post

বিনয় ও উদারতা

সায়ীদ মোস্তাফিজ

৩০ জুলাই ২০২২

আমরা সবসময় জিততে চাই। নিজের বড়ত্ব জাহির করতে মরিয়া হয়ে উঠি। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা করি আমার অনেক ক্ষমতা। কথায় কথায় রিকশাওয়ালার কলার ধরি। বাসের হেলপারের গায়ে হাত তুলি। গরিবকে হেয় করি। হাতছাড়া করি না মানুষকে অপমান করার ন্যূনতম সুযোগও। কেন যেন অন্যকে ছোট করে পৈশাচিক আনন্দ অনুভব করি আমরা। আরো মজার ব্যাপার হলো, আমরা নিজেরাও অন্যের দ্বারা অপমানিত হয়ে থাকি। কিন্তু মানুষের খারাপ ব্যবহার আমাকে কষ্ট দিলেও, আমার খারাপ ব্যবহারে যে মানুষও কষ্ট পেতে পারে তা অনুভব করি না। যে রিকশাওয়ালা অন্যের কাছে ভালো ব্যবহার আশা করে, সে নিজেও অপর রিকশাওয়ালার সাথে বিনয়ী আচরণ করতে পারে না। সবার মাঝে কেমন একটা উগ্র উগ্র ভাব। আজকাল তরুণরা কালার করা কাঠঠোকরানো চুল রাখে। ফ্যাশনের নামে পরে ছেঁড়া পোশাক। নিজেকে উগ্র প্রমাণ করতে মুখটা সবসময় কেমন বিকৃত করে রাখে। ওঁৎ পেতে থাকে কারও সামান্য দুর্বলতা পেলেই কুপোকাত করার জন্য। অবস্থা এমন যে, নিজের মাঝে উগ্রতা ফুটিয়ে তুলতে পারলে লোকে ভয় করবে। ভক্তি করবে। এজন্য অনেক ক্ষেত্রে পারিপাশির্^ক পরিবেশ দায়ী। হুড়-হাঙ্গামার মধ্যে বেড়ে ওঠা শিশু উগ্রতার মধ্যে জীবন খুঁজে। এজন্য বিশেষ কিছু অঞ্চলে প্রায়ই ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে। আর দায়ী দেশি-বিদেশি সিনেমা। কারণ এখানে উগ্র, ভাঙচুরপ্রবণ এবং উচ্ছৃঙ্খল যুবককে নায়ক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। ঠাণ্ডা মাথায় সমস্যা সমাধানের শিক্ষা থাকে না। আর তার প্রভাব পড়ে তরুণদের ওপর। তৈরি হয় কিশোর গ্যাং। গড়ে ওঠে হিংস্র মানসিকতা। আর এই মানসিকতার জন্যই কেউ কাউকে ছাড় দিতে চায় না।  ফলে ছোট ছোট ছাড়ের অভাব বড় বড় দ্বন্দ্বের জন্ম দেয়। চায়ের কাপের ঝগড়া রূপান্তরিত হয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে। অথচ কোনো এক পক্ষের সামান্য ভুল স্বীকার জায়গার সমস্যা জায়গায় সমাধানের জন্য যথেষ্ট হতে পারত। কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কোন একটা ঝামেলা সৃষ্টিতে উভয় পক্ষই কম বেশি দায়ী থাকে। আরেকটা ব্যাপার হলো মানুষ না জেনেও ভুল করে থাকে। অশিক্ষা এবং অনভিজ্ঞতার দরুন অনেক সময় অপ্রত্যাশিত ভুল হয়ে যেতে পারে। কারণ সবসময় সবার সবকিছু জানার সুযোগ থাকে না। নতুন শহরে আসা গ্রামের ছেলেটা শহুরে সংস্কৃতি জানবে না এটাই তো স্বাভাবিক। এটা তার অপরাধ নয়। এক্ষেত্রেও আমরা উদারতা ও বিনয় দেখাতে ব্যর্থ হই। কিন্তু ইসলাম মানুষকে সর্বদা বিনয়ী হতে উৎসাহিত করে। উদার হবার পরামর্শ দেয়। রাসূলুল্লাহ সা. নিজেই ছিলেন বিনয় ও উদারতার মূর্তপ্রতীক। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সূরা আলে ইমরানের ১৫৯ নম্বর আয়াতে সেই ঘোষণা দিয়েছেন; “কেননা, আপনি আল্লাহর রহমতে তাদের প্রতি সদয় আচরণ করেছিলেন, আর যদি আপনি কর্কশ ও কঠোর হৃদয়ের অধিকারী হতেন তবে তারা আপনার চারপাশ থেকে সরে পড়ত।” 

এ প্রসঙ্গে দুইটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। ঘটনা দু’টিই রাসূলুল্লাহ সা. ও বেদুইনদের মধ্যে ঘটেছিল। বেদুইনরা মরুভূমির মানুষ। পশু চরানোই তাদের প্রধান পেশা। শিক্ষা-দীক্ষার তেমন সুযোগ নাই বললেই চলে। একবার এক আরব বেদুঈন মসজিদে প্রস্রাব করে দিলো। মুসলমানরা তাকে মারতে উদ্যত হলে রাসূলুল্লাহ সা. তাদেরকে বললেন, তাকে প্রস্রাব করতে দাও এবং তার প্রস্রাবের উপর এক বালতি পানি ঢেলে দাও। কারণ তোমাদেরকে নম্র ব্যবহারকারী হিসাবে পাঠানো হয়েছে, কঠোর ব্যবহারকারী হিসাবে নয়। (বুখারি ও মুসলিম)

আরেকটি ঘটনা আনাস রা. হতে বর্ণিত। একদিন তিনি রাসূল সা.-এর সঙ্গে হাঁটছিলেন। রাসূল সা.-এর গায়ে ছিল একটি গাঢ় পাড়যুক্ত নাজরানি চাদর। এক বেদুঈন তাঁকে পেয়ে চাদর ধরে সজোরে টান দিলো। আনাস রা. বলেন, আমি নবী করিম সা.-এর কাঁধের ওপর তাকিয়ে দেখলাম যে জোরে চাদরটি টানার কারণে তাঁর কাঁধে দাগ বসে গেছে। তারপর বেদুঈন বলল, হে মুহাম্মাদ, তোমার কাছে আল্লাহর দেওয়া যে সম্পদ আছে, তা থেকে আমাকে দেওয়ার জন্য আদেশ করো। তখন নবী করিম সা. তার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললেন এবং তাকে কিছু দান করার জন্য আদেশ করলেন।’ (বুখারি)

এ ব্যাপারে ক্রুআনের স্পষ্ট নির্দেশনা হলো, পৃথিবীতে উগ্রভাবে বিচরণ করো না। নিশ্চয়ই তুমি পদভারে ভূপৃষ্ঠকে কখনই বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় তুমি কখনও পর্বতসম হতে পারবে না’ (বনি ইসরাইল-৩৭)। উগ্রতার বিষয়ে হাদিসের কঠোর হুঁশিয়ারি হলো; প্রত্যেক অনর্থক কথা নিয়ে ঝগড়াকারী বদমেজাজি ও অহঙ্কারী ব্যক্তি জাহান্নামি। (মুসলিম) 

এই বিনয়, নম্রতা ও উদারতার সাথে জীবন উপভোগের সম্পর্ক কী? যারা উগ্র, বদমেজাজি। নিজের স্বার্থরক্ষায় অনড়-অটল। নিজের বড়ত্ব প্রমাণে ব্যস্ত। বড়কে সম্মান করে না। ছোটদের স্নেহ করে না। তারা নিজেরা নিজেদের হিরো ভাবলেও পরিবার-পরিজন, আত্মীয় ও বন্ধু-বান্ধব কারও প্রিয়পাত্র হতে পারে না। এবং অন্যের কাছে যা প্রত্যাশা করে তা না পেয়ে মানসিকভাবে অস্থির থাকে। সবসময় উঁচু মঞ্চের বাসনা তাদের কুরে কুরে খায়। সর্বত্র খবরদারি ফলানোর চেষ্টা তাদের সমাজ বিচ্ছিন্ন করে তোলে। যা তারা বাইরে হেয় করে উড়িয়ে দিতে চাইলেও, ভেতরে ঠিকই যন্ত্রণা অনুভব করে। কারণ মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা হলো লোকের কাছে নিজের প্রশংসা শুনতে চাওয়া। কারও বাঁকাদৃষ্টি কেউই কামনা করে না। অন্যদিকে যারা ন¤্রভাবে সমাজে চলাফেরা করে, লোকে ভয় করুক বা ভক্তি করুক এমন কোনো অযাচিত প্রত্যাশা তাদের থাকে না। ফলে না পাওয়ার বেদনা তাদের অস্থির করে না। বরং তারা সমাজকে অনেক কিছুই দিয়ে থাকে নিঃস্বার্থভাবে। নিজের অজান্তেই যা তাদের করে তোলে জনপ্রিয়। না চাইতেই লোকে তাদের সম্মান করে। স্নেহ করে। ফলে এই বাড়তি পাওয়ায় তারা টইটম্বুর হয়ে যায়। জীবন হয়ে ওঠে উপভোগ্য। তবে বিনয় বলতে অবশ্যই দুর্বলতা নয়। জুলুমকে উসকে দেয় যে বিনয় তার কোনো প্রয়োজন নেই। বিনয়ের সুরে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারা সর্বোচ্চ বিনয়ীর পরিচয় বহন করে। ইতরবিশেষে বিনয় প্রদর্শনও চরম ভণ্ডামি। অফিসের বসের সাথে বিনয়ী আচরণ করলেও অফিসের পিয়নের কাছে কাঠখোট্টা ব্যক্তি প্রকৃত বিনয়ী নয়। ধনী বন্ধুর কাছে উদার ব্যক্তি গরিব বন্ধুর ব্যাপারে উদাসীন হলে তার এই উদারতাও উপভোগের উদারতা নয়।

মুসলমানরা বিনয়ী জাতি। উদার জাতি। এবং সাথে সাথে বিজয়ী জাতি। প্রকৃতঅর্থে অস্ত্র নয়, বিনয় আর উদারতা দিয়ে মুসলমানদের বিজয় এসেছিল। মানুষ কেন মানুষকে ভয় করবে। মানুষ তো ভয় করবে আল্লাহ রাব্বুল আলামিনকে। যে ভয়ই কেবল মানুষকে বিনয়ী হতে সাহায্য করে। চলুন আমরা লোককে ভয় না দেখিয়ে, আল্লাহকে ভয় করি। বিনয়ী হই। উদার হই। মানুষের সাথে সহনশীল আচরণ করি। বিনয় আর উদারতার অফুরান শক্তি আছে। সে শক্তি আমাদের অশান্ত মনকে প্রশান্ত করে। অস্থিরতাকে প্রশমিত করে। আমাদের জীবন হয়ে ওঠে উপভোগ্য। প্রশস্ত হয় জান্নাতের পথ। কেননা আল্লাহর নৈকট্য লাভকারী প্রত্যেক বিনয়ী ও নম্র লোকের জন্য জাহান্নাম হারাম। (তিরমিজি)। জান্নাত তো উপভোগেরই স্থান। পরকালীন জীবনই তো প্রকৃত জীবন। 

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির