post

বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ভূমিকা

প্রফেসর তোহুর আহমদ হিলালী

মানুষে মানুষে ভেদাভেদ বা বৈষম্য সুদূর অতীত থেকে চলে এসেছে। এই বৈষম্য সংকীর্ণ জাতীয়তা ছাড়াও ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-লিঙ্গ নানাভাবে সৃষ্টি হয়েছে। বৈষম্যের ফলে মানুষে মানুষে আশরাফ-আতরাফ (শ্রেষ্ঠ-নিকৃষ্ট) ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে। এই বৈষম্য স্রেফ জন্মগত যাতে স্রষ্টার ইচ্ছা ছাড়া মানুষের কোনো হাত নেই। এমন অবস্থায় মনে করা হয়, একজন ইংরেজ বা আমেরিকান বা আরব বা শ্বেতাঙ্গ অতএব সে শ্রেষ্ঠ পক্ষান্তরে একজন আফ্রিকান, উপজাতি বা কৃষ্ণাঙ্গ অতএব সে নিকৃষ্ট। জন্মের ভিত্তিতে উত্তম-অনুত্তম বৈষম্য না রেখে মহান আল্লাহপাক স্পষ্ট করেছেন, মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব হলো তার নৈতিক মান ও চরিত্রে। চরিত্রের দিক দিয়ে যে উত্তম সেই উত্তম। আমাদের ¯্রষ্টা ও মালিক মহান আল্লাহ মানুষের তৈরি সকল বৈষম্যের মূলোৎপাটন করে ঘোষণা করেছেন, সমগ্র মানবজাতি একই উৎস থেকে সৃষ্টি হয়েছে। দেশভিত্তিক জাতীয়তা বা ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-লিঙ্গ সবকিছু মিলে একটিই পরিচিতি এবং সেটি হলো মানবজাতি। আল্লাহর বাণী, “হে মানবজাতি, আমি তোমাদের একজন পুরুষ এবং একজন নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। তারপর তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে দিয়েছি যাতে তোমরা পরস্পরকে চিনতে পারো। তোমাদের মধ্যে যে অধিক মুত্তাকি সেই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কাছে অধিক মর্যাদার অধিকারী। নিশ্চয়ই আল্লাহ মহাজ্ঞানী ও সবকিছু সম্পর্কে অবহিত।” (সূরা হুজুরাত : ১৩) 

আমরা সবাই বাবা আদম ও মা হাওয়ার বংশধর এবং পরস্পরের ভাই। আমাদের যে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী বাঙালি-অবাঙালি (ভাষা), বাংলাদেশী-ভারতীয়-পাকিস্তানি-ইরানি (ভূখণ্ডগত জাতীয়তা), হিন্দু-মুসলিম (ধর্ম), নারী-পুরুষ (লিঙ্গ), শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ (বর্ণ)- এই বিভক্তি স্রেফ পরিচিতি। এই পরিচিতি দ্বারা একে অপর অপেক্ষা বড় বা ছোট নয় বা মর্যাদার মাপকাঠিও নয়। আল্লাহপাকের কাছে মর্যাদাবান সেই যে বেশি নীতিবান অর্থাৎ যে বেশি আল্লাহকে ভয় করে। স্কুলজীবনে একটি কবিতা আমাদের পাঠ্য ছিল। মানবতাবাদী কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা কবিতাটির নাম ‘মানুষ জাতি’। সেই কবিতার প্রথম দুটি লাইন-

‘‘জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে 

সে জাতির নাম মানুষ জাতি’’

এ ছাড়া আরো দুটি লাইন যা আমাদের প্রায়ই ব্যাখ্যা বা ভাবসম্প্রসারণ হিসেবে প্রশ্ন হতো-

‘‘কালো আর ধলো সে বাহিরে কেবল

ভেতরে সবারই সমান রাঙা।’’

এই কবিতার মধ্য দিয়ে মানুষে মানুষে যে ভেদাভেদ ও আশরাফ-আতরাফের ধারণা তা ভেঙে দিয়ে বলা হয়েছে জগতে রয়েছে একটিই জাতি সেটি হলো মানুষ জাতি। মহান আল্লাহপাকের ঘোষণারই প্রতিধ্বনিত হয়েছে এই কবিতায়।

ইসলাম আল্লাহপাক প্রদত্ত এক পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। মানুষের জীবনের ব্যাপকতা যতখানি ইসলামও ততখানি বিস্তৃত। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সকল ক্ষেত্রে ইসলামের বক্তব্য সুস্পষ্ট। কোথাও একদেশদর্শিতা নেই। আবার ইসলামে কোনো বৈষম্যও নেই। নারী-পুরুষ, ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, মুসলিম-অমুসলিম সকলের স্বার্থ ও নিরাপত্তা সংরক্ষিত রয়েছে। এক কথায় বলা যায় শ্রেণী, বর্ণ, গোষ্ঠী, ধর্ম নির্বিশেষে সকলের স্বার্থসংরক্ষণকারী একটি ভারসাম্যপূর্ণ জীবনাদর্শই হলো ইসলাম। আল্লাহপাক সকলের ¯্রষ্টা (খালেক), লালন-পালনকারী (রব), শাসক (মালিক) এবং তাকে কেউ মানুক আর না মানুক সকলের প্রয়োজন তিনি পূরণ করে যাচ্ছেন। তাঁর প্রদত্ত বিধানেই সম্ভব সকলের স্বার্থ সংরক্ষণ। যেমন আল্লাহর সৃষ্টি চন্দ্র-সূর্য, বাতাস, পানি সবারই প্রয়োজন পূরণ করছে। কোনো বৈষম্য নেই। 

মানুষ আল্লাহপাকের বড় প্রিয়, বড় আদরের সৃষ্টি; সকল সৃষ্টির সেরা তাঁরই প্রতিনিধি। এই পৃথিবীর বুকে সুন্দর জীবন-যাপনের লক্ষ্যে মানুষকে জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন করার পরও আল্লাহপাক তাকে হেদায়াত দান করেছেন। পৃথিবীতে আসার সময়ে আদি পিতা হযরত আদম (আ) ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁকে অভয়বাণী শোনানো হয়েছিল, “আমরা বললাম, তোমরা সবাই এখান থেকে নেমে যাও। এরপর যখন আমার পক্ষ থেকে কোনো হেদায়াত তোমাদের কাছে পৌঁছবে তখন যারা আমার সেসব হেদায়াত অনুসরণ করবে তাদের কোনো ভয় ও দুঃখ থাকবে না।” (সূরা বাকারা ৩৮) তাঁর প্রতিশ্রুতি মোতাবেক প্রতিটি যুগে প্রতিটি জনপদে অসংখ্য নবী-রাসূল এসেছেন এবং সেই ধারা মোতাবেক সর্বশেষ নবী ও রাসূল হলেন আমাদের প্রিয়তম নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

মহানবী (সা)-এর আগমনকালকে অন্ধকার যুগ বলা হয়। মানুষ ছিল নানাভাবে বিভক্ত এবং দুর্বলের ওপর সবলের ছিল অত্যাচার ও জুলুম-নির্যাতন। সম্মান ও মর্যাদাগতভাবে মনিব ও দাস, নারী ও পুরুষ বিভক্ত হওয়ার পাশাপাশি ছিল বংশীয় কৌলীন্য এবং দেশে দেশে হিংসা-বিদ্বেষ ও রাজ্যজয়ের প্রতিযোগিতা। এমনি একটি পরিবেশে মুহাম্মদ (সা) কোনো শ্রেণী বা পেশার মানুষকে উসকিয়ে না দিয়ে বা সমাজের কোনো সমস্যাকে পুঁজি করে একে অপরের বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম না করে সমগ্র মানবজাতিকে উদ্দেশ্য করে উদাত্ত কণ্ঠে আহবান জানিয়েছিলেন, “হে দুনিয়ার মানুষ! তোমরা সকলে মিলে বলো, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, তাহলেই তোমরা সফলকাম হবে।” মানবচরিত্রে ভালো বলে স্বীকৃত সকল সৎ গুণাবলির সমাবেশ ঘটেছিল তাঁর জীবনে এবং নবী হওয়ার পূর্বেই তিনি ছিলেন তাঁর জাতির একজন আস্থাভাজন ও বিশ^স্ত; তাদের বিবাদ-বিসংবাদের মীমাংসাকারী ও আমানত সংরক্ষণকারী আল-আমিন ও আস-সাদিক। এত কিছুর পরও তাঁর জাতি এই চিরন্তন সত্য বাণী মেনে নিতে পারেনি এবং প্রচণ্ড বিরোধিতার মধ্য দিয়ে রাসূল (সা)-এর আহ্বানের জবাব দেয়। 

বাধা-বিপত্তির মধ্যেও কিছু সংখ্যক সত্যনিষ্ঠ নারী ও পুরুষ, দাস ও মনিব, ধনী ও দরিদ্র তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইসলাম কবুল করেন এবং এক পর্যায়ে আল্লাহপাক তাঁর মাধ্যমে দ্বীনকে বিজয়ী করেন। তিনি সমাজের অবহেলিত অংশ নারী, দাস ও দরিদ্রদের প্রতি সদয় ছিলেন কিন্তু তিনি পুরুষবিদ্বেষী বা ধনীবিদ্বেষী ছিলেন না বা সমাজে কোনো ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়াননি। সমাজে সকল শ্রেণী ও পেশার মধ্যে তিনি ভারসাম্য নিয়ে এসেছেন। তিনি বিলালের মতো দাসের সাথে উসমান গনির মতো ধনাঢ্য ব্যক্তিকে গভীর ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন। ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র বা বংশীয় শ্রেষ্ঠত্ব সব পার্থক্য দূর করে মানবজাতিকে এক কাতারে নিয়ে এসেছিলেন। বর্ণ, ভাষা, লিঙ্গ, পেশা, বংশভেদে মানুষে মানুষে সকল বৈষম্য অস্বীকার করে তিনি ঘোষণা করেন, “তোমাদের মধ্যে একে অপরের ওপর কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই, নেই অনারবের উপর আরবের বরং ঐ ব্যক্তিই শ্রেষ্ঠ যে আল্লাহকে বেশি ভয় করে বা যে চরিত্রের দিক দিয়ে উত্তম।”

ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র সকল ক্ষেত্রে মহানবী (সা)-এর জীবন ছিল ভারসাম্যপূর্ণ। তাঁর খানাপিনা, পরিচ্ছন্নতা, স্ত্রী ও সন্তানদের সাথে ব্যবহার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় দায়-দায়িত্ব পালনে কখনো কোনো অবহেলা বা বিশেষ ব্যাপারে ঝুঁকে পড়েননি। সকলের অধিকার আদায়ে ছিলেন যত্নশীল। আল্লাহর হক ও বান্দার হক পালনে কখনই শৈথিল্য প্রদর্শন করেননি। ইসলাম পূর্ণাঙ্গ দ্বীন এবং সেই দীনের রূপকার ছিলেন প্রিয়তম নবী মুহাম্মদ (সা)। তিনি ছিলেন সমগ্র মানবজাতির আদর্শ। একজন আদর্শ স্বামী ও গৃহকর্তা, আদর্শ পিতা, সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্ণধার। সকল শ্রেণী, পেশা ও বয়সভেদে তিনি সবারই আদর্শ এবং সবারই অনুপ্রেরণা। তিনি তাঁর পূর্ণ যৌবনকাল একজন বয়স্কা স্ত্রীর সাথে কাটিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে নানা অবস্থার প্রেক্ষিতে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করেছেন এবং সেখানে অতি বৃদ্ধা থেকে কুমারীও ছিলেন। স্বামী হিসেবে সকল স্ত্রীর প্রতি সুবিচার করেছেন এবং কারো প্রতি ঝুঁকে পড়ে অন্যদের অধিকার হরণ করেননি।

রাসূল (সা)-এর সমগ্র জীবন তাঁর উম্মতদের জন্য অনুসরণীয় এবং তাঁর মাধ্যমে আল্লাহপাক তাঁর দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দান করেছেন। আল্লাহপাক মানার ক্ষেত্রে তাঁর বান্দাদের জন্য দ্বীন সহজ করে দিয়েছেন। তাঁর বাণী, “আল্লাহ কাউকে তার সাধ্যের অতিরিক্ত বোঝা চাপাননি।” রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর উম্মতদের মধ্যমপন্থা অবলম্বনের তাগিদ দিয়েছেন। বাড়াবাড়ি তিনি অপছন্দ করতেন। হিংসা-বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকার আহবান জানিয়েছেন এবং বলেছেন, “আগুন যেমন শুকনা কাঠকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয়, হিংসা তেমনি মানুষের নেক আমল ধ্বংস করে দেয়।” হিংসা-বিদ্বেষের কারণেই সমাজে যতো অশান্তি ও হানাহানি। রাসূলুল্লাহ (সা)-এর হাতে গড়া সমাজে সকল মানুষের সহাবস্থান ছিল এবং সেই সমাজ ছিল শান্তি ও নিরাপত্তার। তাঁর সমাজে কেউ অপরাধ করলে তার সামাজিক পরিচিতি বা মর্যাদা বিবেচনা করা হতো না এবং এ ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য ছিল স্পষ্ট- ‘আমার মেয়ে ফাতিমাও যদি চুরির অপরাধে অপরাধী হন, তাহলে আমি তার হাত কেটে দেবো।’ আইনের শাসন বলতে যা বোঝায় জগৎবাসী রাসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রতিষ্ঠিত সমাজে সেটিই প্রথম লক্ষ্য করেছে। পরবর্তীতে খলিফা ওমর (রা) তাঁর ছেলেকে শাস্তিদানের ক্ষেত্রে একটুও কুণ্ঠা প্রকাশ করেননি। আবার আলী (রা) বর্মচুরির ঘটনায় কাজীর দরবারে এক ইহুদির বিরুদ্ধে মামলা রুজু করলে কাজী গ্রহণযোগ্য সাক্ষী না থাকায় ইহুদির পক্ষে রায় দেন। সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ও কল্যাণকর এবং ভারসাম্যপূর্ণ জীবনব্যবস্থা বিশ্ববাসীর কাছে প্রথম উপস্থাপন করেন মুহাম্মদ (সা)।

এ দেশের মানুষ ছিল অধিকার বঞ্চিত। গণতন্ত্রে ভোটাধিকার দেশের নাগরিকদের একটি মৌলিক অধিকার। যে কেয়ারটেকার সরকারের জন্য সকল দল সম্মিলিতভাবে আন্দোলন-সংগ্রাম করে সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত করেছিল; দুর্ভাগ্য, আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হয়ে তাদের শাসনকে চিরস্থায়ী রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে আদালতের মাধ্যমে সংবিধান থেকে কেয়ারটেকার সরকারব্যবস্থা বাতিল করে। এর ফলে নির্বাচন ব্যবস্থা একেবারে ভেঙে পড়ে। ভোটারবিহীন সরকার গঠনের ফলে সরকার পুরোপুরি স্বৈরাচারে রূপ নেয় এবং দেশে ভয়াবহ গুম-খুন, আয়নাঘরে নিয়ে সীমাহীন নির্যাতনের মাধ্যমে ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি করে। আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মী এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে যারা আওয়ামী সমর্থক তারা শতশত কোটি টাকার মালিক হয়ে পড়ে। জাতির জন্য দুর্ভাগ্য, দেশে সুশাসন ও দুর্নীতি রোধ যাদের দায়িত্ব এমন দুটি বাহিনীর প্রধান সেনাপ্রধান ও পুলিশপ্রধান এবং সচিবসহ বিভিন্ন পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মতো একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ ওঠে। পিএসসি চেয়ারম্যানের ড্রাইভারকে আটক করার পর দেখা যায় সে কোটি কোটি টাকার মালিক। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমার পিয়নও চারশ কোটি টাকার মালিক এবং হেলিকপ্টার ছাড়া চলাফেরা করে না। পুলিশ প্রধান বেনজীর ও ডিবি প্রধান হারুনের বিরুদ্ধে হিন্দু সম্প্রদায়ের জমি ভয়ভীতি দেখিয়ে স্বল্পমূল্যে হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ ওঠে। 

দেশের ব্যাংকব্যবস্থাকে মুষ্টিমেয় লোক ধ্বংস করে ফেলে। এস আলম গ্রুপ এককভাবে ইসলামী ব্যাংক থেকে ৭৫ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে বিদেশে পাচার করে এবং সালমান এফ রহমান জনতা ব্যাংক থেকে ২৭ হাজার কোটি টাকা উত্তোলন করে বিদেশে পাচার করে। সীমাহীন দুর্নীতির কারণে দেশে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য অনেক বেড়ে গেছে এবং আওয়ামী সরকার এ জাতির ঘাড়ে বিরাট অঙ্কের ঋণের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে। ২০০৯ সালে ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা যখন যখন দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন মোট ঋণ ছিল দুই লাখ ৭৬ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা। বর্তমানে ঋণ ১৮ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সুদ পরিশোধের জন্য বরাদ্দ ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এই ঋণের দায় ধনী-দরিদ্র সবার। অথচ মেগা প্রকল্পে মেগা দুর্নীতির টাকা শেখ হাসিনা, তার পরিবার ও দলীয় লোকদের পকেট ভারী করেছে। সমাজে সীমাহীন জুলুম-নির্যাতন চলতে থাকলে এবং মজলুমের প্রতিবাদ-প্রতিরোধের ক্ষমতা জালেম ধ্বংস করে দিলে আল্লাহ তায়ালার দায়িত্ব হয়ে পড়ে মজলুমের পক্ষ অবলম্বন করা। তাঁর বাণী, “আমি সঙ্কল্প করেছিলাম, পৃথিবীতে যাদের লাঞ্ছিত করে রাখা হয়েছিল তাদের প্রতি অনুগ্রহ করবো, তাদের নেতৃত্ব দান করবো, তাদের উত্তরাধিকার করবো এবং পৃথিবীতে তাদের কর্তৃত্ব দান করবো।” (সূরা ক্বাসাস ৫-৬) আল্লাহর বাণীই সত্যে পরিণত হয়েছে। মাত্র কয়দিনের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ফলে স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে এবং মানুষ মুক্তির স্বাদ লাভ করে। এ এক আল্লাহপাকের নিদর্শন বৈ আর কিছু নয়।

ছাত্র-জনতার এ বিজয়ের মধ্য দিয়ে ইসলাম কায়েমের পথকে আল্লাহ তায়ালা প্রশস্ত করে দিয়েছেন। আল্লাহর দেওয়া এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এখন প্রয়োজন ইসলামপন্থী সকলের ঐক্য এবং ব্যাপকভাবে মানুষের কাছে দাওয়াত পৌঁছে দেওয়া। এই দাওয়াত হতে হবে জনকল্যাণমূলক কাজের মধ্য দিয়ে। ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-ভাষা নির্বিশেষে মানুষকে সম্মান প্রদান, তাদের কল্যাণ সাধন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা)-এরই নির্দেশ। আল্লাহপাকের বাণী, “তোমরা সর্বোত্তম দল। তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে মানব জাতির কল্যাণ সাধনের জন্য। তোমরা ভালো কাজের আদেশ করবে এবং মন্দ কাজে নিষেধ করবে।” (সূরা আলে ইমরান ১১০) ইসলামী রাষ্ট্র বলতে বোঝায় কল্যাণমূলক সমাজ, এক ইনসাফপূর্ণ সমাজ যেখানে কোনো বৈষম্য থাকবে না, থাকবে না শোষণ-বঞ্চনা। প্রতি জুমায় খতিব মহোদয় তেলাওয়াত করেন, “আল্লাহ ন্যায়-নীতি, পরোপকার ও আত্মীয়-স্বজনদের দান করার হুকুম দেন এবং অশ্লীল-নির্লজ্জতা ও দুষ্কৃতি এবং অত্যাচার-বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন, যাতে তোমরা শিক্ষালাভ করতে পারো।” (সূরা নহল ৯০) 

তিনি আরো বলেন, “হে ঈমানদারগণ! ইনসাফের পতাকাবাহী ও আল্লাহর সাক্ষী হয়ে যাও, তোমাদের ইনসাফ ও সাক্ষ্য তোমাদের নিজেদের ব্যক্তিসত্তার অথবা তোমাদের বাবা-মা ও আত্মীয়-স্বজনদের বিরুদ্ধে গেলেও। উভয় পক্ষ ধনী বা অভাবী যাই হোক না কেন আল্লাহ তাদের চাইতে অনেক বেশি কল্যাণকামী। কাজেই নিজেদের কামনার বশবর্তী হয়ে ইনসাফ থেকে বিরত থেকো না। আর যদি তোমরা পেঁচালো কথা বলো অথবা সত্যতাকে পাশ কাটিয়ে চলো, তাহলে জেনে রাখো, তোমরা যা কিছু করছো আল্লাহ তার খবর রাখেন।” (সূরা নিসা ১৩৫) ইনসাফ ও সুবিচারের কথা বারবার উচ্চারিত হয়েছে, “হে ঈমানদারগণ! সত্যের ওপর স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত ও ইনসাফের সাক্ষ্যদাতা হয়ে যাও। কোনো দলের শত্রুতা তোমাদের যেন এমন উত্তেজিত না করে দেয়, যার ফলে তোমরা ইনসাফ থেকে সরে যাও। ইনসাফ ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠিত করো। এটা আল্লাহভীতির সাথে বেশি সামঞ্জস্যশীল। আল্লাহকে ভয় করে কাজ করতে থাকো। তোমরা যা কিছু করো আল্লাহ সে সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত আছেন।” (সূরা মায়েদা ৮)

বিচার-মীমাংসার ক্ষেত্রেও ইনসাফের পরিচয় দিতে হবে। আল্লাহর বাণী, “আর মীমাংসা করে দিলে যথার্থ ইনসাফসহ মীমাংসা করো। কারণ আল্লাহ ইনসাফকারীদের পছন্দ করেন।” (সূরা মায়েদা ৪২) প্রতিশোধপরায়ণ নয়, শাসককে হতে হবে ন্যায়পরায়ণ এবং সকলের সাথে ইনসাফপূর্ণ ব্যবহার করতে হবে। ইনসাফকারী শাসকের মর্যাদা আল্লাহর কাছে অতি উচ্চে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “হাশরের ময়দানে যখন আল্লাহর আরশের ছায়া ছাড়া আর কোনো আশ্রয় থাকবে না সেই কঠিন মুহূর্তে আরশের ছায়ার নিচে আশ্রয়প্রাপ্তদের মধ্যে অন্যতম হবেন ন্যায়পরায়ণ শাসক ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠাকারী বিচারক।” আবার তিনি হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করেন এই বলে “যে শাসক জালেম ও খেয়ানতকারী হিসেবে মৃত্যুবরণ করবে, আল্লাহ অবশ্যই তার জন্য জান্নাত হারাম করে দিবেন।” তিনি বলেন, “যে বিচারক সত্যকে জানতে পেরেও ফায়সালা করার ব্যাপারে অবিচার ও জুলুম করেছে, সে জাহান্নামে যাবে। আর যে অজ্ঞতা সত্ত্বেও জনগণের জন্য বিচার ফয়সালা করেছে সেও জাহান্নামি হবে।”

ইসলামী রাষ্ট্রে মানুষের সম্মান ও মর্যাদা অতি উচ্চে কারণ মানুষ ০তো আল্লাহর খলিফা। মানুষের সঙ্গে ভালো ব্যবহার অর্থ আল্লাহর সাথেই ভালো ব্যবহার এবং মানুষের সাথে দুর্ব্যবহার অর্থ আল্লাহর সাথেই দুর্ব্যবহার। মানুষের ধনমাল, জীবন ও সম্মান অত্যন্ত পবিত্র। কোনোভাবেই ক্ষুণ্ন করা যাবে না। আল্লাহপাকের বাণী, “নিশ্চিত ধ্বংস তাদের জন্য যারা মানুষকে সামনা-সামনি গালাগাল ও পেছনে দোষ প্রচার করে।” (সূরা হুমাজা) একটু গালাগাল ও পেছনে দোষ প্রচার (গিবত) করার পরিণতি যদি নিশ্চিত ধ্বংস (হুতামা) হয় তাহলে গুম-খুন ও আয়নাঘরে রেখে শাস্তিদানের পরিণতি কী হতে পারে? ইসলাম মানুষকে সম্মান দান করেছে এবং তার দোষ-ত্রুটি আঁতিপাতি করে খোঁজা, তাকে হেয় করা, তার গিবত করা সবই হারাম। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর বাণী, “হে ঈমানদারগণ! বেশি ধারণা ও অনুমান করা থেকে বিরত থাকো, কারণ কোনো কোনো ধারণা ও অনুমান গুনাহ। দোষ অন্বেষণ করো না। আর তোমাদের কেউ যেন কারো গিবত না করে। এমন কেউ কি তোমাদের মধ্যে আছে, যে তার নিজের মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করবে? দেখো, তা খেতে তোমাদের ঘৃণা হয়। আল্লাহকে ভয় করো। আল্লাহ অধিক পরিমাণে তওবা কবুলকারী এবং দয়ালু।” (সূরা হুজুরাত ১২)

এই পৃথিবীতে বৈষম্যহীন ও সকল মানুষের জন্য সমভাবে কল্যাণকর জীবনব্যবস্থা হলো ইসলাম যা মহান আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত এবং তাঁর মনোনীত নবী ও রাসূল মুহাম্মদ (সা) নিজে বাস্তবায়ন করে জগদ্বাসীর জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছেন। আল্লাহপাক নবী মুহাম্মদ (সা) প্রদর্শিত পথে চলার তৌফিক বিশ্ববাসীকে দান করুন। আমিন। 

লেখক : উপাধ্যক্ষ (অব), কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ

আপনার মন্তব্য লিখুন

কপিরাইট © বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির