আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। তাই মানুষের বৈশিষ্ট্যগুলো তাঁর চেয়ে ভালো অন্য কেউ জানে না। আল্লাহ তায়ালা সূরা কাহাফে ইরশাদ করেছেন, “মানুষ অন্য সব কিছুর চেয়ে তর্ক করতেই বেশি পছন্দ করে।” (সূরা কাহাফ : ৫৪)
বাস্তবিক অর্থেই মানুষের স্বাভাবিক ফিতরাত হলো তারা তর্ক বিতর্ক করতে চায়। কুরআনে তর্ক বা বিতর্ককে যে শব্দটি দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে তা হলো, জাদালাহ। আরবি জাদালাহ শব্দের অর্থ হলো হৃদয়, বা মন দিয়ে অর্থাৎ আন্তরিকতার সাথে তর্ক করা বা নিজেকে সঠিক প্রমাণ করার জন্য বিতর্ক করা। কুরআন পাঠ করলে দেখা যায়, আল্লাহ তায়ালা বরাবরই তর্ক করাকে নিরুৎসাহিত করেছেন। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি হলো- যাদের ঈমানী শক্তি নড়বড়ে তারাই অপ্রয়োজনীয় ও কম গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে ব্যস্ত থাকে কিংবা অযথা তর্কে লিপ্ত থাকে। কুরআনে আল্লাহ তর্ক ও ঝগড়া করাকে শয়তানের অন্যতম কৌশল হিসেবেও উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ বলেন, “শয়তানরা তাদের মধ্যে ঝগড়া সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু যদি তোমরা শয়তানের আনুগত্য করো তাহলে অবশ্যই তোমরা মুশরিক হয়ে যাবে।” (সূরা আনআম: ১২১)
আল্লাহ পাক আরো বলেন, “আর হে মুহাম্মাদ! আমার বান্দাদেরকে বলে দিন, তারা যেন মুখে এমন কথা বলে যা সর্বোত্তম। আসলে শয়তান মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করে। প্রকৃতপক্ষে শয়তান হচ্ছে মানুষের প্রকাশ্য শত্রু।” (বনি ইসরাইল ১৭ : ৫৩)
তাই সবসময় ঝগড়ার মানসিকতায় থাকা কখনোই সত্যিকারের মুসলিমের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। বিশ্বাসী বান্দারা বরং ঝগড়া বিতর্ক এড়িয়ে মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আল্লাহ তায়ালা রাসূল (সা)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন, “তারা যদি আপনার সাথে বিতর্ক করে, তবে বলে দিন, তোমরা যা করো, সে সম্পর্কে আল্লাহ অধিক ভালো জানেন” (সূরা হজ্জ: ৬৮)। মুমিন বান্দাদের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আল্লাহ পাক আরো ইরশাদ করেন, “তারা মিথ্যা কাজে সম্পৃক্ত হয় না। এরপরও যখন তারা অপ্রয়োজনীয় কোনো কাজের মুখোমুখি হয় তখন নিজেদের সম্মান রক্ষা করে ভদ্রভাবে চলে যায়” (সূরা ফুরকান: ৭২)। অন্যদিকে, রাসূল (সা) বলেছেন, কোনো সম্প্রদায় হিদায়াতের রাস্তা পেয়ে আবার পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যায় শুধুমাত্র বিবাদ ও বাগি¦তণ্ডায় জড়িত হওয়ার কারণে। (তিরমিজি : ৩২৫৩)
এ কারণে রাসূল (সা) আমাদেরকে অপ্রয়োজনীয় তর্ক ও ঝগড়া থেকে বিরত থাকার তাগিদ দিয়েছেন। এটি দুঃখজনক যে, বৈষয়িক নানা বিষয় তো আছেই- রোজা ও হজ্জের মতো বিষয় নিয়েও অনেকে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়। অথচ এই বিশেষ সময়গুলোতে বিবাদ বিতর্ক থেকে আমাদের দূরে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকা প্রয়োজন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের কেউ রোজা রাখলে সে যেন অশ্লীল কথা ও মূর্খতা পরিহার করে। যদি কেউ তাকে গালমন্দ করে কিংবা তার সঙ্গে ঝগড়া-মারামারিতে লিপ্ত হয়, সে যেন বলে, আমি রোজাদার।’ (মুসলিম : ২৫৯৩)
আর হজ্জের সময় ঝগড়ায় না জড়াতে স্বয়ং আল্লাহ পাক নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, “হজ্জের মাসগুলো সবার জানা। যে ব্যক্তি এই নির্দিষ্ট মাসগুলোতে হজ্জ করার নিয়ত করে, তার জেনে রাখা উচিত, হজ্জের সময়ে সে যেন যৌন সম্ভোগ, দুষ্কর্ম ও ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত না হয়।” (সূরা বাকারা : ১৯৭)
অহেতুক ঝগড়া মানুষকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। আবু হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোনো একসময় আমাদের সামনে এসে দেখলেন যে, আমরা তাকদির বা ভাগ্য নিয়ে তর্র্কে লিপ্ত হয়েছি। কেউ একটি আয়াত নিয়ে নিজেদের অবস্থান প্রকাশ করছে আবার অন্য সাহাবারা আরেকটি আয়াত দিয়ে তর্ক করছে। এ দৃশ্য দেখে তিনি ভীষণ রাগান্বিত হলেন। রাসূল (সা) এতটাই রেগে গেলেন, তাঁর মুখ এমনভাবে লাল হয়ে গেল যেন তাঁর দুই গালে ডালিম ফল নিংড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তারপর তিনি বললেন, তোমরা কি এজন্য আদেশপ্রাপ্ত হয়েছো, না আমি তোমাদের ওপর এমনটা করার জন্য প্রেরিত হয়েছি? এ বিষয়ে তোমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম যখনই বাগি¦তণ্ডা করেছে তখনই তারা ধ্বংস হয়েছে। আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞার সাথে তোমাদেরকে বলছি, তোমরা এ বিষয়ে কখনো যেন বিতর্কে লিপ্ত না হও। (তিরমিজি : ২১৩৩)
আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, চারটি (দোষ) যার মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে সে খাঁটি মুনাফিক; আর যার মধ্যে এ দোষগুলোর একটি বর্তমান রয়েছে তা ত্যাগ না করা পর্যন্ত তার মধ্যে মুনাফিকির একটি স্বভাব থেকে যায়।
১) যখন সে কথা বলে মিথ্যা বলে
২) সে সন্ধি চুক্তি করলে তা ভঙ্গ করে
৩) সে ওয়াদা করলে তা ভঙ্গ করে এবং
৪) সে ঝগড়া করলে অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে। (মুসলিম, হাদিস : ১১৩)
এখানে ঝগড়াকালে অশ্লীল ভাষা ব্যবহারকে মুনাফিকের চরিত্র বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। আর আমরা যেভাবে ঝগড়া করি তাতে অশ্লীল শব্দ এসেই যায়। অনেক ক্ষেত্রেই মনে হয়, দু’চারটা আজেবাজে শব্দ ব্যবহার না করলে ঝগড়াই জমে না। আর যখনই আমরা এমনটা করি, তখন মানুষকে শয়তান প্রভাবিত করে আর তারা বিবেক বুদ্ধি হারিয়ে অশ্লীল কথা/কাজ করতে দ্বিধাবোধ করে না।
এ কারণে আহলুল বাইত, সাহাবাগণ, তাবেঈ, তাবে-তাবেঈ এবং ইমামদের মধ্যে একটি চর্চা ছিল- তারা অহেতুক তর্ক এড়িয়ে যেতেন। এমনকি ধর্মতাত্ত্বিক কোনো বিষয়েও তারা তর্ক করতে পছন্দ করতেন না। ইমাম মালিক বিন আনাস (রহ) বলেন, দ্বীন সংক্রান্ত তর্ক মানুষের অন্তরকে কঠিন করে দেয় আর ইবাদত ও আমলকে করে দেয় দুর্বল।
মন কঠিন হয়ে গেলে ইবাদাতে মন বসে না, খুলুসিয়াতের সাথে আমল করা যায় না। এমনকি শারীরিক ও মানসিকভাবেও স্বস্তিতে থাকা যায় না। খেয়াল করলে দেখবেন, যেদিন আপনি কোনো বন্ধু, প্রিয় কোনো মানুষ, বা পরিবারের কোনো সদস্য বা সদস্যার সাথে তর্ক করবেন, সে রাতে আপনার মন অস্থির থাকবে। ঘুম ভালো হবে না। বিছানায় এপাশ ওপাশ করেই হয়তো রাতের একটি অংশ চলে যাবে। মনের ভেতর রাগ বা জিদ পুষে রাখলে গলা চড়ে যায়। মেজাজের ভারসাম্য নষ্ট হয়। দেখা যাবে, আপনি একজনের সাথে রাগ করে উচ্চস্বরে কথা বলবেন। সে আবার পাল্টা আপনাকে কিছু কথা শুনিয়ে দেবে। দু’জনেই রাগে ফুঁসতে থাকবেন। এরপর কোনো কাজই সুন্দরভাবে এগুবে না। যে কাজগুলো করার নিয়ত ছিল, তার অর্ধেকও শেষ করতে পারবেন না।
এই আলোচনার সারকথা এমনটা নয় যে, তর্ক বা বিতর্ক করা ইসলাম একদমই অনুমোদন করে না। আপনি যৌক্তিক ও প্রয়োজনীয় কোনো বিষয়ে নিজের যুক্তি, প্রমাণাদি দিয়ে বিতর্ক করতেই পারেন। তবে মোটাদাগে বলা যায়, কুরআন তর্ক ও ঝগড়াকে নিরুৎসাহিত করেছে। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, “হে নবী! তাদের বলে দিন : তোমরা কি আল্লাহর ব্যাপারে আমাদের সাথে ঝগড়া করছো? অথচ তিনিই আমাদের রব এবং তোমাদেরও। আমাদের কাজ আমাদের জন্য, তোমাদের কাজ তোমাদের জন্য। আর আমরা নিজেদের ইবাদাতকে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করেছি।” (সূরা বাকারা ২:১৩৯)
“তোমরা যেন তাদের মতো হয়ে যেও না, যারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে গেছে এবং সুস্পষ্ট ও প্রকাশ্য হিদায়াত পাওয়ার পরও মতবিরোধে লিপ্ত হয়েছে। যারা এ নীতি অবলম্বন করেছে তারা সেদিন কঠিন শাস্তি পাবে।” (সূরা আলে ইমরান ৩:১০৫)
“তারপর কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাদেরকে লাঞ্ছিত করবেন এবং তাদেরকে বলবেন, বলো, এখন কোথায় গেলো আমার সেই শরিকরা যাদের জন্য তোমরা (সত্যপন্থীদের সাথে) ঝগড়া করতে? যারা দুনিয়ায় জ্ঞানের অধিকারী হয়েছিল তখন তারা বলবে, আজ কাফেরদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনা ও দুর্ভাগ্য।” (সূরা নাহল : ২৭)
প্রশ্ন হলো, কোন কোন প্রেক্ষাপটে বিতর্ক করা যায়? এক্ষেত্রে দুটো প্রেক্ষাপট রয়েছে। একটি হলো দ্বীনের বিষয়ে তর্ক করা আরেকটি হলো দুনিয়া বা বৈষয়িক কোনো বিষয়ে তর্ক করা। দুটোর মধ্যে প্রথমে আমরা দুনিয়া সংক্রান্ত তর্ক নিয়ে কিছু কথা বলব। এক্ষেত্রে সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, যখন আপনি মজলুম হবেন, অর্থাৎ কেউ আপনার ওপর জুলুম করবে কিংবা আপনার অধিকার কেড়ে নেবে এবং সেই অধিকার ফিরে পাওয়ার ক্ষেত্রে আপনার হাতে স্বাভাবিক কোনো কৌশলও থাকবে না, সেক্ষেত্রে আপনি নিজের অবস্থান তুলে ধরার জন্য বিতর্ক করাকে একটি কৌশল হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, “যে নারী তার স্বামীর বিষয়ে আপনার সাথে বিতর্ক করছে এবং অভিযোগ পেশ করছে আল্লাহর দরবারে, আল্লাহ তার কথা শুনেছেন। আল্লাহ আপনাদের উভয়ের কথাবার্তা শুনেন। নিশ্চয় আল্লাহ সবকিছু শুনেন, সবকিছু দেখেন।” (সূরা মুজাদালাহ : ১)
আয়েশা (রা) এ আয়াতটি নাজিলের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে বলেন, এই মহিলা যখন তার স্বামীর ব্যাপারে নালিশ নিয়ে এসেছিল তখন আমি ঘরেই ছিলাম। মহিলাটি রাসূল (সা)-এর সাথে খুবই আস্তে আস্তে এবং আওয়াজ না করে কথা বলছিলেন। মনে হচ্ছিল, মহিলাটি রাসূল (সা)-এর সাথে ফিসফিস করে কথা বলছেন। অথচ আল্লাহ এই আয়াতে জানিয়ে দেন, এই মহিলা যতই আস্তে বলুক না কেন, তিনি তার সব অভিযোগ শুনেছেন। আল্লাহু আকবার।
এই বিতর্কটি জায়েজ ছিল কেননা উক্ত নারী তার স্বামীর করা অন্যায়ের প্রতিকার পাওয়ার জন্য তর্ক করেছিলেন। এমনটা আমরাও করতে পারব। কিন্তু যদি কেউ জুলুমের শিকার হন, এরপরও যদি তিনি মনে করেন যে, তর্ক করে খুব একটা ফায়দা পাওয়া যাবে না অথবা এখনও তর্ক করার যথাযথ সময় আসেনি তাহলে তিনি তর্ক না করেও নিজেকে সংযত রাখতে পারেন। এমন সুযোগও দেওয়া হয়েছে। কুরআনেও এর নিদর্শন আছে। যখন ইউসুফ (আ) এর ভাইয়েরা তার বিরুদ্ধে অপবাদ দিয়েছিল তখন তিনি সত্য জানা সত্ত্বেও চুপ ছিলেন এবং তাদের সাথে তর্কে লিপ্ত হননি। আল্লাহ বলেন, “তারা (ইউসুফ আ. এর ভাইয়েরা) বলতে লাগল, যদি সে চুরি করে থাকে, তবে তার এক ভাইও ইতঃপূর্বে চুরি করেছিল। তখন ইউসুফ প্রকৃত সত্যটি নিজের মনে রাখলেন এবং তাদেরকে জানালেন না। মনে মনে বললেন, তোমরা লোক হিসেবে নিতান্ত মন্দ এবং তোমরা যা করছো আল্লাহ তা ভালোভাবেই জানেন।” (সূরা ইউসুফ: ৭৭)
এতটা সংযত আচরণ আমরা করতে পারব না। আমাদের ঈমান ও ইয়াকিন ততটা পোক্ত নয়। এ কারণে, আমাদের ঘাড়ে যখন কেউ অপবাদ চাপিয়ে দেয়, কিংবা কিছু না করেও যখন অন্যায়ের দায় আমাদের ওপর আসে, তখন আমরা সাথে সাথেই তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করি। তাৎক্ষণিক উত্তর দিয়ে বা ঝগড়া করে অভিযোগকারীকে দুর্বল করার চেষ্টা করি। কিন্তু যারা উত্তম আমলদার এবং উন্নত ঈমানসম্পন্ন, তারা নিজেদের সংযত রাখতে পারেন। ইউসুফ (আ) নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিলেন। যারা এভাবে নিজেদের সংযত রাখতে পারেন, তারা মূলত আল্লাহর ওপর ভরসা রাখেন এবং আল্লাহ তায়ালাও তাদের সম্মান সময়মতো এবং যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠা করে দেন।
অন্যদিকে, দ্বীনি কোনো বিষয়ে তর্ক বা বিতর্ক করার ক্ষেত্রেও অনেকগুলো পূর্বশর্ত রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, “আপন রবের পথে আহ্বান করুন জ্ঞানের কথা বুঝিয়ে ও উপদেশ শুনিয়ে উত্তমরূপে এবং তাদের সাথে বিতর্ক করুন উত্তম পন্থায়।” (সূরা নাহল : ১২৫)
দাওয়াতি কাজের সমর্থনে নাজিল হওয়া এই আয়াতটি আমাদের অনেকের কাছেই পরিচিত। এই আয়াতে আল্লাহ পাক স্পষ্ট করে দিয়েছেন তিনটি ধাপের কথা। কারো সাথে কথা বলার ক্ষেত্রে সবার আগে হিকমাহর প্রয়োগ ঘটাতে হবে। এর পরের স্তরে গিয়ে বুঝিয়ে ও উপদেশ দেওয়ার মাধ্যমে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করতে হবে। এ দুটো স্তরে কাজ না হলে তারপরে বিতর্ক করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে তবে সেই বিতর্কও হতে হবে যৌক্তিক পন্থায়। ধর্মীয় বা দ্বীনি কোনো আলোচনা সরাসরি বিতর্ক দিয়ে শুরু করার সুযোগ নেই। ইসলাম এমনটা নির্দেশ করে না। আর বিতর্ক যদি করতেই হয় তাহলেও সেখানে উত্তম শিষ্টাচার, উন্নত আদব ও সমৃদ্ধ চরিত্রের প্রতিফলন ঘটাতে হবে। আরেকটি আয়াতে আল্লাহ সেই সব বান্দাদের সমালোচনা করেন যারা জ্ঞান, প্রমাণ ও সুস্পষ্ট কিতাব ছাড়াই আল্লাহ সম্পর্কে বিতর্ক করে (সূরা হজ্জ : ৮)। এই আয়াত থেকেও বিতর্কের একটি নির্দেশনা পাওয়া যায়। আর তাহলো বিতর্ক করতে তিনটি বিষয় থাকা জরুরি। প্রথমটি হলো জ্ঞান। দ্বিতীয়টি হলো তথ্য প্রমাণ আর সর্বশেষ হলো স্পষ্ট দিক নির্দেশক আলোকিত কিতাবের বয়ান বা রেফারেন্স।
ইমাম মালিক বিন আনাস (রহ) এর চমৎকার ঘটনা জানা যায়। একদিন ইমাম মালিক রহ. তার ছাত্রদের নিয়ে বসেছিলেন। এমন সময় সেখানে একজন লোক এলো। সে কোনো রকম ভূমিকা না দিয়েই সরাসরি ইমামকে বলে বসল, আমি আপনার সাথে দ্বীনি কিছু বিষয়ে তর্ক করতে চাই।
ইমাম প্রশ্ন করলেন, ভালো কথা, যদি আপনি তর্কে জিতে যান, তাহলে কী হবে?
লোকটি বলল, তাহলে আপনি আমার কাছে পরাজয় স্বীকার করবেন এবং আমার মতামত অনুসরণ করবেন।
ইমাম প্রশ্ন করলেন, যদি আমি তর্কে জিতে যাই, তাহলে কী হবে?
লোকটি বলল, তাহলে আমি পরাজয় মেনে নেব এবং আপনার কথা অনুসরণ করব।
ইমাম আবার প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা ধরুন, তৃতীয় একজন এলো। সে আমাদের দুজনকেই তর্কে পরাজিত করল। তাহলে কী হবে?
লোকটি বলল, তাহলে আমরা দু’জনেই নিজেদের অবস্থান ছেড়ে দেবো এবং তাকে অনুসরণ করব।
ইমাম বললেন, “আমাদের দ্বীন এভাবে নির্ধারিত হয় না। কেউ আসলো, তর্ক করল, জিতে গেল আর আমি তাকে অনুসরণ করলাম, এমনটা হয় না। আমাদের আল্লাহ আছেন, রাসূল (সা) আছেন, কিতাব আছে। তর্ক কখনোই এগুলোর চেয়ে বড় কিছু হতে পারে না। অতএব, আপনি চলে যান। আমি তর্ক করার মানুষ নই। দ্বীন নিয়ে আমার মাঝে ন্যূনতম সংশয়ও নেই। যাদের সংশয় আছে, যারা তর্ক করে মজা পান, আপনি তাদের সাথে গিয়ে তর্ক করুন।” আমাদের ইমামগণ বরাবরই অপ্রয়োজনীয় ও অনর্থক তর্ক এড়িয়ে যেতেন। রাসূল (সা) অসংখ্য হাদিসে ঝগড়া থেকে সংযত থাকার তাগিদ দিয়েছেন। রাসূল (সা) বলেন, “যে ব্যক্তি নিজের অবস্থান সঠিক হওয়া সত্ত্বেও ঝগড়া ত্যাগ করল তার জন্য জান্নাতের মধ্যখানে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়।” (ইবনে মাজাহ : ৫১)
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে অনর্থক ঝগড়া থেকে দূরে থাকার তাওফিক দিন। কারণ অনর্থক ঝগড়া মনকে কঠিন করে দেয়, সৃজনশীলতা নষ্ট করে দেয়, সময়ের অপচয় করে, আমলকে দুর্বল করে দেয়, ইবাদতের স্বাদ নষ্ট করে দেয়। আল্লাহ তায়ালা আমাদের জিহ্বাকে সংযত করার সক্ষমতা দান করুন। আমিন।
(ড. ইয়াসির ক্বাদি-এর একটি লেকচার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে)
লেখক : বিশিষ্ট অনুবাদক
আপনার মন্তব্য লিখুন