যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তখন আমার বয়স ১৯ বছর। দৌলতপুর বিএল কলেজের ছাত্র। থাকতাম বয়রাতে রায়ের মহল গ্রামে। চলছে অসহযোগ আন্দোলন। তৎকালীন সরকারের সবকিছু প্রায় বয়কট। কলেজে তখন পরীক্ষা চলছিল। আমরাও বয়কট করলাম পরীক্ষা। হল থেকে ছাত্রছাত্রীরা সব বেরিয়ে আসছে। স্লোগান উঠলো আর পরীক্ষা নয়, এবার স্বাধীনতার ডাক, স্বাধীনতার পরীক্ষা। সোজা বাড়ি চলে এলাম শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নের চকবারা গ্রামে। গ্রামের মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত। কখন কী হয়। পাকসেনাদের দু’টি যুদ্ধজাহাজ তখন কপোতাক্ষ-খোলপেটুয়াতে নিয়মিত কড়া নজরদারি করছে। কারণ আড়পাঙ্গাসিয়া, কলাগাছিয়া এবং চুনা নদী দিয়ে ভারতের পশ্চিমবাংলার সাথে নৌযোগাযোগ। হাজার হাজার শরণার্থী ঐ নদীপথে নৌবহরে ভারত গমন করছে। একদিন সকালে দেখলাম আমাদের বাড়ির সামনে খোলপেটুয়া নদীতে শত শত নৌবহর। জানতে পারলাম পাইকগাছা, নলিয়ান থেকে আসছে ঐসব শরণার্থী। পাক যুদ্ধজাহাজ দু’টি খোলপেটুয়ার শাখানদী কলাগাছিয়া এবং চুনানদীর মোহনায় অবস্থানরত। জাহাজের বহির্ভাগে কোন মনুষ্য পদচারণা দেখা যায় না। দূর থেকে মনে হয় শিকারি পাখির মত এক জায়গায় স্থির অবস্থান করে এক দৃষ্টে নজরদারি রাখছে চতুর্দিক। বেলা বাড়ার সাথে সাথে শরণার্থীদের নৌবহর চলতে শুরু করল চুনা নদীর পথে। জাহাজওয়ালারা কিছুই বললো না। মনে হলো ওরা যেন মনে মনে বলছে যাকগে যেন জায়গা খালি হলো। এদেশের ভালোই হলো। আর শরণার্থীরা যেন অশ্রুজলে পিছন ফিরে তাকিয়ে তাকিয়ে বলছে-বিদায় হে দেশ মাতৃকা! বিদায় হে শৈশব! কৈশোরের জন্মভূমি তোমাকে বিদায়!... আমরা গ্রামের কতিপয় যুবক তখন নদীর ধারে দাঁড়িয়ে একদিকে শত্রুর নজরদারি রক্তচক্ষুর তীক্ষ্ণবাণ। অপরদিকে উদ্বাস্তু-শরণার্থী মহিলা-পুরুষ-যুবা-কিশোর-কচিকাঁচা মানবসন্তানদের অশ্রুসজল চোখের চাহনি আর দুরু দুরু বুকের ভীত-প্রকম্পিত দীর্ঘ স্পন্দনের তপ্ত নিঃশ্বাস যেন একদৃষ্টে অনুভব করছিলাম চোখে মুখে মনে আর হৃদয়ের গভীরে। তখনই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম! না, আর দেরি নয়- এ দেশকে বাঁচাতে হবে; বাঁচাতে হবে এদেশের কোটি অসহায় জনতাকে। বাড়ি ফিরে গেলাম। সারা রাত কাটলো কী এক অসহ যন্ত্রণায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি- আমাদের বাড়ির সামনে বৈঠকখানায় কাঠের তক্তার বেড়ায় চোখে পড়ার মতো কালো তুলির মোটা ক্রস-চিহ্ন। আব্বা গ্রামের সকলকে ডেকে শুনলো বিষয়টা কী! কারা এঁকেছে এ ক্রসচিহ্ন! বাড়ির পাশের ইউছুফ সরদার আব্বাকে বললো চাচা গতকাল সন্ধ্যায় দেখলাম দু’জন অপরিচিত লোক এসে তোমার বৈঠকখানা দোকানের বেড়ায় ঐ কালো ক্রস দিয়ে চলে গেছে। এক সপ্তাহের মধ্যে এই চিহ্নিত বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হবে। কারণ তোমার ছেলে মুক্তিফৌজ বা তাদের দোসর, পাকিস্তানের শত্রু। আব্বা একটু ভাবনায় পড়ে গেলেন, আমাদের দু’ভাই (আরেক ভাই তখন ছোট ৬-৭ বছর বয়স) কে ডেকে বললেন আব্দুল আজিজ (বড় ভাই) তুমি বাড়ি থাকো আর নজরুল (অর্থাৎ আমি- লেখক) তুমি বাড়ি থেকে চলে যাও। যত আক্রমণ সব তোমার উপরে। তুমি না ছাত্রলীগ করতে, মুক্তিফৌজে নাম দিবা বলে তোমরা নদীর ধারে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে এ খবর কে বা কারা পাকিস্তানি দোসরদের কাছে পৌঁছে দিয়েছে- তাই এই জ্বালাও পোড়াও ব্যবস্থা। ঠিক আছে, আল্লাহ সহায়! আব্বা একবুক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, বাবা! দুশ্চিন্তা করো না আল্লাহ তোমাকে দেখবেন আমাদেরকেও দেখবেন ইনশাআল্লাহ। মায়ের অশ্রুভেজা দোয়া নিয়ে বাড়ি থেকে বের হলাম। কিছুদিন দূরবর্তী আত্মীয়ের বাড়ি। এরপর তৎকালীন মুক্তিফৌজ চান্নিমুখার নুরুল হকের সাথে যোগাযোগ। এরপর ডুমুরিয়ার আফাজুদ্দীন- আমরা ছিলাম মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলীল সাহেবের অধীন, সুন্দরবন এলাকায়। কতদিন কতরাত যে সুন্দরবনের বনে জঙ্গলে, গ্রামে-উপকণ্ঠে কাটিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। খাল, বিল, পুকুর-নদী প্রান্তর দীর্ঘ পথ অস্ত্র কাঁধে কখনো দলবদ্ধভাবে কখনো নির্দেশনা অনুযায়ী টিম করে করে কত বার কোথায় গিয়েছি আজ স্বাধীনতার ৪৮ বছর পর তা যেন স্বপ্ন আর স্মৃতি। তবে যে স্বপ্নটি আজ বাস্তবে রূপ পরিগ্রহ করেছে তা হলো ‘মুক্তিযুদ্ধ’ ‘স্বাধীনতা’ আর ‘বাংলাদেশ’। ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ করে ছিনিয়ে আনলাম স্বাধীনতা। পেলাম স্বাধীন স্বদেশ বাংলাদেশ, কিন্তু আজ ৪৮ বছর পর মনে হয় তবুও কী যেন পেলাম না (?) কী যেন পাচ্ছি না (?) শুধু কেবল একবুক হাহাকার, দীর্ঘশ্বাস আর যেন জংলী জনপদে মৃত্যুপুরীর আর্তনাদ। একটি স্বাধীন দেশে যেন নিশ্চিন্তে চলতে পারছি না। এখানে যেন স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি নেই। সন্ত্রাস, গুম, খুন, হত্যা, কোন্দল, ষড়যন্ত্র-রাহাজানি, ধর্ষণ লুটপাট এখানের নিত্যসঙ্গী। উৎপাদিত ফসলের কমমূল্যে কৃষকের হাহাকার। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের শুধু ঊর্ধ্বগতি নয়- আকাশচুম্বী। গর্বিত স্বাধীন দেশে স্যাটেলাইটও ওড়ে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যও ওড়ে। স্বাধীন বুভুক্ষু জনগণ চাতকের মত তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে- কখন পাওয়া যাবে ঐসব হাতের নাগালে। মিথ্যা মামলা, হামলা, ডাকাতি, জিম্মি, চাঁদাবাজি, শিক্ষাঙ্গনে যুদ্ধ, আন্দোলন, ঘেরাও, হরতাল, অবরোধ, মানববন্ধন যেন স্বাধীন বাংলাদেশের নিত্যসঙ্গী। এ যেন পাকিস্তানি হানাদারদের নৃশংসতা এবং যুদ্ধ-পরবর্তী দেশের অরাজকতাকেও হার মানায়। ’৭১-এ যুদ্ধ করেছি শত্রুর সাথে রণাঙ্গনে- এখন যুদ্ধ হচ্ছে মিত্রের সাথে সতীর্থ-সংঘাতে। ’৭১-এ আমরা সবাই ছিলাম এক ও অভিন্ন। এখন আমরা সবাই অনৈক্য ও ছিন্নভিন্ন। দলে বিভাজন, মতে বিভাজন, পথে বিভাজন, চিন্তায় বিভাজন, মনে ও মননে উইপোকার কুরে খাওয়া বিষদাঁত, চিন্তাও চেতনায় ছুঁচো ইঁদুরের ভয়ঙ্কর উৎপাত। কী সরকারি কী বেসরকারি-সকল দলের মধ্যে দল, তার ভেতরে উপদল, বাম-রাম-সেক্যুলার, ধর্ম-অধর্ম পিকিউলিয়াররা। মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা দ্বন্দ্ব সংঘাত বিভাজন। স্বাধীনতার চেতনা নিয়ে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি, ধর্মেরও মূলোৎপাটনের চক্রান্ত, কুরআন, সুন্নাহ, নবী রাসূল সা.-এর প্রতি চরম বেয়াদবি- এ সবকিছু দক্ষিণ এশিয়ার এ সম্ভাবনাময় মুসলিম দেশটিকে পার্শ্ববর্তী দূরবর্তী বন্ধু অবন্ধু রাষ্ট্রগুলো শকুনির শ্যেন দৃষ্টির ভাগাড়ে পরিণত করেছে। আর এ ভাগাড়ের শকুনদের পাহারা দিয়ে নখর বসিয়ে ছিন্ন ভিন্ন করতে সহযোগিতা করেছে এ দেশের একদল কুত্তা ও কাউয়া। হায় রে স্বদেশ! স্বাধীনতার আজ ৪৮ বছর পর হিসাব মেলাতে যেয়ে যোগ বিয়োগ আর গুণন-ভগ্নাংশে বিস্তর ভুল পরিলক্ষিত হচ্ছে। যখন চিন্তা করি মুক্তিযুদ্ধ করলাম আমরা স্কুল-কলেজের ছাত্ররা, পাড়ার যুবকেরা, দেশের বিভিন্ন স্তরের মুক্তিপাগল মানুষেরা, সাহায্য করলো গাঁয়ের চাষিরা, নৌকার মাঝিরা, বাজারের ব্যবসায়ীরা, পাড়ার মুরব্বিরা, ঘরের মেয়েরা-বোনেরা। অস্ত্র হাতে নিয়ে পল্লীর পথে-প্রান্তরে শত্রুর খোঁজে ঘুরতে ফিরতে সহসা রাত গভীরে কোনদিন উঠে পড়লাম আমার গ্রামের এক আত্মীয়ের বাড়িতে। হঠাৎ আগমনে বাড়িওয়ালা একটু সন্ত্রস্ত হলেও অভয় দিয়ে বললাম ২০ জনের খাবার দরকার। কোন কথা নেই, ঐ গভীর রাতে বাড়ির মা-বোনদের ডেকে তাৎক্ষণিক ডাল ভাতের ব্যবস্থা উদরপুরে খেয়ে বিশ্রাম শেষ না হতেই সুবহি সাদিকের আজান। ঘোর না কাটা আলো আঁধারিতে আমাদের রণযাত্রা আবার শুরু। পথিমধ্যে গোলখালির খেয়াপারে খেয়ামাঝির যে আন্তরিকতা, ওপারে বন বাওয়ালিদের গোলপাতার ছইওয়ালা নৌকায় দুপুর যাপন। রাতে আবার সুন্দরবনের সেই নির্ধারিত আস্তানায় যাওয়া। গভীর রাতে রান্না করা মা-বোনদের সহযোগিতা। বাড়িওয়ালা, খেয়ামাঝি, বন-বাওয়ালি, সবাই যেন মুক্তিযুদ্ধে একাকার। কাকে মুক্তিযোদ্ধা বলবো (!) কাকে অমুক্তিযোদ্ধা বলবো (!) আজ স্পষ্টতই মনে পড়েছে ’৭১-এর সেই ৬ মের ঘটনা। ঐদিন মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় সৈনিক নির্ভীক সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলীলের নেতৃত্বে একদল দেশপ্রেমিক সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ২টি লঞ্চ বোঝাই করে সমরাস্ত্র নিয়ে শ্যামনগরের চুনানদী দিয়ে খোলপেটুয়া হয়ে কপোতাক্ষ দিয়ে বরিশাল অভিযান। পথিমধ্যে আমার নিজগ্রাম গাবুরার এপারে ৯ নং সোরা আর ওপারে সুন্দরবনের কলাগাছিয়া খাল ও জঙ্গল। সন্ধ্যার পর আমাদের অস্ত্র বোঝাই লঞ্চ দু’টি তরতর করে এগোচ্ছে সামনের পানে। রাত ৮টার থেকে হঠাৎ সামনের দিকে ব্যারিকেড দিল পাক সেনাদের সেই দু’টি যুদ্ধজাহাজ। যার কথা আগেই উল্লেখ করেছি। আমাদের দেখা মাত্রই এলোপাতাড়ি গুলি শেল-মর্টার নিক্ষেপ আর মুহুর্মুহু বোমার শব্দ। চারিদিকে যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গ। লোকালয়ের লোকজন হতবিহ্বল হয়ে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করছে। আমাদের লঞ্চ দুটি ধীরগতিতে ৯ নং সোরার চরে লাগিয়ে দিয়ে দ্রুতগতিতে কমান্ডার মেজর জলীলসহ সকলেই গ্রামে উঠে মাটির রাস্তা ধরে পার্শ্বেমারী দিয়ে খেয়া পার হয়ে ওপারে কয়রা বেদকাশী দিয়ে মহান আল্লাহ পাকের অপার করুণায় নিরাপদ প্রত্যাগমন। ততক্ষণে পাকসেনাদের গানবোট দু’টি থেকে মুহুর্মুহু শেল মর্টার বোমা নিক্ষেপ করে আমাদের অস্ত্র বোঝাই লঞ্চ দু’টি ধ্বংস করে নদীতে ডুবিয়ে দিয়েছে। এতবড় ভয়ঙ্কর বিপদ মুসিবতের মাঝেও আমাদের প্রত্যাগমনের পথে সাহায্য করেছে গ্রামের দাড়ি-টুপিওয়ালা মুরব্বিরা, গ্রামের চাষি বাওয়ালি জেলেরা। মা-বোনেরা রান্না করে খাওয়ালো, হাতের সেলাই করা কাঁথা দিয়ে শরীরের উষ্ণতা দিল, পাড়ার যুবকেরা সামনে নিরাপত্তা দিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেল, খেয়া মাঝিরা কপোতাক্ষ নদী পার করে দিয়ে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো তা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চির অক্ষয়। হয়তো এ ইতিহাস লেখা হয়নি কোন ঐতিহাসিক বিবরণীতে, কোন সাহিত্যে, কিংবা কোন যুদ্ধগাঁথা ইতিহাস লিপিতে। এখানে কিন্তু গ্রামের, পাড়াগাঁয়ের, ঘরের খেয়ার সবাই যেভাবে সহযোগিতা করেছে তারা সবাই কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা কিংবা মুক্তিযুদ্ধের একান্ত সহযোগী। এখানে নেই কোনো পার্থক্য নেই কোনো বিভাজন। সকলেই আমরা দেশমাতৃকার স্বাধীনতা সংগ্রামের একানিষ্ঠ সৈনিক। প্রশ্ন জাগে- কেন আমরা ঐ ঐক্য, ভালোবাসার বন্ধন, মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামী ঐক্যবদ্ধ চেতনা ধরে রাখতে পারলাম না? কারণ একটাই শাসকগোষ্ঠীর ভাগ করো আর শাসন করো- নীতি অবলম্বনে শাসন এবং শোষণ, ভাগ এবং ভোগের পশরাকে দীর্ঘায়িত করার স্বৈরাচারী মানসিকতা। আজ দেশ ও দশের জন্য যেটা বেশি প্রয়োজন সেটা হলো জাতীয় ঐক্যের। সকল বিভাজন ভুলে ঐক্যবদ্ধ জাতি রাষ্ট্র গঠনে প্রয়োজন এমন নেতৃত্ব- যে নেতৃত্ব সকল বাংলাদেশীকে এক সুতোয় গ্রথিত করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় ধারা বজায় রেখে ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষ সকলের সমান অধিকার এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হয়ে এগিয়ে আসবে- সেই নেতৃত্বকে অভিবাদন; সেই নেতৃত্বকে স্বাগতম। বিজয়ের চার যুগ পর এই হোক সকলের ঐকান্তিক কামনা। লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক এমপি, সাতক্ষীরা-৪ আসন
আপনার মন্তব্য লিখুন