post

বিদেশে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন সুযোগ ও প্রস্তুতি

মু. সাইফুল ইসলাম

০১ অক্টোবর ২০২৪

[ পর্ব-৫ ]

বিদেশে উচ্চশিক্ষা সংক্রান্ত এই ধারাবাহিকতাটি আমরা লেখা শুরু করেছিলাম বিশেষ করে স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের উপযোগী করে। কিন্তু আপনাদের চাহিদার আলোকে তাতে পরিবর্তন এনেছি। গত পর্বে আমরা বিশেষভাবে মাদরাসা এবং ইসলামিক স্টাডিজ বা এই জাতীয় বিষয়াবলীতে পড়তে ইচ্ছুকদের জন্য সাজিয়েছিলাম। এবারের পর্ব থেকে আমরা স্নাতকোত্তর ও পিএইচডির বিষয়েও আলোকপাত করব। যদিও আগের পর্বগুলোর প্রস্তুতি সংক্রান্ত বিষয়গুলো সবার জন্যই প্রযোজ্য হবে। বিগত পর্বগুলোতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উচ্চশিক্ষা ও স্কলারশিপ সংক্রান্ত বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এবারের পর্বে ইউরোপের গুরুত্বপূর্ণ (তবে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের কাছে কম আলোচিত) দুইটি দেশ যথাক্রমে- মাল্টা ও বেলজিয়ামে উচ্চশিক্ষার সুযোগ, প্রস্তুতি ও আবেদনের বিষয়ে কিছু ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করব।

মাল্টা

বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য মাল্টা ক্রমশই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে তার সহজলভ্য ভিসা প্রক্রিয়া, উচ্চমানের শিক্ষাব্যবস্থা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার জন্য। মাল্টা, ইউরোপের শেনজেনভুক্ত দেশগুলোর একটি- যা ভূ-মধ্যসাগরের বুকে অবস্থিত। এখানকার সরকারি ভাষা মাল্টিজ ও ইংরেজি। মাল্টাতে শিক্ষার পরিবেশ অত্যন্ত ভালো এবং বিদেশী শিক্ষার্থীরা পার্ট-টাইম কাজের মাধ্যমে নিজেদের খরচ মেটাতে পারে। মাসিক আয় ৫০০ থেকে ৭০০ ইউরোর মধ্যে হতে পারে, যা বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৫০,০০০ হাজার থেকে ৭০,০০০ হাজার টাকা। পাশাপাশি, মাল্টায় স্নাতক শেষ করার পর শিক্ষার্থীদের ইউরোপের অন্য শেনজেনভুক্ত দেশগুলোতে কাজ করার বা স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগও থাকে।

মাল্টায় কেন পড়বেন?

- বিশ্বমানের শিক্ষাব্যবস্থা : মাল্টার শিক্ষাব্যবস্থা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কারিকুলাম অনুযায়ী পরিচালিত। এখানে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ও ইনস্টিটিউট আছে, যেগুলোতে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক ধরনের প্রোগ্রাম ও বিশেষ সুযোগ রয়েছে।

- স্বল্প খরচে উচ্চশিক্ষা : মাল্টায় জীবনযাত্রার ব্যয় অন্যান্য ইউরোপীয় দেশের তুলনায় তুলনামূলকভাবে সুলভ। একজন শিক্ষার্থীর মাসিক খরচ গড়ে ৫০০ থেকে ৮০০ ইউরোর মধ্যে হয়ে থাকে, যার মধ্যে আবাসন, খাদ্য, যাতায়াত এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচ অন্তর্ভুক্ত। ডরমিটরিতে থাকার খরচ সাধারণত ২০০ থেকে ৪০০ ইউরোর মধ্যে হয়, তবে শহরের কেন্দ্রে বা ব্যক্তিগত বাসায় থাকলে এই খরচ বেড়ে যেতে পারে। খাদ্য এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচ গড়ে ২০০ থেকে ৩০০ ইউরো হয়, যাতায়াত খরচ ২০ থেকে ৫০ ইউরো পর্যন্ত হতে পারে। মাল্টার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর টিউশন ফি বিষয়ভেদে পরিবর্তিত হয়, তবে গড়ে প্রতি বছর ৫,০০০ হাজার থেকে ১২,০০০ হাজার ইউরো পর্যন্ত হতে পারে। মেডিসিন বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো বিশেষ কোর্সের ক্ষেত্রে টিউশন ফি কিছুটা বেশি হতে পারে। সার্বিকভাবে- মাল্টা সুলভ খরচে ইউরোপীয় মানের শিক্ষা এবং জীবনযাত্রার সুযোগ প্রদান করে, যা বিদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

- শেনজেন ভিসার সুবিধা : মাল্টাতে পড়াশোনা করার সময় শিক্ষার্থীরা শেনজেনভুক্ত ২৬টি দেশে ভ্রমণ করার সুবিধা পান, যা অন্য ইউরোপীয় দেশগুলোতে ভ্রমণ ও কাজ করার সুযোগ তৈরি করে।

- মাল্টায় উচ্চশিক্ষার জন্য বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এবং বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট অন্তর্ভুক্ত। মাল্টার সবচেয়ে বিখ্যাত এবং প্রধান উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো- University of Malta, যা দেশের অন্যতম প্রধান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশিরভাগ কোর্স ইংরেজিতে পড়ানো হয়, যা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য সুবিধাজনক। এখানে ব্যাচেলর, মাস্টার্স এবং পিএইচডি পর্যায়ে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর উচ্চশিক্ষার সুযোগ রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ইঞ্জিনিয়ারিং, আইটি এবং কম্পিউটার সায়েন্স, বিজনেস ম্যানেজমেন্ট, মেডিসিন, স্বাস্থ্যসেবা এবং ‘ল অ্যান্ড লিগ্যাল স্টাডিজ’। আবেদন প্রক্রিয়া সাধারণত অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত চলে। ক্লাস শুরু হয় অক্টোবর-নভেম্বরে। আবেদন লিংক: www.um.edu.mt

মাল্টার আরেকটি শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান হলো- American University of Malta (অটগ), যা ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি একটি আমেরিকান স্টাইলের বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষার্থীদের জন্য ব্যাচেলর ও মাস্টার্স পর্যায়ে বিভিন্ন প্রোগ্রাম চালু রয়েছে। ‘অটগ’ থেকে অর্জিত ডিগ্রি ইউরোপ ও আমেরিকাসহ বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। এখানে ব্যাচেলর প্রোগ্রাম হিসেবে ব্যবসা প্রশাসন, হিসাবরক্ষণ, ইলেকট্রনিক্স, কম্পিউটার সায়েন্স, গ্রাফিক ডিজাইন ও অ্যানিমেশন প্রভৃতি বিষয় পড়ানো হয়। পাশাপাশি, মাস্টার্স প্রোগ্রাম হিসেবে এমবিএসহ বিভিন্ন উচ্চতর কোর্সে পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বিশ্বমানের শিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ প্রদান করে, যা তাদের আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিযোগিতামূলক করে তোলে। আবেদন প্রক্রিয়া ফেব্রুয়ারি এবং আগস্ট মাসে শেষ হয়। ক্লাস শুরু হয় ফেব্রুয়ারি এবং সেপ্টেম্বর মাসে। আবেদন লিংক: www.aum.edu.mt

মাল্টার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে রয়েছে-

- European Graduate School (EGS): এটি মূলত মাস্টার্স ও পিএইচডি প্রোগ্রামের জন্য বিখ্যাত এবং স্কলারশিপ সুবিধা প্রদান করে। আবেদন বছরের বিভিন্ন সময় করা যায়। ক্লাস শুরু হয় সেপ্টেম্বর মাসে। আবেদন লিংক: www.egs.edu

- MCAST (Malta College of Arts, Science and Technology): এটি মাল্টার অন্যতম শীর্ষ প্রতিষ্ঠান। যেখানে প্রযুক্তি, আর্টস এবং সায়েন্সের ওপর বিভিন্ন প্রোগ্রাম চালু রয়েছে। আবেদন সাধারণত ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত করা যায়। ক্লাস শুরু হয় অক্টোবর মাসে। আবেদন লিংক: www.mcast.edu.mt

- Global College Malta: এখানে বিজনেস এবং ম্যানেজমেন্টের ওপর বিশেষায়িত প্রোগ্রাম চালু রয়েছে এবং বিদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য স্কলারশিপের সুযোগ দেওয়া হয়। বছরে দুইবার (জানুয়ারি এবং সেপ্টেম্বর) মাসে আবেদন করার সুযোগ থাকে। আবেদন লিংক: www.gcm.edu.mt

আবেদন প্রক্রিয়া ও যোগ্যতা

মাল্টার শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবেদন করার জন্য শিক্ষার্থীদের সাধারণত কিছু নির্দিষ্ট যোগ্যতা থাকতে হয় এবং আবেদন প্রক্রিয়া তুলনামূলকভাবে সহজ। স্নাতক পর্যায়ের জন্য ঐঝঈ/এ-লেভেল বা সমমানের শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকতে হবে এবং স্নাতকোত্তর প্রোগ্রামের জন্য ব্যাচেলর ডিগ্রি আবশ্যক। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি ভাষার দক্ষতার প্রমাণ হিসেবে IELTS বা TOEFL স্কোর চায়, যেখানে IELTS -এর ক্ষেত্রে ন্যূনতম স্কোর ৫.৫ থেকে ৬.৫ পর্যন্ত হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে মোটিভেশন লেটার (SOP), রিকমেন্ডেশন লেটার এবং একাডেমিক সার্টিফিকেট ও ট্রান্সক্রিপ্ট জমা দিতে হয়। আবেদন প্রক্রিয়াটি সাধারণত অনলাইনের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়। শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে প্রয়োজনীয় ফর্ম পূরণ করে সকল প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস আপলোড করতে হয়। একবার আবেদন জমা হলে শিক্ষার্থীরা সাধারণত কিছু সময়ের মধ্যে অফার লেটার পেয়ে থাকেন, যা দিয়ে তারা ভিসার জন্য আবেদন করতে পারেন।

স্কলারশিপ, ফান্ডিং ও খরচ

মাল্টায় উচ্চশিক্ষার জন্য খরচ এবং ফান্ডিং সম্পর্কে জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মাল্টায় স্নাতক পর্যায়ে স্কলারশিপের সুযোগ তুলনামূলকভাবে সীমিত হলেও, শিক্ষার্থীরা অনেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আংশিক স্কলারশিপ পেতে পারেন। বিশেষত, American University of Malta (অটগ) সরাসরি ৫০% পর্যন্ত টিউশন ফি ছাড় প্রদান করে থাকে, যা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বড়ো সুবিধা। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও মেধার ভিত্তিতে আংশিক স্কলারশিপ পাওয়া যায়, যা টিউশন ফি কমিয়ে পড়াশোনার খরচকে সহজতর করে।

অন্যদিকে- মাল্টায় উচ্চশিক্ষার জন্য বেশ কয়েকটি স্কলারশিপও রয়েছে, যা বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত সহায়ক। স্কলারশিপগুলোতে আবেদন করার প্রক্রিয়া সাধারণত অনলাইনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় এবং শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট কিছু ডকুমেন্ট জমা দিতে হয়। 

- Erasmus+Program ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভিত্তিক একটি স্কলারশিপ, যা মাল্টাসহ অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে মাস্টার্স ও পিএইচডি পর্যায়ে পড়াশোনার সুযোগ দেয়। আবেদনকারীরা Erasmus+ এর ওয়েবসাইটে গিয়ে একাডেমিক রেকর্ড, মোটিভেশন লেটার, রিকমেন্ডেশন লেটার এবং ভাষাগত দক্ষতার প্রমাণপত্র জমা দিয়ে আবেদন করতে পারেন। আবেদন লিংক: www.erasmus-plus.ec.europa.eu

- Malta Government Scholarships-এর ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা সরাসরি মাল্টার সরকার বা সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট থেকে আবেদন করতে পারেন এবং আবেদনকারীদের মেধার ভিত্তিতে স্কলারশিপ প্রদান করা হয়। আবেদন লিংক: www.um.edu.mt

- University of Malta শিক্ষার্থীদের জন্য সরাসরি স্কলারশিপ প্রদান করে, যা মেধার ভিত্তিতে দেওয়া হয় এবং আবেদন প্রক্রিয়াও অনলাইনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। আবেদন লিংক: www.um.edu.mt

- Commonwealth Scholarships বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষভাবে সহায়ক। কারণ, এটি মেধার ভিত্তিতে মাস্টার্স ও পিএইচডি পর্যায়ে টিউশন ফি এবং অন্যান্য খরচ কভার করে। আবেদনকারীরা কমনওয়েলথ স্কলারশিপ কমিশনের ওয়েবসাইটে আবেদন করতে পারেন। আবেদন লিংক: www.acu.ac.uk/scholarships/commonwealth-scholarships

- Fulbright Scholarships  প্রোগ্রামটি গবেষণা এবং উচ্চশিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের সহায়তা করে এবং আবেদনকারীদের একাডেমিক রেকর্ড, মোটিভেশন লেটার এবং রিকমেন্ডেশন লেটার জমা দিতে হয়। আবেদন লিংক:  www.foreign.fulbrightonline.org

ভিসা আবেদন

বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের মাল্টায় পড়াশোনার জন্য স্টুডেন্ট ভিসা প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশে মাল্টার কোনো দূতাবাস না থাকায় ভিসা প্রক্রিয়া সাধারণত ভারতের নয়াদিল্লিতে অবস্থিত মাল্টার দূতাবাসের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হয়। মাল্টায় পড়াশোনার জন্য National Long-Stay Visa (Type D প্রয়োজন হয়, যা ৯০ দিনের বেশি সময়ের জন্য শিক্ষার্থীদের মাল্টায় থাকার অনুমতি দেয়। ভিসার জন্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টের মধ্যে রয়েছে- বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কনফার্মেশন লেটার, টিউশন ফি প্রদানের প্রমাণ, ব্যাংক স্টেটমেন্ট, স্পন্সরশিপ ডকুমেন্ট বা এফডিআর Fixed Deposit Receipt [যা প্রমাণ করে যে তাদের কাছে পর্যাপ্ত অর্থ রয়েছে মাল্টায় পড়াশোনা এবং জীবনযাপনের খরচ মেটানোর জন্য], বাসস্থানের প্রমাণ, স্বাস্থ্য বীমা, পাসপোর্ট কপি এবং পূরণকৃত ভিসা আবেদন ফর্ম। ভিসা ফি সাধারণত ৭০-১০০ ইউরো হয়ে থাকে, এবং প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে ৪ থেকে ৬ সপ্তাহ সময় লাগে।

বেলজিয়াম

বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য বেলজিয়াম উচ্চমানের শিক্ষাব্যবস্থা, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি এবং সুবিধাজনক ভিসা প্রক্রিয়ার কারণে অনেক জনপ্রিয় গন্তব্য হয়ে উঠছে। বেলজিয়াম পশ্চিম ইউরোপের একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ এবং এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের কেন্দ্রস্থল হিসেবে পরিচিত। এখানকার সরকারি ভাষা তিনটি- ডাচ, ফ্রেঞ্চ এবং জার্মান হলেও উচ্চশিক্ষার বেশিরভাগ প্রোগ্রাম ইংরেজিতে পড়ানো হয়। বেলজিয়ামে শিক্ষার্থীরা অত্যন্ত আকর্ষণীয় পরিবেশে পড়াশোনা করতে পারে এবং একইসাথে পার্ট-টাইম কাজের মাধ্যমে তাদের ব্যয় মেটানোর সুযোগ পান। শিক্ষার্থীরা মাসে প্রায় ৮০০ থেকে ১,২০০ ইউরো আয় করতে পারেন, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৯০,০০০ হাজার থেকে ১,৩০,০০০ হাজার টাকা। বেলজিয়ামে স্নাতক শেষে শিক্ষার্থীরা ইউরোপের অন্যান্য শেনজেনভুক্ত দেশগুলোতে কাজ করার এবং স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ পান।

বেলজিয়ামে কেন পড়বেন?

- বিশ্বমানের শিক্ষাব্যবস্থা : বেলজিয়ামের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্বমানের এবং ইউরোপজুড়ে অত্যন্ত সম্মানিত। এখানে গবেষণা এবং শিক্ষা উভয় ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য অনেক সুযোগ রয়েছে। বেলজিয়ামের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় যেমন- KU Leuven, University Catholique de Louvain, Ges Ghent University বিশ্বব্যাপী উচ্চশিক্ষার মানদণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।

- স্বল্প খরচে উচ্চশিক্ষা : বেলজিয়ামের জীবনযাত্রার খরচ তুলনামূলকভাবে অন্যান্য পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোর চেয়ে কম। এক্ষেত্রে, একজন শিক্ষার্থীর মাসিক জীবনযাত্রার ব্যয় গড়ে ৭৫০ থেকে ১,১০০ ইউরো। এই খরচের মধ্যে আবাসন, খাদ্য, যাতায়াত এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচ অন্তর্ভুক্ত থাকে। ডরমিটরিতে থাকার খরচ সাধারণত ২০০ থেকে ৪০০ ইউরো হতে পারে এবং ব্যক্তিগত বাসায় থাকার খরচ কিছুটা বেশি হতে পারে। বেলজিয়ামে বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি সাধারণত ৪,০০০ হাজার থেকে ৯,০০০ হাজার ইউরো পর্যন্ত হয়ে থাকে, তবে কোর্সের ধরণ অনুযায়ী এটি বাড়তে পারে।

- শেনজেন ভিসার সুবিধা : বেলজিয়ামে পড়াশোনা করার সময় শিক্ষার্থীরা শেনজেনভুক্ত ২৬টি দেশে ভ্রমণের সুবিধা পান, যা তাদেরকে অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোতে পড়াশোনা বা কাজ করার সুযোগ দেয়।

বেলজিয়ামের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়

বেলজিয়ামে বেশ কিছু শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যেখানে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য নানা ধরনের প্রোগ্রাম চালু রয়েছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো-

- KU Leuven : এটি বেলজিয়ামের অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে বিজ্ঞান, ইঞ্জিনিয়ারিং, ব্যবসা এবং আইনসহ বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ রয়েছে। আবেদন সাধারণত অক্টোবর মাসে শুরু হয় এবং মার্চ থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে শেষ হয়। তবে নির্দিষ্ট প্রোগ্রামের জন্য সময়সীমা ভিন্ন হতে পারে। আবেদন লিংক: www.kuleuven.be

- University Catholique de Louvain (UCLouvain) : এটি গবেষণা ও একাডেমিক উৎকর্ষতার জন্য বিখ্যাত। এখানে বিভিন্ন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর প্রোগ্রাম ইংরেজিতে পড়ানো হয়। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর প্রোগ্রামের জন্য আবেদন প্রক্রিয়া সাধারণত নভেম্বর থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে হয়ে থাকে। তবে নির্দিষ্ট প্রোগ্রামের ওপর ভিত্তি করে আবেদন করার সময়সীমা পরিবর্তিত হতে পারে। কিছু বিশেষ প্রোগ্রামের জন্য আবেদন প্রক্রিয়া এপ্রিল মাস পর্যন্ত খোলা থাকতে পারে। আবেদন লিংক: www.uclouvain.be

- Ghent University : বেলজিয়ামের অন্যতম শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়, যা বিশ্বজুড়ে উচ্চশিক্ষার মানদণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। এখানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর বিভিন্ন উচ্চতর প্রোগ্রাম চালু রয়েছে। সাধারণত, ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত আবেদন করা যায়। কিছু বিশেষ প্রোগ্রামের জন্য আবেদন প্রক্রিয়া এপ্রিল মাস পর্যন্ত রাখা হয়। আবেদন লিংক: www.ugent.be

- Vrije Universiteit Brussel (VUB) : বেলজিয়ামের অন্যতম প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়, যা বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও শিক্ষার উৎকর্ষতার জন্য পরিচিত। এখানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে বিভিন্ন প্রোগ্রাম ইংরেজিতে পড়ানো হয়। VUB-এ বিভিন্ন প্রোগ্রামের জন্য আবেদন প্রক্রিয়া সাধারণত ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে সম্পন্ন হয়। শিক্ষার্থীদের জন্য ক্লাস শুরু হয় সেপ্টেম্বর মাসে। কিছু প্রোগ্রামের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়সীমা পরিবর্তিত হতে পারে, তাই সময়মতো আবেদন করা গুরুত্বপূর্ণ। আবেদন লিংক: www.vub.be

- University of Antwerp : উচ্চমানের গবেষণা এবং শিক্ষার জন্য বিখ্যাত। এখানে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর প্রোগ্রামগুলোর অনেকগুলোই ইংরেজিতে পড়ানো হয়। আবেদন করার সাধারণ সময়সীমা নভেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত থাকে। ক্লাস শুরু হয় সেপ্টেম্বর মাসে। কিছু প্রোগ্রামের জন্য আবেদন প্রক্রিয়ার সময়সীমা নির্দিষ্ট হতে পারে, তাই প্রোগ্রাম অনুযায়ী আবেদন করার সময়সীমা সম্পর্কে ভালোভাবে খোঁজ নেওয়া প্রয়োজন। আবেদন লিংক: www.uantwerpen.be

আবেদন প্রক্রিয়া ও যোগ্যতা

বেলজিয়ামের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আবেদন করতে হলে শিক্ষার্থীদের HSC/এ-লেভেল বা সমমানের শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকতে হবে। স্নাতকোত্তর প্রোগ্রামের জন্য ব্যাচেলর ডিগ্রি আবশ্যক। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে IELTS বা TOEFL স্কোর চাওয়া হয়, যেখানে IELTS -এর ক্ষেত্রে ন্যূনতম স্কোর ৬.০ থেকে ৬.৫ পর্যন্ত হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে মোটিভেশন লেটার, রিকমেন্ডেশন লেটার এবং একাডেমিক সার্টিফিকেট ও ট্রান্সক্রিপ্ট জমা দিতে হয়। আবেদন প্রক্রিয়াটি সাধারণত অনলাইনের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় এবং শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে প্রয়োজনীয় ফর্ম পূরণ করে আবেদন করতে পারেন।

স্কলারশিপ, ফান্ডিং ও খরচ

বেলজিয়ামে উচ্চশিক্ষার জন্য বেশ কিছু স্কলারশিপ ও ফান্ডিং পাওয়া যায়, যা শিক্ষার্থীদের খরচ কমাতে সহায়ক। উল্লেখযোগ্য স্কলারশিপগুলোর মধ্যে রয়েছে-

- Erasmus+ Program : শিক্ষার্থীরা Erasmus+ এর ওয়েবসাইটে গিয়ে একাডেমিক রেকর্ড, মোটিভেশন লেটার, রিকমেন্ডেশন লেটার এবং ভাষাগত দক্ষতার প্রমাণপত্র জমা দিয়ে আবেদন করতে পারেন। আবেদনের সময়সীমা সাধারণত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত থাকে। আবেদন লিংক: www.erasmus-plus.ec.europa.eu

- VLIR-UOS Scholarships : বেলজিয়ামে উন্নয়নশীল দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য VLIR-UOS স্কলারশিপের মাধ্যমে মাস্টার্স ও শর্ট কোর্সের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়। এটি বিশেষ করে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের জন্য সহায়ক। আবেদন সাধারণত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে করতে হয়। আবেদন লিংক: www.vliruos.be

- Master Mind Scholarships : বেলজিয়ামের সরকার কর্তৃক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য Master Mind Scholarships চালু রয়েছে। এটি মেধার ভিত্তিতে প্রদান করা হয় এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ের জন্য প্রযোজ্য। আবেদন ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসের মধ্যে করা হয়। আবেদন লিংক: www.studyinflanders.be/en/scholarships/master-mind-scholarships

- Commonwealth Scholarships: এই স্কলারশিপটি কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর শিক্ষার্থীদের জন্য এবং মূলত মাস্টার্স ও পিএইচডি প্রোগ্রামের জন্য প্রদান করা হয়। শিক্ষার্থীরা মেধা ও আর্থিক প্রয়োজন বিবেচনায় এই স্কলারশিপ পেতে পারেন। আবেদন সাধারণত অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে করতে হয়। আবেদন লিংক: www.acu.ac.uk/scholarships/commonwealth-scholarships

বেলজিয়ামে সেলফ ফান্ডের মাধ্যমে পড়াশোনা করতে হলে শিক্ষার্থীদের অর্থনৈতিক প্রমাণপত্র জমা দিতে হয়, যা তাদের আর্থিক সক্ষমতা প্রমাণ করে। শিক্ষার্থীদের বা তাদের স্পন্সরের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত অর্থ থাকতে হবে, যা টিউশন ফি এবং জীবনযাত্রার খরচ কভার করতে পারে। সাধারণত, বেলজিয়ামের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর টিউশন ফি ৪,০০০ হাজার থেকে ৯,০০০ হাজার ইউরো পর্যন্ত হতে পারে। শিক্ষার্থীদের মাসিক জীবনযাত্রার খরচ গড়ে ৭৫০ থেকে ১,১০০ ইউরো, যা বার্ষিক  ৯,০০০ হাজার থেকে ১৩,০০০ হাজার ইউরো পর্যন্ত হতে পারে। সুতরাং, শিক্ষার্থীকে প্রায় ১৩,০০০ হাজার থেকে ২২,০০০ হাজার ইউরো (প্রায় ১৫ থেকে ২৫ লাখ টাকা) ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দেখাতে হয়, যা টিউশন ফি ও জীবনযাত্রার খরচ কভার করতে যথেষ্ট হবে।

ভিসা আবেদন

বেলজিয়ামে পড়াশোনা করতে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য স্টুডেন্ট ভিসা প্রয়োজন, যা সাধারণত National Long-Stay Visa (D-Type) নামে পরিচিত। ভিসার জন্য আবেদন করতে হলে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট জমা দিতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে- বেলজিয়ামের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত অফার লেটার, প্রথম সেমিস্টারের টিউশন ফি প্রদানের প্রমাণ, পর্যাপ্ত অর্থ থাকার জন্য ব্যাংক স্টেটমেন্ট এবং বেলজিয়ামে থাকার সময় স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য স্বাস্থ্য বীমা। এছাড়াও, বেলজিয়ামে আবাসনের প্রমাণপত্র এবং পূরণকৃত ভিসা আবেদন ফর্ম জমা দিতে হয়। সাধারণত বেলজিয়ামের ভিসা ফি ২০০ ইউরো এবং ভিসা প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে ৬ থেকে ৮ সপ্তাহ সময় লাগে। যেহেতু বাংলাদেশে বেলজিয়ামের কোনো দূতাবাস নেই, তাই ঢাকায় VFS Global-এর মাধ্যমে ভিসা আবেদন জমা দিতে হয় এবং পরে ভারতের নয়াদিল্লিতে অবস্থিত বেলজিয়ামের দূতাবাস সেই আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। ভিসা পাওয়ার পর, শিক্ষার্থীরা ইউরোপের অন্যান্য শেনজেনভুক্ত ২৬টি দেশে অবাধে ভ্রমণের সুযোগ পাবেন, যা শিক্ষার্থীদের জন্য একটি বড়ো সুবিধা।

আবেদনের ক্ষেত্রে প্রস্তুতি ও পদ্ধতি নিয়ে আজকের পর্বের আমরা বিস্তারিত আলোকপাত করিনি। উক্ত বিষয়ে মোটামুটি গাইডলাইন ১ম পর্বে দেওয়া হয়েছে। সেটির আলোকে প্রস্তুতি নিতে হবে। আগামী পর্বে আমরা নতুন আরও কিছু দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ ও আবেদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানব ইনশাআল্লাহ। আজ এই পর্যন্তই। আল্লাহ হাফিজ।

লেখক : পিএইচডি গবেষক, আঙ্কারা ইউনিভার্সিটি, তুরস্ক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির