৈরাচারের শাসন হিসেবে আখ্যায়িত হয় এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯০ সালে জেনারেল এরশাদ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ওই সময়ে বিএনপি, আওয়ামীলীগ ও জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে পরিচালিত গণতান্ত্রিক এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলন সমগ্র দেশকে আচ্ছাদিত করে তোলে এবং আন্দোলনে দেশের মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তসহ সকল শ্রেণীর জনগণ অংশগ্রহণ করে। প্রধান বিচারপতি জনাব শাহাবুদ্দিন আহমদ ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন এবং দেশে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন এরশাদ সাহেবকে জনরোষের ক্ষুব্ধতায় গ্রেফতার করেন এবং ১৯৯১ সালে দেশের প্রথম প্রচলিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি সফল অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সক্ষম হন।

ষষ্ঠ পর্ব (১৯৯১-১৯৯৬) :
বিএনপির শাসনামল

নির্বাচনে দেশের মধ্যডানপন্থী দল বিএনপি বহু সংখ্যক আসনে জয়লাভ করে এবং তত্ত্বাবধায়ক ফর্মুলার প্রবর্তক জামায়াতে ইসলামী এবং তাদের বিজয়ী সংসদ সদস্যদের সমর্থনে দেশে একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করে। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বিধবা স্ত্রী খালেদা জিয়াকে দেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অধিষ্ঠিত করা হয়। ওই সময়ে জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ দুর্নীতির অভিযোগে কারাগারে বন্দি থাকেন। বেগম জিয়ার প্রধানমন্ত্রিত্বে জাতীয় সংসদে সংবিধানের ব্যাপক পরিবর্তন সংশোধন ও পরিবর্ধন করে দেশে ১৯৭২ সালের মৌলিক সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শাসিত শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। 

তৎকালীন অর্থমন্ত্রী জনাব সাইফুর রহমান একটি উদার অর্থনৈতিক সংস্কারের কাজ শুরু করেন, যা দক্ষিণ এশিয়ায় একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে এবং ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় মডেল হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় ওই সময়ে ১৯৯৪ সালের মার্চ মাসে একটি সংসদীয় উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়, এতে তৎকালীন বিরোধী দল এও দাবি করে যে খালেদা জিয়া অবৈধভাবে ক্ষমতায় এসেছেন। সমগ্র বিরোধী দলও অনির্দিষ্টকালের জন্য সংসদ বয়কট করে এবং বেগম খালেদা জিয়ার পদত্যাগ দাবি করে। সাথে সাথে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি নিরপেক্ষ শান্তিপূর্ণ অবাধ অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য দেশে আন্দোলন শুরু করে বারবার হরতালের কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়। বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিগোচর হয়। তৎকালীন কমনওয়েলথ সচিবালয়ের সহায়তায় বিতর্কিত মধ্যস্থতার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে সংসদ থেকে বিরোধীদল পদত্যাগ করে এবং রাজপথে ব্যাপক হারে মিছিল, বিক্ষোভ ও হরতালের কর্মসূচি পালিত  হয়। এ সময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়কীয় ব্যবস্থাকে সংবিধানে সংযোজন করারও দাবি উপস্থাপন করে এবং ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচন বয়কট করার অঙ্গীকার করে। ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়ে যাওয়ার পর তৎকালীন সংসদে সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক নির্বাচন অনুষ্ঠানের নতুন সংসদীয় নির্বাচন পরিচালনার পদ্ধতি চালুর অনুমোদন সাংবিধানিকভাবে গৃহিত হয়।

সপ্তম পর্ব :
দ্বিতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার

প্রধান বিচারপতি মোঃ হাবিবুর রহমান দেশের সাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে প্রথম প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অভিষিক্ত হন। ওই সময়ের রাষ্ট্রপতি জনাব আব্দুর রহমান বিশ্বাস সেনাবাহিনী প্রধান লেফটেনডেন্ট জেনারেল আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসীমকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার কারণে বরখাস্ত করেন, ফলে সেনাবাহিনীর মধ্যে আকস্মিক অভ্যুত্থানের শঙ্কা দেখা দেয়। বরখাস্ত সেনাবাহিনী প্রধান জনাব নাসিম বগুড়া, ময়মনসিংহ ও যশোরের সৈন্যদলসহ ঢাকায় যাওয়ার জন্য তার অনুগত বাহিনীকে নির্দেশ দেন। এহেন অবস্থায় সাভারের সামরিক কমান্ডার দেশের রাষ্ট্রপতির পক্ষাবলম্বন করেন এবং রাজধানী ও তার আশেপাশের মহাসড়কে ট্যাংক মোতায়েন করে অভ্যুত্থানকারী বাহিনীকে দমন করার জন্য অপারেশনের অংশ হিসেবে ফেরী চলাচল বন্ধ করে দেন। পরে লে. জেনারেল নাসিমকে ঢাকা সেনানিবাসে গ্রেফতার করা হয় এবং সেনা বিদ্রোহ দমনে সফলতা আসে।

এরপর ১৯৯৬ সালের ১২ জুন তারিখে প্রধান উপদেষ্টা জনাব হাবিবুর রহমান সফলভাবে একটি স্বাধীন ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করেন। এ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ ১৪৬ টি আসনে জয়লাভ করে বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। বিএনপি ১১৬টি আসন, জাতীয় পার্টি ৩২টি আসন এবং জামায়াতে ইসলামী ৩টি আসন লাভ করে।

অষ্টম পর্ব (১৯৯৬-২০০১) :
আওয়ামী শাসনামল

শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালের জুন মাসে ‘জাতীয় ঐক্যমতের সরকার’ নামক একটি সরকার গঠন করেন যার মধ্যে ছিল জাতীয় পার্টির একজন মন্ত্রী এবং জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এর একজন মন্ত্রী। বলাবাহুল্য জাতীয় পার্টি তখনও কোনো আনুষ্ঠানিক জোটে প্রবেশ করেনি বরং পার্টির প্রেসিডেন্ট জনাব এরশাদের সিদ্ধান্তে ১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরে আওয়ামীলীগ সরকারের থেকে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেন এবং পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালের জানুয়ারিতে জনাব এরশাদকে মুক্তি দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণ নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের মতে ১৯৯৬ সালের জুন মাসের নির্বাচন ছিল মুক্ত, অবাধ এবং ন্যায্য। শেষতক বিএনপি ওই সংসদে যোগ দেয় এবং বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে।

হাসিনা প্রশাসন ওই সময়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কার্যক্রমে সফলতা লাভ করে। (এক) ভারতের সাথে গঙ্গার পানি ভাগ চুক্তি, (দুই) ঢাকায় এক আন্তর্জাতিক ত্রিপক্ষীয় সম্মেলনের আয়োজন; যে সম্মেলনে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরীফ, ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আই কে গুজরাল এবং আমেরিকার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিন্টন যোগদান করেন। এরপরেও হাসিনা সরকারের একদলীয় ও একদেশদর্শী মানসিকতায় রাষ্ট্র পরিচালনায় জুলুম-অত্যাচার প্রভৃতি অভিযোগে বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি ১৯৯৭ সালে ৬ দিনের হরতাল থেকে শুরু করে ১৯৯৯ সালে ২৭ দিনের হরতাল পর্যন্ত ব্যাপক আন্দোলনী কর্মসূচী পালন করে।

১৯৯৯ সালের শুরুতে গঠিত হয় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় বিরোধী জোট এবং ঘোষণা করা হয় যে নির্বাচনী বৈষম্য দূর করার জন্য সরকারি নেতৃত্ববৃন্দের পক্ষ থেকে কার্যকরী পদক্ষেপ না পাওয়া পর্যন্ত কোন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে না। শেখ হাসিনার সরকার ওই পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় বিএনপি পরবর্তীতে ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯ সালের পৌর নির্বাচনে এবং ২০০০ সালের চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন বর্জন করে। 

নবম পর্ব (২০০১-২০০৬) :
চারদলীয় জোট সরকার

বিএনপি ১৪ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০০১ আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে জাতীয় ধর্মঘটের ডাক দেয়। এপ্রিলে রাজপথে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে কিছু লোকের মৃত্যু ঘটে, অনেকেই আহত হন। শেখ হাসিনা ১৫ জুলাই ২০০১ পদত্যাগ করেন এবং ১৬ জুলাই ২০০১ বিচারপতি লতিফুর রহমান এর নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয় এবং তার নেতৃত্বে ২ সেপ্টেম্বর ২০০১ সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ৩০০ আসনের মধ্যে ২১৪ টি আসন লাভ করে, আওয়ামীলীগ পায় ৬২টি আসন। নির্বাচন সংক্রান্ত সহিংসতায় প্রায় ২৩০ জন নিহত হয়। নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেন আওয়ামীলীগ নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৪ অক্টোবর ২০০১ ঢাকার কাছে রাজনৈতিক সহিংসায় তিন ব্যক্তি নিহত হয়। নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় কয়েক হাজার সংখ্যালঘু বাস্তুচ্যুত হয়। বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া ১০ অক্টোবর ২০০১ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন এবং জোট সরকার গঠন করেন। আওয়ামী লীগ ৩০ অক্টোবর ২০০১ থেকে শুরু হওয়া জাতীয় পরিষদ বয়কট করে এবং ২৪ জুন ২০০২-এ সংসদ বয়কট শেষ করে। ২৮ সেপ্টেম্বর ২০০২ সাতক্ষীরায় বোমা হামলায় ১০ জন নিহত হয়। সরকার ২০০২ সালের অক্টোবর থেকে ২০০৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ‘‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’’ চালু করে। এর ফলে প্রায় ৩০০ জনকে গ্রেফতার এবং সামরিক হেফাজতে প্রায় ৪০ জনের মৃত্যু হয়। ২০০২ সালের ৭ ডিসেম্বর ময়মনসিংহে বোমা হামলায় ১৭ জন এবং ২০০৩ সালের ১৭ জানুয়ারি দারিয়াপুরে বোমা হামলায় ৭ জন নিহত হয়। এভাবে সারাদেশে এক অরাজক অস্থির পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় ২৫ জানুয়ারি থেকে ১৬ মার্চ ২০০৩ দেশে স্থানীয় পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় ৮০ জন মানুষ নির্বাচন সংক্রান্ত সহিংসতায় নিহত হয়। এ ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালের ৭ আগস্ট সিলেট শহরে আওয়ামী লীগের এক নেতা নিহত হন। ২১-২২ আগস্ট ১৯ জন নিহত হন। বিএনপি জোট সরকার ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে জামাতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) এবং জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ (জেএমজেবি) নামের দুটি ইসলামিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ১৭ অক্টোবর ২০০৫ হরকত-উল-জিহাদ আল-ইসলামী (এইচজেআই) নামক একটি ইসলামী দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ২৪ অক্টোবর ২০০৫ খুলনায় বোমা হামলায় বিএনপির সদস্য মিজানুর রহমান নিহত হন। ১৪ নভেম্বর ২০০৫ দুজন সরকারি কর্মকর্তা (বিচারক) ঝালকাঠিতে বোমা হামলায় নিহত হন। আওয়ামীলীগ ৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৬ পর্যন্ত তাদের বছরব্যাপী সংসদ বয়কট চালু রাখে। ৩০ মে ২০০৬ নিষিদ্ধ ঘোষিত জামাতুল মুজাহিদিনের নেতা শাইখ আব্দুর রহমানসহ সাতজনকে ঝালকাঠিতে বোমা হামলায় জড়িত থাকার অপরাধে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। ডিসেম্বর ২০০৬ সালের ২ জুলাই ঢাকায় সোনারগাঁও-এ রাজনৈতিক সহিংসতায় চারজন সরকারি পুলিশসহ দুব্যক্তি নিহত হয়। এভাবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের পাঁচটি বছর সারাদেশে হরতাল-অবরোধ, সংসদ বয়কট, সহিংসতা ও খুন-হত্যায় বিরোধী দল আওয়ামীলীগ এবং জঙ্গি সংগঠনগুলো দেশে নৈরাজ্য এবং উত্তপ্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে জোট সরকারকে নিদারুন বিব্রত  রাখার অপচেষ্টা চালায়।

দশম পর্ব (২০০৬-২০০৮) :
মাইনাস টু ফর্মুলা ও ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিনের আমল

প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ২০০৬ সালের ২৭ অক্টোবর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা স্থানান্তরের কথা থাকলেও সাবেক প্রধান বিচারপতি কে এম হাসান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের পদ প্রত্যাখ্যান করলে বেগম জিয়া সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডক্টর ইয়াজউদ্দীন সাহেবের কাছে ২৯ শে অক্টোবর ২০০৬ ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। সুচতুর আওয়ামী লীগ সুযোগ বুঝে ২৮ অক্টোবর ২০০৬ সারা দেশে লগী-বৈঠার তাণ্ডব চালিয়ে শুধুমাত্র ঢাকায় ওই দিনেই লগি-বৈঠার আক্রমণে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ১৮ জন মানুষকে হত্যা করে এবং ডিসেম্বর ২০০৬ পর্যন্ত সারা দেশে প্রায় আরো ৪৫ জনকে হত্যা করে। আওয়ামী লীগ আরো ১৪টি বিরোধী দলসহ ২৮ অক্টোবর ২০০৬ থেকে সারা দেশে সড়ক পথ অবরোধ করে জনজীবনে স্থবিরতা সৃষ্টি করে এবং ২৩ নভেম্বর ২০০৬ অবরোধের ডাক দেয়। দেশের এক নাজুক পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের বিশেষ দূত ক্রেগ জেনেম ২৯ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বর ২০০৬ পর্যন্ত দেশের সরকারি কর্মকর্তা এবং বিরোধী দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার বৈঠক করেন এবং সকলের মধ্যে শান্তিপূর্ণ সংলাপের জন্য আহ্বান জানান। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ২১ ডিসেম্বর ২০০৬ তারিখে নির্বাচনী সংস্কারের দাবি জানায়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এ দাবিতে সম্মত হলে ২৪ ডিসেম্বর ২০০৬ তারিখে বিরোধী দলগুলো তাদের নির্বাচন বয়কটের দাবি প্রত্যাহার করে। ৩ জানুয়ারি ২০০৭ আওয়ামী লীগ এবং অন্যান্য বিরোধী দল আসন্ন সংসদ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়। রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন দেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে আসন্ন সংসদ নির্বাচন স্থগিত করেন এবং ১১ জানুয়ারি ২০০৭ এ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১২ জানুয়ারি ২০০৭ জনাব ফখরুদ্দিন আহমদ একটি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন। সেনাপ্রধান মইন ইউ আহমদ নেপথ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে প্রায় ২টি বছর সেনা শাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে দেশ পরিচালনা করেন। তাদের দুই বছরের দেশ পরিচালনার বিশেষ দিক হলো সন্দেহভাজন দূর্নীতিবাজ ধরা, জেলে ঢোকানো এবং অভিনব মাইনাস টু ফর্মূলায় বেগম জিয়া ও শেখ হাসিনাকে নির্বাসনের ব্যবস্থা করা।

একাদশতম পর্ব (২০০৯-২০০১৪) :
আওয়ামী দুঃশাসনের সূচনা

সেনা প্রধান মঈন ইউ আহমদ সমর্থিত ড. ফখরুদ্দিনের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ এবং ১২ জানুয়ারি ২০০৯ তারিখ অনুষ্ঠিত জাতীয়পরিষদের নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৩০টি আসনে জয় লাভ করে। মাত্র ৩০ টি আসনে জয়ী হয়ে বিএনপি কারচুপির অভিযোগ তুলে। ৬ জানুয়ারি ২০০৯ শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। আওয়ামীলীগের জনাব জিল্লুর রহমান ১১ ফেব্রুয়ারী ২০০৯ জাতীয় পরিষদ কর্তৃক রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ২৫ থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে ঢাকার পিলখানায় তৎকালীন বিডিআর-এর সদর দপ্তরে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী এক অজ্ঞাত কারণে আকস্মিক বিদ্রোহ করে। যার ফলে ৭৪ জন দেশপ্রেমিক সেনা অফিসার নির্মমভাবে নিহত হন। ২৭ জানুয়ারি ২০১০ তারিখে ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার সাথে জড়িত থাকার অপরাধে সাবেক ৫ জন সেনা অফিসারকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। ২৫ মার্চ ২০১০ সরকার ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য তিন বিচারকের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল গঠন করে। ২৭ জুলাই ২০১০ সরকারের বিতর্কিত এবং নিপীড়নমূলক কার্যক্রমের বিরোধিতায় বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামী দেশে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়, এর ফলে ২৫ জন আহত হয় এবং ১৫০ গ্রেফতার হন। ২১ জুলাই ২০১০ পাবনা জেলায় বাম উগ্রপন্থীরা তিনজন পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে। ২৫ জুলাই ২০১০ আইসিটি কর্তৃক জামায়াতে ইসলামের আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী এবং সেক্রেটারী জেনারেল জনাব আলী হাসান মো. মুজাহিদসহ দলের চার জন নেতাকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়। ১৫ ডিসেম্বর ২০১০ সরকার হরতালে সহিংসতা উসকে দেওয়ার জন্য বিএনপির একজন সিনিয়র নেতা জনাব সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে গ্রেফতার করে। ২৭ জুন ২০১১ একটি বিশেষ আদালতে ৬৫০ জনের বেশি সীমান্তরক্ষী বিডিআরকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ১১ জানুয়ারি ২০১২ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবকে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংঘটিত যুদ্ধ অপরাধের মাস্টার-মাইন্ড অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। 

সরকার সমর্থিত সৈন্যরা ১৯ জানুয়ারি ২০১২ শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে একটি পরিকল্পিত সামরিক অভিযান প্রতিরোধ করে বলে জানা যায়। বিএনপি ১৮ এপ্রিল ২০১২ সরকারের বিরুদ্ধে ১৮ দলীয় জোট গঠনের ঘোষণা দেয়। সরকারি পুলিশ ও জামায়াত সমর্থকদের মধ্যে রাজপথে সংঘর্ষে ১০ জন এবং ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ কক্সবাজার এবং ঢাকায় যথাক্রমে ৩ জন ও ৪ জন নিহত হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতার জন্য জামায়াতে ইসলামীর নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ঢাকার আইসিটি আদালতে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। এ আদেশের পরের সপ্তাহে পুলিশ ও জামায়াত সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে সারাদেশে প্রায় ৬০ জন নিহত হয়। ২০ মার্চ ২০১৩ অসুস্থতার কারণে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান মারা যান। ৫ ও ৬ মে ঢাকায় পুলিশের সাথে জামায়াতে ইসলামীর বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে ২৭ জন নিহত হয়। ৯ মে ২০১৩ জামায়াত নেতা অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকে আইসিটি কর্তৃক মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ২০ মে ২০১৩ গাজীপুর শহরে ২০০৫ সালের নভেম্বরে আত্মঘাতী বোমা হামলায় জড়িত থাকার অপরাধে ১০ জন জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। জামায়াতের শীর্ষ নেতা অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেবকে ২০১৩ সালের ১৫ জুলাই আইসিটি কর্তৃক ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ১৬ জুলাই ২০১৩ সাতক্ষীরা জেলায় বিক্ষোভে পুলিশের গুলিতে  দুজন জামায়াত কর্মী নিহত হন। ১৭ জুলাই ২০১৩ জামায়াত নেতা কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল জনাব আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদকে আইসিটি কর্তৃক মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জামায়াতের আরেক শীর্ষনেতা জনাব আব্দুল কাদের মোল্লাকে ঢাকায় আইসিটি কর্তৃক মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। ১ অক্টোবর ২০১৩ বিএনপি নেতা জনাব সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে আইসিটি আদালত মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। ২৭ থেকে ২৯ অক্টোবর ২০১৩ বিএনপি জামায়াতের ডাকা সাধারণ ধর্মঘটে পুলিশের গুলিতে ১০ জনেরও বেশি লোক নিহত হয়। ২ নভেম্বর ২০১৩ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এবং আশরাফুজ্জামান খানকে আইসিটি আদালত মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। ৫ নভেম্বর ২০১৩, ২০০৯ সালের বিডিআর বিদ্রোহে জড়িত থাকার অপরাধে প্রায় ১৫২ জন বিডিআরকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ২৫ থেকে ২৭ নভেম্বর ২০১৩ পুলিশের সাথে সংঘর্ষে বিএনপি-জামায়াতের ১৫ জন সমর্থক নিহত হয়। ২৪ নভেম্বর ২০১৩ বাসে বোমা হামলায় ঢাকায় ৪ জন যাত্রী নিহত হয়। ১১ ডিসেম্বর ২০১৩ ঢাকায় জাতিসংঘের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো ঢাকায় সরকার ও বিএনপির মধ্যে মধ্যস্থতার জন্য আলোচনা হয়। ১৩ ও ১৪ ডিসেম্বর ২০১৩ ঢাকায় জামায়াত সমর্থকদের মধ্যে পুলিশের সংঘর্ষে ৬ জন নিহত হয়। এরই মধ্যে ৫ জানুয়ারি ২০১৪ দেশে সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং আওয়ামীলীগ ৩০০ আসনের মধ্যে ২৩৪ আসন লাভ করে, জাপা পায় ৩৪টি। বিএনপিসহ ১৭ টি রাজনৈতিক দল ঐ নির্বাচন বয়কট করে। নির্বাচন সংক্রান্ত সহিংসতায় প্রায় ২০ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়। ১২ মে ২০১৪ বাংলাদেশ ও চীন সরকারের মধ্যে ঢাকায় চারটি সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর হয়। ২৯ অক্টোবর ২০১৪ আমীরে জামায়াত মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীকে যুদ্ধাপরাধ আইনে আইসিটি আদালত কর্তৃক মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়।

দ্বাদশতম পর্ব (২০১৪-২০১৯) :
দুঃশাসনের ২য় মেয়াদ

শেখ হাসিনা, আওয়ামীলীগ এবং তার মহাজোটের মিত্রদের সাথে নিয়ে টানা তিনবার মেয়াদে ক্ষমতাসীন হন। ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে অনির্বাচিত ১৫৩ জন সংসদ সদস্যসহ ২৬৭ আসনে জিতে ভূমিধস জয় লাভ করে দেশে অনায্য পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। 

নির্বাচন পরিচালনায় নির্দলীয় প্রশাসনের অভাবের কারণে নেতৃস্থানীয় বিরোধী দলগুলো ঐ নির্বাচন বর্জন করে। ফলে আওয়ামীলীগ এবারের নির্বাচনে অলৌকিকভাবে ২০০৮ এর নির্বাচনের ফলাফলকে ছাড়িয়ে যায়। এই নির্বাচনে ভারতের সুজাতা সিং এর অলৌকিক হস্তক্ষেপ ছিলো বলে রাজনৈতিকভাবে পরিদৃশ্যমান। নির্বাচনটি বিতর্কিত। সহিংসতায় এবং নির্বাচনের দৌড়ে বিরোধীদের বিরুদ্ধে কথিত ক্রাকডাউন। ১৫৩ আসনে (৩০০ টির মধ্যে) বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পেয়ে আওয়ামী লীগ মোট ২৩৪ টি আসন নিয়ে কথিত নিরাপদ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি আগের কয়েকটি নির্বাচনের তুলনায় অনেক কম ছিল। মজার বিষয় হলো, আওয়ামী লীগের এবারের সরকার বিরোধী দল ছিল কথিত সরকারি বিরোধী দল। কেননা এরশাদের জাতীয় পার্টি আওয়ামী প্রতীক নিয়ে ৩৪ টি আসন পেয়ে সংসদে হাসিনা সরকারের সরকারি বিরোধী দলের এক অদ্ভুত নমুনা স্থাপন করে। বিএনপি চেয়েছিল একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হোক এবং সরকারকে তা বাধ্য করতে বিক্ষোভ-আন্দোলন অব্যাহত রাখার আশা পোষণ করেছিল। কিন্তু ঐ সময় দেশে তথাকথিত ইসলামিক চরমপন্থীদের দ্বারা ক্রমবর্ধমান আক্রমণও দেখা গেছে, যার মধ্যে জুলাই ২০১৬ এর ‘‘ঢাকা হামলা’’ যাকে বিবিসি দ্বারা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে মারাত্মক জঙ্গী হামলা হিসেবে বর্ণনা করা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকার তার রাজনৈতিক বিরোধী দলের পাশাপাশি গণতান্ত্রিক ও নাগরিক অধিকার সংকুচিত করে চরমপন্থী গোষ্ঠীর বিকাশের স্থান তৈরি করে তদ্দ¦ারা ইসলামিক গোষ্ঠীগুলোকে একটি সহিংস প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীতে রুপ দিতে অপকৌশল অবলম্বন করেছে বলে বোদ্ধামহল মনে করেন। 

মার্চ ২০১৭ বাংলাদেশে প্রথম দুটি সাবমেরিন চালু হয়। সেপ্টেম্বর ২০১৭-এ সরকার প্রায় এক মিলিয়ন রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরকে আশ্রয় ও সহায়তা দিয়ে দেশে এবং বিদেশে প্রশংসা কুড়ায়। 

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সামনে ‘‘জাস্টিস মূর্তি’’ অপসারণে শেখ হাসিনার সম্মতি ইসলামপন্থীদের কাছে নত শিকার করা হয়েছে বলে অনেকে মন্তব্য করেন।

ত্রয়োদশতম পর্ব (২০১৯-২০২৩) :
দুঃশাসনের ৩য় মেয়াদ

শেখ হাসিনা এবার টানা চতুর্থ মেয়াদে বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সদিচ্ছায় তৎকালীন প্রধান জোটগুলোর নেতা ড. কামাল হোসেনকে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করে বঙ্গবন্ধুর কন্যা কথা রাখতে পারঙ্গম- এ সুধা বাক্য আপ্ত করে নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮ আসনে জয়লাভ করে। বিরোধীদলের পক্ষ থেকে ড. কামাল এ নির্বাচনকে প্রহসন বলে আখ্যায়িত করলেও বিশ্বখ্যাত এ অর্বাচীন ব্যারিস্টার সাহেবের বিকল্প কিছুই করণীয় ছিল না। কারণ শেখ হাসিনা পূর্বাহ্নেই তাকে বঙ্গবন্ধুর আফিম খাইয়ে বিবশ করে ফেলেছিলেন। নির্বাচনের পূর্বে হিউম্যান রাইটসের এবং অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থাগুলো সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধীদের জন্য ভীতিকর পরিবেশ তৈরির অভিযোগ এনেছিল। নিউইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয় বোর্ড নির্বাচনকে প্রহসনমূলক বলে বর্ণনা করে। সম্পাদকীয়তে মজা করে বলা হয়েছিল, ‘‘শেখ হাসিনা সম্ভবত ভোট কারচুপি ছাড়াই জয়লাভ করতেন কিন্তু কেন জানি তিনি তা করে ফেলেছিলেন এবং তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।’’ বিএনপি এযাবৎ ১২ বছর ক্ষমতার বাইরে আছে। ২০১৪-এর সাধারণ নির্বাচন বর্জন করে মাত্র ৮টি আসন পেয়ে বিড়ম্বিত অবস্থানে কাতরতায় বিভোর ছিল। ২০২১-২২ অর্থ-বছরের শেষ নাগাদ দেশে বৈদেশিক ঋণ $৯৫ থেকে $৮৬ বিলিয়নে পৌঁছেছে, যা ২০১১ সালের তুলনায় ২৩৮% বৃদ্ধি বলে শেখ হাসিনার সরকার অতি উৎসাহী হয়ে প্রচারণা চালায়। অবশ্য জুলাই ২০২২ সালে অর্থমন্ত্রণালয়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-এর কাছে আর্থিক সহায়তার অনুরোধে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া হিসেবে বৈদেশিক রিজার্ভ হ্রাস পেয়েছে বলে উল্লেখ করে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের সাথে খাদ্যদ্রব্যের উর্ধগতির কারণে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। ডিসেম্বর ২০২২ বিএনপি ঢাকায় একটি মহাসমাবেশের পদক্ষেপ নেয় এবং সাফল্যের সাথে সম্পন্ন করে। ২৮ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা ঢাকার উত্তরা থেকে অভয়নগর পর্যন্ত দেশের প্রথম গণ দ্রুত পরিবহন মেট্রো রেলের প্রথম ধাপের উদ্বোধন করেন। ২০২৩ সালের জি-২০ নয়াদিল্লি শীর্ষ সম্মেলনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে একটি বৈঠক করেছিলেন যাতে সংযোগ ও বাণিজ্যিক যোগাযোগ ক্ষেত্রে উভয় দেশ বৈচিত্র আনতে পারে। উক্ত বৈঠকে তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ হাজির ছিলেন যিনি ডাব্লিউএইচও নির্বাচনে একজন প্রার্থী হওয়ার আশা পোষণ করেন।

চতুর্দশতম পর্ব (২০২৩) :
দুঃশাসনের আরেক অধ্যায়

বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তারিখ নির্ধারিত হয়েছিল। তবে ১২ ফেব্রুয়ারি দুপুরে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া বন্ধ হয়ে যায় এবং আওয়ামীলীগের একজন রাজনীতিক মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন চুন্নু ওই বন্ধ হয়ে যাওয়া সময় পর্যন্ত একক প্রার্থী ছিলেন এবং ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ জনাব শাহাবুদ্দিন সাহেবকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয়। মার্চ ২০২৩ থেকে বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধী দল যুগপত আন্দোলনের ডাক দিয়ে সরকারকে মেসেজ দেওয়ার কৌশল গ্রহণ করে। সরকার বিদেশীদের চাপে বিরোধী দলের আন্দোলনকে কিছুটা স্বাভাবিক গতিতে চালানোর সুযোগ দিলেও পাল্টাপাল্টি দলীয় কর্মসূচি দিয়ে বিরোধীদের সমান্তরাল আন্দোলনের পরাকাষ্ঠা দেখাতে থাকে। এতে করে দুই এক জায়গায় মাঝে মাঝে সংঘর্ষ, অরাজকতা ও হত্যার মতো দুর্ঘটনা ঘটতে থাকে। ২৮ অক্টোবর বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি ঘটনা বহুল স্মরণীয় দিন। ২০০৬ সালের এইদিনে বিএনপি জামায়াত জোট সরকার পদত্যাগ করলে আওয়ামী লীগ ঢাকাসহ সারাদেশে পূর্বপরিকল্পিত লগি-বৈঠার তাণ্ডব চালিয়ে প্রায় ১৮ জন জামায়াত নেতাকর্মীদের হত্যা করে। সারাদেশে আরও প্রায় অর্ধশত বিরোধী নেতাকর্মী সংঘর্ষে নিহত হয়। বিএনপি সম্ভবত ঐ ২৮ অক্টোবরকে স্মরণ করে ২০২৩ সালের ঐ দিনে ঢাকায় মহাসমাবেশের প্রস্তুতি নেয়। জামায়াতে ইসলামীও ঐদিন ঢাকায় মহাসমাবেশ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অপরদিকে হিংসার রাজনীতির মুখোশের আড়ালে আওয়ামী লীগের সরকারি দল ঐ ২৮ অক্টোবরের একই দিনে ঢাকায় সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নেয় যা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথেও বড় একটি বাধা, যেমন একই দিনে সরকার ও বিরোধী দলের সমাবেশ ডাকা। শেষ মুহূর্তে সরকার বিরোধী দল বিএনপিকে সমাবেশ করার অনুমতি দিলেও জামায়াতে ইসলামীকে কোনো প্রকার ছাড় দেওয়া হবে না বলে ডিএমপি থেকে হুংকার দেওয়া হয়। জামায়াতও তার পূর্ব সিদ্ধান্তে যে কোনো মূল্যে ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ করার জন্য অটল থাকে। বিএনপির বিশাল সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে শুরু হয়ে শেষ পর্যন্ত সরকারের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী পেটুয়া পুলিশ এবং ভাড়াটিয়া গুন্ডাবাহিনী দিয়ে সমাবেশ বন্ধ করে দেয় এবং দেখাতে চায় বিএনপির মহাসমাবেশ ব্যর্থ হয়েছে। অপরদিকে জামায়াতে ইসলামী লক্ষ নেতা-কর্মী সহকারে শাপলা চত্বরের পাশে আরামবাগে সর্বকালের বিশাল ও শান্তি-শৃঙ্খলাপূর্ণ মহাসমাবেশ করতে সমর্থ হয়।

পঞ্চদশতম পর্ব (২০২৩-বর্তমান) :
চূড়ান্ত স্বৈরশাসন

বিরোধীদলের সকল বাঁধার মুখে সরকার ১৭ নভেম্বর ২০২৩ পরবর্তী ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচন করবে বলে একতরফা তফসিল ঘোষণা করে। বিরোধীদল ওই দিনেও তাদের প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ কর্মসূচি অব্যাহত রাখে এবং ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত সপ্তাহে দু-তিন দিন পর্যায়ক্রমে চার দিন পর্যন্ত হরতাল অবরোধ অব্যাহত রাখে। ৩০ নভেম্বর ২০২৩ আওয়ামী লীগ দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচনের জন্য ৩০০ আসনের মনোনয়নপত্র বিক্রি করে ২৯৮ জন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে। মজার বিষয় হলো এবারে আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থীর বিপরীতে যদি কোনো দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড়িয়ে যায় তাহলে আওয়ামী লীগ তাদের অনুমোদন দেবে অর্থাৎ ডামি প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে বলে এক কৌশলী সিদ্ধান্ত নেয়। জাতীয় পার্টির রওশন এরশাদ এবং তার পুত্র এরিক এরশাদ এতদিনে জাপার হাল ধরে একাংশ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত ছিলেন। জাতীয় পার্টির অপর নেতা জনাব জি এম কাদের এই অবৈধ সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না বলে প্রায়শঃ-ই হাঁক-ডাক দিতে থাকেন। এমনকি তারা অতীতের মতো আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হবেন না বলে জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু শেষমেষ দেখা গেল নির্বাচনের বেশ কিছুদিন পূর্বে দিল্লির ডাকে জি এম কাদের ভারত সফর করে ফিরে এসে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থেকে ‘‘তিনি কী যেনো একটা করবেন’’ এমন হাম-বড়া অভিব্যক্তি নিয়ে থাকার পর সহসা ৩০ নভেম্বর সকল নীরবতা এবং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে তারই কথিত অবৈধ সরকারের পাতানো নির্বাচনের অধীনে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। দেশবাসীকে বোকা বানিয়ে, তাক লাগিয়ে তার বড় ভাই স্ব-ঘোষিত স্বৈরাচার এরশাদ সাহেবের মতো মারাত্মক ডিগবাজি মেরে ভোটে যাওয়ার সকল কার্যক্রম সম্পন্ন করলেন। অপরদিকে রওশান কাঙ্খিত সিট না পেয়ে তার পুত্রকে নিয়ে হতাশার অন্ধকারে হাবুডুবু খেয়ে নোমিনেশন না নেওয়ার মনস্থ করে বসে থাকলেন। এখানে সরকারও চাতুর্যের সাথে এতদিনের রওশান এরশাদকে ধরে রাখার মায়া ত্যাগ করে জি এম কাদেরকে পেয়ে রওশনকে ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার কারিশমা দেখালেন। বড় চালাক ডাক সাইটে জেনারেল মোহাম্মদ ইব্রাহীম (বীরোত্তম) হঠাৎ করেই নামকাওয়াস্তে তিন দলের যুক্তফ্রন্ট সৃষ্টি করে এতো দিনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী জেটের সাথে কায়মনে একাত্ম থাকা ১২ বছরের জোটবদ্ধ সম্পর্ক ছিন্ন করে ‘‘আন্দোলন করে পারা গেলনা’’র হতাশা নিয়ে ‘‘এ অবৈধ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়’’ এমন অঙ্গীকারের সুকঠিন ব্রত নিমিষেই ভঙ্গ করে দেশের রাজনৈতিক বোদ্ধাদের কথিত মতে ‘‘বুড়ো বয়সে দেশ-জাতির সাথে বেইমানি করে’’ ওই অবৈধ সরকারকে একটু ক্ষুদ্র হলেও বৈধতা দিতে নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্তে নিজেই মুক্তিযুদ্ধের মহা বীরবিক্রম সৈনিকের তকমা নিয়ে, পূর্বতন আরেক ক্ষমতাধর মহা স্বৈরাচারী সৈনিক নেতা জনাব এরশাদের পদাঙ্ক অনুসরণে জনমনে স্মৃতিস্মারক হয়ে থাকলেন। বিএনপি নেত্রীর সাবেক উপদেষ্টা আরেক মুক্তিযোদ্ধা বিশিষ্ট কূটনৈতিক বলে খ্যাত জনাব শমসের মবিন চৌধুরী এবং আরেক  তুখোড় বাকপটু বিএনপি নেতা জনাব তৈমুর আলম খন্দকার, বিএনপির আরেক ডাকসাইটে নেতা মরহুম ব্যারিষ্টার নাজমুল হুদা কর্তৃক ইতঃপূর্র্বে প্রতিষ্ঠিত তৃণমূল বিএনপিতে যোগ দিয়ে এই সরকারের অধীনে একেবারেই ৩০০ সীটে নির্বাচন করবেন বলে মহাসমারোহে প্রার্থী মনোনয়নের ঘোষনা দিয়ে বিএনপিসহ সকল দল-বল ও কৌশলকে হতবাক করে ফেললেন। হালে বিএনপির আরেক সাবেক সৈনিক মন্ত্রী স্বঘোষিত ‘‘হ্যাডাম’’ নেতা, লে. কর্ণেল অবসরপ্রাপ্ত জনাব শাহজাহান ওমর বীর বিক্রম, আওয়ামী সরকারের কোপানলে গ্রেফতার হয়ে কারাপ্রকোষ্ঠে অবস্থানরত অবস্থায়, বিনা বিচারে, দেশের সাংবিধানিক এবং আদালাতিক সকল রীতিনীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গত ২৯ নভেম্বর ২০২৩ একেবারে সাঁঝ-সন্ধ্যায় শ্রীঘরের গোপন প্রকোষ্ঠ থেকে সন্তর্পণে বের হয়ে পরদিন প্রাতঃকালে স্যোৎসাহে এবং স্ব-উল্লাসে এতোদিনের পুঞ্জীভূত অতিপ্রিয় সৈনিক জিয়ার নীতি-আদর্শে সঞ্জীবিত জাতীয়তাবাদ এবং ইসলামী মূল্যবোধের অঙ্গন থেকে মূলোৎপাটিত ও বিচ্ছিন্ন হয়ে একেবারেই বিপরীত মেরু ধর্মনিরপেক্ষ-সমাজতন্ত্র এবং ইদানিং সংযুক্ত বাকশালী একনায়কতন্ত্রের পাজর-প্রকোষ্ঠে সবল অবস্থান নিয়ে স্ব-কপোলে বিখ্যাত আওয়ামী প্রতীক নৌকার লেবেল এঁটে অধুনা দলত্যাগের যে ভৈরবী-ডিগবাজীর নমুনা সৃষ্টি করলেন দেশ-জাতি-বিশ্ব তা হয়তো বহুদিন স্মরণে রাখতে উৎসাহী থাকবে। এছাড়া ছোটখাটো কিছু দল যেমন বিএনএম, বিএসপি প্রমুখ নির্বাচনে মহাসমারোহে অংশ নিয়ে সরকারের ডামি নির্বাচনকে সরগরম করে তুলতে কুন্ঠাবোধ করেনি। 

আমি ১৯৭১ সাল থেকে শুরু করে ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে অতি সংক্ষেপে পঞ্চদশতম পর্ব পর্যন্ত অবতারণা করেছি। বিভিন্ন প্রেক্ষাপটের ওই সকল পর্বে আমি কোনো বিষয়ের ব্যাখ্যায় না গিয়ে শুধু কেবল ঘটনার বর্ণনা করেছি মাত্র। তবে শেষের দিকের প্রেক্ষাপটে দু-একটি পর্বে সামান্য কিছু মন্তব্য স্বাভাবিকভাবে দৃশ্যপটে এসে গেছে। মূলে মন্তব্য জ্ঞানবান বিদগ্ধ পাঠকেরাই করবেন।

তবে এমনিতেই দীর্ঘ আলোচনার আলোকে বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে যে সকল ঘটনার অবতারণা হয়েছে এবং ঘটেছে সে আলোকে সম্মানীয় পাঠকদের মূল্যবান মতামতের সাথে আমার কিছু মূল্যায়ন যোগ করতে চাই যা নিম্নরূপ:

সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন :

এক) দেশে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী দলগুলো ২০২৪ এর ৭ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচনোত্তর বছরগুলোতে সরকারের বিরুদ্ধে বড় বড় সমাবেশ করতে সক্ষম হয়েছিল যদিও সরকারপক্ষ আওয়ামী লীগ এবং তাদের সমর্থকগোষ্ঠী ওইসব সমাবেশে বাধা দিতে সদা তৎপর ছিল। ঢাকায় ডিসেম্বরে বিএনপি সমর্থকদের ওপর গুলিতে অন্তত একজন মারা যায় এবং ৬০জন আহত হয়, এরপর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বিএনপির কয়েক শীর্ষ নেতাকে আটক করা হয়।

দুই) গত ২০২২ সালের জুন মাসে সরকার দেশে মানবাধিকার গোষ্ঠীর নিবন্ধন প্রত্যাহার করে নেয়, যা বাংলাদেশে সরকারীভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সুস্পষ্ট প্রমাণ।

তিন) গণতান্ত্রিক পার্লামেন্টারি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় একজন রাষ্ট্রপতি পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি আইনসভায় সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত হন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ দ্বিতীয় মেয়াদেও বিনা ভোটে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন, যা সংবিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

চার) এককক্ষ বিশিষ্ট জাতীয় সংসদের সবচেয়ে বেশি আসনে জয়ী দলের নেতা প্রধানমন্ত্রী হন এবং কার্যকর ক্ষমতা মজবুত করেন, কিন্তু অতীতে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় আওয়ামীলীগনেত্রী একপ্রকার নিরঙ্কুশ বিজয়ে প্রধানমন্ত্রী  হন, যেখানে নির্বাচনে সহিংসতা, জালিয়াতি, ভোটকারচুপি, মধ্যরাতের নির্বাচন ইত্যাদির বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ থাকায় সংসদীয় পদ্ধতিতে প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্টিত হওয়ার সৌন্দর্য অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়েছে।

পাঁচ) জাতীয় সংসদে মহিলা সদস্যসহ ৩৫০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত যেখানে ৩০০ জন সরাসরি এবং ৫০ জন মহিলা সদস্যা মনোনীত হয়ে থাকেন। ডিসেম্বর ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৮৮ আসনে সরাসরি বিজয়ী ঘোষিত। এ নির্বাচনে রাজনৈতিক সহিংসতা, ব্যালট স্টাফিং, বিরোধী সমর্থকদের হয়রানি, বিরোধীদলের প্রার্থীদের গ্রেফতার, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কারচুপি দেশের গণতান্ত্রিক ইজ্জতকে ভুলন্ঠিত করেছে।

ছয়) বিরোধীদল ও বাইরের পর্যবেক্ষকরা ওই নির্বাচনকে বিতর্কিত হিসেবে দীর্ঘদিন সমালোচনা করে আসছেন। এ কারণে কয়েকটি বিদেশি সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ইসিকে দেওয়া আর্থিক সহায়তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে যা দেশের জন্য অগৌরবের বিষয় শুধু নয় অবমাননাকরও বটে।

সাত) বাংলাদেশে একটি বহুদলীয় শাসনব্যবস্থা প্রচলিত থাকলেও ক্ষমতা ঐতিহাসিকভাবে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির পরিবারতন্ত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ যেখানে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রও পরিপূর্ণ অস্বচ্ছ।

আট) দেশে ইসলামপন্থী দল বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামী (জেআই) যারা ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারে জোটবদ্ধ ছিল। ২০১৩ সালে ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করার সংবিধানিক বিধান অনুযায়ী জামায়াত তার নিবন্ধন হারায়। জামায়াত প্রার্থীরা এখন স্বতন্ত্র অথবা বিএনপির হয়ে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, কিন্তু কিছু বিদেশি রাষ্ট্র অতি উৎসাহে জামায়াতকে মৌলবাদী, জঙ্গি এবং সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিয়ে ঐরূপ চাপে রাখার পলিসি নিলেও দেশে অন্যান্য ইসলামী দলগুলোর সাথে কথিত অসাম্প্রদায়িক সরকার সখ্যতা রেখে চলার চেষ্টা করে আসছে, এটা আওয়ামী লীগ সরকারের একটি দ্বিমুখী নীতি বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন।

নয়) সরকার দেশে বিরোধীদলকে নিয়মিত হয়রানি, বিএনপিসহ অন্যান্য দলীয় প্রধানদের অন্যায়-অহেতুকভাবে গ্রেফতারের কারণে প্রধানবিরোধী দলগুলোকে অসম্ভব রকমের দুর্বল করে রাখার পলিসি নিয়ে চলছে, জামায়াতে ইসলামীর মতো একটি গণমুখী জনপ্রিয় দলকে প্রচণ্ড চাপে রাখার নীতি একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে শিকড় কাটার মতো দুর্বল করে দিচ্ছে।

দশ) আওয়ামী লীগ ও বিএনপি রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তারের জন্য দলের অভ্যন্তরীণ কাঠামোতে শ্রেণীবিন্যাস নিয়ে প্রশ্ন তুলে ভিন্ন মতাবলম্বীদের মধ্যে গ্রুপিং সৃষ্টি করে রাজনৈতিক পছন্দকে সীমিত করে দিচ্ছে; এতে দলের আভ্যন্তরীণ কাঠামো দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।

এগারো) জাতীয় সংসদে ৫০টি আসন মহিলাদের জন্য বরাদ্দ; যারা নির্বাচিত দলীয় সদস্যগণ কর্তৃক নির্বাচিত হন। দেশে প্রধান দুটি দলের নেতৃত্বে হচ্ছেন নারীরা, তা সত্ত্বেও এখানে নির্বাচনের ক্ষেত্রে লিঙ্গ প্রথায় সামাজিক বৈষম্য বজায় রাখার খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে।

বারো) দেশে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। বিচার বিভাগ, শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ সব যেমন দুর্নীতিতে আছন্ন তেমনি সবগুলো বিভাগ সরকারদলীয় কর্মকাণ্ডে শতভাগ নিয়ন্ত্রিত। এসব দুর্নীতির তথ্য বিভিন্ন সময়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্বারা শতভাগ প্রমাণিত। 

তেরো) দুর্নীতি, অপরাধ প্রবণতা, দুর্বল আইনের শাসন, আমলাতান্ত্রিক অসচ্ছতা দীর্ঘদিন ধরে সরকারের জবাবদিহিতাকে দুর্বল করে দিচ্ছে।

চৌদ্দ) দেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা কঠোরভাবে সীমাবদ্ধ। মিডিয়া জগত নিয়ন্ত্রিত। সংবাদপত্র দলীয় প্রভাবে আচ্ছন্ন। সাংবাদিকগণসহ জনগণ মত প্রকাশে অবরুদ্ধ। মিডিয়াকর্মীদের ওপর হামলা প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। ব্লগারদের ওপর হামলায় সাংবাদিক হত্যার বিচার সুদূর পরাহত। সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যার বিচার কোর্টের মাধ্যমে শতবার শতদিন পরিবর্তন হয়েও বছরের পর বছর ধরে চলে বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কেঁদে ফিরছে।

পনেরো) দেশে অতীতের মগদস্যুদের প্রেতাত্মারা আজ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে, সম্পদশালীদের, মেধাবীদের রাতের আঁধারে গুম করে নিয়ে যাচ্ছে অজ্ঞাত জায়গায়। কিছুদিন পরে পাওয়া যাচ্ছে গলিত লাশ অথবা নিখোঁজ, যা দেশের মানবাধিকার এবং ব্যক্তিস্বাধীনতাকে  মারাত্মকভাবে ভূলুন্ঠিত করছে।

ষোলো) দেশে ধর্মীয় স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রিত যদিও সংবিধানে রাষ্ট্র ধর্মের স্বীকৃতি আছে। প্রাণ খুলে কোরআনের বাণী প্রচার করতে পারেন না দেশবিখ্যাত অনেক জনপ্রিয় আলেমগণ। বছরের পর বছর তারা কারারুদ্ধ। হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান শিয়া আহমদিয়ারা তটস্থ। সংখ্যালঘুদের ওপর, ধর্মীয় উপাসনাগুলোর ওপর আঘাতের খবর মাঝে মাঝে প্রকাশ হয়ে থাকে। অনেক সময় দেখা গেছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে সংখ্যালঘুদের হত্যা করে, ধর্মীয় উপাসনালয়ে আগুন দিয়ে, ভাঙচুর করে তা ইসলামপন্থীদের ওপরে নির্লজ্জভাবে চাপানো হয় যার উদাহরণ হিন্দু দর্জি বিশ্বজিতকে প্রকাশ্যে হাতুড়ি পিটিয়ে হত্যা, মহাপাড়া গ্রামের একটি মন্দির আগুন দেওয়া, ভাঙচুর করা ইত্যাদি।

সতেরো) সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে দলীয়ভাবে নিয়োগ, স্বায়ত্তশাসন হ্রাস, বিভিন্ন অনুষদের নিয়োগ প্রায়শই আওয়ামী লীগের দলীয় সমর্থনের সাথে যুক্ত। ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে একাডেমিক ক্যাম্পাসগুলো প্রায়ই জিম্মি থাকে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যপুস্তকগুলোতে জাতীয় মননের এবং ঐতিহ্যের বিপরীতে বীজাতীয় বিধর্মীয় উপমা অনুসম্ভারে ভরপুর করে ইসলামী ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে ধ্বংস করতে অপচেষ্টা চলছে, এতে করে দেশে ইসলামপন্থীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়ে দেশে একটা ভিন্নমাত্রায় আন্দোলন সৃষ্টি করার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে।

আঠারো) দেশে সভা সমাবেশের অধিকার সর্বাত্মকভাবে সীমিত করা হয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সভা সমাবেশ করলে, মিছিলের আয়োজন করলে সরকারি পক্ষ প্রায়শই পাল্টা প্রোগ্রাম করে দেশে একটি গৃহযুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি করার অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে, যা গণতন্ত্র বিকাশে অদৌ সহায়ক  নয়।

উনিশ) আইনের শাসন দেশে আদৌ বলবৎ আছে কি? বিচার বিভাগে রাজনীতি ও দলীয়করণ মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি শুধু পায়নি; একচ্ছত্রভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সর্বোচ্চ আদালত থেকে নিম আদালত পর্যন্ত একই অবস্থা বিরাজমান, বিশেষ করে প্রতিপক্ষ জনগণ বিচারব্যবস্থায় মারাত্মক হয়রানির শিকার। এক একটি মামলা বছরের পর বছর ঝুলে আছে, দেখার কেউ নেই। মাননীয় প্রধান বিচারপতি নভেম্বর ২০২৩, ঢাকার একটি সেমিনারে এ বিষয়ে উল্লেখ করে দেশের বিচার ব্যবস্থার অন্তর্মূলের কথা নির্দ্বিধায় প্রকাশ করেছেন।

বিশ) দেশ আজ ব্যক্তিগত স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত। জনগণের ব্যক্তি অধিকার সংকুচিত। দেশাভ্যান্তরে বিদেশীদের ন্যায় স্বদেশীদের চলাচলেও প্রতিনিয়ত চেকিং এর শিকারে নির্যাতিত হতে হচ্ছে। দেশে ব্যক্তির ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক স্বাধীনতাও সীমিত। স্ত্রীকে নিয়ে ভ্রমণে গেলে বৈবাহিক কাবিননামা দর্শনের রেওয়াজ একটি স্বাধীন দেশের জন্য কু-রেওয়াজ এবং কু-প্রথা হিসেবে নিন্দিত হচ্ছে।

একুশ) দেশে ১৯৭২ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১১টি সংসদ নির্বাচন হয়েছে। দু-দুবার সেনা শাসন পরিচালিত হয়েছে। প্রত্যেক সংসদীয় নির্বাচনের পর পরাজিত দল বিজয়ী দলকে কিংবা জোটকে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনেছে। ক্ষমতায় গিয়ে কী করে ক্ষমতায় আজীবন স্থায়ী থাকা যায় প্রতিটি ক্ষমতাসীন দায়িত্বশীলগন সেই ব্যবস্থাই পাকাপোক্ত করার ফন্দি-ফিকির আঁটার ব্যবস্থা করছে এবং আজও করে যাচ্ছে। দেশে মারাত্মকভাবে দুটি পরিবারতন্ত্রের রাজকীয় ধারা বহমান হচ্ছে এবং তা আরো স্থায়ী করার প্রক্রিয়া চলছে যা আমাদের স্বাধীনতার চেতনার পরিপন্থী এবং সংবিধানের মৌলিক অধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এখানে যারা সরকারে যান, তারা যেনো বিরোধী দলের শত্রু, আবার যারা বিরোধী দল তারা যেনো সরকারি দলের শত্রু। এই শত্রুঘ্ন মানসিকতার দীর্ঘমেয়াদী পরিচর্যা দেশকে বিভাজন করে অনৈক্য সৃষ্টি করে জাতিসত্তাকে ধ্বংস করে দিতে পারে। সরকারি দলের নেতাকর্মীদের লেলিয়ে দিয়ে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের সনাক্ত করে উত্তমমাধ্যম দিয়ে পুলিশে দেওয়ার নির্দেশ দেশের সর্বোচ্চ দায়িত্বশীলের পক্ষ থেকে দেওয়া হচ্ছে। এটি যে কত বড় ভয়াবহ অবস্থা যা কেবল জনগণ অনুধাবন করতে পারেন! এভাবে দেশে গৃহযুদ্ধ বাঁধানোর সুস্পষ্ট পাঁয়তারা চলছে। পরিবার, সমাজ, ভ্রাতৃত্ববোধ, সৌজন্য, ভালোবাসা, সহানুভূতিশীলতায় মারাত্মক এবং ধ্বংসাত্মক পরিণতির সৃষ্টি হচ্ছে। তৃণমূল শুধু নয় অভিজাত সমাজ ব্যবস্থা এতই ধ্বংসমুখী যে পিতা পুত্রকে খুন করছে, ছেলে মাকে হত্যা করছে, স্বামী স্ত্রীকে গলা টিপে মারছে। ধর্ষণ এত পরিমানে বৃদ্ধি পেয়েছে যা সামাজিক গণ্ডি পেরিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র ব্যবস্থায় থানা পুলিশ, ইউএনও, ডিসি, এসপি, সচিবালয় এমপি, মন্ত্রী এমনকি যারা দেশ পরিচালনায় অভিভাবকত্ব গ্রহন করেছে তাদের মধ্যেও প্রতিনিয়ত অবৈধ সম্পর্ক, ধর্ষণ, খুন এবং সমাজবিরোধী কার্যকলাপ সংঘটিত হচ্ছে, পত্রপত্রিকা ও মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রকাশিত হয়ে সমাজের টপ টু বটম কলুষিত হয়ে একটি অবিমিশ্র ইবলিসি কলঙ্কিত সমাজ তৈরি হচ্ছে যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মসহ মানবিক চেতনাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এসব বিষয়ে দেশ ও জনগণকে এখনই সাবধান হওয়া জরুরি।

লেখক: সাবেক সংসদ সদস্য

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির