সাম্প্রতিক সময়ে বৃদ্ধ বাবা-মার প্রতি ছেলে-মেয়েদের নিষ্ঠুর আচরণ বেড়ে গেছে। কী সচ্ছল, কী গরিব, কী সামর্থ্যবান, কী বিত্তহীন, সব ধরনের পরিবারে বয়স্ক বাবা-মা এখন অবহেলার পাত্র। তারা নানাভাবে বঞ্চনার শিকার। বাবা-মা নিজেদের যৌবনে সন্তানকে মানসিক ও বৈষয়িকভাবে সক্ষম করে তুলতে কী করেন না! সেই তারা বার্ধক্যে এসে পরিবারের কাছে হয়ে পড়ছেন মূল্যহীন। এর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দেওয়া দুরূহ। তবে সমাজবিজ্ঞানীরা তত্ত্বীয় ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারবেন নিশ্চয়। আমরা যারা সাধারণ মানুষ; যাদের কাঠামোগত জ্ঞান নেই; তারা খাবি খাচ্ছি প্রতি নিয়ত।
কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করলে বিষয়টির ভয়াবহতা উপলব্ধিতে আসতে পারে। প্রথম ঘটনাটি সারা দেশে আলোড়ন তুলেছিল। সচ্ছল পরিবারের একাকিত্বে ভোগা অসহায় এক ব্যবসায়ী ফেসবুক লাইভে এসে ধানমন্ডিতে নিজ বাসায় মাথায় গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন। ষাটের কাছাকাছি বয়সের আবু মহসিন খান চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি রাতে হৃদয়বিদারক এ ঘটনার অবতারণা করেন। জীবন দিয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণের আত্মঘাতী পথ বেছে নেন তিনি। স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছেন কি না বলা মুশকিল। তার চেয়ে বলা ভালো, পরিস্থিতি তাকে এ ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। একাই থাকতেন নিজের ফ্ল্যাটে। বাসায় কোনো কাজের লোক ছিল না। বাইরে থেকে খাবার এনে খেতেন। একসময় পোশাক কারখানায় সুতা সরবরাহ করতেন। ঋণে জর্জরিত হয়ে ব্যবসা ছেড়ে দেন। অনেকের কাছে হয়েছেন প্রতারিত। ২০১৭ সালে ক্যান্সার ধরা পড়ে। বিদেশে চিকিৎসাও করেছিলেন। মৃত্যুর আগে সুইসাইড নোটে উল্লেখ করেন, তার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নন। কত অসহায় হলে এমন কাজ করতে পাবেন একজন মানুষ? তা কি ভাবা যায়! তিনি ছিলেন এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। ছেলে মাকে নিয়ে থাকেন অস্ট্রেলিয়ায়। আর মেয়ে ঢাকাই সিনেমার প্রতিষ্ঠিত এক চিত্রনায়কের স্ত্রী। তাদের ছেড়ে তাকে একাকী জীবনযাপন করতে হয়েছে। বৃদ্ধ বয়সের একাকী জীবন থেকে মুক্তি পেতে বেছে নেন আত্মহননের পথ।
দ্বিতীয় যে ঘটনার উল্লেখ করছি সেটি একটি হতদরিদ্র পরিবারের করুণ কাহিনী। নাম সাজেদুল। বাড়ি জামালপুর শহরের ছনকান্দায়। সন্তানেরা পরিত্যাগ করায় স্ত্রী মেহেরুন বেগমকে নিয়ে তার সংসার। ‘সেই সন্তানেরা একবারও জিজ্ঞেস করে না, কেমন আছি’- শিরোনামে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, ‘৭০ বছর বয়সী মো: সাজেদুল। বয়সের ভারে অনেকটাই ন্যুব্জ। আয়ের একমাত্র অবলম্বন ছিল এক ঘোড়ার গাড়ি। সম্প্রতি বাসের ধাক্কায় ঘোড়াটির একটি পা কাটা পড়ে। আয়ের একমাত্র অবলম্বন হারিয়ে এখন দিশাহারা তিনি। বৃদ্ধা স্ত্রীকে নিয়ে দিন কাটছে অর্ধাহার-অনাহারে। এ দম্পতির তিনটি ছেলেসন্তান রয়েছে। কেউ তাদের খবর রাখে না’ (৪ মার্চ, প্রথম আলো অনলাইন সংস্করণ)।
শুধু দেশ নয়, প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিম বাংলায় এ বছরের ৫ মার্চ আনন্দ বাজার অনলাইন সংস্করণের খবর ছিল এরকম ‘বোঝা হয়ে পড়েছিলেন বৃদ্ধা মা, পুড়িয়ে মেরে রাস্তায় ফেলে রাখলো ছেলে, সঙ্গী স্ত্রী’।
বাবা-মার সাথে নিষ্ঠুর আচরণের এমন দৃষ্টান্ত দেওয়া যাবে ভ‚রি ভ‚রি। এরপরও বাবা-মার কাছে সন্তান যে কত প্রিয় সেটি উদাহরণ দিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। ছেলে-মেয়েদের কাছ থেকে বাবা-মা নিষ্ঠুর আচরণ পেলেও এখনো অনেক পিতা-মাতা সন্তানের জন্য চ‚ড়ান্ত ত্যাগ স্বীকারে পিছপা হন না। কোনো কার্পণ্য করেন না। একটি খবর দিই খবরের শিরোনাম- ‘মায়ের কাছে সন্তানের জীবনই আগে : ছেলেকে কিডনিদাতা মা’। ৫৪ বছর বয়সী বুলি বেগম ২৪ বছর বয়সী ছেলে জাহিদ হাসানকে তার একটি কিডনি দিয়েছেন। মায়ের দেওয়া কিডনি ছেলের শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এই মা-ছেলে এরই মধ্যে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরেছেন। শরীরে ব্যথা ও দুর্বলতাসহ শারীরিক জটিলতা থাকলেও তারা হাসিমুখে নিশ্চিন্ত মনে দিন কাটাচ্ছেন (প্রথম আলো, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২২)।
চরম ত্যাগ স্বীকারকারী বাবা-মায়ের প্রতি দিন দিন উদাসীন হয়ে পড়ছে অনেক সন্তান। অবহেলার শিকার হচ্ছেন বাবা-মা। ভোগবাদী জীবন তাদের প্রতি উদাসীন করে তুলছে আমাদের, এ কথা এখন পরীক্ষিত সত্য। পশ্চিমা দুনিয়ায় বৃদ্ধ বাবা-মাকে সন্তানরা কাছে রাখতে চায় না। সেখানে এ সংস্কৃতি পুরনো; কিন্তু আমাদের ঐতিহ্যবাদী সমাজেও এ বিষবৃক্ষ এখন শেকড় গেড়েছে। ফলে চার পাশে সন্তানের কাছে বাবা-মাকে নিগৃহীত হওয়ার ঘটনা গণমাধ্যমে অহরহ প্রকাশ পাচ্ছে।
এ কথা বলার কোনো প্রয়োজন নেই যে, দুনিয়ায় বাবা-মা দু’জনই সন্তানের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সন্তানের জন্য বাবা-মা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেন। দুনিয়া দেখার উপলক্ষও তারা। সন্তানের স্বাস্থ্য ও সুস্থতার সার্বিক বিষয়ে নিবেদিতপ্রাণ ও যত্নশীল। সন্তানের জন্য এতটাই নিঃস্বার্থ যে সবকিছুর ওপর কোনো কাজে বাবা-মা কখনো কোনো বিনিময় চান না। এ জন্যই প্রতিটি ধর্মগ্রন্থ বাবা-মার সর্বোচ্চ মর্যাদা ও সম্মান নিশ্চিত করেছে। পরিবারেও বাবা-মার মর্যাদা ও সম্মান সবার উপর।
আল কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা তাঁকে (আল্লাহ) ছাড়া আর কারো ইবাদত করো না এবং বাবা-মার প্রতি উত্তম আচরণ করো। তাদের একজন কিংবা উভয়ই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদের উফ্ বলো না এবং তাদের ভর্ৎসনা করো না; বরং তাদের সাথে সম্মানসূচক নম্র ভাষায় কথা বলো। অনুকম্পায় তাদের প্রতি বিনয়াবনত থাকো। আর বলো- ‘হে আমার প্রতিপালক! তাদের উভয়ের প্রতি দয়া করো, যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে প্রতিপালন করেছেন।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ২৩-২৪)। সন্তানের কাছে বাবা-মার অধিকার একটি মহান দায়িত্ব। আল্লাহ কুরআনে বাবা-মার হকের বিষয়টি তুলে ধরেছেন এভাবে- ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তাঁর সাথে কোনো কিছু শরিক করো না এবং বাবা-মার সাথে সদ্ব্যবহার করো।’ (সূরা নিসা : ৩৬)।
যদিও একজন বিশ্বাসীর কাছে কুরআন সত্যের মানদণ্ড। তা সত্তে¡ও বাবা-মায়ের অধিকার বিষয়ে আমাদের দেশে রয়েছে সুনির্দিষ্ট আইন। অনেকে জানেন না, মা-বাবা যখন বৃদ্ধ হয়ে যান, কর্মক্ষম সন্তানের কাছে তখন তাদের আইনত কিছু প্রাপ্য রয়েছে। প্রচলিত আইনে বৃদ্ধ মা-বাবা তার সাবালক ও কর্মক্ষম সন্তানের কাছ থেকে প্রাপ্য সম্মান ও ভরণপোষণে আইনের আশ্রয় চাইতে পারেন। দেশে ‘পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন, ২০১৩’ বলবৎ রয়েছে। এ আইনে প্রত্যেক কর্মক্ষম সন্তানকে মা-বাবার ভরণপোষণের নিশ্চয়তা দিতে হবে, এ বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা হয়েছে। কোনো মা-বাবার একাধিক সন্তান থাকলে সে ক্ষেত্রে সন্তানরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে তাদের বাবা-মায়ের ভরণপোষণ নিশ্চিত করবে।
কোনো সন্তান তার মা কিংবা বাবা বা উভয়কে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো বৃদ্ধনিবাস কিংবা অন্য কোথাও একত্রে বা আলাদাভাবে বসবাস করতে বাধ্য করতে পারবে না। মা-বাবার স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখতে হবে, প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা ও পরিচর্যা করতে হবে। এমন যদি হয়, মা এবং বাবা আলাদা থাকেন, সেক্ষেত্রে প্রত্যেক সন্তানকে উভয়ের সাথে আলাদা করে নিয়মিত সাক্ষাৎ করাতে হবে। মা-বাবা স্বেচ্ছায় অন্য কোনো জায়গায় বাস করলে তাদের মাসিক বা বার্ষিক আয়ের যুক্তিসঙ্গত অর্থ নিয়মিত দিতে হবে সন্তানকে। মা-বাবাকে ভরণপোষণ না করলে এবং আইন অনুযায়ী দায়িত্ব পালন না করলে অভিযুক্ত সন্তানের জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে।
তবে সব থেকে বড় কথা নৈতিকতা। নৈতিকতা বলে প্রত্যেকের উচিত বাবা-মায়ের যথাযথ অধিকার সংরক্ষণ করা। বাবা-মা যখন বার্ধক্যে পৌঁছেন, তখন তাদের প্রতি ধৈর্যশীল আচরণ করা। কারণ সন্তান শৈশবে যা দেখে সে সম্পর্কে বাবা-মাকে জিজ্ঞাসা করে থাকে। সে সময় বাবা-মা সন্তানের জিজ্ঞাসায় বিরক্ত না হয়ে ধৈর্যের সাথে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করতেন। কিশোর বয়সে সন্তান যখন কোনো বিষয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠত তখনো বাবা-মা সন্তানের ক্ষিপ্ততায় রেগে না গিয়ে ধৈর্য ধারণ করতেন। সুতরাং সন্তানের উচিত বাবা-মা বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদের সাথে ধৈর্যশীল হওয়া। এটি সন্তানের প্রতি বাবা-মার প্রাপ্য অধিকার। বাবা-মা যদি কাছে না থাকেন তাহলে তাদের খোঁজখবর নেওয়া। এতে তারা প্রফুল্লবোধ করেন, সন্তানের সাথে কথা বলে তারা মনে প্রশান্তি অনুভব করেন। সন্তানের উচিত তাদের কাছে রাখা ও যথাযথ সেবাযত্ন করা। তাদের প্রতি গভীর মমতায় মনোযোগ দেওয়া।
লেখক : সহকারী সম্পাদক, নয়া দিগন্ত
আপনার মন্তব্য লিখুন