প্রথম পর্ব-
ব্রিটিশ শাসনের কবল থেকে ভূমি ও মানুষকে মুক্ত করতে যে স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে- যাকে ব্রিটিশরা নিছক সিপাহি বিদ্রোহ নামে চালাবার চেষ্টা করে- সেখানে যেমন ইসলামপন্থী মানুষদের নেতৃত্বে দেখা গেছে, দেখা গেছে শাহাদাত বরণে, নির্বাসনের দণ্ড গ্রহণে, জীবনের সর্বস্ব কোরবান করতে সর্বাধিক অগ্রবর্তী, পরবর্তীকালেও সেই ধারার অনুবর্তীদের পশ্চাৎপদ দেখা যায়নি। পাকিস্তান শাসনামলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের অধিকার আদায় ও পূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল ও নেতৃবৃন্দকে দেখা গেছে সম্মুখ সারিতে। আওয়ামী লীগসহ ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলো এবং জামায়াতসহ ইসলামী দলগুলো একসঙ্গে এমনকি জোটবদ্ধভাবেও সরকারবিরোধী আন্দোলন করেছে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার ও দাবিদাওয়া নিয়ে লড়াই করেছে। ১৯৪৮-৫২ খ্রিস্টাব্দের ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৫৫-৭০-এর গণ আন্দোলন, গণ অভ্যুত্থান ও নির্বাচনসমূহে উভয় ধারার সম্পর্ক রাজনৈতিক সংগ্রামে বলতে গেলে ছিল এক দেহে লীন হবার মতোই। বিপুল আদর্শিক মতপার্থক্য সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় ইসলামী রাজনৈতিক দলসমূহ কখনোই পিছপা থাকেনি। স্বাধীন বাংলাদেশেও একদলীয় শাসনব্যবস্থা থেকে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণে, স্বৈরাচারের কবল থেকে দেশকে উদ্ধার করার দীর্ঘ গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে, নির্দলীয়-নিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন ব্যবস্থার আন্দোলনে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল ও নেতৃবৃন্দকে নীতিনির্ধারণী ভূমিকায় এবং রাজপথের সংগ্রাম ও টেবিলের আলোচনায় সমান নেতৃত্ব প্রদানে উজ্জ্বল অবস্থানে দেখা গেছে। সেই পঞ্চাশ দশক থেকে নব্বই দশকের পুরোটা জুড়ে গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের যে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস- তার অন্যতম অংশীদার ইসলামপন্থীরা। বলা বাহুল্য, এর মধ্যে সর্বাধিক সংগঠিত ও অগ্রবর্তী ছিল জামায়াতে ইসলামী। তাই এই ইতিহাস থেকে জামায়াতের নাম মুছে ফেলে তাকে অন্য কোনো অভিধায় পরিচিত করানোর প্রক্রিয়াকে ইতিহাস কখনোই হজম করতে পারবে না। এই নিবন্ধে এই দীর্ঘ ইতিহাসের অতি সংক্ষিপ্ত একটি চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছে।
পঞ্চাশ-ষাটের দশকের সংগ্রাম
পাকিস্তানের পূর্বাংশে তখন পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী পুরোপুরি সাংগঠনিক কাঠামোয় দাঁড়াতে পারেনি। তবে ১৯৫৩-৫৪ থেকেই ছিল লোক তৈরির পূর্ণ প্রক্রিয়া। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে জামায়াতের পূর্ব পাকিস্তান শাখা গঠিত হয়। এতে মাওলানা আবদুর রহীম প্রাদেশিক আমীর ও অধ্যাপক গোলাম আযম সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। ১৯৫৬ সালের ২৬ জানুয়ারি মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদীর ঢাকা আগমনের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। ঐদিন মাওলানা মওদুদীকে অভ্যর্থনা জানাতে বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন, প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সভাপতি মাওলানা আকরম খান এমএনএ, লালবাগ জামেয়া কুরআনিয়ার প্রিন্সিপ্যাল মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী, প্রখ্যাত মুফাস্সিরে কুরআন মুফতি মাওলানা দীন মুহাম্মাদ, জমিয়তে আহলে হাদিসের সভাপতি মাওলানা আবদুল্লাহিল কাফি আল কুরাইশী এবং প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা নুর মোহাম্মদ আজমী। এই সফর জামায়াতকে শুধু সাংগঠনিকভাবেই এগিয়ে দেয়নি, রাজনৈতিকভাবেও প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। ফলে অচিরেই দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রামের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান জামায়াত পূর্ণ শক্তি নিয়ে অবতীর্ণ হতে সক্ষম হয়।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পুরো ৬০-এর দশক জুড়েই পাকিস্তানের পূর্ব অংশে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলো তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার ও দাবিদাওয়া নিয়ে যে সংগ্রাম করেছে এর মধ্যে যেমন সক্রিয় ছিল আওয়ামী লীগ তেমনি ছিল জামায়াতে ইসলামী। সে সময়ের আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবিবরণী ইতিহাসের পাতায় পাতায় লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। এর কিছু উদাহরণ এখানে উপস্থিত করা হবে।
গবেষক-লেখক ড. প্রীতিকুমার মিত্র-র ভাষ্য অনুযায়ী ‘১৯৬২ সালের ৪ অক্টোবর ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) বা জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট প্রস্তাবিত বহুদলীয় সংগঠনটির জন্ম নিলো। এতে পাকিস্তানের দুই অংশের অনেকগুলো দল- যথা আওয়ামী লীগ, কেএসপি, কাউন্সিলপন্থী মুসলিম লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও নেজামে ইসলামী শামিল হলো।’ (বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস)।
১৯৬৪ সালের মার্চে সর্বদলীয় ভোটাধিকার ও প্রত্যক্ষ নির্বাচন কর্মপরিষদ ‘সর্বজনীন ভোটাধিকার আদায়ের জন্য জনগণের প্রতি পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান নেতাদের আবেদন’ শীর্ষক এক প্রচারপত্র প্রকাশ করে। এতে স্বাক্ষর করেন, ন্যাপ সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগিশ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মহিউদ্দীন আহমদ, পূর্ব পাকিস্তান নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি মাওলানা সৈয়দ মোসলেহ উদ্দীন ও সাধারণ সম্পাদক মাওলানা সিদ্দিক আহমদ এবং জামায়াতে ইসলামীর পক্ষে মাওলানা আবদুল আলী এমপিএ ও আখতার উদ্দীন আহমদ এমএনএ। (বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস ও দলিলপত্র, পৃষ্ঠা-২০০)।
সে বছর ১২ জুলাই বিরোধী দলের ডাকে সারা পাকিস্তানে জুলুম প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়।.....২৪ জুলাই আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কাউন্সিল মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলাম পার্টি মিলে ‘সম্মিলিত বিরোধী দল’ বা Combaind Opposition Party (COP) নামে নির্বাচনী ঐক্যজোট গঠন করে। এই জোট একটি ‘নয় দফা নির্বাচনী কর্মসূচি’ ঘোষণা করে জাতীয় সংসদ ও প্রাদেশিক পরিষদ সমূহের নির্বাচন তথা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকার, জাতীয় সংসদ ও প্রাদেশিক পরিষদগুলোর হাতে আইন ও বাজেট প্রণয়নের পূর্ণ ক্ষমতাসহ সংসদীয় পদ্ধতির পুনঃপ্রবর্তন, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন, নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন, পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসান, মুসলিম রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে বিশেষ সম্পর্কসহ স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ, কতিপয় ব্যক্তির হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়া প্রতিরোধ তথা সাধারণ মানুষের আর্থিক উন্নতির লক্ষ্যে অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়া, শরিয়তি আইন অধ্যাদেশ এমনভাবে সংশোধন করে নেওয়া যাতে তা ইসলামিক নীতির সাথে সামঞ্জস্য হয়- প্রভৃতি ‘কপ’-এর ৯ দফার অন্তর্ভুক্ত ছিল।’ (বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস)। জামায়াতে ইসলামীর নেতা গোলাম আযমও সংসদীয় গণতন্ত্রের ও প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের প্রবক্তা হয়ে ‘পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তি কোন পথে’ শীর্ষক পুস্তিকা প্রকাশ করে এক নতুন প্রোগ্রাম দিলেন। (ঐ)
প্রগতিশীল লেখক আবদুল হক ‘চার দশকের রাজনীতি পরিক্রমা (১৯৫৩-৯৩)’ গ্রন্থে সে সময়ের আন্দোলনের যে ধারা বর্ণনা দিয়েছেন- তার একটা চিত্র পাওয়া যায়। তাঁর তথ্য মতে, তৎকালে গঠিত ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের (এনডিএফ) পূর্ব পাকিস্তান শাখার ১৯৬৪ সালের ৫ জানুয়ারি তারিখে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ৫ দফা দাবি প্রণয়ন করা হয়। দাবিগুলো ছিল (১) ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের শাসনতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন, (২) পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, (৩) পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, (৪) সর্বজনীন বয়স্ক ভোটাধিকার এবং (৫) নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সদর দফতর পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন। এই বৈঠকে যথারীতি ফ্রন্টের সদস্য হিসেবে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। তিনি আরো উল্লেখ করেন, ৬ জানুয়ারি প্রাদেশিক সরকার জামায়াতে ইসলামীকে বেআইনি ঘোষণা করে। মাওলানা আবুল আ’লা মওদুদী এবং দলীয় অন্যান্য নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। একই বছর অক্টোবরে সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ের মাধ্যমে জামায়াতের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। উল্লেখ্য, যে কারণ দেখিয়ে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হয় তার মধ্যে ছিল, ‘জামায়াতের আমীর মাসিক তরজুমানুল কুরআনে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ইরান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়িয়ে দু’দেশের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টির অপচেষ্টা করেছেন এবং জামায়াত একটি জঙ্গি সংগঠন। কর্মীদেরকে বিপ্লবী ট্রেনিং দেওয়া হয়, যাতে শক্তি প্রয়োগ করে দেশের সরকারি ক্ষমতা দখল করে নেওয়া যায়।’ ২৪ জুলাই পাকিস্তানের (প্রধানত পূর্ব পাকিস্তানের) ৫টি রাজনৈতিক দল ঢাকায় কয়েকদিন আলোচনার পর আগামী সাধারণ নির্বাচনে সকল স্তরে যুক্তভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার লক্ষ্যে নির্বাচনী মৈত্রী গঠন করে। রাজনৈতিক দলগুলো হলো, আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কাউন্সিলপন্থী মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম ও জামায়াতে ইসলামী। ’৬৪ সালের নভেম্বরে আইউব খান প্রেসিডেন্ট নির্বাচন দেন। এতে ‘এনডিএফ’ ও ‘কপ’ মিস ফাতেমা জিন্নাহকে সমর্থন দেয়। ১০-১১-১৯৬৪ থেকে ১৯-১১-১৯৬৪ তারিখ পর্যন্ত এই নির্বাচনে মিস ফাতেমা জিন্নাহর সঙ্গে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। ২-১১-১৯৬৫ তারিখে ঘোষিত ফলাফলে আইয়ুব খান বিজয়ী হন, ফাতেমা জিন্নাহ পরাজয় বরণ করেন। এতে দেখা যায়, আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানে পেয়েছেন ২১,০১২ ভোট ও ফাতেমা জিন্নাহ ১৮,৪৩৪ ভোট। আইয়ুব খান পশ্চিম পাকিস্তানে পেয়েছেন ২৮,৯৩৯ ও ফাতেমা জিন্নাহ ১০,২৫৭ ভোট। সমগ্র পাকিস্তানে আইয়ুব খান পান মোট ৪৯,৯৫১ এবং ফাতেমা জিন্নাহ ২৮,৬৯১ ভোট। দেখা যায় জামায়াত-আওয়ামী লীগ সমর্থিত জোটের প্রার্থী ফাতেমা জিন্নাহ পশ্চিমের চেয়ে পূর্বে বেশি সমর্থন লাভে সক্ষম হন।
আবদুল হকের বর্ণনায় সে সময়ের বিরোধী দলগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রক্রিয়া প্রচেষ্টার ও নির্বাচনী সমঝোতার বিবরণ মেলে। তিনি ১৯৬৫ সালের জানুয়ারিতে এরকম একটি প্রয়াসের উল্লেখ করেছেন : ‘জাতীয় পরিষদের পদপ্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে ‘কপ’ এর মধ্যে যে অন্তঃবিরোধ দেখা দেয় তার ফলে ন্যাপ বেরিয়ে এসেছিল তা স্বল্পস্থায়ী হয়। প্রদেশের বিরোধী দলগুলোর মধ্যে পূর্ণ ঐক্য পুনঃস্থাপিত হয় এবং সকল দলের যুক্ত পদপ্রার্থী তালিকা প্রণীত হয়। ঐক্যবদ্ধ বিরোধী দলগুলোর মধ্যে রয়েছে, আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, কাউন্সিলপন্থী (খাজা নাজিম উদ্দিন পরিচালিত) মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী ও এনডিএফ। এ দলগুলো সম্মিলিতভাবে ৭০টি পদের জন্য প্রার্থী মনোনয়ন করেছে, সেগুলোর মধ্যে ৭টি কেন্দ্র বিভিন্ন দলের একাধিক প্রার্থীর জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। দলগুলোর মধ্যে এ ঐক্য প্রশংসনীয় বলতে হবে এবং এ একটা সুলক্ষণ ও সুঐতিহ্য।’
আবদুল হক তাঁর দিনপঞ্জিতে ১৯৬৬-র ৩ আগস্ট ‘গণতন্ত্রের জন্য ঐক্য’ শিরোনামে উল্লেখ করেন, রোববার ২১ জুলাই তারিখে নুরুল আমীন সাহেবের বাসভবনে পূর্ব পাকিস্তানের বিরোধী দলগুলোর নেতৃবৃন্দের এক সম্মেলন হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কর্মসূচি উদ্ভাবন। সম্মেলনে বিভিন্ন দল তাদের নিজ নিজ মতামত উপস্থাপিত করে, কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। এতে অংশগ্রহণ করে নিম্নলিখিত দলগুলোর প্রতিনিধি : ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, আওয়ামী লীগ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী ও ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট। ১৯৬৭-র ১৬ এপ্রিল তারিখে আবদুল হক উল্লেখ করেন, পাকিস্তান গণতান্ত্রিক আন্দোলনে পাঁচটি বিরোধী রাজনৈতিক দলের সমবায়ে ৩০ এপ্রিল ‘পাকিস্তান গণতান্ত্রিক আন্দোলন’ (Pakistan Democratic Movment-PDM) নামে একটি সংস্থা গঠিত হয়। দলগুলো হচ্ছে, পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী ও ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি এর বাইরে থেকে গেছে। এসব দল ৮ দফা কর্মসূচিতে ঐক্যবদ্ধ রয়েছে।
১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ-পরিস্থিতি নিয়ে আইউব খান যে সর্বদলীয় বৈঠক ডাকেন সেখানেও আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের নেতারা বেশ অন্তরঙ্গভাবেই যোগদান করেন। ‘রাজনীতির তিরিশ বছর’ নামক গ্রন্থে মিজানুর রহমান চৌধুরী জানান, ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে (পাক-ভারত) পূর্ব পাকিস্তান অরক্ষিত থাকায় পূর্ব পাকিস্তানিদের জন্য ১৯৬৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে নেজামে ইসলাম পার্টির প্রধান চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর বাসভবনে নেতৃবৃন্দ এক বৈঠকে বসেন। বৈঠকে আওয়ামী লীগ, নেজামে ইসলামী, জামায়াতে ইসলামী ও কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ যোগ দেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেন শেখ মুজিবুর রহমান। মুজিব ঐতিহাসিক স্বায়ত্তশাসনের ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন। (পৃ-৭৭)। ১৯৬৭ সালের ৩০ এপ্রিল সাবেক প্রাদেশিক মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের বাসভবনে আওয়ামী লীগ, মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), নেজামে ইসলাম পার্টি, জামায়াতে ইসলামী ও ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে গঠিত হয় ‘পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক মুভমেন্ট (পিডিএম)’ এর পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি হন আওয়ামী লীগের আবদুস সালাম খান এবং সেক্রেটারি হন গোলাম আযম।
ঊনসত্তর-সত্তরের গণ অভ্যুত্থান
১৯৬৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ও ১০ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য যে সর্বদলীয় বৈঠক আহ্বান করেন তাতে জামায়াতের আমীর মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান বসেছিলেন পাশাপাশি, অন্তরঙ্গ পরিবেশে। এই বৈঠকে অধ্যাপক গোলম আযমও উপস্থিত ছিলেন। এ বৈঠক উপলক্ষে অধ্যাপক গোলাম আযম তাঁর এক লেখায় শেখ মুজিবের সঙ্গে ‘মধুর সম্পর্কের’ একটি বর্ণনা দিয়েছেন। “পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত নেতৃবৃন্দ ঢাকা ফিরে যাওয়ার সুব্যবস্থার উদ্দেশ্যে পিআইএ’র এক বিশেষ বিমানকে রাওয়ালপিন্ডি থেকে সরাসরি ঢাকা পৌঁছার নির্দেশ দেওয়া হয়। গোলটেবিল বৈঠক উপলক্ষে ৮ দলের অনেক নেতা রাওয়ালপিন্ডি এসেছিলেন। বৈঠকে আমন্ত্রিতদের কয়েকগুণ বেশি সংখ্যায় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত হন, যাতে কোনো বিষয়ে দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজন হলে ত্বরিত ব্যবস্থা করা যায়। বিমানে আরোহণ করে আমার আসন তালাশ করছি। এমন সময় শেখ মুজিব ‘এই আযম সাহেব এদিকে আসেন’ বলে আওয়াজ দিলেন। কাছে গিয়ে লক্ষ করলাম যে, আশপাশে কয়েক দলের নেতারা বসে আছেন। শেখ মুজিব হাসিমুখে কথা বলতে অভ্যস্ত এবং হালকা রসিকতা করতে পছন্দ করতেন। শেখ মুজিব হাত বাড়িয়ে আমাকে এক আসনে বসিয়ে দিয়ে রসিকতা করে অন্যদেরকে শুনিয়ে বললেন, ‘আযম সাহেবের মতো ভালো মানুষ জামায়াতে ইসলামীতে গেলেন।’ আমি জওয়াবে হেসে বললাম, ‘শেখ সাহেব ঠিকই বলেছেন। সব ভালো লোকগুলো জামায়াতে ইসলামীর মতো একটা খারাপ দলে যোগদান করেছে এবং মন্দ লোকগুলো আওয়ামী লীগের মতো একটা ভালো দলে শামিল হয়েছে।’ আশপাশে সবাই হাসলেন। শেখ সাহেব বললেন, ‘দেখুন দেখি আমাকে কেমন মারটা দিলো।’ আমি পরিবেশ হালকা করার জন্য বললাম, ‘আমরা এখানে সবাই গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সহযোদ্ধা, আর আপনি সেনাপতি।’ শুনে আমার সাথে মজবুত আলিঙ্গন করলেন। আমার আসন একটু দূরে ছিল। নিকটবর্তী সবার সাথে হাত মিলিয়ে আমার আসনে গিয়ে বসলাম।” (জীবনে যা দেখলাম, ৩য় খণ্ড)। এই বৈঠকের বিষয়বস্তু সম্পর্কে আলোচনার জন্য শেখ মুজিব ও তাজউদ্দীন আহমদসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ জামায়াতের আমীর মাওলানা মওদূদীর বাড়িতেও যান এবং একান্ত বৈঠক করেন।
লেখক আবদুল হকের ‘চার দশকের রাজনীতি পরিক্রমা (১৯৫৩-৯৩)’ থেকে আরো কিছু তথ্য নিচে উদ্ধৃত করা হলো-
‘ডাক’ এর কর্মসূচি : ৮ তারিখে (৮-০১-৬৯) ঢাকায় ৮টি বিরোধী দল সম্মিলিতভাবে আগামী নির্বাচন বয়কটের সপক্ষে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ১৭ জানুয়ারি তারিখ থেকে তারা আন্দোলন আরম্ভ করে। এই উদ্দেশ্যে সকল দলের প্রতিনিধি নিয়ে ডাক (উবসড়পৎধঃরপ অপঃরড়হ ঈড়সসরঃঃরবব-উঅঈ) নামে এক সংস্থা গঠন করা হয়েছে। বিরোধী দলগুলো ৮ দফা নিম্নতম কর্মসূচি গ্রহণ করেছে ;
-ফেডারেল পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার
-সর্বজনীন বয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচন
-অবিলম্বে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার
-নাগরিক অধিকার সুপ্রতিষ্ঠা, যাবতীয় কালা কানুন প্রত্যাহার
-যাবতীয় কারাবন্দীর মুক্তি (শেখ মুজিবসহ)
-১৪৪ ধারার অধীন যাবতীয় নির্দেশ প্রত্যাহার
-শ্রমিকদের ধর্মঘটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা
-সংবাদপত্র দমনমূলক যাবতীয় বিধিনিষেধ প্রত্যাহার এবং নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার।
যেসব বিরোধীদল সংযুক্ত কর্মপন্থা গ্রহণ করেছে তাদের মধ্যে আছে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ (৬ দফাপন্থী) জামিয়াতুল উলামা ই-ইসলাম, পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ওয়ালী খান গ্রুপ), পিডিএমভুক্ত ৫টি দল যথা, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাউন্সিল), পাকিস্তান আওয়ামী লীগ (পিডিএমপন্থী), পাকিস্তান জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (এনডিএফ), নেজামে ইসলাম পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী। ভাসানীপন্থী ন্যাপ ও ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি তখনও এই বিরোধ সংগ্রামের বাইরে।
১৭ জানুয়ারি শুক্রবার ‘ডাক’ এর আহ্বানে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে দাবি দিবস উদযাপিত হয়। সংবাদপত্রে যতদূর দেখা যায় উভয় প্রদেশেই ব্যাপকভাবে এই দিবস উদযাপিত হয়। ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ ডাক-এর আহ্বানে সারা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে সর্বজনীন হরতাল পালিত হলো। একই কর্মসূচি অনুযায়ী একই দিনে সমগ্র পাকিস্তানে এরূপ সর্বজনীন হরতাল পালন এই প্রথম। বিকেলে ঢাকার পল্টনে বিরাট জনসভা হলো। এতে ‘ডাক’-এর ৮-দফা ও ছাত্রদের ১১ দফার সমর্থনে প্রস্তাব গৃহীত হয়।
১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ : গতকাল ডাক এর প্রতিনিধিদলের ৩১ জন বিরোধীদলীয় নেতা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনার জন্য লাহোরে গেছেন। ২২ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন এবং সকল বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
৬ মার্চ ১৯৬৯ লাহোরে পূর্ব পাকিস্তান গণতান্ত্রিক পরিষদের ৫ ঘণ্টাব্যাপী অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে ৫ দফা সুপারিশ কেন্দ্রীয় গণতান্ত্রিক পরিষদে পেশ করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে :
-প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচন
-ফেডারেল পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠা
-পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন
-জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধি নির্বাচন
-এক ইউনিয়নের বিলোপ।
এতে পূর্ব পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক পরিষদের সব দলের প্রতিনিধিই যোগ দিয়েছিলেন।
১১ মার্চ ১৯৬৯ : গোলটেবিল বৈঠকের আজকে দু’বার অধিবেশন বসেছে। গতকাল নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান কর্তৃক পেশকৃত ‘ডাক’ এর দু’টি সর্বসম্মত দাবি : আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনসহ ফেডারেল পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। ১৪ মার্চ ১৯৬৯ ‘ডাক’-এর কাজ শেষ হয়ে গেছে বলে এর আহ্বায়ক নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ খান এর বিলুপ্তি ঘোষণা করেন। (আবদুল হক)
২৫ মার্চ, ১৯৬৯ : আইউব খান পদত্যাগ করেন এবং ইয়াহিয়া খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। নয়া প্রেসিডেন্ট সামরিক আইন জারি করেন। এই পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় জামায়াত নেতা চৌধুরী রহমত ইলাহী ঢাকায় আসেন শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। যথারীতি সাক্ষাৎ হয় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে এবং এসময় অধ্যাপক গোলাম আযমও উপস্থিত ছিলেন। অধ্যাপক গোলাম আযম এ প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, শেখ মুজিব চৌধুরী সাহেবকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে কোলাকুলি করলেন এবং আমাদের দু’জনের সাথে হাত মিলিয়ে ভেতরে খাস কামরায় নিয়ে গেলেন। বৈঠকখানায় তাঁর দলের দু’জন নেতৃস্থানীয়সহ কয়েকজন উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও তাদের কাউকে ভেতরে নিলেন না। তিনি আমাদেরকে বসাবার পর চৌধুরী সাহেবের সাথে কথা বলবার আগে আমাকে লক্ষ করে বললেন, ‘আযম সাহেব! আমি যদি জানতাম যে, আবার মার্শাল ল’ জারি হবে তাহলে আমার ভূমিকা সম্পূর্ণ ভিন্ন হতো।’ (জীবনে যা দেখলাম, ৩য় খণ্ড)।
১৯৭০ সাল ছিল পাকিস্তানে নির্বাচনের বছর। ১৯৬৯ সালের ২৮ নভেম্বর ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক তৎপরতা চালুর এবং বছর শেষে ৫ অক্টোবর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ঘোষণা দেন। দীর্ঘ আন্দোলনের ফসল মনে করেই এই নির্বাচনে- ফলাফল যাই হোক না কেন- জামায়াতে ইসলামী অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও আওয়ামী লীগ সে সময় বলতে গেলে নির্বাচনের ময়দানে কাউকেই দাঁড়িয়ে থাকতে না দেওয়ার নীতি গ্রহণ করে। ৬ দফা ও ১১ দফার পক্ষে আন্দোলনকারী বামপন্থী কোনো দলই নির্বাচনে সামান্য অনুগ্রহও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পায়নি। ন্যাপের ভাসানী গ্রুপ ও মোজাফ্ফর গ্রুপ এবং মুসলিম লীগের তিন গ্রুপ প্রার্থী দাঁড় করালেও আওয়ামী লীগের প্রচারাভিযানের দাপটে শেষ পর্যন্ত ঘোষণা দিয়ে তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। একমাত্র জামায়াতে ইসলামী ছাড়া আর কোনো দল ময়দানে দাঁড়িয়ে থাকেনি। (জীবনে যা দেখলাম, ৩য় খণ্ড : অধ্যাপক গোলাম আযম)।
নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ও পশ্চিমে পিপিপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। জামায়াত পশ্চিমে ৪টি ও পূর্বে ১টি আসন লাভ করে। সার্বিক ভোট প্রাপ্তির দিক দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে জামায়াতের অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। বিজয়ী আওয়ামী লীগকে জামায়াতের পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানিয়ে ৮ জানুয়ারি সংবাদপত্রে বিবৃতি দেওয়া হয় গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য বজায় রাখতে। ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে গড়িমসি করলে জামায়াতের পক্ষ থেকে এর প্রতিবাদ জানিয়ে ৮ জানুয়ারি সংবাদপত্রে বিবৃতি দেওয়া হয়। ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয় নিয়ে ইয়াহিয়া-মুজিব সংলাপের ফলাফল জানার জন্য ২৫ মার্চ সন্ধ্যে পর্যন্ত তৎকালীন জামায়াত আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আবদুস সামাদ আজাদ প্রমুখের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখেছিলেন। অতঃপর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং জামায়াতে ইসলামী সাংগঠনিকভাবে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।
এভাবে দেখা যায়, ষাট-এর দশকজুড়ে আন্দোলনকারী ৬২-র ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (এনডিএফ), ৬৭-র পিপলস ডেমোক্র্যাটিক মুভমেন্ট (পিডিএম), ৬৯-র ডেমোক্র্যাটিক অ্যাকশন কমিটি (ডাক) প্রভৃতি তৎকালীন সকল জোট ও আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ও জামায়াত ছিল পরস্পরের সহযোগী-সহযাত্রী। মাঝখানে ’৭১-এর এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর- মাত্র ৯ মাস সময়ের জন্য তারা পরস্পরের ‘জানি দুশমন’ বনে গেল। সময়ের প্রবাহে আবারও হলো অবস্থার পরিবর্তন। দুশমন আবার দোস্তে পরিণত হতে সময় লাগলো না। এই ৯ মাসের ঘটনাবলিরও কোনো যৌক্তিক বিশ্লেষণ করা হয়নি। শুধুই বিদ্বেষের হলাহল উদগিরণ করা হয়েছে। রাজনৈতিক স্বার্থের যুপকাষ্ঠে বলি দেওয়া হয়েছে অন্যের ন্যায়সঙ্গত ও গণতান্ত্রিক অধিকারকে।
একদলীয় ব্যবস্থা থেকে উত্তরণে
মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর আওয়ামী লীগ দেশে ইসলামপন্থী রাজনীতি নিষিদ্ধ করেই ক্ষান্ত হয়নি- ইসলামী শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও চেতনাকে বিলুপ্ত করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতির পরিবর্তে দেশে প্রায় একদলীয় শাসন চালু করে। মাত্র সাড়ে ৩ বছরের মাথায় ১৯৭৫ সালের জুন মাসে পুরোপুরি ‘এক নেতা এক দেশ’ নীতি নিয়ে বাকশাল গঠন করা হয়। বাকশাল নামক দল ছাড়া আর কারো রাজনীতি করার অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হয়। মাত্র ৪টি পত্রিকা সরকারের নিয়ন্ত্রণে রেখে বাকি সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দেওয়া হয়। সংবিধানের কুখ্যাত চতুর্থ সংশোধনীর সাহায্যে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। এভাবে সরকারের যে কোনো অন্যায়-অপকর্ম ও ভুল নীতির প্রতিবাদ করার রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। এমতাবস্থায় একটি নির্মম ঘটনার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনের অবসান ঘটে। অতঃপর জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সূচনা ঘটে নয়া গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার। তিনি রাজনৈতিক দল গঠনের সুযোগ উন্মুক্ত করার ঘোষণা দিয়ে বাকশালের ধ্বংসস্তূপের উপর গণতন্ত্রের পতাকা উড্ডীন করেন। ফলে কি ধর্মনিরপেক্ষবাদী, কি ইসলামপন্থী, আর কি বামপন্থী- আদর্শ-লক্ষ্য নির্বিশেষে রাজনীতির পথ উন্মুক্ত হয়ে যায়।
এই প্রেক্ষাপটে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মতো ইসলামপন্থীরাও দল গঠনে ব্রতী হয়। সময়ের চাহিদাকে সামনে রেখে গঠিত হয় ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক লীগ (আইডিএল)। আর নির্বাচনী লড়াইয়ের জন্য গঠন করা হয় ‘গণতান্ত্রিক ইসলামী ফ্রন্ট।’ নয়া গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার অংশ হিসেবে দেশে স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম সরাসরি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াকে ইসলামপন্থীরা সমর্থন দেয়। এর মধ্য দিয়ে ইসলামী রাজনীতির গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় পুনঃঅভিষেক ঘটে। এরপর অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের জাতীয় সংসদ নির্বাচন। জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ প্রভৃতিকে নিয়ে গঠিত ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক লীগ (আইডিএল)-র নেতৃত্বাধীন ‘গণতান্ত্রিক ইসলামী ফ্রন্ট’ এই নির্বাচনে ২০টি আসন লাভ করে। এই স্বল্পসংখ্যক আসনে বিজয়ী হয়েও এই ফ্রন্টের সদস্যগণ সংসদে ইসলামী মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার পাশাপাশি গণতন্ত্র চর্চার এক অনন্য নজির স্থাপন করেন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে দেশে গণতান্ত্রিক ধারাক্রমে আবারো বিচ্ছেদের সূচনা হয়। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল এরশাদের অবৈধ পন্থায় ক্ষমতা দখল ও সামরিক শাসন জারির ফলে সেই বিচ্ছেদ পূর্ণতা পায়। অতঃপর স্বৈরাচারের এক জগদ্দল পাথরকে অপসারণ করতে চলে দীর্ঘ ৯ বছরব্যাপী আরেক গণতান্ত্রিক সংগ্রাম।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও গ্রন্থকার
আপনার মন্তব্য লিখুন