post

বাংলাসাহিত্য ও কাব্যরাজ্যের কিংবদন্তি আল মাহমুদ

অধ্যক্ষ ডা: মিজানুর রহমান

২১ জানুয়ারি ২০২০

কাব্যজগতের রাজপ্রাসাদের রাজার রাজা আধুনিক বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি ও অমর কাব্যের কারিগর কবি আল মাহমুদ একটি নাম, একটি প্রতিষ্ঠান, একটি ইতিহাস। শহর, নগরের আধুনিক সভ্যতা ও অসভ্যতাকে পাশ কাটিয়ে আবহমান রূপসী গ্রামবাংলার স্নিগ্ধ, শ্যামল, সবুজ মাঠঘাট, নদ-নদীর জীবনসত্তা আর বৈচিত্র্যময় ঋতুর পরিবর্তনের মাটি-মানুষ ও জীবন প্রকৃতিকে রংধনুর সাত রঙের সংমিশ্রণে অপরূপ সাজসজ্জায় যিনি জীবন ও জগৎকে মনের মাধুরীতে সাজাতে পেরেছেন তিনিই আল মাহমুদ। রূপসী বাংলাকে অপরূপ সাজে গত ১ শ’ বছরে এভাবে কেউ সাজাতে পেরেছে তা আমার জানা নেই। যিনি চোখ দিয়ে ভিডিও করে আর হৃদয় দিয়ে সম্পাদনা করে সুদীর্ঘ ৬৭ বছরের কর্মক্ষম জীবনের ব্যবধানে মানবজীবন ও প্রকৃতিনির্ভর এক স্বর্গীয় প্রেমের চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও পরিচালনা করে দর্শক ও পাঠকদের অন্তরে আকাশ ও সমুদ্রের মতো জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি বহুমাতৃক প্রতিভা আর কর্মযজ্ঞের মহান নায়ক হিসেবে নশ্বর জগতে স্বাতন্ত্রিক সজীবতায় এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় সভ্যতার আলো ছড়িয়ে যাবেন চিরকাল এ কথা চ্যালেঞ্জ করে বলা যায়। বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা কায়েম করার দাবিতে মশালে মশালে কাব্যকথার চেরাগ জ্বালিয়েছেন। বাংলা, ইংরেজি ও আরবি শতাব্দীর পরিবর্তনের নীরব সাক্ষী হিসেবে বিচিত্র অভিজ্ঞতা আর জ্ঞানের আকর তিনি। সত্য-মিথ্যার মিজান, আলো-আঁধারের ফারাক প্রতীক তিনি। নদীপ্রবাহের ন্যায় জীবনপ্রবাহের ভেলায় ভাসতে ভাসতে জীবন সায়াহ্নে তিনি শাশ্বত জ্ঞানের সাথে মিশে গিয়ে অসাধারণ ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তিনি একাধারে কবি, ছড়াকার, গল্পকার, লেখক, প্রাবন্ধিক, নিবন্ধিক, সম্পাদক, ঔপন্যাসিক, শিশুসাহিত্যিক, সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, পলাতক ও হাজতখানার কয়েদি, সরকারি আমলা, অবশেষে বহুল আলোচিত সমালোচিত দেশপ্রেমিক মহান ব্যক্তি। কবির জন্ম, মায়ের কোল, শৈশব, কৈশোর, যৌবনের অমিত সম্ভাবনার জাল বুনাতে গিয়ে নদী-পাহাড়, ঝর্ণার, যাপিত তারুণ্যতা তাকে চলচ্চিত্রের নায়কের ন্যায় এক অনাকাঙ্ক্ষিত চিত্রায়িত হয়েছে তার কাঁধে সার্বক্ষণিকভাবে অবস্থানরত কিরাবান কাতিবিনের অডিও ভিডিওতে। আমার মনে হয় সেই অনুতাপের ফসল আজকের কবি আল মাহমুদ। জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক ঋতুচক্র, প্রকৃতি, সহপাঠী, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী, আকাশ-বাতাস, আগুন-পানি, পাহাড়-পর্বত, গাছ-পালা, বন-বনানী, নীল আকাশে মেঘের আনাগোনা, গ্রামগঞ্জ-শহর, নগর প্রাণিজগতের জীবণাচরণ এ সবই এক একজন শিক্ষক হিসেবে জীবনসত্তার রূপ ধারণ করে পাঠদান করে এ কবির জীবনে। কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য শিক্ষা-সংস্কৃতি, সাহিত্য-সভ্যতা, প্রগতি-দুর্গতি, বিজ্ঞান-দর্শন, আধুনিক প্রযুক্তির উৎকর্ষতা ধীরে ধীরে তাকে আকৃষ্ট করে। পাঠশালার পাঠ্যসূচির জ্ঞান, সাহচর্য, ভ্রমণ, পারিপাশির্^ক সমাজব্যবস্থা, শিল্প, সাহিত্য, চারু কারুকলার জ্ঞান, গার্হস্থ্য বিজ্ঞান, ক্রীড়া, কৌতুক ইত্যাদি দৃশ্যমান অভিজ্ঞতা তাকে সমহিমায় করে শিক্ষিত। সমকালীন রাষ্ট্রের মানচিত্র পরিবর্তন, বাংলা, ইংরেজি ও আরবি বা হিজরি সনের ৩টি শতবর্ষ পূর্তির বাস্তবচিত্র যিনি অবলোকন করেছেন চোখে, মনে ধ্যানে। শ্রেণীসংগ্রাম, ক্ষমতা ও ধনী-গরিবের মধ্যকার বৈষম্য এবং অন্নবস্ত্র বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ ভাষা ও সংস্কৃতির আগ্রাসন নদী ও পানি আগ্রাসান তাকে দারুণভাবে ভাবিয়ে তুলেছিল বলেই মানবতা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অগ্রসৈনিক বনে গিয়েছিলেন যৌবনকালেই। খাদ্যনিরাপত্তা, জননিরাপত্তা, জনসংখ্যার আধিক্য, যুদ্ধ-বিগ্রহ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ক্ষমতার পালাবদল, তন্ত্রমন্ত্রের বাহানা, যাতায়াত, যোগাযোগ, রেডিও, টেলিভিশন, মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, প্রজেক্টর, স্যাটেলাইট ইত্যাকার সুযোগ-সুবিধা, দুর্যোগ-দুর্ভোগ তাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করেছে, ভাবিয়ে তুলেছে। কামনা-বাসনা প্রেম-ভালোবাসা সমাজ-সংসার, মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তান, রুটি-রুজির জোগাড়, আহার-বিহার, শিক্ষা-দীক্ষা, মেধাচর্চা, সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নিরূপণ, সত্য শাশ্বত জীবনাদর্শ গ্রহণ অনুশীলন ও পরকালের জান্নাত আবিষ্কার করণে দেহ মন ও আত্মার উন্নতি সাধনে যিনি একজন সার্থক ব্যক্তি, তিনিই হলেন পরিপূর্ণ আলোকিত মানুষ। সমগ্র পৃথিবী এমন জ্ঞানী ব্যক্তিই কামনা করে। তাই একজন বিখ্যাত কবি লিখেছেন- “একটি প্রদীপ জ্বললে পরে, হাজার প্রদীপ জ্বলে, একটি মানুষ মানুষ হলে, হাজার মানুষ টলে।” জীবনের শেষবেলায় এসেও যিনি কোন চাপেই ফেলে আসা সাম্রাজ্য ও ইহুদিবাদ তথা সমাজতন্ত্র কিংবা প্রচলিত তন্ত্র মন্ত্রের ধার ধারেননি। এসবের অসারতা ও অক্ষমতা হারে হারে বুঝতে পেরেছিলেন বলেই খোদাদ্রোহী তাগুদের নিকট মাথানত করেননি বরং খোদাদ্রোহী অপশক্তির বিরুদ্ধে সিসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় দৃঢ় থেকে এ শতাব্দীর কবিদের, সাহিত্যিকদের, বুদ্ধিজীবীদের, সাংবাদিকদের, রাজনীতিবিদদের, প্রাবন্ধিকদের, অর্থনীতিবিদদের, উন্নয়ন কর্মীদের, পরিবেশবাদীদের, মানবতাবাদীদের, গবেষকদের, বিজ্ঞানীদের, চিকিৎসকদের, প্রতি উদাত্ত আহবান ও চেতনা জাগানিয়ার জয়গান গেয়ে গেলেন। তিনি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে নিজেকে একজন পূর্ণ ঈমানদার করে গড়ে তোলার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতেন। বিশেষ করে তিনি সর্বদা মুসলমানদের বিজয় ও সুদিন কামনা করতেন। তিনি প্রায় বলতেন, “মদীনার সৌরভ ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বের আনাচে কানাচে”। কবির এ আকুতি মিনতি মহান আল্লাহ নিশ্চয়ই একদিন বাস্তবায়ন করবেন ইনশাআল্লাহ। জগদ্বিখ্যাত মানুষের জীবনচরিত মূলত অন্ধকার আকাশে ধ্রুবতারার সমতুল্য। অন্ধকার সাগরে জাহাজের সারেং যেমন ধ্রুবতারা দেখে দিক নির্ণয় করে তেমনি অন্ধকার অসভ্য বিশ্বে মুক্তির মশাল হাতে যুগে যুগে, শতাব্দীর পর শতাব্দীতে এমন কিছু ক্ষণজন্মা মহামানবের আবির্ভাব ঘটে, যাদের দেখে পথহারা মানুষগুলো মহামুক্তির পথের সন্ধান লাভ করতে সক্ষম হয়। চরম মূর্খ ও অসভ্য তমসার যুগেও এমনি একজন বিশ্বমানব সভ্যতার রূপকারের আবির্ভাব ঘটেছিল পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের। যিনি মাত্র তেইশ বছরের ব্যবধানেই বিশ্বকে আলোকিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যিনি এমন এক মহাগ্রন্থের বার্তাবাহক যে গ্রন্থটি সর্বকালের সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য চির কল্যাণকর। শাশ্বত ও সর্বজনীন যে গ্রন্থটি কোন মানুষের রচনা নয় স্বয়ং মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালার। এই মহাগ্রন্থ আল কুরআনে কিসে মানুষের সফলতা আর কিসে ব্যর্থতা সে বিষয়ে সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে। দেরিতে হলেও এ কবি জেলখানার অবসর সময়ে সে জীবনব্যবস্থা সন্বন্ধে সম্যক ধারণা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি জীবনের একটি পর্যায়ে এসে আল কুরআনে সময় ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব অনুধাবন করেছিলেন। জীবন মানেই সময় এর মর্মার্থ বুঝতেই যে ঐশীবাণী তাকে বেশি আকৃষ্ট করে তা হলো- “সময়ের কসম। নিশ্চয়ই সমস্ত মানুষ ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত। তারা ছাড়া, যারা ঈমান এনেছে, সৎ কাজে নিয়োজিত রয়েছে। একে অন্যকে সত্য কাজ ও ধৈর্যের উপদেশ দিয়েছে।” এই সূরার মর্মার্থ হৃদয়ঙ্গম করতে তিনি মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীতে জানতে পারেন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- “মৃত্যুর পর পুনরুজ্জীবন দিবসে মানুষকে পাঁচটি বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হবে। (১) তার জীবন (সময়) সম্পর্কে যে কিভাবে তা ব্যয় করা হয়েছে? (২) তার যৌবন কাল সম্পর্কে বলা হবে, কেমন করে সে বার্ধক্যে উপনীত হয়েছে? (৩) সম্পদের বিষয়ে প্রশ্ন করা হবে, এই সম্পদ সে কিভাবে অর্জন করেছে? (৪) আর কিভাবেই বা তা খরচ করা হয়েছে? (৫) তার (অর্জিত) জ্ঞান নিয়ে সে কী করেছে?” তিনি মহানবীর আরেকটি হাদিস থেকে শিক্ষা নিয়েছেন যে, (১) “বৃদ্ধকাল আসার আগে যৌবনের, (২) অসুস্থতার আগে সুস্থতার, (৩) দারিদ্র্যের আগে সচ্ছলতার, (৪) ব্যস্ত হয়ে যাওয়ার আগে অবসরের ও (৫) মৃত্যু আসার আগে জীবনের।” সেই সাথে তিনি আরও শিক্ষা নিয়েছেন সূরা মুমিনুনের প্রথমাংশ, সূরা হাশর, সূরা বাকারার শেষাংশ ও সূরা জুমার ও সূরা সফের বিশেষ অংশ থেকে। সেই সাথে শিক্ষা নিয়েছেন বিশ^নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার সাহাবীদের জীবনাচরণ থেকে। যে কারণে তার জীবনে একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। জেল থেকে বেরিয়েই কবি তার অভিপ্রায় ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, “এক বছর বিনা বিচারে জেল খেটে আমি যে অর্জনটা করতে পেরেছি তা হলো মহাগ্রন্থ আল কুরআনের মর্মার্থ ভালোভাবে বুঝতে পেরেছি। যে কারণে আমি নিজেকে একজন বিশ^ মুসলিম উম্মাহর সক্রিয় সদস্য ভাবতে স্বাচ্ছন্দ্য ও গর্ববোধ করি। তার পরিবর্তনকে যারা মেনে নিতে কুণ্ঠাবোধ করেন ঈর্ষা করেন তাদেরকে উদ্দেশ করে তিনি অবজ্ঞা করে বলেন, “দাড়ি রাখলে আর ধর্মভীরু হলেই যদি কেউ মৌলবাদী হয়; তবে অবশ্যই আমি মৌলবাদী।” গত ১২ জুলাই ২০১৯ তারিখে প্রকাশিত দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার ভিতরকার ছোট কাগজে সপ্ত সিন্ধুতে আবিদ আজমের সাথে কবির অপ্রকাশিত এক সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হলে সেখান থেকে আমার আরও কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন হয়। সেই সাক্ষাৎকারের একাংশে এক প্রশ্নের জবাবে কবি বলেন- “প্রকৃত পক্ষে সমাজতন্ত্র বা পৃথিবীর কোনো আদর্শের প্রতি আমার কোনো ক্ষোভ নেই। একসময় খুব স্বাভাবিক পড়াশোনার মধ্যে দিয়ে মার্কসবাদের প্রতি আগ্রহী হয়েছিলাম। এই দর্শনের সঙ্গে আমার এক ধরনের সম্পৃক্ততাও ঘটে গিয়েছিল। তবে অন্য অনেক পড়াশোনা আমাকে এর থেকে সরে আসার প্ররোচনা দিয়েছে। একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষে পরিণত করেছে (আমাকে)। বলতে পারো আমি (কুরআন হাদীস ইসলামী সাহিত্য) পড়তে পড়তে বদলাই আর লিখতে লিখতে বিকশিত হই।” কবি আল মাহমুদ শেষ জীবনে ধর্ম বিশ্বাস ও একত্ববাদের প্রতি ভিতরে ভিতরে এতই অগ্রসর হয়েছিলেন যে, তার জীবনাচরণ বেশ-ভূষা চলাফেরা কথাবার্তা, আলোচনা, পর্যালোচনার ক্ষেত্রে একটি ভিন্ন সমতা সংযোজিত হতে থাকে, যে কারণে এককালের একশ্রেণীর ভক্তদের ভাবিয়ে তোলে। শেষ পর্যন্ত তার জীবনধারার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়ে মুষ্টিমেয় জ্ঞানপাপী তাকে মৌলবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করতে থাকে। জীবনের শেষ প্রান্তে, এসে প্রতিহিংসার দাবানল প্রসারিত হতে হতে শাসকগোষ্ঠীর মাথায়ও বাসা বাঁধে। যে কারণে কবির মৃত্যুর পরও শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে তার দাফন করতে আপত্তি জানায়। যে কারণে মহান এ কবির মর্যাদা নিরাপদ ও পবিত্র স্থানে সমাহিত করার মাধ্যমে আল্লাহ তা’য়ালা অক্ষুন্ন রেখেছেন বলে অনেকেরই ধারণা। তার পরও প্রশ্ন জাগে কী অপরাধ ছিল এই বর্ষীয়ান প্রবীণ কবির। যিনি পুরো জীবন যৌবন বিলিয়ে দিয়ে অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় জ্ঞান সাধনা করেছেন, অর্জন করেছেন বহু পুরস্কার ও সম্মাননা। এই মহান কবি ২০০০ এর দশকে একবার জামালপুর জেলা পরিষদ মিলনায়তনে প্রধান অতিথি হিসেবে একটি সাহিত্য সেমিনার ও সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় এসেছিলেন। সে অনুষ্ঠানে তার দরাজ দিলের কণ্ঠে স্বরচিত কবিতা ও মহামূল্যবান বক্তব্য ও জীবনের অভিজ্ঞতার বর্ণনা শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। তিনি বলেন “মানুষের বিশ্বাস, ধর্ম মানুষকে একটা চিরন্তন আশ্রয়ের (জান্নাতের) আশ্বাস দেয়। এ আশ্বাসের বলেই মানুষ পরকালে বিশ্বাস করে। মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে বিশ্বাস করে। আমি মনে করি এই পার্থিব জীবনটাই শেষ নয়। মৃত্যুর পরও (আমার) একটা জীবন শুরু হবে। তবে আমার সাম্যবাদে বিশ্বাসীদের প্রতি আমার কোনো বিদ্বেষ নেই। ব্যক্তিজীবনে আমি একসময় সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলাম। পরে আমার বিশ্বাসের (ইনসানিয়াতের) কাছে ফিরে এসেছি।” সেদিন আমি বুঝেছিলাম কাব্যে সাহিত্যে তিনি একজন কীর্তিমান ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব। তাঁর চেহারায়, চোখে, পোশাক-আশাক আচার-আচরণ, কথা-বার্তায়, টাক মাথার উপরে সাদা বলাকার পালকের ন্যায় লম্বা উড়ন্ত পাতলা পাতলা সাদা চুল, কালো ফ্রেমের চশমা, কপালে ও অবয়বে প্রবীণতার ছোট ছোট দাগের ছাপ, ধূসর তিলক, চুন সুপারি ও সুগন্ধি মশলার উপর-নিচ ছোপ ছোপ লালবর্ণের দাগের ঠোঁট যেন মণিমুক্তার দরজা বলে মনে হয়েছিল আমার।

কবির জন্ম ও পরিচয় বিংশ শতাব্দীর এই আলোচিত সার্থক প্রতিভাধর মানুষটির পুরোনাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। তিনি ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুর রব মীর এবং মাতার নাম রওশনারা। তার দাদার নাম আব্দুল ওয়াহাব মোল্লা যিনি ব্রিটিশ ভারত শাসনামলে হবিগঞ্জ জেলার জমিদার ছিলেন। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি বড় ছিলেন। আল মাহমুদ ব্যক্তিগত জীবনে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানার বীরগাঁও গ্রামের সৈয়দা নাদিরা বেগমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির ঘরে ৫ ছেলে ও ৩ মেয়ে রয়েছে।

শিক্ষাজীবন কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দিতে সাধনা হাইস্কুল এবং পরে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড হাইস্কুলে পড়ালেখা করেন। তিনি যখন সীতাকুন্ড হাইস্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন তখন তিনি পূর্ণ যুবক। যৌবনের শুরুতেই নিজ বাড়িতে একটি অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার দায় এড়াতেই ভয়ে বাড়ি ছাড়েন। বাড়ি ছাড়ার কারণে স্কুলও ছাড়তে হয়। যে কারণে কবি নজরুলের মতো নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেখাপড়ার সুযোগ পাননি। তাই বলে তিনি অপ্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার কাছে হার মানেননি। বরং তিনি হাঁটিহাঁটি পা পা করে নিজেকেই একটি অত্যাধুনিক ও ঐশ^রিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রেক্টর ও আকর করে তৈরি করেন। যারা তাঁর এ প্রতিষ্ঠানের আলোয় পরশ পেয়েছেন তাঁরা সুভাগা আর যাঁরা তা পাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছেন কিংবা সাময়িক স্বার্থের জন্য নিজেদের বিবেকবোধ বিসর্জন দিতেও কুণ্ঠাবোধ করেননি তারা আদতেই দুর্ভাগা। তবে এ কথা জোর দিয়ে বলা যায় যে, এই মহান কবির কবিতার তুফান ঠিকই একদিন জ্ঞানপাপীদের সমস্ত অর্জনকে ধূলিকণার ন্যায় উড়িয়ে দিবে। এই মানুষটি যখন সর্বপ্রথম ঢাকায় আসেন তখন পাকিস্তান আমল। পৈতৃকসূত্রে পাওয়া লাল রঙের একখানা ভাঙা সুটকেস বগলে আগলে ধরে রাজধানীতে পা রাখেন। যার ভিতরে কুঁচকে ভাঁজ পড়া লুঙ্গি আর গায়ের জামা। সাথে জীবনসত্তা তিতাস নদীর অমর স্মৃতি ফুল পাখি তার জন্মস্থানে, মায়া সমতলে, ভরপুর নয়নাভিরাম সবুজ শ্যামল সোনার বাংলার কয়েকটি গ্রামের জীবন ও প্রকৃতির রসদ। বাল্যকাল থেকেই তিনি ছিলেন চঞ্চল, ডানপিটে, উদার ও ভাবুক প্রকৃতির। মাটি ও মানুষের প্রতি তার মমত্ববোধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ যুদ্ধের দুর্ভোগ ও বিভীষিকাময় জীবনবৈষম্য তাকে ভাবিয়ে তুলতো। তিনি যদিও এসবের সমাধানে কিছু করতে পারবেন না তবুও মনের মধ্যে একটা তাপদাহ যন্ত্রণা জিজ্ঞাংসার আগুন জ্বালাতেন অন্তরে অন্তরে। তার নজির প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময়। তিনি তখন নবম শ্রেণীর টগবগে যুবক। দুধে আলতায় তার দেহের রঙ বেটে করে তার দেহের গড়ন। মুখে তার প্রতিবাদী অভিব্যক্তি। সেই সময় কিশোর আল মাহমুদ একটি কবিতা লিখেছিলেন, যে কবিতার চারটি লাইন তৎকালীন “ব্রাহ্মণবাড়িয়া ভাষা আন্দোলন কমিটির” এক লিফলেটে প্রকাশিত হয়। এই লিফলেটের কবিতার সূত্র ধরেই কবিকে গ্রেফতার করার জন্য পুলিশ খুঁজতে থাকে। যে কারণে কবিকে বহুদিন আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে। সেই সময় বিভিন্ন সংবাদপত্রে তার লেখা প্রকাশিত হতে থাকার সুবাদেই তিনি ১৯৫৪ সালে ঢাকা আগমন করেন। সমকালীন বাংলা সাপ্তাহিক পত্র-পত্রিকার মধ্যে কবি আব্দুর রশীদ ওয়াসেকপুরী সম্পাদিত ও নাজমুল হক প্রকাশিত সাপ্তাহিক কাফেলা পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় প্রুফ রিডার হিসেবে সাংবাদিকতা জগতে পদচারণা শুরু করেন। ১৯৫৫ সালে কবি আব্দুর রশীদ ওয়াসেকপুরী কাফেলা পত্রিকায় চাকরি ছেড়ে দিলে কবি সেই পত্রিকার সম্পাদক পদে যোগদান করেন। কবি আল মাহমুদ থেমে থাকেননি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ও সব শেষে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ভাষা আন্দোলন ও ভাষা অধিকারের স্বপক্ষে কবিতা লিখে তিনি ফেব্রুয়ারির পাখি উপাধি পেয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি ভারত গমন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। আর দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের পর দেশটি স্বাধীন হলে অস্ত্রের পরিবর্তে দেশ গড়ার প্রত্যয়ে কলম হাতে নিয়েছিলেন। তৎকালীন জাসদের মুখপাত্র হিসেবে খ্যাত দৈনিক গণকণ্ঠ নামক পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন। সম্পাদক থাকাকালীন এ সময় সরকারের বিরুদ্ধে লেখার কারণে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ করা হয় এবং কবিকে ১৭ মার্চ ১৯৭৪ সালে কারাদণ্ড দিয়ে জেলহাজতে পাঠানো হয়। তিনি যখন জেলে গেলেন তখন জাসদের অনেক তরুণ যুবক জেলে বন্দী ছিল। তারা আল মাহমুদকে পেয়ে বেশ উৎফুল্ল হলো। আর আল মাহমুদও তাদের দেখে প্রাণ ফিরে পেলেন। এদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তীতে একেকজন খ্যাতি অর্জন করে স্মরণীয় বরণীয় হয়েছিলেন। যেমন- মশিউর রহমান যাদু মিয়া, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, শ্রমিক নেতা লিয়াকত আলী, অলি আহমদ, কমরেড খালেকুজ্জামান, মেজর জয়নাল আবেদীন, কবি দাউদ হায়দারসহ আরো অনেকে। এদের মধ্যে আইনি বিষয়ে মওদুদ আহমদ ও মশিউর রহমান তাঁর একান্ত জেলসঙ্গী হিসেবে সাহস সাহচর্য সবচেয়ে বেশি দিয়েছেন। কবির জেলখানার জীবন যাপনে কবির বন্ধু দাউদ হায়দারের বড় ভাই মশিউরের স্নেহ, ভালোবাসা জেলখানার মধ্যে কবি সকল প্রকার দুঃখ কষ্ট ভুলে যেতেন। একসাথে জেলখানার বাইরের খাবার ভাগাভাগি করে খেতেন। মশিউর রহমান বলতেন- আল মাহমুদ শোন, “জীবন কখনো সমান্তরাল চলে না। জীবনে উত্থান পতন আছে, খানাখন্দ আছে। আছে সাফল্য ও ব্যর্থতা। জেলজীবন নেতাদের জন্য জনপ্রিয় হওয়ার জায়গা। আর সৃষ্টিশীল মানুষের জন্য লেখালেখি ও পড়াশোনার অবারিত নিরাপদ সুযোগ। অতএব, তোমার হারানোর কিছু নেই। তুমি তোমার কবিতাতে ডুবে যাও। ডুবে যাও বইয়ের বুকে।” যাদু মিয়ার এসব যাদুকরী মহামূল্যবান জ্ঞান ও কথা আল মাহমুদকে অসাধারণভাবে আন্দোলিত করেছিল। মূলত যাদু মিয়া স্বভাবতই মানবিক ও সৃষ্টিশীল মানুষকে বেশি ভালোবাসতেন। জেলের বন্দী হিসেবে আল মাহমুদকে খুব বেশি ভালো লাগতো। তিনি পছন্দ করতেন সৃষ্টিশীল কবিতা। কবির বন্ধু কবি দাউদ হায়দারের নিকট থেকে মশিউর আল মাহমুদ জেলে আসার পূর্বেই কবি সম্পর্কে অনেক বিষয়ে জানতে পেরেছিলেন বলেই কবির প্রতি তার দায়বদ্ধতা ও স্নেহশীল মনোভাব প্রকাশিত হতে থাকে অবারিতভাবে। কবি ও সম্পাদক আল মাহমুদ দীর্ঘ এক বছর জেলহাজতে কাটাতে থাকাকালীন তার প্রিয় বন্ধু গিয়াস কামাল চৌধুরীসহ অন্যান্য প্রিয় বন্ধুদের প্রচেষ্টায় তিনি জেল থেকে ছাড়া পান ৯ মার্চ ১৯৭৫। এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কবিকে ডেকে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে কবির হাতে তিন হাজার টাকা গুঁজে দেন। শুধু তাই নয়, কবির দৃঢ়তা সাহস ও কর্মযোগ্যতা এবং বিচক্ষণতার বিষয়টি বিবেচনা করে তাকে ১৯৭৫ সালে শিল্পকলা একাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের সহকারী পরিচালকের চাকরি প্রদান করেন। এ পদে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে পরিচালকের পদটি খালি হওয়ায় তিনি দীর্ঘদিন পরিচালকের দায়িত্বে আসীন থাকা অবস্থায় ১৯৯৩ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তথ্যমতে জানা যায়, কবি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রবাসী মুজিবনগর বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বিভাগের স্টাফ অফিসার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার প্রুফ রিডার ও মফস্বল সম্পাদক ছিলেন। চট্টগ্রামের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বইঘরের প্রকাশনা কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছেন। চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত ‘দৈনিক কর্ণফুলীর’ সম্পাদক হিসেবেও বহুদিন দায়িত্ব পালন করেন। মূলত কাব্যে, সাহিত্যে চলচ্চিত্রে, মিডিয়াতে আজ আদর্শ চিন্তাধারায়, সভ্যতা বিনির্মাণের কোনো ভালো মানের কারিগর তৈরি হচ্ছে না। এ দুর্যোগে দুঃসময়ে ধ্রুবতারার ন্যায় বটবৃক্ষের ন্যায় আবির্ভূত হয়ে কবি আল মাহমুদ এক শতাব্দীর মানুষ গড়ার সার্থক কারিগর হয়েই বিদায় নিলেন। যিনি খন অনুকার আঁধারের কালো মেঘ থেকে স্বচ্ছ, নিরাপদ বৃষ্টির পানি বর্ষণ করে শীতল করলেন মরুকরণ সাহিত্যের অঙ্গন। হৃদয়ের জমিনে চাষ করালেন সভ্যতার যুগের ফুলের বাগান। চিরন্তনী প্রেম, অবিনশ্বর জগতের মুক্তির আগাম বার্তা, ইহজগতের বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থার স্বপ্নিল জগৎ। যেমনটা করেছিলেন রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ, কবি ফেরদৌসী রুমি, ওমর খৈয়াম। বর্ষীয়ান এই কবির সুপ্ত প্রতিভা বাল্যকাল থেকেই বিস্ময়কর ও অদ্ভুত ধরনের। সেই ১৯৫৩ সাল থেকেই কাব্যজগতে তার পদচারণা এ যতই দিন যেতে থাকে ততই তার সে সুপ্তপ্রতিভা বিকশিত হতে থাকে এবং ইসলাম বুঝার সুবাদে তা আরো পত্রপল্লবে সুশোভিত শাণিত হতে থাকে। ১৮ বছর বয়সে তার লেখা কবিতা ঢাকা থেকে প্রকাশিত সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকা এবং কলকাতার নতুন সাহিত্য চতুষ্কোণ ‘ময়ূখ’ ‘কৃত্তিবাস’ ও বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায় লেখালেখির সুবাদে ঢাকা কলকাতার পাঠকদের কাছে তিনি সুপরিচিত হন। তাঁর লেখা ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ ও ‘একুশে কবিতা’ নামে ঐতিহাসিক সঙ্কলন প্রকাশিত হয় কবি হাসান হাফিজুর রহমান ও কবি আজিজুল হাকিম এবং আব্দুর রশীদ ওয়াসেফপুরীর সম্পাদনায়। এর পরই যতই দিন যাচ্ছিল ততই এই মহান কবির ক্ষুরধার লেখনী ও প্রতিভার গ্রহণযোগ্যতার মাত্রা বেড়েই চলছিল পাঠকের হৃদয়ে এবং ছাপার জগতে। অতুলনীয় বর্ণনা, কল্পনা, বিস্ময়কর, জীবন ও প্রকৃতির বর্ণনা, জীবনযাত্রা ও ভাবনার অলিগলিতে স্মৃতির ক্যানভাসে এক অসাধারণ পিরামিড ও ভাস্কর্য তৈরি করে আমাদের যে ঋণী করে চলে গেলেন যা বর্ণনার মতো ভাষা আমার জানা নেই। তাঁর কবিতায় নীরব চিন্তার বিকাশ, ধ্যানের ও জ্ঞানের নীরবতাসহ মানবতার কল্যাণ, প্রেম ভালোবাসা, মায়া-মমতা, নীল আকাশ, জ্যোৎস্না, সকাল-বিকেলের রোদে নদীর পানিতে সোনালি রুপালি ঝিকিমিকি, আকাশ, পাহাড়, নদ-নদী, ফুল, পাখি, বৃষ্টি, নৌকা, যুবক, যুবতীর বৈশ্বিক জীবন প্রকৃতি, ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিসহ চলমান রাজনীতির ধরন ধারণ, বৈষম্য এবং মানবতা ও মানবাধিকার নিশ্চিত করে পরকালের আবাসস্থল যেন সুখময় হয় সেটিই তাঁর জীবনদর্শনের শেষ লক্ষ্য। তিনি কদর রাত্রির প্রার্থনা কবিতার একাংশে লিখেছেন- “হে অনুকম্পার মহান অধিপতি/ এই মহা নগরীর ভদ্রবেশী বেশ্যা, লম্পট, হেরোইন সেবী ও ছিনতাইকারীর/ প্রাত্যহিক পাপের দেনায় আমার অন্তর অতিষ্ঠের সাথে যোগ দিয়েছে বিশ^বিদ্যালয়ের মহান পণ্ডিতেরা/ শিক্ষার প্রতিটি প্রাঙ্গণে কিশোর হত্যার মহাপাপে এখন রক্তাক্ত পঙ্কিল/ প্রভু! ছিনতাইকারী, পঙ্কিল ও বেশ্যাদের হাত থেকে তুমি কি ইসলামকে রক্ষা করবে না?” স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে যে পরিমাণ অবদান তিনি রেখে গেলেন তা একটি প্রবন্ধে প্রকাশ করা একেবারেই অসম্ভব। চলমান শতাব্দীতে কবিতায় সাহিত্যে বাংলাদেশের জাতীয় আত্মপরিচয় গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যে কয়েকজন লেখক অবদান রেখেছেন তাদের মধ্যে আল মাহমুদ অন্যতম। তারপরও এক অদৃশ্য কারণে কবির যথাযথ সম্মান ও প্রাপ্তিতে কিছুটা হলেও অবহেলিত। যে বিষয়টি ফুটে উঠেছে তাঁর প্রবন্ধ সঙ্কলন ‘সাহসের সমাচার’ গ্রন্থের মাধ্যমে। তিনি বারবারই এ কথাটা বলেছেন, “তোমরা আমাকে বোঝোনি”। আমি বলি না বুঝবে না, বুঝবে। তবে তখন আমি আর থাকবো না। তবে এটা মনে রেখো, বাংলা সাহিত্যে যারা কিছু করতে চাও, আমাকে তোমার পাঠ করতেই হবে। এটা আমার আত্মবিশ্বাস। ভারতবর্ষের সমকালীন বাংলা কবিতায় জ্যামিতিক পরিমাপে যে পদ্ধতিতেই এই কবির কবিতা, সাহিত্যের মূল্যায়নের রেখা অঙ্কন করা হোক না কেন, সেক্ষেত্রে এই কাব্যস্রষ্টার কবিতার বৃত্তে সাহিত্যের উপাত্তে সব সময়ই ৯০-৯৫ ডিগ্রি কোণে ফলাফল নির্ণীত হবে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল, পল্লীকবি জসীম উদ্দীন, কবি শামসুর রাহমান, কবি গোলাম মোস্তফা, কবি জীবনানন্দ দাশ, কবি নির্মলেন্দুগুণ, কবি হাসান হাফিজুর রহমান, কবি ইসমাইল হোসেন সিরাজীর মতো খ্যাতনামা কবিদের চিন্তা, দর্শন, দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাষাতত্ত্বের গুণ বিচারে তিনি কিন্তু অনেকাংশে ভিন্ন ধারার অদ্ভুত ও অসাধারণ প্রকৃতির ছিলেন। যে কারণে কবির গ্রহণযোগ্যতা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে। শোষিত বঞ্চিত অবহেলিত গণমানুষের অধিকার নিশ্চিতকরণে এবং সর্বপ্রকার বৈষম্য ও অমানবিকতা অন্যায় অত্যাচার জেল জুলুমের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন বিদ্রোহী। পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এবং অতঃপর ইহুদিবাদের বিরুদ্ধে তাঁর কলম বরাবরই ছিল কাচকাটা হীরের মতো তীব্র ধারালো। তিনি মানবতার শত্রু স্বৈরাচার ও তাগুত বা অপশক্তির নিকট বিক্রি হয়ে যাননি। বিবেকবর্জিত বিষয়ে তিনি ছিলে আপসহীন এক যোদ্ধা। সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্বে তিনি বরাবরই সত্যের জয়গান গেয়েছেন। মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি তার আনুগত্যের মাত্রা এতই প্রখর হয়ে গিয়েছিল যে সত্য প্রকাশে তার কোনো ভয়ঙ্কর একেবারেই ছিল অনুপস্থিত। তিনি একজন ঈমানদার কবি ছিলেন। ইসলামী আন্দোলন, ইসলামী সংগঠন ও তার নেতা-কর্মীদের আপন ভাইয়ের থেকে বেশি ভালোবাসতেন। যে কারণে খোদাদ্রোহী প্রগতিশীল শ্রেণীর কিছু মানুষ তার প্রতি বীতশ্রুদ্ধ হয়ে নানা প্রকার বাক্য মন্তব্য করতেও দ্বিধা করেননি। তারপরও এই শ্রেণীর মানুষের প্রতি রাগ-অনুরাগের কোনো অভিব্যক্তি কবির মুখে বা লেখায় প্রতীয়মান হয়নি। তার দৃঢ় বিশ্বাস ঠিকই একদিন কাব্য সম্ভার তাদের অনুপ্রাণিত করবে। অপেক্ষা শুধু সময়ের। জীবনের অঙ্কে আল-মাহমুদ একজন সার্থক অঙ্কবিশারদ। জীবনের নানা পাকের মাঝে শেষ ভালো তাঁরই ললাটে শোভাবর্ধন করেছে। এ কথাটি -মান্না দে এর গানের একটি কলির মাধ্যমে প্রকাশ করা যেতে পারে। যেমন- দুঃখ আমাকে দুঃখী করেনি, করেছে রাজার রাজা- এ গানের মর্মার্থ যথার্থই তার জীবনের ওপর নানা ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে। কবির লেখা ‘কবিতা সমগ্র’ ৩৭৯ পৃষ্ঠার কাব্যগ্রন্থের ভূমিকা তথ্য মতে কবি সম্বন্ধে জানা যায়- তিনি একুশ বছর বয়স পর্যন্ত এ শহরে এবং কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি থানার অন্তর্গত জগৎপুর গাঁয়ের সাধনা হাইস্কুলে এবং পরে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড হাইস্কুলে পড়াশোনা করেন। এসময়ই লেখালেখি শুরু। ঢাকা ও কলকাতার সাহিত্য-সাময়িকীগুলোতে ১৯৫৪ সাল থেকে তার কবিতা প্রকাশ পেতে থাকে। কলকাতার নতুন সাহিত্য, চতুষ্কোণ, চতুরঙ্গ, ময়ূখ ও কৃত্তিবাসে লেখালেখির সুবাদে ঢাকা ও কলকাতার পাঠকদের কাছে তার নাম সুপরিচিত হয়ে ওঠে। এসময় বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায় তার কয়েকটি কবিতা ছাপা হলে সমসাময়িক কবি-মহলে তাঁকে নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়। ঢাকা থেকে প্রকাশিত সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সমকাল’ পত্রিকায় তখন তিনি নিয়মিত লিখতে শুরু করেন। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার তিরিশদশকীয় প্রবণতার মধ্যেই ভাটি বাংলার জনজীবন গ্রামীণ দৃশ্যপট, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের কর্মমুখর জীবনচাঞ্চল্য ও নর-নারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহের বিষয়কে অবলম্বন করেন। আধুনিক বাংলাভাষার প্রচলিত কাঠামোর মধ্যেই অত্যন্ত স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায় আঞ্চলিক শব্দের সুন্দর প্রয়োগে কাব্যরসিকদের মধ্যে আল মাহমুদ নতুন পুলক সৃষ্টি করেন। সমালোচকগণ তাকে জসীম উদ্দীন ও জীবনানন্দ দাশ থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রধারার এক নতুন কবি প্রতিভা বলে উল্লেখ করতে থাকেন। এ সময় ‘লোক লোকান্তর’ ও ‘কালের কলস’ প্রকাশিত হয়। আল মাহমুদ দু’টি মাত্র কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯৬৮ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে আল মাহমুদ সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। ’৭১-এ বিজয়ীর বেশে কবি দেশে ফিরে এসে ‘গণকণ্ঠ’ নামক একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং দেশে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বৈপ্লবিক আন্দোলনকে সমর্থন দানের অপরাধে গ্রেফতার হন। তার আটকাবস্থায় গণকণ্ঠ সরকার বন্ধ করে দেয়। ১৯৭৫-এ আল মাহমুদ জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের সহ-পরিচালক পদে যোগদান করেন। পরে ওই বিভাগের পরিচালক রূপে ১৯৯৩ সালের এপ্রিলে তিনি অবসর নেন। কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধের বই মিলিয়ে আল মাহমুদের বইয়ের সংখ্যা তিরিশের বেশি। তিনি বহু পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকী সম্পাদনা করেছেন। কবির সখ বইপড়া ও ভ্রমণ। তার দেখা শহরগুলোর মধ্যে ভারতের কলকাতা, দিল্লি, ভোপাল, ব্যাঙ্গালুরু, আজমীর। সউদি আরবের মক্কা, মদীনা ও জেদ্দা। আরব আমিরাতের দুবাই, আবুধাবি, শারজাহ্ ও বনিয়াস। ইরানের তেহরান, ইস্পাহান ও মাশহাদ। যুক্তরাজ্যের লন্ডন, ম্যানচেস্টার, গ্লাসগো, ব্রেডফোর্ড ও ওল্ডহাম অন্যতম। আল মাহমুদ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একুশের পদকসহ বেশকিছু সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এতো কিছুর পরও তিনি নিজস্ব স্বকীয়তায় সমান তালে চালিয়ে যেতে থাকেন তাঁর সৃষ্টিযজ্ঞ। যিনি একাধারে বহু পুরস্কার ও সম্মাননা গৌরব অর্জন করেন। ১. বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৮) ২. জয়বাংলা পুরস্কার (১৯৭২), ৩. হুমায়ুন কবীর স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭২), ৪. জীবনানন্দ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭২), ৫. কাজী মোতাহার হোসেন স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৬), ৬. কবি জসীম উদ্দীন পুরস্কার (১৯৮৬), ৭. ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৬), ৮. একুশে পদক (১৯৮৬), ৯. নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক (১৯৯০), ১০. ভানুসিংহ সম্মাননা পদক (২০০৪) ১১. লালন পুরস্কার (২০১১)। ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরস্কার, অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার, সুফী মোতাহের হোসেন সাহিত্য স্বর্ণপদক, লেখিকা সংঘ পুরস্কার, ফররুখ স্মৃতি পুরস্কার, হরফ সাহিত্য পুরস্কার ও জীবনানন্দ দাশ স্মৃতি পুরস্কার অন্যতম। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তিনি ঢাকার মগবাজার থেকে প্রকাশিত জনপন্থী ভাবধারার মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন এবং বার্ধক্যজনিত কারণে অবসর গ্রহণ করেন। আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, আল মাহমুদের কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের আগে বাম ধারায় চিন্তা চেতনা দেখা গেলেও ১৯৭৪ সালে জেল খাটার পর থেকে ইসলামী ভাবধারা পরিলক্ষিত হয়। তবে এ কথাটি জোর দিয়ে বলা যায় যে ১৯৫০ সালের পর বাংলা সাহিত্যে যত কবির আবির্ভাব হয়েছে শিল্পমান এবং লেখার বিচার বিশ্লেষণ করা আল মাহমুদকে সন্দেহতীতভাবে প্রথম সারিতেই রাখতে হয়। কবি তার কাব্যগ্রন্থ ‘লোক লোকান্তরে’ (১৯৬৩) ‘কালের কলস’ (১৯৬৬), ‘সোনালী কাবিন’ (১৯৬৬), ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠে’ (১৯৬৬), কাব্যগুলো প্রথম সারির কবি কাতারে দাঁড় করিয়েছে। কবি আধুনিক বাংলা কবিতার নগরকেন্দ্রিক প্রেক্ষাপটে ভাটি বাংলার জনজীবন, গ্রামীণ আবহ, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের জীবনপ্রবাহ এবং এর নারীর চিরন্তন প্রেম বিরহকে তার কবিতায় অবলম্বন হিসেবে দাঁড় করিয়েছেন। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘কবি ও কোলাহল’। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি গল্প লেখার দিকে মনোযোগী হন। ১৯৭৫ সালে তার প্রথম ছোট গল্পগ্রন্থ ‘পানকৌড়ির রক্ত’ প্রকাশিত হয়। তার সবচেয়ে সাড়া জাগানো সাহিত্যকর্ম ‘সোনালী কাবিন’। এছাড়া পাঠক মহলে সমাদৃত আরব্য রজনীর রাজহাঁস, বখতিয়ারের ঘোড়া, অদৃশ্যবাদীদের রান্না-বান্না দিনযাপন, দ্বিতীয় ভাগেস, একটি পাখি লেজ ঝোলা, পাখির কাছে ফুলের কাছে, আল মাহমুদের গল্প, Selected Poems-1981, গল্প সমগ্র, প্রেমের গল্প, যেভাবে বেড়ে উঠি, কিশোর সমগ্র, কবির আত্মবিশ্বাস, কবিতা সমগ্র-২, পান, সৌরভের কাছে পরাজিত, গন্ধ বণিক, ময়ূরীর মুখ, না কোন শূন্যতা মানি না, নদীর ভেতরের নদী, প্রেম ও ভালোবাসার কবিতা, প্রেম প্রকৃতির দ্রোহ আর প্রার্থনা কবিতা, প্রেমের কবিতা সমগ্র, উপমহাদেশ, বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ, উপন্যাস সমগ্র ১, ২, ৩ তোমার গল্পে ফুল ফুটেছে (২০১৫) ছায়ায় ঢাকা মায়ার পাহাড়, (রূপকথা) ত্রিশেরা, উড়ান কাব্য ইত্যাদি। কবি তার কবিতায় যে মৌলিকত্ব ক্ষমতা মমতার বন্ধনে বাংলাদেশকে বাংলাদেশের প্রকৃতি ও জীবনের মালা গেঁথেছেন তা আর অন্য কোনো কবির পক্ষে সম্ভব হয়নি। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে কলকাতার বাংলা ভাষাকে এড়িয়ে নতুন পূর্বকল্পীয় ভাষার প্রয়োগ করে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট লেখক সমালোচক শিবনারায়ণ রায় যথার্থই বলেন- “বাংলা কবিতায় নতুন সম্ভাবনা এনেছেন আল-মাহমুদ, পশ্চিম বাংলার কবিরা যা পারেননি তিনি সেই অসাধ্য সাধন করেছেন।” বাংলা কবিতার জন্মভূমি রাজধানী কলকাতার পর দ্বিতীয় জন্মভূমি বাংলাদেশের ঢাকাকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার মহান নায়ক হিসেবে বিবেচনা করলে সর্বপ্রথম আল মাহমুদের নাম লিখতে হবে। আর ১৯৯০-২০১৯ সালের এ দশকে কবিকে কবিতার বিশ্ব স্রষ্টার প্রতি বিশ্বাস, মহানবীর রেখে যাওয়া আদর্শ ও সাহাবী চরিত তাঁকে সমৃদ্ধ ও আকৃষ্ট করতে থাকে। তিনি তথাকথিত প্রগতিশীলদের সমালোচনার মুখোমুখি হতে থাকেন। আর যখন তিনি ইসলামী রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়েন মেজর জলিলের ন্যায় তখন বিদ্বেষ পোষণকারীদের বিশেষ করে তথাকথিত লেখক বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। জীবনের শেষ বেলায় কবি নিউমোনিয়াসহ বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভোগাকালীন রাজধানী ঢাকার ইবনে সিনা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। জীবনসায়াহ্নে তিনি লিখলেন “আমার যাবার কালে খোলা থাক জানালা দুয়ার/যদি হয় ভোরবেলা। স্বপ্নচ্ছন্ন শুভ শুক্রবার।” মৃত্যুকে কামনা করে কবির এ আকুতি মঞ্জুর হলো ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ তারিখ শুক্রবার রাত ১১টা ৫ মিনিটে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। বাংলাসাহিত্যের অন্যতম এই শ্রেষ্ঠ কবি আল মাহমুদ তাঁর জন্মস্থান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহরের দক্ষিণ মোড়াইল এলাকার পারিবারিক কবরস্থানে মরহুম মা-বাবার পাশে শয়নের মাধ্যমে ইহজগৎকে বিদায় জানান। এই প্রশান্ত আত্মার বিকিরণ ছুঁয়ে যাক আগামী শতাব্দীর মানবতাবাদীদের অন্তরে। প্রতিষ্ঠিত হোক কবি মনের অকৃত্রিম স্বপ্নিল ভাবনা। আমিন। লেখক: জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রাবন্ধিক সাংবাদিক ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির