post

বাংলায় খিলজী শাসন

আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ

২২ মার্চ ২০২৪

ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী জন্মগ্রহণ করেন আফগানিস্তানের হেলমান্দের দাশ্ত-ই-মার্গে। দুর্ধর্ষ কিন্তু কপর্দকহীন এই তুর্কি বীর মুহাম্মদ ঘুরী কিংবা কুতুবউদ্দিন আইবেক কারও দরবারে চাকরি না পেয়ে চলে আসেন অযোধ্যায়। অযোধ্যার মালিক হুসামউদ্দিনের নিকট থেকে অযোধ্যার পূর্ব সীমান্তের সীমান্তরক্ষীর দায়িত্ব পান। তিনি সেখান থেকে ধীরে ধীরে অভিযান চালিয়ে বিহার জয় করে ফেলেন। বিহার বিজয়ের পর খিলজী কুতুবউদ্দিন আইবেকের কাছে গেলে আইবেক তাকে অনেক উপঢৌকন দিয়ে সম্মানিত করেন। এর পরের বছরই তিনি নদীয়া জয় করেন। 

বাংলার দক্ষিণ ভাগে ছিল বঙ্গোপসাগর আর উত্তরে হিমালয়। পূর্ব দক্ষিণ ভাগ ছিল তখন ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ, যাকে বলা হতো ঝাড়খন্ড।  ফলে তেলিয়াগড়ের গিরিপথই ছিল দুর্ভেদ্য বাংলায় ঢোকার একমাত্র রাস্তা।  কিন্তু খিলজী এই ঝাড়খন্ডের জঙ্গলের ভেতর দিয়েই নদিয়া আক্রমণ করেন। অখ্যাত খিলজীকেও যেমন কেউ প্রত্যাশা করেনি, তেমনি তার এই আক্রমণও ছিল অপ্রত্যাশিত। 

তিন দিনের মাঝেই নদীয়ায় নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করে তিনি লক্ষণাবতী (গৌড়) জয় করে এর নাম দেন লাখনৌতি।  এই লাখনৌতিই হয় খিলজীর রাজধানী।  লাখনৌতির পূর্ব সীমানায় ছিল তিস্তা ও করতোয়া নদী, উত্তরে দিনাজপুরের দেবকোট হয়ে রংপুর, দক্ষিণে পদ্মা নদী আর পশ্চিমে ইতঃপূর্বে অধিকৃত বিহার।  তিনি তার রাজ্যকে তিন ভাগ করে এর জন্য প্রশাসক নিযুক্ত করেন।  প্রতি ভাগকে বলা হতো ইকতা এবং এর শাসককে বলা হতো মুকতা। 

খিলজী সব সময় ঘুরীর প্রতি ব্যাপক শ্রদ্ধা পোষণ করতেন।  তার বেড়ে ওঠার সময়ই ঘুরী দিল্লি জয় করেন।  ফলে খিলজী কখনো গজনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেননি।  এজন্যই তিনি নিজের নামে কোনো মুদ্রাও ছাপাননি বলে মনে করা হয়। 

খিলজীর শাসনকর্তা বা সেনাপতিদের মাঝে মাত্র তিনজনের নাম জানা যায়। তার মধ্যে আলী মর্দান ছিলেন বরসৌল (বর্তমান দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট এলাকা), হুসাম উদ্দিন ইওয়াজ খিলজী ছিলেন গঙ্গতরী (তান্ডা এলাকা) এবং মুহাম্মদ শীরন খিলজী ছিলেন লাখনৌতির দক্ষিণে পদ্মাতীরের শাসক। 

তিন বছরে এই এলাকা সুসংহত করে তিনি তিব্বতে অভিযান পরিচালনা করেন, যা ছিল তার জীবনের শেষ অভিযান।  তিব্বতের চুম্বি উপত্যকায় গেরিলাদের আক্রমণ তাকে পিছু হটতে বাধ্য করে। এই অভিযানে ব্যর্থতার বোঝা নিয়েই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।  পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ দিনাজপুরে তাকে সমাহিত করা হয়।  দক্ষিণ দিনাজপুরের নারায়নপুরে অবস্থিত তার এই সমাধি পীরপাল দরগাহ নামে পরিচিত।  কাকতালীয় ব্যাপার হচ্ছে, এই একই সময়ে মুহাম্মদ ঘুরী পাঞ্জাবের ঝিলাম নদীর তীরে আততায়ীর হাতে মারা যান এবং নদীয়া থেকে পালিয়ে যাওয়া লক্ষ্মণসেনও বিক্রমপুরে মারা যান। 

সেই সময়ে শক্তিস্তম্ভ সুলতান ঘুরী কিংবা দিল্লি অধিপতি আইবেকের সাহায্য ছাড়াই অখ্যাত পরিচয়ের এই তুর্কি বীর এমন এক সময়ে এই রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করে যান, যা মঙ্গোল ঝড়ে বিধ্বস্ত মধ্য-এশিয়া এবং আব্বাসীয় রাজধানী বাগদাদের গণ্যমান্য সুফি ও আলিমদের আশ্রয়স্থল হিসেবে কাজ করে।  ক্ষমতার দ্বন্দ্বে দিল্লি যখন টালমাটাল, তখনও দিল্লির সম্ভ্রান্ত পরিবারগুলোর আশ্রয়স্থল হিসেবে ভূমিকা পালন করে এই লাখনৌতি।  অল্পদিনের মধ্যে এই লাখনৌতি দিল্লির ঐশ্বর্যকে টেক্কা দিয়ে দিল্লির ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। 


দুই.

১২০৮ সালে অযোধ্যার শাসক কায়েমাজ রুমী দিল্লির সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেকের নির্দেশে লাখনৌতি দখল করে হুসামউদ্দিন ইওউয়াজ খিলজীকে লাখনৌতির শাসক নিযুক্ত করেন।  মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী দেবকোট থেকে রাজ্য শাসন করতেন, শীরন খিলজীও তা অব্যাহত রাখেন। কিন্তু ইওয়াজ খিলজী লাখনৌতিতে তার কেন্দ্র স্থানান্তরিত করেন। ১২১০ সালে আলী মর্দান দিল্লি থেকে ফিরে এলে ইওয়াজ খিলজী তাকে অভ্যর্থনা জানান এবং তার হাতেই ক্ষমতা ছেড়ে দেন। 

আলী মর্দানের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আমিররা তাকে হত্যা করে। তারপর ইউয়াজ খিলজী আবারও ক্ষমতায় আসেন।  কিন্তু এবার তিনি দিল্লি থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে গিয়াসউদ্দিন উপাধি ধারণ করেন। তিনি লাখনৌতিকে দূর্গবেষ্টিত শহরে পরিণত করেন।  বসনকোট নামে তিনি আরেকটি দূর্গবেষ্টিত শহর নির্মাণ করেন।  তিনিই বাংলায় প্রথম মুসলিম শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠন করেন।  বাংলা বদ্বীপে বন্যার ভয়াবহতা লক্ষ করে বন্যাপ্রতিরোধী বাঁধ নির্মাণ করেন।  শহরগুলো সংযুক্ত করে দক্ষিণ এশিয়ায় তিনিই প্রথম রাজপথ নির্মাণ করেন বলে মনে করা হয়।  এ ছাড়া তিনি গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডও বিস্তৃত করেন। 

তিনি দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিশকে এড়িয়ে গজনীর ঘুরিদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করেন।  দিল্লির সুলতানের সমকক্ষতা বজায় রাখতে নিজের নামে খুতবা পাঠ করেন এবং আব্বাসীয় খলিফা আন-নাসিরের নামে মুদ্রা তৈরি করেন। তিনি তার পুত্র আলী শের খিলজীকে বিরভূমের শাসক নিযুক্ত করেন।  ১২২১ সালে আলী শেরের শাসনামলে আজারবাইজানের মারাগেহ অঞ্চলের স্থপতি ইবনে মুহাম্মদ ইসলাম প্রচারক মাখদুম শাহের জন্য বিরভূমে একটি খানকাহ নির্মাণ করেন।  মধ্য এশিয়ার দাঈ জামালুদ্দিন বিন জালালুদ্দিন গজনভী তার সময়ে বাংলায় আসেন। 

ইলতুৎমিশ তার রাজত্বের প্রাথমিক সময়ে নানা বিদ্রোহ এবং মঙ্গোলদের আক্রমণের কারণে বাংলার দিকে মনযোগ দিতে পারেননি। ১২২৫ সালে তিনি বিহার এবং বাংলা জয় করার উদ্দেশ্যে বের হন। ইওয়াজ খিলজী তাকে তেলিয়াগড় গিরিপথে বাধা দেন।  তিনি ইলতুৎমিশের সাথে সন্ধি করে তার অধীনতা মেনে নেন।  ইলতুৎমিশ আলাউদ্দিন জানীকে বিহারের শাসক নিযুক্ত করে ফিরে যান।  কিন্তু ইউয়াজ খিলজী চুক্তি ভঙ্গ করেন এবং আলাউদ্দিন জানীকে বিহার থেকে বিতাড়িত করেন।  

ইলতুৎমিশ ইওয়াজ খিলজীকে পরাজিত করার সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। ইওয়াজ খিলজীও পরিস্থিতি বুঝতে পেরে দীর্ঘদিন রাজধানী ত্যাগ করে কোনো অভিযানে যাননি।  এদিকে অযোধ্যায় হিন্দুরা বিদ্রোহ করলে ইওয়াজ খিলজী ভাবলেন, দিল্লি-বাহিনী এখন অযোধ্যায় ব্যস্ত থাকবে।  তাই তিনি পূর্ব বাংলায় অভিযানে বের হন।  এদিকে ইলতুৎমিশ তার পুত্র নাসিরুদ্দিন মাহমুদকে অযোধ্যার বিদ্রোহ দমন করে লাখনৌতি জয় করার জন্য পাঠান। সাথে ছিলেন বিহারের বহিষ্কৃত শাসক আলাউদ্দিন জানী।  নাসিরুদ্দিন মাহমুদ অযোধ্যার বিদ্রোহ দমন করে দ্রুত লাখনৌতি আক্রমণ করেন।  ইওয়াজ খিলজী ফিরে এসে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে নিহত হন। 


তিন.

বখতিয়ার খিলজীর তিন সেনাপতির মাঝে আলী মর্দান খিলজীই ছিলেন কিছুটা কুটিল স্বভাবের। তিনি বখতিয়ার খিলজীকে হত্যা করে শীরন খিলজীর হাতে বন্দি হন।  কিন্তু তিনি বন্দিশালা থেকে পালিয়ে দিল্লির সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেকের দরবারে হাজির হন।  তিনি সুলতান আইবেককে লাখনৌতি আক্রমণে রাজি করান।  ফলে অযোধ্যার শাসক লাখনৌতি দখল করে ইওয়াজ খিলজীকে শাসক নিযুক্ত করে আসে। 

১২০৮ সালে গজনীর শাসক তাজউদ্দিন ইলদিজ লাহোর আক্রমণ করলে আইবেক তাকে পরাজিত করেন এবং এগিয়ে গিয়ে গজনীও দখল করেন।  আইবেকের বাহিনীতে আলী মর্দানও ছিলেন। তাজউদ্দিনের কূটকৌশলের ফলে আইবেক ৪০ দিনের বেশি গজনী দখলে রাখতে পারেননি।  তিনি দিল্লি চলে আসেন।  আটকা পড়েন আলী মর্দান।  কিন্তু তিনি তাজউদ্দিনের অনুগ্রহ লাভে সফল হন। সালার জাফর নামে এক খিলজী আমিরের সাথে তার সখ্যতা গড়ে উঠে। একবার তাজউদ্দিনের সাথে শিকারে বের হন আলী মর্দান আর সালার জাফর।  আলী মর্দান সালার জাফরকে প্রস্তাব দিলেন, তিনি চাইলে তাজউদ্দিনকে হত্যা করে তাকে গজনীর সিংহাসনে বসাতে পারেন।  সালার জাফর তার চরিত্র বুঝতে পেরে দুটি ঘোড়া উপহার দিয়ে গজনী ছেড়ে চলে যেতে বলেন।  আলী মর্দান দিল্লিতে ফিরে এলে আইবেক খুশি হয়ে গ্রহণ করেন এবং তাকে লাখনৌতির শাসনকর্তা করে পাঠান। 

আলী মর্দান জানতেন, লাখনৌতির আমিরগণ তাকে সহজে গ্রহণ করবেন না। তাই তিনি নিজে সৈন্যবাহিনী তৈরি করে লাখনৌতি আসেন।  তাকে অবাক করে দিয়ে ইওয়াজ খিলজী সিংহাসন ছেড়ে দেন এবং আলী মর্দানকে অভ্যর্থনা জানান। এর কিছুদিন পরই আইবেকের মৃত্যু হয়। আইবেকের কোনো পুত্র না থাকায় একদল আমিররা আইবেকের পালিত পুত্র আরাম শাহকে এবং অন্যদল আইবেকের জামাতা বাদায়ুনের শাসনকর্তা ইলতুৎমিশকে সমর্থন করে।  এই দলাদলির সুযোগে কোনো কোনো হিন্দু রাজা বিদ্রোহ করে।  আলী মর্দানও এই সুযোগে নিজেকে লাখনৌতির স্বাধীন সুলতান ঘোষণা করে।  সেই হিসেবে আলী মর্দান লাখনৌতির প্রথম স্বাধীন সুলতান।  তবে দরবারের আমীররা তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তাকে হত্যা করে ইওয়াজ খিলজীকেই আবার সিংহাসনে বসায়। 


চার.

ইওয়াজ খিলজী লাখনৌতিতে স্বাধীনতা ঘোষণা করলে দিল্লির সুলতান শামসুদ্দিন ইলতুৎমিশ তার জ্যেষ্ঠ পুত্র নাসিরুদ্দিন মাহমুদকে বিদ্রোহ দমনে প্রেরণ করেন।  ১২২৭ সালে তিনি ইওয়াজ খিলজীকে পরাজিত করে লাখনৌতির শাসক হন।  নাসিরুদ্দিন মাহমুদ পূর্বে অযোধ্যার শাসক ছিলেন।  তিনি নেপালেও অভিযান পরিচালনা করেন, কিন্তু অতিরিক্ত ঠান্ডায় তার সে অভিযান ব্যর্থ হয়।  বাংলায় মাত্র দুই বছর শাসন পরিচালনা করে ১২২৯ সালে তিনি মারা যান।  ইলতুৎমিশ তাকে মালিক উস-শরক তথা পূর্বাঞ্চলের রাজা উপাধি দিয়েছিলেন।  ইলতুৎমিশ তার এই প্রিয় পুত্রের স্মৃতি রক্ষায় কনিষ্ঠ পুত্রের নামও রাখেন নাসিরুদ্দিন মাহমুদ, যিনি পরবর্তী সময়ে দিল্লির সুলতান হন। 

নাসিরুদ্দিন মাহমুদের মৃত্যুর পর আলাউদ্দিন দৌলত শাহ বিন মৌদুদ নামে এক খিলজী সেনাপতি ইলতুৎমিশের অধীনতা স্বীকার করে লাখনৌতির শাসক হন।  তিনি খিলজীদের আধিপত্য ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা চালান।  কিন্তু ইওয়াজ খিলজীর পুত্র মালিক ইখতিয়ারুদ্দিন বালকা খান তাকে বিতাড়িত করে বাংলার সিংহাসন দখল করেন।  বালকা খান স্বাধীনতা ঘোষণা করলে ১২৩২ সালে সুলতান ইলতুৎমিশ এবার নিজে বাংলায় অভিযান পরিচালনা করে বালকা খানকে পরাজিত করেন। ফলে বাংলায় খিলজী শাসনের সমাপ্তি ঘটে। 


তথ্যসূত্র : 

১।  মুসলিম আমলে বাংলার শাসক , আশকার ইবনে শায়েখ 

২।  বাঙলাপিডিয়া 

৩।  History of the Muslims of Bengal Vol. IA – Dr. Mohar Ali 

৪।  বাংলার ইতিহাস (১২০০-১৮৫৭)  আব্দুল করিম

৫।  বাঙলার ইতিহাস দ্বিতীয় খণ্ড, রাখালদাস বন্দোপাধ্যায়

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির