করোনা-পরবর্তী বিশ্বে নাই নাই আওয়াজ উঠেছে। মহা মন্দার পূর্বাভাস দিয়েছেন বিশ্ব মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিবিদরাও। তাদের সাথে সুর মিলাচ্ছেন জাতিসংঘ, বিশ্ব খাদ্য সংস্থা, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ বিভিন্ন বিশ্বসংস্থার কর্তা ব্যক্তিরা। এই আওয়াজের প্রভাবে বিভিন্ন দেশ জাতীয়তাবাদী অর্থনৈতিক বলয় গড়ে তুলে সঙ্কটকে আরো প্রকট ও ত্বরান্বিত করছে। ভবিষ্যৎ সঙ্কট মোকাবেলা করতে যার যার মতো করে সঞ্চয় বাড়াচ্ছে। ফলে পৃথিবীর সম্পদের সুষম ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এই সঙ্কটের আগাম বার্তা নিয়ে যে যার মতো করে তার ব্যাখ্যা করছে। কিন্তু সমস্যার মূলে কেউ আঘাত করছে না এবং সমাধানের চেষ্টাও করছে না।
আমরা বিশ্বাস করি, এই বিশ্ব জাহানের ¯্রষ্টা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তিনিই জানেন মানবজাতির ওপর কেন বিপর্যয় নেমে আসে। কোন সমস্যার সমাধান কোন পথে। কিন্তু বর্তমান পুঁজিবাদী ও বস্তুবাদে বিশ্বাসী সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিবিদদের সেই জ্ঞান ও গবেষণা নেই। আধুনিক বিশ্বে ইসলামী শিক্ষার প্রগতিশীল ধারা ও গবেষণাও অনেকটা বন্ধ। ইসলামের নামে মুসলিম বিশ্ব যেসব বিশ্বসংস্থা গড়ে তুলেছে তার নেতৃত্বে যারা আছেন, তাদের অধিকাংশই কথিত আধুনিক শিক্ষায় যতটা শিক্ষিত কুরআন হাদিসের জ্ঞানে ততটাই পিছিয়ে। অথচ অর্থনীতির আধুনিক অনুষঙ্গগুলোকে ইসলামের আলোকে বিশ্লেষণ করে সমস্যার সহজ সমাধান সম্ভব। অন্যদিকে শুধুমাত্র ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত অন্য একটি গ্রুপ আছেন, যারা গবেষণা দ্বার রুদ্ধ করে যুগ সমস্যার সমাধান খুঁজেন, অতি প্রাচীন কালের বিশ্লেষকদের গবেষণার মধ্যে। কারণ তাকে ভিত্তি ধরে নতুন কিছু উদ্ভাবনের যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষা তারা পাননি। তারা উল্টো আধুনিক চিন্তাধারার পথে বাধার সৃষ্টি করেন। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায়,‘বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে, আমরা তখনও বসে/ বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি, ফিকাহ ও হাদিস চষে।’ তাদের অর্থনীতির জ্ঞান, ‘জিন্দিগানি মেঘের পানি চলছে ছুটে দরিয়ায়, আল্লাহর ঘরে দিনে টাকা আখেরাতে পাওয়া যায়’ এর মধ্যে সীমাবব্ধ। বিশ্বমন্দা উত্তরণের সঙ্কট মোকাবেলার জ্ঞান ও যোগ্যতা না থাকায় তারা ব্যস্ত ধান্ধায়। ইসলাম থেকে দূরে থাকা গোষ্ঠী এবং কথিত অতি কাছে থাকা অজ্ঞ মানুষদের কারণে পৃথিবীতে সম্পদ বণ্টনের যে ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়েছে, তার প্রভাবেই সৃষ্টি হয়েছে অর্থনৈতিক মন্দা।
সম্পদের অভাব মন্দার কারণ নয়
সম্পদের অভাব মন্দার কারণ নয়। বিশ্বে অতি সম্পদশালী আর দরিদ্রতম জনগোষ্ঠীর মধ্যে বৈষম্য এতটাই প্রকট যে, শীর্ষ আট ধনীর সম্পদের পরিমাণ বিশ্বের অর্ধেক মানুষ অর্থাৎ ৩৬০ কোটি মানুষের মোট সম্পদের সমান। এ তথ্য ২০১৬ সালে প্রকাশ করেছে, আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা অক্সফাম। অক্সফামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘অতি ধনী ও দরিদ্রতম ব্যক্তিদের মধ্যে ব্যবধান অনেক বেড়েছে। এই ব্যবধান কমাতে বিশ্বনেতাদের এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে এ ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে জনরোষ বাড়তেই থাকবে। বৈষম্যের কারণে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বড় ধরনের আলোড়ন তৈরি হবে। এটা খুবই চিন্তার বিষয় যে বিপুল পরিমাণ সম্পদ একেবারেই অল্প কিছু মানুষের হাতে রয়েছে। অথচ এখনো পৃথিবীর প্রতি ১০ জনের একজন মাত্র ২ ডলারে দিন চালায়। বৈষম্যের কারণে কোটি কোটি মানুষ দারিদ্র্যের ফাঁদে আটকা পড়ছে। এটা আমাদের সমাজ ও গণতন্ত্রের মধ্যে ফাটল তৈরি করছে। অক্সফামের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, ৬২ জন অতি ধনীর হাতে রয়েছে পৃথিবীর অর্ধেক পরিমাণ সম্পদ। পরে তা ৯ জনে সংশোধন করে অক্সফাম। এবার মার্কিন সাময়িকী ফোর্বসের ২০১৬ সালের ধনীর তালিকা ব্যবহার করে গবেষণা করেছে অক্সফাম। ফোর্বসের তালিকা অনুযায়ী মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস পৃথিবীর শীর্ষ ধনী। তাঁর সম্পদের পরিমাণ ৭৫ বিলিয়ন ডলার। তালিকার পরের অবস্থানগুলো হলো স্প্যানিশ ব্যবসায়ী অ্যামানসিও ওর্তেগা (৬৭ বিলিয়ন ডলার), মার্কিন ব্যবসায়ী ওয়ারেন বাফেট (৬০.৮ লিলিয়ন ডলার), মেক্সিকান ব্যবসায়ী কার্লোস স্লিম (৫০ বিলিয়ন ডলার), ই-কমার্স ওয়েবসাইট আমাজনের প্রধান জেফ বেজস (৪৫.২ বিলিয়ন ডলার), ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ (৪৪.৬ বিলিয়ন ডলার), সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওরাকলের প্রধান নির্বাহী ল্যারি অ্যালিসন (৪৩.৬ বিলিয়ন ডলার) ও নিউ ইয়র্কের সাবেক মেয়র মাইকেল ব্লুমবার্গ (৪০ বিলিয়ন ডলার)।’
আজ ২০২২ সালে এসে পৃথিবী যে সঙ্কটেন কারণে আতঙ্কিত এর র্প্বূাভাস অক্সফামের ২০১৬ সালের প্রতিবেদনেই দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সম্পদ বৈষম্যের কারণ নির্ণয় এবং তার সমাধানের চেষ্টা বিশ্ব নেতারা তখন করেননি, এখনো করছেন এমনটা বলা যায় না। তাই সঙ্কট প্রতিদিন বাড়ছে।
ফোর্বস ম্যাগাজিন ২০২২ সালেও বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের তালিকা প্রকাশ করেছে। এতে শীর্ষ ব্যক্তির স্থান পরিবর্তন হলেও কয়েকজন ব্যক্তির হাতেই সম্পদ কুক্ষিগত সে তথ্যই উঠে এসেছে। ২০২২ সালের মঙ্গলবার ৫ এপ্রিল প্রকাশিত ফোর্বস ম্যাগাজিনের সর্বশেষ বিলিয়নিয়ার তালিকা অনুসারে, টেসলা এবং স্পেসএক্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইলন মাস্ক বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। চলতি বছরের ১১ মার্চ পর্যন্ত, ইলন মাস্কের মোট সম্পদের পরিমাণ আনুমানিক ২১৯ বিলিয়ন ডলার ছিল। কারণ গত বছর বৈদ্যুতিক গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান টেসলার শেয়ারদর ৩৩ শতাংশ বাড়ায় ইলন মাস্কের সম্পদের পরিমাণ ৬৮ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে। ইলন মাস্কের মোট সম্পদের পরিমাণ জেফ বেজোসের তুলনায় ৪৮ বিলিয়ন ডলার বেশি। খুচরা জায়ান্ট অ্যামাজন এর শেয়ার ৩ শতাংশ কমে যাওয়ায় জেফ বেজোস চার বছরে প্রথমবারের মতো তালিকার দ্বিতীয় স্থানে নেমে এসেছেন। এছাড়া দাতব্য দান বাড়ানোর কারণে তার মোট সম্পদের পরিমাণ ৬ বিলিয়ন কমে গেছে। এছাড়া ফরাসি বিলাস পণ্য ব্যবসায়ী বার্নার্ড আরনাল্ট তালিকার তৃতীয় স্থানে রয়েছেন। তার সম্পদের পরিমাণ আনুমানিক ১৫৮ বিলিয়ন ডলার। গত এক বছরে তার সম্পদের পাহাড়ে আরও ৮ বিলিয়ন ডলার যোগ হয়েছে।
ফোর্বসের তথ্য বলছে, বিশ্বের বিলিয়নিয়ারদের মোট আনুমানিক সম্পদের পরিমাণ ১২ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার। যা ২০২১ সালের তুলনায় ৪০০ বিলিয়ন ডলার কম। পুরো তালিকায় মোট ২ হাজার ৬৬৮ জন ধনী ব্যক্তির স্থান হয়েছে। এর মধ্যে ৭৩৫ জন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এবং ৬০৭ জন চীনের নাগরিক। এছাড়া তালিকায় রাশিয়ান ধনকুবেরের সংখ্যা ৮৩ জন।
অর্থনীতির একটি সাধারণ স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম হলো, সম্পদ সঞ্চয়ে নয় বিনিয়োগে বাড়ে। ইসলাম তাই সম্পদ সঞ্চয়ে নয় বিনিয়োগ, খরচ ও দানে উৎসাহিত করে। ইসলামী অর্থব্যবস্থায় কৃপণতা ও অপচয় দুইটিই হারাম বা নিষিদ্ধ। সুদকেও হারাম করা হয়েছে, জাকাত বা সম্পদের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্জনকারীদের জন্য দান করা বাধ্যতামূলক বা ফরজ ঘোষণা করা হয়েছে। তাই এই অর্থব্যবস্থায় সম্পদ নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির হাতে পুঞ্জিভূত হওয়ার সুযোগ নেই। ইসলামে অর্থব্যবস্থার ধারণা হলো, পৃথিবীর সমস্ত সম্পদের মালিক আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। আল্লাহর প্রত্যেক বান্দার দায়িত্ব তাঁর নির্দেশিত পথে সম্পদ ব্যয় করা। কিন্তু ইসলামে বিশ্বাসী নন এমন ব্যক্তিরা মনে করেন, তিনি তার মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে সম্পদ অর্জন করেছেন, এর একমাত্র মালিক তিনি নিজে। এতে অন্য কারো অধিকার নেই। এই কারণেই বর্তমান সঙ্কট উত্তরণের কোন পথ তারা খুঁজে পাচ্ছেন না। অবস্থা এমন মৃত্যু নিশ্চিত রোগও নির্ণয় হয়েছে কিন্তু ওষুধ খুঁজে পাচ্ছেন না বিশ্ব অর্থনীতিবিদরা।
বিশ্ব অর্থনীতির ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং
আরও অনিশ্চিত
বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস গত মাসে বলেছেন, বেশিরভাগ দেশই মন্দার দিকে। এমনকি বিশ্বে ১৯৭০ দশকের সেই স্ট্যাগফ্লেশনও ফিরে আসতে পারে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিভা গত সপ্তাহেই বলেছেন, বিশ্ব অর্থনীতির ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন ও আরও অনিশ্চিত। তারা দেখতে পাচ্ছেন তিনটি জটিল রোগে আক্রান্ত বিশ্ব অর্থনীতি: উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বদ্ধ স্ফীতি বা স্ট্যাগফ্লেশন এবং রিসেশন বা মন্দা। কিন্তু কোন পথে এর সমাধান তা নিয়ে আছে নানা মুনির নানা মত।
একটি জাতীয় দৈনিকের অর্থনীতিবিষয়ক প্রতিবেদক ও বিশ্লেষক শওকত হোসেন গত ১ আগস্ট প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে লিখেছেন, ‘জলে কুমির ডাঙায় বাঘ এককথায় এটাই এখন বিশ্ব অর্থনীতির চিত্র। আর এ কারণেই অর্থনীতি এখন কোন পথে যাচ্ছে, এর উত্তর দেওয়াটা সহজ নয়। অর্থনীতিকে কোন পথে যেতে হবে, এটা নিয়ে নীতিনির্ধারক ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও আছে নানা মত। তবে সবাই একমত যে সামনের সম্ভাব্য প্রতিটি পথই খারাপ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কুৎসিত। পথ মূলত তিনটি উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বদ্ধ স্ফীতি বা স্ট্যাগফ্লেশন এবং রিসেশন বা মন্দা।’
দ্য গ্রেট ইনফ্লেশন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সমৃদ্ধি এনে দিয়েছিল। সে সময় উৎপাদন বাড়ে, কমে যায় বেকারত্ব, মূল্যস্ফীতিও ছিল অনেক কম, ১ শতাংশের ঘরে। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টে যায় ১৯৬৫ সাল থেকে। বাড়তে থাকে বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতি। এই পরিস্থিতি ছিল ১৯৮২ সাল পর্যন্ত। ১৯৮০ সালে দেশটির মূল্যস্ফীতির হার ছিল প্রায় ১৫ শতাংশ। এ সময়কেই বলা হয় দ্য গ্রেট ইনফ্লেশন। এর মধ্যেই অভিজ্ঞতা হয় স্ট্যাগফ্লেশনেরও। মূলত এর পর থেকেই একটি আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা কী হবে, নির্ধারিত হয়ে যায়। তখনই ঠিক হয় যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্যতম কাজ। সেভাবেই ভূমিকা পালন করে আসছে মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ বা ফেড। উন্নত দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোও একই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে আসছে। ১৯৮১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হন রোনাল্ড রিগ্যান। সে সময়ের মূল্যস্ফীতি দেখেই তিনি সেই বিখ্যাত উক্তিটি করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘মূল্যস্ফীতি হচ্ছে ছিনতাইকারীর মতো হিংস্র, সশস্ত্র ডাকাতের মতো ভয়ঙ্কর এবং খুনির মতোই প্রাণঘাতী।’ উচ্চ মূল্যস্ফীতি থেকে বাঁচতে তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক কৌশল হিসেবে অর্থনৈতিক মন্দাকে বেছে নিয়েছিল। মার্কিন ফেড মুদ্রা সরবরাহ ব্যাপকভাবে কমিয়ে দেয়, বাড়ায় নীতিনির্ধারণী সুদহার। তাতে কমে যায় উৎপাদন। মানুষের হাতে নগদ অর্থও হ্রাস পায়। এতে কমে চাহিদা। ফল হিসেবে ১৯৮৫ সালে মূল্যস্ফীতি নেমে এসেছিল সাড়ে ৩ শতাংশে।
আবার সেই মূল্যস্ফীতি
যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি এখন ৯ দশমিক ১ শতাংশ, যা ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। অর্থাৎ সেই আশির দশকের উচ্চ মূল্যস্ফীতির পরে এটাই সর্বোচ্চ। এবারের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ফেড চলতি বছরে এখন পর্যন্ত চারবার সুদের হার বাড়িয়েছে। এর মাধ্যমে মুদ্রা সরবরাহ কমাতে চায় তারা। মূলত কোভিড-১৯-এর দুই বছরে চাহিদা ঠিক রাখতে মানুষের হাতে অর্থ তুলে দেওয়া হয়েছিল। সেই অর্থই তারা ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছে।
সারা বিশ্বই মূলত তাকিয়ে থাকে ফেডের দিকে। সুদহার বাড়ানো বা কমানোর সিদ্ধান্ত সবার জন্যই একটি সংকেত। তা ছাড়া প্রায় সব দেশই উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে আছে, তাই সবাই অনুসরণ করছে ফেডকে। ফেডের চেয়ারম্যান জেরোমি পাওয়েল বলেছেন, মূল্যস্ফীতি না কমা পর্যন্ত তাঁরা সুদহার বাড়িয়েই যাবেন। এখন অনেকেরই আশঙ্কা, ফেডের এই নীতিই আসলে মন্দার দিকে নিয়ে যাচ্ছে অর্থনীতিকে।
মন্দা কি অপরিহার্য
যুক্তরাষ্ট্রে ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ (এনবিইআর) নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আছে। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদসহ নানা পর্যায়ের বিশেষজ্ঞরা এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। প্রতিষ্ঠানটির অন্যতম কাজ অর্থনীতির বাণিজ্যচক্র বিশ্লেষণ করা। মূলত তারাই বলে দেয় কখন অর্থনীতির মন্দা শুরু আর কখন শেষ। সাধারণত পর পর দুই প্রান্তিকে অর্থনীতি সংকুচিত হলে তাকেই মন্দা বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে পরপর দুই প্রান্তিকেই অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে। এখনো মন্দার ঘোষণা আসেনি। তবে মন্দা যে আসছে, তাতে সবাই কমবেশি একমত।
ব্লুমবার্গের অর্থনৈতিক মডেল বলছে, ২০২৪ সালে মন্দা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা ১০০ শতাংশ। জার্মানির ডয়চে ব্যাংকের অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মন্দা দেখা দেবে ২০২৩ সালের মাঝামাঝিতে। যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ওয়েলস ফারগো অ্যান্ড কোম্পানির মতে, মন্দা হবে ২০২৩ সালের শুরুতে আর জাপানের আর্থিক কোম্পানি নমুরা হোল্ডিং বলছে, মন্দা দেখা দেবে চলতি ২০২২-এর শেষ দিকেই।
আশির দশকে ফেড মন্দাকে বরণ করে নিয়েছিল। তবে এবার ফেডের চেষ্টা হচ্ছে মন্দায় না ঢুকেই মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা। কেননা, মন্দা দেখা দিলে উৎপাদন কমবে, কর্মসংস্থান কমবে, মানুষের আয়ও কমে যাবে। এই পরিস্থিতি অর্থনীতির জন্য মোটেই সুখকর নয়। যদিও মার্কিন অর্থনীতির জন্য মন্দা মোটেই নতুন কিছু নয়। বার্তা সংস্থা সিএনএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৮৫৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মার্কিন অর্থনীতিতে ৩৪ বার মন্দা দেখা দিয়েছিল। এর অর্থ প্রতি পাঁচ বছর পরপর মন্দা দেখা দেয় আর গড়ে এর স্থায়িত্ব ১৭ মাস। তবে এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ মন্দার কবলে পড়লে এর প্রভাব পড়বে সারা বিশ্বে। কেননা চীনের অর্থনীতিও সংকুচিত হয়ে পড়েছে। আর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে ইউরোপ পড়ে আছে তীব্র জ্বালানিসঙ্কটে।
মন্দার চেয়েও যা কুৎসিত
মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে এখন সবাই সুদের হার বাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এতেও যদি কাজ না হয়? যদি এমন হয় যে মূল্যস্ফীতি মোটেই কমল না, বরং সংকুচিত হলো অর্থনীতি। এ পরিস্থিতিকেই বলা হয় স্ট্যাগফ্লেশন। অর্থাৎ ‘ইনফ্লেশন’ ও ‘রিসেশন’-এর মিশ্রণ, যা দেখা দিয়েছিল ১৯৭০-এর দশকে। ওই সময়ে সৌদি আরব ও অন্য তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সমর্থক দেশগুলোর কাছে জ্বালানি তেল বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিলে এসব দেশের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যায়। উৎপাদনও হ্রাস পায়। একটা পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্রের বেকারত্বের হার বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৯ শতাংশ আর মূল্যস্ফীতি প্রায় ১৫ শতাংশ। এটাই সেই কুখ্যাত স্ট্যাগফ্লেশন, যাকে অনেকেই সবচেয়ে কুৎসিত অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বলে মনে করেন।’
তার মানে আধুনিক অর্থনীতিবিদরা যে পথে সমাধান খুঁঁজছেন তাতে বেকারত্ব বেড়ে গিয়ে আরো ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা সেই অবস্থার নাম দিয়েছেন স্ট্যাগফ্লেশন। শওকত হোসেনের ভাষায় “কুখ্যাত স্ট্যাগফ্লেশন”। তাহলে এখন উপায় কী? উপায় একটাই সুদমুক্ত অর্থব্যবস্থার কাছে আত্মসমর্পণ। সহজ কথায় ইসলামী অর্থব্যবস্থাই এখন একমাত্র বিকল্প। কিন্তু আধুনিক অর্থনীতিবিদরা কি তা মেনে নিবেন। তাদের সামনে এই সত্য উপস্থাপন করার মতো ইসলামী অর্থনীতিবিদ কি ‘কুন তুম খয়রা উম্মত’ (পবিত্র কুরআনের ভাষায় সর্বোত্তম জাতি) এর বা মুসলিম বিশ্বের নেতারা তৈরি করতে পেরেছেন?
কুখ্যাত স্ট্যাগফ্লেশন থেকে মুক্তির পথ
কুখ্যাত স্ট্যাগফ্লেশনের মূল কারণ সুদভিত্তিক অর্থনীতি যা বতর্মান আধুনিককালের পুঁজিবাদী অর্থনীতিবিদরাও স্বীকার করছেন। অন্যদিকে ইসলামী অর্থব্যবস্থায় সুদ হারাম, নিষিদ্ধ বা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অরলিন্স ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. কবির হাসান ও মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মালায়ার পিএইচডি গবেষক অধ্যাপক মুহাম্মদ মোস্তফা হোসাইন তাদের যৌথ এক গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছন,‘ ইসলামী সমাজ বা অর্থব্যবস্থার অন্যতম মৌলিক লক্ষ্য সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সুদ একটি বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা। সেজন্যই আল্লাহ তায়ালা সুদকে পরিপূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করেছেন (সূরা বাকারা ২৭৮-২৭৯; সূরা আলে ইমরান ১৩০)। তারই আলোকে রাসুল সা. খোলাফায়ে রাশেদার যুগ এবং অষ্টম থেকে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত মুসলিম শাসনামলে সুদবিহীন শক্তিশালী ইসলামী অর্থব্যবস্থার প্রচলন ছিল। সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থায় ঋণগ্রহীতা ঋণের টাকার বিপরীতে লভ্যাংশ অর্জন করুক বা না করুক যেকোনো অবস্থাতেই নির্দিষ্ট হারে ঋণদাতাকে সুদ আদায় করতে হয়, যা মূলত জুলুমকেই প্রতিষ্ঠিত করে। ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আমানতকারীদের সুদ গ্রহণ নিয়ে ধূম্রজাল থাকলেও মূলত ব্যাংক আমানতকারীর আমানতকে অন্যত্র অতিরিক্ত মোটা সুদে বিনিয়োগ করে সেখান থেকে সুদের একটা অংশ আমানতকারীকে দিয়ে থাকে, সুতরাং এখানেও একই জুলুম বিরাজমান। এক্ষেত্রে ব্যাংক থেকে ঋণগ্রহীতা কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান যদি ঋণ প্রদানে অক্ষম হয় তখন ঋণগ্রহীতার শিল্প বা বন্ধক দেওয়া সম্পত্তির ওপর ব্যাংক হস্তক্ষেপ করে, ফলে স্তরে স্তরে অর্থনৈতিক লোকসানসহ নানা ধরনের সামাজিক ও আর্থিক সমস্যা তৈরি হয়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সুদভিত্তিক অর্থব্যববস্থার অন্যতম গুরুতর সমস্যা। উৎপাদক ও খুচরা ব্যবসায়ীরা স্বাভাবিক নিয়মে যৌক্তিক লভ্যাংশ সংযুক্ত করে পণ্য বাজারজাত করলে সেটা ক্রয় করা গ্রাহকের জন্য অনেক সময় সহনীয় পর্যায়ে থাকে, তবে সুদভিত্তিক ঋণ নিয়ে পণ্য উৎপাদন করলে সেখানে সুদের হার সংযুক্ত করে লভ্যাংশ নির্ধারণ হয় বলে স্বাভাবিক নিয়মেই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়, তাতে অনেকের পক্ষেই প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। সুদভিত্তিক অর্থব্যবস্থায় পরিশ্রম ব্যতিরেকেই সমাজে নির্দিষ্ট একটি শ্রেণির কাছে প্রচুর পরিমাণে অর্থ জমা হতে থাকে। এতে বাজারে ব্যবসাবান্ধব পুঁজির সঙ্কট তৈরি হয়। কোনো রকম পরিশ্রম ব্যতিরেকেই এক শ্রেণির মানুষ বিপুল পরিমাণ সম্পদের অধিকারী হয়, অন্যদিকে ঋণগ্রহীতা দরিদ্র শ্রেণি শুধু রক্ত নিঃসৃত ও ঘর্মাক্ত পরিশ্রমই করে যায়, যেটি সমাজে ধনী ও দরিদ্রদের মাঝে মোটাদাগের বৈষম্য তৈরি করে। এছাড়া ফাটকাবাজারি ও বিনিয়োগ-পরবর্তী পুঁজি সংরক্ষণে ঋণগ্রহীতার প্রতি সুদভিত্তিক বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো রকম দায়বদ্ধতা গ্রহণ করে না, যা পুরোপুরি ইসলামী অর্থনীতির বিপরীত।’ তাই ব্যবস্থায় কুখ্যাত স্ট্যাগফ্লেশন শিকড় গাড়তে পারে না।
ইসলামী অর্থনীতির দার্শনিক তত্ত্ব
যুক্তরাষ্ট্রের নিউ অরলিন্স ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. কবির হাসান ও মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মালায়ার পিএইচডি গবেষক অধ্যাপক মুহাম্মদ মোস্তফা হোসাইন তাদের যৌথ এক গবেষণাপত্রে উল্লেখ করেছন,‘ ইসলামী অর্থনীতির দার্শনিক তত্ত্ব বোঝার জন্য সূরা আরাফের ৩১ থেকে ৩৩ নম্বর আয়াতগুলোও আমাদের বিশ্লেষণ করা দরকার। যেখানে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে অপব্যয় না করে ভোগ ও পানাহারের অনুমোদন দিয়েছেন এবং নিজেদের ইচ্ছেমতো ইসলামের বৈধ বিষয়াবলিকে অবৈধ করার ব্যাপারে সতর্ক করছেন। পাশাপাশি আল্লাহ তায়ালা বান্দার মধ্যে তার প্রদত্ত নিয়ামতের প্রতিফলন দেখতে পছন্দ করেন বলে ঘোষণা দেয়ার পাশাপাশি আরো কিছু আনুষঙ্গিক বিষয়ের প্রতি আলোকপাত করেন। ইসলামী অর্থনীতিতে ভোগের পরিধি নির্ধারণ করে দেওয়া থাকলেও পোশাক-পরিচ্ছদ, অলংকার, খাওয়া ও পানাহারকে উৎসাহিত করার মধ্য দিয়ে ইসলাম বৈরাগ্যবাদের নীতিকে অগ্রাহ্য করে। ইসলামের এ নীতির ফলে ইসলামী সমাজে উৎপাদন, বিপণন ও আল্লাহর নির্দেশের যথাযথ অনুসরণের মাধ্যমে একটি সুন্দর জীবন পরিচালনা করাকে ইসলাম গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তবে এক্ষেত্রে অবৈধ ভোগ ও অপ্রয়োজনীয় পানাহার থেকে দূরে থাকতে স্পষ্ট আদেশ দেয়া আছে, যেটিকে কুরআনের ভাষায় ‘ইসরাফ’ বলা হয়ে থাকে। এবং এটি ব্যক্তিগত ও সামাজিক সব ক্ষেত্রেই বাস্তবায়নের তাগিদ দেওয়া হয়েছে। সামাজিক ক্ষেত্রে সরকারের পরিকল্পনা, আমদানি-রফতানি, উৎপাদন ও বণ্টননীতি এমনভাবে প্রণয়ন করতে হবে যাতে এসবের আলোকে কোনো ধরনের ‘ইসরাফ’ উৎসাহিত না হয়। আর তাই কনজিউমারিজমকে ইসলামী নীতি হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। এতে মানুষ অতিরিক্ত বস্তুবাদের প্রতি ঝুঁকে পড়ে আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাকে প্রবল করে তোলে। এক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা নীতিই হবে ইসলামী অর্থনীতির নীতিপ্রণয়নের মানদণ্ড। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিলাসী প্রকল্প গ্রহণের মানসিকতা বাদ দিয়ে বরং দারিদ্র্য বিমোচন ও দুর্বলদের পুনর্বাসনের বিষয়টি অগ্রাধিকার দেয়াই এই আয়াতের মূল দাবি, তাতে মানুষের ওপর আরোপিত অপ্রয়োজনীয় করের বোঝাও অনেকাংশে কমে আসবে। আয়াতগুলোর মধ্যেই ইসলামী অর্থনীতিতে ‘পবিত্রতা’র গুরুত্ব স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। কারণ ইসলামী অর্থনীতিতে অপবিত্র, অস্বাস্থ্যকর কিংবা অকল্যাণকর কোনো কিছুরই যেমন জায়গা নেই, ঠিক তেমনি শরিয়ত প্রদত্ত বৈধ কোনো কিছুকে অবৈধ করারও কারো অধিকার নেই। এটিই ইসলামী অর্থনীতির মূল্যবোধ ও নীতি।
সূরা তাওবার ২৪ নম্বর আয়াতেও ইসলামী অর্থনীতির ধারণা পরিষ্কার করার চেষ্টা করা হয়েছে। যেখানে ঈমানের পথকে পরিহার করে বাবা-মা, সন্তান-সন্ততি, স্বামী বা অন্যান্য আত্মীয়স্বজন, সহায়সম্পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং নিজেদের বাসস্থানের গুরুত্বকে জিহাদের চেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়, সেটিকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। কারণ আল্লাহর পথে জিহাদ উপরোল্লিখিত সব কাজ থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনীতির গুরুত্বকে ইসলাম স্বীকার করলেও সেই অর্থনৈতিক কার্যক্রম যাতে আল্লাহ ও রাসূলের থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ না হয় সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সতর্ক থাকার ব্যাপারে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। অর্থসম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্য কোনো কিছ্ইু যাতে আল্লাহ ও রাসূলের নির্ধারিত আইন, বিধান, সীমা ও নির্দেশনার গণ্ডি অতিক্রম না করে। সম্পদের ভোগ, ব্যবহার, উন্নয়ন, বিনিময় ও ব্যয় সবকিছুই যাতে আল্লাহ ও রাসূলের প্রদর্শিত বিধানের আলোকে বাস্তবায়িত হয় সে বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। অর্থনীতি বিষয়ক যেকোনো আইন প্রণয়ন, পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অবশ্যই নীতিনির্ধারকদের এ বিষয়গুলো অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিবেচনা করতে হবে, এর ব্যত্যয় হলে কুরআনের আলোকে তারা আল্লাহর শাস্তির উপযুক্ত হবেন। জিহাদের সঙ্গে অর্থনীতির সামঞ্জস্যতার বিধানের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক নীতিকে এ আয়াত স্পষ্ট করে জিহাদের সময় অর্থনৈতিক বিন্যাসের দৃষ্টিভঙ্গি এখানে তুলে ধরা হয়েছে। জিহাদের প্রয়োজনে মুমিন তার অর্থনৈতিক স্বার্থকে পরিহার করার মানসিকতা পোষণ করবে এবং সম্পদের প্রতি ভালোবাসা কাউকে জিহাদ থেকে বিরত রাখতে পারে না এ নীতিই এ আয়াত প্রমাণ করে। এটি ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে যেমনটি প্রযোজ্য ঠিক তেমনি রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রেও। ইসলামী রাষ্ট্র ও কখনো কখনো জিহাদের প্রয়োজনে অর্থনৈতিক লোকসানের মানসিকতা পোষণ করতে হবে এটিই আয়াতের দাবি। কিংবা জিহাদের সময় পরিস্থিতির আলোকে রাষ্ট্র তার অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলোকে ঢেলেও সাজাবে, যাতে সফলতার সঙ্গে জিহাদ পরিচালনা করা যায়।’ অর্থনৈতিক মুক্তির এই জিহাদের তাৎপর্য আমেরিকা ও পাশ্চাত্য অস্বীকার করলে পরিণতি কি হতে পারে সে সম্পর্কে বিখ্যাত সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট-এর উল্লিখিত পূর্বাভাসটি তুলে ধরে নিবন্ধের ইতি টানছি, ‘সমস্যা হলো যে মন্দার প্রভাব কম হলেও ভঙ্গুরতা প্রকাশ করবে। কারণ হচ্ছে ইউক্রেন আগ্রাসনের ফলে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে পণ্যের মূল্য বেড়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে এশিয়া পর্যন্ত দেশগুলোর তীব্র খাদ্যসঙ্কট এবং জ্বালানি তেলের দামে ঊর্ধ্বগতি সঙ্কট তৈরি করেছে। রাশিয়ার গ্যাস ও তেলের কারণে ইউরো জোন একটি বড় ধাক্কা মোকাবিলা করছে। বিশ্বজুড়ে পারিবারিক আয় প্রকৃত অর্থে ধসে পড়ছে। আমেরিকান মন্দা তাদের রফতানির চাহিদা কমিয়ে বিশ্ব অর্থনীতির দুর্বল অংশগুলোতে আরেকটি আঘাত হানবে। ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের কঠোর নীতির কারণে ১৯৯৪ সালের পর ডলারের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এরই মধ্যে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। আইএমএফ বলছে যে প্রায় ৬০ শতাংশ দরিদ্র দেশ ঋণসঙ্কটে ভুগছে, বা উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। একটি চূড়ান্ত ভঙ্গুরতা হলো আমেরিকার অতি-দলীয় রাজনীতি। একটি মন্দা ২০২৪ সালের শেষের দিকে আঘাত হানতে পারে যা আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকেও প্রভাবিত করবে। যদি আমেরিকার অর্থনীতি পরের বছর বা দুই বছরে সংকুচিত হয়, তবে এটি দেশের দীর্ঘমেয়াদি দিক পরিবর্তন করতে পারে। একটি মন্দার সর্বোত্তম প্রতিক্রিয়া যার সময় মুদ্রাস্ফীতি উচ্চ থাকে তা হবে প্রবৃদ্ধির পক্ষে সংস্কার। যেমন নিম্ন শুল্ক এবং প্রতিযোগিতার পরিবেশ। ফলে মন্দা জনতাবাদ ও সুরক্ষাবাদকে ইন্ধন দিতে পারে এবং এমনকি সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পুনরায় পদে ফিরিয়ে দিতে পারে। বিগত চারটি মন্দার মধ্যে তিনটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। দেখা গেছে যে, প্রতিবারই হোয়াইট হাউজ নিয়ন্ত্রণকারী দল ক্ষমতা হারিয়েছে।’
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক
আপনার মন্তব্য লিখুন